নোবেল পুরস্কার ও ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্য
নোবেল পুরস্কারকে ধরা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সম্মাননা হিসেবে। কিন্তু ১৯০১ সাল থেকে প্রচলিত এই পুরস্কার নিয়ে আজ অবধি অনেক বিতর্কও চলে আসছে নানা কারণে, এই যেমন সাহিত্যে নোবেল প্রথমবার সবাই ধরে নিয়েছিল নির্দ্বিধায় পাবে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যিক রাশিয়ার লিও টলস্টয়। কারণ সেই সময় লিও টলস্টয় ছাড়া আর কাউকে সাহিত্যে নোবেলের দাবীদার ভাবাটা কষ্টকর ছিল। কিন্তু সুইডিস একাডেমি সবার আকাঙ্খাকে পাশ কাটিয়ে নোবেল দিল ফ্রান্সের সুলি প্রুধম বা রেনে ফ্রানকোকে। আমরা জানি সুইডেন ও রাশিয়ার পুরনো দ্বন্দ্বের কারণে রাশিয়ানরা সবসময় নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, আর সেই কারণে হেনরিক ইবসেন, টলস্টয়, আন্তন চেখব,
ছাড়া – ভার্জিনিয়া উলফ, জেমস জয়েস ও রবার্ট ফ্রস্টের মতো পৃথিবী শ্রেষ্ঠ লেখকদের নোবেল না দেয়া কোন অংশেই তাদের লেখনিকে খাটো করেনি বরং নোবেল কমিটিই এতে তাদের দীনতা প্রকাশ করেছে। একটা বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এ পর্যন্ত যত নোবেল দেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগই গেছে ইউরোপীয়ানদের হাতে। এ’ক্ষেত্রে, এশিয়া বা লাতিন আমেরিকানরা ছিলেন অনেক উপেক্ষিত। এটার পিছনে অর্থনৈতিক প্রভাব ও রাজনৈতিক শক্তিকে কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
তবে এশিয়ার প্রথম নোবেল একজন বাঙালী আর বাংলা ভাষীর কাছে আসাটা নিঃসন্দেহে একটা অসামান্য কৃতিত্ব। রবীন্দ্রনাথের প্রথম এশিয়ান হিসেবে নোবেল লাভ যেমন এশিয়াকে গৌরবান্বিত করেছে তেমনি বাংলা ভাষাকে এটি সুউচ্চ স্তরে নিয়ে গেছে। তবে অনেক নিন্দুক রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাবার পিছনে অনেক ধরণের তীর্যক মন্তব্য করেন। তবে রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যের কাজ দিয়ে একটা ভাষাকে যে স্তরে নিয়ে গেছেন, তার ছোট গল্প, নাটক, কাব্য, উপন্যাস, গান, সুর, গীতনাট্য ও দার্শনিকতা সেই সঙ্গে অসামান্য সাহিত্য প্রতিভা নোবেল কমিটিকে বাধ্য করেছিল রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যে নোবেল দিতে। তার গীতাঞ্জলি যার জন্য তিনি নোবেল পান তার ভূমিকাতে ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা কবি ডাবলিউ. বি. ইয়েটস লিখেছিলেন ‘আজ থেকে শত বছর পরেও গীতাঞ্জলির গানগুলো (এটি কবিতা ও গানের সমন্বয়) হাটে, মাঠে, নদীর ঘাটে গাওয়া হবে’ – যা মিথ্যে হয়নি। দিনে দিনে রবীন্দ্র সাহিত্য আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ও যুগোপযোগী হয়ে উঠছে। তবে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিটা উপভোগ করেছিলেন? তা একটি গানে উনি প্রকাশ করেছেন, –
‘এই মণিহার আমার নাহি সাজে/
এরে পরতে গেলে লাগে,
এরে ছিড়তে গেলে বাজে’
শুনলেই বোঝা যাবে। কবির আকুতি ছিল-
‘ফুলমালার ডোরে/ বরিয়া লও মোরে’।
ইউরোপ ছাড়া এশিয়া ও লাতিন আমেরিকানদের নোবেল পাওয়াটা একটা বিশেষ কৃতিত্বের কারণ তা তারা অর্জন করেছেন তাদের অসামান্য সৃষ্টিশীল প্রতিভার জন্যে, সাহিত্য জগতে নতুন নতুন অধ্যায় সৃষ্টির জন্যে, আমরা এখানে এমনি কয়েকজন লাতিন আমেরিকান নোবেল বিজয়ীকে নিয়ে আলোচনা করব যাদের জন্যে বিশ্ব সাহিত্য আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে এবং পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। এদের মধ্যে যারা নোবেল পেয়ে নোবেলকে আরও ঔজ্জ্বল্য দান করেছেন তারা হলেন- চিলির গ্যাব্রিয়াল মিস্ত্রাল (১৯৪৫), গুয়াতেমালার, মিগুয়েল এনজেল অস্ত্রিয়াস (১৯৬৭), চিলির পাবলো নেরুদা (১৯৭১), কলাম্বিয়ার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (১৯৮২), ম্যাক্সিকোর অক্টাভিও পাজ (১৯৯০) ও পেরুর মারিও বার্গাস ইয়োসা।
গ্যাব্রিয়াল মিস্ত্রাল মূলত প্রথম স্পানিস আমেরিকান কবি যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তার আসল নাম ‘লুসিয়া গথোয় এলাকায়গা’ কিন্তু হিস্পানিক বিশ্বে সবাই আদর করে তাকে গ্যাব্রিয়াল বলে ডাকে। চিলির এই নারী কবিকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করতে গিয়ে নোবেল কমিটি বলেন, তার নামটিই সমগ্র লাতিন আমেরিকার আদর্শগত প্রতীক হয়ে উঠেছে।’ তিনি লাতিন আমেরিকার প্রথম নোবেল বিজয়ী কবি। তাই তিনি এই মহাদেশের সাহিত্য অঙ্গনের প্রধান প্রতিনিধি হয়ে থাকবেন চিরকাল। তিনি এই অঞ্চলের সাহিত্যিক মূল্যবোধ, চিন্তাধারা, ঐতিহ্যকে সারা পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করেন। শুধু কবি হিসেবেই নয় চিলির ইতিহাসে তিনি একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কূটনৈতিক, নীতি নির্ধারক, নারী ও শিশু অধিকার রক্ষায় একাগ্র কর্মী হিসেবে অমর হয়ে আছেন। তাছাড়াও এই বিশিষ্ট কবি তার রচনায়, প্রবন্ধে, বক্তৃতায়, পত্রিকা লেখনীতে শিশু, অসহায় নারী, যুদ্ধাহত, শ্রমিক, গরিবদের রক্ষার জন্য তার সহমর্মিতা দেখান। শুধু তাই নয় তাদের জন্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেন। তিনি চিলির এক দরিদ্র পরিবারে ১৮৮৯ সালের ৭ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তার সাফল্যের পিছনে বাধা বিপত্তি ছিল নিত্য সঙ্গী। গ্রামের একটি স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে তার শুরু, পিতৃহীন দরিদ্র পরিবারকে রক্ষার তাগিদ নিয়ে। আর এই শিক্ষকতাই তার সাহিত্য চর্চার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। বাবাকে ছোট বেলায় হারানো, বিকলাঙ্গ মা আর সতেরো বছর বয়সে প্রেমিক পুরুষের আত্মহত্যা তাকে বিমর্ষ করে দেয়। তিনি এই বেদনা ভুলতে আরও বেশি কবিতার জগতে ডুব দেন। তার কবিতার মূল উপজিব্য মৃত্যু ভাবনা, ভালবাসা, মায়া ও লাতিন আমেরিকান জীবন। যেহেতু দারিদ্র্যের মাঝেই তার ছিল বসবাস ও চিলির দরিদ্র মানুষজনদের কাছ থেকে দেখেছেন তার কবিতায় এর ছাপ পড়ে আর ধীরে ধীরে তার কবিতা দেশের গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে বিদেশে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে, ‘মৃত্যুর জন্য সনেট’ (১৯১৪)- এর জন্য তিনি চিলির জাতীয় পুরস্কার হোর্হেস ফ্লোরালেস এ ভূষিত হন। ১৯২২ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত তার ডেজোলেশান একটি সাহিত্যিক মাইলফলক, এটিই তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দেয় এটি কবিতা ও প্রবন্ধের সংকলন ছিল। তার গীতি কবিতার ধারা পরবর্তীতে সমগ্র লাতিন আমেরিকার আদর্শগত ধারা হয়ে ওঠে। তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কর্মগুলো হলো : –
মৃত্যুর জন্য সনেট গুচ্ছ, নিরুদ্দেশ, নারীর জন্য পাঠ, নিষ্পাপ শিশুর জন্য গান, সাদা মেঘ ও চিলির গান, ফসল ফলানো ইত্যাদি।
মিগুয়েল এনজেল অস্ত্রিয়াস হলেন গুয়াতেমালার নোবেল বিজয়ী কবি, কূটনৈতিক, উপন্যাসিক, নাট্যকার ও সাংবাদিক। তার অবদান লাতিন আমেরিকার মূল ধারার সাহিত্যকে পশ্চিমা ধারার সাহিত্যের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করানোতে এবং একই সঙ্গে স্বজাতীয় সাহিত্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করানো, বিশেষ করে গুয়াতেমালার সাহিত্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা। তার জীবনের একটা বড় সময় দেশের বাইরে কাটে। তার প্রথম জীবনের পড়া লেখা হয় প্যারিসে মানবজাতি বিষয়ে। তিনি প্রথম সাহিত্যিক যিনি দেখান কিভাবে নৃতত্ত্ব ও ভাষার বৈজ্ঞানিক ব্যবহার সাহিত্য লেখনীতে প্রভাব ফেলে। প্যারিসে থাকাকালীন অস্ত্রিয়াস সুরিয়ালিজম বা পরাবাস্তব আন্দোলনেও জড়িত ছিলেন এবং মর্ডানিস্ট সাহিত্যের অনেক বিষয় তিনি লাতিন সাহিত্যে প্রয়োগ করেন। এভাবে তিনি ১৯৬০-৭০ এর দশকে- লাতিন আমেরিকান বুম- যা এই অঞ্চলের সাহিত্য ধারণাকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করে খ্যাতি লাভ করেন অস্ত্রিয়াস এখানে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেলও এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার উপন্যাস মিস্টার প্রেসিডেন্ট (১৯৪৬) লাতিন সাহিত্যের এক বড় মাইলফলক এটি লাতিন অঞ্চলের শাসকদের স্বৈরাচারিতার রূপ অন্বেষণ করে ও সমাজে এর প্রভাব অনুসন্ধান করে। রাজনৈতিক অপশাসনের বিরুদ্ধে তার লেখনী সবসময় উচ্চকিত ছিল। তিনি যে জন্য বিশিষ্ট হয়ে থাকবেন তা হলো সাহিত্যে তার নতুন নতুন কলাকৌশলের প্রয়োগ। তিনি প্রথম সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়ালিজমের প্রয়োগ করেন পরবর্তীতে মার্কেল এটির পূর্ণতা দেন। সামাজিক অন্যায়ের নানা দিক তার সাহিত্যে রূপায়িত হয়েছে কারণ লাতিন আমেরিকায় এটি বিশেষভাবে প্রথিত। স্বৈরশাসকের অধীনে জীবন যাপনের যন্ত্রণাময় ও বিভীষিকাময় রূপ মিস্টার প্রেসিডেন্টে প্রতীয়মান। তার স্বপ্ন চিত্রময়তা, অনুকারশব্দ, প্রতীক, শব্দের প্রতিফলন, ভাঙ্গা বাক্যের প্রয়োগ, দৃশ্যপটের পরিবর্তনশীলতা, পরাবাস্তবতাবাদ পরবর্তীকালের অনেক সাহিত্যিককে প্রভাবিত করে। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে তার লেখনীর কারণে তাকে অনেকদিন নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হয়। তার যে বইটিকে তার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম ধরা হয় তা হলো মেন অব মেইজ। এটি লাতিন সভ্যতা ও প্রাত্যহিক রীতিনীতির ওপর রচিত। এটিতে এমন এক রাজনৈতিক সমাজের রূপরেখা অঙ্কিত যেখানে মানুষের বিশ্বাস, রাজনৈতিক বিশ্বাস ও ধারণা এমন এক জীবনে সঞ্চারিত যেখানে জীবনের ওপর আস্থা, বিশ্বাস ও ভ্রাতৃত্ববোধ একত্রিত। ১৯৬৬ সালে লেনিন পিস প্রাইজ পাবার পরের বছর তিনি সাহিত্যে নোবেল পান দ্বিতীয় লাতিন আমেরিকান হিসেবে। এছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কর্মগুলো হলো, লিজেনডস অব গুয়াতেমালা, মিরর অব লিডা সেল।
পাবলো নেরুদা কবি ও রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯০৪ সালে চিলিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম ছিল নেফতালি রিকার্দো রেয়েস বাসোয়ালতো। গার্সিয়া মার্কেজ তাকে বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে অভিহিত করেন। তার কবিতা প্রাণবন্ত ও আবেগপূর্ণ। লোরকার মতে নেরুদা একজন বিশিষ্ট কবি। শেষ বিচারে তাকে একজন চূড়ান্ত কবি বলতে হয়। পাবলো নেরুদা প্রথমে তার ছদ্মনাম হলেও পরে নামটি আইনী বৈধতা পায়। কৈশোরে তিনি এই ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন। ছদ্মনাম গ্রহণের পশ্চাতে দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, ছদ্মনাম গ্রহণ ছিল সে যুগের জনপ্রিয় রীতি, দ্বিতীয়ত – এই নামের আড়ালে তিনি তার কবিতাগুলো নিজের পিতার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতেন। তার পিতা ছিলেন কঠোর মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি। তিনি চাইতেন তার পুত্র কোন ব্যবহারিক পেশা গ্রহণ করুক। নেরুদা নামটির উৎস কবি ও রাজনীতিবিদ। নেরুদা নামটির উৎস চেক লেখক জান নেরুদা এবং পাবলো নামটির সম্ভাব্য উৎস পাল ভারলেইন। পাবলো নেরুদাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী লেখক মনে করা হয়। তার রচনা অনূদিত হয়েছে একাধিক ভাষায় নেরুদার সাহিত্যকর্মে বিভিন্ন প্রকাশ শৈলী ও ধারার সমাবেশ ঘটেছে। একদিকে তিনি যেমন লিখেছেন- কুড়িটি প্রেমের পত্র ও একটি হতাশার গান- কামোদ্দীপনামূলক কবিতা সংকলন তেমনি রচনা করেছেন পরাবাস্তববাদী লেখা থেকে ঐতিহাসিক মহাকাব্য ও রাজনৈতিক ইস্তেহারও। এছাড়াও তার কবিতায় রাজনৈতিক সমালোচনা পাওয়া যায় তাই তাকে অনেকবারেই শাসকের কুনজরে পড়তে হয়েছে। ১৯৪৮ সালে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তাকে এই সময় তার বন্ধুরা একটি ঘরের বেসমেন্টে লুকিয়ে রাখে। এরপরে নেরুদা পাহাড় পার হয়ে আর্জেন্টিনাতে গিয়ে আশ্রয় নেন।
নেরুদা এক হয়েও তার লেখনীর কারণে বহুধাগুণে গুণান্বিত। তিনি যেমন ছিলেন একজন স্পষ্টভাষী, চিৎকৃত, দায়বদ্ধ আবার অন্যদিকে ব্যক্তিগত, নিভৃতমনা, পরাবাস্তববাদী। প্রেম তার কবিতার অনিবার্য এক দিক; প্রেম দিয়ে যেমন আচ্ছন্ন মনের বেদনা লুকাতে চেয়েছেন তেমনি প্রেম দিয়ে গ্লানিকে অতিক্রম করতে চেয়েছেন। কবি মনের বিষাদ ভুলতে কবি লেখেন- রেসিডেন্স অন আর্থ, বইটি এ বইয়ের- আর্স পোয়েটিকা, ওড টু ফেদেরিকা গার্সিয়া লোরকা, স্পেন ইন আওয়ার হার্ট, এরকম অনেক কবিতা আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। তার- ক্যান্টো জেনারেল- এক বিচিত্র মহাকাব্য পনেরো খ-ের বইটিতে ২৩১টি কবিতা রয়েছে।
১৯৭৩ সালে নেরুদা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি তার কবিতার জন্যে পৃথিবী জোড়া খ্যাতি লাভ করেন যেমনি তেমনি সামরিক শাসকের শ্যেনদৃষ্টিতেও পড়েন। চিলির সামরিক শাসক পিনোচেট, অনেকে শঙ্কা করে নেরুদার অসুস্থতার সময় ডাক্তারকে নির্দেশ দেয় তাকে প্রাণঘাতী বিষ প্রয়োগ করার জন্যে। মৃত্যুর পড়ে তিনি হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান বলে রটনা করা হয়। চিলির সামরিক শাসক অগাস্তো পিনোচেট নেরুদার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া জনসমক্ষে অনুষ্ঠিত করার অনুমতি দেননি। যদিও হাজার হাজার মানুষ সেদিন কার্ফ্যু ভেঙ্গে পথে ভিড় জমান। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পরিণত হয় চিলির সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম গণপ্রতিবাদে।
অক্টাভিও পাজও কবি হবার পাশাপাশি কূটনৈতিক ছিলেন। তিনি ১৯১৪ সালে ম্যাক্সিকো সিটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার লেখায় ম্যাক্সিকান ও ইউরোপিয়ান দুই ধারাই পরিলক্ষিত। খুব ছোটকাল থেকেই তার দাদার সূত্রে প্রাপ্ত লাইব্রেরীতে তার পড়া ও সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ- বন্য চাঁদ- ১৯ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তবে তার অনেক আগে থেকেই তিনি কবি হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন। তিনি শহর ছেড়ে, ইয়োকাতান রাজ্যের একটি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন কবিতা চর্চার জন্য। এখান থেকে প্রকাশিত হয় তার কাব্য গ্রন্থ- পাথর এবং ফুলের মধ্যে। এটি টি.এস. এরিয়ট দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং ম্যাক্সিকোর চাষিরা কিভাবে জমিদার দ্বারা শোষিত তার চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে কাব্য প্রতিভা প্রকাশিত হতে থাকলে তার দেশে গৃহযুদ্ধ চলাকালীন তিনি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক লেখক কংগ্রেসে আমন্ত্রিত হন এবং এখানে তিনি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি সেখান থেকে ফিরে ওয়ার্কশপ নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত করেন। তিনি এলেনা গারোর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন; অনেকের মতে এলেনা ছিলেন সেই সময়ের সবচেয়ে চমৎকার লেখিকা। কিন্তু তাদের বিয়ে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এরপরে অক্টাভিও পাজ আমেরিকায় পাড়ি জমান ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের জন্য। এর ফলশ্রুতিতে তার গ্রন্থ- দ্য লিবারিন্থ অব সোলিচুড প্রকাশিত হয়। নিউইয়র্ক টাইমস এটাকে ম্যাক্সিকোর পর্যালোচনা হিসেবে গণ্য করে এবং এটাতে ম্যাক্সিকোর ব্যক্তিত্ববোধকে অক্টাভিও পাজ নেতিবাচক বলে ধারণা করেন। এরপরে তিনি ভারত, জেনেভা, টকিওতে কূটনৈতিকের দায়িত্ব পালন করে দেশে ফিরে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সানস্টোন- রচনা করেন। তার উত্তরোত্তর খ্যাতি বাড়তে থাকে এরপরে ১৯৫৯ আবার প্যারিসে কূটনৈতিকের দায়িত্বে পাঠানো হয় এবং ১৯৬২ সালে ভারতের এ্যাম্বাসেডরের দায়িত্ব লাভ করেন। এরপরে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দান করেন। সেখানে তিনি চার্লস এলিয়ট নরটন প্রফেসরশিপ হিসেবে গণ্য হন। পরবর্তীতে তার বক্তৃতাটি চিলড্রেন অব মায়ার নামে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। সেমুয়েল বেকেটের মতো লেখকরা তার লেখা অনূদিত করেন। তার লেখায় ম্যাক্সিকান পরাবাস্তবতা, অস্তিত্বের সংকট, বুদ্ধের দর্শন এবং হিন্দু ধর্মের দর্শন এই সকল বিষয় বিশেষভাবে পরিলক্ষিত। তার কাব্যগ্রন্থের পরাবাস্তবতাকে; বিশেষ করে সানস্টোন এ- নোবেল কমিটি অক্টাভিও পাজের অনবদ্য সৃষ্টি বলে ঘোষণা করে। তার পরবর্তী কালের অনেক কবিতা প্রেম ও যৌনতা নিয়ে লেখা। তাছাড়া গভীর আবেগ, আধুনিক চিত্রকলা, নৃতত্ত্ব, আজটেক শিল্প যেগুলো অন্য বড় কবিদের মধ্যে পাওয়া যায় তার কবিতার উপজিব্য বিষয়। ম্যাক্সিকোর ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে তার লেখা ম্যাক্সিকান কালচার অন্যান্য ম্যাক্সিকান লেখকদের প্রভাবিত করেছে। ইলান স্টেভানের মতে অক্টাভিও পাজ হচ্ছেন দান্তের আধুনিক রূপ। এছাড়াও অক্টাভিও পাজ প্রবন্ধ ও নাটকও রচনা করেন। অক্টাভিও পাজ ছোট গল্পের ক্ষেত্রে নাথানিয়েল হথর্ন ও ইয়েটস দ্বারা প্রভাবিত হন। ইংরেজী ছাড়াও তার লেখনীতে স্পানিস, জাপানিজ, ভারতীয় প্রভাব তার সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যের মর্যাদা দান করে।
মারিও বার্গাস ইয়োসা পেরুর শীর্ষস্থানীয় কথাসাহিত্যিক ও গদ্যকার ২০১০ সালে মারিও বার্গাস ইয়োসা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। তার জন্ম ১৯৩৬ সালে দক্ষিণ পেরুর আরেক্কিপা শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তার যৌবনকাল কাটে প্যারিস, মাদ্রিদ ও লন্ডনে। তার প্রথম পেশা ছিল সাংবাদিকতা ও অধ্যাপনা। অত্যন্ত প্রতিভাধর বার্গাস বিশ্বখ্যাত কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তার রাজনৈতিক লেখনীতে লাতিন আমেরিকার ক্ষমতা ও দুর্নীতির অমানিশা তীব্রভাবে ও একান্তভাবে চিত্রিত। বিংশ শতকের হিস্পানী লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম প্রধান। তিনি ৩০ এরও বেশি উপন্যাস উপন্যাস, নাটক ও গদ্যগ্রন্থের লেখক। মারিও বার্গাস ইয়োসা স্পেনীয় ভাষায় কার্লোস ফুয়েন্তেস ও গার্সিয়া মার্কেজের সমতুল্য লেখক। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তার প্রভাব ধীরে ধীরে গভীরতর হচ্ছে। ১৯৬০ এর দশকে তার তিনটি উপন্যাস নায়কের কাল, দ্য গ্রীন হাউস এবং গির্জায় কথোপকথন প্রকাশিত হবার পর তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং সংবাপত্রে তার লেখনী যেগুলোর শাসালো অংশ হচ্ছে রাজনৈতিক সমালোচনা শাসক মহলে বিশেষ তোলপাড় সৃষ্টি করে। তার রচনাবলী পেরুর জাতীয় ও সামাজিক সমস্যা কেন্দ্রিক কিন্তু শুধু পেরু নয় আধুনিক যুগের সব দেশের মানুষ যেভাবে রাজনীতি দ্বারা নিষ্পেষিত তা তার লেখার জোরালো দিক। বিংশ শতকের মানুষের বিপন্নতা ও অসহায়ত্ব তার লেখায় প্রতিফলিত। তার লেখায় এ ছাড়াও কৌতুকাবহ ও যৌনতা তার লেখাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। যেখানেই মানুষের স্বাধীনতা বিপন্ন, যেখানে মানুষ অসহায় ও মানবাধিকার লাঞ্ছিত সেখানেই বার্গাস ইয়োসার কণ্ঠস্বর প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। লাতিন আমেরিকান জনগণ শত শত বছর ধরে রাজনৈতিক বঞ্চনার শিকার; অনেক বিখ্যাত লাতিন লেখকের মতো বার্গাসও এই দিকটিকে তার লেখনীর ক্ষুরধার অংশ করে তোলেন তাই তাকে লাতিন আমেরিকার-রাজনৈতিক বিবেক-বিবেচনা করা হয়। তিনি সক্রিয় রাজনীতি করে সমাজের ভিতর যে কীট তা নির্মূলের চেষ্টা করেছিলেন; তাই তিনি রাষ্ট্রপতি পদের জন্য সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন যদিও তিনি জয়লাভ করতে পারেননি খুব অল্প ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন।
বার্গাস ইয়োসা গভীরভাবে সমাজ সচেতন ছিলেন তার যুক্তি ছিল রাজনীতি শুধু রাজনীতিবিদদের একচেটিয়া অধিকার নয়। লেখক ও সাংস্কৃতি কর্মীরাও রাজনীতিতে গভীর ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিচালিত তাই কেউ রাজনীতি এড়িয়ে চলতে পারে না। তিনি সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষেও রুখে দাঁড়ান। একবিংশ শতকে ফ্যানাটিজমের কারণে সন্ত্রাসবাদের জন্ম। মানুষের সহনশীলতার অভাবের দিকেও বার্গাস আঙ্গুল তোলেন। লাতিন আমেরিকার ভ্রষ্ট রাজনীতিকে তিনি দায়ী করেন সন্ত্রাসবাদ সঞ্চারণের জন্যে। বার্গাসের মতে লেখকদের রাজনৈতিক ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ও আপোসহীন ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি মার্কেলের লেখা ও রাজনৈতিক নীতির সমন্বয়ের সমালোচনা করেন যদিও তিনি মার্কেলের লেখাকে অনেক উঁচু মানের বলেন।
মারিও বার্গাস লেখার মূল উপজীব্য করেছেন সমাজের ক্ষয়িষ্ণু রূপ, বৈষম্য, শোষণ ও সামাজিক নিপীড়নকে এই বিয়গুলো বারবার তার উপন্যাসে ফিরে এসেছে। তার আরও উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হচ্ছে, নায়কের কাল, জুলি চাচি এবং নাট্যরূপকার, জগৎ বিলয়ের যুদ্ধ, ছাগলের মহাভোজ, নষ্টা মেয়ে ইত্যাদি। তার এই উপন্যাসগুলোও রাজনৈতিক সমালোচনায় ঋদ্ধ।
লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের যেমন রয়েছে বিশিষ্টরূপ তেমনি তা বিশ্ব সাহিত্য দিয়ে প্রভাবিত। লাতিন বিখ্যাত লেখক গ্যাব্রিয়াল মিস্ত্রাল, মিগুয়েল এনজেল অস্ত্রিয়াস, চিলির পাবলো নেরুদা, কলাম্বিয়ার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, ম্যাক্সিকোর অক্টাভিও পাজ ও পেরুর মারিও বার্গাস ইয়োসা যেমন বিশ্ব সাহিত্যের তাৎপর্যময় দিক ও বৈশিষ্ট্য, ধ্যান, ধারণা, চেতনা, দর্শন দ্বারা অচ্ছন্ন হয়েছেন তেমনি তারা তাদের নিজ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সারা বিশ্বে সঞ্চারিত করেছেন এবং বিশ্বসাহিত্যকে আরও বর্ণিল, সমৃদ্ধ ও বহুমুখী করে তুলেছেন। লাতিন লেখকদের আলাদা রচনাশৈলী পরাবাস্তবতা, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্টাবলী, স্বপ্নবাস্তবতা, ম্যাজিক রিয়ালিটি ও রাজনৈতিক ও সমাজ সচেতনতা ও গভীর দর্শনবোধ বিশ্বসাহিত্য সম্ভারে চিন্তা, চেতনার ও সচেতনতার নব দীগন্ত উন্মোচন করেছে তাই এগুলো ব্যাপক মাত্রায় বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আমরা লাতিন সাহিত্যকে বাংলায় আরও বেশি অনূদিত করে আধুনিক সমাজের সাহিত্য পিপাসুদের যেমন ঋদ্ধ করতে পারি তেমনি তা বিশ্বসাহিত্য জানবার নতুন অধ্যায়ও রচনা করবে তাই বিশ্বায়নের এই সময়ে যখন এক ভাষা অন্য ভাষা থেকে গ্রহণ করে আরও পূর্ণতা পাচ্ছে; আমাদেরও বিশ্বসাহিত্য বা লাতিন সাহিত্য সমন্ধে আরও বেশি জ্ঞানলাভ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা বাংলাকে আরও সমৃদ্ধ করবে তা বিশ্বাস করা অমূলক কোন ধারণা নয়।
——————————————
[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত
কৃতজ্ঞতা ও ঋণস্বীকার –
সাদিক ইসলাম। ]