Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ঘনাদার মৌজ করে সেই সিগারেট খাওয়ার মধ্যেই গৌর তার হাতঘড়িটা আমাদের দেখাতে বেশ সন্ত্রস্ত হয়ে আমরা পরস্পরের সঙ্গে চোখাচোখি করলাম। বেলা তো প্রায় দেড়টা হয়ে গেছে। আমাদের তো বটেই, ঘনাদা নিজেরও নাওয়া খাওয়ার কথা ভুলে গেছেন নাকি? গল্প যা কেঁদেছেন, তা এত বেশি সবিস্তারে বলার মধ্যে অতিমাত্রায় বেলা বাড়িয়ে দিয়ে আসল কথাটা গোলেমালে হারিয়ে ফেলে দেওয়ার মতলব নেই তো?

সিগারেটে ঘনাদার দু-চারটে রামটানের পর তাই একটু কড়া গলাতেই বলতে হল, এ সব বৃত্তান্ত তো অনেক শোনালেন! সারাদিন ধরে নাওয়া খাওয়া ভুলে এ বৃত্তান্ত শুনে আমাদের মোক্ষলাভ হবে না, পল্টুবাবুর গাড়ির আট-ন গ্যালন তেল ফুকে দিয়ে আসার ঠিক মতো জবাবদিহি পাব? –

কেন? কেন? আমাদের সকলের চোখ কপালে তুলিয়ে পল্টুবাবুই ঘনাদার হয়ে জোরালো ওকালতি করলেন, ওঁকে অমন যা-তা বলছ কেন? উনি যা বলছেন, আমার আটন গ্যালন তেলটা তার চেয়ে দামি হল তোমাদের কাছে? না, না, আপনি বলুন, বলে যান। একদিন অমন নাওয়া খাওয়া বন্ধ হলে যার নাড়ি ছেড়ে যায়, সে চলে গিয়ে খাওয়া-দাওয়াই করুক। বলে যান আপনি।

হায় কপাল! যার জন্য লড়তে নামি, সে-ই বন্দুকের নল দেয় ঘুরিয়ে।

আমাদের উড়ন্ত নিশান একেবারে ভিজে ন্যাকড়ার মতোই নেতিয়ে পড়ে।

ঘনাদা তার ওপর কাটা ঘায়ে যেন নুনের ছিটে দিয়ে বললেন, না, না, খিদেতেষ্টার কথা মনে রাখতে হবে বইকী! সকলের সহ্যশক্তি তো আর সমান নয়।

তা ছাড়া বেলাও বড় কম হয়নি। তবে আমারও বলার খুব বেশি কিছু আর নেই।

বোরোত্রার নিজের সঙ্গে সারাক্ষণ পুতুলের ছল করে কথা বলবার ওই বদভ্যাসটা যে একটা রোগ, সেদিন হংকং-এর চিনা হোটেলের লবিতেই সেরকম সন্দেহ হয়েছিল। আমার সন্দেহটা ঠিক না হলে তার সঙ্গে জীবনে দ্বিতীয়বার দেখা আর অবশ্য হত না। আর তা না হলে ই-ইউ-ডব্লিউ-সি নামটা দুনিয়া থেকে মুছে গিয়ে এসএস-পি-এস-এর সাম্রাজ্যই নিশ্চয়ই সমস্ত পৃথিবী গ্রাস করে নিত।

সেদিন চিনা হোটেলের লবিতে পরিচয়-টরিচয় করার পর বোরোত্রা যে রকম খাতির করে আমায় তার সামনের চেয়ারে বসিয়েছিল, আর তার সঙ্গী পুচকে পিঁপিঁর বেয়াদবি মাপ করতে বলে যেভাবে একটা দুঃখের কাহিনী আমায় শুনিয়েছিল, তাতে নেহাত বাস্ক ভাষাটা জানা না-থাকলে তার সম্বন্ধে একটু দ্বিধায় হয়তো আমি পড়তে পারতাম। পেটের দায়ে এসএস-পি-এস-এর চর হলেও ভবঘুরে বাজিকর হিসেবে লোকটা খুব খারাপ নয়, এমন ধারণা আমার হতে পারত। আর দুবারি সম্বন্ধে সে যা আমায় শুনিয়েছিল, তার কতকটা সত্য বলে বিশ্বাসও হয়তো আমার হত।

দুব্যারি সম্বন্ধে গল্পটা সে বেশ কায়দা করেই সাজিয়েছিল। নিজেকে ধোয়া তুলসিপাতার মতো সাধু বা দ্যুব্যারিকে মিটমিটে বিচ্ছু শয়তানগগাছের কিছু হিসেবে সে মোটেই সাজায়নি।

তার বদলে দুব্যারি যে তার দেশেরই ছেলে আর ছেলেবেলার বন্ধু এ কথা জানিয়ে, আজ নিয়তির খুঁটি নাড়ায় দুজনে সম্পূর্ণ বিপরীত দলে ভিড়লেও কেন সে পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে দ্যুব্যারির একটা চরম উপকার করতে চাইছে, সে কথা আমায় বলেছে। যা বলেছে তা খুব অবিশ্বাস্য ব্যাপারও নয়। দুব্যারি যখন জীবন মরণ তুচ্ছ করে কোনও এক অজানা আস্তানায় তার কী আশ্চর্য সাধনা চালিয়ে যাচ্ছে, তখন যে কয়জনের অকৃত্রিম বন্ধুত্বের উপর বিশ্বাস রেখে সে তার দল গড়ে তুলেছে, তাদের কেউ কেউ নাকি শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবার ফন্দি এঁটেছে। আগেকার দিন আর বন্ধুত্বের খাতিরে সময় থাকতে সাবধান হবার জন্য দুব্যারিকে এই খবরটা শুধু বোরোত্রা দিতে চায়। দুব্যারির পেছনে তাই সে এমন করে ছুটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু দুব্যারি তাকে এখন এত অবিশ্বাস করে যে তাকে ক মিনিটের জন্য কাছে আসবার সেই সুযোগটুকুও দিচ্ছে না। এ পর্যন্ত বারবার একেবারে মুখোমুখি হওয়ার অবস্থায় যেমন করে তোক এড়িয়ে পালিয়েছে।

বোরোত্রার এ গল্প বেশ যেন মন দিয়ে শুনেছিলাম। তবে এ গল্প বলার মধ্যে পিঁপিঁ একবারও বাধা দেয়নি, এটাও লক্ষ করেছি। গল্প শেষ হলে একটু যেন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, কিন্তু এসব কথা আমায় শোনাচ্ছেন কেন?

পিঁপিঁ কী যেন একটা বলতে মিহি সুর তুলতে যাচ্ছিল। ক্যাঁক করে তার গলা টিপে ধরে বোরোত্রা সবিনয়ে বলেছে, মাপ করবেন সেনর দাস। আপনার চেহারাটা যে কোনও জায়গায়, বিশেষ করে এখানকার মানুষজনের মধ্যে, একটু চোখে পড়বার মতো তো। তাই আমাদের জানাশোনাদের কেউ কেউ আপনাকে লক্ষ করার সময়ে দুব্যারির মতো কাউকে যেন আপনার ট্যাক্সিতে লুকিয়ে উঠতে দেখেছে। এই খবরটা তাদের কারও কারও কাছে পাবার পরই যাচাই করতে আপনার এখানে এসেছি।

বেশ একটু কৃতার্থভাবে হেসে এবার বলেছি, এবার তা হলে আপনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে পারেন।

ভাগ্যবান? বোরোত্রা সত্যি সত্যিই কথাটার মানে বুঝতে না পেরে সন্দিগ্ধভাবে আমার দিকে চেয়েছে।

ভাগ্যবান মানে বুঝতে পারছেন না? কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে লিফটটার দিকে আঙুল দেখিয়েছি। তারপর সেদিকে যেতে যেতে বলেছি, আপনার ছেলেবেলার বন্ধু দ্যুব্যারির সঙ্গে এতদিন বাদে আজ আপনার দেখা এখুনি হবে বলে আপনাকে ভাগ্যবান বলছি।

লিফটটা ভাগ্যক্রমে নিজেই তখন খালি অবস্থায় নেমেছে। বোরোত্ৰা আর তার পুঁচকে সঙ্গীকে নিয়ে সেই লিফটে ওপরে উঠতে উঠতে আরও আশ্বাস দিয়ে বলেছি, আপনার বন্ধু দুব্যারি সত্যিই আমার ট্যাক্সিতে এখানে এসে কাকুতি মিনতি করে আমার কামরায় আশ্রয় চেয়েছে। আশ্রয় দিলেও তার ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে মনে হওয়ায়—এই আসছি—বলে কামরার দরজায় তালা দিয়ে তাকে আটকে রেখে এসেছি।

আমার কামরার সামনে দাঁড়িয়ে নিজস্ব চাবি লাগিয়ে দরজাটা খোলার সময় বোরোত্রার চেহারাটা ফোটো তুলে রাখবার মতো। উত্তেজনায় সে যেন তখন ফেটে পড়ছে। তার বাঁ বগলে রাখা পিঁপিঁ তো কান ফুটো করা হুইসলের স্বরে চেঁচিয়েছে, খোল শিগগির, খোল।

দরজা খুলতে-না-খুলতে হুড়মুড় করে ঢুকেছে বোরোত্রা। পিঁপিঁর জবানিতে আমার এতক্ষণের সব অপমানের শোধও তখন আমি নিতে পেরেছি।

বোরোত্রা সমস্ত কামরাটা তো বটেই, বাথরুম এমনকী ওয়ার্ডরোব পর্যন্ত খুলে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেশ গরম গলায় বলেছে, কই, গেল কোথায় দুব্যারি?

আমিও একেবারে তাজ্জব বনে যাওয়ার ভান করে বলেছি, তাই তো! এই বন্ধ কামরা থেকে সে যাবে কোথায়?

তারপরই যেন হঠাৎ কী মনে হওয়ায় পেছনের একটা জানলার দিকে ছুটে গিয়ে চিৎকার করে উঠেছি, এই তো, এই তো দুব্যারির পালাবার প্যাঁচ!.

বোরোত্রাও তখন হাঁফাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়িয়েছে।

প্যাঁচটা দেখে তার মুখ আরও থমথমে হয়ে উঠেছে। হবারই কথা। কারণ সেখানে একটা খড়খড়িতে বেঁধে দুটো পাকানো চাদর পরপর গিট দিয়ে যেভাবে ঝোলানো, তাতে তা বেয়ে নামবার চেষ্টা করলে আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু করা যায় না। পাঁচতলা থেকে দুটো চাদর চারতলা ছাড়িয়ে সামান্য একটু পৌঁছেছে মাত্র। সেখানে ওদিকের খাড়া দেওয়ালে একটা জানলার কার্নিশও নেই একটু পায়ের ভর দেওয়ার। একমাত্র গতি সুতরাং সেখান থেকে হাত পা ছেড়ে নীচে লাফ। প্রমাণ-প্রায় চারতলা সমান উঁচু থেকে সে লাফ কেউ দিলে তার হাড়গোড়ের টুকরোগুলোও সব খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

জানলার খড়খড়িতে বাঁধা চাদর দুটো যে নেহাত ছেলেভুলানো মিথ্যে চালাকি, তা একবার নজর দিলেই বোঝা যায়।

বোরোত্রার মুখ যত থমথমে হয়ে উঠেছে, পিঁপিঁর গলা তত হয়েছে কান-ফুটো করা। অসহ্য ছুঁচলো গলায় বাস্ক-এ সে চেঁচিয়েছে, সব মিথ্যে কথা! তোর সঙ্গে মশকরা করছে কালা নেংটিটা। জিভটা ওর টেনে ছিঁড়ে ফেল! না হয় চটকে দলা পাকিয়ে ফেলে দে এই পাঁচতলা থেকে। দে, ফেলে দে! দেখছিস কী?

বোরোত্ৰা গম্ভীর মুখে যেন মেঘলা আকাশের গায়ে বাজগড়ানো আওয়াজে বলেছে, সবুর, সবুর। দু-দিন ওর দৌড়টা একটু দেখেই টুটি চেপে ধরব।

কিছুই যেন না-বুঝে বোকা-বোকা মুখে আমি বোরোত্রাকে সহানুভূতি জানিয়েছি, সত্যি এমন করে জ্বালাবে, ভাবতেও পারিনি।

পিঁপিঁ চিড়বিড়িয়ে উঠেছে, থোঁ মুখটা ভোঁতা করে দে না। বোরোত্রা যেন মেঘ-ডাকা আওয়াজে বলেছে, দেব, দেব। দুটো দিন শুধু নজরে রাখি।

নজরে রাখতে সে পারেনি। তার নিজের আর তার সঙ্গী চর-অনুচরদের চোখে ধুলো দিয়ে কখন যে আমি হংকং থেকে চিনেদের মাছধরা নৌকোয় সরে পড়েছি, জানতেও পারেনি তারা। জানবেই বা কী করে? তাদের পাহারায় গাফিলি কিছু ছিল না। কিন্তু সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার কোনও ট্রলারে মাছের জন্য পাঠানো সব বরফের বাক্সের কোনওটায় যে মানুষ থাকতে পারে, তা তাদের মাথায় আসেনি।

নিজে সরে পড়বার আগে এক বেলার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা সেখানকার পুলিশ-ফাঁড়িতে-জমা-করে-রাখা দুব্যারিকেও সেখান থেকে ছাড়িয়ে ওই জেলে-নৌকোতেই পালাবার ব্যবস্থা করবার সময় তার সঙ্গে সব বোঝাপড়াও করে নিয়েছি। বোঝাপড়া শুধু এই যে, তখন থেকে আমিও তাদের ই-ইউ-ডব্লিউ-সি-র একজন অংশীদার হয়েছি। দুব্যারি তার রেডিয়ো-টেলিস্কোপের গোপন ঘাঁটিতে নির্বিঘ্নে যাতে তার বাকি কাজটুকু সারতে পারে, বাইরের দুনিয়ায় তারই একজন প্রধান পাহারাদার হওয়া আমার কাজ। দুব্যারিকে হংকং থেকে পাচার করবার সময় আর-একটা পরামর্শও তাকে দিয়েছি। ছোট বড় দরকার-টরকার যা মাঝে মাঝে হয়, তার জন্য লন্ডন নিউইয়র্ক প্যারিস তো নয়ই, হংকং-এর মতো দুনিয়াদারির শহরে সে যেন না আসে। আর কাজ শেষ হবার আগে আমার সঙ্গেও কোনও যোগাযোগের চেষ্টা না করে।

তা সে করেনি। কিন্তু আমার পরামর্শ মতোই নিশ্চয়ই অন্য বড় শহর-টহরের বদলে কলকাতায় সওদা করতে এসেই প্রায় সর্বনাশ বাধাতে বসেছিল।

এস-এস-পি-এস তো কম পাত্তর নয়। তারাও চুপ করে বসে থাকেনি। ওত পেতে থেকে থেকে ওদের ওই বোরোত্রা কেমন করে দুব্যারির কলকাতা আসার খবরটা ঠিক পেয়ে গেছে। দুব্যারির পেছনে ও যে কলকাতাতে এসেছে, তা আমি আর কেমন করে জানব।

কিন্তু বোরোত্রার ওই ভেনন্ট্রিলোকুইজমের কায়দায় নিজের সঙ্গে হরদম কথা বলার রোগই তাকে ধরিয়ে দিয়েছে। তার এ রোগ না-থাকলে আর পল্টুবাবুর গাড়িটা ঠিক ওই সময়েই না পেলে পৃথিবীর এনার্জির সমস্যা মিটতে কত যুগ লাগত কে জানে!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *