সাইকেলটা
০৩.
সাইকেলটা দাওয়ার সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো রয়েছে। আর অন্ধকার সজনেতলায়, সিগারেটের স্ফুলিঙ্গ দপদপিয়ে উঠছে ঘন ঘন। নিরন্ধ্র অন্ধকারে আর কিছুই দেখা যায় না। ঘন ঘন সিগারেটের আগুনে শুধু চকচকিয়ে উঠছে দুটি তীক্ষ্ণ চোখ। ব্যাকুল উৎকণ্ঠা সেই চোখে।
সারাদিনের অসহ্য গরমের পর বাতাস যেন পাগলা ঘোড়ার সওয়ার হয়ে ছুটে আসছে দক্ষিণ থেকে। চৈত্রের ঝরা পাতা এখনও ছড়িয়ে আছে এখানে-সেখানে। বাতাসে পাতা সরসরিয়ে উঠছে। কিংবা পাতার ওপরে হেঁটে ফিরে বেড়াচ্ছে ইঁদুর গিরগিটিরা। বাঁশঝাড়ের বাতাস নিশ্বাসের সঙ্গে চাপা মোটা স্বরের গোঙানি উঠছে। কোথায় একটা পাখি ডেকে চলেছে অক্লান্ত। টেনে টেনে ভয় পাওয়া সুরে ডাকছে। হয়তো আশঙ্কা করছে, কিংবা চোখে পড়েছে, ধীর গতি ধূর্ত অব্যর্থ সাপটাকে। আরও দূরে, হয়তো খালপাড়ের ওদিকে কোথাও একটা মদ্দা পাখি গলা ফাটিয়ে ডেকে মরছে, বউ কথা কও বউ কথা কও! এর মানে বোধ হয়, কোথায় আছিস, সাড়া দে। একটা কাঁদছে মরার ভয়ে। আর একটা ডাকছে প্রেমের আশায়। দুতিনটে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে কাছে ও দূরে। আকাশ জুড়ে নক্ষত্রের সভা। চণ্ডীতলার মাঠে কৃষকসভার মতো। যেন গোটা আকাশটার কোথাও এতটুকু জায়গা ফাঁক নেই।
একটা সিগারেট শেষ হল। আর একটি সিগারেট ধরাল চিরঞ্জীব। বার কয়েক পায়চারি করল উঠোনে। তারপর আবার সজনেতলায় গিয়ে দাঁড়াল চোখ তুলে।
পাড়ার মধ্যে কোথায় একটি ছেলে কাঁদছে। ভাঙা ভাঙা বুড়ি গলায় বকবক করছে কেউ। একটা মালগাড়ি যাবার শব্দ শোনা গেল।
অন্ধকার থেকে একটি মোটা মেয়েলি গলা ভেসে এল, ছোটঠাকুর নিকি?
চিরঞ্জীব ঘুরে দাঁড়াল। অন্ধকারে তার চোখে জ্বলে। পরিষ্কার দেখতে পেল যমুনাকে। দুর্গার যমুনা-মাসি।
চিরঞ্জীব এগিয়ে এসে বলল, হ্যাঁ। যমুনা-মাসি?
হঁ।
–তোমাদের মেয়ে বেরিয়েছে কখন?
অনেকক্ষণ। সেই সনজেবেলা লাগাদ।
–গেল কোথায়।
–জানি না। দেখা হয় নাই। এয়েছিলুম আর একবার, দেখা পাই নাই। খাল-কেষ্টা, দলেরই লোক আমাদের, সে নিকি দেখেছে, ইস্টিশানের দিকে যেতে।
বোধ হয় অনেক কেষ্টর এক কেষ্ট খাল-পাড়ের বাসিন্দা, তাই হয়েছে খাল-কেষ্টা। যমুনা আবার বলল, আমারটা আমি পাচার করে এয়েছি ছোট্ঠাকুর।
চিরঞ্জীবের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বলল, কোথায় গেছলে তুমি?
যমুনার গলা ক্রমেই আরও মোটা এবং গদগদ হয়ে উঠল। বলল, নিল্লায়।
মাইল তিনেক দূরের গ্রাম, নির্লা। আসলে হয়তো নিরালা। চলতিতে দাঁড়িয়েছে নিল্লা। মহকুমা শহরের আরও কাছাকাছি জায়গা। শহরে যাবার চোরা রাস্তা আছে। নির্লাতে রোজ লোক আসে মদ নিয়ে যাবার জন্যে।
চিরঞ্জীব জিজ্ঞেস করল, কী করে নিয়ে গেলে?
যমুনা হাতের ঝাপটা দিল এমন ভাবে যেন ও সব কিছুই নয়।
একটু জড়িয়ে জড়িয়ে হেসে বলল, অই যে গো, তোমার রপারের টিউক, তাইতে ভরে, সারা শরীলে আমার পেঁচিয়ে বেঁধে দেছেল দুগগা। নিষ্টেপিষ্টে দেছেল ; কারুর বাবার টের পাবার সাধ্যি ছেল না। কয়লা কুড়োবার ঝুড়ি নিলুম, সড়ক ধরে সোজা হেঁটে গেলুম রেল নাইনে। নাইন ধরে ধরে নিল্লায়।
বলে আর একবার গুঙিয়ে গুঙিয়ে হাসল দুর্গার যমুনা-মাসি। তার রপারের টিউক আসলে রবারের টিউব। সাইকেলের টিউব এ সব কাজের মস্ত সহায়।
চিরঞ্জীব কিছু বলার আগেই যমুনা আবার বলল, তা ক্ষার বস্তু কি না। আমার সারা গায়ের মধ্যে জ্বলছিল।
চিরঞ্জীব রুক্ষু গলায় জিজ্ঞেস করল, টিউবটা খুলেছিলে নাকি?
যমুনা ভয় পেয়ে বলল, ওমা। ছি! অমন বেইমানি করতে আছে? ধরা পড়ে যাবার ভয় নাই আমার?
চিরঞ্জীব বলল, তবে নেশা করলে কোত্থেকে, জল পেলে কোথায়?
মদ নয়, মাল নয়, জল। যমুনা আর এক চোট হেসে নিল। অন্ধকার সয়ে যাওয়ার চোখে পরিষ্কার দেখা যায়, যমুনার প্রৌঢ়া চোখ দুটি হাসিতে যেন ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বলল, অ। সেই কথা। মেয়ে আমাকে দয়া করেছে যে আজ। বললুম কি না, সারাটা দিন আজ পেটে কিছু পড়ে নাই মা দুগগো, শরীলে বল নাই তেমন। টুকুসখানি তাজা জল আমাকে দাও, গলায় দিয়েনি। তোমার ঘড়ামি মেসো এখনও কাজ সেরে ফেরে নাই। তাই দেছেলো। তা শরীল আর মন আমার বেশ বশে আছে ছোট্ঠাকুর। জিনিস নে আর এক পাক দে আসতে পারি।
চিরঞ্জীব বলল, সে তো বুঝতেই পারছি।
–পারছ ছোট্ঠাকুর?
চিরঞ্জীব প্রায় ধমকে উঠল, খুব পারছি। দয়া করে আর ওরকম তাজা জল খেয়ে জিনিস নিয়ে কোথাও যেয়ো না। এই নাও।
বলে পকেট থেকে দুটি টাকা বের করে দিয়ে বলল, ঘরে গিয়ে রান্না বান্না করোগে এখন।
পরমুহূর্তেই আবার চিরঞ্জীব অন্ধকারে দুচোখ তুলে তাকাল।
টাকা দুটি নিয়ে যমুনা খানিকক্ষণ হাঁ করে রইল। তারপর বলল, একি আমার মজুরি দিলে ছোট্ঠাকুর?
–হ্যাঁ।
–সে তো আমাকে পরশুকে আগাম দে রেখেছেল দুগগা। একটু অসহিষ্ণু গলায় বলল চিরঞ্জীব, এও না হয় আগাম দেওয়া হল, এখন যাও। বারে বারে যেন নিয়ো না।
যমুনা বলল, ছি, তাতে বেইমানি হবে না আমার।
কথা শেষ হবার আগেই চিরঞ্জীব সিগারেটের আগুন হাতের আড়াল করে, চাপা গলায় বলে উঠল, চুপ! চুপ কর মাসি। কে যেন আসছে।
তারা দুজনেই সজনেগাছটার কোলে আঁধার ঘেঁষে দাঁড়াল।
হন হন করে এসে ঢুকল একজন দুর্গার বাড়ির উঠোনে। একেবারে দাওয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। চিরঞ্জীব এতক্ষণে চিনেছে মূর্তিটাকে। বলল, গুলি না?
–হ্যাঁ।
গুলি এসে দাঁড়াল কাছে। চিরঞ্জীব জিজ্ঞেস করল, কী? গোলমাল কিছু?
গুলি হাঁপাচ্ছে। বলল, এখনও হয়নি।
–দুর্গা কোথায়?
–সেই কথাই বলতে এলুম।
বল।
চিরঞ্জীবের দু চোখ সত্যি যেন বাঘের মতো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। শক্ত হয়ে উঠল তার শরীর।
গুলি বলল, দুগগাদি ন্যাড়াকালীতলায় চলে গেছে।
চিরঞ্জীবের গলায় শঙ্কিত বিস্ময়। সেটা চাপবার চেষ্টা করে বলল, ন্যাড়াকালীতলায় কেন?
গুলি বলল, গজু আর সতীশ জিনিস নে যাচ্ছিল গোরুর গাড়িতে করে।
–সে তো জানি। বিচুলির গাড়ি ছিল। কোন রাস্তা দিয়ে গেছে?
গুলি বলল, খালধারের রাস্তা দিয়ে। সে সবে কোনও গণ্ডগোল নেই। কিন্তু ভোলা আর কেষ্ট, ওই দুশালার কেমন যেন নজর পড়ে গেছে। পেছু নিয়েছে গাড়িটার। গজুর সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছিল। গজু সতীশও তো খুব শক্ত নয়। খবরটা আমিই দিয়েছিলুম দুগগাদিকে। তা শুনেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
চিরঞ্জীব যেন আর এ-গল্প শুনতে পারছিল না। অসহিষ্ণু হয়ে বলল, তারপর বল। ন্যাড়াকালীতলায় গেল কেমন করে?
গুলি বোধহয় ভয় পেল চিরঞ্জীবের গলা শুনে। বলল, দুগগাদি, অন্য পথ দিয়ে, এগিয়ে গিয়ে, খালপাড়ের সেই একেবারে সাহেববাগানের ধারে, আগে থেকেই পথে বসেছিল। আমি দূর থেকে দেখেছি। তারপরে, ভোলা-কেষ্টর সঙ্গে দেখা হতে কী কথা হল দুগগাদির। ভোলা-কেষ্ট গাড়ির পেছু ছেড়ে দিয়ে, দুগগাদিদির সঙ্গে চলে গেল।
–কোথায় গেল?
ন্যাড়াকালীতলায় বসে কথা বলতে দেখে এয়েছি ভোলা-কেষ্টর সঙ্গে।
–আর গাড়ি?
–গাড়ি চলে গেছে।
হুঁ।
চিরঞ্জীব কয়েক মুহূর্ত অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল চুপ করে। কিছু যেন ভাবল। আবার জিজ্ঞেস করল, জটারা চন্দননগরে চলে গেছে?
–বেরিয়ে গেছে জানি।
কলোনির সেই মেয়েটাও সঙ্গে গেছে ওদের?
বীণা? হ্যাঁ, ছিল।
চিরঞ্জীব এক হাতে সাইকেলটা টেনে নিল। পকেট থেকে বার করে টর্চলাইটটা হাতের চেটোয় চেপে একবার দেখে নিল বোতাম টিপে। জ্বলছে ঠিকই। তারপরেই মুখ ফিরিয়ে যমুনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, মাসি তুই দাঁড়িয়ে কেন? চলে যা।
যমুনা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, মেয়ের কী হবে ছোট্ঠাকুর?
কী আবার হবে? নতুন তো নয়। তারপরেও যদি কেউ অসাবধান হয়ে ধরা পড়ে, কারুর তো কিছু করবার নেই।
চিরঞ্জীবের গলায় একটু বিরক্তির ঝাঁজ। যদিও তার চোখে-মুখে বিরক্তির সঙ্গে উৎকণ্ঠার গাঢ় ছাপই বেশি।
যমুনা বলল, তা বাপের বেটি তো। শুনে চুপ করে থাকতে পারে না।
-না পারে তো মরবে, আমার কী?
বলে সাইকেলে উঠতে উদ্যত হয়ে থামল চিরঞ্জীব। গুলিকে বলল, কাছেপিঠেই থাকিস, আমি আসছি।
তারপর চেনা পথের অন্ধকারে, যেন বাতাসের আগে চলে গেল সে।
.
ন্যাড়াকালীতলা মহকুমা শহরে যাবার বড় রাস্তার ধারেই। যে-বড় রাস্তাটি গিয়ে, জি, টি, রোডে পড়েছে। বাঁ-দিকে গেল চন্দননগর। পূর্ব-দক্ষিণে বাঁকে ফেরা রাস্তাটা গেছে মহকুমা শহরে।
রাস্তাটা সাধারণত নির্জনই। দিনের বেলা লোক চলাচল থাকে। রাত্রে নিঝুম হয়ে আসে। মাঝে মধ্যে এক-আধখানা মোটরগাড়ি হেডলাইটের চোখ ঝলসে চলে যায়।
গোরুর গাড়ির চাকার ককানি-গোঙানিও শোনা যায় প্রায় সারা রাত্রিই। লোক চলাচলও যে একেবারেই নেই, তা নয়। তবে খুব কম। রাস্তাটার দুপাশেই গ্রাম আছে। গ্রামের ফাঁকে ফাঁকে অবশ্য বাগান আর জঙ্গলের বিরতিই বেশি। তবু, রাত-বিরেতে এ-গাঁয়ে ও-গাঁয়ে লোকের একটু-আধটু যাতায়াত আছে বইকী। প্রথম রাতেই অবশ্য। পাড়াগাঁয়ের প্রথম রাত যাকে বলা যায়।
এ রাস্তাটার ধারেই, একটি অন্ধকার আমবাগানের পাশ ঘেঁষে ন্যাড়াকালীতলার থান। কোনও মন্দির নেই, বিগ্রহ নেই। আছে গোটাকয়েক মান্ধাতা আমলের বট-অশত্থ। ঝাড়ালো বেঁটে আর অজস্র ঝুরিতে গাছগুলি শতাব্দীকাল ধরে বংশ বাড়িয়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে কাঠা কাঠা জমি নিয়ে। রাত দূরের কথা, দিনের বেলাতেও এখানে ছায়া ছায়া অন্ধকার ঘুচতে চায় না। বাতাস এখানে অষ্টপ্রহর অনেক অশরীরীদের ফিসফিস কানাকানি চুপিচুপি কথার মতো শব্দ করে। যে ঝুরিগুলি মাথার ওপরে ছাদ সৃষ্টি করে, দৈত্যের কঙ্কালের মতো থাম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বাতাস সেখানে বাঁধাপড়া পশুর মতো মরণের ডাক ছাড়ে। লোকের ভয় আছে, ভয় নেই শুধু কাছের ডোমপাড়াটার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের। ওরা সারাদিন ঝুরিস্তম্ভগুলির আড়ালে-আবডালে লুকোচুরি খেলে। দিনের বেলা হঠাৎ বৃষ্টি বাদলায়, পথিকেরা আশ্রয় নেয় ঝুরির তলায়। ডোমপাড়ায় স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া হলে, যে কোনও এক পক্ষ এসে আশ্রয় নেয় রাতের মতো। তবে সে খুবই কম।
কালীতলায় কালীর দেখা নেই। একটি বটের গোড়া বাঁধানো। তার ওপরে রাশি রাশি পোড়ামাটির ছাঁচের ঘোড়া রয়েছে পড়ে। লোকে দিয়ে গেছে মানসিক করে। একপাশে এক ষষ্ঠী মূর্তি, আর একপাশে শীতলার। দু-ই মাটির। পুজো করে, যাদের জলে বিসর্জন দিতে নেই, তাদের শেষ আশ্রয় এই গাছের গোড়ায়। বছর ঘুরতে না ঘুরতে দেখা যাবে এই সব মূর্তি জলে ধুয়ে গেছে। পড়ে আছে শুধু খানকয়েক ব্যাঁকারি কঞ্চি। খড়গুলি ন্যাড়াকালীতলার স্থায়ী বাসিন্দা পাখিদের ঠোঁটে ঠোঁটেই উঠে যায়।
বাঁধানো জায়গাটিতে সন্ধে দেবার স্থায়ী খুপরি আছে, ডোমপাড়ার মেয়ে বউরা রোজই এই খুপরির মধ্যে বাতি জ্বেলে রেখে যায়। যতক্ষণ তেল থাকে ততক্ষণ জ্বলে। চারদিকের ঘুটঘুটি অন্ধকারে ওই আলোটুকুই যেন গোটা ন্যাড়াকালীতলায় অস্পষ্ট আলো-আঁধারির মায়া সৃষ্টি করে।
আজও সেই আলো রয়েছে। ছোট খুপরির মধ্যে টিমটিমে সেই আলো, ডোমপাড়ার অতি কষ্টের ছিটেফোঁটা তেলের আয়ু নিয়ে বাতাসে মরো মরো করছে। সেই আলোয় দুর্গার পুষ্ট শরীরের মায়াবিনী অবয়ব রেখা কাঁপছে। সে হাসছে খিলখিল করে। যেন ধরে রাখতে পারছে না নিজেকে। হাসির দমকে পড়ছে ঢলে ঢলে। কাপড়ের খয়েরি ডোরা অস্পষ্ট। চুলে নেই বাঁধন, এলো-খোঁপা খসা ঘাড়ের কাছে। পান খেয়েছে সে, রক্তরঞ্জিত ঠোঁটে, নিশিন্দাপাতা আয়ত কালো চোখের ধাঁধায়, ন্যাড়াকালীতলায় যেন সে একটি সর্বনাশের খেলায় মেতেছে।
কয়েক হাত দূরেই অস্পষ্ট ছায়া নিয়ে বসে আছে ভোলা আর কেষ্ট। বলির ছাগ নয়, মন্ত্রমুগ্ধ বিহ্বল দুটি মানুষ যেন সারা জীবনের আরাধ্য দেবীর দেখা পেয়ে বাক্যহারা। নিমেষহারা দু জোড়া রক্তাক্ত চোখ। ফাটা ফাটা কালো ঠোঁটগুলি হাঁ হয়ে রয়েছে। কালো কালো দুটি খোলা শরীর অবশ, পাথরের মতো স্তব্ধ।
তাদের কিছু বলার নেই। সন্ধ্যার ঝোঁকে তারা উদ্দেশ্যহীন ভাবে বেরিয়েছিল। খালপাড়ে এসে হয়তো শুয়ে থাকত, কিংবা বসে থাকত। মন চাইলে খালধার ধরে চলে যেত হয়তো শ্মশানে। অথবা শুধু ঘুরতেই থাকত গোটা গ্রামটা। পাক খেতে খেতে চক্রটাকে ছোট করে নিয়ে আসত বাগদিপাড়ার সীমানায় এসে। আরও ছোট করে নিয়ে আসত বাঁকা বাগদির বাড়িটাকে ঘিরে।
কিন্তু হঠাৎ তাদের নজরে পড়ে গিয়েছিল গজেনের বিচুলির গাড়িটা। গজেন, অর্থাৎ গজু হেঁটে গাড়ি চালাচ্ছে। সতীশ বসে আছে গাদার মাথায়। এমনিতে সন্দেহ করার কিছু নেই। গজেন-সতীশ মোটামুটি চেনাশোনা লোক। বড়লোক জোতদারের স্থায়ী কৃষি-চাকর।
কিন্তু একটু ঘুরে গেলে যারা, শহরে যাবার পিচের রাস্তা পেত, তারা কেন খালধারের কাঁচা রাস্তা ধরেছে? তাও আবার সন্ধ্যাবেলা। যেতে চায় কোথায়? শহরে? বেশ, কিন্তু এখন রওনা হয়ে তো রাত বারোটায় শহরে পৌঁছুবে। রাত বারোটায় পৌঁছে লাভ কী? এ সব কাজ তো ভোলা-কেষ্টও করেছে কোনও এক কালে। অজানা কিছুই নেই।
খালধার দিয়েও অনেকে যায়, রাস্তাটা শটকাট। কিন্তু রাত বারোটায় শহরে পৌঁছবার জন্য কেউ বিচুলির গাড়ি বার করে না। বরং রাত বারোটায় বেরিয়ে ভোর ভোর শহরে পৌঁরার চেষ্টা করে সবাই। সারাদিন ঘুরে বিচুলি বেচে ফিরে আসে। নয়তো দুপুরের মুখে বেরিয়ে, সন্ধ্যায় শহরে পৌঁছে, রাতে কোনও কাজকর্ম থাকলে সেরে নেয়। অনেক কাজকর্মই থাকে। মামলা-মোকদ্দমা থাকলে উকিলমশায়ের বাড়ি যেতে হয়। মামলা-মোকদ্দমার তদ্বির-তদারক থাকে। হিসেব-নিকেশ থাকে শহরের মহাজনের কাছে। কেনাকাটাও থাকতে পারে।
কিন্তু এমন অসময়ে কেন? একমাত্র গজেন-সতীশ বলেই সন্দেহটা পাকাপাকি গেঁথে যায়নি মনে। কারণ গজেন-সতীশ এ-নাইনের লোক বলে তারা জানে না। কিন্তু এ সন্দেহ শাওনের মেঘ। একবার যখন ঘনিয়ে এসেছে, সে না বর্ষে ছাড়বে না। তাই, গাড়িটা দেখামাত্রই তাদের মধ্যে একটি অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় হয়েছিল। প্রথম ভোলা এগিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কোথা চললে হে গজু?
গজু খুব নির্বিকার ভাবেই আগে গোরুটাকে মুখতাড়া দিয়েছিল, দ্যাখ দ্যাখ শালা জোড়া বলদের কীর্তি। শালাদের লজর থানে যায় না, অস্থানে যায়। সোজা চল।
কেষ্ট বলেছিল, বলদের দোষ কী বল। ঢাল দেখলে গড়িয়ে যেতে চায়।
কথার মধ্যে উভয় পক্ষের যেন কিছু অর্থপূর্ণ বাক্য বিনিময় হয়েছিল।
গজু তেমনি নির্বিকার ভাবে কথার জের টেনে জবাব দিয়েছিল, শহরে যাব।
ভোলা বলেছিল, তা, এই সনজেবেলায় কেন গো? মাঝরাতে গে পৌঁছবে যে?
তা পৌঁছুব। কী করব বল। ভোর পাঁচটায় খদ্দেরের বাড়ি মাল দিতে হবে, মনিবের হুকুম। যন্তন্না কি কম? রাতের ঘুমের তো তেইশটি মারা হয়ে গেল।
জবাবটা গজু ভালই দিয়েছিল। বিশ্বাসযোগ্য কৈফিয়ত। কিন্তু তেল দাও সিঁদুর দাও ভবী ভোলে কই? অমন লাগসই জবাবটাও সন্দেহ ঘোচাতে পারেনি। কেষ্ট-ভোলা আবার চোখাচোখি করেছিল। ওদের ভাবলেশহীন রক্তাভ চোখের চাউনি দেখলে লোকে কিছু ঠাহর করতে পারে না। কিন্তু ওদের পরস্পরের অভাবের মধ্যে ভাবের খেলা নিজেরা ঠিক বুঝতে পারে। ওদের চোখ ওদের বলে দিয়েছিল, না এ গাড়ির পিছন ছাড়া যায় না। শাওনের মেঘ একবার যখন ঘনিয়েছে!
ভোলা আবার বলেছিল, পাকা সড়ক দে না গে এ-পথে যাচ্ছ যে?
দায় বড় ভারী। ভিতরে ভিতরে দুর্বলতা না থাকলে গজু কৈফিয়ত না দেবার জেদ করতে পারত। কিন্তু তাকে বলতে হল, রাস্তাটা শটকাট তাই।
আজকাল গাঁয়ের সব লোকেই শটকাট বলে। ভোলা-কেষ্টও এই কথাটাই শুনতে চেয়েছিল গজুর মুখ থেকে।
কেষ্ট তৎক্ষণাৎ বলেছিল, হাজার শটকাট হলেও, রাত করে কেউ এ-পথে যায়? বলে হেঁটে যেতেই ভরসা হয় না। গীসসি কাল, কীসের থেকে কী হয়, বলা যায়? রাস্তাও সরু, তার ওপরে গাড়ি। এটা তোমার ঠিক হয় নাই হে গজু।
এ সব হচ্ছে লোক চটাবার কথা। চটাতেই চাইছিল ভোলা কেষ্ট। তাতেই ওদের সুবিধা। কিন্তু চটবার অধিকার নেই গজেন-সতীশের। এবারে সতীশ জবাব না দিয়ে পারেনি, বাপ্পু ইসরে, তোমাদের যে বড় দুশ্চিন্তা দেখি? তোমাদের কি শহরে যাবার মতলব আছে?
–থাকলে?
