নাস্তিকের ঈশ্বর দর্শন -5
মকর সংক্রান্তি বললে আপনারা কি ভেবে বসবেন? সেই গঙ্গাসাগর , এলাহাবাদ, উজ্জয়নী,পূণ্যস্নান আর বাঙালির ঘরে ঘরে পিঠে পায়েসের ধুম।আচ্ছা যদি হালখাতা বলি,তখন কি মনে আসবে আপনাদের? পয়লা বৈশাখ,অক্ষয় তৃতীয়া,দেওয়ালি এইসব।যদিও আমি দেখেছি আরও দিন যখন বেশ কিছুজন হালখাতা করে-যেমন বিশ্বকর্মা পুজো,মহাবীর জয়ন্তী,গুরু পূর্ণিমা বা গুরু নানকের জন্মদিনে। শুধু জানতাম আমার এক মক্কেল অনিল দা ১৫ই আগস্ট হালখাতা করতেন।নিজে স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন, তাই।নতুন হালখাতা জানলাম খোকনদা-র কাছে। মধ্য বয়স্ক,আটপৌরে খোকনদা আগে ডেকরেটরের দোকানের মজুর ছিলেন,পরে নিজের চেষ্টায় ছোট করে ব্যবসা শুরু করেছেন। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কালীঘাটের মা কালীর পরম ভক্ত। সে যত ভীড়ই হোক’না কেন শনিবার,মঙ্গলবার,অমাবস্যা আর প্রতি অষ্টমী তিথিতে কালীঘাটে যাবেই যাবে। কোন প্রসাদ (মানে মিষ্টি জাতীয় কিছু) কিনবে না, জবার মালাও থাকবে না তার হাতে।শুধু একটা নিখুঁত বেলপাতা দিয়ে পুজো দেবে আর পান্ডাদের দেবে পাঁচ টাকা। এতবার গিয়ে গিয়ে তার একটা পরিচিতি ছিল। জানি বলবেন আমি এত কথা জানলাম কি ভাবে।বাবু,আমার ঐ বন্ধুটি অত্যন্ত জুলুম করে আমাকে বেশ কয়েকবার নিয়ে গিয়েছিল বলেই বর্ণনা দিতে পারলাম।বাবু কখনোই লাইনে দাঁড়িয়ে ভেতরে যেত না।সবসময়ই বেলাইনে যেত।অঙ্কন দা,যাকে সবাই মেজদা বলে (জানি না এখন ওনার শারীরিক কন্ডিশন কেমন) যিনি রোজ মঙ্গল আরতি করেন কালিঘাটে ,বাবুকে খুব পছন্দ করতেন,হতে পারে এই ভালোবাসাটাই বাবুর বেলাইনে ঢোকার ইউ পি এস। বাবু আমাকেও মাঝে মাঝে টেনে নিয়ে যেত। অঙ্কন দা আমাকেও ভাসবাসতেন। ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন করে প্রায়দিনই আমার মনের দাগ কাটার চেষ্টাও করতেন। কিন্তু ঐ যে বলে “বামুনে মন্ত্র বলে, পাঁঠায় ম্যা ম্যা শোনে “, আমার অবস্থা ঐ রকম থাকত। যদিও কালীঘাট মন্দিরে গেলে চেষ্টা করতাম মনে শ্রদ্ধা ভক্তি নিয়ে আসতে। সে গুড়ে বালি । সালটা মনে হয় ২০১৩, মকর সংক্রান্তির দিন, সকালে খোকন দা এসে হাজির। সঙ্গে আবদার। ওনার হালখাতা, তাই নতুন খাতা কালীঘাটের মায়ের পায়ে ছুঁইয়ে দিতে হবে। ভাবলাম এ আবার এমন কি কঠিন কাজ। মন্দিরে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। অন্তত গোটা দশেক লাইন অজগর সাপের মত এঁকে বেঁকে মন্দিরে ঢুকেছে। আর হেলে সাপের লাইন , তাও নেহাৎ কম নয়। মনে হচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গের সব জনগণ গঙ্গাসাগরে না গিয়ে কালিঘাটে পূণ্য কামাতে এসেছে ।সব লাইনের ল্যাজটা কালীঘাট থানা টপকে গেছে।এতক্ষণে টের পেলাম খোকন দা কেন আমাকে টেনে এনেছে। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। খোকন দিকে বললাম, ক্ষমা কর গুরু, আমি নেই। নিতান্ত পাগল ছাড়া কেউ এখানে আসে না, তোমার মঙ্গল করুক মা, আমি চলি। চলি বললেই হল, আমার থেকে যথেষ্ট বয়স্ক একটা মানুষ রাস্তাতেই পা জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত আবদার, কান্নাকাটি শুরু করে দিল। এ তো মহা জ্বালা। অগত্যা, কোন রকমে পুলিশের জাল কেটে অঙ্কন দা-র দোকানে এসে প্রণাম জানিয়ে আসার অভিপ্রায় বলতেই উনি দু’হাত মাথায় ঠেকিয়ে মুখের ওপর জানিয়ে দিলেন আজকের দিনে উনি আমাদের সাহায্য করতে পারবেন না। বরং আমি যদি কিছু করতে পারি নিজের থেকে সেই চেষ্টাই যেন করি। অন্যথায় অন্যদের মত লাইনে দাঁড়িয়ে যাই।খোকন দা-ও সব শুনে হতোদ্যম। তবুও ডাইনে বাঁয়ে মারাদোনার মত ডজ করে পৌঁছলাম গর্ভগৃহে ঢোকার দরজার নীচে। এখানে দোতলা বাড়ি সমান উঁচু শালখুঁটি আর বাঁশ দিয়ে যে ব্যারিকেড করেছে তার মধ্য দিয়ে একমাত্র নেংটি ইঁদুরই গলতে পারবে। আমার এই রোগা প্যাংলা চেহারাটাও সেখানে মোটা। আমাদের দেখে এক পুলিশ কর্তা রে রে করে তেড়ে এলেন। উনি ব্যারিকেডের অপর প্রান্তে। শান্ত স্বরে বললাম আমাদের কাজকর্ম দেখার পর উনি যেন উত্তেজিত হয়ে পড়েন। অনর্থক চেঁচাচ্ছেন কেন। কে কার কথা শোনে। তখনই স্বয়ং মা কালী আবির্ভূতা হলেন। হটাৎ মন্দিরের এক দারোয়ান গলা তুলে আমাদের হয়ে ঐ পুলিশ কর্তার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করলো, তারপরেই নীচে এসে ঐ ব্যারিকেডের একটা বাঁশ খুলে আমাদের ভেতরে ডেকে নিল।বুঝলাম ঐ বিশেষ জায়গাটা এরাই চেনে। পুলিশ কর্তার সামনে দিয়ে দুই হিরো পেছনের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। রঘু, ঐ দারোয়ান,নামটা পরে জেনেছিলাম। রাস্তা আটকে আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। ভেতরে কিছু পরিচিত পূজারী আমাকে দেখে নাক মুখ কুঁচকে বলে উঠলেন এখন কেন এলেন। আপনার তো রাতে আসবেন। আসুন আসুন একটু তাড়াতাড়ি করবেন। সঙ্গে কিছুই ছিল না ঐ একটা ছোট হাতখাতা। খোকন দা মায়ের পায়ে ঠেকালেন। পূজারী নিজের থেকেই হাত বাড়িয়ে খাতাটা নিয়ে একজনকে অর্ডার করলো কাঁচাটাকার ছাপ মেরে অন্যান্য সব করতে। খোকন দা একশ এক টাকা দক্ষিণা দিল। পাঁচ মিনিটে পুজো শেষ। বাইরে এসে কিন্তু রঘুকে দেখতে পেলাম না। সেই পুলিশ কর্তার সামনে দিয়ে অঙ্কন দা-র দোকানে আসতে সব শুনে তিনিও চমৎকৃত হলেন। বললেন মায়ের অসীম করুণা না পেলে আমরা এইভাবে পুজো দিতে পারতাম না। দু দিন পরে রঘুকে ডেকে পাঠিয়ে একশ টাকা দিলাম। সেও খুব খুশি। শেষ হলো আরেকটা মন্দির দর্শনের ইতিকথা। এখানেও যে প্রশ্নটা আমাকে আজও তাড়া করে, কে এই রঘু ? তার সঙ্গে তো পরিচয় ছিল না ! তাকে যে কয়দিনই যাই না কেন বাবুর সঙ্গে আদৌ দেখিনি ! তাহলে তার প্রাণ আমাদের জন্য ভালোবাসাতে ভরলো কেন ? কেনই বা রঘু আমাদের সুযোগ করে দিল, অথচ যদি অর্থ তার চাহিদা হয় ওই দিন সে আমাদের ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল কেন ? কেনই বা আমরা দীর্ঘক্ষণ মন্দির চত্বরে তার সহকর্মীদের বা পান্ডাদের জিজ্ঞেস করেও পুজোর পরে তার টিকিটাও দেখতে পেলাম না ! তাহলে অর্থলোভী কথাটা খাটবে কেন ? পান্ডাটাই বা কেন আগ বাড়িয়ে খাতা নিয়ে বিভিন্ন মাঙ্গলীক চিহ্ন এঁকে দিলেন ? না এইসব হাজার প্রশ্নের উত্তর আজও পেলাম না। তাহলে কি ধরে নেব অঙ্কন দা ঠিক, স্বয়ং মা কালি আমাদের টেনে নিয়েছিলেন কি ওনার কাছে ? কে জানে !!
এরপর পুরীর মন্দিরের গল্প।