Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » প্রিয়গুপ্তের অভিজ্ঞানশকুন্তলম || Shankarlal Bhattacharya

প্রিয়গুপ্তের অভিজ্ঞানশকুন্তলম || Shankarlal Bhattacharya

হর্হে লুইস বোর্হেসকে নিবেদিত

উজ্জয়িনীর পার্শ্ববর্তী মেদিনীরাজ্যে প্রিয়গুপ্ত দার্শনিক থাকেন। নিজের বাসস্থলের তল্লাটটাও ভালো করে দেখে নেবার ফুরসতটুকু এই তরুণ দার্শনিকের বড়ো একটা হয়নি। জগৎ সম্পর্কে ধারণা তাঁর যতই লঘু ততই গুরু তাঁর দর্শনচিন্তা। এযাবৎ তিনি কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলমের টীকাকৃতিতে ব্যস্ত। মুখ গুঁজে বই ঘাঁটেন, লেখার সময়টায় বিস্তর লেখেন। প্রিয়গুপ্ত বাস্তবিকই ঘাবড়ে গেছিলেন রাজার পেয়াদা তাঁকেই খোঁজ করছে শুনে। গুরুতর কাজ ফেলে প্রিয়গুপ্ত রাজসভায় গিয়ে যা শুনলেন তাতে ওঁর বিস্মিত না হয়ে উপায় ছিল না। রাজ্যের গুণিন সামন্তসেন রায় দিয়েছেন রাজকুমারী রাগেশ্রীর শুভবিবাহে সব চেয়ে বড়ো বাগড়া প্রিয়গুপ্ত। নেই নেই করে সাত-সাতটা চমৎকার যোগাযোগ নষ্ট হয়েছে, কারণ এই প্রিয়গুপ্ত মনে-প্রাণে কামনা করেন রাগেশ্রীকে। এবং এই অশুভ কামনার অবসান না হলে রাজকুমারীর কোনো সম্বন্ধই টিকবে না। রাজা বললেন, দার্শনিক! তোমার এত বড়ো স্পর্ধা কী করে হল! সাধারণ রক্তের মানুষ তুমি রাজরক্তের স্ত্রী কামনা কর কী সাহসে? প্রিয়গুপ্ত এতটা আশ্চর্য কখনোই হননি। দর্শনের কোনো জটিল সমস্যাও তাঁকে এতখানি বিব্রত কখনো করেনি। তাই মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, কিন্তু রাজন, আমি তো আপনার কন্যাকে কখনো দেখিনি। তাঁকে আমি কামনা করব কী করে? তা ছাড়া ইদানীং আমি অভিজ্ঞানশকুন্তলমের টীকা লিখনে ব্যস্ত আছি। কোনো স্ত্রীসংক্রান্ত চিন্তা আমাকে স্পর্শ করে না। এবার সামন্তসেন আসন থেকে উঠে দার্শনিকের কাঁধে হাত রাখলেন। সাদা দাড়িগুলো চুলকোতে চুলকোতে বললেন, তুমি না সত্যানুসন্ধী দার্শনিক! এরকম মিথ্যে কথার খই ফোঁটাচ্ছ কী ভেবে?

প্রিয়গুপ্তের এবার সত্যিই কান্না পাচ্ছিল। ছুটে গিয়ে রাজার সামনে নতজানু হয়ে বলতে লাগলেন, বিশ্বাস করুন রাজন আমি আপনার কন্যাকে কখনো দেখিনি, চিনি না, কামনা করি না। রাজা একটু ভাবিত হচ্ছেন দেখে সামন্তসেন বললেন, তাহলে দাঁড়াও দার্শনিক। আমি আমার যৌগিক আয়নাটা আনাই। তাতেই তোমার সব ধড়িবাজি ধরা পড়বে।

দেখতে দেখতে চারজন পেয়াদা একটা বিশাল আয়না এনে সভায় হাজির করল। আয়না, অথচ তাতে কোনো কিছুর প্রতিফলন ঘটছে না। গুণিন বললেন, তুমি যে নারীকে অদ্যাবধি চিন্তা করেছ তাকেই স্মরণ করো। আয়নাতে তার প্রতিবিম্ব ফুটবে। সে নারী যদি আমাদের জনগণপ্রিয় রাজকুমারী না হন তাহলেই রাজা তোমাকে মুক্তি দেবেন।

প্রিয়গুপ্ত বললেন, কিন্তু গুণিন, আমি যে নারীর চরিত্রমাধুর্যের পর্যালোচনা করি সে তো বাস্তবের কোনো লোক নয়। আমার মন-জুড়ে আছে কবি কালিদাসের শকুন্তলা। সে তো নিছক মানসী।

সামন্তসেন বললেন, বটে! তাহলে তুমি শকুন্তলাকেই চিন্তা করো। যেমনভাবে তুমি তাকে মনশ্চক্ষে দেখেছ।

প্রিয়গুপ্ত চোখ বুজলেন। অচিরেই শকুন্তলার চিন্তায় ডুবে গেলেন। সেই মগ্নমুহূর্তে চোখ দিয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। কোনো একসময় রাজকুমারী রাগেশ্রীও সভার এক কোণে এসে দাঁড়িয়েছেন।

যখন ঘোর ভাঙল সভাসদদের, তাঁরা অপার বিস্ময়ে দেখলেন আয়নায় প্রতিফলিত নারীর রূপটি রাগেশ্রীরই। সবচেয়ে অবাক মানলেন প্রিয়গুপ্ত। এ কী! এ কন্যা তো শকুন্তলাই। অন্তত তাঁর স্বপ্নে ধরা শকুন্তলা।

কান্নায় ভেঙে পড়লেন দার্শনিক। নিজেকে বড়ো মূখ ঠেকল। একবারও যদি এই কন্যাকে তিনি কোথাও দেখে থাকতেন তাহলে তো এই বিভ্রাট হত না। না জেনে, নিয়তির অমোঘ নিয়মে, তিনি রাজকন্যাকেই শকুন্তলা সাজিয়ে এসেছেন মনে! হে ঈশ্বর! কী বিচিত্র সৃষ্টি এই মানবমন।

দেখতে দেখতে রাজা হুকুম দিলেন প্রিয়গুপ্তের প্রাণদন্ডের। প্রিয়গুপ্ত হতভম্ব হয়ে তা শুনলেন।

পরের দিন ভোরেই প্রিয়গুপ্তকে স্নান করিয়ে আনা হয়েছে হাড়িকাঠে। জল্লাদও উপস্থিত নিকটে। পুরোহিত আহ্নিক সেরে নিচ্ছেন। সমস্ত বধ্যভূমি গিজগিজ করছে দর্শকে। রাজা আছেন, গুণিন আছেন, কে নেই!

হাড়িকাঠে মাথা রেখেছেন প্রিয়গুপ্ত। জল্লাদ আস্তিন গোটাচ্ছে। অন্য একজন হাড়িকাঠের খিলটা পরিয়ে দিচ্ছে দার্শনিকের গলায়। এমন সময় রাজকুমারী রাগেশ্রী ঢুকলেন কম্বকরাজ্যের যুবরাজের সঙ্গে। এর সঙ্গেই অবশেষে ঠিক হয়েছে রাজকন্যার বিবাহ। দ্বারী সরবে কুমারের রাজ্যের নামটা ঘোষণা করতেই স্মৃতির কোথায় একটা খোঁচা খেলেন মুমূর্ষু প্রিয়গুপ্ত। তবু চেষ্টা করে চোখ মেলে দেখলেন কুমারকে। সত্তার অন্তঃস্থল থেকে কে যেন জানিয়ে দিল যুবরাজ হলেন কালিদাস কথিত দুষ্মন্ত।

ঝিমন্ত প্রিয়গুপ্ত আচমকা সজাগ হয়ে উঠলেন! তাঁর একটু বেশি বেশি মনে পড়তে লাগল সব কিছু! কিন্তু এ সমস্ত স্মৃতি জন্মের ওপার থেকেই যেন ভেসে আসছে। এক দন্ডে দার্শনিক বছরের পর বছর ছুঁয়ে যেতে লাগলেন। প্রশ্ন জাগল ওই স্বাস্থ্যবান পুরুষটিই যদি কালিদাসের কাহিনির সেই লম্পট দুষ্মন্ত হয়, এবং ওই সুদর্শনা কন্যাই যদি শকুন্তলা হয় তবে প্রিয়গুপ্ত স্বয়ং কে?

প্রিয়গুপ্ত ক্রমশ নিজেকেও চিনে ফেলেন। মনে পড়ল কন্থ মুনির আশ্রমের পাশের একটা ব্রহ্মচর্যাশ্রম। মনে পড়ল পুণ্যদেবকে। পুণ্যদেবের মুখ প্রিয়গুপ্ত জলের প্রতিফলনে ছাড়া দেখেননি। অর্থাৎ এই পুণ্যদেব প্রিয়গুপ্ত নিজেও হতে পারেন। এই মুহূর্তে পুণ্যদেবের চোখই প্রিয়গুপ্তের চোখ। পুণ্যদেবের দৃষ্টি এবং বিচারই প্রিয়গুপ্তের দৃষ্টি এবং বিচার।

পুণ্যদেব, নামে রূপে সাধনায় বাস্তবিকই পুণ্যদেব। পাপের লেশমাত্র তাঁকে স্পর্শ করে না। পাশের আশ্রমের শাঙ্গদেব, শারদ্বত, প্রিয়ংবদা সকলেই জানে শকুন্তলার সঙ্গে পুণ্যদেবের এক অপূর্ব নিষ্পাপ প্রেমের সম্পর্ক আছে। ওরা চায়ও শকুন্তলা বয়সকালে এই সৌম্য যুবকটিকে বিবাহ করুক।

সন্ধ্যাহ্নিক শেষে পুণ্যদেব যখন আশ্রমের বেড়ার ধারটায় এসে দাঁড়ায় সে শুনতে পায় শকুন্তলার মিষ্টি গলায় বেদগান। সে দেখতে পায় গোধূলির আলোয় মুনিকন্যা কত সুন্দর। শকুন্তলাও পুণ্যদেবকে দেখে লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়। কাছে এসে বলে, ব্রহ্মচারী! ওভাবে কাউকে দেখতে নেই জান না!

পুণ্যদেব শকুন্তলার করতলের পৃষ্ঠদেশে চুমু দেয়। বলে, সামনের বছর আমি তোমার পিতৃদেবের কাছে নতজানু হয়ে বলব, মুনে! আপনার কন্যাটিকে আমায় উপহার দিন। ওই পরমাপ্রকৃতি নারীটিকে আমি কামনা করি।

লজ্জায়, আনন্দে ভরা ঢেউ শকুন্তলা বলে, বাবা তোমার কান মলে দেবে। বলবে, আরও বারো বছর ব্রহ্মচর্য পালন করো বৎস। বলেই ছুটে পালিয়ে যায় শকুন্তলা।

কিন্তু বিভ্রাট ঘটল এর মাসখানেক পরে। রাজা দুষ্মন্ত এসে নিষ্পাপ শকুন্তলার সরলতার সুযোগ নিলেন। প্রমাদ গুণল পুণ্যদেব। ভয়ে-দুঃখে-লজ্জায় আশ্রমের বেড়া ডিঙোল না মাসের পর মাস। শেষে যেদিন আশ্রমের সমস্ত কিছুকে কাঁদিয়ে গর্ভবতী শকুন্তলা বিদায় নিল, দূর থেকে গাছের পাতার আড়ালে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখল পুণ্যদেব।

পরে যখন শুনেছিল দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তখনও বুক বাড়িয়ে গিয়ে বলতে পারেনি, প্রিয়তমা তুমি আমার।

নিরীহ আস্ফালনে পুণ্যদেব মনস্থ করেছিল এক কাব্যনাটকে দুষ্মন্তের ওপর তার রাগের জের তুলবে।

সহসা হাড়িকাঠে ফাঁসবাঁধা প্রিয়গুপ্ত চিৎকার করে উঠলেন, রাজন! রাজন! একটা আর্জি আছে রাজা, একটা আর্জি আছে।

খঙ্গ তুলেছিল জল্লাদ কোপ বসাতে। রাজা হাত দেখাতে খঙ্গ নামাল। অপরজন হাড়িকাঠ থেকে মুক্ত করে আনল দার্শনিককে। রাজা জানতে চাইলেন প্রিয়গুপ্তের আর্জি।

বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে প্রিয়গুপ্ত জানালেন পুরো অভিজ্ঞানশকুন্তলম একটা ধড়িবাজের লেখা। পুণ্যদেবের সমস্ত ব্যাপারটাই সেখানে উপেক্ষিত। এক ভীতু কালিদাসের রাজভক্তিই প্রকট হয়েছে ওই মিলনান্তক নাটকে। ওটা হওয়া উচিত বিয়োগান্তক উপাখ্যান। নিষ্পাপ মাধুর্যের ওপর স্বেচ্ছাচারের দৌরাত্মই নাটকের বিষয়, যেটা শিল্পীর স্বভাবসুলভ দ্বিধার সঙ্গেই এড়িয়ে গেছেন কালিদাস।

রাজা জানতে চাইলেন বিয়োগবেদনার অমোঘ কারিগর কালিদাস কেন এ ত্রুটি করলেন? প্রিয়গুপ্ত বললেন, সম্ভবত এইজন্যই যে পুণ্যদেবের খোঁজ কেউ রাখেনি। কালিদাস হয়তো জানতেন না কখনো কোথাও পুণ্যদেব বলে কেউ ছিলেন কি না। কিংবা এক নিষ্পাপ মুনিবালকের আত্মহত্যা তিনি সমাজের সামনে তুলে ধরতে চাননি।

রাজা জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু তুমি এসমস্ত জানলে কোত্থেকে? প্রচন্ড লোভ হওয়া সত্ত্বেও আত্মসংবরণ করলেন প্রিয়গুপ্ত। বললেন, আমাকে সময় দিন রাজা। আমি অভিজ্ঞানশকুন্তলম কালিদাসের চেয়েও সুন্দর করে লিখে পড়ে শোনাব আপনাকে। এবং সে-লেখার পর কালিদাসের ওই বাতুল নাটককে মানুষ ভুলেই যাবে।

রাজা বললেন, বেশ। আমার কন্যার বিয়ে সাত মাস পর। তুমি ওই বিবাহ-বাসরে তোমার নবলিখিত অভিজ্ঞানশকুন্তলম সভাসদদের পড়ে শোনাবে। কবি কালিদাসের থেকে তা শ্রেয় হলে সেদিনই তোমার মৃত্যুদন্ড প্রত্যাহৃত হবে, এবং তোমাকে সসম্মানে সভাকবি নির্বাচন করা হবে।

প্রবল হর্ষধ্বনির মধ্যে প্রিয়গুপ্ত বাড়ি ফিরলেন। ফিরেই প্রচন্ড ঘৃণায় কালিদাসের বইগুলিকে সবচেয়ে নিকটের পুকুরে ছুড়ে ফেললেন। নিজের লেখা শকুন্তলার টীকাগুলোও চুলোয় গুঁজে দিলেন। তারপর স্নান-আহ্নিক সেরে নতুন করে কালিদাসের নাটকটাকে লিখতে বসলেন।

লিখতে লিখতেই প্রিয়গুপ্ত টের পাচ্ছিলেন তাঁর হাত দিয়ে এত সুন্দর সংস্কৃত এর আগে কখনো বার হয়নি। এমন ঘোরের মাথায় লেখা বেরুচ্ছে যে লেখক টেরই পাচ্ছেন না তিনি কী লিখছেন। সম্ভবত অনুপ্রাণিত লেখা একেই বলে। যে লেখা কালিদাসের গুষ্টির কেউ কখনো চিন্তা করেনি।

লেখার মধ্যেই কাটাকাটি যা হবার হয়ে গেল। কোনো ত্রুটি প্রিয়গুপ্ত রাখবেন না স্থির করেছেন। পঞ্চম মাসে যখন নাটক শেষ হল অশেষ কৌতূহল ও উত্তেজনা সত্ত্বেও প্রিয়গুপ্ত লেখাটা নিজেকে পড়ে শোনালেন না। অধীর আগ্রহে বসে রইলেন রাজকন্যার বিয়ের দিনটির জন্য। মনে মনে বুঝতে পারছিলেন এ সংস্কৃত সাহিত্যের মুকুটমণি হয়ে থাকবে। একটু-আধটু করুণাও হল বেচারি কালিদাসের জন্য।

মেদিনীরাজ্যের সমস্ত সম্রান্ত শিক্ষিত পুরুষ-নারী জমায়েত হয়েছেন সভাকক্ষে। রাজার পাশেই রাজকন্যা দীর্ঘ ঘোমটা টেনে বসে। পাশে ককরাজ্যের যুবরাজ। তার মুখে হাসি। সভার প্রত্যেকটি মানুষ প্রফুল্ল বোধ করছেন। রাজা ডাক দিলেন, দার্শনিক। তারপরেই ভুল সংশোধন করে বললেন, কবি! এবার তোমার কাব্যনাট্য পড়ে শোনাও।

এই ক্ষণটির জন্যই কত আকাঙ্ক্ষায় দিন কাটিয়েছেন প্রিয়গুপ্ত! সভার প্রত্যেককে নমস্কার জানিয়ে পাঠ শুরু করলেন। বস্তুত এরকম পরিবেশে যা সবারই হয়ে থাকে প্রিয়গুপ্তেরও তাই হল। এমন অনুরাগ দিয়ে পড়তে লাগলেন প্রিয়গুপ্ত যে, নিজে কিছুই কানে শুনতে পেলেন না। কিংবা বলা চলে কানে শুনলেও মনে ছাপ বসল না। সভার সদস্যেরা কিন্তু একমনে সেই মন্ত্রোচ্চারণের মতন নাটকপাঠে ডুবে রইলেন।

যখন পাঠ শেষ হল, প্রিয়গুপ্ত তখনও এক আচ্ছন্নতায় মগ্ন। ঘোর ভাঙল রাজার চিৎকারে। পামর! ধূর্ত বেয়াদব! চালাকি পেয়েছে আমার সঙ্গে? ভেবেছ আমরা কেউ শকুন্তলা পড়িনি? তোমার রচনা বর্ণে বর্ণে, ছত্রে ছত্রে বিন্দুতে বিন্দুতে কালিদাসের শকুন্তলা। তাই বলি এত ভালো সংস্কৃত এই হতভাগা শিখল কবে। আর কোথায় তোমার পুণ্যদেব? তাঁর কথা তো নাটকের এক জায়গাতেও বিবৃত করোনি। কোথায় গেল তোমার সে আস্ফালন? আসলে তুমি সমস্তটাই স্বৰ্গত অমর কবির লেখা থেকে টুকেছ। তোমার মৃত্যু আজই। হ্যাঁ, বিবাহবাসরের আগেই তোমার অপসারণ আমরা চাই।

প্রিয়গুপ্তের কাছে সমস্ত ব্যাপারটাই খুব গোলমেলে ঠেকছিল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। তিনি একটু জল চাইলেন। জল খেয়ে তাকালেন গুণিনের দিকে। গুণিন স্মিত হেসে একটা কালিদাসের শকুন্তলা দার্শনিকের হাতে তুলে দিলেন। পাতা ওলটাতেই লজ্জায় মরে গেলেন প্রিয়গুপ্ত। জিভ কাটলেন। চোখ ফেটে জল গড়াল! ভাবলেন, হে ঈশ্বর! এরকম স্মৃতি-বিভ্রম আমার ঘটল কী করে? সারাজীবন যে শকুন্তলা আমি পাঠ করে এসেছি সেই শকুন্তলাই আমি নতুন করে অজ্ঞানের মতো লিখলাম কী করে? এমনকী একটা বয়ানেরও হেরফের হল না কোথাও! ঈশ্বর, হে করুণাময় ঈশ্বর। এ কি সম্ভব? না এ স্বপ্ন? চোখ রগড়ালেন প্রিয়গুপ্ত। না সমস্তটাই তো বাস্তবের ব্যাপার। তাহলে … তাহলে … তাহলে… ওই পুণ্যদেব ওরফে প্রিয়গুপ্তই কি কালিদাস?

ফের স্মৃতির অতলে নামলেন প্রিয়গুপ্ত। না, ঠিক স্মৃতিও নয়। বলা চলে স্মৃতি-সত্তা ভবিষ্যত। আস্তে আস্তে কতকটা মানে খুঁজে পাচ্ছেন দার্শনিক। বুঝলেন শিল্পের শেষ বিচারে কোনো পুণ্যদেব ওরফে প্রিয়গুপ্ত ওরফে কালিদাসের দাম কিছু নেই। আসল দাম, তাঁরা তাঁদের নিজস্ব দুঃখকে যে শব্দের বিনিময়ে বেচলেন সেই ঝংকারে। পুণ্যদেবরা পুড়ে ভস্ম হলে কালিদাস হয়। তাঁদের ভস্ম-উপস্থিতি রচনায় থাকে না। তাঁদের ঠিকানা পন্ডিত টীকাকাররাও জানতে পারেন না।

কাজেই পুণ্যদেব আত্মহত্যা করলেন কি না, প্রিয়গুপ্ত হাড়িকাঠে মাথা গলালেন কি না, কালিদাস শেষ বয়সে স্মৃতি হারালেন কি না এ প্রশ্ন জগৎ তোলে না। জগজ্জন জানে এক অভিজ্ঞানশকুন্তলম লিখেছেন এমন এক মানুষ যিনি জীবন এবং কল্পনার দুই সমান্তরাল অগ্নিস্রোতের মধ্যে দিয়ে নিস্পৃষ্ট সীতার মতো হেঁটে-চলে বেড়ান। মৃত্যু নামে যে ক্ষয়, কিংবা জীবন নামে যে অপচয় এ দুয়েরই পরপারে তাঁরা। তাঁদের দুঃখ যত বাড়ে মানুষের কল্পনার আকাশে তত বেশি তারা ফোটে। এ মানুষগুলি তাঁদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, গোপনীয়তা নিয়ে পাতার আড়ালে দাঁড়িয়ে শকুন্তলাদের বিদায় নিতে দেখেন। সমস্ত রাগ তাঁদের পড়ে গিয়ে ওই পামর দুষ্মন্তদের ওপর। সেই রাগ থেকেই ওই পামরগুলো অমরত্ব পায় এক একটা

অভিজ্ঞানশকুন্তলমে।

সেদিনই মধ্যাহ্নে হাড়িকাঠে মাথা নোয়ালেন প্রিয়গুপ্ত দার্শনিক। শাঁখের আওয়াজ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ওঁর সুন্দর মুখটা ধুলোয় গড়িয়ে পড়ল খঙ্গের কোপে। কবি কালিদাসের অমর অভিজ্ঞানশকুন্তলমও অক্ষয় রইল।

১৯৭৪ সালের ৩রা ডিসেম্বর পর্যন্ত আর কেউ কালিদাসের থেকেও ভালো করে শকুন্তলা লিখেছেন বলে খবর পাওয়া যায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *