নাস্তিকের ঈশ্বর দর্শন -2
বেনারস আর পশ্চিমবঙ্গের সরিষার হাট,হীরের আংটি পাওয়া-কিছু বুঝলেন আপনারা। জানি না বলবেন।আচ্ছা কাওয়ারি কাদের বলা হয় বলতে পারেন।এই তো অনেকেই জানেন দেখছি।শ্রাবণ মাসে যারা বিভিন্ন শিবধামে জল ঢালতে যায় তাদের মূলত বিহার আর উত্তর প্রদেশে কাওয়ারি বলা হয়। ১৯৯৫-র অক্টোবর আর ২০০৯-র জুলাই মাসে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে বিজ্ঞানীদের সাজো সাজো রব, কারণ ঐ হীরের আংটি। আজ্ঞে হ্যাঁ অনেকেই এবার ধরতে পেরেছেন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ ছিল। ১৯৯৫-তে একদঙ্গল বন্ধু-বান্ধবী ভোর রাতে ছুটেছিলাম ডায়মন্ড হারবারের কাছে সরিষার হাটে বন্ধুর দিদির বাড়িতে,উদ্দেশ্য-ছবি তুলবো গ্রহণের। বেহালা থেকেই পুলিশের পথ আটকানো শুরু,যেহেতু ঐ দিদির কর্তা নিজেই পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিক তাই ওনার বাড়ি পৌঁছতে বেগ পেতে হয়নি।চক্ষু সার্থক করে ভালোলাগার আবেশ নিয়ে ফিরেছিলাম।তারপর বিভিন্ন বিজ্ঞানমঞ্চের সঙ্গে এবং বিড়লা তারামন্ডলে ধর্ণা দিতে দিতে চলে এলো ২০০৯ সাল,আরও জানলাম যে আগামী ২০০ বছরে ভারতে আর পূর্ণগ্রাস দেখা যাবে না। তাই প্ল্যান প্রোগ্রাম করতে বসলাম।নেট এসে গেছে।অরকুট ছিল,ফেসবুক তত জনপ্রিয় নয়। বিস্তর গবেষণা করে বেনারস যাবো ঠিক করলাম।আড্ডায় বলতে দুই সুগ্রীব (দোসর) নেচে উঠল যাবে বলে সপরিবারে।তাদের বাচ্চাদের বোঝার বয়স হয়েছে। পরের ২০০ বছর দেখা যাবে না।বেশ যাচ্ছিলাম একা একা,বুঝলাম হয়ে গেল।গ্রহণের দুদিন আগে হাওড়া থেকে বিভূতি এক্সপ্রেস ধরে রওনা দিলাম।সারা যাত্রাপথে এই কাওয়ারিদের জ্বালায় অতিষ্ঠ। সকালের ট্রেন বিকেল চারটেতে বেনারস পৌঁছলো।হোটেল বুক ছিল।একটু ফ্রেশ হয়ে চা খেয়ে ঘুরতে গেলাম,উদ্দেশ্য জায়গা দেখে আসা।হোটেল ম্যানেজার আমাদের কথা শুনে প্রচুর উপদেশ দিলেন শুধু নয় নিজের পরিচিত এক অটো চালককেও পাকড়াও করে এনে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দর দস্তুর করে গেলাম গঙ্গার এক ঘাটে, যে জায়গাটা বেনারসের শেষ সীমানায় প্রায়।মূলত শ্মশান ঘাট,বেশ ফাঁকা। আমার পছন্দ হলো,সঙ্গীরা এইবার আর প্যায়তারা করেনি, পছন্দ-অপছন্দের ভার আমার ওপর।ঐ ঘাট থেকেই নৌকা ভাড়া করে গঙ্গা আরতি দেখে ঐ অটো করে শহর ঘুরতে গেলাম।দেখি গেরুয়া গেঞ্জি বা জামা আর গেরুয়া হাফ প্যান্ট বা লুঙ্গির লোকেদের ভীড়ে শহর ছয়লাপ,শ্রাবণ মাস,সবাই বাবার ছেলে,কাওয়ারি।মনে মনে প্রমাদ গনলাম। এই ভীড়ের যদি এক কণাও কাল ঐ ঘাটে যায় তাহলে ছবি তোলা চৌপাট।অটো ড্রাইভার আশ্বস্ত করলো যে এরা গ্রহণের সময় কেউ যাবেই না। তখন মন্দির বন্ধ থাকবে এরা আজ রাত থেকেই লাইনে দাঁড়াবে বাবার মাথায় জল ঢালবে বলে, অতএব-নো চিন্তা।রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম।ভোররাতে উঠতে হবে,চিন্তা দুটো বাচ্চার ঘুম ভাঙা নিয়ে।প্ল্যান আছে হোটেল ছেড়ে গ্রহণ দেখে অটো নিয়ে ঘুরে রাতে মোগলসরাইতে ফেরার ট্রেন ধরবো।সবকিছু ঠিকঠাক হলো,ঘাটেও ভীড় নেই,ফের একবার চক্ষু সার্থক।এই মহাজাগতিক দৃশ্য যারা স্বচক্ষে দেখেন নি,সত্যি বলছি মিস করেছেন।সবকিছুই প্ল্যান মাফিক চলছিল,বিধি বাম, এক বৌদি হটাৎ বললেন- সবাই স্নান করে কাচা জামাকাপড় পড়ে আছে একটু বিশ্বনাথ দর্শন করেই যাই।আমার মাথায় হাত। যুক্তি দিলাম-সঙ্গে দামি ক্যামেরা,শ্রাবণ মাস,কাওয়ারিদের ভীড়,অচেনা অটো ড্রাইভারের কাছে সমস্ত লাগেজ,পাগলের কথা বলছো ইত্যাদি প্রভৃতি।কে কার কথা শোনে।চললো বাক্যের লড়াই,ফের হারলাম।সূর্যগ্রহণে ডায়মন্ড রিং দুবার দেখা যায়,প্রথমে পূর্ণগ্রাসের আগের মূহুর্তে,দ্বিতীয়বার গ্রহণ ছেড়ে যাওয়ার সময়।আমরা ঐ সময়তেই ঘাট ছেড়েছিলাম।এর মধ্যেই এই চাপ।আমি যাবোই না,একপ্রকার দমন পীড়ন নীতিতে নত হয়ে এগোতে লাগলাম মন্দিরের দিকে।ইতিমধ্যে ছানাপোনাগুলোর ক্ষিধে পেয়েছে।সঙ্গে কিছুই নেই,এমন কি জলও।একে তাকে জিগ্যেস করে চলেছি।পথে অনেক দোকান পেলাম।সব হাফ বন্ধ।এক বোতল জল পর্যন্ত বিক্রি করলো না তো বিস্কুট,গ্রহণ চলছে যে। এই ভাবে পৌঁছলাম বিশ্বনাথ গলির মুখে সিংহ দরজায়।দেখি এক এলাহি কান্ড।বিশ্বনাথ গলির বেশ কিছুটা আগে লোহার ব্যারিকেড,কাওয়ারিরা একযোগে অপেক্ষমান,গ্রহণ শেষ হলেই দেবে দৌড়।সে প্রায় হাজার দশেক লোক।আর গলির মুখে পুলিশের পুলিশে ছয়লাপ।সিং দরজার মাথার ওপর উদ্যত বন্দুক হাতে পুলিশ।গলিতে ঢুকতে যেতেই বাধা-কোথায় যাবেন-উদ্দেশ্য শুনেই সোজা হুকুম ঐ কাওয়ারিদের পেছনে লাইন দিয়ে আসুন-আমরা জল ঢালবো না,দর্শন করেই চলে যাবো-যাবেন না, লাঠি খাবেন।ওখানে বেশ কিছু মহিলা পুলিশ ছিল,এক বৌদি গিয়ে তাদের কাছে অনুনয় বিনয় করে উদ্দেশ্য বলতেই তারা তো জুতো খুলে এই মারে কি সেই মারে।আমি যত বলছি অনেক হলো চলো এইবার। কে কার কথা শোনে। হটাৎ নজর গেল এক পুলিশ অফিসারের দিকে,ইঙ্গিতে ডাকলেন,গেলাম – প্রশ্নোত্তর-কোথা থেকে আসছেন-কোলকাতা-ক্যামেরা গলায় কেন-সূর্যগ্রহণের ছবি তুলতে-পত্রকার (সাংবাদিক)- আজ্ঞে না শখ-আজব পাবলিক,এমন শখ হয়?- কি করি বলুন-এখন কি চাইছেন-আমি নই,ভাবীরা চাইছে বিশ্বনাথ দর্শন-সম্ভব নয়-কোন ভাবেই কি একটু কিছু করা যায় না,আমরা জল ঢালবো না,পুজোও চড়াবো না। একটু পজ্-মানে ভাবলেন,তারপর নীচু গলায় বললেন —-