Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আজ রাত্রেই প্রথম বর্ষা নামল তার পুরো বাহিনী নিয়ে।

প্রথম বিলম্বিত কালবৈশাখী। আমি বাড়ি পৌঁছোবার সঙ্গে সঙ্গে জানলা দরজায় ঝনঝনাত শুরু হয়ে গেল। শোঁ-শোঁ আওয়াজে মনে হয় যেমন পুরো একটা সমুদ্র ধেয়ে আসছে শহরের দিকে। আমাদের পাড়ার মোড়ের কৃষ্ণচূড়া গাছটার বড় একটা ডাল ভেঙে পড়ল। উড়ে গেল বেশ কয়েকটা দোকানের সাইন বোর্ড।

ঝড়ের ধরন দেখে মনে হলো, আজ কলকাতার বহু গাছ উপড়ে নেবে। একেই বেচারা এই শহরটার গাছ এত কমে গেছে, তার ওপর ঝড়ের এই রুদ্র রোষে আরও যাবে।

মা আর বৌদি অনেক বার বারণ করলেও আমি ঝড় দেখার জন্য ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম।

দিনের বেলা হলে আরও ভালো করে দেখা যেত, কিন্তু রাত্তিরের ঝড়েরও একটা হিংস্র সুন্দর রূপ আছে। বাঘের মতন। বাতাসের এমন গতি যেন আমাকেও উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আকাশের দিকে তাকালে কিছুই দেখা যায় না, কিন্তু এক একবার ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ, ঠিক ম্যাজিকের মতন আকাশের এক কোণে মুহূর্তের জন্য ফুটে উঠছে এক আলোকিত দৃশ্য, আবার মুছে যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে।

বিদ্যুৎ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে, কিন্তু তারপর বজ্রের গর্জনটা সহ্য হয় না। খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে ঐ শব্দ শুনলে আমার বুক কাঁপে। বজ্র গর্জনের চেয়েও কোনো প্রবল শব্দ মানুষ কখনো শুনেছে কি! অ্যাটম বোমার আওয়াজ কি এর চেয়েও বেশি।

পর পর দুটো বজ্রপাতে আমার কানে প্রায় তালা লাগবার উপক্রম। তারপর বৃষ্টি নামল। তাতেই জুড়িয়ে গেল শরীর। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো এত বড় যেন মনে হয় শিল পড়ছে!

খানিকটা ভেজার পর পালিয়ে এলাম নীচে।

বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দের জন্যই আমি সেই সময় আমাদের বাড়ির কার্নিশের খানিকটা ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পাইনি।

ছাদের কার্নিশ ভাঙলেই বা ক্ষতি কী? বাচ্চা বয়েসে ছাদের পাঁচিল ডিঙিয়ে মাঝে মাঝে কার্নিশ দিয়ে দৌড়েছি। ঘুড়ি ধরতে গেছি। এখন তো আর সেই বয়েস নেই। আমাদের বাড়িতে আর কোনো বাচ্চা ছেলেও নেই যে ওখানে দৌড়োবে। তা হলে কার্নিশ থাকল বা না থাকল, তাতে কিছু যায় আসে না।

আমাদের বাড়িটার বয়েস কত তা আমি জানি না। তবে বছর কুড়ি পঁচিশ—এর মধ্যে কোনো রকম মেরামতের ব্যাপার যে হয়নি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভাড়া বাড়ি সারাবার কোনো নিয়ম নেই বোধহয়। মাঝে মাঝে চুনকাম ও রঙ করার ব্যাপারটা আমাদেরই করে নিতে হয়।

তবে বাড়িটা এমনিতে বেশ মজবুতই আছে বলতে হবে। কখনো সখনো প্লাস্টার খসে পড়ে, জানলা ঝুলে যায় বটে, কিন্তু কখনো তো ছাদ ভেঙে পড়েনি, এমনকি মাথার ওপর একটা ইঁটও পড়েনি।

নীচে নেমে আসতেই মা আর বৌদি দারুণ চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিল।

ওরা হুড়মুড় শব্দ পেয়েছে, ওদের ধারণা হয়েছিল ঝড়ে পুরো বাড়িটাই ধসে পড়ছে!

