বাড়ির খবর
সকালবেলা বাইরের কোনো লোক এলে দরজা খোলার দায়িত্ব আমার। দাদা এখন অবশ্য অফিসের কাজে দিল্লি গেছে, কিন্তু যখন কলকাতায় থাকেও, তখনও প্রতিদিন সকাল নটা পর্যন্ত নিজের বেডরুমের বাদশা। বিছানা থেকেই নামবে না, শুয়ে শুয়ে তিন-চার কাপ চা খাবে, নানা রকম হুকুম চালাবে আর খবরের কাগজখানা এমনভাবে মুখস্থ করবে যেন অফিসে গেলেই কেউ পড়া ধরবে তার দাদা কোনোদিন বাজারে যায় না, আলুর দাম বছরের কোন্ কোন্ সময় কমে কিংবা বাড়ে, সে খবর রাখে না। দুধ আনা, পাঁউরুটি আনা, এমনকি রান্নাঘরে দেশলাই ফুরিয়ে গেলে দৌড়ে গিয়ে কিনে নিয়ে আসা, এসব কাজ বোধহয় আমি ঠিক জন্মের পর থেকেই করে আসছি, দাদাকে কেউ কখনো অনুরোধ জানাতেও সাহস করে না। বৌদি ভোরবেলা ইস্কুলে চলে যায়। মা বাথরুম, রান্নাঘর আর পুজোর জায়গার মধ্যে কখন যে কোথায় থাকেন তার ঠিক নেই।
ডিমওয়ালা, জমাদার, চাঁদা চাইবার ছেলেরা, সাবানের সেল্সম্যান, ভোটের লোকজন, ধর্মীয় ভিখিরি, পুরোনো খবরের কাগজওয়ালা এরা যে-যখন এসে দরজায় ঠকঠক করবে, অমনি আমাকেই গিয়ে খুলতে হবে। অনেক সময় আমি জমাদারকে বলে ফেলি, এখন চাঁদা হবে না! ধর্মীয় ভিখিরিকে বলি, ডিম চাই না, ডিম চাই না। আর ভোটের লোকদের বলি, বাথরুম সাফ করোনি কেন?
দরজা খোলার পর এক সৌম্যদর্শন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক একগাল হেসে, হাত জোড় করে বললেন, নমস্কার, নীলুবাবু, নমস্কার। সব খবর ভালো তো!
ভদ্রলোককে একটু চেনা চেনা মনে হলেও কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছি না। নাম সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তবে ভদ্রলোকের ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা গেল, একে দু’চার কথায় উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, ভেতরে এনে বসাতে, হবে, উনি সে-রকমই আশা করছেন।
দরজার আধখানা খুলেছিলাম, এবার দু’পাল্লা খুলে, একটু সরে দাঁড়িয়ে আমি বললাম, আসুন, আসুন!
ভদ্রলোক ভেতরে পা দিয়ে চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে লাগলেন। দেওয়াল, প্লাগ পয়েন্ট, জানলা, শিলিং-এর কাছে ঝুল জমা, এই সব। আমি তাঁকে এনে বসালুম আমার ঘরে। আমাদের ফ্ল্যাটে আলাদা কোনো বসবার ঘর নেই। কিংবা বলা যেতে পারে, বসবার ঘরেরই এক পাশে আমি খাট পেতে শুই। দাদার বন্ধুরা এলে আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। আত্মীয়-স্বজনরা এলে আমি বাথরুমে সময় কাটাই।
চেয়ারে বসবার আগে ভদ্রলোক দেয়ালের একটা প্লাস্টার খসা জায়গায় দুটো টোকা দিলেন। ঝুরঝুর করে আরও একটু বালি খসে পড়ল। তিনি বেশ সন্তুষ্ট ভাবে মাথা নাড়লেন।
পায়ের ওপর পা তুলে বললেন, তারপর, কী খবর-টবর?
এখনো চিনতে পারছি না, তাই ভাসা ভাসা ভাবে বললুম, ভালো! বেশ ভালো!
ভদ্রলোক বললেন, বাঃ! আজকাল ভালো কথাটা প্রায় শোনাই যায় না। সবাই তো ভুরু কুঁচকে আছে। কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা যায়, কেমন আছেন? অমনি একগাদা অভাব-অভিযোগ আর দুর্দশার ফিরিস্তি শোনাবে! কী, ঠিক কি না!
ভদ্রলোক আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন আমাকে তাঁর সব কথা মেনে নিতেই হবে।
—আপনার দাদা আছেন? তাঁর সঙ্গে একটু দরকার ছিল!
এইবার সামান্য একটু ক্লু পাওয়া গেল। দাদার চেনা। ভদ্রলোক দাদার চেয়ে অনেক বড়, সুতরাং দাদার বন্ধু হতে পারেন না। অফিসের সহকর্মী? শ্বশুরবাড়ির কেউ?
–দাদা তো কলকাতার বাইরে। সোমবার ফিরবে!
—ও!
এ খবর শুনেও তাঁর বিশেষ ভাবান্তর হলো না। পকেট থেকে বার করলেন সোনালি রঙের সিগারেট কেস। সেটা খোলার পর একবার তাকালেন আমার দিকে। বোধহয় একবার ভাবলেন আমাকেও অফার করবেন কিনা। তারপর বোধহয় বুঝে গেলেন আমার মতন লোকের জন্য একটা দামী সিগারেট নষ্ট করার কোনো মানে হয় না, নিজে একটা তুলে ঠোটে গুঁজলেন। লাইটার দিয়ে জ্বেলে প্রথম এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে ওপরের দিক তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত।
তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, জানলার ধারে ওটা কি গাছ?
-কদম।
–বাঃ, বেশ বড় হয়েছে তো। এবার বর্ষায় ফুল এসেছিল?
এরপর আমার বলা উচিত, আপনি কে মশাই?
কিন্তু বলতে পারছি না। যদি বিশেষ চেনা কেউ হয়? বৌদির কোনো মাসতুতো দাদা-টাদা হলে তাঁকে না চেনাটা আমার অপরাধ বলে গণ্য হবে।
—আপনাকে কটার সময় অফিসে বেরুতে হয়, নীলুবাবু?
-আমার নিজের ব্যবসা, যখন খুশি গেলেই হয়!
–ও, আপনি আজকাল বিজনেস করছেন, বাঃ!
রবীন্দ্রনাথ নিজেকে ‘সাহিত্য ব্যবসায়ী’ বলেছেন। সেই অনুসারে আমিও আজকাল নিজেকে ‘ভ্রমণ ব্যবসায়ী’ বলতে শুরু করেছি। ভ্রমণটা বুঝি একটা কাজ না?
ভদ্রলোক আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মা আমাকে ডাকলেন বাইরে থেকে।
তা হলে নিশ্চয়ই গণ্যমান্য কেউই হবেন। মা চা খাওয়াতে চাইছেন। মা বললেন, অংশুবাবু নিজে থেকে এসেছেন কেন রে?—তা তো আমি জানি না।
–তোর দাদা তো চেক লিখে রেখে গেছে। তুই দিয়ে আসিসনি?
ওঃ হো, এই ব্যাপার! ইনি আমাদের বাড়িওয়ালা! প্রত্যেক মাসের পয়লা তারিখে দাদা একটা চেক লিখে দেয়, আমি হরীশ মুখার্জি রোডে ওঁদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। সেখানে আমি অংশুবাবুকে কখনো দেখিনি। ওঁদের বাড়ির একতলায় একটা অফিস মতন আছে, চেকটা দিলেই একজন লোক রশিদ দিয়ে দেয়। বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করার কোনো প্রয়োজন হয় না।
বাড়িওয়ালা সম্পর্কে আমাদের পরিবারে প্রধান অভিযোগ, তিনি কক্ষনো আমাদের খোঁজখবর নিতে আসেন না। ছাদে জলের ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে একবার ছাদটা পুকুর হয়ে গিয়েছিল, তখনও বাড়িওয়ালার পক্ষ থেকে কেউ সাহায্য করতে. আসেনি।
আজ হঠাৎ সাতসকালে তিনি নিজে এসে উপস্থিত। আমি চেকটার কথা ভুলে গিয়েছিলুম, মোট পাঁচদিন দেরি হয়ে গেছে। লোকটা মহা কঞ্জুষ তো! দাদার ড্রয়ারে চেকটা পড়ে ছিল। সেটা নিয়ে এসে বিনীতভাবে বললাম, আমার খুব কাজ পড়ে গিয়েছিল, দিয়ে আসতে পারিনি, খুবই দুঃখিত, আপনাকে আসতে হলো।
অংশুবাবু উদারভাবে বললেন, না, না। তাতে কী হয়েছে! এমনিই এলাম খোঁজখবর নিতে। অনেকদিন তো আসা হয় না। আপনার মা কেমন আছেন?
—ভালোই আছেন। আপনি চা খাবেন?
—নাঃ। সকালে এক কাপ খাই, তার বেশি আমার সহ্য হয় না। আগে, মানে ভবানীপুরে নতুন বাড়িটা কেনার আগে, এই বাড়িটাতে আমরা নিজেরাই থাকতাম। এই যে এই ঘরটা, যেখানে এখন বসে আছি, এটা ছিল আমার পড়বার ঘর। কতদিন আসিনি এদিকে। এখন কি অবস্থা হয়েছে ঘরটার। ছাদ থেকে জল পড়ে?—তা পড়ে, বেশি বর্ষা হলে ঐ কোণটায় গামলা পেতে রাখতে হয়। আপনার চেকটা…
–থাক, থাক, ওটা আমার হাতে দেবার দরকার নেই।—আপনার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে? ঠিক আছে, আজই দুপুরবেলা…
–না, না, প্রত্যেক মাসে আপনি কষ্ট করে অতদূরে যাবেন কেন? থাক না ভাবছি ও টাকাটা আর নেব না!
–আপনি ভাড়া নেবেন না?
–ঐ সামান্য টাকা, নেওয়াও যা, না নেওয়াও তা! আপনারা সজ্জন, ভদ্রলোক, আপনারা বিনা ভাড়াতেই থাকুন না! কোনো অসুবিধে নেই। থাকুন, থাকুন!
—কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে কি, আমার দাদার মান-অপমান জ্ঞান বড্ড টনটনে।। দাদা তো বিনা ভাড়ায় থাকতে রাজি হবে না।
–দাদাকে জানাবেন না! টাকাটা আপনিও নিয়ে নিতে পারেন। নীলুবাবু, আপনি নতুন ব্যবসা করছেন, আপনার কাজে লেগে যেতে পারে। আপনার কী ব্যবসা?
—ভ্রমণ ব্যবসা!
—ভ্রমণ ব্যবসা? ওঃ হো, তার মানে ট্রাভেল এজেন্সি?
—এজেন্সিটা এখনো হয়নি। শুধু ট্রাভেল চলছে। কিন্তু অংশুবাবু, দাদা আপনার নামে চেক কাটবে। সে টাকা আমি ভাঙাবো কী করে?
—আমি ভাঙিয়ে দেব। কোনো চিন্তা নেই। দাদার কাছ থেকে চেকটা নিয়ে আপনি ছিঁড়ে ফেলবেন। আমি মাসে মাসে আপনাকে দুশো টাকা করে দিয়ে যাব!
—ভাড়ার রশিদ দেবেন?
–ভাড়া নেব না বলছি, অথচ রশিদ দেব, এ আবার কী অদ্ভুত কথা! ওটা যে বে-আইনি ব্যাপার হয়ে যায়। সত্যি কথা বলছি, আপনাদের কাছ থেকে ভাড়া নিতে আমার লজ্জা করে। কী দশা হয়েছে এ বাড়ির! ছাদ ফুটো, দেয়াল নোনা ধরা, জলের পাইপ নষ্ট হয়ে গেছে। এ রকম অবস্থায় আপনাদের রেখেছি, তার ওপরে আবার টাকা নেব? ছি ছি ছি! ছি ছি ছি, আমার কি বিবেক বলে কিছু নেই। অতটা চশমখোর আমি হতে পারি না। অথচ এখন এ বাড়ি সারানোর সাধ্যও আমার নেই। তাই তো বলছি, আপনারা বিনা ভাড়াতেই থাকুন।
–দাদা যে আমার কাছ থেকে ভাড়ার রশিদ দেখতে চাইবে? দাদার এসব কথা খুব মনে থাকে।
—আজ দিচ্ছি কাল দিচ্ছি বলে কাটিয়ে দেবেন। বলবেন, রশিদ হারিয়ে ফেলেছি। মাসে আপনি দুশো টাকা করে পাবেন, একটা কিছু বুদ্ধি বার করতে পারবেন না?
আমার চেয়ে দাদার বুদ্ধি অনেক বেশি। আচ্ছা অংশুবাবু, আমি আর একটা কথা শুনেছি। মাসের পর মাস ভাড়া না দিলে নাকি ভাড়াটেরা ডিফল্টার হয়ে যায়? তখন বাড়িওয়ালারা তাদের চট করে তুলে দিতে পারে।
-আরে রাম রাম! আমাকে সে-রকম লোক ভাবলেন? আপনার বাবাকে আমি চিনতাম। কত শ্রদ্ধা করতাম তাঁকে। আপনাদের সঙ্গে আমি সে-রকম ব্যবহার করতে পারি! মাসের পর মাস, তারপরের মাস, তার পরের মাসও আপনারা বিনা ভাড়ায় থাকুন না। আমি কিছু বলব না। আই প্রমিস। এইভাবে মাস ছয়েক কাটিয়ে দিন। তার মধ্যে অন্য জায়গায় একটা সুবিধে মতন বাড়ি খুঁজে বার করতে পারবেন না? ছ’মাসের আগে আমি টু শব্দও করব না, আমি আপনাকে ওয়ার্ড অফ অনার দিচ্ছি।! কী, নীলুবাবু, এটা খারাপ প্রস্তাব!
–না, না, আমার তো খুবই ভালো মনে হচ্ছে। ছ’মাস কি কম কথা? কিন্তু আমার দাদা গোঁয়ার ধরনের মানুষ। দাদা যদি মানতে না চায়? শুনেছি রেন্ট কন্ট্রোল বলে একটা ব্যাপার আছে। সেখানে নিয়মিত ভাড়ার টাকা জমা দিলে ভাড়াটেদের গায়ে আর কেউ হাত ছোঁয়াতে পারে না।
—দূর দূর, ওসব কত্ত পুরোনো ব্যাপার। আজকাল কেউ গ্রাহ্য করে না। অনেক বাড়িওয়ালা তখন জল বন্ধ করে দেয়, ইলেকট্রিক লাইন কেটে দেয়। ভাড়াটেদের উত্যক্ত করে মরে। সেসব বড় বিশ্রী ব্যাপার।
-অনেক ভাড়াটেও নাকি এমন গোঁয়ার হয় যে জল আলো বন্ধ করলে থানায় ডায়েরি করে। মামলা লাগিয়ে দেয়। সেই মামলা আট-দশ বছর চলে!
–সেসবেরও ওষুধ আছে, বুঝলেন নীলুবাবু। অনেক বাড়িওয়ালা তখন পাড়ার ছেলেদের হাত করে। দু’চারটে গুণ্ডা মতন ছেলেকে বশ করে বলে, লাগ ওদের পেছনে লাগ। পাড়ার ছেলেরা পেছনে লাগলে সে পাড়ায় আর কেউ বাস করতে পারে? তখন বাপ বাপ বলে পালায়।
—ভাড়াটেদেরও যদি দু’-একটি অল্পবয়েসী ছেলে থাকে, তখন পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে তাদের ভাব থাকে। মনে করুন, পাড়ার ক্লাবে ভাড়াটেদের একটা ছেলে মেম্বার। বাড়িওয়ালা থাকে অন্য পাড়ায়। এখন সেই বাড়িওয়ালা ঝঞ্ঝাট করতে এলে ক্লাবের ছেলেরা ভাড়াটেদেরই মরাল সাপোর্ট দেবে না? নিশ্চয়ই দেবে!
—সে-রকম ক্লাব-ফ্লাব আজকাল নেই, বুঝলেন নীলুবাবু। সব পলিটিক্স। সব জায়গায় পলিটিক্সের আখড়া। বুদ্ধিমান বাড়িওয়ালা কী করে জানেন? গোটা দু’এক পলিটিক্যাল পার্টিকে মাসে-মাসে চাঁদা দেয়। মনে করুন একজন ল্যাণ্ডলৰ্ড দুটো পলিটিক্যাল পার্টিকে প্রতি মাসে পাঁচশো করে টাকা দিতে লাগল। ভাড়াটেরা অত টাকা দিতে পারবে? টাকার জোর থাকলে মরাল সাপোর্ট-ফাপোর্ট ওসব কিছু না।
আমি একটু চুপ করে গেলাম। আমাকে একেবারে জব্দ কর দিয়েছেন মনে করে অংশুবাবু বেশ তৃপ্তির সঙ্গে হাসতে লাগলেন।
আমি খানিকটা দমে গিয়ে মিনমিন করে বললাম, টাকা তো অনেক জায়গায় পাওয়া যায়, ব্যাঙ্কে গেলেই পাওয়া যায়, কিন্তু মরাল সাপোর্ট অত সহজে কেউ পায় না। টাকা দিয়ে মরাল সাপোর্ট কেনা যায় না!
অংশুবাবু এবার অট্টহাসি করে বললেন, ব্যাঙ্কে গেলেই টাকা পাওয়া যায়, হা-হা-হা-হা, এটা বেশ ভালো বলেছেন, হা-হা-হা, যে-কেউ ব্যাঙ্কে গেলেই টাকা পাবে? হা-হা-হা! আপনি আমার সঙ্গে বাজি ফেলবেন! টাকা দিয়ে পাড়ার ছেলেদের মরাল সাপোর্ট কেনা যায় কিনা দেখবেন?
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি আবার সিগারেট কেসটা খুললেন। এবার আমার দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নিন!
আমিও বিনা দ্বিধায় একটা তুলে নিয়ে বললুম, আপনি তা হলে চা খাবেন না?
অংশুবাবু বললেন, নাঃ! আচ্ছা নীলুবাবু, আর একটু প্রশ্ন করি। সব ভাড়াটেই মনে করে, বাড়িওয়ালারা তাদের ওপর অত্যাচার করে। বাড়িওয়ালারা স্বার্থপর। তাই না? কিন্তু আপনি নিজে যদি বাড়িওয়ালা হতেন, তখন কী ভাবতেন?
—হতাম না।
—কী হতেন না?
–বাড়িওয়ালা হবার কোনো চান্স নেই আমাদের।
—মনে করুন না, হঠাৎ একটা বাড়ির মালিক হয়ে গেলেন।
—কী করে হবো? আমার ব্যবসা থেকে কোনোদিন কোনো লাভ হবার আশা নেই। দাদা আর বৌদি যা মাইনে পায়, তাতে কোনো রকমে সংসার খরচ চলে যায়। কিচ্ছু জমে না। বাড়ি হবে কী করে?
—হঠাৎ যদি একটা লটারির ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে যান!
—কিনি না!
—আহা, কল্পনা করতে দোষ কী? ধরে নিন না, কোনো রকমে একটা বাড়ির মালিক হয়ে গেলেন, তাতে দু’তিন ঘর ভাড়াটে …
—কল্পনাতেই যদি পোলাউ খেতে হয়, তাতে ঘি কম দেব কেন? সে-রকম যদি একটা বাড়ির মালিক হয়েই যাই, তা হলে ভাড়া দিতে যাব কোন দুঃখে? অনেক ঘর খালি পড়ে থাকবে। কোনোটা হবে লাইব্রেরি, কোনোটা হবে আড্ডার ঘর, কোনোটা হবে ঝগড়ার ঘর…
—আজকাল আর ওসব সম্ভব নয়, বুঝলেন। ফাঁকা ঘর ফেলে রাখলেই কেউ না কেউ এসে দখল করে নেবে। এবার আসল কথাটা শুনুন। কলকাতা শহরটা দিন দিন কী রকম বিচ্ছিরি হয়ে যাচ্ছে দেখছেন তো! এই রকম একটা তিনতলা বাড়ি, ভাঙাচোরা, রঙ করা হয়নি দশ বছর, এ-রকম বাড়ির জন্যই তো শহরটা আরও খারাপ দেখায়। এ বাড়ি সারাতে গেলে পুরো খোল-নলচে বদলে ফেলতে হবে।
–কেন, আমাদের তো বেশ চলে যাচ্ছে। বৃষ্টির সময় একটু জল পড়ে বটে, কিন্তু তাতে এমন কিছু অসুবিধে হয় না। এ রকম রঙ-চটা বাড়ি কলকাতায় হাজার হাজার রয়েছে।
—আহা, আগে শুনুন পুরোটা। হাজারটা বাড়ি থাকুক, কিন্তু আমার নিজের বাড়ি এ-রকমভাবে ফেলে রাখতে আমার লজ্জা করে। আপনাদেরও কষ্ট দিতে চাই না। পুরো বাড়ি সারাবার সামর্থ্য আমার নেই। তাই ঠিক করে ফেলেছি, এটা একেবারেই ভেঙে ফেলব। অনেকটা জমি আছে, এখানে একটা মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং দিব্যি হতে পারে। ভাবুন তো, এখানে একটা দশতলা বাড়ি উঠলে কত সুন্দর দেখাবে। পাড়াটার চেহারাই খুলে যাবে।
—এ তো খুব চমৎকার কথা! এতক্ষণ বলেননি কেন? আমার মা, দাদা—বউদি সবাই শুনলে খুব খুশি হবে! ভেঙে ফেলুন বাড়ি। দশতলা বিল্ডিং-এ অনেক ফ্ল্যাট হবে, তার মধ্যে একটা আমাদের দিতে চান, এই তো? আমাদের কিন্তু দক্ষিণ খোলা ফ্ল্যাট দিতে হবে, আমি আগে থেকেই বুক করে রাখছি।
মুখখানা করুণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অংশুবাবু। সিগারেটটা গুঁজে দিলেন অ্যাশট্রেতে।
তারপর বললেন, দিতাম, নিশ্চয়ই দিতাম। আপনাদের খুশি করতে কি আমার মন চায় না? আপনার বাবাকে আমি কত শ্রদ্ধা করতাম। আমি নিজে মাল্টিস্টোরিড বানালে আপনাদের একটা ফ্ল্যাট দিতাম। কিন্তু আমার অত টাকা কোথায়? একজন মাড়োয়ারি ভালো দর দিয়েছে। জমিটা সে চায়। আমার নিজের ব্যবসায়ে এখন খুব মন্দা চলছে, ক্যাশ টাকার খুব দরকার। তাই এই বাড়িটা আমাকে বেচতেই হবে।
–বেশ তো, সেই মাড়োয়ারিকে বলবেন আমাদের একটা ফ্ল্যাট দিতে।
–ঐ তো আর একটা মুস্কিল। সে কোনো পুরোনো ভাড়াটের ঝামেলা রাখতে চায় না। সে খালি বাড়ির পজেশান চায়। সে এখানে লাক্সারি ফ্ল্যাট বানাবে, অনেক টাকা দাম, আপনাদের মতন লোক সেখানে থাকতে পারবেন না। আপনাদের উঠে যেতেই হচ্ছে, নীলুবাবু!
-আমরা যাব কোথায়? এখন বাড়ি ভাড়াই পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায়, তার অসম্ভব ভাড়া।
—ব্যারাকপুরে চলে যান না। কিংবা এদিকের সোনারপুরে। কিংবা হাওড়া লাইনের বেগমপুরে। ওসব জায়গা এখনো বেশ ফাঁকা আছে। অনেক গাছপালা। কলকাতায় কি আর মানুষ থাকতে পারে? ছ্যা ছ্যা ছ্যা! রাস্তাঘাটের কী অবস্থা! নরককুণ্ড একেবারে! ট্রাম-বাসে যেতে গেলে মানুষগুলোকে জন্তু হয়ে যেতে হয়! কেন শুধু শুধু এই ঘিঞ্জির মধ্যে থাকতে যাবেন? মফস্বলে যান, টাটকা বাতাসে নিঃশ্বাস নেবেন, কোনো পলিউশান নেই। ফ্রেশ মাছ, তরি-তরকারি পাবেন।
—কলকাতা যদি এতই খারাপ জায়গা হয়, আর মফস্বল সব স্বর্গ, তা হলে আপনারা যাচ্ছেন না কেন সেখানে?
–আমাদের কি যাওয়ার উপায় আছে! বিষয়-সম্পত্তির এত ঝামেলা!
—তার মানে বাড়িগুলো সব বেচে দিচ্ছেন মাড়োয়ারিদের আর আমাদের মতন মধ্যবিত্তদের তাড়িয়ে দিতে চান মফস্বলে, এই তো?
—আমি তাড়াবার কে বলুন! সবই নিয়তি, সবই ভাগ্য! এতকাল তো কম ভাড়ায় এই বাড়িতে দিব্যি আরামসে রইলেন, আমি কিছু বলেছি! এখন আমার সাধ্যে কুলোচ্ছে না। বাড়িটা বেচতেই হবে। মাড়োয়ারিরা ভালো দাম দেয়, তাদেরই বেচব, এ তো সোজা কথা! এর মধ্যে অন্যায্য কী আছে, বলুন?
-কিন্তু আমার দাদা বোধহয় এই সোজা কথাটা বুঝতে চাইবে না। বড্ড গোঁয়ার!
–এর মধ্যে গোঁয়ার্তুমির চান্স কোথায়? আমি বাড়ি বিক্রি করব ঠিক করে ফেলেছি। মাড়োয়ারি প্রমোটার নতুন মাল্টিস্টোরিড বানাবার আগে এটা ভেঙে ফেলবে। তা হলে আপনারা থাকবেন কী করে?
—আমরা যদি ছেড়ে না যাই, তা-ও ভাঙবে?
—একতলার দোকানঘরগুলো ছাড়তে রাজি হয়েছে। তাদের সঙ্গে ব্যবস্থা হয়ে গেছে। দোতলার ভাড়াটেরা সল্টলেকে নিজস্ব বাড়ি করে উঠে গেছে, তা জানেন নিশ্চয়ই? সুতরাং একতলা আর দোতলা ভাঙতে কোনো অসুবিধে নেই। তারপরেও আপনারা তিনতলায় থাকবেন?
—হ্যাঁ থেকে যাব। কোনো অসুবিধে নেই। তখন আমরা হাসন রাজার গান গাইব!
–কার গান?
-হাসন রাজার গান শোনেননি? ‘কী ঘর বানাইনু আমি শূন্যের মাঝার, লোকে বলে, বলে রে, ঘর-বাড়ি ভালা না আমার।’
কটাস করে সিগারেট কেসটা বন্ধ করলেন অংশুবাবু। শক্ত করলেন চোয়াল। চোখ দুটি ডাক্তারদের সরু টর্চের মতন আমার চোখের দিকে ঘুরিয়ে বললেন, আপনি এখনো ছেলেমানুষ রয়ে গেছেন, নীলুবাবু! এসব ঠাট্টা-ইয়ার্কির ব্যাপার নয়। এ বাড়ি আপনাদের ছাড়তেই হবে। এ নিয়ে কোনো তিক্ততার সৃষ্টি হোক আমি চাই না!
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আমিও চাই না! তিক্ততা? এঃ! কোনোরকম তেতো জিনিসই আমি একদম পছন্দ করি না।
এই সময় সিঁড়ি দিয়ে দুপদাপ শব্দ করে উঠে এল একটি কিশোরী মেয়ে। হলুদ স্কার্ট পরা। ভেজানো দরজা ঠেলে সে ঢুকে পড়ল একটা হলুদ ঝড়ের মতন। মুমু!
আমার সামনে এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সে বলল, অ্যাই ব্লু। পাজি, মিথ্যেবাদী! আমাকে যে কালকে শরদিন্দু রচনাবলী পৌঁছে দেবার কথা ছিল, তার কী হলো?
সুনীল গঙ্গে’পাধ্যায়ের লেখা একখানা বই আমার গায়ে ছুঁড়ে মেরে বলল, এই বইখানা আমি পড়ব না।! বাজে, পচা, মাথামুণ্ডু নেই। এই লেখকটা লিখতেই জানে না। শরদিন্দু কোথায়?
তারপর হঠাৎ অংশুবাবুর দিকে চোখ পড়তেই সে অবাক হয়ে বলল, একী! জ্যাঠামণি, তুমি এখানে?
অংশুবাবুর মুখখানা এর মধ্যে কোমল হয়ে গেছে। চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে স্নেহ। তিনি বললেন, মামণি, এটা তো আমারই বাড়ি!
মুমু বলল, যাঃ তোমার বাড়ি কী করে হবে? এখানে তো নীলকাকারা থাকে। আমি বললাম, যে-যেখানে থাকে, সেটাই কি তার নিজের বাড়ি হয়! এই বাড়ির মালিক উনি। বোসো মুমু, দিচ্ছি বই।
মুমু আমার কাছে এসে চুল টেনে ধরে বলল, একদিন দেরি করেছ, তোমার ফাইন! আমাকে আইসক্রিম খাওয়াতে হবে!
অংশুবাবু যেন বেশ খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে একবার মুমুর দিকে, একবার আমার দিকে তাকাতে লাগলেন।