–উঠে এসো না কেন গাড়িতে! গাড়িতে যাবার জন্যেই তো এত কথা, নাকি?
চালটা মন্দ চালেনি সতীশ। আর একবার চোখাচোখি করতে হয়েছিল ভোলা-কেষ্টকে। কিন্তু শাওনের মেঘ একবার যখন ঘনিয়েছে।
তবে ঢালবেই এমন কথা নেই। উথলি-পাথালি পুবে ঝড় অনেক সময় তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। ভোলা-কেষ্ট তো জানত না, এতক্ষণ ধরে সেই বাতাসের আয়োজন চলছিল। তারা দেখছিল, সাহেববাগানের ধারে, গাছতলায় দুর্গা।
সে বসে থাকা, বসে থাকা নয়! ঝড়ের চেয়েও ভয়ংকর। লোক দেখে দুর্গা উঠে দাঁড়িয়েছিল। বাঁ-হাতে তার কোঁচড় ধরা। ডান হাত কোঁচড়ের মধ্যে। চোখের নজর বাগানের দিকে।
গজু জিজ্ঞেস করেছিল, দুগগা? এখানে কী হচ্ছে?
ন্যাকামিটা গজু ভালই করেছিল। দুর্গা আর একবার বাগানের দিকে উঁকি মেরে বলেছিল, দ্যাখ। সেই কখন বেরিয়েছি একটু ন্যাড়াকালীতলায় যাব বলে। এখেনে এসে আটকে পড়েছি।
-কেন?
–আর কেন? মরণ ধরেছে এ্যাটটা মিনসের! চিনি-টিনি না, অনেকক্ষণ থেকে পেছু লেগেছে। তোমরা আসছ সাড়া পেয়ে, বাগানে গে ঢুকেছে। এখন না পারি ঘরে ফিরতে, না পারি কালীতলায় যেতে। কেন যে মরতে এ-পথে এলুম।
ভোলা-কেষ্ট তখন নিজেদের চোখে চোখে তাকাতেও ভুলে গিয়েছিল। শাওনের মেঘ গিয়েছিল উড়ে। বুঝি দুর্গারই ইশারায় গজেনের গাড়ি গিয়েছিল এগিয়ে। কিন্তু ভোলা-কেষ্টর শক্ত পা চারটে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল কোন মায়াপাশে।
পশ্চিমের রক্তাভ আকাশ তখন পুরোপুরি ছায়ার আলিঙ্গনে। সন্ধ্যা তারাটা উঠেছে অনেকক্ষণ। আরও কয়েকটি নক্ষত্র ফুটে উঠেছে এদিকে-ওদিকে। যেন খালের ধারে এই খেলাটা দেখবার জন্য। আকাশের সভায় সব জায়গা নিয়ে বসেছে আগে থেকেই। ঝিঁঝিরা ডাক দিয়েছিল আগেই। খালপাড়ের কোন গাছে বসে একটা একলা পাখি তখনও শিস দিয়ে ডাকছিল।
দুর্গা ফিক করে হেসে উঠেছিল। সেই শব্দে স্থির হয়ে গিয়েছিল গোটা খালপাড়টা। ভোলা-কেষ্ট চোখ তুলে তাকিয়েছিল।
দুর্গা বলেছিল, কী গো, তোমরাও কি আমার পেছু লেগেছ নিকি?
ভোলা বলেছিল, তা লাগতে পারি।
কেষ্ট বলেছিল, যাদের যা কাজ।
দুর্গা হেসে উঠেছিল। বলে, তা বেশ করেছ। মস্ত মরদ সব তোমরা, এখন পেছু লেগে আমাকে ইটটুস সাহেববাগানটা পার কর দিনি।
ভোলা-কেষ্ট তাকিয়ে দেখছিল, গজুর বিচুলির গাড়ি হটর হটর করে পুবে চলে যাচ্ছে। এইবার আর একবার চোখাচোখি করেছিল ভোলা আর কেষ্ট। আর সেই মুহূর্তেই নিজেদের বুকের ভিতর থেকে শুনতে পেয়েছিল ওরা, গাড়ি যাক, দুর্গা থাক। গাড়ি অনেক ধরা যাবে, দুর্গাকে ধরা যাবে একবারই। দেখি, দুর্গা কোথায় নিয়ে যায়।
দেখি নয়, দেখতে হবে। ভাগ্যের লিখন খণ্ডানো যায়! রক্তের পাকেপাকে যে লিখন আছে তাকে খণ্ডানো সবচেয়ে দুরূহ এই সংসারে!
দুর্গা ততক্ষণে মোড় নিয়েছে সাহেববাগানে। ভোলা-কেষ্ট পা বাড়িয়েছিল তাদের চিরশত্রুর পিছনে পিছনে।
ভোলা জিজ্ঞেস করছিল, কোঁচড়ে কী?
দুর্গার পায়ে যেন ঢল ঢল নাচের তাল। বলেছিল, মায়ের বাহন, দেব কালীতলায়। মানসিক আছে।
কেষ্ট–এমন অসময়ে যে?
অসময় কোথা? বেরিয়েছি সেই কখন। সারাদিন উপোস করে, বিকেলে নেয়ে, তা’পর বেরিয়েছি। ভাবলুম কিনা পুজো দে ফিরে এসে খাব। তা, কী আপদ লেগেছে, দ্যাখ না। মিনসেটা এবাগানেই কোথাও লুকিয়ে আছে।
কত ভয় দুর্গার। এত যদি ভয়, তবে চোখে-মুখে অমন অন্ধকারের ছুরির মতো হাসি চমকাচ্ছে কেন? আন মিনসের যদি এত ভয় এই রাতের ঘোর-লাগা নির্জন সাহেববাগানে ভোলা-কেষ্টর কাছে কেমন করে ভরসা পেল দুর্গা?
কোনও ভরসা নেই। সাহেববাগানের এদিকে পুকুর, ওদিকে পুকুর। বিঘার পর বিঘা জমিতে আমবাগান। অযত্নে বেড়েছে কালকাসুলে আর আসশেওড়ার বন। নোনার ঝাড় আর ধুতুরার ঝোপ। প্রায় মানুষের বুক সমান। কোনও এক কালে এক সাহেব তার বাগানবাড়ি করেছিল। এখন সাহেব নেই, বাংলোটা আছে। তারও জানালা-দরজা চুরি হয়েছে গেছে অনেকদিন। মাথার টালিগুলিও নেই! টালির ফ্রেমের কাঠও গেছে। বেড়া ভেঙেছে বহুকাল। খালধার থেকে যারা পিচের রাস্তায় আসতে চায়, তারা এই আধমাইল বাগান পার হয়। পিচের রাস্তায় পড়ে খানিকটা ঘুরে গেলেই ন্যাড়াকালীতলা।
এই নির্জন ভুতুড়ে বাগানে, প্রথম রাত্রির ঘোরে, কোনও ভরসা নেই দুগর ভোলা-কেষ্টর কাছে। তবু দুর্গা নিজের ভয়ের সঙ্গে বাজি ধরে এসেছে। দুর্গা বলেই এমন দুঃসাহসিক কাজ সম্ভব হয়েছে। এই জন্যেই বোধ হয় লোকে তাকে নাম দিয়েছে বাঘিনী। ভোলা কেষ্ট যে ক্রমেই তার গায়ের কাছে ঘেঁষে আসছিল, তাও টের পাচ্ছিল দুর্গা। বুকের মধ্যে কাঁপছিল তার। বোধ হয় সেই কাঁপুনিকেই হাসির ঢুলুনিতে রঙিয়ে তুলেছিল সে। ভরসা মাত্র একটিই। একটা লড়ায়ে, ভোলা-কেষ্টর কাছ থেকে পাঞ্জা জিতে নিয়েছিল দুর্গা আগেই। ওদের সাহসকে তার চেনা ছিল।
কথাটা মিথ্যে নয়। যে বাগানে গাঁ-ঘেঁষা পাখিরাও বাস করে না, সেই বাগানের নির্জনে দুর্গার হাসি শুনে ভোলা-কেষ্টর বুকের মধ্যেও বুঝি কাঁপছিল। ওরা যেন কোনও দুর্জেয় রহস্যের সন্ধানে এক বিচিত্র মেয়ের পিছু পিছু চলছিল। বোধ হয় অস্বস্তিতেই জিজ্ঞেস করেছিল ভোলা, এত হাসি কীসের?
দুর্গা আরও হাসতে হাসতে বলেছিল, হাসব না? যত ভাবছি, তত হাসি পাচ্ছে।
ভোলা-কেষ্ট চোখাচোখি করেছিল। দুর্গার যতটা কাছে যেতে প্রাণ চাইছিল ওদের তত কাছে যেতে পারছিল না। তবু এক চুম্বকের টানে যেন দুর্গার গায়ের বাতাসের আওতায় চলতে চাইছিল।
কেষ্ট জিজ্ঞেস করেছিল, কী ভাবছ, আমাদের এটটু শোনাও।
দুর্গা একবার তাকিয়েছিল তার আয়ত চোখ তুলে। কেমন যেন নেশাধরা গলা মনে হচ্ছিল ভোলা-কেষ্টর। এই নির্জনে একবার যদি নেশায় ওরা পাগল হয়, তবে, কে বাঁচাবে দুর্গাকে।
দুর্গা জবাব দিয়েছিল, এই আমার কালীতলায় যাবার ব্যাপারখানা ভাবছি, আর আমার হাসি পাচ্ছে। তোমরা কোথায় ভাবছিলে, দুর্গাকে বামাল ধরতে হবে। তা নয়, মুশকিল আসান করতে হচ্ছে।
বলতে বলতে দুর্গা হেসেছিল আবার।
কিন্তু ভোলা-কেষ্টর মনের অন্ধিসন্ধি, সব কি জানে দুর্গা!
ভোলা বলেছিল, তা মুশকিলে যখন পড়েছ—
মুখের কথা কেড়ে বলেছিল কেষ্ট, আসান তো করতেই হয়, না কীরে ভোলা?
ভোলা বলেছিল, বটে। যখন যেমন, তখন তেমন—
–হ্যাঁ। তুমি যদি এখন মাল পাচার করতে তা বলে কি ছেড়ে
-সেটা আমাদের সরকারি ডিউটি। তা কখনও হয়?
ওরা যে নিজেদের কথা নিজেরা কেড়ে নিয়ে বলছিল, তাতে ওদের রাগ হচ্ছিল না। ওরা একটা ঝোঁকের মাথায় কথা বলছিল।
কিন্তু ভোলাই প্রথম টিপে টিপে বলেছিল, তবে এই আঁধারে, বনে বাঁদাড়ে আমাদের ওপর ভরসা করে এলে—
কেষ্ট-হ্যাঁ, সেটা ইটটু বেশি সাহস হয়ে গেছে।
দুর্গা হেসেছিল খিলখিল করে। বলেছিল, তোমরা তো চেনা লোক।
ভোলা–তা বটে।
কেষ্ট–চেরকালের চেনাশোনা, কিন্তুক
ভোলা–আমাদের কপাল মন্দ।
কেষ্ট-হ্যাঁ, সে কথাটাই বলতে যাচ্ছিলাম।
ভোলা-কেষ্ট তখন দুর্গার গায়ের কাছে। দুর্গার আঁচল বাতাসে উড়ে ওদের গায়ে পড়ছিল। নাকের পাটা ফুলছিল দুর্গার। চোখের কোণে কোণে ধিকি ধিকি আগুন দেখা যাচ্ছিল। আর শিরায় যেন একটি রুদ্ধ বেগ থমকে ছিল।
ভোলা-কেষ্টও যেন কেমন মিইয়ে গিয়েছিল দুর্গাকে না হাসতে দেখে। কিন্তু বেশিক্ষণ সে-অবস্থায় থাকতে হয়নি। অন্ধকার তখন চেপে বসলেও, রাস্তাটা দুর্গা দেখতে পেয়েছিল। দেখছিল, একটি গোরুর গাড়ি যাচ্ছে, বুকের তলায় হ্যারিকেন ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে। হারিকেনের আলোয় রাস্তা জুড়ে ছায়া পড়েছিল গাড়ির চাকার, আর বলদের পায়ের।
কিন্তু ভোলা-কেষ্টকে ভ্রষ্ট করা গেছে, ওদের মতলব নষ্ট করা হয়নি। রাস্তায় পড়ে বলেছিল, পুজো দে ফেরাও মুশকিল। রাত হয়ে যাবে অনেক। আমাকে একটি কাজ করে দেবে তোমরা?
ভোলা বলেছিল, বলো।
কাছেই একটি দোকান ছিল। দোকানের বাতি দেখিয়ে বলেছিল, ওখেন থেকে দুপয়সার বাতাসা এনে দেবে? কালীতলায় দেব।
কেষ্ট তাড়াতাড়ি ছুটেছিল দোকানের দিকে। দুর্গা চেঁচিয়ে বলেছিল, পয়সা নে যাও।
–ফিরে এসে নেব। কাছে আছে।
বাতাসা আর পুতুল কালীতলায় দিয়ে, প্রণাম করে বাঁধানো কালীতলায় বসেছিল দুর্গা।
ভোলা বলেছিল, বলেছিলে যে সারাদিনের উপোস রয়েছে।
দুর্গা তার সারা মায়াবিনী শরীর মোচড় দিয়ে, হাই তুলে বলেছিল, এখন আর হাঁটতে পারছিনে। বড় তেষ্টা লাগছে।
ভোলাই ছুটেছিল জল আনতে। কোত্থেকে যেন ঘটি সংগ্রহ করে জল এনেছিল। সঙ্গে কিছু চিড়ে মুড়ি মুড়কি। খানকয়েক রসমণ্ডিও ছিল।
দুর্গা বলেছিল, ও মা! উকি, না না, এ সব কেন?
ভোলা বলেছিল, খাও। পুণ্যি করতে এয়েছ। মাল পাচারে তো বেরোও নাই। সারা দিনের উপোস। শুনলে—
-খাওয়াতে হয়।
কেষ্ট বলেছিল। দুর্গা হেসেছিল খিলখিল করে। সেই হাসিতে ন্যাড়াকালীতলার অশরীরী মায়া তার মোহ বিস্তার করে দিয়েছিল। দুর্গা বলেছিল, দাও।
দুর্গা খেতে খেতে কেবলি হাসছিল। সে হাসি শুনে বুঝি ডোমপাড়ার মানুষরাও গা ছমছমানি নিয়ে তাকিয়েছিল কালীতলার দিকে। প্যাঁচা ডাকছিল চ্যাঁ চ্যাঁ…।
খাওয়ার পরে, দু খিলি পান এগিয়ে দিয়েছিল ভোলা। চিরশত্রুর সঙ্গে আজ ভোলা-কেষ্টর অতিথি সম্পর্ক। অতিথি সৎকারে কোনও ত্রুটি রাখেনি তারা।
সেই পান খেয়ে, ঠোঁট দুটি রক্তাক্ত করে জমিয়ে বসেছিল দুর্গা। সেই থেকে বসেই আছে। অর্থহীন বিহ্বল প্রলাপের মতো কী দু-একটা কথা বলছে ভোলা-কেষ্ট। দুর্গা শুধু হাসছে। তবু খুপরির ওই মরো মরো বাতিটার মতোই হাসিটুকু ক্ষয়ে আসছে তার। ওঠবার তার উপায় নেই। কে জানে গজেন-সতীশ বুদ্ধি করে রাস্তা বদলাল কি না।
দুর্গা হঠাৎ বলল, আজ রাতের কাজ তোদের মাটি হল।
ভোলা-কেষ্টর আসল আসামি পাশে বসে। কাজ মাটি হবে কেন। তবু ভোলা বলল, তা রোজ রোজ কি আর কাজ হয়, আজ না হয় তোমার কাছেই বসে কাটল।
কেষ্ট বলল, হ্যাঁ, একদিন তো!
যেন রোজ রোজ হলে আর ওরা কাজ করত না। চিরদিন ধরে ওরা এমনি বসে থাকতে চায়। কথা শুনে দুর্গা হেসে উঠল। যেন আসলে আমাকে চোখে চোখে রেখেছ বলে?
ভোলা রাখতে চাইলেই কিন্তু রাখা যায়।
কেষ্ট–আছ, তাই রেখেছি!
ভোলা–কিন্তুক এটটা কথা
কেষ্ট-হ্যাঁ, আমিও বলছিলুম—
ভোলা–একদিন তোমাকে ধরা পড়তে হবে।
কেষ্ট-সেদিনে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
দুর্গা হেসে, নিজের হাঁটুর উপর নুয়ে পড়ল। বলল, সত্যি? তা আগে থেকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ যে বড়?
ভোলা-কেষ্ট চোখাচোখি করল। কথাটা না বলতে চেয়েও বলেছে তারা। ভোলা বলল, না, এমনি বললুম আর কী!
তারপরে আর কোনও কথা নেই। দুর্গা যেন বাঁধানো গাছতলায় সদ্য আবির্ভূতা দেবীমূর্তি। ন্যাড়াকালীতলার চিররহস্যময় অন্ধকারে মরো মরো প্রদীপের আলোয়, যার চারপাশে ঘিরে রয়েছে ভয় ও মোহ।
আর ভোলা-কেষ্ট দেখছে সেই দেবীমূর্তি, তাদের হাতের নাগালের মধ্যে। কিন্তু হাত তাদের অবশ। সমস্ত দেহ অবশ। তারা যেন ভারবাহী ক্লান্ত পশু। কিন্তু চোখ ভরে নেশার আমেজ!
এমন সময়ে একটি শব্দ শুনে তারা তিনজনেই ফিরে তাকাল। দেখল বাঁধানো চত্বরের পাশে এক দীর্ঘ মূর্তি। সঙ্গে সাইকেল। পরমুহূর্তেই টর্চের তীব্র আলো চকিতে একবার দুর্গাকে ছুঁয়ে, ভোলা-কেষ্টর ওপর গিয়ে পড়ল।
আলো সহ্য করতে না পেরে ভোলা আর কেষ্ট চোখে হাত চাপা দিল। ভোলা অসন্তুষ্ট স্বরে বলে উঠল, উ আবার কী রকম ঢং। চোখ থেকে বাতি সরাও।
চিরঞ্জীব টর্চ নিভিয়ে বলল, একটু দেখে নিচ্ছি, কে কে বসে আছিস।
কেষ্ট বলল, সে খবর না লিয়ে কি আর এয়েছ?
চিরঞ্জীব ফিরে তাকাল দুর্গার দিকে। দুর্গার আয়ত চোখের বাঁকা চাউনি সহজ হয়ে এল। যেন ঘুমে জড়িয়ে এল তার চোখ। ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে, সে আর একবার হেসে উঠল কালীতলা শিউরিয়ে।
চিরঞ্জীবের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বাঁধানো চত্বরের ওপর বসে সে ভোলা-কেষ্টকে জিজ্ঞেস করল, পুজো দিতে এসেছিস নাকি তোরা?
জবাব দিল কেষ্ট, না একটা মামদো ভূতে নিকি পেছু নেছেল দুর্গার, সেটাকে দেখতে এয়েছিলুম।
চিরঞ্জীব আবার তাকাল দুর্গার দিকে। দুর্গা হেসে উঠল খিলখিল করে।
ভোলা বলল চেপে চেপে, তবে সে ভূত বোধ হয় এতক্ষণে পগার পার হয়ে গেছে।
বলে সে গোঙা স্বরে হাসল। তাকাল দুর্গার দিকে।
চিরঞ্জীব হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। দুর্গার দিকে তাকিয়ে বলল, বাড়ি যাবি এখন?
তার গলায় চাপা বিরক্তি। দুর্গা বলল, ইটটু বসে যাও না।
–না, আমার বসবার সময় নেই। যাবি তো ওঠ।
বলে সে সাইকেল নিয়ে তৈরি হল। দুর্গা আর একবার হাই তুলে, সারা শরীরে একটি হিল্লোল তুলে উঠে দাঁড়াল। ভোলা-কেষ্টর দিকে ফিরে বলল, চলি গো তালে। অনেক উবগার করেছ তোমরা।
ভোলা বলল, এসো গে ভালয় ভালয়।
কেষ্ট বলল, মানসিক করে গেলে। ফল ফললে আমাদের বারেক মনে কোরো।
ভোলা আবার বলল, তোমার হাতে বানানো রস খাইও এটটু।
দুর্গা হেসে বলল, রস? আচ্ছা খাওয়াব।
বলে সে অবলীলাক্রমে চিরঞ্জীবের হাতে-ধরা সাইকেলের ডান্ডার ওপরে কাঠের সিটে লাফ দিয়ে বসল। পরমুহূর্তেই চিরঞ্জীব সাইকেলে উঠে, দুর্গাকে নিয়ে অদৃশ্য হল অন্ধকারে।
ভোলা-কেষ্ট দেখল, টর্চের আলো একবার জ্বলে উঠল বড় রাস্তার ওপরে। টিং টিং করে ঘণ্টা বেজে উঠল দুবার। তারপর থেকে থেকে যন্ত্রণাকাতর গোঙানির মতো, একটি চলন্ত গোরুর গাড়ির চাকা ককাতে লাগল।
খানিকক্ষণ ওরা দুজনেই তেমনি বসে রইল। খুপরির আলোটা জ্বলছিল তখনও। তবু যেন সামান্য আলোটুকুও দুর্গা তার আঁচলের ঝাপটায় নিয়ে চলে গেছে। গাঢ় অন্ধকার দলা দলা হয়ে উঠেছে।
ভোলা প্রথম বলল, গজুর বিচালির গাড়িটা এতক্ষণে বেশি দূরে যেতে পারে নাই।
কেষ্ট বলল, এতক্ষণে নিশ্চয় রাস্তা বদলে ফেলেছে।
ভোলা–বদলালেই বা যাবে কোথা? গায়েব হয়ে তো যাবে না!
কেষ্ট-না। বেরুলেই ধরা যায়।
ভোলা-এখুনি!
কেষ্ট-বিচালির গাড়িতে যখন যাচ্ছে, মাল তালে অনেক আছে।
ভোলা–তা আছে। ধরলে, রোজগার মন্দ হবে না।
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। তারপরে হঠাৎ ভোলা বলল, কিন্তুক আজ ধরব না, কী বলিস কেষ্টা?
কেষ্ট অন্ধকার রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, আজ আর কাউকে ধরব না। মনটা খারাপ হয়ে গেছে।
ভোলা–বিগড়ে গেছে সব।
দুজনেই ক্লান্তভাবে এলিয়ে বসল। আর গোটা জীবনের ব্যর্থতাটা তাদের দুজনেরই হঠাৎ এখন মনে পড়ল।
ভোলা বলল, একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সোমসারে দুটো বস্তু দরকার, বুইলি কেষ্টা। এটাটা মাটি, আর এটটা বউ।
কেষ্টা যেন অবাক হয়ে বলল, অ্যাঁ?
ভোলা আবার বলল, দুটো জিনিস। এটটা মাটি, আর এটটা বউ।
কেষ্ট যেন ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বলল, এটটা না থাকলে আর এটটা পাওয়া যাবে না।
ভোলা-হ্যাঁ। মাটি না থাকলে বউ হয় না। এসে পা দেবে কোথায়?
কেষ্ট-সে জন্য আমার বউটা রইল না। মাটি ছেল না, ডাঁড়াতে পারল না।
ভোলা–হুঁ!…আমাকে বাঁকা খুড়ো একবার বলেছেল, ভোলা তোর সঙ্গে আমার দুগগার বে দিতে পারি, কিন্তুক আমার সঙ্গে এ সব চোলাই কারবার ছাড়তে হবে। জমি জিরত করে গুছিয়ে-গাছিয়ে বসতে পারলে, আমার মেয়েকে দেব। বলে ছেল একদিন বাঁকা খুড়ো–।
একটা দমকা বাতাস এসে যেন তার কথার মুখে থাবড়ি দিয়ে চুপ করিয়ে দিল। তারপর তারা দুজনে বাঁধানো চত্বরের উপর শুয়ে পড়ল।
.
খুপরির আলোটার আয়ু তখন শেষ হয়ে গেছে।
দুর্গা বলল চাপা গলায়, ঘুটঘুটে আঁধার, ইটটু আস্তে চালাও।
চিরঞ্জীব সে কথার কোনও জবাব দিল না। অদূরেই স্টেশনের আলো দেখা যাচ্ছে। স্টেশন আর হাটের সামনের রাস্তা দিয়ে যাওয়া চলবে না। টর্চলাইটটা আর একবার জ্বালাল চিরঞ্জীব। বাঁদিকে, একটি কাঁচা রাস্তা গেছে মাঠের মাঝখান দিয়ে। সেই রাস্তায় বাঁক নিল সাইকেল। সাইকেলের ঝাঁকুনি বাড়ল, কিন্তু গতি কমল না।
দুর্গা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল, উঃ! লাগছে যে?
কিন্তু সাইকেল সমান গতিতে চলতে লাগল। দুর্গা এবার মুখ ফিরিয়ে তাকাল চিরঞ্জীবের দিকে। প্রায় মুখে মুখে ঠেকে যাওয়ার মতো কাছাকাছি। দুজনের নিশ্বাস দুজনেরই গায়ে মুখে লাগছে। দুর্গার কষ্ট হলেও চোখের কোণে একটু হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল। বলল, ছোট্ঠাকুর কি রাগ করেছ?
চিরঞ্জীব সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, না।
তবে?
তবে কী?
-রাগ রাগ মনে হচ্ছে যে?
সাইকেল আবার খালধারেই এসে পড়ল। গ্রামের বাইরে যাওয়া আসার এইটিই সবচেয়ে নির্জন রাস্তা। কি দিনে, কি রাত্রে।
একটু চুপ করে থেকে জবাব দিল চিরঞ্জীব, আমার রাগের কী আছে? যার যা স্বভাব, সে তো তাই করবে।
ঠিক এই কথাটি কোনওদিন সহ্য করতে পারবে না দুর্গা। চিরঞ্জীবও বড়-একটা বলে না। যে-দিন রাগ সামলাতে না পারে, সেদিন অজান্তে, অনিচ্ছায় বেরিয়ে যায়। দুর্গার কাছে এ কথা বরাবরই অপমানকর বোধ হয়েছে। মনে হয়েছে, এর মধ্যে কোথায় একটি নিষ্ঠুর বিদ্রুপাত্মক খোঁচা আছে। তাদের জাত, তাদের জীবন, বিশেষ করে দুর্গার জীবনের প্রতি যেন অতি সহজ বিশ্রী একটা কটাক্ষ আছে।
সহসা সাইকেলটা টলমল করে উঠল। চিরঞ্জীব বলল, কী হল?
দুর্গার চাপা গলা শোনা গেল, নামব। নাম্মিয়ে দাও আমাকে।
চিরঞ্জীব হ্যান্ডেলটা আরও জোরে চেপে ধরল। সেই ধরার বাঁধনে, দুর্গাকেও আরও শক্ত করে ঘিরল। বলল, পথে তো আমার র্যালা করার সময় নেই। চুপচাপ বসে থাক।
কিন্তু দুর্গা বারে বারে পা ঠেকাতে লাগল মাটিতে। হ্যান্ডেলে ঝাঁকুনি খেতে লাগল। দুর্গা ঝাঁকি দিয়ে কপালের চুল সরিয়ে বলল, আমারও র্যালা শোনবার সোময় নাই। নাম্মিয়ে দাও না।
চিরঞ্জীব জবাব দিল না। সে শুধু তার শক্ত মুঠি দুটি হ্যান্ডেলের মাঝখানে বরাবর চেপে ধরল। তাতে তার দুই কনুই প্রায় সাঁড়াশির মতো দুর্গার ক্ষীণ কটি ধরল আঁকড়ে। স্ক্রু-আঁটা-যন্ত্রের মতো দুর্গা প্রায় অনড়, নিশ্চল।
ব্যর্থ প্রচেষ্টায় দুর্গা ঠোঁট কামড়ে ধরে, সামনের অন্ধকারে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তবু যেন একটা শেষ চেষ্টা করে ঝাঁকুনি দিল। চিরঞ্জীব সামলে নিল।
দুর্গা বলল, এই বা কেমন ভাল স্বভাবের কাজ হচ্ছে?
চিরঞ্জীব বলল, বুঝে দ্যাখ?
–দেখছি।
আর একটা ঝাঁকুনি দিল দুর্গা। চিরঞ্জীব তৈরিই ছিল। সামলে নিল।
কিন্তু দুর্গার ফোঁসানি বাড়ল বই কমল না। বলল, স্বভাব মন্দ বলবে, আবার ধরেও রাখবে–এ কেমন ধারা? নামতে দাও আমাকে। আমি যাব না তোমার সঙ্গে।
বলে দুর্গা বারে বারে ঝাঁকুনি দিতে লাগল। ক্রমে কঠিন হয়ে উঠল সাইকেল ঠিক রাখা।
চিরঞ্জীব আরও শক্ত হয়ে দম আটকানো গলায় বলল, পড়বি, পড়ে হাত পা ভাঙবি।
–ভাঙি ভাঙব, তোমার তাতে কী? নাম্মিয়ে দাও।
চিরঞ্জীব শান্ত গলায় বলল, বাড়ি গিয়ে নামবি। এসে গেছি। ওই তো দেখা যায়।
নামা যে সম্ভব নয়, এ কথা প্রথম থেকেই জানত দুর্গা। তবু সে আর এক মুহূর্তও থাকতে চাইছিল না চিরঞ্জীবের সান্নিধ্যে। বাড়ির দিকে নজর পড়তে সে আর কিছু বলল না। চিরঞ্জীব একেবারে উঠোনে এসে নামল সাইকেল থেকে। দুর্গা দ্রুত উঠোন পার হয়ে দাওয়ায় উঠে ঝনাৎ করে শিকল খুলল। ঘরে ঢুকে অন্ধকারে একটি কোণে বসে রইল চুপ করে।
গুলি ভেসে উঠল অন্ধকার উঠোনে। দুজনকেই ফিরে আসতে দেখেছে সে। জিজ্ঞেস করল, জলগুলোর কী ব্যবস্থা হল চিরোদা? ধরা পড়ে যাবে না?
চিরঞ্জীব বলল, ব্যবস্থা একটা করেছি। গাড়ি থেকে জিনিস বার করে সতীশকে খালের ওপার করে দিয়েছি। বলেছি, চিতে পাড়ার ফটিকের ওখানে উঠতে। যদি হামলা না হয়, তবে ফটিককে নিয়ে শহরে চলে যাবে রাতারাতি। গজু গাড়ি নিয়ে যেমন যাচ্ছে, তেমনই যাবে।
ভোলা-কেষ্ট শুধু গাড়ি ধরবার কথাই ভেবেছিল। যদিও চিরঞ্জীব জানে না, ভোলা-কেষ্টর নাকি আজ মন বিগড়ে গেছে। তাই তারা আজ আর মাল ধরবে না। তারা দুজনেই শুয়ে আছে কালীতলায়। কিন্তু চিরঞ্জীব আগে থেকেই আন্দাজ করেছিল, ভোলা-কেষ্ট গাড়ির পিছন ছাড়বে না। দরকার হলে ওরা শহর অবধি ধাওয়া করবে। তাই সে ব্যবস্থা পাকাপাকি করেই ন্যাড়াকালীতলায় গিয়েছিল।
গুলি বলল, যাক, তা হলে ব্যবস্থা একটা হয়ে গেছে। কাসেম শালা একটা চক্কর মেরে গেছে এদিকে। আমি তো ভাবলুম, তোমাদের সঙ্গে পথেই দেখা হয়ে যাবে।
–দেখা হলেই বা কী হত?
–তবু একটা মানে তোমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখলে আবার নানানখানা ভেবে বসত।
-বসত তো বসত।
কথার ভাবেই বুঝল গুলি, চিরঞ্জীবের মেজাজ ভাল নেই। বলল, তোমাদের ঝগড়া হয়েছে নাকি?
চিরঞ্জীব মুখ বিকৃত করে বলল, কে জানে কী হয়েছে? আর ভাল লাগে না। তুই বাড়ি চলে যা। কাল সকালে জটাকে একবার দেখা করতে বলিস।
গুলির বয়স বেশি নয়। বছর আঠারো-উনিশ হবে। এই গ্রামেরই ছেলে কিন্তু জল খেয়েছে অনেক ঘাটের। নামের পিছনে ইতিহাস লুকোনোই আছে। কালো কুচকুচে রং, আর গুলির মতো ছোট একটুখানি। ছেলে কামারবাড়ির। গুলি ছাড়া এখন বংশটাই লোপ পেয়েছে। হাটেবাটে ঘুরে কেমন করে বেঁচে গেল সেইটা বিস্ময়। এখন বেঁচে থাকাটা আর বিস্ময় নয়। এখন দেহে বড় হয়েছে, শক্তিও কম ধরে না। আজ জীবনের সব ঘাট-অঘাট সমান হয়ে গেছে। সংসারে গুলিদের সৎ হয়ে বাঁচার উপদেশ দেবার সাহস কারুর নেই। সৎভাবে মরবার পদ্ধতিটাও শেখেনি। কারণ, শেখায়নি কেউ। জীবনে শ্রদ্ধা নেই। বাঁচার আকাঙক্ষাটুকু মরে না। সংসারের কতগুলি মিল-অমিলের দুর্বোধ্য বোঝা নিয়ে, একটা সমূহ আবেগ চলে বেড়ায়।
কেন যে ও গ্রামে ফিরে এসেছিল, নিজেই জানে না। বোধহয় ওর অবচেতন মনে একটি অস্পষ্ট ভাবনা দেখা দিয়েছিল। এ সংসারের প্রতি কোনও একটি বিক্ষুব্ধ ব্যথাহত মুহূর্তে, বাপ-মায়ের সান্নিধ্যের জন্য মন ছটফটিয়ে উঠেছিল। বাপ-মা তো মারা গেছে অনেকদিনই। তবু হারিয়ে-যাওয়া ভিটে আর গ্রামে এলে, তাদের যেন কাছাকাছি মনে হয়।
এসে আর যাওয়া হয়নি। অকুর দে বলে, শালা বেইমান ছোঁড়াটাকে আমিই পিকআপ করেছিলুম। অর্থাৎ অকুর দে-ই প্রথম তাকে এ-পথে এনেছিল, দলে ভিড়িয়েছিল। না খেয়ে না মরুক, গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হত সেদিন গুলিকে। কিন্তু বাঁদরকে নাকি মুলো ক্ষেত দেখাতে নেই। প্রমাণ, গুলি চিরঞ্জীবের দলে যোগ দিয়েছে।
ওকুর দের আফশোস অকারণ নয়। সে জানে, তার পিকআপটা বারুদের মতো কাজ দিয়েছিল তাকে। কিন্তু চিরঞ্জীবের দলে স্বাভাবিক টানে যোগ দিয়েছিল গুলি। ওকুর দে ছিল বাবু। চিরঞ্জীব চিরোদা। বয়স আর সম্পর্কই শুধু নয়, স্নেহের ছিটেফোঁটাও কিছু ছিল বোধ হয়। যেটুকুর জন্যে গুলি আশৈশব লালায়িত। গুলির আশ্রয়ও মিলেছে চিরঞ্জীবদের বাড়িতেই। খাওয়াটা যদিও নিজের করে নেওয়ার কথা, অধিকাংশ দিনই সেটা এদিক-ওদিক করে হয়ে যায়। কখনও দুর্গার কাছে। কখনও চিরঞ্জীবের মায়ের কাছে। ওই দুজনের মর্জি এবং সুবিধে মতোই জোটে। কিন্তু ভাগাভাগি করে জুটে যায় ঠিকই। আশ্রয়টাও তার ভাগাভাগির মধ্যে। মাঝে মাঝে দুর্গার কাছেও থাকে সে।
গুলিকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিরঞ্জীব বলল, কী হল? দাঁড়িয়ে রইলি যে? খাবি নাকি এখানে?
গুলি বলল, না। একটা কথা বলছিলুম চিরোদা। জটা তোমাকে ডোবাবে। কলোনির বীণাকে নিয়ে একটা গণ্ডগোল হয়ে যাবে কোন দিন।
চিরঞ্জীব শান্ত গলাতে বলল, জানি। সেইজন্যেই জটাকে কাল দেখা করতে বলেছি।
গুলি চলে গেল। তার যাওয়ার ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল আরও কিছু বলতে চাইছিল সে। চিরঞ্জীব সিগারেট ধরালে একটা। ফিরে তাকাল একবার অন্ধকার ঘরের দিকে। মুখ ফিরিয়ে, আরও কয়েক মুহূর্ত পর দাওয়ায় এসে উঠল সে। ঘরের অন্ধকারকে লক্ষ করে বলল, অন্ধকারে বসে আছিস কেন? বাতি জ্বেলে খেয়ে শুয়ে পড়।
বলে আরও একটু সময় দাঁড়িয়ে রইল। তারপর দাওয়া থেকে নেমে এসে, সিগারেটটা ফেলে, সাইকেলে হাত দিল।
দুর্গা বেরিয়ে এল দাওয়ায়। বলল, যাচ্ছ কোথা?
চিরঞ্জীব উঠোন পার হতে হতে বলল, বাড়ি।
দুর্গা পিছনে পিছনে এসে বলল, বাড়ি যাচ্ছ কী রকম? রান্না করতে বলেছিলে যে?
চিরঞ্জীব বলল, করেছিস কি না তা জানব কেমন করে? তখন থেকে তো ফোরকে রইছিস।
দুর্গাও কম যায় না কিছু। বলল, তা কী জানি। আজ আমার হাতে খেলে তোমার জাত যাবে কি না কে জানে?
চিরঞ্জীব ঠোঁট কুঁচকে বলল, তাই নাকি?
দুর্গা বলল, তাই তো। তা পাপ তো নিজের ইচ্ছায় করি নাই, তুমি খেতে চাইলে, না রেঁধে উপায় কী?
চিরঞ্জীব বলল, শাঁখের করাত বল? যেতেও কাটে আসতেও কাটে। তা এ সব ধম্মোজ্ঞানটা অন্য সময় থাকে কোথায়?
চিরঞ্জীব দুর্গার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, কতদিন না তোকে বারণ করেছি, তুই যেখানে-সেখানে ওরকম ঝাঁপিয়ে পড়বিনে? তুই জানিস, তোর ওপর সকলের ঝোঁক বেশি, ধরতে পারলে আর রক্ষে নেই।
–তা নিজের জন্যে যাই নিকি?
–না হয় পরের জন্যই যাস। কিন্তু এই পরোপকার না করলে নয়?
চিরোঠাকুরের এ কেমন ধারা যুক্তি, দুর্গার মগজে ঢোকে না। নিজের জন্যে নয় মানে কী, দুর্গা একেবারে নিজেকে বাদ দিয়ে কি বলছে? সে অন্ধকারে চিরঞ্জীবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি নিজে যখন ঝাঁপিয়ে পড়ো, তখন কার কথা শোনো শুনি? ছামুখে এটটা বেপদ দেখলে কেউ চুপ করে থাকতে পারে? তুমি নিজে পারো?
কথাটা মিথ্যে না। চিরঞ্জীব নিজের কানে শুনলে আজ স্থির থাকতে পারত না। একটা কিছু করতে হত তাকে। মুখে সে যাই বলুক, অন্তরে জানে, দুর্গা মাঝখানে গিয়ে না পড়লে, এতক্ষণে ভোলা-কেষ্ট কাজ হাসিল করে ফেলত। আর জিনিস ধরা পড়লে যে চিরঞ্জীবের অবস্থা কেমন হয়, সে অভিজ্ঞতা থেকে দুর্গা বঞ্চিত নয়। যদিও সে অভিজ্ঞতার দায় থেকে মুক্তির জন্যেই দুর্গা ঝাঁপিয়ে পড়েনি আজ! এইটিই দুর্গার আসল পরিচয়। তার চরিত্রের রীতি। নিজের করণীয় কিছু থাকলে যে-কোনও অবস্থার সামনে সে ছুটে যাবে।
চিরঞ্জীব তা ভাল করে জানে। বোধহয় সবচেয়ে বেশি জানে। আর ডাকাবুকো নির্ভীক চিরঞ্জীবের মনে তাই ভয়। দল তার অনেক বড়। সকলের সঙ্গে তার সমান সম্পর্ক নয়। কিন্তু অধিকাংশের সঙ্গেই তার প্রীতি ও ভালবাসা আছে। তবু চিরঞ্জীবের এ-ভয়ের লীলা বড় বিচিত্র।
চিরঞ্জীব বলল, সবই তোকে পারতে হবে এমন কোনও কথা আছে নাকি?
দুর্গা জবাব দিল, সব পারার কথা বলছেটা কে? যা পারি তাই করি। দলে যখন আছি, তখন করব বইকী। না যদি করতে দাও, তবে বিদেয় করে দাও।
ও কথা শুনলে আবার চিরঞ্জীবের রাগ হয়। বললে, বিদেয় নেবার বুঝি বড় ইচ্ছে তোর?
দুর্গা বলল, ইচ্ছেটা তোমার না আমার তুমিই ভেবে দেখো।
–আমি তো দেখি তোরই ইচ্ছে।
–তা বটে। মন তো কেউ দেখতে পায় না।
বলে অন্ধকারে দুর্গা আর একবার চিরঞ্জীবের চোখের দিকে তাকাল। তারপর মুখ নামিয়ে পিছিয়ে এল দু পা।
চিরঞ্জীব জানে দুর্গার মুখ এবার ভার হয়ে উঠেছে। রাগে নয়, অন্য কারণে। চিরঞ্জীব নিজেও একটি চকিত মুহূর্তের জন্য গম্ভীর হয়ে উঠল, মন বুঝি তুই একলা দেখতে পাস?
দুর্গা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, আমার আবার মন, আমার আবার চোখ! রাত হয়েছে অনেক, খেয়ে নাও।
চিরঞ্জীব সাইকেল নিয়ে দাওয়ার দিকে যেতে যেতে বলল, আসল ব্যাপারটা অন্যরকম। ভোলা-কেষ্ট তোর পুরনো বন্ধু। ওদের কথা শুনলে ঘরে থাকতে পারিসনে।
এতক্ষণে বৈশাখের বাতাস-দোলা অন্ধকার রাত্রিটা দুর্গার খিলখিল হাসিতে শিউরে উঠল। সহসা সেই হাসির লহরে, বুঝি চমকে-ওঠা পাখি একটা ডেকে উঠল পিক পিক শব্দে। পাশের বাড়ির কুকুরটা ডেকে উঠল দুবার ঘেউ ঘেউ করে।
চিরঞ্জীব শাসিয়ে উঠল, এই, এই দুর্গা, এত রাত্রে অমন করে হাসছিস কী? পাড়ার লোক জেগে যাবে না?
দুর্গা গলা নামালেও, হাসি তার সহজে বন্ধ হতে চায় না। বলল, এতক্ষণে এটা কথার মতো কথা বলেছ চিরোঠাকুর। পুরনো বন্ধু কেন, প্রাণের ইয়ার পঞ্চাতেলী। সত্যি, তাদের নাম শুনলে কি ঘরে থাকা যায়?
বলতে বলতে ঘরে ঢুকে, দেশলাই খুঁজে বার করল দুর্গা। চিরঞ্জীবও পিছন পিছন এসে ঢুকল। বলল, হাসছিস যে? ভোলা-কেষ্টর নাম শুনলেই ছুটে যাস বুঝি না তুই?
ফস করে দেশলাইয়ের কাঠিটা জ্বলে উঠল দুর্গার হাতে। কিন্তু দুর্গার মুখে তখন কথা। কথার ঘায়ে মূর্ছা গেল আলো। দুর্গা বলল, যাই-ই তো। যেখেনে জোঁক, সেখেনেই নুন, না গেলে চলবে কেমন করে?
পায়ে পায়ে দুর্গার কাছে এসে দাঁড়াল চিরঞ্জীব। বলল, ঠাট্টা নয়। একদিন কোন নুনের মুখে কে যে জোঁক হয়ে বসে থাকবে, তখন আর রক্ষে থাকবে না। জিনিস ধরা পড়বে কি না পড়বে, সে কথা ভাবিনে। কত বিপদ-আপদ হতে পারে।
আবার দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলেছিল দুর্গা কিন্তু চিরঞ্জীবের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে, সেই মুহূর্তেই হিসিয়ে উঠল সে, ইস! মুরোদ বড় মান, তার ছেঁড়া দুটো কান! আমার দেখা আছে।
–তোর সবই দেখা আছে, না?
বলে, চিরঞ্জীব নিজেই দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে হ্যারিকেনটা ধরাল এবার।
সিকার ওপর থেকে ভাত-তরকারি নামাতে নামাতে জবাব দিল দুর্গা, অত শত আমি জানি না। যা করবার তাই করেছি। যে বিচার তোমার মন চায় করো। এখন রাত হয়েছে, খেয়ে নাও।
থালায় ভাত বেড়ে, জল গড়িয়ে দিল দুর্গা। রান্না জিনিসপত্র সব এগিয়ে নিল কাছে।
চিরঞ্জীব বলল, বিচারের কথা তো বলেছি। এ ভাবে তুই যেখানে-সেখানে ছুটবিনে আর।
–আর ছুটলে?
–অ্যাদ্দিন যা করিনি, তাই করব। ধরে তোকে ঘা কয়েক দিয়ে দরজা বন্ধ করে রেখে দেব।
দুর্গা হাসতে হাসতে প্রায় ঢলে পড়ল। বলল, নতুন কথা শোনালে দেখছি।
–কেন নতুন কথা হল কীসে?
–যেন তুমি আমাকে মারো নাই কোনওদিন। ওকুর ব্যাটা এয়ে যিদিন খারাপ খারাপ কথাগুলো বলেছিল, সিদিনে ওকে ইট ছুঁড়ে মেরেছিলুম বলে, তুমি আমার চুল ধরে টানো নাই? আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দাও নাই দাওয়ায়?
চিরঞ্জীব যেন বিস্মৃতপ্রায় ঘটনাকে মনে করবার চেষ্টা করছে। আসলে মনে তার পড়েছে ঠিকই। বরং একটু অস্বস্তি বোধ করছে।
দুর্গা ঠোঁট উল্টে, চোখ ঘুরিয়ে একটু বিদ্রূপের রসান দিয়ে বলে, মনে পড়ছে না? বেশিদিনের কথা নয়। মাস ছয়েক হবে। আমি বলেছিলুম, আমার বাপ আমাকে কোনওদিন মারে নাই বড় হওয়া ইস্তক। আর তুমি আমাকে মারলে? আমি তোমার মুখো দশ শন করব না।
–তা আবার দর্শন করেছিলি কেন?
–গুলিকে পাঠিয়ে খোশামুদ করেছিলে। তাতে হয় নাই, তারপর নিজে এসেছিলে, মনে নাই?
–তা কথা হচ্ছিল, কথা শুনিয়ে দিয়েছিলি। অত বড় ইঁট মেরে লোকটার কাঁধ ফুলিয়ে দিয়েছিলি, তোকে মারব না? মামলা-মোকদ্দমা করত কে?
–তা বললে কী হবে? ও সব খচ্চর মিনসের বুকে বসে নোড়া থেতো করা দরকার।
বটেই তো। নইলে ফাঁসি যাবার সুবিধে হবে কেমন করে? নে নে, খেতে দে।
–তবে যে বলছ, মারবে? মেরেছ তো আগেই। ঘরের দরজাটা অবিশ্যি বন্ধ করে রাখো নাই।
এবার তাই রাখব। আর মারও যে সে মার নয়। এ্যায়সা ঠ্যাঙানি দেব, তখন দেখিস।
দুর্গার সঙ্গে চকিতে একবার চোখাচোখি হল চিরঞ্জীবের। দুর্গার চোখে ঠোঁটে বিদ্যুত-ঝিলিকের মতো হাসি দেখা দিল। বলল, তাই দিয়ো। দাঁড়াও আসনটা দিই—
–থাক।
চিরঞ্জীব লেপা মেঝেতেই থেবড়ে বসল। হাত ধোবার নাম পর্যন্ত নেই। ভাতে হাত ঢুকিয়ে দিল সে! তার উশকোখুশকো চুল, ময়লা ময়লা জামাকাপড়। সাইকেল চালিয়ে ধুলোভরা পা, সব কিছুর সঙ্গে থালা বাসনগুলিরও কোনও মিল নেই। মানুষের জীবন বোধ হয় এইখানেই বিচিত্র। দুর্গার জীবনের সঙ্গেও থালা-বাসন-ব্যঞ্জনের কোনও মিল নেই। সেগুলি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে। সযত্ন হাতের নিয়ত স্পর্শ ছাড়া এমনটি সম্ভব নয়। পটু হাতের রান্না এমন সতর্ক প্রহরায় না থাকলে, রান্না খাওয়ার শুচিটুকু থাকে না। কিন্তু এ ঘরের বাসিন্দার জীবনের সঙ্গে, ওই মনটা খুঁজে পাওয়া দায়। মিল-অমিলের সংমিশ্রণ আছে বলেই বোধ হয় বৈচিত্র্য আছে সংসারকে ঘিরে।
দুর্গার বাবা বেঁচে থাকতে ঘরের চেহারা এমনি ছিল। আজও আছে। কিন্তু দুনিয়ার লোক জানে, দুর্গা আর সে দুর্গা নেই। লোকে বলে, হ্যাঁ, বাঁকা বাগদির বেটি বটে। সেটা আগেকার অর্থে নয়। খরখরে চোপাউলী ডাকিনী মেয়ে বলে নয়। অন্য অর্থে! যে অর্থে লোকে সর্বনাশের কথা বলে। মাতি মুচিনীর ভাষায়, সারা পিরথিমীতে এত বড় মেয়ে-ডাকাত নাই। এত বুকের পাটা আর দেখা যায়নি কোথাও। আইবুড়ো নাম ঘোচেনি দুর্গার। কিন্তু অরক্ষণীয়া আর কেউ বলে না তাকে। যে পিঁপড়েরা একদিন অবিশ্রান্ত আছিল তাকে ঘিরে, আজ তারা থতিয়ে গেছে। থতিয়ে গেছে চিরঞ্জীবকে দেখে। মাতি মুচিনী বলে, ডাকা পেয়েছে ডাকিনী। একা রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর। ও মেয়ে ইচ্ছে করলে, রাত করে গোটা গাঁয়ের ঘরে ঘরে শেকল তুলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে।
যদিও মাতি মুচিনী নিজেও দুর্গার চোলাই রসের চালানদারনি হয়েছে আজকাল। এটাও সংসারের বৈচিত্র্যের মধ্যেই পড়ে। তবে মাতি মুচিনীর মনে যদি কেউ কান পাতে, তা হলে শুনতে পাবে, দুর্গাকে তার কত ভয়, কত ভক্তি। দুর্গা তার সারা জীবনের অনেক দেখার একমাত্র বিস্ময়।
সেই ভয়-বিস্ময়টা আজ গোটা অঞ্চল জুড়েই। মাতির মতো ভক্তিও তাকে অনেকে করে। এটাও সংসারের একটি বৈচিত্র্য। সুরেশবাবু মিথ্যে বলেননি, দুর্গা আজ কিংবদন্তির নায়িকা। মাঠেহাটে, দোকানে, গোরুর গাড়িতে, গল্প-গুজবের মধ্যে দুর্গার আলোচনা আকছার। বউ-ঝিদের গুলতানির মধ্যে দুর্গার নাম ওঠে বারে বারে। সেই সব আলোচনা-গুলতানির মধ্যে অনেককেই হলফ করে বলতে শোনা যায়, অলৌকিক মায়া জানে দুর্গা। শুধু যে ভয়মিশ্রিত বিস্ময়ের সুরে দুর্গার কথা বলে তারা, তা নয়। দুর্গার মধ্যে তারা তাদের অবদমিত বাসনা চরিতার্থতার প্রকাশ যেন দেখতে পায়। সেটা যত বিকারগ্রস্তই হোক তবু সেটা হল দুর্গার দুর্জয় সাহস। একটা সর্বনাশের মধ্য দিয়ে জীবনধারণ। আর চিরোঠাকুরের মতো লোককে আঁচলে বেঁধে রাখা। লোকে ওইভাবেই দেখে। তার কারণ, তার যত দেবীত্ব কিংবা অপদেবীত্ব, সবটাই চিরঞ্জীবের মতো দেবতার পরিমণ্ডলেই কল্পিত। আরও ভীত ও খুশি তারা দুর্গার স্বচ্ছন্দ বিহার দেখে। দুর্গা যে নিপাটে ভাঁজ হয়ে নেই, দাপটে বাঁচছে, এইটাই যেন তাদের বাসনার রূপ। মাতি মুচিনীদের যৌবনের কিংবা আজকের গানি মুচিনীর মতো দুর্গা তাদের কাছে দেহপোজীবিনী স্বৈরিণী নয়।
কথায় বলে, যা রটে, তার কিছু বটে। কিন্তু যা ঘটনা, রটনা যে তার চেয়ে বেশি, এখন দুর্গাকে দেখলে সেই কথাই মনে হয়। দুর্গা শুধু সারা জীবন এমনি করে বসে থাকতে চেয়েছে। এমনি করে তার স্বাভাবিক ভঙ্গি মুখের ওপর আঁচল তুলে, একটু অন্ধকার বেছে নিয়ে, অস্পষ্ট আড়াল থেকে দুচোখ মেলে এমনি চেয়ে চেয়ে দেখতে চেয়েছে একজনকে।
খেতে খেতে হঠাৎ খাওয়া থামাল চিরঞ্জীব। ভ্রূ কুঁচকে বলল, ওরকম তাকিয়ে থাকিসনে তো। আমার বড় গায়ে বেঁধে।
দুর্গা চমকে উঠে বলে, ওমা তাকিয়ে আছি কোথা?
আমি বুঝি জানি নে? ওরকম তাকিয়ে থাকিসনে আমার দিকে।
আসলে এই উষ্মা লজ্জা থেকে। এবং চোখে না দেখলে, কানে না শুনলে, মাত্র তেইশ বছরের বে-আইনি চোলাই স্মাগলার দুরন্ত ও দূর্ধর্ষ চিরঞ্জীবের এই বিচিত্র লজ্জা বিশ্বাস করা যায় না। যার সঙ্গে তার কোনও লজ্জার বালাই নেই, তারই চোখের চাউনিতে তেইশ বছরের পুরুষের এই লজ্জা অভাবিত। কিন্তু মিথ্যে নয়।
দুর্গা রাগ করল না। বরং আঁচলে ঠোঁট চাপা থাকলেও, তার চোখ দেখে বোঝা গেল, হাসছে। সে। বলল, কেন, চোখে কি আমার ছুঁচ আছে যে বেঁধে।
চিরঞ্জীবকে যেন ছেলেমানুষ বোধ হয়। বলল, কী জানি। আমার গায়ের মধ্যে যেন কী রকম করতে থাকে। তুই যেন কী!
দুর্গা এবার সশব্দে হেসে উঠল। বলল, কী আমি?
কী জানি আমি বুঝিনে।
দুর্গার শরীরের কাঁপুনি দেখলেই বোঝা যায়, হাসি সামলাতে পারছে না সে। একটু পরেই বলল, তুমি যখন তাকিয়ে থাকো তখন?
–আমি আবার কখন তাকিয়ে থাকি?
–মনে করে দেখো। তখন আমারও তোমার মতন হয়।
ওরা দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদের দুজনের মধ্যেই যেন কেমন করে। কিন্তু কেন তাকিয়ে থাকে আর কেমন করে, ওরা তা জানে না। বছর ঘুরে চলেছে, ওরা প্রায় একসঙ্গেই আছে। ওদের যা কাজ, সেই কাজ করে। হাসে, ঝগড়া করে, এমনি খাওয়ানো আর খাওয়াও প্রায় রোজ দাঁড়িয়েছে। তবু ওরা যেন জানে না, ওদের মন-প্রাণের স্বরলিপি কোন পর্দায় বাঁধা। কেন ওরা মাঝে মাঝে নিরালা চায়। আর যদিও বা পায়, সেই নিরালা মুহূর্তগুলি কেন ঘূর্ণি জলের আবর্তের মতো পাক খেতে থাকে। সৃষ্টি করে দহ। একটা স্রোতের ধারা খুঁজে পায় না।
লোকে জানে, ওদের সম্পর্কের মধ্যে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। ওটা এখন তর্কেরও অতীত। শুধু ওরা দুজনেই তা জানে না।
কারণ, ওদের দুজনের বিষয় যে কথা বলার চেয়ে বেশি, সেই বিষয়টাই একটা দুর্লঙঘ না বলার সীমায় ওদের দুজনকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ওরা একজন ডাকা, একজন ডাকিনী। চলতি প্রবাদটা যারা গা পেতে নিয়েছে লজ্জা ঘেন্না ভয়, তিন থাকতে নয়। কিন্তু এই ডাকা আর ডাকিনীটা একটি ফাঁদের মায়ায় বোবা হয়ে তাকিয়ে আছে পরস্পরের দিকে। কেন, ওরা জানে না। সেটা ওদের লজ্জা নয়, ভয় নয়, ঘেন্না নয়। সেটা ওদের অচেনা অবলা দুর্নিরীক্ষ্য অস্পষ্ট সীমা। যে সীমাটাকে লোকে দেখতে পায় না, ওরা দুজনে তার চারপাশে, কাজে-সাজের নানান লীলায় ঘুরে কিংবদন্তি সৃষ্টি করছে।
জেল মামলা ছাড়াও ওদের জীবনধারণের ঘেরা গলিটা কানা কি না, সেই পরিণতিটাই যেমন জানে না ওরা, তেমনি ওরা জানে না নিজেদেরই পরিণতি।
তাই বোধহয় ওরা এখনও মারামারি চেঁচামেচি করতে পারে। দুজনে দুজনকে যা খুশি বলে আক্রমণ করতে পারে চুক্তিহীন ভাবে। যে-কোনও মুহূর্তেই ছেড়ে যেতে পারে দুজন দুজনকে।
তবু যে-ফাঁদটায় ওরা ধরা পড়েছে, সেখান থেকে ওদের মুক্তি নেই। চিরঞ্জীব দুর্গার কথার খেই টানল। বলল, হয় তো বলিস না কেন? তা হলে আর তাকাব না তোর দিকে।
দুর্গার মুখে একটু ছায়া সঞ্চারিত হল। বলল, তাকিয়ো না। তাতে কী আমার হবে শুনি?
বলে দুর্গা আর বেড়ায় হেলান দিয়ে রইল না। একেবারে ধপাস করে শুয়ে পড়ল মাটিতে। আঁচলটা যেন গড়িয়ে গেল কোন দিকে। শুধু লাল ছিটের জামার ঊর্ধ্ব বাঁকে হ্যারিকেনের আলো একটি সর্বনাশের দ্যুতিতে দপদপ করতে লাগল। মাথার নীচে কুণ্ডলী পাকানো একরাশ কেউটের মতো এলিয়ে রইল চুল।
চিরঞ্জীব সেইদিকে একবার দেখে বলল, তোরা মেয়েছেলেগুলো যেন কেমন।
দুর্গা বলল টিপে টিপে, মন্দ তো? মেয়েছেলের সঙ্গে মেশো কেন?
চিরঞ্জীব বলেই চলেছে, এ দুটো কথা বলে, সে দুটো কথা বলে।
দুর্গাও খুব নীরস নির্বিকার গলায় জবাব দিল, বলবেই তো! তুমি আমাকে সোনার গয়না দাও, রানির মতন আদরে রাখো। বলবে না?
–আর ফুল বিছিয়ে দিইনা তোর পায়ের তলায়?
–লোকে তো তাই বলে। এই তো সেদিনেও মাতি বুড়ি হাটে দাঁড়িয়ে বলে এয়েছে, সে স্বচক্ষে দেখেছে, মাঝ রাতে নিকি বাঁকা বাদির উঠোনে শেতল পাটি পেতে বসেছিল চিরোঠাকুর। আর তার বুকের মাঝখানে মাথা রেখে গুনগুন করে গান গাইছেল দুগগা।
বলছিল, না?
চিরঞ্জীবের গলায় রাগ ফুটল এবার।
কপালের ওপর হাত রাখায় দুর্গার মুখ অন্ধকার। শুধু লাল কাঁচের চুড়িগুলি বিন্দু বিন্দু জ্বলছে। বলল, হ্যাঁ বলছেল! আরও কত কথা বলছেল। চিরোঠাকুর দুহাতে জড়িয়ে ধরে দুগগাকে সোহাগ করছেল। আর দুগগা চিরোঠাকুরের মুখে পানের খিলি পুরে দিচ্ছেল।
চিরঞ্জীব প্রায় লাফিয়ে উঠে আর কী। বলল, মিথ্যুক বুড়িটার মুণ্ডুটা এবার ধড়ছাড়া করে ছাড়ব আমি।
এবার দুর্গা মুখ ফেরাল আলোর দিকে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, বটে? এনে দেব কাটারিখানা? এনে দেই কেমন?
চিরঞ্জীব একমুহূর্ত থতিয়ে গিয়ে, দুর্গার দিকে একটু তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ও তুই ঠাট্টা করছিস?
-ঠাট্টা কোথায় দেখলে! সত্যিই তো। আর বলবে না বা কেন?
–কেন?
–তুমি আসবে কেন মেয়েছেলের কাছে? আসবে কিন্তুন দুন্নাম শুনবে না, তা কি হয়?
চিরঞ্জীব ঝাঁঝিয়ে উঠল, দুর্নামের ভয় করছে কে? সে ভয় থাকলে কি আর এ লাইনে এসেছি? কিন্তু ওবুড়ি মিছে কথা বলবে কেন?
দুর্গা কথায় খুব শান্ত। কিন্তু শান্ত কথাগুলির মধ্যে বারুদ ছিল প্রচুর। বলল, আহা, চটছ কেন? সে কথা তো হচ্ছে না, কোন লাইনে এয়েচ আর আসো নাই। কথা হচ্ছে মেয়েছেলে নে। তুমি নিজেই বলছ, জনে জনে নানান কথা বলে। সবাইকে গে মুণ্ডু কাটো।
চিরঞ্জীবের নিজেরও মনে হল, তার রাগটা যেন ঠিক রাগের মতো হচ্ছে না। বরং সন্দেহ হল, দুর্গা-ই রেগেছে। সে বলল, তোর বোধহয় এ সব শুনলে রাগ হয়, না?
–না।
-কেন?
–কেন হবে? ব্যাটাছেলের সঙ্গে মিশে চোলাই কারবার করি, দশজনে দশকথা বলবেই তো?
চিরঞ্জীব বলল, হ্যাঁ, তোর তো ও সব জল-ভাত। গা-সওয়া হয়ে গেছে।
দুর্গা একবার চোখ তুলে তাকাল চিরঞ্জীবের দিকে। তারপর একেবারে অন্ধকারের দিকে পাশ ফিরে শুল।
চিরঞ্জীব বলল, কী হল?
অন্ধকার থেকেই চাপা স্বর ভেসে এল দুর্গার, কী আবার! আমি মেয়েছেলে, তায় বাগদিদের মেয়ে, তাই মন্দ। আমার তো ও সব গা-সওয়া হবেই। তোমরা ভাল, তাই তোমাদের পটপটানি দেখছি।
চিরঞ্জীব ততক্ষণে আঁচাতে চলে গেছে। ফিরে এসে বলল, নে, এবার খেয়ে নে।
–খাবখনি তুমি যাও।
চিরঞ্জীব সিগারেট ধরাতে গিয়ে থেমে গেল। খেঁকিয়ে উঠল প্রায়, ওঠ ওঠ খেয়ে নে।
দুর্গাও ফুঁসে উঠল, মেলা ধমকাচ্ছ কেন? তুমি বাড়ি যাও না, আমি যখন খুশি খাব।
চিরঞ্জীব ভ্রূ কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল দুর্গার দিকে। চুলগুলি এলিয়ে পরে, পুরোপুরি গ্রীবা দেখা যাচ্ছে দুর্গার। জামাটা অনেকখানি উঠে গেছে পিঠের দিকে। চিরঞ্জীব তার শক্ত হাত দিয়ে টানতে গিয়ে দেখল, দুর্গা তার চেয়েও বেশি শক্ত হয়ে আছে। আবার বলল সে, উঠবি ভালয় ভালয়?
দুর্গার সেই একই জেদি জবাব, তুমি যাও না কেন?
কথা শেষ হবার আগেই চিরঞ্জীব তাকে এক হ্যাঁচকায় টেনে তুলে বসিয়ে দিল। দুর্গা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল, উঃ!
আর এক হেঁচকায় একেবারে দাঁড়িয়ে পড়ল দুর্গা। এবার আরও জোরে আর্তনাদ করে উঠল দুর্গা, উঃ! কবজিটা ভেঙে দিলে আমার।
পরমুহূর্তেই চিরঞ্জীবকে ধাক্কা দিয়ে, ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিল সে।
অন্য কেহ হলে এ ধাক্কা সামলাতে কতখানি ঘায়েল হত বলা যায় না। চিরঞ্জীব সহজেই সামলে নিল। বলল, যা, খেয়ে নিগে যা।
দুর্গা ফুঁসে উঠল, আমার যখন খুশি খাব, তোমার কী? যা খুশি তাই বলে হেনস্থা করবে, আবার জোরও খাটাবে? ভেবেছটা কী? তোমার মনের কথাটা কী? আমাকে এটটা হ্যাংলা পেয়েছ?
–মানে?
মানে ভেবে দেখো গে। যেন চিরোঠাকুরের পেছু পেছু আমি হ্যাংলাপনা করে মরছি। তাই তো বলছ তুমি।
সে কথা আমি বলেছি, না তুই বলছিস। আনসাটে তুই কী বলছিস, আমি বুঝি বুঝতে পারিনে? এ সব কথার মানে কী–মেয়েছেলের সঙ্গে মিশলে লোকে তো বলবেই। দুর্নাম তো হবেই। তার মানে, আমি খারাপ, খারাপ মতলব নিয়ে আমি তোর কাছে আসি, না?
রাগে ও বিস্ময়ে যেন কয়েক মুহূর্ত বোবা হয়ে রইল দুর্গা। তারপরে বলল, তুমি একখানি মিথ্যুক, ঘোর মিথ্যুক।
–হ্যাঁ, আর তুই সত্যবাদী।
চিরঞ্জীব সিগারেট ধরাল।
এত বাদানুবাদ, এত দোষারোপ আসলে ওদের ছলনা। এই ছলনাটাও ওরা জেনে করে না বোধহয়। যে দুর্লঙঘ না বলার সীমাটা ওদের মাঝখানে রয়েছে, সেই সীমাটা না পেরোতে পারার ক্ষোভে ওরা পরস্পরকে একটু খুঁচিয়ে নেয় মাঝে মাঝে।
দুর্গা এবার নিজে থেকেই খেতে বসে গেল।
চিরঞ্জীব হঠাৎ বলল, আমি একবার বাঁশঝাড়ের তলাটা দেখে আসি। জিনিসগুলো আবার ঠিক আছে কি না—
কথা শেষ হবার আগেই দুর্গা একেবারে যেন শিউরে উঠল। বলল, মাথাটা কি খারাপ হয়েছে নিকি?
–কেন?
নয় তো? এখন যাবে তুমি বাঁশ ঝাড়ে, জিনিস দেখতে? জানো না, ওখানে কী আছে? বলে ছাগল গোরুও ভুলে ওদিকে যায় না রাত করে। আর তুমি যাবে জিনিস দেখতে।
পকেট থেকে টর্চ লাইট বের করেছে চিরঞ্জীব। বলল ও সেই সাপটার কথা বলছিস?
দুর্গা ভয়ার্ত গলায় উচ্চারণ কর, আস্তিক আস্তিক আস্তিক, গরুড় গরুড় গরুড়। কোনও কথা আটকায় না, না? লতা বলতে পারো না রাত করে?
চিরঞ্জীব বলল তোর আবার যত ইয়ে। ধম্মো করবি, আবার অধম্মো করবি। বামুনের ছেলেকে রেঁধে খাওয়াতে পারিস, আর সাপকে লতা না বললেই–
–আঃ–
দুর্গা ঝামটা দিয়ে উঠল। বলল, মেলা বিদ্যে ফলিয়ো না তো ছোটঠাকুর, আমার গা জ্বালা করে। খাওয়ানোর সঙ্গে লতার কী আছে। খাইয়েছি, আমার পাপ হবে। তা বলে জেনে-শুনে নিগঘাত যমের মুখে যেতে হবে! তুমি যেতে পারবে না এখন উদিকে।
আবার বসে পড়ল চিরঞ্জীব। দুর্গা মুখে ভাত তুলতে গিয়ে থামল। বলল, আচ্ছা, বেশি রাত করে গেলে বুড়ো মায়ের কষ্ট হবে বলে তুমি এখানে খেলে। তো গুলিটাকে বাড়ি পাঠালে কোন আক্কেলে! সে-ই তো গে বুড়ো মানুষটাকে কষ্ট দেবে।
চিরঞ্জীব বলল, বাঃ, সন্ধেবেলা টাকা নিয়েছে আমার কাছ থেকে, বাইরে খাবে বলে। আর মাকে তো আমি রান্না করতেই বারণ করেছি।
বাইরে কী খাবে? ময়রার খাবার?
–তা কী জানি। ওর আবার কারা সব সাঙ্গ-পাঙ্গ আছে তো বাজারে। তাদের কাছে খাবে হয়তো।
–আচ্ছা শোনো–
চিরঞ্জীব ফিরে তাকাল। দুর্গা তখন খেতে শুরু করেছে। চিরঞ্জীব বলল, কাল কি ‘জাওয়া’ বসছে তা হলে?
–হ্যাঁ।
-কোথায়?
অঘোর কবরেজ মশায়ের বাড়িতে।
চিরঞ্জীব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দুর্গার দিকে। দুর্গা খেতে খেতে হাসল।
জাওয়া বসানো হল চোলাই করা। দেশীয় প্রথায় চোলাই করার বোধহয় প্রাগৈতিহাসিক যান্ত্রিক ব্যবস্থাটার নাম-ই জাওয়া বসানো।
যেন অনেকটা ভিয়েন বসার মতো। কিন্তু অঘোর কবরেজ মশায়ের বাড়িতে?
চিরঞ্জীব বলল, কী যা তা বলছিস? নির্ঘাৎ একটা ফাঁদে গিয়ে পড়বি। অঘোর কবরেজের বাড়িতে জাওয়া বসবে এ কখনও হয়?
দুর্গা বলল, এই নাও। বলছি, সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। মালমশলা সব পচছে আমার ওখেনে।
অঘোর কবরেজ জানে?
–তা জানে। কবরেজ-গিন্নি সেটা নিকি বলেছে কত্তাকে।
কী করে কথা হল?
রাঘব মিত্তিরের বাড়ি যে জাওয়া বসেছিল, গিন্নি সেটা টের পেয়েছে। আমাকে গিন্নি ডেকে বলেছে কয়েকদিন আগে, ও দুগগা আমাদের বাড়িতে চোলাই করিস। পাঁচটা টাকা দিস আমাকে। আমি বলেছিলুম, আচ্ছা।
–তারপর আবগারিতে খবর দিয়ে দেয় যদি!
মুখে ভাত তুলতে গিয়ে, থেমে বলল দুর্গা, তোমার যেমন কথা। মানুষ চিনি না আমি? কবরেজ মশায়ের তো আজ কত বছর ধরে আয় নাই। বড় ছেলে কোলকেতায় না কোথা থাকে। চাকরি করে, কিন্তুন আসা দূরের কথা, চিঠি দে খবরটাও নেয় না। উদিকে বের যুগ্যি মেয়ে ঝুলছে গলায় দুটি। আর যিটিকে সোয়ামি নেয় না, সিটিও তো দুটো বাচ্চা নে এখেনে রয়েছে।
কিন্তু চিরঞ্জীব ছাড়ল না। তাতে তোর কী সুবিধে হল?
সুবিধে অসুবিধে আবার কী? অবস্থা খারাপ বলে না সাহস করেছে। আর কবরেজ বাড়ি কি নতুন নিকি! কে কেমন, আমি সবই জানি। গিন্নি এতখানিও বললে, তুই আমার মেয়েদের দেখিয়ে দিস, তা হলেই হবে। ওরা সব করে দেবেখনি।
বলিস কী?
হ্যাঁ। আরও বললে, পেটে ভাত থাকলে ধম্মজ্ঞান থাকত। তোদের কবরেজ ঠাকুদ্দা তো ঠায় বসে আছে বলেই চলে। গাঁয়ে তো সবই মুখ শোঁকাশুঁকির ব্যাপার। সবার কথা-ই সবাই জানে। তবু মা তোকে দিব্যি দে বলছি, কোথাও যেন কিছু বলিস না। মেয়ে দুটোকে পার করতে হবে তো। লোকে আর কিছু না পারুক, দুর্নাম দিতে কসুর করবে না। তা’পর বললে, কোনওকালে তো বাইরে বেরুই নাই। ঘরে বসে যেটুকুন হয়, সেটুকুন আমাদের সঙ্গে মিলে করিস। তা আমি ভাবলুম সেই ভাল। আর মিত্তির বাড়ির ছোঁড়াগুলানকে বড্ড ভয় লাগে। কখন চেঁচিয়ে মেচিয়ে শোর তুলে দেবে, একেবারে হাটে হাড়ি ভাঙা।
চিরঞ্জীবের মুখে একটু চিন্তার ছায়া। অধিকাংশ চোলাই বনেবাদাড়ে হয়ে থাকে। আবগারির সন্দেহভাজন কারও বাড়িতেই চোলাই সম্ভব নয়। সেখানে নিয়ত সতর্ক চোখের পাহারা আছে। কান খাড়া আছে দেয়ালে বেড়ায়। এদিক দিয়ে চিরঞ্জীবেরা অনেকখানি নিশ্চিন্ত। গ্রামের যে-সব বাড়িতে তাদের কাজ হয়, সে-সব বাড়ি সম্পর্কে কারুর কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু মন কষাকষি হলেই সর্বনাশ। মিত্তিরবাড়ির লোকেরা রেগে গিয়ে খবর দিতে পারে। একটি ছেড়ে আর একটি ধরা, দুইয়েতেই বিপদ। নতুনকে ভয় না জানার। পুরনোকে ভয় ধরিয়ে দেবার।
দুর্গা বলল, কী হল? অমন গুম হয়ে রইলে যে?
চিরঞ্জীব এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, না, ঠিক আছে। সাবধানে থাকিস আমি চলি। ভোর রাত্রে আবার বেরুতে হবে। পাঁচ ঝাঁকা যাবে কাল কলকাতায়।
ঝাঁকা অর্থে সবজি আর তরকারির ঝাঁকা। এখানকার স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন শতাধিক তরকারির ঝাঁকা নিয়ে যায় চাষিরা। অনেক সময় শহরের ফড়েরাও মাল কিনে নিয়ে যায়। আর এ সব ঝাঁকায় মদ চালান যাওয়া কিছু গোপন ঘটনা নয়। এখন এটা পুরনো ফন্দি। যদিও, সহজ এবং সুবিধাজনক। এত ঝাঁকা যায় যে, সবাইকে দেখে, সার্চ করে ওঠাই মুশকিল। আর সবদিনই পুলিশের দৃষ্টি একদিকেই থাকে না। বিশেষ, আগে খবর না থাকলে, অধিকাংশই বেরিয়ে যায়।
দুর্গা বলল, সে কী কথা। আজ ধরা পড়েছে ওকুর দের দু-ঝাঁকা, আবার কালই পাঠাবে তুমি?
–হ্যাঁ, সে জন্যেই পাঠাব। ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আর শোন, কাল আমি কলকাতায় যাব মোটর গাড়ি নিয়ে। গাড়ি থাকবে চন্দননগরে। সেখান থেকেই উঠব। ফিরতে বোধহয় রাত হবে। তুই নিজে আর বেরুসনি কোথাও কাল।
চিরঞ্জীব উঠে দাঁড়াল। দুর্গাও তাড়াতাড়ি দাওয়ায় গেল ঘটি নিয়ে। মুখ ধুয়ে আবার ঘরে এল। চিরঞ্জীব গেল বেরিয়ে। গিয়ে দাঁড়াল একেবারে দাওয়ার নীচে। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল অন্ধকারে।
দুর্গাও বাইরে এল। দুহাত দিয়ে বাঁশের খুঁটি জড়িয়ে দাঁড়াল।
চিরঞ্জীব বলল, যা দরজা বন্ধ করে দে।
দুর্গা বলল, দিচ্ছি তুমি যাও।
এই একটি সময়, কয়েকটি মুহূর্ত, প্রায় রাত্রেই ওদের দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। বোধহয় সবচেয়ে রুদ্ধশ্বাস, কঠিন কয়েকটি মুহূর্ত ওদের দুজনের। কথা, ঝগড়া, হাসি, কিছুই হয় না এ সময়ে। সব মিলে মিশে একাকার হয়ে, বোবা আর অর্থহীন সময় খানিকটা। দুটি হাত যত জোরে পারে সাইকেলের হ্যান্ডেল চেপে ধরে। আর দুটি হাত দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধরে রাখে খুঁটি! প্রবল বন্যার স্রোত বাধা পায়, ঘূর্ণি হতে থাকে।
দরজা দিয়ে আসা আলোয় অস্পষ্ট দেখা যায় চিরঞ্জীবের মুখ। আর দুর্গার পিছনে আলো। সামনে থেকে তার ছায়া একটি রহস্যে দুলতে থাকে।
চিরঞ্জীব বলল, চুলগুলো বাঁধিসনে কেন?
–বেঁধেছিলুম। কালীতলায় যাবার আগে খুলে দিয়েছি।
চিরঞ্জীব ঘুরে গেল উঠোনের মাঝখানে। দুর্গা যেন নিশির টানে নেমে আসে দাওয়া থেকে।
চিরঞ্জীব না ফিরেই বলল, গুলিকে থাকতে বলিস না কেন রোজ?
–থাকে তো মাঝে মধ্যে। কেন?
–একেবারে একলা থাকিস।
তারপর সাইকেলে চড়ার একটা উদ্যোগ করেও থেমে গেল চিরঞ্জীব। আর হঠাৎ একেবারে নতুন কথা শোনাল একটি। বলল, জানিস দুগগা, যে কাজ করি, তাতে মা রাগ করে না বরং খুশি। আমাকে লোকে বড়লোক বলে এখন। কিন্তু
–আমার কাছে আসো, তাই রাগ করে।
দুর্গা বলে উঠল শান্ত গলায়।
হ্যাঁ, কেমন করে জানলি।
–শুনিচি।
–আর তোর কাছে খাই বলে, আমার থালা বাসন সব আলাদা করে দিয়েছে। আমি মলে নিশ্চয় মা আমার হয়ে প্রায়শ্চিত্ত করবে।
–আচ্ছা, হয়েছে।
দুর্গা একটু ধমক দিল চিরঞ্জীবকে। তারপরে যেন ভয়-ভয় চাপা গলায় বলল, আজ এ কথা বললে কেন ছোটঠাকুর?
চিরঞ্জীব একটু চুপ করে থেকে বলল, মা বলেই শুধু বলছিনে। মানুষের ধর্মজ্ঞান দেখে বললুম।
দুর্গা বলল, মানুষের দোষ নেই। ধম্মোজ্ঞান এমনিই হয়। তুমি প্রথম যিদিনে আমাকে দেখেছিলে, তোমার চোখেও কত কী ছেল। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে, হুঁ, তোর চলে কেমন করে?
চিরঞ্জীব কোনও জবাব দিল না।
দুর্গা বলল, রাগ করলে?
রাগ করেনি চিরঞ্জীব। দুর্গার কথাটা ভেবে দেখল সে। প্রথম যখন দেখেছিল সে অরক্ষণীয়া দুর্গাকে, তখন কত খারাপ সন্দেহ করেছিল। সকলেই করে থাকে। তবু সে সন্দেহ মিথ্যে ছিল। মায়ের দোষ কী?
চিরঞ্জীব বলল, রাগ করিনি। কিন্তু ও সব ধর্মজ্ঞানে কী আসে যায়। আমি তোকে সন্দেহ করেছিলুম, তুই তখন রাগ করেছিলি। আমার সন্দেহ যদি সত্যি হত, তা হলেই বা ধর্মের কী এমন ক্ষতি হত?
দুর্গা বলল, হত বইকী ছোট্ঠাকুর। মেলা ক্ষতি হত।
–কেমন করে?
তুমি আর আসতে না।
অন্ধকারের মধ্যেই চিরঞ্জীব দুর্গার মুখ দেখবার চেষ্টা করল। বলল, যারা আমার সঙ্গে কাজ করে, তারা কি সব খুব ধর্মিষ্ঠি নাকি?
দুর্গা বলল, তাদের কথা আমি জানি না। আমি নিজের কথা বললুম। এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছ, তবু এখনও তোমার সেই ধম্মোজ্ঞান কত টনটনে।
কথা অন্যদিকে মোড় নিল। সব নদী সমুদ্রে যায়। এখানকার সব রাস্তা জি.টি. রোডে যায়। দুর্গার সব কথা একটি জায়গায় এসে বাজে।
দুর্গার এ কথা হয়তো একটু বেশি স্পষ্ট হয়ে গেছে। দিনের বেলা হলে এ কথা বলে আর সামনে দাঁড়াত না। অন্ধকার আছে বলেই, মুখ ফিরিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বলে এখন লজ্জা করছে। যে কথা মেয়েদের মুখ ফুটে বলতে নেই, তাই বেরিয়ে গেছে মুখ দিয়ে। শুনে চিরোঠাকুরের রাগ হতে পারে। বেহায়া ভাবতে পারে দুর্গাকে।
কিন্তু স্বৈরিণী হতে যার বাধা ছিল না, তবু বেআইনি চোলাইয়ের চোরা চালানদারনি যার জীবনধারণের পেশা, সে যে সব কিছুর ওপারে দাঁড়িয়ে শুধু একজনের দিকে তাকিয়ে আছে, একজন কবে একটু আঙুল তুলে ডাক দেবে, শোনবার জন্য উৎকীর্ণ হয়ে আছে, সেই কথাটি ফাঁক পেলেই বেরিয়ে পড়ে। তাকে চেপে রাখা যায় না।
চিরঞ্জীবের ছায়ায় আছে, তাইতেই কি অরক্ষণীয়া নামের সবটুকু ঘুচে যায়। দুর্গার মন, দুর্গার দেহ, কোথাও আশ্রয় নিয়ে রক্ষা পেতে চায়। দেবার জন্য যখন একজন হাত বাড়িয়ে থাকে আর একজন তখন হাতে তুলে না নিলে সে অরক্ষিতাই থেকে যায়।
চিরঞ্জীব চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। তারপরে বলল, আমার ধর্মজ্ঞানের কথা বলছিস? বলেও আবার খানিকক্ষণ চুপচাপ। তারপর হঠাৎ বলল, কাল আমার সঙ্গে কলকাতায় যাবি?
কলকাতায়? কেন?
–এমনি। একটু বেড়িয়ে আসবি।
-না।
মুখ না দেখা গেলেও, গলার স্বর শুনে বোঝা গেল, দুর্গা গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বলল, তুমিই বা যাচ্ছ কেন, বুঝতে পারছিনে। তুমি কি অচেনা লোক নিকি যে, জিনিস নিয়ে গটগটিয়ে গাড়ি চেপে যাবে?
চিরঞ্জীব বলল, মহকুমা শহর পার হয়ে আমি গাড়িতে উঠব। না গেলে নয়, কলকাতার লোকগুলো ভারী ছ্যাঁচড়া। টাকা পয়সা মেটাতে বড় গণ্ডগোল করছে কিছুদিন থেকে। তাই একবার নিজেই যাব। এ সব গণ্ডগোল পাকিয়েছে জটা আর ওই মেয়েটা।
–কোন মেয়েটা?
বীণা। সেজেগুজে ভদ্রলোকের মতো বীণাই তো মোটরে করে জিনিস নিয়ে যাচ্ছিল কলকাতায়। চন্দননগরের আবগারি ওকে চিনেও ফেলেছে।
–চিনল কেমন করে?
–মেয়েটারই দোষ শুনিচি। অনেক বন্ধু জুটিয়েছে চন্দননগরে। আজ এর হাত ধরে সিনেমায় যায়, কাল ওর হাত ধরে চন্দননগরের স্ট্যান্ডের ধারে হাওয়া খেয়ে বেড়ায়। ক্যাপ্তেনরা সব প্যালা ছুঁড়তে আরম্ভ করেছে। ছুড়ির মাথা ঘুরে গেছে। ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। শুনি, আজকাল নাকি রোজ বাড়ি ফেরে না, চন্দননগরেই থেকে যায়। কোনদিন শুনব, গঞ্জের মেয়েপাড়ায় গিয়ে ঠেকেছে।
রাত করে বাড়ি ফেরে না বলছ, ঠেকে যাওয়ার আর বাকি কী আছে? কিন্তু এ সব করছে কে?
চিরঞ্জীব জানে, এ কথাটাই বলবে দুর্গা। এবং এর পিছনে যে-লোকটির নাম দুর্গা ইচ্ছে করেই উহ্য রাখল, তাকে দল থেকে তাড়াবার কথা অনেকদিন বলেছে সে। কিন্তু তাড়ানো সহজ নয় জেনে, চিন্তিত মুখে নীরব থেকেছে চিরঞ্জীব। এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে।
চিরঞ্জীব বলল, যাকগে, সে সব কথা পরে হবে। অনেক রাত হয়েছে, এবার ঘরে যা।
বিদায়ের আড়ষ্ট মুহূর্তটা নতুন প্রসঙ্গে ভুলে গেছে দুজনেই। কিন্তু রাতটুকু এমনি উঠোনে দাঁড়িয়ে পুইয়ে গেলেও ক্ষতি কী? দুর্গার একলা অরক্ষিত জীবনের সেটা খুব বড় লাভ না হোক, ছোট একটি সান্ত্বনা বোধ হয়।
সে সব কথা ভেবেও, দুর্গা না বলে পারল না, তুমি যদি না জানো সে কে, তবে আমার কাছেই শোনো। এ সবের মূলে তোমার ওই পয়লা নম্বর শাকরেদ জটিরাম। ওই জটা একদিন বারোটা বাজাবে, মনে রেখে দিয়ো।
সে সন্দেহ চিরঞ্জীবেরও আছে। জটা যদিও তার দলভুক্ত, তবু ওর একটা স্বাধীন সত্তা বারে বারেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চায়।
চিরঞ্জীব বলল, হয়তো দলের বারোটা বাজাবে। কিন্তু, বীণার সঙ্গে নাকি জটার খুব ভালবাসা শুনতে পাই।
দুর্গা ফুঁসে উঠে বলল, ঝাঁটা মারি অমন ভালবাসার মুখে। পিরিতের নাম করে এই পাকিস্তানের ছুঁড়িকে ঘরের বার করে চোরাই চালানদারনি করেছে। এবার গিয়ে গাঁটছড়া বাঁধা হবে চন্দননগরের মেয়ে-পাড়ায়। মেয়েটাকে খাটাবার তালে আছে, বুঝি না আমি?
কথাটা কোথায় গিয়ে যেন লাগল চিরঞ্জীবের। অন্ধকারের মধ্যে সে তীক্ষ্ণ চোখে দুর্গার মুখ দেখবার চেষ্টা করল। বীণাকে ঘরের বার করে চোরাই চালানদারনি করেছে জটা। কথাটা দুর্গা শুধু জটা আর বীণার কথা ভেবেই বলেছে কি না কে জানে। কিন্তু কথাটা বাঁকা বঁড়শির মতো ঘুরে যেন একটি ইঙ্গিত নিয়ে চিরঞ্জীবের মনে বিঁধল। গম্ভীর হয়ে চুপ করে রইল সে কয়েক মুহূর্ত। তারপর ফিরতে উদ্যত হল।
দুর্গা আরও এগিয়ে এল। বলল, কী হল, রাগ হল নিকি ছোটঠাকুরের।
প্যাডেলটা একবার উলটোদিকে ঘুরিয়ে দিল চিরঞ্জীব। বলল, না। কিন্তু আর রাত করব না।
দুর্গা বলল, দেখো বাপু, আমি কিন্তুন তোমার রাগের কথা কিছু কইনিকো। কাল তবে যাচ্ছ তুমি?
–হ্যাঁ।
চিরঞ্জীবের হাতের টর্চের আলো একবার ঝলকে উঠল সামনে। আবার বলল সে, তোরও ধর্মজ্ঞান দেখছি খুব টনটনে। তোকে কিন্তু আমি এ পথে টেনে আনিনি। তুই নিজেই এসেছিস।
দুর্গা বলল, ও মা, ওদের সঙ্গে আমার কী কথা? ওদের মধ্যে নিকি ভালবাসা আছে বললে, তাই বললুম। আমাকে তোমাকে নিয়ে সে কথা কেন? আমি আমার বাপের পেশা ধরেছি।
চিরঞ্জীব আর একবার দুর্গার দিকে তাকিয়ে সাইকেলে উঠে অন্ধকারে অদৃশ্য হল। কোনও কথা বলল না।
অন্য সময় হলে বুঝি দুর্গা খিলখিলিয়ে হেসে উঠত। এখন এই নিশুতি রাত্রের অন্ধকারে, চিরঞ্জীবের চলে যাবার পর একলা দাঁড়িয়ে সে হাসতে পারল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ।
দক্ষিণের বাতাস উন্মাদ, তবু নিশ্বাস নিতে যেন একটু কষ্ট হল দুর্গার। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে একটানা। শুকনো পাতার মর্মর অদৃশ্য প্রাণীর অস্তিত্ব যেন। দুর্গা ঘরে এসে খিল দিল। তারপর যেন রুদ্ধশ্বাসে, নিঃশব্দে, কাকে লুকিয়ে, চুপি চুপি ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ে, হাত বাড়িয়ে হ্যারিকেনটা নিবিয়ে দিল।
যে বাতিটা থেকে সহস্র প্রদীপ জ্বলে, তার নাম জীবন ও জন্মান্তর। সেই একটি বাতি যদি নিবিয়ে দাও, তবে মহানির্বাণের যাত্রা। কিন্তু হায়! বাঁকা বাগদির মেয়েটার চোখে, অন্ধকারেও সহস্র আলো দপদপ করে জ্বলতে লাগল। বাঘিনী মেয়ের চোখের কোণ ছুঁইয়ে মহাসাগরের লবণধারা উত্তরঙ্গ হল।
.
চিরঞ্জীব বাড়ির সামনে এসে সাইকেল থেকে নামল। যদিও সঠিক যুক্তি এবং ব্যাখ্যা নেই, তবু মনে মনে সে অশান্ত হয়ে উঠছে। রাগ করতে পারছে না। যদিও মনে করছে সে, দুর্গার ওপরে তার রাগ হয়েছে। একটা অস্পষ্ট বিক্ষোভে ধিকি ধিকি জ্বালা অনুভব করছে সে।
কিন্তু সাইকেল থেকে নেমে, সে একটু অবাক হল। দেখল, তার ঘরের জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে। গুলির কথা প্রথমেই মনে হল। কিন্তু গুলি তার ঘরে থাকে না। যদি বা কোনও কারণে থাকে, এত রাত্রে বাতি জ্বালিয়ে রাখবে কেন?
বাড়ির দরজা বলে কিছু নেই। বাঁশ ব্যাকারির আগল ঠেলে সে ঢুকল। এককালে দরজা ছিল। গজাল পোতা বড় দরজা। সেটা কোনও এককালের পতিতপাবন বাঁড়ুজ্জের গৌরব রক্ষা করত। হুগলি জেলার কোনও এক রাজবাড়ির প্রধান আমলার আমলাত্ব এখনও এই ভাঙাচোরা পুরনো ইট বের করা একতলা বাড়িটার গায়ে ভূতের মতো চেপে আছে। দক্ষিণাংশ অনেকদিনই প্রায় নোনা ইটের স্তূপে পরিণত হয়েছে। নোনা ইট আর শুরকি-খাওয়া ঘাস শেওলা বেড়েছে অবাধে। তেলাকুচ আর কুকুরছটকে তালগাছ দেয়াল যা পেয়েছে, সব কিছুকে জড়িয়ে দুর্ভেদ্য হয়ে উঠেছে। সাপ গোসাপ আর চোখ-খাবলারা বাসা করে সুখেই আছে তাদের নির্ধারিত সীমানায়। পিছনের বাগানটা ঊর্ধ্বতন আর এক পুরুষ আগেই বিক্রি হয়েছে। দক্ষিণাংশের জমি আর ধ্বংসস্তূপও বিকিয়ে গেছে চিরঞ্জীবের বাবা। কোণঠাসা উত্তরাংশ বন্ধক ছিল। সেই বন্ধকি তমসুক মুক্ত করে এনেছে চিরঞ্জীব। রাজমিস্তিরি লাগিয়ে কিছুটা বাসযোগ্যও করেছে। তাই এখন গাঁয়ের লোকে বলে, বলু বাঁড়ুজ্জের ছেলে নতুন বাড়ি করেছে। পতিতপাবন বাঁড়ুজ্জের গৌরব বুঝি আবারও ফিরে আসে বেআইনি চোলাই মদের উজান ঠেলে। আরও কিছু বলে, চোলাই মদের চেয়ে যে কথা বলতে লোকের উত্তেজনা আরও বেশি হয়। বাঁকা বাগদির মেয়ে, আর বলু বাঁড়ুজ্জের ছেলে। যদিও সে কথা সাহস করে সামনে উচ্চারণ করা আর শমনের সঙ্গে লড়া এক।
তবু এ কথা ঠিক, প্রপিতামহ পতিতপাবনের ভিটায়, নোনা ইটে নতুন পলেস্তরা, জীর্ণ মেঝের সংস্কার, আর নতুন দরজা জানালা সবাইকে চমক লাগিয়েছে। বলু বাঁড়ুজ্জের বিধবার গায়ে আস্ত থান দেখে পশ্চিমে সূর্যোদয় দেখেছে কেউ কেউ! দুবেলা পেট ভরে খেতে দেখে, সংসারের সত্য মিথ্যায় সংশয় দেখা দিয়েছে সকলের। অচল আর সচল টাকার মূল্যবোধ নিয়ে সবাই যেন নতুন করে ফ্যাসাদে পড়েছে।
বারান্দায় উঠে চিরঞ্জীব বুঝল, দরজায় শিকল তোলা নেই। প্রতিদিন তাই থাকে। ভাত ঢাকা দেওয়া থাকে ভিতরে। জিনিসপত্র এমন কিছু থাকে না, যা চুরি হতে পারে। শেয়াল কুকুরে ভাত খেয়ে যেতে পারে, সেই ভয়ে চিরঞ্জীবের মা, শিকল তুলে রাখে! জেগে থাকবার দরকার হয় না মায়ের। যদিও মা জেগেই থাকে। দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকারে। ছেলের খাওয়া দেখার জন্যেই কিনা কে জানে। তবে এ সময় ছাড়া যেহেতু চিরঞ্জীবের সঙ্গে সংসারের কাজের কথা বলার সময় থাকে না, সেই হেতু মাকে আসতেই হয়। সংসারের কাজের কথার মধ্যে একমাত্র টাকা। বলতে হয় না। চিরঞ্জীব হাত বাড়িয়ে টাকা দিয়ে দেয়।
মা হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলে, রাখ এখানে।
অর্থাৎ মাটিতে। কারণ, চিরোকে ছোঁবে না। তারপর মাটি থেকে টাকাটা তুলে আঁচলে বাঁধতে বাঁধতে বলে, কাল কী খাবি? মাছ আনাব একটু? না হয়, কাল তো রোববার, অজা পাঁঠা মারবে বোধহয়। একটু মাংস এনে রেঁধে দেব?
চিরঞ্জীব বলে, যা হয় কোরো।
এড়িয়ে না গেলে আরও কিছু সাংসারিক প্রসঙ্গ উঠতে পারে। ওঠেও তাই। যদি না, চিরঞ্জীব আগে থেকেই চাপা দেবার চেষ্টা করে।
কিন্তু বাতিই বা জ্বলছে কেন। দরজা বা কেন ভেজানো! সাইকেলের সামনের চাকা দিয়ে দরজা ঠেলতেই দেখা গেল, তক্তপোশের ওপর একজন শুয়ে আছে। শিয়রের কাছে বাতি, কিছু কাগজপত্র, ফাউন্টেন-পেন। মেঝেয় জুতো, পেরেকে ঝোলানো জামা। দরজার শব্দে গেঞ্জি গায় লোকটি পাশ ফিরে তাকাল।
চিরঞ্জীব থমকে দাঁড়াল। বলল, শ্রীধরা নাকি?
শায়িত ব্যক্তি বললেন, অসুবিধে হল?
এক মুহূর্তের জন্য চিরঞ্জীবের দৃষ্টি স্থির হল। কঠিন হয়ে উঠল বুঝি মুখের ভাব। ঘরে ঢুকে সাইকেলটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখতে রাখতে বলল, না, অসুবিধে না। আমাদের বাড়িতে এসেছেন, তাই জিজ্ঞেস করলুম।
সাইকেলটা রেখে একটু দূরে, মুখোমুখি দাঁড়াল সে। শ্রীধর ততক্ষণে উঠে বসেছেন। কালো, বলিষ্ঠ চেহারা। সামনের চুলে কিছু পাক ধরেছে। মুখের সব রেখাগুলি শুধু বয়সেরই নয়, জীবনধারণের ঝড়-ঝাপটার চিহ্ন হিসাবেই অত্যন্ত অনাড়ম্বর, মাঠেখাটা মানুষের মতো রেখাবহুল মুখ। চওড়া কপাল, মোটা ভ্রূর তলায় তীক্ষ্ণ এক জোড়া চোখ। রাজ্যসভার উনি স্থানীয় প্রতিনিধি। লোকে বলে এম. এল. এ।
শ্রীধরের মুখে ঘৃণা-মিশ্রিত তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসা দেখে, চিরঞ্জীব ভ্রূ কুঁচকে মুখ ফিরিয়ে নিল। দূরের একটা জলচৌকিতে গিয়ে বসল সে। যদিও মশার উৎপাতে বসা প্রায় মুশকিল।
শ্রীধর বলেন, প্রকৃতিস্থ আছিস? না কি শুয়ে পড়তে হবে?
মুখ না ফিরিয়েই চিরঞ্জীব জবাব দিল, অপ্রকৃতিস্থ হবার কী আছে?
শ্রীধর বিদ্রূপ করে হেসে বললেন, কী আছে? তুই মদ খেয়ে এলে, আমাকেই মুখ ফিরিয়ে থাকতে হবে। কিছু বলব না। তাই আগেই জিজ্ঞেস করছি, ঠিক আছিস কি না?
চিরঞ্জীব একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি মদ খাইনে।
বটে? শ্রীধর হেসে উঠলেন হা হা করে। বললেন, তুই যে পিয়ারি বাঈজির মতো কথা বলছিস রে? বাঈজিগিরি করি বটে, তা বলে বেশ্যা নই। ঘরের বউয়ের চেয়ে একটুও কম নই।
শ্রীধরের হাসির রেশ থামবার পর চিরঞ্জীব বলল, ও সব ভেবে দেখিনি। তবে ময়রাও তো অনেক সময় মিষ্টি খায় না। সেরকম ধরে নিন।
শ্রীধর একটু গম্ভীর হলেন। লক্ষ করলেন আর একবার চিরঞ্জীবকে। বললেন, সেই মেয়েটার ওখান থেকে ফিরলি বুঝি?
–হ্যাঁ!
কী যেন নাম মেয়েটার?
-দুর্গা।
–দুর্গা। তা ভালই করেছিস। মেয়েটার সাহস ছিল বরাবরই, খুব স্পষ্টবাদী। কয়েক বছর আগে, আরও ছোট থাকতে আন্দোলনের সময় মেয়েটার তেজ দেখে অবাক হয়েছিলুম। ওইরকম একটা মেয়েকে ভজাতে পেরেছিস, তোর সুবিধেই হবে।
চিরঞ্জীব চুপ। শক্ত হয়ে, মাথা নিচু করে বসে রইল সে।
শ্রীধর বললেন, মেয়েটার খুব নামডাকও হয়েছে আজকাল শুনতে পাই। আর তোদের দুজনের নাকি–
কথা শেষ হবার আগেই শ্রীধরের হাসি ফেটে পড়ল। আবার বললেন, তা বেশ করেছিস। এ সব পথে ওরকম জুটি নিয়ে না নামলে ঠিক সুবিধে হয় না। তবে মেয়েটা কী করে তোর সঙ্গে ও পথে আসতে রাজি হল, ভেবে পাই না।
ঠোঁটের ওপর উপচে-আসা কয়েকটি তীক্ষ্ণ কথা চিরঞ্জীব দাঁতে কামড়ে ধরল। তার বলতে ইচ্ছে করছিল, আপনারা রক্ষা করতে পারলেন না, তাই রাজি হয়েছিল। কিছু না বলে সে উঠে দাঁড়াল, বলল, দরজা বন্ধ করে তা হলে আপনি শুয়ে পড়ন। আমি পাশের ঘরটায় যাচ্ছি।
শ্রীধর বললেন, সেখানে তোর এক শাকরেদ রয়েছে।
-ওর কাছেই শুয়ে পড়ব।
-খাবিনে? তোর খাবার ঢাকা রয়েছে যে?
–খেয়ে এসেছি দুর্গার ওখানে।
–ও! বেশ বেশ! ওকে বাড়িতে এনে রাখলেই পারিস। মিছিমিছি আর ও পাড়ায় একলা ফেলে রাখা কেন? নাকি আরও কিছু ব্যাপার আছে!
দুর্বিনীত বলে যার এত কুখ্যাতি, সেই চিরঞ্জীবকে রীতিমতো শালীন ও শান্ত মনে হল। সে বলল, সে কথা শুনে আপনার আর কী লাভ হবে।
ইচ্ছে থাকলেও শ্রীধরকে আগের মতো দাদা বলে ডাকতে পারল না চিরঞ্জীব। কিন্তু শ্রীধর শুধুই হাসছিলেন না। তার হাসির ধারে ধারে অঙ্গারের আভা ধিকিধিকি জ্বলছে। আবার বললেন, এইবার আস্তে আস্তে রেসপেকটেবল ভদ্রলোক হয়ে উঠবি। পয়সা আসছে হাতে, তাইতেই অপরাধ চাপা পড়ে যাবে। কোনদিন দেখব, মন্ত্রীদের টিকিট নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ভোটে নেমে পড়েছিস। তোফা!
চিরঞ্জীব এ কথারও কোনও জবাব দিল না। জিজ্ঞেস করল, খেয়ে এসেছেন?
–হ্যাঁ, ওটা কলকাতা থেকেই সেরে এসেছি।
পাশের ঘরটায় ঢোকবার আগে আর একবার থামল চিরঞ্জীব। মুখ না ফিরিয়েই বলল, কিন্তু কেন এসেছেন, তা তো বললেন না।
শ্রীধর বললেন, সে কৈফিয়তটা অবশ্য দেয়া দরকার। তোর কাছে আসব বলেই আসিনি। বিমলাপুরে কাল একটা কৃষকসভা আছে। আমার আসবার কথা ছিল সকাল সকাল। আসতে পারিনি। লাস্ট ট্রেনে এসে পড়েছি, গোরুর গাড়ি নিয়ে যাদের থাকবার কথা ছিল, তাদেরও খুঁজে পেলাম না। কাল সকালে আসব মনে করে তারা হয়তো চলেই গেছে। কাছাকাছি রাতটা কাটাবার মতো এখানেই এসে পড়লাম। অবশ্য আরও জায়গা ছিল। তবে, তোর এত নামডাক, ভাবলাম, একটু দেখেই যাই।
চিরঞ্জীব তখন পাশের ঘরের অন্ধকারে অদৃশ্য। দক্ষিণ চাপা ভ্যাপসা গরম অন্ধকার ঘরটার মধ্যে সে যেন ওঝার মার-খাওয়া আহত সাপের মতো আড়ষ্ট কিন্তু ক্রুদ্ধ গর্জনে ফুঁসতে লাগল ভিতরে ভিতরে। বিষ টগবগ করছে। মাথা তুলতে পারছে না।
শ্রীধর আর চিরঞ্জীব, দুজনেরই অলক্ষে এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন চিরঞ্জীবের মা। চিরঞ্জীব আসার পর থেকেই দাঁড়িয়েছিলেন। আড়ি পেতে শুনছিলেন সমস্ত কথাই। শুনতে শুনতে বয়সের চেয়েও অবস্থার চাপে বৃদ্ধার কপালে কতগুলি রেখা কিলবিলিয়ে উঠছিল। দুচোখে তার ভয় ও রাগের যুগপৎ ছায়া কাঁপতে লাগল। চলে যাবেন বলে পিছন ফিরে আবার ঘুরে দাঁড়ালেন। ওদের কথা শেষ না হলে যেতে পারছেন না।
চিরঞ্জীবের গলা আবার ভেসে এল অন্ধকার ঘর থেকে, দেখে যাবার আর কী আছে।
শ্রীধর অন্ধকার দরজাটার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখে যাবার আছে বইকী। তুই এখন নাকি ভিলেজ লাইট। কিন্তু একটা বিষয়ে বোঝাপড়া করার ছিল তোর সঙ্গে। ওখানে গেলি কেন? এখানে আয় না।
বলুন না আপনি।
-মুখ না দেখলে বলি কেমন করে? লজ্জা যদি তোর সত্যি করে তা হলে আড়ালেই থাক। কিন্তু আছে বলে আমার মনে হয় না। থাকলে দু তিনটে গাঁয়ের গরিব চাষি মজুরগুলোকে তোর এ পাপ ব্যবসায় টেনে নামাতে পারতিস না।
চিরঞ্জীব এবার দরজায় এসে দাঁড়াল। এবার সে চোখ তুলে তাকাল শ্রীধরের দিকে। বলল, টেনে নামিয়েছি কী রকম?
শ্রীধর চিরঞ্জীবের চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন, এতক্ষণে তোর গায়ে লেগেছে দেখছি। ভেবেছিলুম ওই অক্রূর দে কর্তাদের রাজনীতি করে, মদের ব্যবসাও করে। গাঁয়ের গরিব মানুষদের এ পথে টেনে আনতে পারলে ওর সবদিক দিয়েই লাভ। তাতে অক্রূরের সঙ্গে আমাদেরও বিরোধ। গরিব কিষাণদের ধরে ধরে তো আর মারতে পারি না। বোঝাতে পারি। তবু পেটের দায় সামলাতে না পেরে তারা ওর শিকার হয়। আমার নিজেকে গিয়ে এস. ডি. ও.র কোর্টে এই লোকগুলোকে জামিন দিয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। এম. এল. এ হয়ে আমাকে বে-আইনি মদের স্মাগলারদের জামিনদার হতে হয়। লোকে বোঝে না, আমার কোনও কৈফিয়ত নেই। কিন্তু ওদের এই অবস্থায় আমি ফেলে আসতে পারি না। তাতে যে যাই মনে করুক। কিন্তু তুই? তুই কী বলে ওই লোকগুলোকে তোর দলে ডেকে আনিস।
চিরঞ্জীবের ঠোঁট ততক্ষণে শ্লেষে বেঁকে উঠেছে। বলল, গাঁয়ের গরিব কিষাণদের ওপর আপনার দেখছি অগাধ বিশ্বাস। ওকুর দে কী করে না করে জানিনে। কিন্তু আপনার ওই গরিব কিষাণেরাই যেচে এসে এ সব কাজ করে। তাদের ডেকে আনতে হয় না। টেনে নামাতেও হয় না এ পথে। আমাদের ইচ্ছে না থাকলে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তারা পরামর্শ দেবে, ফিকির বার করবে, কোথায় কী করা যায়।
-মায়ের কাছে মাসির বাড়ির গল্প করিসনে চিরো। ওদের ঘরে টাকা গজগজ করছে কিনা, যে ওরা মনকে মন কয়লা আর গুড় কিনে নিয়ে এসে চোলাই করতে বসে যাবে। ও সব তোরা সাপ্লাই না করলে ওদের ক্ষমতা কী যে ওরা মালপত্র এনে চোলাই করবে? যাদের আধ পয়সার মুরোদ নেই, তাদের পাই পয়সাও কেউ ধার দেয় না। ও সব আমরা জানি।
–ভুল জানেন।
ভুল জানি?
চিরঞ্জীব ফুঁসে উঠে বলল, হাঁ, ভুল জানেন। আমরা কাউকে কাজ করাবার জন্য খুঁজে মরছি না। ওরা নিজেরাই খুঁজে বার করে আমাদের। না পেলে, নিজেরাই দল বেঁধে থালা ঘটি বাটি বন্ধক দিয়ে চাঁদা করে পয়সা তুলে, জিনিসপত্র এনে চোলাই করে। এমনকী পুলিশের সঙ্গে দাঙ্গা করতে পর্যন্ত পেছপা নয়। আপনি যখন ভাবছেন কৃষক-বিপ্লব করবেন, তখন ওরা আপনাকে কাঁচকলা দেখাচ্ছে।
কথাটা বলেই কেমন যেন থিতিয়ে গেল চিরঞ্জীব। ক্রুদ্ধ মুখ ফিরিয়ে নিল সে। কিন্তু শ্রীধরের মুখে তখন আগুন জ্বলছে। বোধহয় সারা গায়েই হল্কা বইছে। বললেন, বাঃ এই তো, বুলি শিখে গেছিস। তা হলে ওই লোকগুলোকে তুই দলে না টেনে পারবি না?
–আমার টানাটানির কী আছে? আমি অন্য দলেই ছিলুম। বরং এখন আপনার ওই কিষাণদের দলে ভিড়েছি। এ সব কাজে আমার হাতেখড়ি যদি কেউ দিয়ে থাকে, ওরাই দিয়েছে।
বাঃ! বাঃ!
বলতে বলতে শ্রীধর উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন, তোকে জানোয়ার বলব না মিথ্যাবাদী বলব, বুঝতে পারছি না।
–গালাগাল আপনি দিতে পারেন। যা সত্য, আমি তাই বললুম।
শ্রীধর অনেক পড়াশুনা করেছেন। তবু তিনি কৃষকেরই ছেলে। মার্জিত হয়ে চলা এবং বলাটা সব সময় তার ধাতে নেই। তার কালো শক্ত শরীর জুড়ে একটি উদ্যত আঘাতের আক্রোশ ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। বললেন, কৃষক-আন্দোলনের মধ্যে ছিলি, তাই লোকগুলোকে দেখছি তোর পুরোপুরি চেনা হয়ে গেছে। বেশ তো, কাল চল বিমলাপুরের মিটিংএ। সেখানে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো বলে আসবি। দেখি একবার চিরো বাঁড়ুজ্জের সত্যবাদিতা।
–মিটিংএ দাঁড়িয়ে বলতে যাব কেন? ওখানেই কি সব সত্যমিথ্যা যাচাই হয়ে যায়? ও সবে আমার বিশ্বাস সেই।
কীসে তোর বিশ্বাস?
শ্রীধরের গলা চেপে এসেছে। কিন্তু চোখের দীপ্তিতে অঙ্গারের ঝিলিক। আরও দু পা এগিয়ে এলেন তিনি চিরঞ্জীবের দিকে। ঈষৎ সামনে ঝোঁকা, মাঝারি লম্বা কালো চওড়া শ্রীধরকে ভয়ংকর মনে হল।
চিরঞ্জীব তার জীবনে বোধহয় এই প্রথম শ্লেষ-তীক্ষ্ণ চোখে শ্রীধরের আপাদমস্তক লক্ষ করল। বলল, ওরা আপনাকে ভালবাসে, ও সব সভায় হয়ত আপনার কিছু কাজ হাসিল হয়। আসল সত্যমিথ্যা যাচাই হয় না।
বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো গর্জন করে উঠলেন শ্রীধর, থাম! স্বর চেপে বললেন, রাসকেল! একটা নোংরা স্মাগলারের কাছে আমাকে রাজনীতি শিখতে হবে।
চিরঞ্জীব থামল না। এক পাও সরল না। সে যেন সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে শক্ত করে শ্রীধরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, আমার কাছে রাজনীতি শিখবেন কেন? কিন্তু আমি থামবই বা কেন? আপনি কি মনে করেছেন, সেই দুবছর আগের দিন আর আছে? অত আর সহজ নয়।
শ্রীধর কয়েক মুহূর্ত চিরঞ্জীবের দিকে স্থির চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন। চিরঞ্জীবও চোখ নামাল না। শ্বাসরুদ্ধ করে শুধু বাইরে অপেক্ষামানা তার মা।
শ্রীধর ফিরে এলেন তক্তপোশের ওপর। এবার তারই মুখ না ফেরাবার পালা। নিজের ছায়াটার দিকে চোখ রেখে বললেন, কেন, গায়ে হাত তুলবি নাকি?
চিরঞ্জীবও তখন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়েছে। বলল, দুবছর আগে আপনিই গায়ে হাত তুলেছিলেন।
হ্যাঁ, গায়ে হাত তুলেছিলেন শ্রীধর। কিল চড় লাথি, যেভাবে খুশি, চিরঞ্জীবকে মেরেছিলেন। আর যারা কাছাকাছি ছিল, তারা এসে না ধরলে সে মারের পরিণতি কোথায় দাঁড়াত, বলা যায় না।
সেই প্রথম দিনের কথা। সেদিনও এই ঘরের মধ্যেই ঘটনা ঘটেছিল। সংবাদ তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, চিরঞ্জীব চোরাচোলাই মদের ব্যবসায় নেমেছে। শ্রীধরের নিজের হাতের সৃষ্ট বলা যায় চিরঞ্জীবকে। সেই ক্লাশ টেনে পড়বার সময় প্রথম তাকে চোখে পড়েছিল শ্রীধরের। বিমলাপুরের কৃষকদের ওপর গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। প্রতিবাদে বাঘের মতো গর্জন করে উঠেছিল চিরঞ্জীব। কেউ তাকে শেখায়নি, কেউ তাকে বোঝায়নি। স্কুলের সমস্ত ছাত্র নিয়ে সে বিমলাপুরের সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছিল। গোটা বিমলাপুর তখন পুলিশের ঘেরাওয়ে বন্দি। পুলিশের সেই ব্যূহ ভেদ করতে এসেছিল সে তার বন্ধুদের নিয়ে।
পুলিশের তাণ্ডব যদিও অনেকগুলি গ্রাম জুড়েই চলছিল। কিন্তু বিমলাপুর ছিল কৃষক-আন্দোলনের দুর্গ বিশেষ। তাই পুলিশ বিমলাপুরকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। কৃষকরাও প্রাণ দিয়ে রক্ষা করতে চেয়েছিল তাদের বিমলাপুরকে। কয়েকজন কৃষক মেয়েপুরুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। তবু জমিদার ও জোতদারদের কাছে হার মানেনি তারা। তারা লড়েছিল প্রাণপণে। মরেছিল অনায়াসে। যত আঘাত বিমলাপুরে, ততই সমাবেশ সেখানে! সারা ভারত যেমন একদিন চিৎকার করেছিল, চলো চলো দিল্লি চলল, তেমনি সারা জেলাটা সেদিন গর্জে উঠেছিল, চল চল বিমলাপুরে চল! মুখোমুখি লড়াই হয়েছে। বন্দুকের সঙ্গে ঝাঁটা আর আঁশবঁটি, হেসো আর শাবল। অবরুদ্ধ বিমলাপুর তছনছ হয়েছে। তবু পুলিশের জয় হয়নি। গ্রামসুদ্ধ মেয়েপুরুষকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে তারা। কিন্তু ওদের পায়নি। ওদের–যাদের নির্দেশে সকলে প্রাণ তুচ্ছ করেছিল। গ্রাম্য মানুষগুলির আবহমানকালের ভয় মন্ত্রমুগ্ধ সাপের মতো খসে পড়েছিল।
এক মাসের ওপর সমস্ত সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন বিমলাপুর। গোরুর গাড়ির চাকাগুলিতে জং ধরেছিল। রাস্তায় পায়ের চিহ্ন পড়েনি মানুষ ও জানোয়ারের। অনেক ধান মাঠেই ঝরেছে। পায়রা আর ইঁদুরের পৌষ মাস ছিল সেই বছরটা। গ্রাম ঘিরে শুধু গ্রেপ্তার আর জেরা। তবু বিমলাপুরের অভ্যন্তরে পুলিশ দিনের বেলায়ও নিশ্চিন্তে বিরাজ করতে পারেনি। তারা তাদের নিজেদের ছায়া দেখে চমকে উঠেছে। পৌষের শুকনো পাতায় গিরগিটির খসখস চলাফেরায় থমকে গেছে। প্রায় জনহীন নিঃশব্দ বিমলাপুর। কিছু বুড়োবুড়ি শিশু আর অভুক্ত জানোয়ারগুলি ছিল। উৎকণ্ঠিত ত্রাসে গ্রামের পাখিগুলিও চলে গিয়েছিল বোধহয়।
তবু তার মাটির পরতে পরতে কী যেন চাপা ছিল। যেন, যে কোনও মুহূর্তে ডিনামাইটের মতো ফেটে পড়তে পারত।
পারত। পেরেছিল। কিন্তু গ্রামের অভ্যন্তরে নয়। বিমলাপুরের বাইরে থেকে এসে ফেটে পড়েছিল। চিরঞ্জীবের ছাত্রবাহিনী একটি নতুন ডিনামাইট বাহিনীর মতো এসে ফেটে পড়েছিল পুলিশব্যূহে। ভেদ করে ঢুকেছিল বিমলাপুরে। কাস্তে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মাঠে মাঠে। এরকম একটি বিচিত্র বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিল না পুলিশ। আশেপাশের গ্রামের খবর শুনে গোটা মহকুমাই আবার নতুন করে উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল। চল, বিমলাপুর চল।
নিচুতলার গুপ্তাবাস ছেড়ে সেই প্রথম শ্রীধর চিরঞ্জীবের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন! মনে করেছিলেন, চির আরাধ্য সেই ক্যাডার তার চোখের সামনে জন্ম নিল।
আর চিরঞ্জীব মনে করেছিল, শ্রীধর দাসের দেখা পেলুম। স্নেহ-ভালবাসা পেলুম। বিশ্বাস আর সম্মান পেলুম। আমার জীবন সার্থক হল। সব মিলিয়ে, একটি শিখার মতো দপদপিয়ে উঠেছিল সে।
সেই বছরটা জয় হয়েছিল। তার জের লেগেছিল বছর দুয়েক! কিন্তু জমিদার-জোতদারের প্রস্তুতি চলছিলই ভিতরে ভিতরে! তৃতীয় বছরেই তাদের আক্রমণের সামনে বিমলাপুরের দুর্গ অনেকখানিক ধ্বংস হয়েছিল। সেই সময় বাঁকা বাগদির মেয়ে দুর্গা হাজত খেটেছিল মহকুমা জেলহাজতে। লাঞ্ছিত হয়েছিল পুলিশের হাতে। চিরঞ্জীব জেলে গিয়েছিল সেই বছর। ইন্টারমিডিয়েট ফাইনালটা তার আগের বছর টাকার জন্য দিতে পারেনি। কলেজের মাইনে দূরের কথা, ট্রেনের মান্থলি কাটাও তার পক্ষে বহুদূর! বেঁচে থাকার সমস্যাটাই প্রধান হয়ে উঠেছিল ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরেই।
পুরনো নোনাধরা দেয়ালের নতুন পলেস্তারায় দুটি ছায়া নিশ্চল হয়ে রয়েছে। দুজনেই ভাবছে সেই দিনগুলির কথা। কিন্তু চিরঞ্জীবের মা এখনও ফিরে যেতে পারেননি। তেমনই অন্ধকারেই বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। মাথায় তার থান নেই। ছাই রং চুল বাতাসে উড়ছে। কিন্তু এখন আর সরু ছিদ্র দিয়ে ঘরের দিকে লক্ষ নেই। বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। তবু চলে যান না। যেন কোনও গুপ্ত তথ্য জানবার আশায় রয়েছেন। কিংবা যেন তার বিরুদ্ধে কোনও গোপন ষড়যন্ত্র বিষয় শোনবার উৎকণ্ঠ প্রতীক্ষা।
পাখি সারা রাত্রিই ডাকে। জেগে থাকলেই তা থেকে থেকে শোনা যায়। ঝিঁঝির ডাক যেন এ পৃথিবীর নিরন্তন প্রবাহের শব্দময় ধ্বনি। মধ্যরাত্রি পার হয়েছে। এখনকার বাতাস যেন গাঢ় ঘুমেরই আবেদনে বহমান। কিন্তু এখানে সবাই জাগে। ফুল পাতা নোনা ইটের গন্ধ চারিদিকে।
দুবছর আগে সেদিনও রাত্রি ছিল। অন্ধকার ছিল। এমনি স্তব্ধতা ছিল। তবে রাত্রি এত গভীর ছিল না। শ্রীধর কৃষক-সমিতির দুজনের সঙ্গে এসে দরজা ধাক্কা দিয়েছিলেন, চিরো, দরজা খোল।
দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে পিছনের ঘরে মা থাকতেন। তিনি প্রথমে টেরও পাননি। টের পেলেও ওঠবার কিছু ছিল না। অনেকেই যাতায়াত করে চিরঞ্জীবের কাছে।
চিরঞ্জীব সবে শুয়েছিল। শ্রীধরের ডাক শুনে কেমন যেন থতিয়ে গিয়েছিল সে। বাতি জ্বেলে দরজা খুলে দিয়েছিল। শ্রীধর ঘরের চারিদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে, জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুই নাকি ইল্লিসিট লিকারের ব্যবসা ধরেছিস?
এ ঘটনা জেল থেকে ফিরে আসার প্রায় চার বছর পরের কথা। শ্রীধরদা তখন সদ্য এম. এল. এ হয়েছেন। চিরঞ্জীব নাওয়া-খাওয়া ভুলে ভোটের লড়াই করেছে। তার আর একটি জীবনের দরজা যে কখন কোন দিক দিয়ে খুলে গিয়েছিল, শ্রীধর টেরও পাননি। কেমন করে, কেন খুলেছে, সংবাদ রাখেননি। যদিও এমন কাজের কার্যকারণের সংবাদ রাখাটা জীবনের কোনও মহৎ কর্ম নয় শ্রীধরদার পক্ষে।
চিরঞ্জীব দেখেছিল, শ্রীধরের দুচোখ জ্বলছে ভাঁটার মতো। আজকের মতোই বলিষ্ঠ হাত দুটি নিষ্ঠুর শক্ত হয়ে উঠেছিল।
চিরঞ্জীব বলেছিল, হ্যাঁ ধরেছি।
ধরেছিস। বলছিস তুই, ও কাজ ধরেছিস?
শ্রীধর দেখছিলেন, তার পরম বিশ্বাস তারই সামনে ধূলিসাৎ। একটা মিথ্যে কারসাজি করে সমস্ত নির্ভরতা মুখোমুখি বিশ্বাসঘাতকতার মতো দাঁড়িয়েছে। চিরঞ্জীব আর দ্বিতীয়বার হাঁ বলার অবসর পায়নি। শ্রীধর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
যারা সঙ্গে এসেছিল, শ্রীধরকে জোর করে সরিয়ে এনেছিল! কিন্তু ততক্ষণে চিরঞ্জীবের নাক মুখ রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। মুখ থুবড়ে পড়েছিল সে ঘরের কোণে। বাধা দেবার শক্তি তার ছিল না। প্রস্তুতও ছিল না অমন অতর্কিত দ্রুত আক্রমণের জন্য। মনে মনেও দুর্বল ছিল সে।
বেআইনি চোলাই অনেকেই করে। কিন্তু শ্রীধর সবাইকে মারতে ছোটেননি। চিরঞ্জীবের প্রতি যেন তার জাতক্রোধ হয়েছিল। বারে বারে বলেছিলেন, ট্রেটার! বিশ্বাসঘাতক।
তখন চিরঞ্জীবের মা ছুটে এসে চিৎকার করতে যাচ্ছিলেন। শ্রীধর ধমকে বলেছিলেন, চেঁচাবেন না। অমন ছেলের চেয়ে ছেলে না থাকা ভাল। আপনার একটা একদিকে গেছে। আর একটি আর একদিকে গেল।
আবার সঙ্গীদের সঙ্গে বেরিয়ে যাবার আগে বলেছিলেন, আজ থেকে তোর সঙ্গে আমাদের সব সম্পর্ক শেষ। দরকার হলে পেছনে লোক লাগিয়ে আমরাই তোকে ধরিয়ে দেব। আগে বুঝতে পারিনি, তোরা–তোর বোন তুই, তোরা এইরকমই। এ সবই তোদের পেশা।
চলে গিয়েছিলেন শ্রীধর। মা এসে দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিলেন চিরঞ্জীবকে। চিরঞ্জীব ঝটকা দিয়ে মাকে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, সরে যাও।
–সরে যাব কী চিরো। ওরা যে তোকে
কথা শেষ করতে পারেননি মা। চিরঞ্জীব চিৎকার করে বলেছিল, আঃ! বলছি সরে যাও এখান থেকে। চলে যাও। যাও।
মা দেখেছিলেন, চোখের কোল ফোলা, ঠোঁটের কশে, নাকে রক্ত চিরঞ্জীবের। কিন্তু তার দুচোখে আগুন।
–চলে যাও বলছি এখান থেকে।
আর ভরসা পাননি থাকতে। চলে গিয়েছিলেন বাইরে। চিরঞ্জীব উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। নিভিয়ে দিয়েছিল বাতিটা। আঘাতের ব্যথা সে তেমন অনুভব করছিল না তখন। কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। শুধু শেষের কথাগুলি তার কানে বাজছিল তুই, তোর বোন, এ সবই তোদের পেশা।
সেই মুহূর্তে তার ছুটে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল। একবার ভাবছিল, আমি এখুনি মহকুমা শহরে যাব। খুঁজে বার করব দিদিকে। ওকে কাটব, টুকরো টুকরো করব, তারপর ফেলে দেব গঙ্গার জলে। আবার ভাবছিল, না, শ্রীধরদাকে ধরতে হবে গিয়ে। ওকে ছাড়ব না, দাঁতের বদলে দাঁত নেব ওর। রক্তের বদলে রক্ত। পরমুহূর্তেই বাবার মুখ মনে পড়েছিল। মনে হয়েছিল, লোকটিকে জীবিত পেলে এখুনি নখে টিপে নিকেশ করতুম। তারপরেই মায়ের কথা মনে পড়ছিল তার। ওই একটি মেয়েমানুষ, দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। বড় ভাল মানুষ। কিন্তু পরতে পরতে ঢাকা নষ্টামো নোংরামো। কিছুই জানিনে, কিছুই বুঝিনে ভাব করে সে সবই জেনে বুঝে চোখের সামনে অনেক অন্যায় ঘটতে দিয়েছে। অনেক পাপ ঘটতে দিয়েছে। শুধু মাত্র স্বার্থের খাতিরে, জেনে বুঝেও একটা সর্বনাশকে তিল তিল করে বাড়তে দিয়েছে। তারপর ঘটতে দিয়েছে শেষ সর্বনাশ। আমি ওই চোখ দুটি উপড়ে নেব। ওই চোখ দুটি, যে-চোখে অন্যায় এবং পাপ, স্নেহের ছদ্মবেশে মায়ের মতো অসহায়তা চেপে থাকে। ওই গলাটা টিপে দেব। যে-গলার স্বরে ও কথায় ছদ্মবেশ।
কিন্তু অন্ধকার ঘরটায়, কোথাও এক পা অগ্রসর হতে পারেনি চিরঞ্জীব। দরজার বাইরে মা আছে জেনেও, খিল খুলে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেনি। মুখের মধ্যে তার রক্ত না নোনা জলেই বুঝি ভরে উঠেছিল। থু থু করে ছুঁড়ে দিয়েছিল ঘরের মেঝেয়। দাঁতে দাঁত চেপে থরথর করে কাঁপছিল। দেয়াল ধরতে হয়েছিল তাকে। একটা মারখাওয়া গারদে আটকা মানুষের মতো সে ফিসফিস করে বলেছিল, কী করব! আমি কী করব!
এ অতি তুচ্ছ ব্যাপার। গণতান্ত্রিক ভারতের নতুন গঠনতন্ত্র রচনা হয়ে গিয়েছে। সমাধা হয়ে গিয়েছে দ্বিতীয় বৃহত্তম নিবাচন। জল জমেছে বাঁধে বাঁধে। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ নাকি দেখিয়েছে প্রকৃতিকে। ইলেকট্রিক পাওয়ার জমছে, ফুলছে ফাঁপছে। বিজলিগাড়ি আর কল্পনায় নেই। বাস্তবের রূপ নিয়ে সে উপস্থিত হবে শীঘ্রই। পুবে পশ্চিমে কাটা হাত, উত্তরের মাথায় জটায় ঘুম ঘুম সংশয় ও দক্ষিণে সমুদ্রে ডোবা সূচ্যগ্র পদযুগল ভারতবর্ষের ভূমিকা জুড়ে জীবনায়নের ছন্দ। উৎসবের নিনাদ তার নিটোল সূচিপত্রে। ভিতরের পাতায় পাতায় অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের ইতিহাস রচিত হচ্ছে।
আর পশ্চিমবঙ্গের এক দূর গ্রামে, এক বাঙালি যুবক মাথা কুটে জিজ্ঞেস করছে, আমি কী করব! আমি কী করব! এ অতি তুচ্ছ ব্যাপার। হয়তো এমনি একজন নয়, শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে চিরঞ্জীবেরা মাথা কুটে জিজ্ঞেস করছে, আমি কী করব! আমি কী করব! নয়া ভারতের অহঙ্কার ছিল তাদের। বিশাল বেদি জুড়ে বিরাট গঞ্জে তারা সমিধ হবে ভেবেছিল। কিন্তু নয়া ভারত যে কোনদিকে মোড় ঘুরল, সেটা ওরা ঠাহর করতেই পারলে না। যেন বিপথে বিভ্রান্তরা অন্ধকারে হাতড়ে ফিরতে লাগল। কর্তৃপক্ষের সময় রইল না ওদের দিকে ফিরে তাকাবার। যাঁরা প্রগতিশীল ভাবধারায় যজ্ঞটাকে নতুন মন্ত্রগানে ভিন্ন উৎসবে রূপান্তরিত করতে চাইলেন, চিরঞ্জীবেরা আসলে তাঁদেরই অনুগামী ছিল। কিন্তু তাঁদেরই একজনের হাতে প্রহার খেয়ে, রক্তাক্ত মুখে, অন্ধকারে বসে দূর গাঁয়ে কোনও এক কালের প্রগতিশীল যুবকটি, অদৃশ্য এক শক্তির কাছে আকুতি জানাচ্ছে, আমি কী করব! আমি কী করব!
জিজ্ঞেস করতে হবে। কারণ জীবন বসে থাকে না। প্রত্যহের জীবনধারণই সামগ্রিক যুগের একটি পরিণতি হয়ে বুঝি দেখা দেয়। প্রত্যহের বাঁচবার সঙ্গে নয়া ভারতের পথটা মিলল না। চোখ বোজো। চোখ বোজো হে ছেলেরা! কোন এক জাদুকর এসে যেন বললে ওদের। চোখ বোজো, হাত পাতো, নয়া ভারতের প্রসাদ দিই তোমাদের। যা পাবে, তা চোখ মেলে পরে দেখতে পাবে।
পাওয়ার জন্য উদগ্রীব। কারুর সময় নেই। প্রতিদিনই বাঁচতে হবে। সবাই চোখ বুজে প্রসাদ নিল। চিরঞ্জীবেরা তাকিয়ে দেখল, কী পেয়েছে। বিচারের সময় নেই, প্রতিবাদেরও সময় নেই। ভেগে পড়ো, কেটে পড়ো। আরও অনেক, অনেক মানুষ আছে। সময় নেই, কারণ প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে বাঁচতে হবে। দেহ দিয়ে, জিহ্বা দিয়ে, রক্তের স্রোত জিইয়ে রেখে বাঁচতে হবে প্রতি পলে পলে।
চিরঞ্জীবেরা চোখ খুলে, হাত খুলে দেখল, কে কোথায় সরে গেছে। প্রত্যহের তাগিদে তারা ছিটকে গেছে রাষ্ট্রনায়কদের ছায়া থেকে। আর শ্রীধরদারা চলে গেছেন আর একদিকে। প্রত্যহের পায়ে পায়ে ওরা অন্য শরিকানায় গিয়ে উঠেছে। সেখানে ডাইনের পদাঘাত আর বাঁয়ের চপেটাঘাত ওদের সারা গায়ে মাথায় পড়ছে। এখন জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে, আমি কী করব! আমি কী করব! যুগের পরিণতির আদর্শ দর্শনটা প্রতিদিনের মারে কোথায় হারিয়ে গেছে তখন।
চিরঞ্জীব যখন অমন রাগে ও দুঃখে জিজ্ঞেস করছিল, আমি কী করব, জানত না, আসলে অদৃশ্যে ওর সামনে শ্রীধরেরই মূর্তি ছিল। আর সেই মুহূর্তে ওর শিরফোলা ঝাপসা চোখে প্রত্যহের মূর্তি ধরে দাঁড়িয়েছিল একটি যুবতী। সুন্দর বড় বড় নখে যার রক্ত লেপা। তীব্র-রেখ-ঠোঁট রক্তাক্ত। কপালে এলিয়ে পড়া তার চুল। কপালে জ্বলজ্বলে রক্ত টিপ, সিঁথিতে দগদগে ঘায়ের মতো সিঁদুর। হাতে তার মদের পাত্র! সে হাসছে খিলখিল করে। উদ্ধত উত্তাল বুকে তার মরণের দোলা কাঁপছে থরথর করে। সাপের মতো পিছল সিল্ক শাড়ি তার ক্ষীণ কটিতটের অলস বন্ধন খুলে যেন ব্রহ্মার সেই বিশাল যজ্ঞবেদির লেলিহান শিখা জ্বলে উঠতে চাইছে। মুখে মদ নিয়ে সে কুলকুচো করে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে। সেই উচ্ছিষ্ট পানীয় পেয়ে, তার পায়ের নীচে কীটেরা প্রাণ পাচ্ছে, উল্লসিত হচ্ছে!
চিরঞ্জীব ওর রক্তাক্ত মুখটা দুহাতে লুকিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠেছিল, দিদি। দিদি। পরমুহূর্তেই ওর মুখটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। না, কাউকে আঘাত করতে ছুটে যায়নি সে। শুধু নিজেকে জবাব দিয়েছিল, যা করছিলুম, তাই করব। আরও আটঘাট বেঁধে, নিপুণভাবে, আরও বহুদূর ছড়িয়ে।
প্রত্যহ, প্রত্যহ, প্রত্যহেরই জয়। চিরঞ্জীব বাতি জ্বালিয়ে, হাত মুখ ধুয়ে মুছে, শান্তভাবে শুয়ে পড়েছিল।
.
সেই দৃঢ় নিষ্ঠুর ভয়ংকরতাই যেন আজ আবার ফুটে উঠল চিরঞ্জীবের মুখে। শ্রীধরের দিকে চোখ তুলে সে বলল, বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করার কী দরকার। শুয়ে পড়ুন, আমিও শুতে যাই।
শ্রীধরের মুখে ক্রোধের ছাপ নেই। কিন্তু বিদ্বেষ তার চোখে মুখে, গলার স্বরে। বললেন, তা হলে আমার কথার কি এই জবাব হল?
–আপনার আবার কথা কী?
–বোঝা যাচ্ছে না? গাঁয়ের গরিব কিষেণ-মজুরগুলোকে তোর ওই
–আমার কিছু নয়। আপনি কৃষক-নেতা, অ্যাসেম্বলিতে আপনি তাদের এম. এল. এ। আপনি আমাকে না বুঝিয়ে তাদেরই বোঝান গে। তবে একটা কথা বলে রাখি। রাত বিরেতে আবার যদি কোনওদিন এসে পড়েন, তবে আমাদের বাড়িতে না হোক, কাছাকাছি অন্য কোথায় থেকে যাবেন। একলা বিমলাপুর যাবেন না। নিদেন দুচারজন লোক সঙ্গে নিয়ে যাবেন।
বিদ্রুপে শাণিত হয়ে উঠলেন শ্রীধর। বললেন, কেন, মারবি নাকি?
চিরঞ্জীব বলল, আমি মারব না। আপনার ওই গরিব কিষেণ মজুররাই হয়তো আপনাকে ফাবড়া ছুড়ে মেরে ফেলবে। রাতে তারা তাদের নেতাকে চিনতে পারবে না। বিদেশি আনকা লোক ভেবে হয়তো আপনাকেই খুন করে, আপনার পকেট লুটবে। দিন কাল খুবই খারাপ।
শ্রীধরের শ্লেষ তাতে চাপা পড়ল না। বললেন, বটে! জানা ছিল না তো।
চিরঞ্জীব শান্তভাবেই জবাব দিল, কেন, খবরের কাগজে তো ছাপা হয় সব সংবাদ। মফস্বল সংবাদেই পাবেন। চুরি ডাকাতি খুন রাহাজানিতে শহরের চেয়ে গাঁয়ের লোকেরা বিশেষ পিছিয়ে নেই। প্রায় রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর করেই বা কী লোকগুলো। পেটের জ্বালা আছে তো!
–আর তোরাই তাদের নেতৃত্ব করছিস।
না। আমরাই তাদের কাছে শিখছি।
–এই মিথ্যেরও জবাব আছে চিরো। মনে রাখিস, যাদের ওপর দোষ দিচ্ছিস একদিন তাদের হাতেই তোদের মতো লোকের মরণ আছে।
–তার অনেক দেরি।
শ্রীধরের কাছে কথাটা কি দৈববাণীর মতো শোনাল? তার চোখে যেন একটি চকিত হতাশার ছায়া খেলে গেল। শ্রীধরের মতো সারা জীবন ধরে কষ্টভোগী লোক, আশাবাদী রাজনৈতিক কর্মীও যেন চোলাই মদের স্মাগলারের দৃঢ় কঠিন স্বরে মনের কোথায় ঘা খান ; পরমুহূর্তেই ঘৃণামিশ্রিত শ্লেষে বলে উঠলেন, সে-দিনক্ষণের পাঁজিও দেখে রেখেছিস নাকি?
চিরঞ্জীব আজ কোনও জবাব দিতেই ছাড়ল না। বলল, পাঁজি পুঁথি চিরদিন আপনারাই দেখে এসেছেন। গণৎকারের কাছে আপনাদের ভবিষ্যতের কথা আপনারাই বলেন। আমি যা দেখি তাই বলি।
শ্রীধর বললেন, কী জানি। এ সব কথাও হয়তো আজকাল বিহারী মিত্তিরের কাছে শিখেছিস।
বিহারীলাল মিত্র ছিলেন শ্রীধরের নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী। পরাজয় হয়েছে তার।
চিরঞ্জীব বলল, তা কী করে হবে? ওদেরই রাজ্য, ওদের হাতে আইন, চোলাইকারকে ওরা কখনওই শেখাতে আসে?
–আজ আসেনি, কাল আসবে, চাপা থাকবে না কিছুই। ভোট আসুক, কিছু একটা আন্দোলন হোক, চোর ডাকাত গুণ্ডা চোলাইকারেরা শামিল না হলে বিহারী মিত্তিরের রইল কারা?
বলে শ্রীধর হাসলেন। একটু বুঝি থিতিয়েই গেল চিরঞ্জীব। কথাটার মধ্যে সত্যের একটা অ্যাসিড-জাতীয় তীব্র গন্ধ ছিল। চোলাইকার অক্রূর দে বিহারী মিত্তিরের সহায়ক।
শ্রীধরের হাসিটা তখনও থামেনি। ভিতরের চেপে রাখা রাগ নিঃশব্দে খ্যাপা হাসির ছদ্মবেশে যেন ফুঁসতে লাগল। বললেন, সেদিন শুনব হয়তো, প্রগ্রেসিভ কিংবা লেফটিস্ট স্মাগলার।
বলতে বলতে শ্রীধরের মোটা গলার হাসিটা নিশুতি স্তব্ধতায় ফেটে পড়ল। ফেটে পড়ল চিরঞ্জীবেরই অশান্ত ক্ষুব্ধ বুকে। কারণ বিহারী মিত্তিরের সঙ্গে যে কোনওদিন চিরঞ্জীব হাত মেলাতে পারবে না, এ কথা শ্রীধর বোধহয় ভাল করেই জানেন। তবু খোঁচাচ্ছেন চিরঞ্জীবকে। এই বিহারী মিত্তির যখন চিরঞ্জীবের দিদির সঙ্গে শ্রীধরের নাম জড়িয়ে দুর্নাম রটিয়েছিল, তখন সে বিহারীকে খুন করতে চেয়েছিল। বলেছিল, ওকে খালধারের পাঁকে পুঁতে রেখে আসি। আপনি হুকুম দিন শ্রীধরদা।
শ্রীধর ধমকে বলেছিল, মাথা থেকে ও সব টেরোরিজমের পোকাগুলো ঝেড়ে ফ্যাল দিকিনি। কথায় কথায় খালি দাঙ্গা আর খুনোখুনি।
যদিও জানতেন, দাঙ্গা খুনোখুনি কখনওই চিরঞ্জীব করবে না। আসলে ওর ঘৃণা কোনও বাঁধ মানতে চাইত না। তা ছাড়া, লেফটিস্ট স্মাগলার বলে কোনও জীব যেমন থাকতে পারে না, তেমনি বিহারী মিত্তির আর অক্রূর দের দলের সঙ্গে কোনওদিনই চিরঞ্জীবদের মিল হবে না। রাগে অন্ধ হয়ে সে জবাব দিল, তা দরকার হলে বিহারী মিত্তিরের সঙ্গেও হাত মেলাতে হবে। আপনার দরকার পড়লে আপনিও আমাদের ডাকতে পারেন। বিহারী মিত্তিরের শত্রু, এ অঞ্চলের অনেক ডাকসাইটে বদমাশও তো আপনাকে ভোট দিয়েছে। নিজেরা দিয়েছে, দলের লোককে দিইয়েছে। তাতে কি আপনার উপকার কিছু কম হয়েছে?
–তারা চিরদিনই ওই রকম। তোর মতো রাজনীতির ভান করেনি কেউ।
–আমিও আর রাজনীতি করিনে।
–পুরনো সুযোগটা ভোগ করছিস।
না। কৃষক-সমিতির দোহাই দিলে চোলাই মদ বিকোয় না।
–কিন্তু চিরঞ্জীব বাঁড়ুজ্জের একটা নামডাক ছিল, তার দলে লোক বেশি আসে।
–তা ভোট দিয়ে, আর অ্যাসেম্বলির বক্তৃতায় যখন পেট ভরে না, তখন আসবে বইকী।
এ বিতর্কের শেষ হবে না। শ্রীধর নিরস্ত হলেন। তার কথা চিরঞ্জীব আজ আর বুঝতে চাইবে না। যে উদ্দেশে তিনি এত কথা তুলেছিলেন, গাঁয়ের সেই গরিব মানুষদের দূরে সরাবে না সে। গাঁয়ের শুধু গরিব মানুষই নয়, তিনি শুনেছেন প্রায় বাড়িতে বাড়িতেই মদ চোলাইয়ের কাজ চলছে আজকাল। চিরঞ্জীবকে সামনে রেখে রাগে তিনি রুদ্র হয়ে ওঠেন। তবু শুধু বিস্ময় নয়, এক এক সময় ভয় পান শ্রীধর। সমস্ত গ্রামগুলি জুড়ে কী ভয়াবহ নৈতিক অবনতির লক্ষণ সব ফুটে উঠেছে। এ যেন অনাবৃষ্টি হলেই মাঠ জুড়ে সব ধান ক্ষেতের মরণ। অভাব যতই বাড়ছে, নৈতিক মান তত নামছে। চোখ বুজে থাকলেও এ সত্য গায়ে এসে খোঁচা দেয়। কিন্তু এ কি শুধুই অভাব? অভাব কি আর কোনওদিন ছিল না বাংলাদেশে? ছিল। কিন্তু এমন অস্থিরতা, এমন বিবেকহীন ধৈর্যহীন অন্ধ হয়ে ওঠা, গ্রামে গ্রামে আর কোনও যুগে বুঝি দেখা যায়নি। শুধু চোলাই মদের স্মাগলারদের জামিন নয়, সময়ে সময়ে চুরি-ডাকাতির কেসেও তাকে জামিনদার হতে হয়। কারণ সেই সব লোকেরা সত্যি শ্রীধরের আপনজন, কেউ কেউ কৃষক আন্দোলনের সহযোদ্ধা। আর সর্বক্ষেত্রেই তাদের নামে মিথ্যে কেস সাজানো হয় না। ঘটনা কোনও কোনও ক্ষেত্রে সত্যি। প্রত্যহ নতুন নতুন দুর্ঘটনা। কারুর যেন ভাববার সময় নেই। সবাই যেন দিশেহারা হয়ে ছুটছে। ছুটে ছুটে বাঁচতে চাইছে। গাঁয়ে যে আগুন লেগেছে, সে কথা মনে নেই। যত ছুটছে সবাই দিগবিদিকে, আগুন তত বাড়ছে, ছড়াচ্ছে, ফুঁসছে। অতি সাধারণ স্বাভাবিক পারিবারিক ধ্যান ধারণাগুলো পর্যন্ত দ্রুত ভাঙছে। নদী যেমন করে গতি বদলায়, স্রোত নয়া বাঁকে ফেরে, নতুন নতুন গ্রাম ভাঙে, গ্রাস করে, ঠিক তেমনি সব ভাঙছে।
শ্রীধর তাঁর বিদ্যা বুদ্ধি অভিজ্ঞতা যুক্তি দিয়ে সেই নতুন বাঁকে-ফেরা চোরা নদীটিকে যেন পুরোপুরি আবিষ্কার করতে পারছেন না। শুধু এইটুকু জানেন, কর্তৃপক্ষের শাসনের পক্ষে এই অবনতি সুবিধাজনক। অন্তরে অন্তরে তারা এর সমর্থক। এ অবনতিকে তারা জিইয়ে রাখতে চায়। এই অবনতিই শ্রীধরের পরাজয় ঘোষণা করবে।
কিন্তু গরিব মানুষগুলির, নিজেদের কি কোনও সত্তা নেই? নিজেদের কি কোনও ভাবনা অনুভূতি নেই। তিনি যে জানতেন, এ হাড় ভাঙে কিন্তু মচকায় না। তিনি বিশ্বাস করেন, গরিবেরা বিপথে যাবে না, তারা লড়বে তাদের অবস্থার বিরুদ্ধে। বিদ্রোহ করবে। তারা কখনও বিশ্বাস হারাবে না।
কিন্তু এত অবিশ্বাস কোথা থেকে এল? কোন পথ দিয়ে আসছে? সেই চোরাপথের মুখটা কোথায়? শুধু অভাব?
শ্রীধর শহরকে চেনেন না। গ্রাম তাঁর অচেনা নয়। গ্রামের মধ্যবিত্ত জীবনের শিক্ষা-সংস্কৃতি মিলিয়ে যে পারিবারিক সৌন্দর্যবোধ ছিল, সেগুলি কেন ভাঙছে? অভাব? শুধু অভাব? কিষেণবাগের ইউনিয়ন বোর্ডের হাইস্কুলের হোস্টেলের ছেলেরা দল বেঁধে গৃহস্থের বাড়িতে ডাকাতি করল কেন? তারা ক্লাস নাইন-টেনের ছেলে। চোদ্দো থেকে সতেরোর মধ্যে তাদের বয়স। তারা বোমা তৈরি করেছে, দেশি বন্দুক সংগ্রহ করেছে। হয়তো ক্লাশে বসে বসেই তারা প্ল্যান করেছে। তারপর ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। একজন দুজন নয়, তিরিশজনের দল। কেন? ওই ছোট ছোট ছেলেরা ডাকাতের দল করেছে কেন? এ কি শুধু অভাব?
দ্বিধার কাঁটায় আড়ষ্ট হয়ে থাকেন শ্রীধর। তবু নিরস্ত থাকবেন মনে করেও থাকতে পারেন না। চিরঞ্জীবের কথার জবাব না দিয়ে পারেন না। কারণ, তীক্ষ্ণ যুক্তি না থাক, ভবিষ্যতের একটি আশা হারাতে পারেন না। বললেন, ভোট আর অ্যাসেম্বলি পেট ভরাতে পারছে না বলে চোরের সাফাই গাইছিস। কিন্তু একদিন থাকবে না, বদলাবে। সেটা ভুলে যাস না।
–ভুলব কেন? আসুক সেদিন।
–এলেও, তোর কোনও সুবিধেই হবে না। এতদিন মিটিং-এ আমি তোদের কথা তুলিনি। কালকের বিমলাপুরের মিটিং-এ তুলব। তোদের নাম করে করে বলব সভায়, এদের তাড়াও গ্রাম থেকে। এদের ধরিয়ে দাও পুলিশে।
চিরঞ্জীবের রাত্রি-জাগা চোখে জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো হাসি চকচকিয়ে উঠল। বলল, নতুন শ্লোগান?
-হ্যাঁ, নতুন শ্লোগান।
-চেষ্টা করে দেখুন।
শ্রীধর তাঁর কিম্ভূত বিশাল ছায়াটা নিয়ে তক্তপোশের দিকে এগিয়ে গেলেন। বালিশের পাশ থেকে রিস্টওয়াচটা তুলে দেখলেন, রাত্রি আড়াইটা বেজে গেছে। তবু তিনি শুতে যেতে পারছেন না। লক্ষ করলেন, চিরঞ্জীব মুখ ফিরিয়ে পাশের ঘরে যাবার উদ্যোগ করছে। মুখ না ফিরিয়েই শ্রীধর ডাকলেন, চিরো।
চিরঞ্জীব নিঃশব্দে তীক্ষ্ণ চোখে ফিরে তাকাল। চোখে-মুখে তার উত্তেজনার আগুন। দুবছর আগের মার-খাওয়া সেই রাত্রির মুখটাই যেন। কঠিন নিষ্ঠুর সেই দৃঢ়তা। এক পাও পিছনে নয়, আরও শক্ত পায়ে সে এগুবে। কারণ মরণেও বড় ভয় নেই তার।
কিন্তু শ্রীধরের গলায় রাগ-বিদ্বেষ আর নেই। ব্যথা থাকলেও তাঁর কালো শক্ত মুখে সে-ছাপ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবু ডাকের মধ্যে যেন একটি পুরনো সুর ফুটে উঠল।
শ্রীধর চিরঞ্জীবের দিকে ফিরলেন। গলা অনেকখানি নরম হয়ে উঠল তাঁর। বললেন, কমলার কোনও খবর জানিস নাকি?
উত্তেজনাটা কমল না চিরঞ্জীবের। কিন্তু চকিতে একবার চোখাচোখি করেই, দৃষ্টি নামাল সে। প্রায় অস্ফুট গলায় জবাব দিল, না।
শ্রীধরের চোখে সন্ধিগ্ধ দৃষ্টি। বললেন, কোনও খবরই নেই? শুনেছিলুম, সদরেই আছে।
চিরঞ্জীব বলল, আমিও তাই শুনেছি।
শ্রীধর আবার বললেন, তোর লোকেরাও কোনও খবর রাখে না?
চিরঞ্জীব মুখ না ফিরিয়েই বলল, হয়তো রাখে। আমাকে বলতে সাহস পায় না।
বাইরের অন্ধকার বারান্দায় চিরঞ্জীবের মা এবার পুরোপুরি দরজার দিকে ফিরে দাঁড়ালেন। তার দুই চোখে অনেক কথা ঝিকমিক করে উঠল। রেখাবহুল ঠোঁট কেঁপে উঠল। ঘরের ভিতর আসবার জন্য বুঝি পা বাড়াতেও যাচ্ছিলেন।
পরমুহূর্তেই সভয়ে পেছিয়ে এলেন যেন। থানের আঁচল চাপলেন মুখে। পায়ে পায়ে ফিরে গেলেন এবার নিজের ঘরে। আঁচলটা আরও জোরে চাপতে লাগলেন। কারণ একটা তীব্র শব্দ কমলার নাম ধরে তাঁর বুকের ভিতর থেকে উঠে যেন এ রাত্রিকে বিদীর্ণ করতে চাইছিল। কারণ, কমলার খবর শুধু উনিই জানেন। উনিই রাখেন। কিন্তু ও-নাম তাঁকে আর উচ্চারণ করতে নেই।
ঘরের মধ্যে শ্রীধর আবার বললেন, ভাবব না মনে করি। তবু মন থেকে যায় না। এখনও অবাক লাগে, বিশ্বাস হয় না। কেমন করেই বা হবে? কিন্তু পৃথিবীতে দেখছি সবই ঘটতে পারে। আমরা ভাবতে পারি আর না পারি।
একটি নিশ্বাস ফেলে বললেন, যা, শুয়ে পড়গে। আমি আর ঘণ্টাখানেক বাদেই বেরিয়ে পড়ব। কলকাতার মাল নিয়ে যে-সব গোরুর গাড়ি আসবে, তাদেরই একজনকে ধরে চলে যাব।
চিরঞ্জীব বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। কিন্তু সে শুতে পারল না। দিদির কথা মনে পড়েছে তার। দিদির নাম কমলা। দিদির সব খবরই জানে সে। সে জানে, দিদি সদর শহরের, গঙ্গার ধারে সেই পাড়াতেই আছে। সেই পাড়াতে যারা থাকে, তাদের মতোই আছে। সে পাড়াতে এখন ওর খুব নাম। লোকে বলে, মক্ষিরানি। কলকাতার লোক আসে তার আছে। নিজেও কলকাতায় যায় সে রকম আমন্ত্রণ পেলে। সদর শহরের কাঁচা পয়সা এখন কমলার পায়ে স্তূপাকার।
পতিতপাবন বাঁড়ুজ্জের অন্দরমহলে বাড়ির ইটে নোনা ধরেছিল অনেকদিন। বলু বাঁড়ুজ্জের মহলে সেটা কবে থেকে যে গোড়ার ভিত-সুদ্ধ ক্ষয়ে গেছল, কেউ টের পায়নি। টের পাওয়া গেল সেদিন যেদিন সাতাশ বছরের অরক্ষণীয়া কমলা গৃহত্যাগ করল। আর একটি জায়গায় কোপ দিয়ে গেছল কমলা। সেটা হল এ সংসারের প্রতি চিরঞ্জীবের বিশ্বাসের মূল। সেই সময় চিরঞ্জীব কয়েক মাস লোকচক্ষে পালিয়ে বেড়িয়েছে।
কিন্তু দিদিকে চিরঞ্জীব ঘৃণা করতে সাহস করেনি। রাগ হয়েছিল, অভিমান হয়েছিল। ঘৃণা করেছিল সে শুধু মাকে। যে কথা বাইরের মানুষকে বলা যায় না, এমনকী আপন জনকেও বলা যায় না। সে কথা নিজের কাছে চাপতে পারে না কেউ। সে তার মায়ের লুব্ধ চোখে বারে বারে দেখতে পেয়েছে, দিদির মূল্যে এ সংসারের দায় মেটানোর বাসনা। চিরঞ্জীবের কথা বলার অধিকার সেখানে ছিল না। মায়ের আলাপের সূত্র ধরে গাঁয়ের যে-সব সম্পন্ন লোকেরা এ বাড়িতে আড্ডা জমিয়েছিল, তাদের মুখের দিকে কোনওদিন ফিরে তাকাতেও ঘৃণা ছিল তার। সম্পর্কে তারা কেউ মায়ের দেওর, কেউ ভাসুরপো। চিরঞ্জীব তাদের কোনওদিন কাকা দাদা বলে ডাকেনি। তার গায়ের মধ্যে জ্বলছে রি রি করে। ভিতরে ভিতরে একটি অপমানিত ক্রুদ্ধ শক্তি তার হাতের মুষ্টিতে দপদপ করেছে। তার কানের মধ্যে তরল আগুনের স্রোত বয়েছে, যখন সে শুনতে পেয়েছে তার মায়ের গলা, কমলা ও কমলা, অশ্বিনী-ঠাকুরপোকে একটু পান দিয়ে যা।
তার আগেই মায়ের বলা থাকত, ফরসা জামা কাপড় পরে একটু সেজে-গুজে যেন অশ্বিনী চাটুয্যের সামনে যায় কমলা। কারণ, আর কিছুই নয়, অশ্বিনীর চোখে যদি ভাল লাগে, তবে সে আরও দশটা লোককে বলতে পারবে, বিয়ের সম্বন্ধের জন্য। কিন্তু চিরঞ্জীব জানত, অশ্বিনী চাটুয্যে কোনওদিনই দিদির বিয়ের সম্বন্ধ দেখবে না। আশা সে দেবে অনেক রকম। অভিভাবকত্বের ভান করবে রকমারি। কিন্তু বুকে-হাঁটা কেঁচো প্রবৃত্তি তার চোখে লালা হয়ে ঝরতে দেখেছে চিরঞ্জীব। অশ্বিনী চাটুয্যেদের যে-থাবা বরাবর বাগদিপাড়া কিংবা মুচিপাড়ায় হাতড়ে বেড়িয়েছে, সেই থাবার সাহস সর্বত্র অবাধ হয়ে উঠেছিল আগেই। দিদির সঙ্গে কথাবার্তা চাউনির হাবভাব মোটেই কাকার মতো নয়। আর চিরঞ্জীবের বিশ্বাস, একথা তার মাও জানত। জেনে-শুনেই পান দেবার ছলচাতুরি। সেজে-গুজে কাছে যাবার নির্দেশ। নইলে, অশ্বিনী চাটুয্যের করুণার উদ্রেক করা যেত না বুঝি।
দিদি কেন যেত? কেন সাজত? ও কি বিশ্বাস করত, অশ্বিনীকাকা সত্যি ওর বিয়ে দিয়ে দেবে? সে কথা কোনওদিন মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারেনি চিরঞ্জীব। কারণ, জিজ্ঞেস করার রুচি এবং সাহস কোনওটাই ছিল না। কিন্তু বুঝত, দিদিও বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করে না, তবু যেতে হত। অশ্বিনী চাটুয্যের পয়সার আগুন আর দানা এ বাড়ির হেঁসেলে ছিল। চিরঞ্জীবের পেটেও কি যায়নি?
কিন্তু মায়ের ভাষায় চিরঞ্জীব শুধু ছিধর চাষার, চাষা-সমিতির বিনে মাইনের ফোতো মোড়ল। তার কিছু বলবার অধিকার ছিল না। কৃষক-সমিতির কাজে সে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছে। কিন্তু বাড়ি এসে ওই আগুনই গুঁজতে হয়েছে পেটে। সে বিনা মাইনের লোক ছিল, বিনা কাজের নয়। সমিতির কাছে পয়সা চাওয়ার কথা কখনও তার মনে হয়নি। পয়সা অবশ্য সমিতির ছিল না। ধান-চাল ছিল কিছু। কৃষক-সমিতির দরিদ্র সভ্যদের সেই ধান-চাল নিজের হাতে ভাগ করে দিত সে। নিজের জন্য আনা যায় কি না, একথা ভাবেনি কোনওদিন। শ্রীধরও কোনওদিন কিছু বলেনি এ বিষয়ে। শুধু চিরঞ্জীবের মতো একটি কর্মীর জন্য তাঁর গর্বের অন্ত ছিল না। আর এও নিশ্চয় ভেবে নিয়েছিলেন, কোনও কারণে কষ্ট হলে চিরঞ্জীব তাঁকে বলবে।
শহরে গিয়ে চাকরির সন্ধান করতে বলেছে মা। কিন্তু কৃষক-সমিতি ছেড়ে যাওয়া যায় কেমন করে? আর শহরে কার কাছে গিয়ে সে চাকরির সন্ধান করে বেড়াবে? তাই চিরঞ্জীব তখন সব দিক দিয়ে তার মায়ের চক্ষুশূল। আপন গৃহে পরবাসী বলা যায়।
তারপর শুধু আর অশ্বিনী চাটুয্যের একলার অধিকার থাকেনি, তাদের বাড়িতে, আরও কয়েকজনের আবির্ভাব হয়েছিল। তার মধ্যে মহকুমা আদালতে কেরানির কাজ করত, রামনাথও ছিল। রামনাথ প্রায় সোনার পাথর-বাটি। দেখতে সুপুরুষ, বয়স তখন প্রায় চল্লিশ। নৈকষ্য কুলীন মুখুজ্জে। কিন্তু বিয়ে করেনি। দুর্নাম ছিল নানারকম। গ্রামে আসা-যাওয়া তার কমই ছিল। কিন্তু ভ্রমরকে বুঝি ফুলের সংবাদ কাউকে দিতে হয় না। সে নিজেই আসে। সে যখন চিরঞ্জীবদের বাড়িতে আসতে আরম্ভ করেছিল, অশ্বিনী চাটুয্যের বিষাক্ত জিভ তখনই লকলকিয়ে উঠেছিল। কিন্তু অশ্বিনী চাটুয্যে পূর্ণিমার চাঁদ। রাত পোহালেই তার ক্ষয়। রামনাথ, প্রায় প্রথমার চাঁদ বলা যায়। যেখানে প্রতিদিনের আশা।
এখন চিরঞ্জীব বুঝতে পারে, দিদি সকলের সঙ্গে ছলনা করেছিল! রামনাথের সঙ্গে পারেনি। রামনাথকে সেও বিশ্বাস করেছিল। আশা করেছিল, স্বপ্ন দেখেছিল। হয়তো খুব সহজে আশা করেছিল, স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু এই গ্রামে, সাতাশ বছরের আইবুড়ো মেয়ের ভয়ংকর হতাশার কথা কে কবে ভেবেছে? তার ওপরে পেছনে যদি থাকে মায়ের প্ররোচনা।
একদিন রাত্রে বাড়ি ফিরে দেখেছিল চিরঞ্জীব, বাড়ি অন্ধকার কিন্তু ঘর-দুয়ার খোলা। বারান্দার এক কোণে মা। আর এক কোণে দিদি। মা স্তব্ধ। দিদি কাঁদছে ফুলে ফুলে। কেউ তার সঙ্গে একটি কথা বলেনি। এই মা-মেয়েকে সে এমনভাবে কোনওদিন বসে থাকতে দেখেনি। এই দুই বান্ধবীকে এত ফারাকে আর সেই ফারাকের মাঝখানে এমন দুর্লঙঘ , সাপের মতো হিংস্র, ভয়ংকর জটিলতা তার চোখে পড়েনি।
কেমন একটা ভয় শিসিয়ে উঠেছিল চিরঞ্জীবের বুকে। মনে হয়েছিল, তার আকৈশোর জীবনের ছন্দ অনেক আগেই কেটেছিল, টের পায়নি। সেই দিন মনে হয়েছিল, এইবার সত্যিকারের অন্ধকারের সামনে সে পড়ল। বদল হয়ে গেল তার পথ।
মায়ের সঙ্গে কথা বলার কিছুই ছিল না। সে কমলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়েছে রে দিদি? কাঁদছিস কেন?
চুপচাপ। হয়তো কতদিনই তো কেঁদেছে দিদি অমন করে। কোনওদিন জিজ্ঞেস করেছে চিরঞ্জীব? কিন্তু একটু পরেই জবাব দিয়েছিল কমলা, চিরো, আজ কিন্তু কিছু রান্না হয়নি। কিছু যদি খেয়ে না এসে থাকিস বাইরে থেকে, তবে উপোস যাবি রাত্তিরটা।
মা বলে উঠেছিল, ফোঁপানো কান্নার সুরে, আর উপোস! এত বড় ছেলে, সে মেয়ের চেয়ে আমার বড় গলার কাঁটা। কাকে কী বলব!
মায়ের গলায় কেমন যেন তোশামোদের সুর মনে হয়েছিল। এবং সেটা চিরঞ্জীবকেই। তাতে আরও বেশি ঘৃণা হয়েছিল চিরঞ্জীবের।
কিন্তু আসল কথাটা তাকে বলেনি কেউ। সে যে ছোট, সেটা এ বাড়ির কেউ কখনও ভোলেনি। চিরঞ্জীবকেও কখনও ভুলতে দেয়নি। এ সংসারের কোনওটা তখন সজ্ঞানে এড়িয়ে যায়নি চিরঞ্জীব। মা-দিদির দায়িত্বের অজ্ঞতার দায়টাও তার একলার ছিল না। যদিও সে অবুঝ ছিল না। চার বিঘা ধান-জমি শেষ সম্বল। সেটাও ভাগে ছাড়া চাষ করার উপায় ছিল না। তাতে যে কোনও সংসারেরই বছর চলে না, এ কথা বুঝতে বেশি বয়সের দরকার হয় না। তবু, চলে যায়, যাবেও আজন্ম এই জানা কথাটা প্রায় ছন্দের মতোই ছিল। সেটাই সে রাত্রে প্রথম কেটেছিল!
এখন ভাবলে অবাক লাগে। অথচ এই চিরঞ্জীব মন মন ধান ভাগ করে দিত কৃষক-সমিতির দুঃস্থ আর ভূমিহীন কৃষকদের। কার কী অবস্থা, সেই বিচারের ভার ছিল তার ওপরেই। কোনওদিন কেউ নালিশ করতে পারেনি তার বিচারের ওপর।
আসলে এই বুঝি হয়। ঘরে আর বাইরে, কৃষক-আন্দোলন আর সংসার, দুটি আলাদা জীবন যেন। এদের যোগাযোগ ঘটাতে পারেনি সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ চিরঞ্জীব।
ছন্দে বেতাল বেজেছিল। সেই প্রথম দেখা ভবিষ্যৎ, যে চিরদিনই গাঢ় অন্ধকার সংশয়, ভয় ও বিস্ময়ে আবৃত, তার সামনে যেন সহসা এসে দাঁড়িয়েছিল চিরঞ্জীব। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল অনেক। ভবিষ্যৎটা তখন নরকের সদর দেউড়ি পার হয়ে গিয়েছিল। ঘণ্টা বাজছিল নরকের।
শব্দটা কাঁপিয়ে দিয়েছিল চিরঞ্জীবকে, সেই রাত্রেই কমলার বমির শব্দে। কমলা ওয়াক তুলেছিল। আর সেই শব্দের সঙ্গে তাল রেখে মা বলেছিল, মরে যা, তার চেয়ে তুই মর কমলা। ওরে ঘুসকি, ছেনাল, রক্তে তোর বড় জ্বালা। তুই মর, মর, মর!
দিদির কোনও কথা শোনা যায়নি। দেখে এবং জেনেই শুধু অভিজ্ঞতা হয় না। মানুষের আর একটা বোধ হয় মন থাকে। সে যেন কেমন করে অনেক কিছু জানতে পারে। চিরঞ্জীব বুঝতে পেরেছিল, দিদি অন্তঃসত্ত্বা।
সেই রাত্রে ঘুম হয়নি চিরঞ্জীবের। শ্রীধরের কাছে যেতে ইচ্ছে করেছিল তার। বলতে ইচ্ছে করছিল সব কথা। কিন্তু পারেনি। আর সেই তার প্রথম মনে হয়েছিল, শ্রীধরদাও দিদির দিকে তাকিয়ে যেন কেমন দুর্বল হয়ে যেতেন। দিদির কথা পারতপক্ষে বলতেন না। যেন দিদির নামটা শ্রীধরদার নিতে নেই! কিন্তু দিদিকে একেবারে দুরাশা বলেই জানতেন তিনি। কারণ, শ্রীধরদারা সদগোপ। এর নাম বাংলা দেশের গ্রাম। কোনওরকম এদিক ওদিক হলে, এ দেশে কৃষক-আন্দোলন করা সম্ভব নয়। ভোট পাওয়া আরও দুরূহ। একে জাতের বিচার, তায় প্রেম। কর্মীকে পাততাড়ি গুটোতে হবে।
শ্রীধরদা যেন ভয়েই নীরব থাকতেন। কোনও কথা জিজ্ঞেস করতেন না। সমিতির বন্ধুরাই কে কখন কী মনে করে বসবে।
পরে আর শ্রীধরকেও কিছু বলবার অবকাশ পাওয়া যায়নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে প্রথম তার মায়ের কান্না শুনেছিল, ওরে চিরো, কমলি কোথায় চলে গেছে।
গ্রামে রাষ্ট্র হতে দেরি হয়নি। তখন চিরঞ্জীবও কিছুদিনের জন্য বাড়ি ছেড়েছিল। শ্রীরামপুর, চুঁচুড়া, চন্দননগরের আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়েছে। দিদিকে খুঁজতে কিংবা ঠিক চাকরি খুঁজতেও নয়। সে কৃষক-সমিতি করবে না। মার কাছে যাবে না। সে অন্য কিছু করবে। অন্য কোথাও থাকবে। এই ছিল তখন আপাত চিন্তা। সেটা কোনও সুষ্ঠুভাবে নয়। একটা অস্থির অবোধ বদ্ধ যন্ত্রণা ও ভাবনায় অচৈতন্য ঘোরের মতো। কলেজে-পড়া অনেক চেনা ছেলে ছিল ওই সব শহরগুলিতে। কিন্তু বেশিদিন ঠাঁই কারুর কাছেই পাওয়া যায়নি। খেয়ে এবং না-খেয়ে ঘুরেছে ভবঘুরের মতো।
ইতিমধ্যে আর শুধু রামনাথের রক্ষিতা নয়, কমলা যে পুরোপুরি দেহোপজীবিনীর জীবন যাপন করছে, সে সংবাদও পেয়েছিল। শুধু জানা যায়নি, তার গর্ভের সন্তানটির কী পরিণতি হয়েছে।
তার দেখা হয়েছিল জটার সঙ্গে। সে জটা এখন তারই দলভুক্ত হয়ে কাজ করে। চন্দননগরে, লক্ষ্মীগঞ্জের কাছে দেখা হয়েছিল জটার সঙ্গে। তাকে খাইয়েছিল আর একটা কাজ করতে দিয়েছিল। কাজটা এমন কিছু নয়। একটা সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে, গঙ্গায় নিয়ে যেতে হবে। সেখান থেকে খেয়া নৌকায় পার হয়ে যেতে হবে ওপারে। গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। পরের খেয়ায় জটা পার হয়ে সাইকেলটা নিয়ে যাবে।
কারণ? সেটা পরে জানা গিয়েছিল। নির্বিঘ্নেই পার হয়ে গিয়েছিল চিরঞ্জীব। পরের খেয়ায় জটা এসেছিল। জটার সঙ্গে গিয়েছিল চিরঞ্জীব ওপারের চটকল-শহরে। শহরের বস্তি-অরণ্যে। যেখানে মাতাল হয়ে জুয়ার অন্ধকার গুহা থেকে কোনওদিন একলা বেরিয়ে আসার সাধ্য ছিল না চিরঞ্জীবের। সাইকেলের টায়ার খুলে, মদ ভরতি টিউব দুটি বার করেছিল। ফিরে আসার সময় কিছু প্রাপ্তিও হয়েছিল চিরঞ্জীবের।
সেই শুরু। ব্যাপারটা যে একেবারেই জানা ছিল না, তা নয়। কিন্তু অমন প্রত্যক্ষভাবে জানা ছিল না। বাঁকা বাগদি থেকে শুরু করে, অনেককেই সে একাজে লিপ্ত বলে জানত। ভাববার দরকার হয়নি কোনওদিন। সেইদিন থেকে ভেবেছিল। গ্রামে ফিরে এসে, দূর মাঠের দিকে তাকিয়ে কেন যেন তার দুচোখ জ্বলে উঠেছিল অঙ্গারের মতো। শক্ত হয়ে উঠেছিল চোয়াল।
অবিশ্বাস আর নৈরাশ্য তাকে ঘিরে ডাকিনীর মন্ত্র ছুঁড়ছিল। তারপর এসে ধরেছিল দুই হাত। গ্রাস করেছিল সমস্ত চেতনা। শ্রীধরদাদের কথা কি একবারও মনে হয়নি? হয়েছিল। মনে হয়েছিল, সংসারে ওপর দু-চারটে লোক থাকে। যেমন সাধুসন্ন্যাসী ধর্ম নিয়ে মজে থাকে, সেইরকম এরাও একটা কিছু নিয়ে থাকে।
কিন্তু নৈরাশ্য ও অবিশ্বাস এমন জিনিস, যে চিরঞ্জীবকে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো খেটে খাবার পথে নিয়ে যায়নি। কয়েক মাসের মধ্যে হুগলি জেলার ইল্লিসিট লিকার ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড স্মাগলার বলে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। সবাই বলেছিল, এ সেই বাঁকা বাগদির আত্মা।
.
দূরে মালগাড়ির শব্দ শোনা গেল। চিরঞ্জীব উঠল। এখনও তার চোখে সেই আগুন। মুখটা যেন শক্ত, নিষ্ঠুর। পা দিয়ে খোঁচা দিল সে ঘুমন্ত গুলিকে। গুলি লাফ দিয়ে উঠল।
চিরঞ্জীব রুক্ষ চাপা স্বরে বলল, স্টেশনে চলে যা। মাল যাবার সময় হল।
গুলি যেন ঘুমোয়নি, এত তাড়াতাড়ি সে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। কিন্তু চিরঞ্জীবের রুক্ষতায় একটু অবাক হল সে। বাইরে তখনও বেশ অন্ধকার। হাওয়া আরও বেড়েছে। গোটা-তিনেক খোকা কোথা পাখি ডাকছে কোথায়। মাঝে মাঝে শোনা যায় কাকের ডাক। সেটা যেন খানিকটা জিজ্ঞাসা, রাত পোহালো?
দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল শ্রীধরের। বালিশের তলায় হাত দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘড়িটা বার করলেন। কিন্তু অন্ধকার। দরজা খোলা দেখে বলে উঠলেন, চিরঞ্জীব বেরিয়ে গেলি নাকি?
বেরোয়নি। বেরোবার জন্য প্রস্তুত। জামা খোলা আর শোয়া হয়নি এ পর্যন্ত চিরঞ্জীবের। সে এ-ঘরে এসে, সাইকেলে হাত দিয়ে বলল, হ্যাঁ বেরুচ্ছি। আপনি পরে বেরুতে পারেন। গোরুর গাড়িগুলো এখন আসছে। ওদের ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে যাবে।
–তুই কোথায় যাচ্ছিস?
চিরঞ্জীব এক মুহূর্ত চুপ। বলল, বাইরে। একটু দরকার আছে।
অন্ধকারের মধ্যে শ্রীধর তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ফিরবি কখন?
-ঠিক নেই।
-আচ্ছা, তুই যা আমি বেরুচ্ছি। কিন্তু দরজা যে খোলা থাকবে।
খোলাই থাকে।