আমি ওদের আশ্বস্ত করলাম যে ছাদ পুরোপুরি অক্ষত আছে, ইচ্ছে করলে এখনো সেখানে বৃষ্টির মধ্যে নাচানাচি করা যায়। ঝড়ও থেমে গেছে, সুতরাং আপাতত আমাদের মাথা বাঁচাবার কোনো সমস্যা নেই।

এ বাড়ির একতলায় তিনটে দোকান ঘর, সেইসব দোকানের লোকজনেরা রাত্তিরে কেউ থাকে না। দোতলার ভাড়াটেদের সঙ্গে আমাদের বেশ ভাব ছিল, এ বাড়ির ব্যাপারে অনেকখানি দেখাশুনো তারাই করত। কী করে তারা যে হঠাৎ বড়লোক হয়ে গেল কে জানে, সল্ট লেকে বিরাট বাড়ি হাঁকালো। এমনকি এখানে তাদের চেনাশুনো কোনো লোককেও বসিয়ে গেল না।

রাত্তিরবেলা পুরো বাড়িটাতে শুধু আমার কটি প্রাণী!

বাড়িটা ছোট, কিন্তু আগেকার প্ল্যান তো, ঘরগুলো বেশ বড় বড়, যেখানে সেখানে বারান্দা, বাড়িতে ঢোকার সামনে খানিকটা জায়গা, ডান দিকে খানিকটা জায়গা ফেলে রাখা হয়েছে, কোনো কাজেই লাগে না। সব ভেঙে ফেলে এখানে একটা মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং মন্দ হবে না। অন্তত পাঁচ-ছ’ তলা বাড়ি তো হতেই পারে।

ঘণ্টা দেড়েক বাদে বৃষ্টির বেগ খানিকটা কমলে আমি ছাতা নিয়ে গেলাম নীচে। ক্ষতির পরিমাণটা একবার দেখা দরকার।

বাইরে এসে দেখলাম, বাড়ির ডান দিকে যে এঁদো গলি, সেখানেই ভেঙে পড়েছে কার্নিশের একটা অংশ। বেশ অনেকখানিই মনে হয়। কাল সকালে অংশুবাবু যদি একবার ইনস্পেকশানে আসেন, তা হলে আনন্দে লাফাবেন। এই বাড়িটা পুরো ভেঙে ফেলার আরও চমৎকার যুক্তি দেখাতে পারবেন করপোরেশানকে। যুক্তি দেখাবার হয়তো প্রয়োজনই নেই, টাকাপয়সা দিয়ে অর্ডার বার করে নিয়েছেন আগেই, তবু কেসটা জোরালো হবে!

অবশ্য যা বৃষ্টি হলো আজ, নির্ঘাৎ জল জমে থাকবে সব রাস্তায়। সেই জল ঠেলে, অংশুবাবুকে কাল আর এদিকে আসতে হচ্ছে না। এর মধ্যে এই ভাঙা চাঙাড়গুলোর সরিয়ে ফেলার একটা ব্যবস্থা করা দরকার।

বৃষ্টি পুরো থামেনি, পড়েই চলেছে।

ওপরে এসে মনে হলো, ধ্যাৎ, বাড়ির চিন্তা মাথা থেকে তাড়াতে হবে। এমন চমৎকার বৃষ্টির রাতে কবিতা পড়ার কথা, তা নয়, শুধু বাড়ি, বাড়ি আর বাড়ি! অনেকদিন রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়া হয়নি। সেকেণ্ড হ্যাণ্ড রবীন্দ্র রচনাবলীর দুটো ভল্যুম কিনেছিলাম কলেজ স্ট্রিট ফুটপাত থেকে, তার একটা টেনে নিলাম। এই ভল্যুমটায় রয়েছে অনেক গান।

বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছো দান…
আমার প্রিয়ার ছায়া আকাশে আজ ভাসে…
—বুঝি এলি যার অভিসারে…
মনে মনে দেখা হলো তারে..

ওঃ, রবীন্দ্রনাথ সারাজীবনে যে কত প্রেমের কবিতা লিখেছেন তার ইয়ত্তা নেই। ‘এত প্রেম আমি কোথা পাবো নাথ? ‘

পড়তে পড়তে মন খারাপ হয়ে এল।

ঝড় মাথায় নিয়ে আমি ছাদে গিয়েছিলাম, একটা খুব আশা নিয়ে। যদি আকাশ থেকে কোনো নারী নেমে এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। একবার এসেছিল, সত্যি এসেছিল। অন্য কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক, আমি তো জানি, আমি তার রক্তমাংসের শরীর ছুঁয়ে দেখেছি।

আবার অনেক দিন সে আসে না। সে কি আমায় ভুলে গেছে, না পথ হারিয়ে ফেলেছে? হয়তো দিকশূন্যপুরে গেলে তার সন্ধান পাওয়া যাবে। শিগগিরই যেতে হবে দিকশূন্যপুরে, যেতে হবে, যেতে হবে!

টিপিক্যাল ব্যর্থ প্রেমিকদের মতন কবিতার বই বুকের ওপর খোলা রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে আবার পৃথিবী গদ্যময়।

কাগজে নানারকম দুর্ঘটনার খবর। ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। দু’তিনটে বস্তি বিধ্বস্ত হয়েছে, গাছ ভেঙে পড়েছে কুড়ি পঁচিশটা। ট্রাফিক দুর্ঘটনা হয়েছে। ট্রেন বন্ধ।

এ ছাড়া, বউবাজার অঞ্চলে ভেঙে পড়েছে একটা পুরোনো বাড়ি। বাড়িতে অনেক লোকজন ছিল, কিন্তু কেউ হতাহত হয়নি। জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে অনেক। আর ঝাউতলায় একটা অর্ধসমাপ্ত নতুন বাড়ি তাসের ঘরের মতন ছত্রখান হয়ে গেছে, সে বাড়িতে অবশ্য কোনো বাসিন্দা আসেনি এখনো, তবে মিস্তিরিরা একতলায় ঘুমতো, তারা চাপা পড়েছে বেশ কয়েকজন, তিনটি মৃতদেহ এর মধ্যে টেনে বের করতে পেরেছে দমকলবাহিনী। এখনো উদ্ধারকার্য চলছে।

ঘটনাটা ঘটেছে রাত দশটায়। ঝড়-জলের মধ্যেও একজন মন্ত্রী, করপোরেশানের দু’জন কাউনসিলার ও পুলিশের কয়েকজন বড়কত্তা—মেজকত্তা সে জায়গাটা পরিদর্শন করে এসেছেন। ঝাউতলায় যে মাল্টিস্টোরিড কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে, তার প্রোমোটারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, আর্কিটেক্‌ট কলকাতার বাইরে।

তবে রাজ্য সরকার মৃত তিন মিস্তিরির প্রত্যেকের জন্য পনেরো হাজার টাকা দানের কথা ঘোষণা করে দিয়েছেন এরই মধ্যে।

আজকাল দেখি, পুলিশের গুলি কিংবা খবরের কাগজে বেরুবার মতন কোনো দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলেই তার নামে গভর্নমেন্ট পনেরো হাজার টাকা দান করে দেন। নিশ্চয়ই আমাদের গভর্নমেন্ট এখন খুব বড়লোক হয়েছে। সামান্য একটা মানুষের জীবনের জন্য পনেরো হাজার টাকা?

মাঝে মাঝে আমারই ইচ্ছে করে কোনো পুলিশের রাইফেলের সামনে বুক পেতে দাঁড়াই!

মা আর বৌদি ভোরবেলা উঠেও ছাদ-টাদ ভালো করে দেখে এসেছে। না, ছাদে কোনো ফাটল ধরেনি। আমাদের বাড়িটা হেলেও পড়েনি, আপাতত ভয়ের কোনো কারণ নেই।

কিন্তু কাল ঝড়ের সময় কখন এক ফাঁকে দাদার ঘরের দেওয়াল থেকে বাবার বাঁধানো ছবিটা পড়ে গিয়েছিল। টুকরো টুকরো হয়ে গেছে কাচ, ফ্রেমটাও ভেঙে গেছে, বৃষ্টির জল লেগে ছবিটাও নষ্ট হয়ে গেছে প্রায়।

খাটের পেছন দিকে ছবিটা পড়ে গিয়েছিল বলে বৌদি কাল রাত্তিরে খেয়াল করেনি। আজ সকালে সেটা দেখতে পাওয়ার পর দু’জনেরই খুব মনখারাপ। বাবা যেন জানিয়ে দিচ্ছেন, তিনিও আর এ বাড়িতে থাকতে চান না।

আমি খানিকটা বোঝাবার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না। যুক্তি এবং বিশ্বাসের মধ্যে লড়াই চলছে বহুকাল।

আমাদের বাড়ির ঠিক সামনেটায় জল না জমলেও বড় রাস্তায় কোমর জল। আজ আর বাজার করতে যাবার কোনো মানে হয় না। বাড়িতে তো আর কোনো অতিথি নেই, সুতরাং একটা দিন নিরামিষ দিয়ে চালিয়ে দেওয়া যায়।

তবু এই জল ঠেলে এক সময় উপস্থিত হলো তপনদা।

লুঙ্গির বদলে আজ পাজামা, সেটা হাঁটুর ওপর গোটানো, পায়ে রবারের চটি, হাতে বাজারের থলি।

তিনতলায় উঠে এসে তপনদা প্রথমে বাথরুমে পা ধুয়ে নিল।

তারপর বেশ সতৃপ্ত বিদ্রূপের হাসি দিয়ে আমাকে বলল, কী রে, কাপুরুষ, জল দেখে আজ বাজারে যাসনি তো? ঠকেছিস। দারুণ ঠকেছিস! আজ বাজারে মাছ দারুণ শস্তা। প্রচুর পার্শে মাছ উঠেছে, যেমন টাটকা, তেমন শস্তা। পঁচিশ টাকা কিলো!

—আমি অবিশ্বাসের সুরে বললাম, পঁচিশ টাকা? কোনোদিন ষাট টাকার কমে পাওয়া যায় না।

—ওই তো! আজকের দিনটায় খদ্দের এত কম, ওরা কি মাছগুলো জমিয়ে রেখে দেবে?

–সত্যি তপনদা, তুমি মাছ ভালবাস বটে! আর কেউ কি আজ বাজারে গেছে?

—নিজের জন্য নয় রে, নিজের জন্য নয়। শিখা পার্শে মাছ ভালবাসে। ওর জন্যই বাজারে যেতে হলো। আমাদের পাড়ার একজন খবর দিল, বাজারে আজ প্রচুর পার্শে! কী রে, তুই এখনও যাবি নাকি?

–আমার অত শখ নেই, তপনদা! আজ আমাদের বাড়িতে খিচুড়ি আর বেগুনভাজা!

—ইডিয়েট! খিচুড়ির সঙ্গে মাছভাজা ছাড়া জমে? নিরামিষ খিচুড়ি খায় যারা পুজো-আচ্চা করে। খিচুড়ি-ভোগ! যে-সব বাঙালি ব্রেনের চর্চা করে, তাদের মাছ ছাড়া একদিনও চলে না। জানতুম তুই বাজারে যাবি না। তাই তোদের জন্যও এনেছি এক কিলো। আলাদা ঠোঙায় এনেছি, তুলে রাখ।

–না, না, তপনদা, আমাদের মাছ লাগবে না। তুমি বাড়ির জন্য নিয়েছ, নিয়ে যাও।

–বললুম না, তোদের জন্য একস্ট্রা এনেছি।

–সত্যি পঁচিশ টাকা দাম?

–তোকে আর পয়সার কথা উচ্চারণ করতে হবে না। তার বদলে চা খাওয়া। আর যদি মুড়ি-টুড়ি কিছু থাকে। আমি ব্রেকফাস্ট না করেই বেরিয়েছি।

আমি মাকে চায়ের কথা বলতে গেলাম, ততক্ষণ তপনদা খবরের কাগজ পড়তে লাগল।

ফিরে আসার পর তপনদা বলল, দেখেছিস? ঝড়-বৃষ্টিতে পুরোনো বাড়িও ভাঙে, নতুন বাড়িও ভাঙে। পুরোনো বাড়ি ভাঙে ঠিক ঠিক সময়ে মেরামতির অভাবে। নইলে সিমেন্টের তৈরি বাড়ি অনায়াসেই এক শো-দেড়শো বছর টিকে থাকা উচিত। আর নতুন বাড়ি ভেঙে পড়ে কেন? কেন? বল, কেন?

—আমি তার কী জানি তপনদা!

—আমি এর মধ্যে বাড়ির এক্সপার্ট হয়ে গেছি। বাড়ির প্ল্যান যা স্যাংশান করা তার চেয়ে বেশি ফ্লোর স্পেশ নেয়। পাঁচতলা বলে সাত তলা তোলে। সিমেন্ট থ্রি ইস টু ওয়ান হবার কথা, কম দেয়। বালি ছাঁকে না। সব দিকে ভেজাল। কিন্তু নতুন বাড়ি ভেঙে পড়লে হৈ চৈ হয়। পুরোনো বাড়ি ভাঙলে সবাই বলে, বেশ হয়েছে! কলকাতা শহরে এমন লঝঝড়ে বাড়ি থাকবে কেন? বাড়িওয়ালা কেন সেই বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করেনি, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। পুরোনো বাড়িওয়ালাদের সাত খুন মাপ। সেই জন্যই তারা পুরোনো জরাজীর্ণ বাড়ি বলে ডিক্লেয়ার করে করপোরেশানকে দিয়ে ভাঙাচ্ছে আর প্রোমোটারদের ঝড়াঝড় বিক্রি করে দিচ্ছে জমি! কোনো আর মামলা-মোকদ্দমার ঝামেলা নেই!

—তপনদা, এটা সত্যি একটা নতুন অ্যাঙ্গেল, আমি জানতাম না।

—আরও শুনবি? ভবানীপুরে একটা নতুন বাড়ি ভেঙে পড়ায় বেশ কিছু লোক মারা গিয়েছিল, তোর মনে আছে?

—হ্যাঁ, মনে আছে।

—তখন একটা নাম শোনা গিয়েছিল। লাখোটিয়া। সেই লোকটা বেশকিছু ভেজাল বাড়ি বানিয়েছে। তার একটা বাড়ি ভেঙে পড়ায় নিরীহ কিছু লোক মারা পড়ল। তাই তো? সেই লোকটার কী শাস্তি হয়েছে বলতে পারিস? তোর স্মৃতিশক্তি আমি পরীক্ষা করছি, বল, বল, কী শাস্তি হয়েছে?

—জানি না, তপনদা!

—তোর দোষ নেই। কেউ জানে না! খবরের কাগজে প্রথম কিছুদিন হৈ চৈ হয়েছিল, ওই নামটা লোকের মুখে মুখে ফিরত। কিন্তু লোকটার যে শেষ পর্যন্ত কী শাস্তি হলো তা কেউ জানে না। খবরের কাগজেও কোনো উচ্চবাচ্য করে না। কাগজওয়ালারা নিত্য নতুন উত্তেজক খবরের সন্ধানে ফেরে, পুরোনো কথা ভুলে যায়। পাবলিকও ভুলে যায়। লাখোটিয়ারা বহাল তবিয়তে আগেকার মতন ঘুরে বেড়ায়।

–সত্যিই তো, ওই লোকটার কথা আর খবরের কাগজে দেখি না!

–তবু তো ওর নাম জেনেছিলি! এরপর বেহালায় যে আবার ওই একই রকম কাণ্ড হলো! নতুন বাড়ি ভেঙে কয়েকটা লোক মরল। সেই বাড়ির প্রোমোটার কে ছিল, নাম বলতে পারবি?

-না।

-যোধপুর পার্কে যে একটা বাড়ি বসে গেল, তার জন্য দায়ী কে? এরা তো এক একজন খুনী, তাই না? এরা বেশি লাভ করার জন্য প্ল্যান মানছে না, ঠিক মতন ভিত মজবুত করছে না, ভেজাল মশলা দিয়ে বাড়ি বানাচ্ছে, সেই বাড়ি ভেঙে কিছু লোক মরছে। তা হলে ওই লোকগুলোর মৃত্যুর জন্য এরা সরাসরি দায়ী! তুই যদি একটা লোককে খুন করিস, তোর ফাঁসি হবে। আর এরা বহু লোককে মারছে, তবু এদের ফাঁসি তো দূরের কথা, কোনো শাস্তিই হচ্ছে না। সরকারও এদের কিছু বলে না। আজকাল আবার আগাম জামিন বলে একটা ব্যাপার হয়েছে। কিছু একটা গণ্ডগোলের আগেই এই সব বড়লোক খুনীরা কোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়ে নেয়, তখন পুলিশেরও বেশ মজা হয়! পুলিশ তখন এদের বাড়ি গিয়ে চা-বিস্কুট খায়। না, না, কাবাব আর স্কচ হুইস্কি খেতে খেতে বলে, আমরা কী করব, ইনি আগাম জামিন নিয়ে নিয়েছেন। এখন এঁকে ধরব কী করে?

–তপনদা, তুমি এত সব জানলে কী করে?

—পুলিশের এক কর্তা।েছের লোক আমাকে বলল সব। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। আসলে সে শিখার পিসতুতো ভাই, অর্থাৎ আমার দূর সম্পর্কের শালা। তা সে শালা বলল, দাদা, আমরা কী করব, আমাদের হাত-পা বাঁধা। কোর্ট এদের ছেড়ে দেয়, গভর্নমেন্টও এদের ধরতে বলে না। তখন আমরা আর কী করব? আমরা এদের পয়সায় কাবাব আর স্কচ খাই।

—একেই ভিসাস সার্কেল না ওই রকম কী যেন একটা বলে না?

–তুই আরও শুনবি, নীলু? যাতে সামাজিক ভাবেও কোনো রকম বদনাম না হয়, সেই জন্য এই সব প্রোমোটাররা আর একটা নতুন টেকনিক নিয়েছে। এরা এখন ছদ্মনামে কোম্পানি খোলে। হয়তো দেখবি, কানোরিয়া কিংবা বাজোরিয়া, কেউ একটা প্রোমোটার। কিছু একটা গোলমাল হোক, তখন দেখা যাবে, ওই নামে কেউ নেই। এবার কাকে ধরবে ধরো! আসলে হয়তো পেছনে আছে ত্রিলোচন মাড়োয়ারি। কিন্তু কেউ তার নামটাও জানতে পারবে না!

–তোমাদের বাড়িটাও ত্রিলোচনই কিনেছে না?

—আমার বাড়িওয়ালার মুখে ওই নাম শুনেছি। কাগজে-পত্রে হয়ত দেখা যাবে, অন্য নাম রয়েছে।

—এরা কলকাতা শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যে-কোনো বাড়ি কিনছে, ভাঙছে, নতুন করে ইচ্ছে মতন গড়ছে, পুরোনো লোকদের তাড়িয়ে দিচ্ছে, তবু কেউ কিছু বলতে পারবে না?

-কিচ্ছু না! কিচ্ছু না! বাঙালি জাতটাই উচ্ছন্নে গেছে। সেই জন্যই তো আমি বম্বে চলে যাচ্ছি!

—অ্যাঁ? তপনদা, তোমরা চলে যাচ্ছ?

—কী করব? বাড়ি পাব কোথায়? তিন চার হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে থাকার সামর্থ্য নেই, মফস্বলেও যেতে পারব না। তার চেয়ে বম্বে অনেক ভালো। অনেকদিন আগে থেকেই বম্বেতে একটা অফার ছিল। এর আগে নিতে চাইনি। কাল ফোন করলাম, তারা বলল, হ্যাঁ, এক্ষুনি চলে এসো। তোমার থাকার জায়গাও আমরা ঠিক করে দেব! বুঝলি নীলু, কলকাতার তুলনায় বম্বে অনেক বেশি সিভিলাইজ্‌ড! তোদের মতন কলকাতা-প্রেমিকদের আঁতে ঘা লাগবে, তবু বলছি, বম্বে অনেক ভদ্র, সভ্য শহর। সেখানে টেলিফোন কাজ করে, ট্যাক্সি পাওয়া যায়, যখন তখন। লোডশেডিং হয় না।

—কিন্তু শিখা বৌদি যে এখানে গান শিখছিল!

—শিখাই তো বেশি জোর করছে। ও বলছে কলকাতার ভালো পাড়ায় আমরা সাধ্যমতন ভাড়ায় ফ্ল্যাট পাব না। গড়িয়া কিংবা সোনারপুর কিংবা ঠাকুরপুকুর যেতে ও কিছুতেই রাজি নয়। তার চেয়ে বম্বে ভালো! ওখানে বসেও গানের চর্চা করা যায়।

–তার মানে, শিখা বৌদি তোমার জন্য স্যাক্রিফাইস করছে। তোমার যখন একবার মাথায় চেপেছে, তুমি যাবেই। সেই জন্য শিখা বৌদি উৎসাহ দেখাচ্ছে।

—সেটা কি আমি বুঝিনি? আমিও স্যাক্রিফাইস করছি! বম্বেতে ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না। চেতল মাছ পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় যত্তসব সমুদ্রের মাছ, পমফ্রেট-মমফ্রেট, হাঙর, সেসব শিখার পছন্দ।

–সত্যি তপনদা, তুমি লেক মার্কেটে বাজার করা ছেড়ে অত দূরে থাকতে পারবে?

—তবে বলি শোন! এখানকার পড়াশুনোর পাট চুকিয়ে পাড়ি দিয়েছিলুম লণ্ডনে। সেখানে বেশ জেঁকে বসেছিলুম, বুঝলি? ভালো কাজ পেয়েছিলুম, নিজের গাড়ি হাঁকাতুম, একটা বাড়িও কেনা হয়ে গিয়েছিল প্রায়! তবু থাকতে পারলুম না, কলকাতার জন্য মন কেমন করত। কলকাতা রোজ হাতছানি দিয়ে ডাকত। সব ছেড়েছুড়ে তাই ফিরে চলে এলুম। সেই কলকাতা এখন আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। থাকার জায়গা দেবে না। সেই সাধের কলকাতা ছেড়েই যদি চলে যেতে পারি, তা হলে ইলিশ মাছ ত্যাগ করা আর বড় কথা কী?

—তপনদা, আজকের কাগজে কয়েকটা বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে, দেখেছ?

-ভাড়া কী রকম সেটা দেখিসনি? তিন হাজার, চার হাজার, একটার ভাড়া সাড়ে ন’হাজার! জোচ্চোর ছাড়া কেউ এত ভাড়া দিয়ে থাকতে পারে। যে বিজ্ঞাপনগুলোয় ভাড়ার কথা লেখে না, বুঝবি, তারা হেভি সেলামি চাইবে। না রে, নীলু, আমি মন ঠিক করে ফেলেছি। চুলোয় যাক কলকাতা!

—তুমি আর শিখা বৌদি চলে গেলে কলকাতাটা অনেক ফাঁকা ফাঁকা লাগবে!

—তুইও চলে আয়, দেখি বম্বেতে তোর জন্য একটা কাজ জোগাড় করা যায় কিনা!

দ্বিতীয় কাপ চা শেষ করে তপনদা উঠে পড়ল।

আমাদের জন্য রেখে গেল একগাদা পার্শে মাছ। খুব বড় বড় সাইজ, এরকম সচরাচর দেখা যায় না। দেখলেও দাম শুনে পিলে চমকে যায়।

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তপনদা বলল, বম্বেতেও প্রচুর হাই-রাইজ বিল্ডিং উঠেছে। সেখানেও মধ্যবিত্তরা বাড়ি ভাড়া পায় না। মাড়োয়ারি আর গুজরাতি ব্যবসায়ীরা বম্বেটা দখল করে নিয়েছে প্রায়। কিন্তু মহারাষ্ট্রিয়ানদের পুনার মতন আলাদা একটা সুন্দর বড় শহর আছে। বাঙালিদের আজও তেমন কোনো দ্বিতীয় ভালো শহর গড়ে উঠল না, কলকাতাটাও তাদের রইল না।

আস্তে আস্তে নেমে গেল তপনদা।

বাড়িওয়ালার কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার অফার পেয়েও প্রত্যাখ্যান করেছে, স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে, প্রিয় শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পঞ্চাশ হাজার টাকাও খুব কিছু না, এক সময় খরচ হয়ে যেতই, কিন্তু সারা জীবন নিজের কাছে এই প্রত্যাখ্যানের অহংকারটা তো করতে পারবে। কোনো কোনো মানুষের কাছে এই আত্মাভিমানের মূল্যই অনেক।

আজ আর সারাদিন বেরুতে হবে না। যারা চাকরি করে, তারাও অনেকেই আজ অফিস কাট মারবে। অধিকাংশ বাঙালির বাড়িতেই আজ রান্না হবে খিচুড়ি। তাস খেলার আসর বসবে পাড়ায় পাড়ায়।

জানলার ধারে দাঁড়ালে খানিকটা দূরের বড় রাস্তা দেখা যায়। ঠিক মোড়ের মাথায় একটা শৌখিন দোতলা বাড়ি ছিল, সেটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যেই উঠে গেছে ছ’তলা খাঁচা। রাস্তায় ট্রাম চলছে না, গোটা দু’এক প্রাইভেট গাড়ি থেমে আছে আধ-ডোবা হয়ে, রিক্সাওয়ালারা দৌড়োচ্ছে খপাত খপাত করে।

মা এসে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে, তপন অতগুলো মাছ দিয়ে গেল, কেউ ওর বাড়িতে এসে দিয়ে গেছে বুঝি?

আমি দু’ দিকে ঘাড় নেড়ে জানালুম, না।

মা আবার বললেন, এত মাছ, খাবি তো মাত্র তুই আর তোর বৌদি, পাশের বাড়িতে কিছুটা দিয়ে দেব?

এরকম অদ্ভুত প্রস্তাব শুনে আমি মায়ের দিকে ঘুরে তাকালাম। মাছ কখনো বেশি হয় নাকি?

মা বললেন, পাশের বাড়ির গোপা বলল, ওর কত্তা আজ বাজারে গিয়ে মাছ পায়নি। মাছ ওঠেইনি প্রায়, যা আছে, তার আগুন দাম। আশি-নব্বই টাকা দর। অরুণ মাছ না কিনেই ফিরে এসেছে।

এটা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। বেশি দুর্যোগের দিনে মাছের চালান আসে না। যৎসামান্য যা ওঠে, তার দাম খুবই বেশি!

মাকে বললাম, ঠিক আছে, আৰ্দ্ধেকটা ওদের দিয়ে দাও।

তপনদা এই রকমই!

কেউ অন্যকে কিছু দিয়ে আনন্দ পায়, কেউ অন্যদের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিয়ে আনন্দ পায়। পৃথিবীতে দ্বিতীয় ধরনের লোকের সংখ্যা এত বেড়ে যাচ্ছে কেন?

দুপুরটা কাটতে না কাটতেই মনে হলো, দূর ছাই! এরকম ভাবে বাড়ি বসে থাকার কোনো মানে হয় না। যতই জল জমে থাক মিনি বাস ঠিক চলবে। না হলে জলের মধ্যে হাঁটাও যেতে পারে, শুধু ঢাকনা চুরি-যাওয়া হাইড্র্যান্ট-নর্দমার গর্তগুলো খেয়াল করতে হবে। কলকাতার রাস্তা যেখানে সেখানে হাঁ করে আছে।

যেই বাড়ির বাইরে পা দিয়েছি, আবার বৃষ্টি নামল।

ছাতা নেই, কোনোদিন ছাতা নিয়ে বেরুনোর অভ্যেসও নেই। তা বলে কি এখন আবার বাড়ির মধ্যে ঢুকে যাব? গোঁয়ারের মতন এক দৌড়ে চলে এলাম বড় রাস্তার কাছে। দাঁড়ালাম ওষুধের দোকানের উঁচু সিঁড়িতে।

হঠাৎ কেন যেন মনে হলো, যে-কোনো মুহূর্তে লালুদার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।

মারুতি গাড়ি জলে থামে না। কয়েকটা ছোট্টখাট্টো মারুতি হাঁসের মতন জল কেটে কেটে যাওয়া আসা করছেও বটে। লালুদা প্রত্যেক দুপুরে তার লাল মারুতি হাঁকিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে টহল দিতে বেরোয়। আজও কি বেরোবে না?

আমার সঙ্গে লালুদার যেখানে সেখানে দেখা হয়ে যায়। আজ লালুদা এই পথ দিয়ে গেলে নির্ঘাৎ আমাকে লিফ্ট দিতে চাইবে। অনেক কথা বলবে। আজ এই বৃষ্টি ঝরা দুপুরে লালুদার সঙ্গে সময় কাটাতে আমার একদম ইচ্ছে করছে না।

আমার রীতিমতন ভয় করতে লাগল। লালুদা যে-কোনো মুহূর্তে এসে পড়বে। অবধারিত। ঠিক দেখে ফেলবে আমাকে। জোর করে গাড়িতে তুলবে। কাঠালি কলা মার্কা হাসি দিয়ে বারবার আমাকে ভুল নামে ডাকবে। ওই যে দূরে একটা লাল রঙের মারুতি আসছে না?

আমি আর রিস্ক নিলাম না। লাফিয়ে উঠে বসলাম একটা চলন্ত মিনিবাসে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *