Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নদী দিকহারা || Ashapurna Devi » Page 3

নদী দিকহারা || Ashapurna Devi

ঘরে কেউ নেই

ঘরে কেউ নেই।

শুধু শিথিল শয়ানে রাজকন্যা ঘুমে অচেতন। ঘরে কেউ ঢাক পেটালেও এ ঘুম ভাঙবে এমন আশঙ্কা নেই। তবু ঘরের মাঝখানে মিনিট দুই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল অতনু। তারপর গলা ঝেড়ে যেন দেয়ালকে শুনিয়ে শুনিয়ে নিষ্কম্প গলায় বলল, ভোরের প্লেনে চলে যাচ্ছি। গিয়ে যেন শুনি না একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

বলা বাহুল্য এটুকুতে নিদ্রিতার নিদ্রাভঙ্গ হয় না।

অতনু আবার বলে, এবার বাড়ি যাচ্ছি, ভোরবেলা বেরুব। আর দেখা করে যাওয়া সম্ভব হবে না। এই শেষ। হয়তো চিরদিনের মতই।

হঠাৎ বুঝি পাগলিনীর গভীর ঘুমের পর্দাটা ছিঁড়ে যায়, আর সদ্য জাগরণের চেতনা এক করুণ অভিব্যক্তির মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। মৃদু গুঞ্জরণে কাঁদতে থাকে সে বালিশে মুখ গুঁজে।

অতনু একটু কাছে সরে গিয়ে বলে, এই দেখতে হবে জানলে কে আসত?

কান্নার বেগ আরও বাড়ল, ফুঁপিয়ে উঠল পাগলিনী, আমাকে শুধু বকল! ভালবাসল না আদর করল না।

অমিতা, তুমি এমন করছ কেন? ভারী গম্ভীর শোনায় অতনুর গলা। কিন্তু অমিতা এই সহজের সম্বোধনে সাড়া দেবে কি করে? অমিতার বুদ্ধির গোড়ায় যে শনি আশ্রয় করেছে। বিকৃত করে দিয়েছে সে বুদ্ধিকে। তাই সে বালিশে মুখ গুঁজে চাপা বিকৃত স্বরে বলে, চলে যাবে কেন? যারা এসেছে তারা চলে যাবে কেন? তারা থাকবে।

না, কেউ থাকবে না। তুমি সহজ না হলে, ঠিক না হলে, কেউ থাকবে না।

ওরে বাবারে, আমার অসুখ করেছে তবু আমার মনে কষ্ট দিচ্ছে। অমিতার ছড়ানো চুলগুলো বালিশে ঘষটে ঘষটে চামরের মত হয়ে ওঠে।

অমিতা, তুমি ইচ্ছে করলেই ভাল হয়ে যেতে পারো। অসুখ সারিয়ে ফেলতে পারো।

না না না! ইচ্ছে করব না।

বেশ কোর না। আমি তাহলে যাচ্ছি।

যাবে না, যাবে না। হঠাৎ উঠে বসে অমিতা, তুমি থাকবে, একশো দিন পঞ্চাশ দিন থাকবে।

থাকতে পারি। অতনু কয়েক মুহূর্ত সেই পূর্ণ উন্মাদিনী মূর্তির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে, একশো দিন নয়, আর একদিন থাকতে পারি, যদি দেখে যেতে পাই তুমি সভ্য হয়েছ শান্ত হয়েছ।

কে জানে কি উত্তর দিত সেই আরক্ত নয়ন, উড়ন্ত-চুল, উপবাসে শীর্ণ মেয়েটা! বাধা পড়ল। সেজগিন্নী কখন যেন দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকে বলেন, অতনু, দিদি বলছেন তুমি বাড়ি যাবার আগে তোমার রুগীকে কিছু খাইয়ে যাও।

অতনু তার দিকেও একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর ঈষৎ অবহেলাভরে বলে, আপনারাই ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়ান। আমার কথা শুনছে কে? তাছাড়া আমার আর দেরি করার সময় নেই। গোছগাছ আছে। সারাদিনটা তো এলোমেলো করে কেটে গেল।

তবু যাই তুমি আজ ছিলে, তাই যদি বঠাকুর একটু নিশ্চিন্ত ছিলেন। তুমি চলে যাবে, এই মেয়ে নিয়ে যে কী হবে! ভারী দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেন সেজগিন্নী।

আমি আর কী করতে পারলাম!

ওঁর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অতনু বলে, তবু সন্ধ্যেবেলা এ ঘরে গানটান গাইয়ে কিছুটা সহজ করবার চেষ্টা করছিলাম।

সেই তো!

সেজগিন্নী অমায়িক মুখে বলেন, তুমি যতটা বুঝবে, ততটা কি আর আমরা বুঝব? যাক তাহলে দুধ একটু আনি?

অতনু সম্পূর্ণ অগ্রাহ্যভরে বলে, আনুন, খাওয়ান, যা পারেন করুন। আমার নিজের ওপর কোন আস্থা নেই। দেখছেন না, খাওয়ার নামেই দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুলো। বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে অতনু।

পথে বেরবার মুখে জগন্ময় হতাশভাবে বলেন, চলে যাচ্ছ বাবা?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কোন উন্নতি দেখলে না?

মনে তো হচ্ছে। অতনু ইচ্ছে করেই একটু আশ্বাস দেয়, হয়ে যাবে, দুএকদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তারকে আর জানানো হয়েছিল?

বিকেলে চেম্বারে ফোন করেছিলাম। উনিই ওই কথাই বললেন। ঠিক হয়ে যাবে। বললেন সাময়িক। আর বললেন–।

জগন্ময় একটু ইতস্তত করলেন, তারপর বললেন, ডাক্তারের ধারণা অল্প বয়সে এমন অবস্থা হলে, মেয়েরা একটু বেশি অভিমানী হয়ে যায়। হয়তো হঠাৎ কারও কোনও কথায় আহত হয়েছে, শক খেয়েছে। কিন্তু ওকে তো বাবা কেউ কিছু বলি না। সবাই সব সময় ভাল কথা বলি।

সেটাও সব ক্ষেত্রে ঠিক নয়। অতনু বলে, তাতে মনে হয় সবাই আমায় করুণা করছে। একেবারে স্বাভাবিক ব্যবহার করবেন। ভালর সময় ভাল, বকার সময় বকা

ও কি আমার বকবার মত মেয়ে অতনু? জগন্ময় মেয়েমানুষের মত কেঁদে ফেলে কোঁচার খুঁটে চোখ মোছেন।

মানুষটাকে মমতা করে অতনু। কিন্তু মৌখিক সান্ত্বনা আর জোগায় না, তাই বিষণ্ণ ভাবে বলে, আচ্ছা তবে আসি।

কালই তো চলে যাচ্ছ? গলা ঝেড়ে বলেন জগন্ময়।

না, কাল আর যাওয়া হল কই? প্লেনের ব্যবস্থা করতে পারলাম না।

ধীরে ধীরে চলে যায় অতনু।

সরল মানুষের সঙ্গে মিথ্যা কথা বলতে বিবেকে বড় পীড়া দেয়। সেই কথাই ভাবতে ভাবতে যায়।

.

সবাই ভাবছে। যে যার নিজের রুচি প্রকৃতি ধারণা অনুযায়ী ভাবছে।

অমিতার এই অসুখটা যেন গোলকধাঁধার ঘুরন্তপথে ছেড়ে দিয়েছে সবাইকে।

কিন্তু অমিতা নিজে?

অমিতা কি ভাবতে পারছে? ভাববার ক্ষমতা কি আছে অমিতার?

তা মস্তিষ্ক তো কখনও চিন্তাশূন্য হয় না। সে যদি বিকৃত হয়ে যায় তো, বিকৃত চিন্তাই করে। সেই বিকৃত চিন্তার পথেই ঘুরপাক খেতে থাকে তার অসামাজিক বাসনা।

ওকে আমি যেতে দেবো না। যা ইচ্ছে করে যাওয়া বন্ধ করব। ও থাকুক, আমার কাছাকাছি থাকুক। ওকে না দেখে কী করে ছিলাম আমি? ওকে না দেখে কী করে থাকব!

.

ঘরে ঘরে পাখা আছে, তবু জগন্ময় মাদুর হাতে করে ছাতে উঠলেন। বাড়ির অনেককে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, উঃ কী অসম্ভব গুমোট! ঘরে তো টেকা যাচ্ছে না। ছাতটা আজ ধোওয়া হয়েছিল না?

হ্যাঁ, ছাতটা আজ ধোওয়া হয়েছে বইকি। আলাদা বকশিশ কবুল করে নতুন চাকরকে দিয়ে ধুইয়েছেন জয়াবতী।

দেখি ছাতেই যাই, যদি একটু ঘুম আসে। বলে চলে গেলেন জগন্ময় গলাটা একবার ঝেড়ে।

কিন্তু সত্যিই কি আর ঘুম আসার জন্যে এত ঘটা করে ছাতে ওঠা?

জগন্ময়ের বয়েস পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে, জগন্ময়ের একটা মেয়ে মারা গেছে, একটা মেয়ে শুধু বিধবা হয়েও রেহাই দেয় নি, আবার পাগল হয়ে উঠে বাপ-মার মাথায় বাজ হেনেছে, জগন্ময়ের ছেলে বিয়ে করে প্রেমের পাঠ সুরু করেছে, এ সবই সত্যি, তবু তিরিশ বছরের অভ্যাসটাও বড় বেশি সত্যি।

তিনি চৌকিতে শুয়ে নাক ডাকান, এবং জয়াবতী মেঝের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সংসারের অপর সদস্যদের মধুর সমালোচনা স্বামীর কর্ণকুহরে ঢালবার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বিরক্ত চিত্তে মশা চাপড়ান আর ছারপোকা মারুন তাতে কিছু এসে যায় না তার। চিরঅভ্যস্ত উপস্থিতিটুকুই নেশার মত। তার অভাব ঘটলে কিছুতেই যেন কেমন স্বাচ্ছন্দ্য আসে না।

অমিতার বৈধব্যের পর প্রথম প্রথম কিছুদিন জয়াবতী আপন শয়নমন্দির ছেড়ে ওপাশের ঘরে শয্যা বিছিয়েছিলেন, মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু কিছুদিন পরেই সে ব্যবস্থা বাতিল হয়েছিল। অমিতাই বাতিল করে দিয়েছিল।

বলেছিল, তুমিও নাক ডাকায় বাবার থেকে কম যাও না, আমার ঘুম হয় না। নিজের জায়গায় যাও বাপু, তোমার ঢোলের বাজনা ঢাকের বাদ্যির নীচে ঢাকা পড়বে।

আশ্চর্য, নাক ডাকার মত অসহ্যতম অপবাদেও জয়াবতী রেগে ওঠেন নি, প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন নি। শুধু অপ্রতিভ মুখে বলেছিলেন, শোনো কথা মেয়ের! আমার বলে সারারাত ঘুমই আসে না!

ও বাবা, না আসতেই এই! এলে কী হত! আমার তো ওতেই ঘুম ঘোচে। আমি একাই বেশ শোব।

তাই রেখে কখনো আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি? বলেছিলেন জয়াবতী প্রত্যাশার শ্বাস চেপে।

বেশ তো, সবিতা শোবে আমার ঘরে।

রক্ষে কর! সেজগিন্নীর মেয়ে! সে ব্যবস্থা করলে সেজগিন্নী এখন কত অস্বস্তি করবে কে জানে। তোর সারারাত পাখার হাওয়া খাওয়া অভ্যেস, ওর ছেলেমেয়েদের ঠাণ্ডালাগার ধাত।

ঠিক আছে, খোকন শোবে।

খোকন অমিতার নিজের ভাই, জয়াবতীর সম্পত্তি, তার ওপর জোর চলে। অতএব সেই ব্যবস্থাই বহাল হল। এতদিন তাই চলে আসছিল। কিন্তু আবার যে অমিতা বিরাট এক সমস্যা হয়ে উঠেছে! আর তো অন্য কোন ব্যবস্থাই শোভন নয়। এখন থেকে যেটেরা পূজোর রাতের ঘর আগলানোর মত জেগে বসে আগলাতে হবে অমিতার ঘর। আর সে কাজ কে করবে, মা ছাড়া?

রাত্রে শুতে এসে সেই কথাটাই মনে পড়ল জগন্ময়ের। বুকের ভিতরটা খালি খালি ঠেকল। ঘরের মধ্যে প্রাণ হাঁপিয়ে এল। দেয়ালের কোণ থেকে দাঁড় করানো মাদুরটাকে টেনে উঠলেন ছাতে। আর বেশ শোরগোল করেই উঠলেন। বোধকরি অপ্রতিভতাটাকে ঢাকতে। কেউ কিছু মনে করত না, তবু জগন্ময়ের মনে হল সবাই বুঝি অনেক কিছু মনে করবে।

জয়াবতী মেয়ের ঘরের বড় আলোটা নিভিয়ে মৃদুনীল আলোটা জ্বালালেন, মেঝেয় নিজের বিছানাটা পাতলেন, পাখাটা রেগুলেটারের শেষ অঙ্কে ঠেলে দিলেন, কিন্তু সমস্ত দিনের কর্মক্লান্ত দেহটাকে ঝুপ করে ফেলে দিলেন না, মিনিট দুই ঘুরিয়ে নিয়েই বেড়ালেন এ জানলা থেকে ও জানলায়। তারপর সহসাই ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিথর ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, ছাতে বোধহয় ছিষ্টির কাপড় মেলে দেওয়া আছে। হরি কি আর তুলেছে! যা বাবু হয়েছে আজকাল! যাই দেখি গে, রাতে যদি আবার বৃষ্টি আসে! আমারই হয়েছে যত জ্বালা!

আস্তে আস্তে বাইরে থেকে দরজাটা টেনে ভেজিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে উঠে গেলেন সিঁড়ি বেয়ে। মোটা মানুষ! তবে দিনের বেলায় রোদের সময় সিঁড়ি উঠতে যতটা হাঁপ ধরে, রাতে ততটা নয়।

.

ঘুমোলে নাকি? মাদুরের এক প্রান্তে বসে পড়ে এই অহেতুক প্রশ্নটি করলেন জয়াবতী।

কৃতাৰ্থমন্য জগন্ময় ব্যস্তে পা গুটিয়ে নিয়ে উঠে বসলেন। চুপি চুপি বললেন, কাকে রেখে এলে?

রাখব আর কাকে? জয়াবতী আঁচল তুলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ঘুমের ওষুধ খেয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছ। মনে হল সন্ধ্যেবেলা বুঝি ছাতের কাপড় তোলা হয়নি। রাতে যদি বৃষ্টি ঢালে! তা দেখছি হরিবাবু তুলেছেন দয়া করে।

না, এ বয়সে সত্যি কথাকে স্বীকার করা যায় না। পরস্পরের কাছেও নয়। বলা যায় না তোমার জন্যেই এলাম। তোমার কথা ভেবেই এলাম।

অতএব সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।

কেউ কিছু বলবে না তো?

প্রায় তিরিশ বছর আগের শঙ্কিত বুক নিয়েই বললেন জগন্ময়।

বলবে আবার কি! জয়াবতী শঙ্কাকে অস্বীকার করার ভঙ্গিতে বলেন, মার চেয়ে দরদী, তারে বলে ডান! এই যে হল, এ কার গেল?

জগন্ময় করুণস্বরে বললেন, গেল বলছ কেন? ডাক্তার তো বলেছে–ও কিছু না, দুচার দিনের মধ্যে সেরে যাবে।

লোকের হলে সারতো। আমার ভাগ্যে নয়। কপালখানি তো দেখছি! কী যে করব আমি ওই মেয়ে নিয়ে! একে তো শত্ৰুপুরীর মধ্যে বাস!

শত্ৰুপুরী আবার কি?

একটু অসন্তোষ প্রকাশ করলেন জগন্ময়।

তুমি আর কী জানবে? পুরুষমানুষ বাইরে বাইরে থাক। কাল অতনুকে একটু ডেকেছিলাম, তাতেই আজ সংসারে কত কথা! তোমার বড়দি তো আমাকে মিঠে মিঠে করে একশো কথা শোনালেন।

তুমি একথা বলতে পারলে না, অতনু ডাক্তার! রোগ বিপদের সময় লোকে ডাক্তারের বয়েস দেখবে?

বলতে কি আর ছেড়েছি? বলেছি সবই। তবু সেজগিন্নীতে আর ওঁতে চোখ ঠারাঠারি হয়ে গেল। আর ওই বামুন মেয়েটিও কম নয়। ওটিও একটি দেইজি।

বিদেয় করে দিও। বলে কর্তার কর্ম সমাপন করেন জগন্ময়।

জয়াবতী অসন্তুষ্ট স্বরে বলেন, তোমার আর কি, বলে খালাস। ম্যাও সামলায় কে?

আহা তা বলে মাইনে করা লোক।

মাইনে করা লোকের দৌরাত্ম্যি তো চব্বিশ ঘণ্টাই সইতে হচ্ছে। আমার মুখ চাইতে মেয়েটা ছিল, তাও ভগবান মারলেন। তা হ্যাঁ গো, ডাক্তার ঠিক কি বললেন বল দিকি? ওই জিজ্ঞেস করতেই আরও তোমার কাছে আসা। কোনখানে তো একদণ্ড নিরিবিলি নেই।

আবেগের মুখে ছাতের কাপড়ের অজুহাতটা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হন জয়াবতী।

জগন্ময় অবশ্য মনে পড়িয়ে দিয়ে লজ্জায় ফেলেন না। শুধু বলেন, ওই তো তখন বললাম। বলেছেন সেরে যাবে।

সেরে যাবে বললেই সব হল? কবে সারবে তা কিছু বলবে তো?

তা কি আর সঠিক বলা যায়?

তবে আর কিসের ডাক্তার? বলছিলাম মহারাজজীকে একবার জানানো হোক।

জগন্ময় নীরস স্বরে বলেন, ওঁকে আর জানিয়ে কী হবে? এখন ওঁর অনেক বড় বড় শিষ্য হয়েছে, হাইকোর্টের জজ পায়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে, যত সব আগরওয়ালা ঝুনঝুনওয়ালারা সোনার খড়ম, রূপোর সিংহাসন গড়িয়ে দিচ্ছে, আমাদের মতন চুনোখুঁটিদের কথায় কি আর মন দেবার অবকাশ আছে?

কথাটা জয়াবতীরও মনের কথা। তবে কি না জগন্ময়ের মত স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করতে সাহস হয় না তার। ইতস্তত করে বলেন, বড়দি একটা কবচের কথা বলছিলেন, আমার কিন্তু বাপু সাহস হয় না।

কেন, এতে আর সাহসের কী আছে?

কি জানি কার মনে কি আছে, হিতে বিপরীত হবে কিনা! অমির বিয়েতে বড়দিই তো ওঁদের জ্যোতিষী দিয়ে কুষ্ঠি মিলিয়ে দিয়েছিলেন! বলেছিলেন রাজঘোটক হয়েছে।

সত্যটা নির্ভেজাল।

জগন্ময় গভীর নিঃশ্বাসের সঙ্গে বলেন, সবই আমাদের ভাগ্য!

তা ছাড়া আর কি! এখন ভাবছি তখন যদি অতনুর সঙ্গেই দিতাম!

আর ও কথায় কাজ কি?

কাজ না থাকলেও সে কথা লোকে বলে। পশ্চাত্তাপ করাই মানুষের রীতি। তাই জয়াবতী বলেন, মেয়ের মন তো আমি বুঝতাম। বলিনি তোমাদের কাছে, কিন্তু সাতপাঁচ ভেবেছিলাম অনেকবার, কিন্তু ওই যে কেমন মনে হল নেহাৎ পাড়াপড়শীর মধ্যে, আজন্ম দেখাশোনা, লোকে বলবে লভের বিয়ে, তাতেই মন সায় দিল না। তাছাড়া তখন আর কে ভেবেছে বিদেশে চলে যাবে, অমন চাকরি পাবে! এখানে তো ওই, না চাল না চুলো। গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলেন জয়াবতী।

জগন্ময়ও সে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মেশান। বলেন, তুমি না বলল, ধরতে কি আর আমিই পারতাম না? তবে ওই যা বললে, একেবারে ঘরের ছেলের মত! আর ওর চেয়ে দশগুণ ভাল পাত্র পেয়েও গেলাম। আমাদের দুর্ভাগ্যে ওরকম হয়ে গেল তাই। নইলে বীরেশ্বর বেঁচে থাকলে কি আর আজ অতনুকে পুঁছতে অমি?

কি জানি! মেয়েমানুষের মন জয়াবতী নিজেও যে মেয়েমানুষ-জাতীয়া সে কথা বিস্মৃত হয়ে বলেন, স্বর্গ ছেড়ে পাতাল চায়। তা সেও তো রইল না। সেই তখনই যদি কথাও তো হয়েছিল– বিয়ে কথাটা আর উচ্চারণ করেন না জয়াবতী, ওটা এড়িয়েই বলেন, তখন হয়তো অতনুকে বললে রাজী হয়ে যেত!

তা হত! জগন্ময় সায় দেন, ইয়ংম্যান ওরা তো আর প্রেজুডিসের ধার ধারে না। তা ছাড়া মেয়েটাকে স্নেহও করত।

তা হ্যাঁগা এইবার আসল কথা পাড়েন জয়াবতী, এখন আর হয় না?

এখন? জগন্ময় ক্ষুব্ধ হাস্যে বলেন, তুমিও কি মেয়ের সঙ্গে পাগল হলে? এখন ওকথা বলব কোন্ মুখে? ও এখন একটা অত বড় অফিসার, কত ভাল ভাল পাত্রীর বাবা ছুটে আসবে, এখন আমি বলব, তুমি আমার পাগল ছাগল বিধবা মেয়েটাকে বিয়ে কর!

যুক্তিটা অকাট্য। জয়াবতী চুপ করে যান।

হ্যাঁ, এই ভাবেই মানুষ অপরের মনের হিসেবনিকেশ করে নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছয়। তাছাড়া

আর করবেই বা কি! নিজের বুদ্ধির পরিধি ছাড়িয়ে কে কবে ভাবতে পারে?

তবু জয়াবতী একটু চুপ করে থেকে বলেন, তা সেই অবধি তো বিয়েও করল না।

করল না ওর দাদা বৌদির চেষ্টা নেই বলে। আর বাংলা দেশের বাইরে অনেকদূর চলে গেছে!

আরও খানিক ইতস্তত করে জয়াবতী বলেন, আমি ভাবছিলাম চুপি চুপি একবার বলে দেখব।

ক্ষেপেছ! অমন কাজও কোর না। জগন্ময় হাঁ হাঁ করে ওঠেন, কী ভাববে তোমায়? তাছাড়া কালই তো চলে যাচ্ছে।

যাচ্ছে বলেই তো! জয়াবতী বলেন, যাওয়াটা আটকাতাম।

না না, ওসব করতে যেও না। কার কান থেকে কার কানে যাবে। লোকে হাসবে। শুধু একটা কেলেঙ্কারী! অতনুর যদি তেমন ইয়ে হত, নিজেও তো সে প্রস্তাব করতে পারত? অমি বিধবা হবার খবর পেয়ে একটা চিঠিও তো দেয় নি। ও বাড়ি থেকে খবর কি আর পায় নি?

এ যুক্তিটাও অকাট্য।

জয়াবতী নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, মনকে মানিয়ে নিয়ে ঘরসংসারে মন ঢেলে শান্ত হয়ে ছিল সে এক! এখন ওই ভয়ঙ্করকে অহরহ কী করে চোখের ওপর সইব? আর কি করেই বা সামলে বেড়াব?

ভাগ্য! যাও শুয়ে পড়গে। আবার জেগে উঠে কিছু করে বসবে।

আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরবো, তুমি ভুগো মেয়ে নিয়ে। বলে কাদো কাঁদো হয়ে উঠে দাঁড়ান জয়াবতী।

জগন্ময় অনুনয়ের ভঙ্গিতে একটা হাত বাড়িয়ে হাত ধরে বসান। বলেন, অবুঝ হয়ে আর কি করবে? দেখ ডাক্তার তো বলছে ভাল হয়ে যাবে।

আমার কপালে আর হচ্ছে!

মন খারাপ কোর না। একটু বরং এখানে হাওয়ায় গড়িয়ে নিয়ে যাও।

নাঃ! বলে একরকম অভিমানভরেই ধপ ধপ্ করতে করতে নেমে যান জয়াবতী। দোষ ভাগ্যের, জগন্ময়ের উপর অভিমানের কারণ থাকার কথা নয়। কিন্তু বাঙালীর মেয়ে স্বামীকে ভাগ্য ভগবান সব কিছুর প্রতীক ভাবতেই অভ্যস্ত। তাই নিঃসঙ্কোচে দায় দোষ সবই সেই বেচারার ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হয়।

কিন্তু আজ যদি জয়াবতী সেই তাঁর ভগবানের প্রতাঁকের কাছে পরামর্শ নিতে না আসতেন! যদি নিজের বুদ্ধিতে চুপিচুপি অতনুর কাছে বলতেন, বাবা অতনু, অমিতা তোমার ছেলেবেলার খেলার সঙ্গী, তোমার স্নেহের পাত্রী

তা হলে কি এ কাহিনীর ইতিহাস আলাদা হত না? কিন্তু জয়াবতী জগন্ময়ের পরামর্শ নিলেন–বুদ্ধি বিবেচনার পরিধি যাঁর বারো বছরের ছেলেটার থেকে খুব বেশি নয়।

.

কয়েকখানা বাড়ি পরেই আর একটা ছাতে শতরঞ্চ বিছিয়ে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে জেগে পড়ে ছিল এ কাহিনীর নায়ক। এঁদের আলোচনার ছন্দাংশও তার কানে গেল না।

বাতাসের তরঙ্গে তরঙ্গে নাকি জগতের সব শব্দই অক্ষয় হয়ে থাকে, কোথাও হারায় না। শুধু উপযুক্ত যত্ন থাকলেই ধরে ফেলা যায় সে শব্দকে। কোথাও কোনখানে যদি বসানো থাকত সে যন্ত্র! তাহলে কি পরদিন–

হ্যাঁ, পরদিনের কথাই ভাবছিল অতনু।

চলে যেতে হবে।

চলে যাওয়া ছাড়া উপায় কি? থেকেই বা কি করবে?

স্নেহ দিয়ে সেবা দিয়ে ভালবাসা দিয়ে ওকে কি সুস্থ করে তুলতে পারবে অতনু? সে অধিকার কি আছে ওর?

না, অধিকার না থাকলে কোন মহৎ কর্মও করা যায় না।

.

গত রাত্রে ফুলশয্যা তো না হওয়াই। আজ তবু ওরই মধ্যে একটু সকাল সকাল বরকনে ঘর পেয়েছে। আজ সবিতা তার প্রায় সমবয়সী দাদাকে একটু ঠাট্টাও করে গেছে। আর আজ বহিরাগতরা অনেকেই চলে গেছেন বলে বাড়িটাও কিঞ্চিৎ হালকা লাগছে।

তবু প্রথম মিলনোচ্ছ্বাসটা কেটে গেলে, কথায় কথায় সেই ভারী প্রসঙ্গটাই এসে পড়ে। যে ভয়ঙ্কর ভারে কাল থেকে বাড়িখানা হাঁপিয়ে উঠেছে।

গানের সময় ছোড়দি কিন্তু খুব শান্ত হয়েছিল তাই না?

রমলা দুষ্টুমী করে বলে, তা ছিলেন, কিন্তু ছোড়দির ভাই ভ্যাবাগঙ্গার মত যা হাঁ করে গান শুনছিল, দেখে হাসি চাপা দায় হচ্ছিল।

তার মানে? আমি ভ্যাবাগঙ্গার মত বসেছিলাম?

তবে না তো কি? ক্যামেরা থাকলে ফটো তুলে রাখা যেত।

কিন্তু সত্যি, ছোড়দির ওপর তোমার গান খুব প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। কী চুপ করেই

তোমার ধারণা গানের প্রভাবে? রমলা বলে।

তবে?

সাধে বলি গবেট! প্রভাবের উৎস আলাদা, বুঝলে?

না না, তুমি যা ভাবছ, মোটেই তা নয়।

নয় মানে? মেয়েদের চোখ কখনো ভুল করে না, বুঝলে? তোমার অতনুদা এবং ছোড়দির মধ্যে রীতিমত একটি গভীর ভালবাসা ছিল।

ছিল সামথিং, তবে গভীর টভীর কিছু নয়।

নয়, তোমায় বলেছিলেন?

আহা বলবার কি আছে? এই তো বিয়ের আগে যখন অতনুদার নামে নেমন্তন্ন চিঠি পাঠানো হল, ছোড়দি ছিল তো কাছেই, কোন চাঞ্চল্য দেখি নি। তা ছাড়া কাল যখন অতনুদার আসার খবর দিলাম, গ্রাহ্যই করল না ছোড়দি।

সাধে বলি জান না! গভীর সমুদ্রই ওপরে শান্ত, বুঝলে? কিন্তু তরঙ্গ যখন ওঠে, তখন জাহাজ ডোবায়, পাহাড় ভাসায়।

এই বয়সে এত কথা শিখলে কি করে?

মেয়েদের আবার কথা শেখবার জন্যে বয়েস বাড়বার দরকার হয় নাকি?

উঃ বাড়িসুদ্ধ লোক এই বৌকে বলছে, কী শান্ত, কী ঠাণ্ডা, কী ভালমানুষ!

শান্ত ঠাণ্ডা বলে বুদ্ধি থাকবে না?

কিন্তু বুদ্ধির জোরে যতটা ভাবছ, ঠিক তা নয়। ডাক্তার তো বলে গেল, এ রকম ক্ষেত্রে হঠাৎ এক একজনের ওপর ঝোঁক হয়।

যা শুনতে ভাল, ডাক্তাররা তাই বলে।

বাঃ তুমি একদিন দেখেই যে অনেক কিছু আবিষ্কার করছ? আমি দেখছি না চিরকাল?

চিরকাল মানে তো তোমার বারো বছর বয়েস অবধি? বললে না, অতনুদা যখন চলে গেছলেন তখন তোমার বয়েস মাত্র তেরো?

তেরো নয় মোটেই, চৌদ্দ।

রমলা হেসে ওঠে, উঃ একেবারে আকাশ পাতাল তফাৎ। একটা চৌদ্দ বছরের ছেলে! মানে হাফপ্যান্ট পরা খোকা। তার ওপর আবার তোমার মত গবেট। তোমার চোখে ধুলো দিয়ে কত রহস্য পার হয়ে যেত, সে এখন আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।

তা পাবে বইকি। চক্ষু দুটি দিব্য কিনা! অতনুদা তো এসে বেশির ভাগই বাইরের ঘরে বাবার সঙ্গে কি কাকাদের সঙ্গে কথা বলে চলে যেতেন।

হু, তার মানে বাবার সঙ্গে বা কাকাদের সঙ্গে কথা বলবার জন্যে ওঁর প্রাণ অস্থির হয়ে উঠত, তাই ছুটে আসতেন কি বল?

বাঃ তার কি মনে আছে? বরাবর এসেছেন ছেলেবেলা থেকে

ও যুক্তি অচল! এ বাড়ি ওঁকে দুর্নিবার আকর্ষণে টানতো, বুঝেছ?

ক্রমশ সবই বুঝছি। মানে যে ভাবে বোঝাতে সুরু করেছ তুমি! তবে হ্যাঁ, আমি তো একেবারে অস্বীকার করছি না। হাঁদাই হই আর খোকাই হই, একেবারেই যে কিছু বুঝতাম না তা নয়। তবে কিনা তোমার ওই গভীর টভীর? কই? হয়তো অতনুদা চলে যাবার সময় ছোড়দিকে দেখতে পেল, বলে উঠল ইস, তুমি যে রীতিমত একটি মহিলা হয়ে উঠেছ। আর দেখাই পাওয়া যায় না।

রমলা উঠে বসে বলে, আর উত্তরটা?

না না, অমন ধড়ফড়িয়ে উঠে বসবার মত কিছু নয়। ও রকম কথায় ছোড়দি হয়তো বলতো, বাঃ বাড়িতেই তো থাকি। যখন কলেজে যাই তখন আসো তা হলে?

এই? শুধু এই?

তবে আবার কি।

আর তোমাকে দিয়ে কখনো কিছু বলে পাঠাতেন না?

আমাকে দিয়ে? আমাকে দিয়ে কেন?

তোমার মত হাঁদা মার্কাদের দিয়েই ওই রকম কাজ করানো যায় কিনা!

দীপক একটু চুপ করে থেকে বলে, আমাকে দিয়ে? নাঃ তা কোনদিন নয়। যদি বললে, তবে একদিনের কথা মনে আছে। যেদিন আমারও একটু খটকা লেগেছিল।

শুনি শুনি। দেখি তোমার বুদ্ধির বহর।

এমন কিছুই না। তবু–মানে আর কি, সেদিন বিকেলে পার্কে যাচ্ছি খেলতে, দেখি অতনুদা ওই মোড়ের বাস স্টপেজের কাছে দাঁড়িয়ে। বললাম, কি অতনুদা, কলেজ থেকে ফিরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন যে? বাড়ি যাবেন না?

অতনুদা ব্যস্ত হয়ে বললেন, না রে, ভীষণ একটা কাজ ভুলে গেছি তাই।

আমি তো হেসেই উঠেছি।

কাজ ভুলে গেছেন তো বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? রাস্তায় কি কাজ?

অতনুদা খুব চঞ্চল হয়ে উঠে বললেন, না রে, মানে খুব দরকারি একটা নোট কলেজে ফেলে এসেছি, আবার যেতে হবে।

ওঁর কলেজ মানে তো মেডিক্যাল কলেজ! আমি হায় হায় করে বলে উঠলাম, আহা ইস! আবার অতটা যেতে হবে আপনাকে? তা অতনুদা সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, তুই কোথায় যাচ্ছিলি?

বললাম খেলতে।

অতনুদা হঠাৎ ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে বললেন, তবে যা, বিকেলবেলাই হচ্ছে আসল খেলবার সময়, এ সময়টা নষ্ট করতে নেই। এই যে আমার গাড়ি এসে গেছে, বলেই একটা বাসে উঠে বসলেন, যে বাসটা সম্পূর্ণ উল্টোমুখো। ওই বাসে কলেজ! আমি তো অবাক।

কি জানি হঠাৎ আমার কেমন সন্দেহ হল, ওই দরকারি নোট ফোট সব বানানো কথা! অন্য কোন ব্যাপার। তাই পার্কের দিকে যেতে যেতেও আমি ফিরে ফিরে তাকাতে লাগলাম। আর দেখলাম ঠিক যা ভেবেছি! আমি সরে আসতেই সবে ছাড়া চলন্ত বাস থেকে নেমে পড়লেন অতনুদা।

তবে কি ভুলে ভুল বাসে উঠে পড়েছিলেন? ভাবলাম দাঁড়িয়ে। ওই যে মোড়ের কাছে স্টেশনারি দোকানটা আছে, যেখান থেকে আমি ঘুড়ি আর মার্বেল কিনতাম, সেই দোকানটার মধ্যে ঢুকে দাঁড়ালাম। আর দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দেখি ছোড়দি নামল ছোড়দির বাস থেকে। আর যেন আলো জ্বলে উঠল ছোড়দির মুখে।

হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখলাম, কোথায় বা অতনুদার দরকারি নোট, কোথায় বা কি! দুজনে দিব্যি গল্প করতে করতে চলে গেল বাড়ি থেকে উল্টো দিকে।

রমলা হেসে বলে, ইস কে বলছিল তোমাকে বোকা! গোয়েন্দাগিরি পর্যন্ত করেছ?

না সত্যি, কি রকম যেন গোলকধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম সে দিন। ভাবলাম এটা কি হল! খেলতে মন লাগল না, একটু পরেই বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি এসে দেখি মা ব্যস্ত হয়ে এ ঘর ও ঘর করছেন, অমিতা এখনো কলেজ থেকে ফেরে নি বলে। একবার ভাবলাম বলে দিই। বলে দিই–ছোড়দির আসার কথা। কিন্তু কেমন যেন পারলাম না। মুখে আটকে গেল। মনে হল মা আমাকেই খুব বকবেন। তার একটু পরেই ছোড়দি এল, আর তার কথা শুনে আমি একেবারে আকাশ থেকে আছাড় খেলাম। মা যেই বললেন, আজ এত দেরি কেন রে অমি? ছোড়দি অম্লান মুখে বলল, কলেজের লাইব্রেরীতে বই পড়ছিলাম মা!

সন্ধ্যেবেলা আমি ছোড়দিকে ধরলাম। হারে ছোড়দি, তুই মার সঙ্গে মিছে কথা বললি যে? ছোড়দি কপাল কুঁচকে বলল, মিছে কথা আবার কখন বললাম? আমি তখনকার কথা তুললাম। বললাম, তুই তো কলেজ লাইব্রেরীতে ছিলি না? ঠিক সময়ই তো এসেছিলি। অতনুদার সঙ্গে গল্প করতে করতে ওদিকে চলে গেলি। তবে কেন

ছোড়দি গম্ভীরভাবে বলল, সব কথা বড়দের বলতে হয় না। সব কথা ছোটদের শুনতে হয় না।

ছোড়দির ওরকম গম্ভীর মুখ বড় কখনো দেখি নি। তাই আর কিছু বলতে সাহস করলাম না। এই মাত্র একটা দিন। আর কখনো কোনদিন ওদের দুজনকে দাঁড়িয়ে একটু বেশিক্ষণ কথা বলতেও দেখিনি।

ওই একদিনেই তো সব দেখা হয়ে গেল। রমলা গম্ভীরভাবে বলে, ওঁরা কেন যে নিজেদের ভালবাসাকে প্রকাশ করলেন না, এ একটা অদ্ভুত রহস্য। নেহাৎ তো আর দেবদাস পার্বতীর যুগ নয়!

সেই জন্যেই তো বলছি, খুব একটা কিছু হলে–

মানুষ অনেক সময় নিজেকে চিনতে পারে না, বুঝতে পারে না নিজের মনকে। না বুঝে আগে জীবনকে অবহেলা করে ওড়ায়, তারপর সেই জীবনের জন্যে পাগল হয়।

দীপক অবাক হয়ে ভাবে, আশ্চর্য, এত কথা কি করে জানল রমলা? ভাবল, ছোড়দি সহজ থাকলে বৌ দেখে কত খুসি হত! আর রমলাও ছোড়দিকে দেখে! তার ভাগ্যটাই খারাপ, তাই ছোড়দিকে রমলার সামনে মেলে ধরতে পারল না।

দীপক বোকা, দীপক গবেট কিন্তু দীপকের দিদি? দীপকের সেই দিদিকে রমলা কী মূর্তিতেই দেখল!

এ কথাও মনে হল দীপকের, আজ ছোড়দি এমন করে নিজেকে ছড়িয়ে ফেলল তাই রমলার সাধ্য হচ্ছে তার জীবনের নিভৃতে সন্দেহের সার্চলাইট ফেলবার, সাহস হচ্ছে তার প্রেম নিয়ে আলোচনা করবার। এমন না হলে রমলা ছোড়দিকে সমীহ করত, শ্রদ্ধা করত, হয়তো বা ভয়ও করত।

ছোড়দিকে যদি ভাল অবস্থায় দেখতে! নিঃশ্বাস ফেলল দীপক।

নিঃশ্বাস ফেলল রমলাও, আমার ভাগ্য! লোকে হয়তো আমাকেই অপয়া বলে নিন্দে করবে।

তোমায় নিন্দে করতে যাবে কেন? তোমার কি দোষ?

এ সংসারে আমার আবির্ভাব অশুভ।

এর পর আর ছোড়দির প্রসঙ্গ আশ্রয় পায় না, ভেসে যায় আদরের বন্যায়, আবেগের বন্যায়। দীপকের আদরিণী প্রিয়া নিঃশ্বাস ফেলবে!

অনেকক্ষণ পরে রমলা বলে, বিধবা বিয়েটা তো এখন আর নিন্দের নয়।

দীপক গম্ভীর ভাবে বলে, বিদ্যাসাগরের আমল থেকে। অন্তত বেআইনি তো নয়ই তখন থেকে।

গার্জেনরা ইচ্ছে করলেই, অথবা ওঁরা নিজেরা সাহস করলেই, এই মর্মান্তিক অবস্থার অবসান হতে পারে।

আর ওঁরা! দীপক নিঃশ্বাস ফেলে, ছোড়দি কি আর মানুষ রইল?

রমলা এ কথার উত্তর দিতে পারে না। ভাবে, তা সত্যি।

.

রাত্রিশেষের কোমল আলো ঘরে এসে ছড়িয়ে পড়ে, মধুর জাগরণে ক্লিষ্ট দুটি তরুণ তরুণী সচকিত হয়ে বলে, এ কী, ভোর হয়ে এল নাকি?

তাই তো দেখা যাচ্ছে। ইস ঘুমোও, ঘুমিয়ে নাও একটু।

কোথা দিয়ে যে রাতটা কেটে গেল!

সত্যি কী এত গল্প করলাম! শুধু তো সেই

কথা শেষ হবার আগে সচকিত হয়ে উঠল ওরা ঠিক কালকের মত সেই তীব্র তীক্ষ্ণ ভাঙা গলার করুণ কান্নায়। যে কান্না শুনে ঘরে ঘরে দরজা খুলে গিয়েছিল।

কিন্তু আজকের কান্নার বিষয়বস্তু বদলেছে না?

তীব্র করুণ সুরটা এই কথাই না বলছে-আমার মা কোথায় গেল গো! আমার মা! আমার মা মরে গেছে।

জয়াবতীর তৃষিত হৃদয় বুঝি সুধার সাগরে ডুবে যায়, লজ্জিত লাঞ্ছিত প্রাণ গৌরবের আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

দেখুক! দেখুক এইবার সত্যই মেয়ের তার কালকের সেই পরপুরুষের জন্য ব্যাকুলতা নিতান্তই পাগলামী কি না। আজ সে কথা ভুলে গেছে সে। হয়তো অতনু যে কে, একথা জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না। বলবে–জানি না, চিনি না, আমি কি করে জানব?

প্রথম ডাকেই জেগে উঠেছিলেন জয়াবতী, কিন্তু সাড়া দেন নি। থাক আরও ডাকুক। অমিতার মা মা সকলের কানে যাক। শুনুক সবাই, দেখুক অমিতা সত্যি উন্মাদ হয়ে গেছে কিনা।

হ্যাঁ দেখল সবাই।

অমিতা তার মার হাতটা চেপে ধরে বলছে আমার মা মরে গেছে।

অমিতা, অমিতা রে, এই তো আমি। এই তো তোর সামনে বসে রয়েছি, এই তো তোর হাত দিয়ে আমার হাত ধরা।

অমিতা বোজা চোখ খুলে পাগলের হাসি হেসে বলে, আছে? আমার মা আছে?

জগন্ময় কাছে আসেন, এই যে মা, আমিও রয়েছি। আমরা সবাই রয়েছি।

অমিতা কান্না থামিয়ে বলে, তবে কেন ওরা বলল, তোর মা নেই, তোর মা মরে গেছে।

ওরা কারা অমিতা?

ওই যে কালো কালো বিচ্ছিরি লোকগুলো!

বিভীষিকা দেখেছে! বিভীষিকা!

বড়পিসিমা নীচু গলায় ছোট ভাজকে বলেন, পাগলের মাথার মধ্যে যে নরকের বিভীষিকা চলে। যমদূত এসে ডাঙস মারে, তপ্ত তেলে ফেলবার ভয় দেখায়, বলে তোর কেউ নেই, সবাই মরে গেছে।

তাই নাকি? নন্দাও নীচু গলায় বলে, কে বললে? কী করে জানলেন?

ওমা, শোন কথা! এর আবার বলাবলির কি আছে? চিরকেলে জানা কথা।

অগত্যাই নন্দাকে চুপ করে যেতে হয়। সত্যিই তো। চিরকেলে জানা কথা, চিরকালীনরা তো জানবেই।

জগন্ময় সকলের অলক্ষ্যে জয়াবতীকে বলেন, রাত্তিরে টের পেয়েছিল নাকি?

জয়াবতীও সকলের অলক্ষ্যে বলেন, না না, আমি তো ছাত থেকে নেমে এসে দেখলাম অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

আশ্বস্ত হন জগন্ময়।

আজ অমিতার মা বাপকে আশ্বস্ত করার পালা।

আজ আর তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে নি নতুন বরকনে, বেরিয়েছে একটু ধীরেসুস্থে একটু সময় দিয়ে, তার পর এসে ভিড়ে মিশে গেছে।

জয়াবতী ডাকেন, আয় দীপু কাছে আয়, ছোড়দির কাছে বোস।

হয়তো এই ডাকের মধ্যে শুধুই কন্যাস্নেহ বিগলিত হয়ে নেই, আরও কিছু রহস্য প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। হয়তো নতুন বৌকে সমঝে দিতে চান জয়াবতী, আমার এই ছেলেটি কেবলমাত্র তোমার সম্পত্তি নয়। সকলের ভাগ আছে। আমার দাবী আছে।

দীপক এসে খাটের ধারে দাঁড়ায়।

অমিতা চেয়ে দেখ, দীপু তোর কাছে এসেছে।

হঠাৎ অমিতা মাকে অবাক করে দিয়ে হি হি করে হেসে বলে, আহা কী আশ্চয্যি কথাই বললে! দীপু আমার কাছে আসে না?

তবে কি অমিতা স্বাভাবিক হচ্ছে? কেটে যাচ্ছে হিস্টিরিয়ার কে? জয়াবতী কি সত্যনারায়ণের শিন্নি মানবেন?

বড় ননদের দিকে সরে আসেন জয়াবতী, কাল থেকে তো জ্ঞানে নেই, ঘোরে আছে। দেব দৈব কিছু করলে হত না ঠাকুরঝি?

ননদ সুযোগ ছাড়েন না।

উদাস মুখে বলেন, সে তো আমি সাতবার বলাবলি করছি। কিন্তু তোমাদের বিশ্বাস আছে কি নেই, তাই ভেকে গুটিয়ে আছি।

না না, তুমি যা করবে তাই হবে। আমার অপেক্ষা করবার কি আছে? কপালে একটা টাকা ছুঁইয়ে রাখবো? কালকের থেকে একটু যেন ভাল মনে হচ্ছে

কথা শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা হয় না, একটু যেন ভাল মনে হওয়া রুগী শুধু সায়া আর ব্লাউস পরে পরনের শাড়ীখানা পায়ের তলায় লুটোতে লুটোতে খাট থেকে নেমে দালান ডিঙিয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটতে থাকে।

কি হল?

কি হল মা?

অমিতা বলে, বিলেত থেকে আমার বর আসছে যে এরোপ্লেন চড়ে, দেখতে যাব না?

.

হিরণয় চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে চা পরিবেশনকারিণীর দিকে তাকিয়ে তিক্ত স্বরে বলে, কী মনে হচ্ছে? সাজা পাগল?

মনে যাই হোক, মুখে অপ্রতিভের বিনয় টেনে এনে সেজগিন্নী বলেন, ক্রমশ তো পাকাপাকিই হয়ে উঠছে দেখছি।

না বুঝে সুঝে কারও সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করা ঠিক নয়।

কারুর কাছেই মন্তব্য করতে যাইনি আমি, শুধু তোমার কাছেই

আমার কাছেও মনের সঙ্কীর্ণতা প্রকাশ করা উচিত নয়।

আচ্ছা মনে রাখবো। খেয়াল ছিল না যে আমি এক মহাপুরুষের ঘর করছি।

বিজয় স্ত্রীকে ডেকে বলে, আজ আর অতনু অতনু করছে না, না?

লক্ষ্য করি নি। করছে না বোধহয়।

লক্ষ্য না করবার কি আছে? সকাল থেকে মা মা করছে। তখন হঠাৎ বীরেশ্বরের নাম করল।

তার মানে পাগলের শোভনতা-জ্ঞান ফিরেছে। অথবা এ একটা রঙের তুরুপ। অনেকগুলো পিট কুড়িয়ে নেওয়া গেল।

এ কথার অর্থ?

কিছু না। আমার কথার আবার অর্থ! দাড়ি কামাও গে, বেলা হয়ে গেছে। আজ তো আর ছুটি নেই!

কথাটা সত্যি, বাড়িতে বিয়ে বাবদ দুদিন ছুটি নিয়েছিলেন কর্তারা, আজ অফিস।

.

তোমার অফিস যাওয়া হবে না। জয়াবতী তীব্রস্বরে রায় দেন।

জগন্ময় মাথা চুলকে আমতা আমতা করেন। বড় আশা করছিলেন বাড়ির এই দমবন্ধকারী জটিল জাল থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়বেন যেখানে খোলা হাওয়া, যেখানে জীবনের আরাম।

বললেন, আজ একবার না গেলে–আমার তো আবার ওদিকেও দুদিন কামাই হয়েছে।

হোক! আমি একা ওই উন্মাদ মেয়ে নিয়ে মরবো নাকি?

আহা বাড়িতে তো সবাই রয়েছে।

সবাই তো আমার কতই ছাতা দিয়ে মাথা রক্ষা করছে!

একবার না হয় দেখা দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসব।

যা খুশি করো। চিরদিনই তো দেখলাম, সকল জ্বালা আমার।

এত অল্পের উপর দিয়ে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে তা আশা করেন নি জগন্ময়। পুলক গোপন করে তাড়াতাড়ি নেয়ে খেয়ে নেন। অফিস টাইমের ঘণ্টাখানেক আগে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু পথে বেরিয়ে কি মনে হয় কে জানে, গুটি গুটি অতনুদের বাড়ির দিকে এগোন।

অতনুর দাদা অবনী ব্যস্ত হয়ে বলে, কাকাবাবু যে! কেমন আছে অমিতা?

জগন্ময় বোধকরি নিজের অফিস বেরোনোর সমর্থনেই তাড়াতাড়ি বলেন, একটু ভালর দিকে বলেই তো মনে হচ্ছে। সেই ভরসায় বেরোচ্ছি একবার। অনেক কামাই হয়ে গেছে। বিজু, হিরণ, এদের কারুরই তো থাকবার জো নেই, কামাই হয়েছে দুতিন দিন। দীপু থাকবে অবিশ্যি, তা সে তো তেমন ইয়ে নয়। তাই অতনুকে বলে যেতে এসেছিলাম, একবার যেন খোঁজ নেয়। যতই হোক সে ডাক্তার মানুষ, একটা ভরসা। আজ আছে তো?

হ্যাঁ আছে। আজ সারা দিনটা আছে। রাত্রের গাড়িতে যাবে। প্লেনের টিকিট তো পায় নি বলছে।

বাড়ি নেই বুঝি? ইতস্তত প্রশ্ন করেন জগন্ময়। মুখোমুখি বলে যেতে পারলেই যেন ভাল ছিল। অবনী গ্রাহ্য করে বলবে কি না কে জানে।

অবনী বলে ওঠে, বাড়ি আছে। ঘুমোচ্ছ এখন।

ঘুমোচ্ছে এখনও?

তাই তো দেখছি। সারারাত ছাতে পড়েছিল, সকালবেলা ঘরে এসে ঘুমোচ্ছে।

আচ্ছা থাক। উঠলে মনে করে একটু বোলো বাবা। তোমাদের কাকীমাও তাহলে একটু ভরসা পান।

নির্বোধ জগন্ময় নিজের পথ সরল করতে, যে কুমীর অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, আবার তাকে ডেকে নিয়ে আসেন খাল কেটে।

.

হ্যাঁ, সমস্ত রাত ছাতে পড়ে ছিল অতনু।

আর ভাবছিল, জীবনটাকে নিয়ে আর একবার চেষ্টা করা যায় না? এ যুগে এত সাহস, এত দুঃসাহস, অতনু পারে না একবার সাহস করে প্রস্তাব করতে? বলতে পারে না, তোমরা তো জিনিসটাকে রাখতে পারলে না, হাত থেকে ফেলে ভেঙে ফেললে! ওই ভাঙা টুকরোগুলো আমায় দিতে পারো না? দাও না? আমি একবার চেষ্টা করে দেখি সেই টুকরোগুলো জুড়ে আবার আস্ত পুতুল গড়ে তুলতে পারি কি না। তোমাদের তো তাতে কোন লোকসান নেই, অথচ আমার পরম লাভ।

বলা কি অসম্ভব?

দ্বিধাগ্রস্ত মন সারারাত শুধু চিন্তা করেছে। সর্বসন্তাপহারিণীর দেখা মিলেছে একেবারে ভোরবেলা। যখন ওবাড়িতে ঘরে ঘরে দরজা খুলে গেছে, আর পাগলিনী এক নতুন সুর নিয়ে, • কান্নার ঢেউ তুলেছে।

.

কিন্তু সাহস করে বলতে পারার অভাবেই তো কত জীবন অর্থহীন হয়ে যায়, কত জীবন বিস্বাদ!

ওকে আমার চাই, তোমাকে আমি নেবো, এ কথা উচ্চারণ করতে কজন পারে?

অতনুর নিজের কর্মস্থানের বাসা মনে পড়ল। শ্রীহীন লক্ষ্মীছাড়া সেই ঘর। ঘরও নয়, আশ্রয়ও নয়, শুধু আস্তানা। শুধু খাবার শোবার আর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো রাখবার নির্দিষ্ট একটা জায়গা মাত্র।

সেই লক্ষ্মীছাড়া ঘরে লক্ষ্মীর আবির্ভাবের স্বপ্ন কি কোনদিন দেখেছে অতনু?

মনে পড়ছে না। ঘর নিয়ে কোনদিনই কিছু ভাবে নি বোধহয়। শুধু একটা যান্ত্রিক নিয়মে দৈনন্দিনের ঋণশোধ করে এসেছে। যদি কোনদিন সেই শ্রীহীন ঘর মনকে বিমুখ করে তুলেছে, বেরিয়ে পড়েছে বাইরে। হয়তো বা কোন সহকর্মীর ডেরায়।

ওর বিয়ের কথা নিয়ে প্রশ্ন তোলে অনেকেই, অতনু হেসে ওড়ায়। বলে, মিলিটারীতে কাজ করলে বিয়ে করতে নেই।

কিন্তু সত্যিই কি অমিতার জন্যেই নিজের জীবনটাকে এমন অর্থহীন করে রেখেছে অতনু? সেই গতানুগতিক ব্যর্থপ্রেমের স্মৃতি বুকে নিয়ে জীবনটাকে কাটিয়ে দেবে এই ভেবে এসেছে?

কই, তেমন তীব্রতা তো কোনদিন অনুভব করে নি! অমিতার কথা ভেবে ভেবে তো উত্তাল হয়ে ওঠে নি তার দিন আর রাত্রি!

শুধু একটু বিধুর বিষণ্ণতা। শুধু একটু কোমল করুণা।

অমিতা যদি এতদিনে তার স্বামীপুত্রের সংসারে সুখে আনন্দে জ্বলজ্বল করতো, যদি এমন করে নিঃস্ব হয়ে না যেত, হয়তো অতনু নিজের কথা ভাবত। ভাবত, দূরছাই, এই লক্ষ্মীছাড়া জীবন আর সহ্য হচ্ছে না।

কিন্তু অমিতার দুর্ভাগ্য তার চিত্তকে মূক করে রেখেছিল। তার বেশি কিছু নয়। অতনু ভাবে, তবু আমি নির্বোধের মত ছুটে এলাম তুচ্ছ একটু লোভের আকর্ষণে!

কিন্তু কে জানত অমিতা এমন করবে।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress