Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

মেজ খোকার অতিথিদের জন্যে নির্দিষ্ট ঘর। টেবিল, চেয়ার কাপড় রাখার আলমারি বইয়ের তাক। ডানলোপিলোর গদি, ফুলকাটা চাদর ও বালিশের ওয়াড়। খাটের মাথার কাছে পড়ার ল্যাম্প। ঘরে ফ্যান ও এয়ারকন্ডিশনার দুই আছে। যার যেটা সুবিধে হয়।

বাইরে ব্যালকনিতে ইজিচেয়ার। বাথরুমে যাওয়ার এবং বাথরুমের বাতাসকে মোহনীয় করার জন্যে কোন সুগন্ধি ছেটানো হয়।

বিশ্বনাথ দেখবেন বলে এ ঘরে একটি দূরদর্শন। রঙিন। না, তাঁর সুখ—স্বাচ্ছন্দ্যের কোন ব্যবস্থায় ত্রুটি নেই। রোজ তাঁর ঘরে টাটকা ফুল রাখা হয়। ফুল থাকলে নাকি মন ভালো থাকে।

সনকার ছবি দেয়ালে।

ব্যালকনিতে বসে বিশ্বনাথ ভাবছিলেন, এখানে তিনি এলেন কি করে।

সনকা চলে যাবার পর বড্ড ভেঙ্গে পড়েছিলেন। ভাবতে পারছিলেন না ওখানে একা থাকবেন কেমন করে।

মীরার মা ওঁকে খাওয়াতে পারছিল না।

—রাতদিন বাগানে বসে কাঁদলে সে মানুষ ফিরবে? খাওয়া ছেড়ে…ঘুম ছেড়ে…

তুহিন আর বিদিশাও ঘাবড়ে গিয়েছিল। ছেলেরা যখন গেল, তারাও বলেছিল, সেই ভালো, নিয়ে যান।

বিশ্বনাথ নিজেও আর সনকাহীন সনকাবাসে থাকতে চাননি। এমন সময়ে তো ছেলেদের কাছেই থাকে মানুষ।

—বাড়িটা কি করবে?

—কি আর করব, থাকবে।

—এখানে তো তুমি আর থাকছ না।

—তবু থাকুক। মাঝে মাঝে তো আসব।

—সব এইভাবে রেখে যাবে?

—দিলীপ আর মীরা থাকবে এখন।

—ওরা বিশ্বাসী তো?

—ওদের ভরসাতেই তো ছিলাম।

—শেষে গোবরডাঙ্গার বাড়ি না হয়।

—তা কেন হবে?

বাড়ি, একটা বাড়ি যে কত আপন হতে পারে, তা বিশ্বনাথ ছেলেদের বোঝাবেন কেমন করে? বাড়ির প্রতিটি গাছ সনকা আর তাঁর লাগানো। প্রতি ঘরে, বারান্দায় সনকা। এ বাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে?

—ওরা থাকলে বাড়িতে মানুষ থাকবে। ঝাঁটা পড়বে ঘরে ঘরে। বাগানটা…

—বুঝলাম। ফ্রিজ… টেলিভিশন…

—ও সব যা হয় করো।

—বাবা!

—বলো।

—কথাটা খুব খারাপ লাগবে শুনতে। মা’র কোন গয়না ছিল না?

—হাতের রুলি, যে হারটা পরে থাকত, বাঁধানো লোহা, কানে যে ফুলটা পরত…

—আর কিছু নেই?

—আর কি থাকবে বলো? বেবি, ডলির বিয়েতেই তো সব দিল। তোমাদের বউদেরও… আর কি থাকে? কোন শখও ছিল না। আমিও কিনে দিইনি।

—যাকগে যাকগে। সে সব কোথায়?

—আলমারিতে।

—ওগুলো নিয়ে যেতে হবে! ফ্রিজ, টিভি বেচে দেব…আর কি…আর কি…ও, বেবি বলেছে বাসনপত্রও বন্ধ ঘরে রাখতে।

—যা হয় করো।

—হ্যাঁ, তোমার অ্যাকাউন্ট!

—ব্যাঙ্কে?

—হ্যাঁ। ওটা আমার সঙ্গে জয়েন্ট করে নাও। না না… তোমার ওই সামান্য টাকায় আমার কোন লোভ নেই! তবে জীবনমৃত্যু …দেখলেই তো…

—ছোট খোকা কিছু বলবে না?

—ছোট খোকা? ওর শ্বশুর ওই বাড়ির প্রোমোটার। আসলে ওঁরই বাড়ি। দুটি তো মেয়ে। দু’জনে দুটো করে ফ্ল্যাট পেয়েছে। ওঁদেরও দুটো। মানেটা বুঝলে?

—কি!

—সব দুই মেয়ে পাবে। ছোট খোকাও বলেছে, তুমি যাচছ, তুমিই জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করে নাও। যাতে বাড়ি ভাড়ার টাকা, পেনশনের টাকা, সব ওখানে জমা পড়ে। যাতে পরে কোন অসুবিধে না হয়।

মেজ খোকার কথাবার্তা খুবই বাস্তবসম্মত। সে সময় বিশ্বনাথ অত্যন্ত কাতর, অত্যন্ত বিপন্ন! কারো ওপর নির্ভর করতে চাইছেন।

—বেশ তো। তাই হোক।

—উইল করেছ?

—সবই তোমাদের। তবে তোমার মা বলতেন…

—কি?

—মীরাদের কিছু দিতে।

—কেন?

—”কেন” মানে! উনি বলতেন, সেটাই যথেষ্ট। তাছাড়া ওরাই তো সব করছে এতকাল।

—করেছে! পেয়েছেও তেমনি।

—ও ভাবে বোল না মেজ খোকা।

—দেয়া যাবে…দেয়া যাবে।

—এ বাড়িতেই তোমার মায়ের বাৎসরিক কাজও হবে। ওরা থাকবে। মানুষ না থাকলে বাড়ি পোড়ো হয়ে যায়।

—ও সব ফ্যাচাং কলকাতাতেই করা চলে। আমরা তো মনে করি, ক্রমে ক্রমে এ বাড়ি বেচে দিলেই ভালো। কে আসবে?

বিশ্বনাথ চুপ করে থাকেন।

—অবশ্য এখনো নয়।

আসার সময়ে মীরার মা, মীরা, সবাই কেঁদেছিল। মীরার ছেলে অবাক হয়ে দেখছিল সব।

তুহিন আর বিদিশা নেমে এসেছিল। বিশ্বনাথ বলেছিলেন, ছেলেদের, মেয়েদের সবার ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। কখন কোথায় থাকি তা জানাব। তোমরা তো কলকাতা যাও। মাঝে মধ্যে যেও, কেমন?

—নিশ্চয় যাব।

মীরার মা কাঁদতে কাঁদতে একটা থলি এনেছিল।

—এগুলো কী?

—বাবুর ইসবগুল, বেলচূর্ণ, তালমিছরি…

—ও! ভালো কথা। বেবি বলেছিল তুমি কখন কি খাও তা জেনে নিতে।

—সবই খাই। তাই তো, মীরার মা?

—সবই খাও, তবে ঝালমশলা নয়…আর তেতো তো বাবুর নিত্য চাই।

—ও সব তুমি মালিনীকে বলে দিও।

সনকা বাসা ছেড়ে আসতে ব্যস্ত হয়েছিলেন। আসার সময়ে কিন্তু ওঁর চোখ দিয়ে জল পড়েছিল।

মেজ খোকা ওঁর দিকে তাকায় নি। এ বাড়ির দাম কত হতে পারে। তাই ভাবছিল!

বেবির নির্দেশ খুব কড়া। কোন কারণে ওঁকে যেতে দেওয়া হবে না সোদপুরে। ওঁর কিছু হলে আবার ওই জায়গায় দৌড়নো… হোক, না হোক। বেঁচে থাকলেও তো যেতে হবে। না, আর ওরকম হতভাগা জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়। মেজ খোকা বলছিল—

—আমি কি ”না” বলেছি?

—আরেকটা কথাও ভাবতে হবে।

—কি?

—মীরার মা কেমন জাঁকিয়ে বসেছে দেখেছ?

—খুব দেখেছি।

—মা আর বাবা, চিরকাল কাজের লোকদের…

—সে দোষ মালিনীরও আছে।

—দূরত্ব রেখে চলা উচিত।

—যা বলেছ।

মেজ খোকা সে সব কথাই ভাবতে ভাবতে কলকাতা পৌঁছে গেল। তারপর বলল, পৌঁছে গেলাম।

এ বাড়িতে বিশ্বনাথ আগেও এসেছেন। এবার যেন বাড়িটাকে বড্ড বড়ো মনে হলো, বড্ড উঁচু।

বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মালিনী প্রণাম করেছিল, হাত ধরেছিল।

—তোমার কাছেই এলাম মা!

—তাই তো আসবেন।

—এই বুড়ো ছেলেটার ভার এখন…

—বাবি! দাদুকে প্রণাম করো।

ওঁর ষোল বছরের নাতি অত্যন্ত বিরস মুখে নিচু হয়ে কোনমতে পা ছোঁয়।

—থাক থাক!

—চলুন, আপনার ঘর দেখুন।

ঘর দেখে বিশ্বনাথ বলেছিলেন, তোমাদের অসুবিধে হবে না? অতিথি এলে তো এখানেই থাকেন?

মালিনী মাথা নিচু করে বলেছিল, না বাবা! ও তো এই বাড়িতেই দশতলায় একটা ছোট ফ্ল্যাট লীজ নিয়েছে। কেউ এলে সেখানেই থাকে।

—আরেকটা ফ্ল্যাট।

—এর চেয়ে ছোট। …চলুন স্নান করবেন তো?

মেজ খোকা বলেছিল, হ্যাঁ হ্যাঁ। স্নান করবেন, খাবেন, বিশ্রাম করবেন। আমিও আজ একসঙ্গেই খাব।

একসঙ্গে খেতে খেতে বিশ্বনাথের মনে হয়েছিল, এরাই তো ওর আপনজন। এদের কাছে থাকা খুব দরকার ছিল। ওখানে থাকলে…

—বিকেলে কি খান বাবা?

—চা, দুটি শুকনো মুড়ি, কখনো দুটি বিস্কুট…

—ফল খান না? ছানা?

—ফল মানে পেঁপে…কলা…না, ছানা খাই না। এ বয়সে বউমা, মেপেজুখে না চললে…

—হাঁটেন কখন?

—সকালে…বিকেলে… আমাদের মানে বুড়োদের। সেখানে আড্ডা হয়!

মেজ খোকা বলেছিল, লুঙ্গি পরেই থাকো?

—বাড়িতে।

—মালিনী! বাবার জন্যে কয়েকটা পাজামা…পাঞ্জাবী…আর কি লাগে…

—পাজামা তো পরি না।

—ঘরে লুঙ্গি পরতে পার। কিন্তু …কয়েকদিনেই বিশ্বনাথ বুঝেছিলেন, এখানে নিয়মকানুন অন্যরকম। লুঙ্গিটা অসভ্য পোশাক। ঘরে স্নান করে লুঙ্গি পরা চলে। খাবার ঘরে চলে না।

লিফটে নেমে রাস্তা পেরিয়ে সামনে পার্ক। একটি চাকর তাঁকে রাস্তা পার করে দিয়ে যায়। সে—ই সময়মতো নিয়ে আসে।

সন্ধ্যা হলেই তিনি নিজের ঘরে বন্দী। ব্যালকনিতে হাঁটো, টিভি দেখো। না, সমস্ত কলকাতা অন্ধকারে ডুবে গেলেও এ বাড়িতে নিষ্প্রদীপ হয় না।

কয়েকদিন বাদেই উনি বলেছিলেন, আমাকে আনতে যেতে হবে না।

—একা আসবেন?

—হ্যাঁ হ্যাঁ। সোদপুরে তো স্টেশন অবধি চলে যেতাম। ওঁর আবার মাঝে মাঝে মিঠে পান খেতে শখ হ’ত।

—বেশ তো আসবেন!

—রাতের খাবারটা ঘরে কেন দেয়?

মালিনী নিচু গলায় বলেছিল, রাতে তো একেকজন একেক সময়ে খায়…ও রোজ খায়ও না।

—আমি, তুমি আর বাবি তো একসঙ্গে খেতে পারি। কিংবা আমি আর বাবি…

মালিনী ওঁর দিকে দুর্বোধ্য চোখে তাকিয়েছিল। স্বচ্ছল, গৃহস্থ ঘরের মেয়ে। একটু মোটাসোটা। লম্বা চুল ছিল। মেকাপ করতে কখনো দেখেন নি।

এখন ওর চুল ছোট করে ছাঁটা, মেকাপের নিচে এক ক্লান্ত, বিভ্রান্ত মুখ। বাড়িতে হাউসকোট, বেরোলে শাড়ি। ডান হাতে একটি চুড়ি, বাঁ হাতে লোহা, অবশ্যই সোনা বাঁধানো। কানে হীরে।

মোটা মানুষ রোগা হলে যেমন দেখায়, তেমনই চেহারা। যেন কোনো অসুখ আছে।

—তুমি খুব রোগা হয়ে গেছ।

—কই, না তো?

—দেখতে পাচ্ছি।

—খুব মোটা হয়ে যাচ্ছিলাম… ও বলল, তাই… শ্যেরি লুইতে গিয়ে…

—রোগা হয়ে এলে?

—হ্যাঁ বাবা।

—এত কম খাও কেন?

— খেতে পারি না আর।

—কি আশ্চর্য! কেউ মোটার ধাত, কেউ রোগার…

ওর কাছে কতরকম বন্ধু…কাজের লোকজন আসে…

—তা আমাদের একসঙ্গে খাওয়ার কি হ’ল?

—বাবিও তো, যখন ওর সময় হয়…

—রাতে?

—মানে…পরীক্ষা তো হয়ে গেছে…

—কি করে?

—বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও দেখে।

—সে তো বাড়িতেও আছে।

—বাবা! আপনার খাবারটা আমিই নিয়ে আসব। খাবার সময়ে কাছে বসব, কেমন?

—বেশ। তোমার যা সুবিধে!

মালিনীর নয়, মালিনীর নয়, তার স্বামীর। কিন্তু সে কথা মালিনী বলতে পারবে না।

সেদিন পার্কে অনেকক্ষণ হেঁটেছিলেন বিশ্বনাথ। পার্কটি ছোট। বৃদ্ধেরা আলোর নিচে বেঞ্চে বসে থাকেন। সকলেই কাছাকাছি বাড়িতে থাকেন।

যেচে আলাপ করেছিলেন একজন।

—আমার নাম সুপ্রভাত দত্ত।

—নমস্কার। বিশ্বনাথ চৌধুরী।

—কোন বাড়িতে থাকেন?

—সৈকত।

—আরে আমিও তো ওখানেই।

—কত তলায়?

—পাঁচতলা। আপনি?

—চোদ্দতলা। আমার ছেলে নন্দন…

—বুঝেছি। ব্যবসা করেন।

—হ্যাঁ। আপনার ছেলে?

—আমি একা মশাই।

—ও!

—আপনি নতুন এসেছেন?

—হ্যাঁ। সোদপুরে ছিলাম…স্ত্রী মারা যেতে…

—আমার চেয়ে ভাগ্যবান।

—কেন?

—আমার স্ত্রী মশাই, থেকেও নেই।

—সে কি রকম?

—ছিলাম ফরেস্ট সার্ভিসে। ছেলেরা বর্তমানে তিনজনেই বিদেশে।

—আসে না?

—আসবে কেন? বাড়ি করেছে, ও দেশে বিয়ে করেছে, আর কি আসে?

—স্ত্রী?

—আপনার ছেলের তো দুটো ফ্ল্যাট…ওপরেরটা মস্ত বড়। আমারটা ছোট। দুটো বেডরুম, দুজনে থাকব। তা কি যে গুরু জুটল মশাই। সংসারে তিনি থাকতেই পারলেন না।

হিমাচল প্রদেশে গুরুর আশ্রমেই…

—আপনার তো বড় কষ্ট।

—কিছু বলতে পারবেন না। ছেলেরাও লিখল, মা’র ইচ্ছেমতো জীবনযাপনের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে গুরুও এমন—তেমন নন। সে আশ্রমেও টাকার খেলা। তা ছেলেরা ডলার পাঠাল, মা চলে গেলেন।

—আপনার কথা ভাবলেন না?

—মশাই! রীতিমত হোমযজ্ঞ করে, নিজের শ্রাদ্ধ নিজে করে এ জীবন ও জন্মকে ত্যাগ করে তিনি এখন প্রজ্ঞা সরস্বতী। আমি কে, বলুন?

—আপনার তো বড় কষ্ট।

—না না, সময় বদলাচ্ছে, আমি যদি নতুন সময়ের নতুন নিয়ম মেনে নিতে না পারি…

—ঝি—চাকরের সংসার?

—একটি পুরাতন ভৃত্য এবং আমি।

—সময় কাটানোই তো…

—সকালে চলে যাই ন্যাশনাল লাইব্রেরী। খানিক বই পড়ি। নয়তো হর্টিকালচারে …দুপুরে ফিরি…বিকেলে হাঁটি। সন্ধ্যায়…

—টিভি দেখেন?

—না মশাই, জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বুঝলেন…শব্দ আর সহ্য করতে পারি না। আমি না দেখলে কি হবে। প্রতি ঘরে টিভি…ভিডিও…

—শব্দদূষণ যাকে বলে।

—বয়সটা বেশী হয়ে গেছে। নইলে…

—কি করতেন?

—ঝাড়গ্রাম…হাজারিবাগ…কোথাও থাকতাম এ বাড়ি বেচে দিয়ে। তিয়াত্তর বছর হ’ল…

—আমার পঁচাশি।

—বাঃ, চমৎকার রেখেছেন শরীর।

—সবই তো সে দেখত…

—কি হয়েছিল?

—করোনারি। সময়ও দিল না, কিছু করতেও পারলাম না। সে থাকলে কি আর…

—নিজে বাড়ি করেছিলেন?

—হ্যাঁ। জমিটা অনেক আগে কেনা।

—কি করতেন?

—রেলে ছিলাম।

—ওখানেই থাকতেন?

—হ্যাঁ। ছেলেরা অবশ্য কলকাতায়। এক ছেলে আবার ওয়াশিংটনে।

—হ্যাঁ। বিদেশই এখন স্বদেশ।

—আমরা দু’জনে …কখনো ছেড়ে থাকিনি…এখনও ভাবতে পারি না।

—ও বাড়ির কি করলেন?

—তেমনিই আছে।

—কে দেখছে?

—একটি পরিবার…আমরা ওদের ভরসাতেই ছিলাম…কাজ করত, বাড়ির লোক বললে হয়।

সুপ্রভাত বলেন, ছেলেরা রাখতে দেবে না। দেখবেন, বেচিয়ে ছাড়বে।

—আমি থাকতে নয়।

—বলতে পারেন না। ওই যে বৃদ্ধকে দেখছেন? উনি গুজরাটি। স্ত্রী নেই। ছেলে কলকাতাতেই। বাপকে রেখেছে এখানে নার্স, চাকর, এদের কাছে। উনি কানেও শোনেন না, চোখেও ঝাপসা দেখেন। বাপকে দিয়ে ব্যবসা বেচিয়ে নিজে এখন অন্য ব্যবসা করছে। ওই যে, যাঁকে হাত ধরে নিয়ে আসে।

—দেখেছি।

—আপনাকে যা বলব বলে ডেকে আলাপ করলাম। শুনুন, সন্ধ্যের পর পারতপক্ষে পার্কে থাকবেন না। থাকলেও এই দিকে আলোর নিচে।

—কেন বলুন তো?

—নতুন আপনি, তাই জানেন না। সন্ধ্যের পর পার্কের ওদিকটায় গেলে…

—এ এলাকাতেও সমাজবিরোধী?

সুপ্রভাতের প্রতিটি উচ্চারণে কেমন বিদ্রূপ। জীবন ওঁকে নিয়ে বিদ্রূপ করেছে উনি যেন সেটা মেনে নিতে পারেননি। কাকে বিদ্রূপ? নিজেকে?

—না না, সমাজবিরোধী বলতে পারবেন না। এখানে যারা আসে, তারা এইসব বড় বাড়িরই ছেলেমেয়ে।

—বলেন কি!

—আরও শুনুন, আসে তারাই, যাদের বাড়িতে সুবিধে হয় না। বেশির ভাগ বাড়িতেই তো বাপ বেরিয়ে যায়, মা বেরিয়ে যায়, কখন ফেরে কে জানে। সে সব বাড়িতে ছেলেমেয়েরাও…

—বাড়িতে শাসন করে না?

—কে করবে? কখন করবে?

—এইসব ছেলেমেয়ে…

—বুঝতেই তো পারছেন। আবার ড্রাগও চলে। সে সময়ে ওদিকে গেলে ছুরিও খেতে পারেন।

—ছুরি?

—তেমন ছেলেও আসে।

বিশ্বনাথ মাথা নাড়তে থাকলেন বারবার, এসব কি বলছেন সুপ্রভাত?

—চলুন যাওয়া যাক।

—খুবই চিন্তায় ফেললেন। আমারও তো একটা নাতি আছে। বছর ষোল বয়স!

—চিন্তার কথা। কিন্তু কেউ চিন্তা করে কি?

—এইসব বাড়ির ছেলেমেয়েও বললেন…

—কে ছেলে, কে মেয়ে আপনি বুঝবেন কি করে? সবাই প্যান্ট পরে এক রকম, চুল ছাঁটে এক রকম, দেখে চেনাও মুশকিল।

—খুব চিন্তার কথা।

—ওদের নিয়ে ভাববেন না। সৈকতে দশ বছর বাস করে আমার বিশ্বাস হয়েছে যে একেবারে শিশু এবং একেবারে বুড়ো, এর মাঝামাঝি যারা, তাদের জন্যে কেউ ভাবতে গেলে ওরা পছন্দ করে না।

—নাতিটার জন্যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

—কি নাম বলুন তো?

—বাবি বলে।

—বাবি, ববি, বুবি, বিবি, এখন নামে চেনা মুশকিল। দাঁড়ান, লম্বা রোগাটে, ফর্সা, তামাটে চুল? চোখ ক’টা?

—হ্যাঁ, বাপের ধাঁচ পেয়েছে।

—বুঝেছি!

—চেনেন?

—দেখেছি। বলতে পারেন দেখেও থাকি। মানে…আমি যেখানে, তার উল্টোদিকের ফ্ল্যাটেই ওদের আড্ডা আছে। খুব আসে, তাতেই দেখেছি।

—আমাদের সময়ে…

—ভাববেন না। না ভাবলে আরো পনেরো বছর বেঁচে পরের শতাব্দী দেখে যেতে পারবেন।

—আরো পনেরো বছর…

—আপনি তো সুস্থ আছেন।

—আপনিও তো…ভালই দেখা যায়।

—মাঝে মাঝে হাঁপানি। নইলে…

—একা থাকেন!

—ওই যে বললাম, পুরাতন ভৃত্য।

—ভাল খুব, তাই না?

—বাহাদুর…আমার চাকরির প্রথম জীবনে দার্জিলিং থেকে আনি। ওর ছেলেদের চাকরি করে দিয়েছি…ওর বউয়ের ক্যান্সারে চিকিৎসা করিয়েছি…ও তো বলে, যে আমাকে ফেলে যাবে না।

—যাব একদিন আপনার ওখানে।

—আসবেন। নিশ্চয় আসবেন।

এসব নানা কথায় ওঁরা বাড়ি পৌঁছে যান। সুপ্রভাত বলেন, আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ। অনেককাল পরে বাংলায় কথা শুনলাম, বললাম।

—হ্যাঁ…তা বটে…আমার সঙ্গে বাংলা বললেও, ছেলেরা বউরা, নাতি—নাতনি, মেয়ে সকলেই নিজেরা ইংরিজিটাই বলে বেশি।

লিফট ওঁদের নিয়ে উঠতে থাকে। সুপ্রভাত বেরিয়ে যান ছ’তলায়। বিশ্বনাথ অন্যমনস্কভাবে বেরোন লিফট থেকে এবং অন্যমনস্ক থাকেন বলেই লক্ষ্য করেন না কোন ফ্ল্যাটে ঢুকছেন।

পাশাপাশি নয়, মুখোমুখি ফ্ল্যাট। একটির দরজায় পিতলের তন্ত্রোক্ত কঙ্কাল কালিকার ফলক, অন্যটিতে ওড়িশার সিংহ—সিংহী।

বেল টেপেন তিনি।

দরজা খুলে দেন আঁটো গেঞ্জি ও শর্টস করা এক প্রৌঢ়া মহিলা। চুল ছাঁটা, হাতে গেলাস, ওঁর পেছনে কয়েকটি কুকুরের ঐক্যতান।

বিশ্বনাথকে দেখে উনি এবং ওঁকে দেখে বিশ্বনাথ হাঁ; মহিলা ওঁর আপাদমস্তক দেখে বলেন, বাঙালী, নন্দন চৌ? বেঙ্গলী?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—দ্যাট ওয়ান, দ্যাট ওয়ান।

নমস্কার করেন বিশ্বনাথ। লজ্জায় কান লাল হয়ে গেছে তাঁর। হ্যাঁ, ওটাই তো!

করিডর দিয়ে হেঁটে তাঁর ঘরে ঢোকেন। এ ফ্ল্যাটের গেস্টরুম থেকে বাইরে বেরোনো যায়, হল দিয়ে বেরোনো যায়, চাকরদের ঢোকা—বেরোনো রান্নাঘর থেকে।

খাটে একটু বসেন। মালিনী ঢোকে।

—বাবা, এত দেরি?

—বড় ভুল করেছি মা।

—কি করলেন?

—উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে…

—ঢুকে পড়েছিলেন?

—না, ঢুকিনি। এক মহিলা…মহিলা তো? মানে গেঞ্জি হাফপ্যান্ট পরা…

মালিনী বলেন হ্যাঁ হ্যাঁ, মিসেস দারুওয়ালা।

—খুব লজ্জা পেলাম।

—তাতে কি হয়েছে? নতুন নতুন, ভুল তো হতেই পারে। আমারও হ’ত।

—তোমাদের সে বাড়ি তো ভালই ছিল।

—বালিগঞ্জ গার্ডেনসের বাড়ি?

—হ্যাঁ হ্যাঁ। বেশ গেরস্ত পাড়া।

—ওর এ বাড়িটাই…মানে ব্যবসা করে তো…

—মেজ খোকার অনেক আয়, তাই না?

—জানি না বাবা। বিশ্বাস করুন।

—সেটা বেশ পাড়ামতো ছিল।

—আমার তো ভালই লাগত।

—এখানে পার্কে একজনের সঙ্গে আলাপ হল সুপ্রভাত দত্ত। বেশ লোক।

—কোথায় থাকেন?

—এ বাড়িতেই। ছয়তলায়।

—বুঝেঝি। ওই যে, যার স্ত্রী…

—হ্যাঁ। খুব দুঃখ হ’ল শুনে।

—গুরুর আশ্রমে গেছেন।

—তুমিও গুরুটুরু করেছ না কি?

—ও…আমিও…এ ফ্ল্যাটে অনেকেই…স্বামী বরদানন্দের ভক্ত।

—তিনি কোথাকার?

—আমেরিকায় থাকেন।

—ভক্তরা দর্শন পায় না?

মালিনী গভীর বিশ্বাসে বলে, ওঁর জীবন নিয়ে ভিডিও ফিল্ম তোলা আছে! গুরুদর্শন ও গুরুবাণী। প্রতি বছর তোলা হয়—আমরা কিনি।

—তারপর?

—ওঁর জন্মদিনে…মানে সন্ন্যাস নেবার দিনে…এ বাড়ির সবচেয়ে বড় ফ্ল্যাটটা তো ওঁর। সেখানে সবাই যাই। দেখি।

—ঘরে বসেই তো দেখতে পারো।

—না বাবা।

মালিনী ছোটছেলেকে বোঝাবার মতো সযত্নে বুঝিয়ে বলে।

—প্রতি বছর যে নতুন ছবি তোলা হ’ল, সেটা আমরা পয়লা মার্চ ওপরে প্রথম দেখব তার আগে পুজো হবে, প্রার্থনা হবে।

—মূর্তি পুজো?

—না, না। যত বড় মানুষ তত বড় ছবিকেই পুজো করব। একই সঙ্গে ভারতে কত জায়গায়, আমেরিকার কত শহরে, ইউরোপে, স—ব জায়গায় পুজো হবে। আর কি জানেন? প্রত্যেক জায়গায় ভক্তরা ওঁর উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করবে।

—কেমন করে?

—সে বোঝানো যাবে না।

—তারপর?

—তারপর ভক্তেরা ক্যাসেট কিনবে। হ্যাঁ, যে ছবি আছে তা ঘরে বসে প্রতি মাসে দেখার কথা। না দেখলে প্রায়শ্চিত্ত, পূজা করুন।

—তিনি আমেরিকায়, তোমরা এখানে…

—ওপরে হলটা বাদে বাকি সবটাতে তো আপিস চলে। গুরুবাণী বই বিক্রি হয়, ওঁর ছবি, প্রসাদী ফুল।

—আপিস চালায় কারা?

—লোক আছে। তবে আমাদের সকলকেই কিছু না কিছু কাজ করতে হয়।

—ফ্ল্যাটের সবাই যায়?

—সবাই আর যায় কোথায়? তবে মিসেস দারুওয়ালা ওঁর খুব ভক্ত।

—ওই মহিলা?

—হ্যাঁ, ভীষণ ভক্ত। আপিসের কত কাজ করেন। আমাদের সকলের চেয়ে বেশি।

—মেজ খোকা তো খুব র‍্যাডিক্যাল ছিল।

—তা এখনও আছে।

—আমি জামাকাপড় ছাড়ি…

—হ্যাঁ আমি আপনার খাবার আনি।

খেতে খেতে বিশ্বনাথ বলেন, ভালো কথা! সুপ্রভাতবাবু যা বললেন, ওই পার্কটাতে সন্ধ্যার পর নাকি… তোমার ছেলে কোথায় যায়?

মালিনীর চোখের ওপর কোনো পর্দা নেমে আসে, গোটা মানুষটার ওপরেই।

—ও বন্ধুদের কাছে যায়। পার্কে যায় না।

—খেলাধুলা করে না?

—স্কুলে করত!

—এখন করে না?

—না।

—ফুটবল নিয়ে কলকাতায় যে এত…

—ওর কোন ঝোঁক নেই।

—আমি তো ওকে দেখতেই পাই না।

—আসলে …পরীক্ষার পরে ওদের স্কুলের কয়েকটি ছেলেই ইউরোপ বেড়াতে গেল।

—ইউরোপ!

—ট্রাভেল কোম্পানির ব্যবস্থা অবশ্য। ওর বাবা যেতে টাকা দেয়নি, তাতেই খুব মনমরা হয়ে আছে।

বিশ্বনাথের বিশ্বদর্শন হচ্ছে! মানুষ খেতে পায় না। আর স্কুলের ছেলে…ইউরোপ যেতে পায়নি বলে…

মালিনী বলতে চায় না, তবু বলে ফেলে, আমিই যেতে দিইনি। সেইজন্যেই তো ছেলেরও রাগ, বাবাও বলে…

—কত টাকা?

—জানি না। পঁচিশ হাজার…পঞ্চাশ হাজার…জানি না। ওর বাপ ওকে, অবশ্য ভালোভাবে গ্র্যাজুয়েট হলে, বিদেশ তো পাঠাবেই!

—তোমরা একবার গেলে না?

—না বাবা, আমি নয়। ও তো কতবারই গেছে। বাবি যদি ব্যবসা করে, সেও যাবে।

—বিদেশই স্বদেশ!

—কিছু বললেন বাবা?

—না। কি বলব?

—আমি যাই বাবা! ও কয়েকজনকে খেতে বলেছে, সব আসবে।

—ওর ব্যবসার লোক?

—হ্যাঁ বাবা।

—এসো মা!

”মা” শুনে মালিনীর মুখ কেমন যেন হয়ে যায়। ও আস্তে বলে, ওদের রাত হবে। হৈ হল্লা হবে। আপনি যেন বেরিয়ে আসবেন না।

—না মা, আসব না।

এঁটো বাসন নিতে আসে গোপাল। গোপালই ওঁকে পার্কে পৌঁছত, আনত।

—দাদুর আর কিছু লাগবে?

—না, কি লাগবে আর।

—লাগলে বেল বাজাবেন।

—হ্যাঁ। তবে লাগবে না।

—শুয়ে পড়ুন। আজ তো আমার রাত তিনটে।

—কেন?

—এখন ডিনার হবে, কত খাওয়া, জল খাবে সবাই…

—জল?

—রঙিন জল।

—বাবু খায়?

—হ্যাঁ দাদু!

—গোপাল! বাবি কোথায় থাকে রে?

—ছ’ তলায় দাদু! মেমসাহেবকে বলবেন না কিন্তু, এই যে আমি বলে ফেলেছি… সায়েব একটা চাকরি করে দেবে এই জন্যে পড়ে আছি।

—না…বলব না…একটু গরম জল?

—ফ্ল্যাস্কে রেখেছি তো।

গোপাল চলে যায়। বিশ্বনাথ ভাবেন আর ভাবেন এবং মনে হয়, হয়তো এসে খুব ভালো করেননি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *