নাস্তিকের ঈশ্বর দর্শন -6
সালটা ১৯৯০,বন্ধুরা প্রায় সকলেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। মাসের শেষেও হাতে বেশ কিছু থাকছে ,কারণ একটাই,বাপের হোটেল তখনও রমরম করে চলছে। মাসে কিছু ধরিয়ে দিয়েই আমরা খালাস,আর জনক জননীও নিতে চাইতেন না। ওনাদের একটাই কথা,সঞ্চয় করা শেখো।আজ বুঝি কতটা বিচক্ষণ ছিলেন ওনারা। তা যাই হোক,আমাদের কাছে ঐ সব জ্ঞান ভুলভাল ছিল।হটাৎ ট্যাক্সি চেপে ঘুরতে যাওয়া বা নামিদামি রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া এ’সব ছিল আমাদের প্রতি রবিবারের রুটিন। এহেন সময়ে বন্ধু রাণা একদিন প্রস্তাব দিল পুরী ঘুরতে যাওয়ার। এক কথায় আমরা চারজন রাজি। না, দেব দর্শন আমাদের লক্ষ্য নয় বরং নিষিদ্ধ তরল নিয়ে গবেষণা করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য যা বাড়িতে করা যেত না।এদিকে স্বর্গের পথে পা বাড়িয়ে থাকা কিছু সৎ বন্ধু বা সিনিয়র দাদারা ঐ বস্তুটির মহিমা এমন ভাবে ব্যাখ্যা করেছে যে আমরাও আগ্রহ ভরে উৎসুক।হালকা ছুঁয়েছি তা’তে তার মহিমা পুরোটা বুঝতে পারি নি।সকলেই তো চায় স্বর্গে যেতে, অতএব চালাও পানসি পুরী।ট্রেনের টিকিট কাটা হলো,এস টি ডি করে হোটেল বুক হলো।তারপর পুরীর পথে যথাদিনে হাওড়া থেকে রওনা হলাম চার বন্ধু মিলে।সকলেই প্রথমবার যাচ্ছি।যাবার সময় সব বন্ধুদের হাতে একগাদা আত্মীয় টাকা গুঁজে দিয়ে তাদের পুজো দিতে বললেন।বিড়ম্বনার একশেষ।যাত্রাপথের বিবরণ দিলাম না।পৌঁছে হোটেলে চেক ইন করে একটু ফ্রেশ হয়ে সোওজা সমুদ্র স্নানে।ঘন্টা তিনেক জলে দাপাদাপি করে ফেরৎ এসে খেয়ে দেয়ে ঘুম।বিকেলে উঠে একটু সমুদ্র দর্শন করে ঘরে।শুরু হলো গবেষণা।অল্পক্ষণ, গোটা ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় আর নিষিদ্ধ তরলের গন্ধে ম ম করতে লাগলো।আমরা তখন সবাই ছাত্র আবার সবাই শিক্ষক।যে যা এই ব্যাপারে কানে শুনেছে সে সেই জ্ঞান অন্যের ওপর ঝারছে।এর মধ্যেই বমি, প্যান্ট হলদে হয়ে যাওয়া সব ঘটনাই ঘটেছে।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।ঘুম ভাঙল,মাথা ভার হয়ে আছে।কেউ খাটে কেউ মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছি আর অবাক কান্ড ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।সকলেই হাঁ।রুম সার্ভিসের ফোন করে বলাতে ম্যানেজার স্বয়ং এসে দরজার তালা খুলে যা বললেন তার সারমর্ম এই যে বেহেড মাতাল হয়ে আমরা ঘর নোংরা করে দরজা খুলে ঘুমাতে দেখে আমাদের সুরক্ষিত রাখতে উনি এই ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।এখন যেন ফ্রেশ হয়ে নীচে তাই যা’তে ঘরটা পরিস্কার করা সম্ভব হয় (সত্যিই তাই ঘরে গত রাতের ক্রিয়াকলাপ তখনও বিদ্যমান) এবং সবশেষে উপদেশ আমরা যেন পান করার লিমিট মেনটেন করি।আকাট মুকখু।ওরে ছাগল ঐ লিমিট জানার জন্যই তো আমাদের গবেষণা।আর খাচ্ছি আমাদের টাকায় তোর বাপের কি?প্রবীণ লোকটার মুখের ওপর কিছু না বলে নীরবে ঘাড় নাড়লাম।এক এক করে বাথরুম গমন। সেনাপতি শেষে মরে তাই আমি আটকে গেলাম।জামা জুতো গলিয়ে সবাই নীচে ব্রেকফাস্ট করতে গেল।ইতিমধ্যেই এক সাফাইওয়ালা হাজির,আমি খাটে বসে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে নজরে এলো একটা বোতলে তখনও বেশ কিছুটা গবেষণাপত্র রয়েছে।ঘর সাফাইও চলছে আমার দিন শুরু হলো গবেষণাপত্র উদ্ধার করতে করতে।অনেক পরে নীচে এলাম।এক স্বর্গীয় ঘন্টা মাথায় হালকা করে গির্জার ঘড়ির মত ঢং ঢং করছে,মেজাজ ফুরফুরে।নীচে এসে দেখি বাবুরা সব লবিতে বসে স্থানীয় একজনের বক্তব্য বেশ মন দিয়ে শুনছে,আমার দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইতে ঘর সাফাই করা বললাম।লোকটিকে লক্ষ্য করলাম, মধ্য বয়স্ক,মধ্যবিত্ত একজন।মনে হলো হোটেলের স্টাফ,এক কাপ চা আনতে অর্ডার করতেই বন্ধুরা চুপ চুপ করতে বললো।উনি মন্দিরের পান্ডা, আমরা কবে পুজো দিতে যাবো সেই ব্যাপারে জানতে এসেছেন,শুনে বললাম-যাবো তো বটেই আগে এক কাপ চা আনুন।ব্যাজার মুখে উনি চা আনতে গেলেন বন্ধুরা রে রে করে উঠলো।আমি নির্বিকার (প্রসঙ্গত জানাই এই ঘটনার বহু আগে থেকেই আমি নাম নিয়েছি স্বামী নির্বিকারানন্দ)।চা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের ঘুরতে যেতে বলতে উনি মিনমিন করে পুজোর কথা তুললেন।আমি অভয় দিয়ে আশ্বস্ত করে দল বেঁধে বাইরে এলাম।আমরা পুরীতে পাঁচদিন ছিলাম।প্রথম চারদিনের রুটিন ছিল কমন,সমুদ্র স্নান,ঝিনুক খোঁজা, বাড়ির প্রিয়জনদের জন্য উপহার কেনা,বিখ্যাত গজা কেনা আর সন্ধ্যে হলেই গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে যাওয়া।এই ক’দিনেই ‘লিমিট’ শব্দটি কিঞ্চিত বোধগম্য হয়েছে , আর তেমন বেহেড কেউ না হলেও ডিনার কিন্তু বন্ধ,পেট তো তরলে আর সোডাজলে টইটুম্বুর।পঞ্চমদিনে ঐ পান্ডাবাবুকে ডাকা হলো।উঠতে বেশ বেলা হচ্ছিল আমাদের,সবই ঐ তরলের কৃপা।সমুদ্র স্নান স্থগিত রেখে ঘরেই স্নান সেরে গেলাম মন্দিরে।মন্দিরের ওপর কিছু বই কিনেছিলাম, সেগুলো সঙ্গে আছে।কাউন্টারে পুজোর টাকা জমা দিয়ে আমরা মূল মন্দিরে গেলাম,আধো অন্ধকারে ত্রিমূর্তি দর্শন করলাম,পান্ডাবাবু আমাদের মন্ত্র উচ্চারণ করালেন, আমি যথারীতি পাঁঠার মত ব্যা ব্যা করলাম।লক্ষ্য করলাম একটা বিশাল মোটা শাল খুঁটি বিগ্রহ যে ঘরে আছে তার দরজার বাইরে আড়াআড়ি ভাবে লাগানো,যেমন আমরা ঘরের দরজায় খিল দিয়ে থাকি,বুঝলাম অতি বড় ভক্তদের হাত থেকে ভগবানকে দূরে সরিয়ে রাখা।বেচারা ভক্তকূল।পান্ডাবাবু বললেন ঐ খিল সকালের সময় খোলা হয় যাতে ভক্তরা সরাসরি ভগবানকে তাদের আর্জি জানাতে পারে কাছে গিয়ে।অন্য সময় পান্ডারাই গতি। এখানেও দালাল? আমার কিন্তু অন্য কৌতুহল,পড়েছিলাম শ্রী শ্রী চৈতন্য দেব তিরোহিত হয়েছিলেন পুরীতে এবং ওনার মৃত্যুটা খুবই রহস্যময়। আজ পর্যন্ত কেউ সঠিক ভাবে বলতে পারেনি যে ঠিক কি ভাবে ওনার মৃত্যু হয়েছে। বহু মত এই মৃত্যু ঘিরে আছে, তার মধ্যে একটি হল পুরীর তৎকালীন রাজা চৈতন্য দেবের অনুরক্ত হয়ে পড়াতে সেখানকার ব্রাহ্মণ সমাজ ও মন্দিরের পূজারীরা ভয় পেয়ে যান এবং ওনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। হত্যা তো করবে কিন্তু লাশ লোকাবে কোথায়, তখন স্থির হয় যে প্ল্যাটফর্মে বিগ্রহগুলো আছে, যার পোষাকী নাম রত্ন সিংহাসন সেখানেই কবর দেওয়া হবে আর পুরোটাই হবে লোকচক্ষুর অন্তরালে। যেমন ভাবা সেই মত কাজ হল, অর্থাৎ চৈতন্য দেবকে গুমখুন করা হয়েছিল। আরও একটা কথা পড়েছিলাম, ওই প্ল্যাটফর্মের নাম রত্ন সিংহাসন কেন। সম্ভাব্য উত্তর ছিল কালাপাহাড়ের হাত থেকে মূর্তি বাঁচাতে তাকে সরিয়ে ফেলা হয় এবং দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত মূল্যবান বস্তুগুলো ওই মঞ্চ বা বিগ্রহ রাখার নিচেই করা মঞ্চে যেন পোঁতা হয়। প্রচুর অলঙ্কার আর নগদ অর্থ না’কি ওখানে পোঁতা আছে। তাই এই নাম। তাই সবাই যখন বিগ্রহ দেখছে বা মন্দিরের ভেতরের কারুকাজ দেখছে আমার নজর কিন্ত ফিক্সড হয়ে আছে ওই সিংহাসনে। কিসুই পেলাম না। আমাদের পান্ডাবাবুকে আমাদের প্রসাদ হোটেলে পৌঁছে দেবার হুকুম দিয়ে ছুটি দিলাম। শুরু হল আমাদের মন্দিরের ওপর কেনা বইগুলো খুলে স্থাপত্য,খোদাই করা ভাস্কর্য নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ, আমরা যেন এক একজন পুরাতত্ববিদ বা ঐতিহাসিক পন্ডিত। যদিও আমরা সবাই কমার্সের ছাত্র । মন্দিরের চারধার আমরা খালি পায়ে হাঁটছি আর এইসব করছি, আর তখনই ঘটল ঘটনাটা । আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তরফ থেকে মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ চলছে বলে চারদিকে লোহার পাইপ দিয়ে তৈরি ভারা/ভাড়া, যার ওপর চড়ে মিস্ত্রিরা মন্দিরের রিপেয়ারিং করতে পারে। আমরা মাঝেমধ্যেই মন্দিরের প্রায় গায়ে সেঁটে গিয়ে বিশ্লেষণ করছিলাম, তখন অন্তরায় হচ্ছিল ওই লোহার পাইপ। এইরকম কাজকর্ম করতে গিয়েই ঘটে গেল ঘটনাটা ।