আঁকিয়া বাঁকিয়া পার্বত্য নদীর
গলিটি বিসৰ্পিল; নানা ভঙ্গীতে আঁকিয়া বাঁকিয়া পার্বত্য নদীর মত চলিয়াছে। দুই পাশে তিনতলা চারতলা বাড়ি। গলি যতাই সরু হোক, দেখিয়াছি বাড়ি কখনও ছোট হয় না, আড়ে বাড়িবার জায়গা না পাইয়া দীর্ঘে বাড়ে।
একটি তেতলা বাড়ির দ্বারপার্থে ডাক্তার সুরেশ রক্ষিতের শিলালিপি দেখিয়া বুঝিলাম এই বিশু পালের বাড়ি। ডাক্তার রক্ষিত জানালা দিয়া আমাদের দেখিতে পাইয়া বাহির হইয়া আসিলেন, বলিলেন, ‘আসুন।’
বাড়িটি পুরানো ধরনের; এক পাশে সুড়ঙ্গের মত সঙ্কীর্ণ বারান্দা ভিতর দিকে চলিয়া গিয়াছে, তাহার এক পাশে দ্বার, অন্য পাশে দু’টি জানোলা। দ্বার দিয়া ডাক্তারখানা দেখা যাইতেছে; তকৃতকে ঝকঝকে একটি ঘর। কিন্তু রোগীর ভিড় নাই। একজন মধ্যবয়স্ক কম্পাউন্ডার দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া আছে। ডাক্তার রক্ষিত আমাদের ডাক্তারখানায় লইয়া গেলেন না, বলিলেন, ‘সিঁড়ি ভাঙতে হবে। বিশুবাবু তিনতলায় থাকেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ তো। আপনি কি এই বাড়িতেই থাকেন? না কেবলই ডাক্তারখানা?’
ডাক্তার বলিলেন, ‘তিনটে ঘর আছে। দুটোতে ডাক্তারখানা করেছি, একটাতে থাকি। একলা মানুষ, অসুবিধা হয় না।’
দোতলাতেও তিনটি ঘর। ঘর তিনটিতে অফিস বসিয়াছে। টেবিল চেয়ারের অফিস নয়, মাড়োয়ারীদের মত গদি পাতিয়া অফিস। অনেকগুলি কেরানি বসিয়া কলম পিষিতেছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এটা কি?’
ডাক্তার বলিলেন, ‘বিশুবাবুর গদি। মস্ত কারবার, অনেক রাজা-রাজড়ার টিকি বাঁধা আছে। ওঁর কাছে।’
ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না। আমি মনে মনে ভাবিলাম, বিশু পাল শুধু শিশুপালই নয়, জরাসন্ধও বটে।
তেতলার সিঁড়ির মাথায় একটি গুখ রণসাজে সজ্জিত হইয়া গাদা-বন্দুক হস্তে টুলের উপর বসিয়া আছে; পদশব্দ শুনিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং আমাদের পানে তির্যক নেত্রপাত করিল। ডাক্তার বলিলেন, ‘ঠিক হ্যায়।’ তখন গুখা স্যালুট করিয়া সরিয়া দাঁড়াইল।
বারান্দা দিয়া কয়েক পা। যাইবার পর একটি বন্ধ দ্বার। ডাক্তার দ্বারে টোকা দিলেন। ভিতর হইতে নারীকণ্ঠে প্রশ্ন আসিল, ‘কে?’
ডাক্তার বলিলেন, ‘আমি ডাক্তার রক্ষিত। দোর খুলুন।’
দরজা একটু ফাঁক হইল। একটি প্রৌঢ় সধবা মহিলার শীর্ণ মুখ ও আতঙ্কভরা চক্ষু দেখিতে পাইলাম। তিনি একে একে আমাদের তিনজনের মুখ দেখিয়া বোধহয় আশ্বস্ত হইলেন, দ্বার পুরাপুরি খুলিয়া গেল। আমরা একটি ছায়োচ্ছন্ন ঘরে প্রবেশ করিলাম।
পুরুষ কণ্ঠে শব্দ হইল, ‘আলোটা জেলে দাও গিন্নি।’
মহিলাটি সুইচ টিপিয়া আলো জ্বলিয়া দিলেন, তারপর মাথায় আচল টানিয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেলেন।
এইবার ঘরটি স্পষ্টভাবে দেখিলাম। মধ্যমাকৃতি ঘর, মাঝখানে একটি খাট। খাটের উপর প্ৰেতাকৃতি একটি মানুষ গায়ে বাল্যাপোশ জড়াইয়া শুইয়া আছে। খাটের পাশে একটি ছোট টেবিলের উপর ওষুধের শিশি জলের গেলাস প্রভৃতি রাখা আছে। ঘরে অন্যান্য আসবাব যাহা আছে তাহা দেখিয়া নাসিং হোমে রোগীর কক্ষ স্মরণ হইয়া যায়।
প্রেত্যকৃতি লোকটি অবশ্য বিশু পাল। জীৰ্ণগলিত মুখে নিষ্প্রভ দু’টি চক্ষু মেলিয়া তিনি আমাদের পানে চাহিয়া আছেন। মাথার চুল পাশুটে সাদা, সম্মুখের দাঁতের অভাবে অধরোষ্ঠ অন্তঃপ্রবিষ্ট হইয়াছে। বয়স পঞ্চাশ কিম্বা ষাট কিম্বা সত্তর পর্যন্ত হইতে পারে। তিনি স্খলিত স্বরে বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু এসেছেন? আমার কী সৌভাগ্য। আসতে আজ্ঞা হোক।’
আমরা খাটের কাছে গিয়া দাঁড়াইলাম। বিশু পাল কম্পিত হস্ত জোড় করিয়া বলিলেন, ‘আপনাদের বড় কষ্ট দিয়েছি। আমারই যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু দেখছেন তো আমার অবস্থা—’
ডাক্তার বলিলেন, ‘আপনি বেশি কথা বলবেন না।’
বিশু পাল কাতর কণ্ঠে বলিলেন, ‘বেশি কথা না বললে চলবে কি করে ডাক্তার? ব্যোমকেশবাবুকে সব কথা বলতে হবে না?’
‘তবে যা বলবেন চটপট বলে নিন।’ ডাক্তার টেবিল হইতে একটি শিশি লইয়া খানিকটা তরল ঔষধ গেলাসে ঢালিলেন, তাহাতে একটু জল মিশাইয়া বিশু পালের দিকে বাড়াইয়া দিলেন, বলিলেন, ‘এই নিন, এটা আগে খেয়ে ফেলুন।’
বিশু পাল রুগ্ন বিরক্তিভরা মুখে ঔষধ গলাধঃকরণ করিলেন।
অতঃপর অপেক্ষাকৃত সহজ স্বরে তিনি বলিলেন, ‘ডাক্তার, এঁদের বসবার চেয়ার দাও।’
ডাক্তার দু’টি চেয়ার খাটের পাশে টানিয়া আনিলেন, আমরা বসিলাম। বিশু পাল ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন, ‘বেশি কথা বলব না, ডাক্তার রাগ করবে। সাঁটে বলছি। আমার তেজারিতি কারবার আছে, নিশ্চয় শুনেছেন। প্ৰায় পাঁচিশ বছরের কারবার, বিশ লক্ষ টাকা খাটছে। অনেক বড় বড় খাতক আছে।
‘আমি কখনো জামিন জামানত না রেখে টাকা ধার দিই না। কিন্তু বছর দুই আগে আমার দুবুদ্ধি হয়েছিল, তার ফল এখন ভুগছি। বিনা জামিনে ত্ৰিশ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলাম।
‘অভয় ঘোষালকে আপনি চেনেন না। আমি তার ব্যাপকে চিনতাম, মহাশয় ব্যক্তি ছিলেন অধর ঘোষাল। অনেক বিষয়-সম্পত্তি করেছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর কিছু কাজ-কারবারও হয়েছিল। তাই তাঁকে চিনতাম; সত্যিকার সজ্জন।
বিছর দশেক আগে অধর ঘোষাল মারা গেলেন, তাঁর একমাত্র ছেলে অভয় ঘোষাল বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে বসল।
‘অভয়কে আমি তখনো দেখিনি। বাপ মারা যাবার পর তার সম্বন্ধে দু-একটা গল্পগুজব কানে আসত। ভাবতাম পৈতৃক সম্পত্তি হাতে পেলে সব ছেলেই গোড়ায় একটু উদ্ধৃঙ্খলতা করে, কালে শুধরে যাবে। এমন তো কতাই দেখা যায়।
‘আজ থেকে বছর দুই আগের ব্যাপার। অভয় ঘোষালের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছি, হঠাৎ একদিন সে এসে উপস্থিত। তাকে দেখে, তার কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কার্তিকের মত চেহারা, মুখে মধু ঝরে পড়ছে। নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, তার বাবা আমার বন্ধু ছিলেন, তাই সে বিপদে পড়ে আগে আমার কাছেই এসেছে। বড় বিপদ তার, শক্রিরা তাকে মিথ্যে খুনের মামলায় ফাঁসিয়েছে। কোনো মতে জামিন পেয়ে সে আমার কাছে ছুটে এসেছে, মামলা চালাবার জন্যে তার ত্ৰিশ হাজার টাকা চাই।
‘বললে বিশ্বাস করবেন না, আমি বিশু পাল বিনা জামানতে শুধু হ্যান্ডনেট লিখিয়ে নিয়ে তাকে ত্ৰিশ হাজার টাকা দিলাম। ছোঁড়া আমাকে গুণ করেছিল, মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল।
‘যথাসময়ে আদালতে খুনের মামলা আরম্ভ হল। খবরের কাগজে বয়ান বেরুতে লাগল; সে এক মহাভারত। এমন দুষ্কর্ম নেই যা। অভয় ঘোষাল করেনি, পৈতৃক বিষয়-সম্পত্তি প্রায় সবই উড়িয়ে দিয়েছে। কত মেয়ের সর্বনাশ করেছে তার হিসেব নেই। একটি বিবাহিতা যুবতীকে ফুসলে নিয়ে এসেছিল, তারপর বছরখানেক পরে তাকে বিষ খাইয়ে খুন করেছে। তাইতে মোকদ্দমা। আমি একদিন এজলাসে দেখতে গিয়েছিলাম; কাঠগড়ায় অভয় ঘোষাল বসে আছে, যেন কোণ-ঠাসা বন-বেরাল! দেখলেই ভয় করে। ও বাবা, এ কাকে টাকা ধার দিয়েছি!
‘কিন্তু মোকদ্দমা টিকলো না, আইনের ফাঁকিতে অভয় ঘোষাল রেহাই পেয়ে গেল। একেবারে বেকসুর খালাস। তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ প্রমাণ হল না।
‘তারপর আরো বছরখানেক কেটে গেল। আমি অভয় ঘোষালের ওপর নজর রেখেছিলাম, খবর পেলাম সে তার বসত-বাড়ি বিক্রি করবার চেষ্টা করছে। এইটে তার শেষ স্থাবর সম্পত্তি্্, এটা যদি সে বিক্রি করে দেয়, তাহলে তাকে ধরবার আর কিছু থাকবে না, আমার টাকা মারা যাবে।
‘টাকার তাগাদা আরম্ভ করলাম। প্রথমে অফিস থেকে চিঠি দিলাম, কোন জবাব নেই! বার তিনেক চিঠি দিয়েও যখন সাড়া পেলাম না, তখন আমি নিজেই একদিন তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমরা মহাজনেরা দরকার হলে বেশ আঁতে ঘা দিয়ে কথা বলতে পারি, ভাবলাম মামলা রুজু করবার আগে তাকে কথা শুনিয়ে আসি, তাতে যদি কাজ হয়। সে আজ তিন মাস আগেকার কথা।
‘একটা গুর্খাকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম তার বাড়িতে। সামনের ঘরে একটা চেয়ারে অভয় ঘোষাল একলা বসে ছিল। আমাকে দেখে সে চেয়ার থেকে উঠল না, কথা কইল না, কেবল আমার মুখের পানে চেয়ে রইল।
‘কাজের সময় কাজী কাজ ফুরোলে পাজি। গালাগালি দিতে এসেছিলাম, তার ওপর রাগ হয়ে গেল। আমি প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে তার চৌদ্দ পুরুষের শ্রাদ্ধ করলাম। তারপর হঠাৎ নজর পড়ল তার চোখের ওপর; ওরে বাবা, সে কী ভয়ঙ্কর চোেখ। লোকটা কথা কইছে না, কিন্তু তার চোখ দেখে বোঝা যায় যে সে আমাকে খুন করবে। যে-লোক একবার খুন করে বেঁচে গেছে, তার তো আশকার বেড়ে গেছে। ভয়ে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল।
‘আর সেখানে দাঁড়ালাম না, ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ি ফিরে এলাম। বাড়ি ফিরে সবঙ্গে কাঁপুনি ধরল, কিছুঁতেই কাঁপুনি থামে না। তখন ডাক্তারকে ডেকে পাঠালাম। ডাক্তার এসে কোনো মতে ওষুধ দিয়ে কাঁপুনি থামালো। তখনকার মত সামলে গেলাম বটে, কিন্তু শেষ রাত্রির দিকে আবার কাঁপুনি শুরু হল। তখন বড় ডাক্তার ডাকানো হল; তিনি এসে দেখলেন স্ট্রোক হয়েছে, দুটো পা অসাড়া হয়ে গেছে।
‘তারপর থেকে বিছানায় পড়ে আছি। কিন্তু প্ৰাণে শান্তি নেই। ডাক্তারেরা ভরসা দিয়েছেন রোগে মরব না, তবু মৃত্যুভয় যাচ্ছে না। অভয় ঘোষাল আমাকে ছাড়বে না। আমি বাড়ি থেকে বেরুই না, দোরের সামনে গুখ বসিয়েছি, তবু ভরসা পাচ্ছি না।–এখন বলুন ব্যোমকেশবাবু্, আমার কি উপায় হবে।’
ব্বিরণ শেষ করিয়া বিশু পাল অর্ধমৃত অবস্থায় বিছানায় পড়িয়া রহিলেন। ডাক্তার একবার তাঁহার কজি টিপিয়া নাড়ি দেখিলেন, কিন্তু ঔষধ দিবার প্রয়োজন বোধ করিলেন না। ব্যোমকেশ গভীর ভ্রূকুটি করিয়া নতমুখে বসিয়া রহিল।
এই সময় বিশু পালের স্ত্রী ঘরে প্রবেশ করিলেন। মাথায় আধ-ঘোমটা, দুই হাতে দু-পেয়ালা চা। আমরা উঠিয়া দাঁড়াইলাম, তিনি আমাদের হাতে চায়ের পেয়ালা দিয়া স্বামীর প্রতি ব্যগ্র উৎকণ্ঠার দৃষ্টি হানিয়া প্রস্থান করিলেন। নীরব প্রকৃতির মহিলা, কথাবার্তা বলেন না।
আমরা আবার বসিলাম। দেখিলাম বিশু পাল সপ্রশ্ন নেত্ৰে বোমকেশের মুখের পানে চাহিয়া আছেন।
ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালায় ক্ষুদ্র একটি চুমুক দিয়া বলিল, ‘আপনি যথাসাধ্য সাবধান হয়েছেন, আর কি করবার আছে। খাবারের ব্যবস্থা কি রকম?
বিশু পাল বলিলেন, ‘একটা বামুন ছিল তাকে বিদেয় করে দিয়েছি। গিন্নি রাঁধেন। বাজার থেকে কোনো খাবার আসে না।’
‘চাকর-বাকর?’
‘একটা ঝি আর একটা চাকর ছিল, তাদের তাড়িয়েছি। সিঁড়ির মুখে গুখ বসিয়েছি। আর কি করব বলুন।’
‘ব্যবসার কাজকর্ম চলছে কি করে?’
‘সেরেস্তাদার কাজ চালায়। নেহাৎ দরকার হলে ওপরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে যায়। কিন্তু তাকেও ঘরে ঢুকতে দিই না, দোরের কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলে যায়। বাইরের লোক ঘরে আসে কেবল ডাক্তার।’
চায়ের পেয়ালা নিঃশেষ করিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল, হাসিয়া বলিল, ‘যা-যা করা দরকার সবই আপনি করেছেন, আর কী করা যেতে পারে ভেবে পাচ্ছি না। কিন্তু সত্যিই কি অভয় ঘোষাল আপনাকে খুন করতে চায়?’
বিশু পাল উত্তেজিতভাবে উঠিয়া বসিবার চেষ্টা করিয়া আবার শুইয়া পড়িলেন, ব্যাকুল স্বরে বলিলেন, ‘হ্যাঁ ব্যোমকেশবাবু্, আমার অন্তরাত্মা বুঝেছে ও আমাকে খুন করতে চায়। নইলে এত ভয় পাব কেন বলুন! কলকাতা শহর তো মগের মুল্লুক নয়।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তা বটে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে?’
বিশু পাল বলিলেন, ‘সেই তো ভাবনা, এভাবে কতদিন চলবে। তাই তো আপনার শরণ নিয়েছি, ব্যোমকেশবাবু। আপনি একটা ব্যবস্থা করুন।’
কামকেশ বলিল, ‘ভেবে দেখব। যদি কিছু মনে আসে, আপনাকে জানাব। —আচ্ছা, চলি।
বিশু পাল বলিলেন, ‘ডাক্তার!’
ডাক্তার রক্ষিত অমনি পকেট হইতে একটি একশো টাকার নোট বাহির করিয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে ধরিলেন। ব্যোমকেশ সবিস্ময়ে ভ্রূ তুলিয়া বলিল, ‘এটা কি?’
বিশু পাল বিছানা হইতে বলিলেন, ‘আপনার মর্যাদা। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, অনেক সময় নষ্ট করেছি।’
‘কিন্তু এ রকম তো কোনো কথা ছিল না।’
‘তা হোক। আপনাকে নিতে হবে।’
অনিচ্ছাভরে ব্যোমকেশ টাকা লইল। তারপর ডাক্তার আমাদের নীচে লইয়া চলিলেন।
সিঁড়ির মুখে গুখ স্যালুট করিল। সিঁড়ি দিয়া নামিতে নামিতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘এই লোকটা সারাক্ষণ পাহারা দেয়?’
ডাক্তার বলিলেন, ‘না, ওরা দু’জন আছে। পুরোনো লোক, আগে দোতলায় পাহারা দিত। একজন বেলা দশটা থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত থাকে, দ্বিতীয় ব্যক্তি রাত্রি দশটা থেকে বেলা আটটা পর্যন্ত পাহারা দেয়।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সকালে দু-ঘণ্টা এবং রাত্রে দু-ঘণ্টা পাহারা থাকে না?’
ডাক্তার বলিলেন, ‘না, সে-সময় আমি থাকি।’
দ্বিতলে নামিয়া দেখিলাম দপ্তর বন্ধ হইয়া গিয়াছে কেরানির দ্বারে তালা লাগাইয়া বাড়ি গিয়াছে।
নীচের তলায় নামিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই, ডাক্তারবাবু।’
‘বেশ তো, আসুন আমার ডিসপেন্সারিতে।’
আমরা সামনের ঘরে প্রবেশ করিলাম। এটি রোগীদের ওয়েটিং রুম, নূতন টেবিল চেয়ার বেঞ্চি ইত্যাদিতে সাজানো গোছানো। কম্পাউন্ডার পাশের দিকের একটি বেঞ্চিতে এক হাঁটু তুলিয়া বসিয়া ঢুলিতেছিল, আমাদের দেখিয়া পাশের ঘরে উঠিয়া গেল। ব্যোমকেশ ঘরের চারদিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া বলিল, ‘খাসা ডাক্তারখানা সাজিয়েছেন।’
ডাক্তার শুষ্ক স্বরে বলিলেন, ‘সাজিয়ে রাখতে হয়; জানেন তো, ভেক না হলে ভিখ মেলে না।’
‘কতদিনের প্র্যাকটিস আপনার?’
‘এখানে বছর তিনেক আছি, তার আগে মফঃস্বলে ছিলাম।’
‘ভালই চলছে মনে হয়–কেমন?’
‘মন্দ নয়–চলছে টুকটাক করে। দু-চারটে বাঁধা ঘর আছে। সম্প্রতি পসার কিছু বেড়েছে। বিশুবাবুকে যদি সারিয়ে তুলতে পারি–’
ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল, ‘হ্যাঁ। — আচ্ছা ডাক্তারবাবু্, বিশু পালের এই যে মৃত্যুভয়, এটা কি ওঁর মনের রোগ? না সত্যিই ভয়ের কারণ আছে?’
ডাক্তার একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, ‘ভয়ের কারণ আছে। অবশ্য যাদের অনেক টাকা তাদের মৃত্যুভয় বেশি হয়। কিন্তু বিশু পালের ভয় অমূলক নয়। অভয় ঘোষাল লোকটা সত্যিকার খুনী। আমি শুনেছি ও গোটা তিনেক খুন করেছে। এমন কি ও নিজের বোপকে বিষ খাইয়েছিল। কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ আছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাই নাকি! ভারি গুণধর ছেলে তো। এখন মনে পড়ছে বছর দুই আগে ওর মামলার বয়ান খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। ওর ঠিকানা আপনি জানেন নাকি?’
ডাক্তার বলিলেন, ‘জানি। এই তো কাছেই, বড়জোর মাইলখানেক। যদি দেখা করতে চান ঠিকানা দিচ্ছি।’
এক টুকরা কাগজে ঠিকানা লিখিয়া ডাক্তার ব্যোমকেশকে দিলেন, সে সেটি মুড়িয়া পকেটে রাখিতে রাখিতে বলিল, ‘আর একটা কথা। বিশুবাবুর স্ত্রীর কি কোনো রোগ আছে?’
ডাক্তার বলিলেন, ‘স্নায়ুর রোগ। স্নায়ুবিক প্রকৃতির মহিলা, তার ওপর ছেলেপুলে হয়নি–’
‘বুঝেছি। — আচ্ছা, চললাম। বিশুবাবু একশো টাকা দিয়ে আমাকে দায়ে ফেলেছেন। তাঁর সমস্যাটা ভেবে দেখব।’
বাহিরে তখন, রাস্তার আলো জ্বলিয়াছে। ব্যোমকেশ হাতের ঘড়ি দেখিয়া বলিল, ‘সাড়ে ছটা। চল, খুনি আসামী দর্শন করে যাওয়া যাক। বিশু পাল যখন টাকা দিয়েছেন, তখন কিছু তো করা দরকার।’