Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পাঠান মুলুকের বাঘ || Mayukh Chowdhury

পাঠান মুলুকের বাঘ || Mayukh Chowdhury

পাঠান মুলুকের বাঘ

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশ সরকারের অধীন। সেই সময় উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের একটি পার্বত্য অঞ্চলে একদল গোরখা সৈনিকের নেতৃত্বের ভার গ্রহণ করেছিলেন মেজর পি. এডওয়ার্ডস নামক জনৈক ইংরেজ।

সেনাদলের ছাউনি পড়েছে পেশোয়ার থেকে কয়েক মাইল দূরে একটা ছোটো শহরের কাছে। পাহাড়ের উপর অবস্থিত ওই সেনানিবাসের নীচে পার্বত্য ভূমির উপর পাঠানদের একটি গ্রাম। পাঠান মুলুকের মানুষের সঙ্গে তখনকার ইংরেজ সরকারের সম্পর্ক ছিল অহি-নকুল সম্পর্কের মতোই মধুর। অতএব স্থানীয় বাসিন্দারা যে মেজরের গোরখা বাহিনীকে দেখে বিশেষ খুশি হয়নি, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিছু দিনের মধ্যেই স্থানীয় পাঠানদের সঙ্গে গোরখাদের কয়েকটা ছোটোখাটো সংঘর্ষ হয়ে গেল। তবে ব্যাপারটা খুব বেশি গুরুতর হওয়ার আগেই উভয় পক্ষে মিটমাট হয়ে যায় এবং সৈন্যদের দিন কাটতে থাকে বেশ শান্ত ভাবেই।

মেজর একদিন মধ্যাহ্নভোজনের জন্য প্রস্তুত হয়ে টেবিলের সামনে এসে বসেছেন, হঠাৎ তার সামনে ছুটে এল তারই অধীনস্থ এক সৈনিক ধান বাহাদুর।

উত্তেজিত ধান বাহাদুরের মুখ থেকে মেজর শুনলেন নিকটবর্তী গ্রাম থেকে খান মহম্মদ নামক জনৈক পাঠান এক চিতাবাঘের চমকপ্রদ আবির্ভাবের সংবাদ বহন করে এনেছে। উক্ত খান মহম্মদ নাকি চিতাবাঘটিকে স্বচক্ষে দেখে সেনানিবাসকে খবর দিতে এসেছে।

মেজর কথাটা বিশ্বাস করলেন না। আশেপাশে বড়ো জঙ্গল নেই, দুপুরের কাঠফাটা রোদে লোকালয়ের এত কাছে চিতাবাঘের আবির্ভাব বিশ্বাসযোগ্য নয়।

বাঘ কিংবা বাঘের জাত-ভাইদের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে আমাদের মেজর সাহেবের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, জীবনে তিনি কখনো বাঘ অথবা চিতাবাঘ দেখেন নি, কিন্তু শুনেছেন, ছোটো বড়ো কোনো বাঘই প্রকাশ্য দিবালোকে লোেকালয়ের আশেপাশে পদার্পণ করে না।

মেজর সাহেব কথাটা বিশ্বাস করতে চাইছেন না দেখে ধান বাহাদুর বাইরে বেরিয়ে গেল এবং একটু পরেই খান মহম্মদকে সঙ্গে নিয়ে মেজরের সামনে উপস্থিত হল। খান মহম্মদ খুব জোরের সঙ্গে বলল যে, সে ভুল করে নি, মেজর সাহেব যদি তার সঙ্গে যেতে রাজি থাকেন তবে যেখানে সে চিতাবাঘটাকে দেখেছিল সেই জায়গাটা সে সাহেবকে দেখিয়ে দিতে পারে।

খান মহম্মদের কথা শুনে খাওয়া মাথায় উঠল মেজরের, দুপুরের খানা ফেলে খান মহম্মদের সঙ্গে অকুস্থল দর্শন করতে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে কিছু দূরে এসে খান মহম্মদ সত্যিই কয়েকটা পায়ের ছাপ দেখিয়ে দিল। ছাপগুলো দেখে সাহেব বুঝলেন, সেগুলো কোনো চতুষ্পদ পশুর থাবার।

আগেই বলেছি, জন্তু-জানোয়ারের ব্যাপারে মেজর ছিলেন একেবারেই অনভিজ্ঞ, তাই পদচিহ্নের মালিক কোন চতুস্পদ পশু, তা তিনি বুঝতে পারলেন না। কিন্তু খান মহম্মদের কছে তো তা কবুল করা যায় না। তাই তিনি অটল গাম্ভীর্যের সঙ্গে মস্তক আন্দোলন করে তাকে জন্তুটার বর্ণনা দিতে বললেন। প্রবল উৎসাহে খান মহম্মদ জন্তুটার বিশদ বর্ণনা দিল, চিতাবাঘের গায়ের উপর লম্বা লম্বা ডোরার কথাও সে উল্লেখ করতে ভুলল না। শুনে মেজরের দুই চক্ষু ছানাবড়া! অ্যাঁ! ওটা তাহলে বুটিদার চিতাবাঘ নয়, ভোরাদার বাঘ! লেপার্ড নয়, টাইগার!

যদিও পশু-জগৎ সম্বন্ধে মেজর সাহেবের ধারণা ছিল নিতান্তই সীমাবদ্ধ, তবু বাঘ সম্বন্ধে যে সব জনশ্রুতি তার কানে এসেছিল তাতে তার ধারণা হল যে, উক্ত জীবটি মোটেই সুবিধের নয়। অবশ্য চিতাবাঘের সান্নিধ্যও মানুষের পক্ষে বিশেষ আনন্দদায়ক নয়, তবে বাঘ নাকি চিতাবাঘের চাইতেও অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি ভয়ানক।

যাই হোক, এখন আর পিছিয়ে যাবার উপায় নেই। বাঘের পিছু না নিলে পাঠানরা তাঁকে কাপুরুষ ভাববে, চাই কি সামনাসামনি বিদ্রূপও করতে পারে। পাঠানদের বিদ্রুপের পাত্র হতে রাজি নন মেজর এডওয়ার্ডস। তিনি খান মহম্মদকে জানিয়ে দিলেন, বাঘটাকে তিনি মারতে চেষ্টা করবেন। খান মহম্মদ খুব খুশি, সে তৎক্ষণাৎ গ্রামবাসীদের খবর দিতে ছুটল।

মেজর কিন্তু বিশেষ উৎফুল্ল হতে পারেন নি। শিকার সম্বন্ধে তার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না, এবং তার হাতের টিপ ছিল এত খারাপ যে পরিচিত ব্রিটিশ অফিসারদের কাছে তিনি ছিলেন বিদ্রুপের পাত্র।

কিন্তু হাতের টিপ না থাকলেও মেজর সাহেবের সাহসের অভাব ছিল না, জীবন বিপন্ন করেও তিনি বাঘটাকে হত্যা করার সংকল্প করলেন।

সেনানিবাসে ফিরে এসে মেজর গোরখাদের সব কথা জানালেন এবং তাদের সাহায্য চাইলেন। প্রত্যেকেই সাগ্রহে বাঘ-শিকারে অংশগ্রহণ করতে চাইল। দলের ভিতর থেকে হাবিলদার শিশুপালকে ডেকে সাহেব বললেন, সে যেন তার পছন্দমতো দুজন সৈন্যকে নিয়ে তার সঙ্গে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশুপাল হাবিলদারের সঙ্গে দুজন গোরখা সৈনিক মেজরকে বাঘ শিকারে সাহায্য করতে এগিয়ে এল।

অতঃপর যেখানে পায়ের ছাপগুলো দেখা গিয়েছিল, সেইখানে এসে উপস্থিত হলেন মেজর এবং তাঁর সহকারী তিন সৈনিক। শিকারের ব্যাপারে সকলেই আনাড়ি, কাজেই শক্ত মাটির উপর বাঘের পায়ের ছাপ অনুসরণ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হল না।

অগত্যা মেজর সাহেব আবার খান মহম্মদের কাছে ফিরে গিয়ে তাদের সমস্যার কথা জানাতে বাধ্য হলেন। খান মুহম্মদ পাকা লোক, শক্ত পাথুরে মাটির উপরেও সে কি করে বাঘের যাতায়াতের চিহ্ন আবিষ্কার করল সে-ই জানে, কিছুক্ষণের মধ্যে একটা সঙ্কীর্ণ নালার কাছে এসে সে মেজরকে জানিয়ে দিল– ওই নালাটার ভিতরই বাঘ আশ্রয় নিয়েছে।

খান মহম্মদ এবার একা আসে নি, তার সঙ্গে এসেছিল বহু সংখ্যক গ্রামবাসী। এতগুলো নিরস্ত্র মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি হলেন না মেজর, তার অনুরোধে পাঠানরা উঁচু জমির উপর দাঁড়িয়ে চারদিকে নজর রাখতে লাগল এবং মেজর তার সঙ্গীদের নিয়ে নেমে গেলেন নালাটার ভিতরে।

মেজরের সঙ্গীরা সকলেই সশস্ত্র নয়। মেজর ও হাবিলদার শিশুপাল রাইফেল হাতে এগিয়ে গেলেন। তাদের পিছনে আসতে লাগল দুজন নিরস্ত্র সৈনিক।

খানিকটা নামতে না নামতেই উপর থেকে ভেসে এল পাঠানদের উচ্চ কণ্ঠস্বর। খান মহম্মদ ও তার সঙ্গীরা চিৎকার করে জানিয়ে দিচ্ছে বাঘ পাহাড়ের অন্য দিক দিয়ে সরে পড়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে মেজর তার সঙ্গীদের নিয়ে নালার ভিতর থেকে উপরে উঠে এলেন, তার পর খান মহম্মদের নির্দেশ অনুসারে বাঘের সন্ধানে যাত্রা করলেন। খান মহম্মদ সাহেবকে জানাল, কাছেই কয়েকটা পরিত্যক্ত কুটির ও একটি গোয়ালঘর আছে, বাঘ সেইদিকেই গেছে।

ভালো কথা, মেজর বললেন, তুমি পথ দেখাও।

খান মহম্মদ মহা উৎসাহে শিকারিদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। তার সঙ্গীরা অবশ্য এল না, কারণ মেজর তাদের ঘরে ফিরে যেতে বলে দিয়েছেন।

পথ-প্রদর্শক খান মহম্মদ যেখানে এসে থামল, সেখানে ঢালু জমির উপর একটা গভীর খাদের পাশে রয়েছে কয়েকটি পরিত্যক্ত কুটির ও একটি গোয়ালঘর। ওই কুঁড়ে ঘর ও গোয়ালের নীচে ঢালু পাহাড়ের গায়ে প্রায় বিশ গজ ফাঁকা জায়গার মধ্যে কোনো ঝোঁপঝাড় নেই, কিন্তু তারপরই শুরু হয়েছে ঘন ঝোঁপ-জঙ্গল আর সেই ঝোপের ভিতর থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো শুকনো গাছের সারি।

জানোয়ার ওইখানেই আছে।- ঝোপগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল খান মহম্মদ।

মেজর শুধু ওইটুকুই জানতে চেয়েছিলেন। খান মহম্মদকে স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে মেজর এইবার বাঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করার উদ্যোগ করলেন। তার পরিকল্পনা : দুজন নিরস্ত্র সৈনিক গোয়ালঘর ও কুটিরগুলোর বাঁ দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে ঝোপের উপর পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে চিৎকার করবে এবং পূর্বোক্ত স্থানের ডান দিক দিয়ে ঘুরে এসে হাবিলদার ও স্বয়ং মেজর রাইফেল হাতে অপেক্ষা করবেন বাঘের জন্য। নরকণ্ঠের চিৎকার ও প্রস্তর বৃষ্টিতে বিব্রত হয়ে বাঘ নিশ্চয়ই ঝোপের আশ্রয় ছেড়ে শিকারিদের সামনে আত্মপ্রকাশ করতে বাধ্য হবে আর তৎক্ষণাৎ তাকে সগর্জনে অভ্যর্থনা জানাবে দুদুটো মিলিটারি রাইফেল।

মেজরের আদেশ অনুসারে গোয়ালঘর ও পরিত্যক্ত কুটিরগুলোর বাঁ দিক দিয়ে ঘুরে গেল দুজন নিরস্ত্র সৈনিক এবং ডান দিক দিয়ে ঘুরে এসে রাইফেল হাতে সাগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন মেজর ও হাবিলদার।

আচম্বিতে নির্জন পাহাড়ের নীরবতা ভঙ্গ করে জেগে উঠল শ্বাপদ কণ্ঠের বজ্রনাদ আর তার পরক্ষণেই নর কণ্ঠের আর্ত-চিৎকার!

মেজর বুঝলেন, আক্রান্ত হওয়ার আগেই পাঠান মুলুকের বাঘ শত্রুকে আক্রমণ করেছে। ইঙ্গিতে হাবিলদারকে অনুসরণ করতে বলে শব্দ লক্ষ্য করে ছুটলেন তিনি। অকুস্থলে পৌঁছে এক জন সৈনিককে তাঁরা দেখতে পেলেন মারাত্মক অবস্থায়। লোকটির মাথার পিছন দিক থেকে মাংসের খণ্ড ছিঁড়ে ঝুলছে এক ফালি ছেঁড়া কাপড়ের মতো এবং ক্ষতস্থান থেকে তপ্ত রক্তের ধারা গড়িয়ে নামছে তার সর্বাঙ্গ প্লাবিত করে!

ওই অবস্থাতেও টলতে টলতে সৈন্যটি এগিয়ে এল সাহেবের দিকে, একবার অস্পষ্ট স্বরে শুধু বলল, আমি আহত, জন্তুটা আমাকে মেরেছে!

তার পরই অজ্ঞান হয়ে সে পড়ে গেল মাটিতে।

মেজর ও হাবিলদার ধরাধরি করে আহত সেনাটিকে একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এলেন সেনাটির নাম প্রেম সিং এবং তার নিখোঁজ সঙ্গীর নাম শামশের বাহাদুর। মেজর চিৎকার করে শমশেরের নাম ধরে ডাকলেন, কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

ইতিমধ্যে হাবিলদার আহত সৈনিকটির মাথায় সুন্দরভাবে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে ফেলেছে। প্রেম সিংয়ের চেতনা ফিরে এল একটু পরেই। মেজরের আদেশে আহত প্রেম সিংকে নিয়ে হাবিলদার সেনানিবাসের দিকে রওনা হল সুতরাং নিঃসঙ্গ মেজরের ঘাড়ে পড়ল গুরুদায়িত্বের ভার।

বাঘের সঙ্গে নিরুদ্দিষ্ট শামশেরকেও এখন খুঁজে বার করতে হবে। মেজরের আশঙ্কা, শামশেরও হয়তো বাঘের কবলে পড়েছে।

মেজর এডওয়ার্ডস পলাতক ব্যাঘ্রের সন্ধান কতক্ষণে পেতেন অথবা আদৌ পেতেন কিনা বলা মুশকিল, কিন্তু এইবার বাঘেরই বুঝি ধৈর্যচ্যুতি হল- সে নিজেই এগিয়ে এল মেজরের সঙ্গে দেখা করতে!

ঝোপের ভিতর থেকে হঠাৎ ফাঁকা জায়গার উপর আত্মপ্রকাশ করল বাঘ!

মেজর গুলি চালানোর সময় পেলেন না, ভীষণ গর্জন করে বাঘ তার দিকে তেড়ে এল।

একটা মস্ত পাথরের পাশে সরে গেলেন মেজর। বাঘ তাকে লক্ষ্য করে মারল লাফ।

বাঘ খুব তাড়াতাড়ি লাফ মেরেছে বটে, কিন্তু মেজর সাহেব তার চেয়েও তাড়াতাড়ি সরে গেছেন। নখরে সজ্জিত একটা থাবা বোঁ করে মেজরের মুখের পাশ দিয়ে শুন্যে ছোবল মারল, পরক্ষণেই লক্ষ্যভ্রষ্ট শ্বাপদ মেজরের থেকে কয়েক হাত দূরে মাটির উপর এসে পড়ল।

বাঘ কিন্তু এবার শত্রুর দিকে ঘুরে দাঁড়াল না, সোজা ছুটল সামনের দিকে। মেজর বাঘকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন এবং তার স্বভাবসিদ্ধ নিশানায় বাঘের বদলে একটা পাথরকে ঘায়েল করল। রাইফেলের গুলি বাঘকে বিদ্ধ করতে না পারলেও রাইফেলের গর্জন বাঘের গতিবেগ বৃদ্ধি করতে বিলক্ষণ সহায়তা করল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই জন্তুটা একটা ঝোপের ভিতর ঢুকে লুকিয়ে পড়ল।

এতক্ষণ পর্যন্ত মেজরের মনে অস্বস্তি ও আতঙ্কের আভাস ছিল, এইবার তিনি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন। যদিও কোনো পক্ষেরই রক্তপাত হয়নি এবং যদিও বাঘের থাবার মতো মেজরের রাইফেলও অবস্থানকেই বিদ্ধ করেছে, তবু নিজেকে বিজয়ী মনে করে মেজর উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। আক্রমণকারী বাঘ রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করেছে, কিন্তু মেজর এখনও রণস্থলে উপস্থিত; অতএব পলাতক শত্রুকে পরাজিত মনে করে মেজর যদি উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, তবে তাকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না।

মেজর এডওয়ার্ডস নতুন উদ্যমে পলাতক ব্যাকে অনুসরণ করার উপক্রম করছেন, এমন সময় তার সামনে আবির্ভূত হল নিরুদ্দিষ্ট সৈনিক শামশের বাহাদুর!

মেজর দেখলেন, সামশের সম্পূর্ণ অক্ষত, তার দেহে কোথাও আঁচড় কামড়ের দাগ নেই। তিনি খুবই খুশি হলেন। শামশের তাকে যে ঘটনার বিবরণী দিল, তা হচ্ছে এই :

মেজরের নির্দেশ অনুসারে সে এবং প্রেম সিং ঝোপের ভিতর পাথর ছুঁড়তে উদ্যত হয়। হঠাৎ প্রেম সিং বলে, বাইরে থেকে পাথর না ছুঁড়ে ঝোপের ভিতর প্রবেশ করে পাথর ছুড়লে বাঘকে তাড়াতাড়ি তাড়িয়ে আনা যায়। শামশের সঙ্গীর প্রস্তাবে সম্মত হয়নি, সে তাকে নিষেধ করে। শামশেরের নিষেধে কর্ণপাত না করে প্রেম সিং ঝোপের ভিতর প্রবেশ করে এবং একটু পরেই শামশের শুনতে পায় বাঘের গর্জন ও সঙ্গীর আর্তনাদ। ঝোপের কিনারায় এসে শামশের তখন বাঘকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়তে থাকে। ক্রমাগত প্রস্তর বৃষ্টির ফলে বাঘ বিব্রত হয়ে পড়ে, তাই প্রেম সিংকে জখম করলেও জন্তুটা হত্যা করতে পারেনি, মেজর সাহেব ও হাবিলদার যখন অকুস্থলে উপস্থিত হয়েছেন, বাঘ তখন প্রেম সিংকে ছেড়ে দিয়ে আহত শিকারের একটু দূরেই বসে আছে। মেজর যখন শামশেরকে উদ্দেশ করে চিৎকার করছেন, তখন শামশের তার ডাক শুনেও সাড়া দিতে সাহস পায় নি, কারণ তার কণ্ঠস্বরে আকৃষ্ট হয়ে বাঘ হয়তো তাকেই আক্রমণ করত।

মেজর বুঝলেন, শামশের বুদ্ধিমানের মতোই কাজ করেছে। তিনি তাকে সেনানিবাসে ফিরে যেতে বললেন এবং আহত প্রেম সিং-এর পরিচর্যায় নিযুক্ত হাবিলদারকে সাহায্য করতে অনুরোধ করলেন।

সানন্দে মেজরের আদেশ পালন করতে চলে গেলে শামশের। মেজর সম্পূর্ণ একক ভাবেই। বাঘের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হলেন। এবং তার পরেই যা করলেন, তা মুখ ও আনাড়ি ছাড়া কেউ করে না।

ঢালু জমি বেয়ে তিনি নীচের দিকে নেমে গেলেন সেই ঝোঁপটার দিকে, যেখানে একটু আগেই বাঘ গা-ঢাকা দিয়েছে। মেজর ঝোঁপটার কাছে আসতে-না-আসতেই বাঘ ঝোপের বাইরে এসে পূর্বোক্ত গোয়ালঘর লক্ষ্য করে দৌড় দিল। মেজর দুবার গুলি ছুড়লেন। ভাগ্যক্রমে একটা গুলি বোধহয় বাঘের গায়ে লেগে থাকবে। কারণ হঠাৎ ঘরে দাঁড়িয়ে বাঘ মেজরের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠল। মেজর ভাবলেন, বাঘ এইবার তার দিকে তেড়ে আসবে, কিন্তু জন্তুটা দাঁত খিঁচিয়ে মেজরকে এক ধমক দিয়েই গোয়ালঘরের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল। তাকে অনুসরণ করে মেজর গোয়ালঘরের পিছনে এসে দেখেন, বাঘ অদৃশ্য!

মেজর ভাবতে লাগলেন, এখন কি করা যায়। বাঘ কোথায় আছে কে জানে! সে গোয়ালঘরের অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে, অথবা পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরগুলোর যে কোনো একটির মধ্যেই গা-ঢাকা দিলেই বা তাকে খুঁজে বার করছে কে? অন্ধকার গোয়ালঘরের ভিতর অনুসন্ধানেরও কোনো উপায় নেই। প্রত্যেকটি কুটিরের ভিতর ঘুরে ঘুরে বাঘের সন্ধান চালানোর অর্থ আত্মহত্যারই নামান্তর।

তবে? এখন কি করা যায়?…

শিকারি হিসাবে আনাড়ি হলেও এডওয়ার্ডস হচ্ছেন একজন সৈনিক পুরুষ। সাধারণ সৈনিক তিনি নন, দস্তুর মতো একজন মেজর এবং ব্রিটিশ মেজর! অতএব আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণের কায়দাকানুন তিনি ভালোই বোঝেন। মাটি থেকে পাথর কুড়িয়ে তিনি পরিত্যক্ত কুঁড়ে ঘরগুলির উপর প্রস্তরবৃষ্টি শুরু করলেন। আগেই তিনি দেখে নিয়েছেন, পরিত্যক্ত কুটিরগুলোর মধ্যে কোনোটারই দরজার বালাই নেই। দরজার পরিবর্তে যে ফাঁকগুলো হাঁ করে আছে, তারই ভিতর দিয়ে দমাদ্দম শব্দে মেজরের নিক্ষিপ্ত পাথরগুলো ভিতরে গিয়ে পড়তে লাগল।

কিন্তু বাঘের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

একে একে সব কুটিরগুলোর মধ্যেই পাথর বৃষ্টি করে যখন বাঘের সাড়া পাওয়া গেল না, তখন মেজর সাহেব গোয়ালঘর আক্রমণ করলেন। এইবার ফল হল অন্ধকার গোয়ালঘরের ভিতর থেকে ভীষণ গর্জন করে বাঘ জানিয়ে দিল, এই সব পাথর ছোঁড়াছুড়ির ব্যাপারটা সে মোটেই পছন্দ করছে না!

বাঘের সাবধানবাণীতে মেজর কিন্তু কর্ণপাত করলেন না। দ্বিগুণ উৎসাহে তিনি পাথর ছুঁড়তে লাগলেন। গোয়ালঘরের অন্ধকার গর্ভ থেকে ভেসে আসা গর্জন ধ্বনি ক্রমশ হয়ে উঠল আরও ভয়ঙ্কর, আরও তীব্র, আরও হিংস্র!

অবশেষে সম্মুখযুদ্ধে আত্মপ্রকাশ করল বাঘ। এত দ্রুতবেগে সে গোয়ালঘরের ভিতর থেকে বাইরে এল, এমন অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সে মেজরকে লক্ষ্য করে লাফ দিল যে, সমস্ত ব্যাপারটা তিনি ভালো করে বুঝতেই পারলেন না। তিনি শুধু দেখলেন, কালো-হলুদ ডোরাকাটা এক জীবন্ত বিদ্যুৎ শূন্যকে বিদীর্ণ করে উড়ে আসছে তারই দিকে!

নিশানা স্থির করার সময় নেই তখন, রাইফেল তুলে ট্রিগার টিপে দিলেন মেজর। রাইফেল গর্জে উঠল। পরক্ষণে এক প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে মেজর সাহেব ঠিকরে পড়ে গেলেন মাটির উপর। ভাগ্যক্রমে রাইফেলটা তার হস্তচ্যুত হয়নি, তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন, মাত্র কয়েক হাত দূরে তিনি ছিটকে পড়েছেন।

মেজর তখন এত উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন যে, বাঘের ধারালো নখের আঘাতে তার জামাটা যে ছিঁড়ে গেছে, সেটা খেয়ালই করেননি। পরে অবশ্য তিনি বুঝেছিলেন, একটুর জন্য তার জীবন বেঁচে গেছে- বাঘের লাফ ফসকে গেছে, দ্বিতীয় বারও সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।

মেজরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে বাঘ ছিটকে পড়েছিল। সে এই বার মেজরের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চাইল, তার সর্বাঙ্গের পেশিতে জাগল মৃদু কম্পন আক্রমণের পূর্বাভাস!

মেজর এডওয়ার্ডস বাঘের মস্তক লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রকাণ্ড মাথাটা প্রসারিত দুই থাবার উপর নেমে এসে স্থির হয়ে গেল।

সব শেষ!

আনাড়ি মেজরের গুলি এইবার লক্ষ্যভেদ করেছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *