Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রোগীর অতীত সম্পর্কে

ছায়া দেবনাথের গবেষণা, কেস নং ৯

রোগীর অতীত সম্পর্কে এখন একটা সুস্পষ্ট ধারণা করা যাচ্ছে কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। আমার কৌতূহল নিবৃত্তি স্মৃতিচারণার উদ্দেশ্য হতে পারে না।

রোগী নিজের অতীত পুনরুদ্ধার করে বর্তমানকে মেনে নেবে এটাই আশা। সমস্ত বর্ণনা এত জীবন্ত যেন আমাকে বলার সময় সে-ও আরেকবার অভিজ্ঞতাটির মধ্যে দিয়ে যায়। একটা বিশেষত্বনজরে পড়ে। তার স্মৃতিতে দাগ কেটে আছে বহুসংখ্যক স্বল্প পরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ। সে তুলনায় ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আদান প্রদানের চিত্রটি অস্পষ্ট ঝাঁপসা ভাসা-ভাসা। মানুষের সঙ্গে মানুষের সখ্য সহমর্মিতা বিষ ঈর্ষার উজ্জ্বল বলয়ের কেন্দ্রে অন্ধকার মৈত্রেয়ী ও অমলের সম্পর্ক।

রোগীর স্মৃতি রোমন্থনে দেখি সে সর্বদা এক ছোটখাটো জনতায় পরিবেষ্টিত। কখনওই একান্ত বা একলা নয়। এমন কি মৈত্রেয়ীর সঙ্গেও না। ভুবনেশ্বরে মেত্রেয়ীর আসা মানে একতার অনুষ্ঠান পিকনিক আউটিং, নিদেন পক্ষে বাড়িতে জমায়েত। সর্বদা জনতা। মৈত্রেয়ীর সঙ্গে তার নিভৃত জীবনের কোনও বিশেষ ঘটনার বিবরণ পাই না। অথচ বাস্তব তো কিছুতেই সেরকম হতে পারে না। সব অনুষ্ঠান পার্টি লেটনাইটের পরে নারী পুরুষকে এক ছাদের তলায় একান্ত হতেই হয়। তখন কী ঘটত? সে সব স্মৃতি গেল কোথায়? নাকি একান্ত হওয়াটাই ভয়ের। বোঝাঁপড়ার প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই স্বল্পপরিচিত জনারণ্যে তার নিশ্চিত নিরাপত্তা বোধ। মঞ্চে দাঁড়ানো ফোটোগ্রাফারের ক্লিক-ক্লিক, টিভি ক্যামেরার প্রচণ্ড আলো, হাতে মাইক, চারিদিকে প্রচুর লোক। বেশির ভাগ অচেনা। এর মধ্যে ব্যক্তিসত্তার হদিশ কই? নাকি সত্তালোপই ব্যক্তিটির অভীষ্ট। অর্থাৎ ব্যাধির মূল মনের অন্তর্দেশে।

.

অনেক বাস্তব জড়িয়ে থাকা হয়েছে আর নয়। আমি তো বরাবর শুধু আজকের দিনটার কথাই ভাবতাম, আগামী কাল যেন ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। শুধু গতকাল থেকে বেরুতে পারিনা। সেই ২২শে শ্রাবণের প্রস্তুতি, রবীন্দ্রমূর্তি শুভ-এর বাংলানাটক অভিনয়, এসবের খুঁটিনাটিতেইতো সারাক্ষণ ব্যস্ত। কলকাতায় মৈত্রেয়ীর সঙ্গে সময়টা বেশ ভালই কাটল। মৈত্রেয়ীর আবার আগের মতো উৎসাহভুবনেশ্বরে একতার অনুষ্ঠানে, যেন আমার জীবনে আবার সে কেন্দ্রস্থলে ফিরে এসেছে। না ভুল বলা হল। সে বরাবরই কেন্দ্রে ছিল, সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয়। এখন সে যেন আবার জেগে উঠেছে। শুভনাটক গোষ্ঠীর সঙ্গে জমে যাওয়ার ফলেই কি না কে জানে তার উৎসাহ এখন সবার চেয়ে বেশি।

আমার জীবনকাহিনী যদি কোনও জাতির ইতিহাসের সঙ্গে তুলনা করা যায় তা হলে রবীন্দ্রমূর্তিপর্ব হতে পারত রেনেসাঁস, পুনরুজ্জীবন। সেখান থেকে শুরু হত নব নব দিগন্ত সন্ধান, বহু বিচিত্র ক্ষেত্রে বিস্তার। কিন্তু তা হয়নি। বেঙ্গল রেনেসাঁসের মতো জ্বণেই মৃত। কী হতে পারত ভুত আমাকে ছাড়ে না। মনে করতে ইচ্ছে করে না অথচ সর্বদাই স্মৃতিতে জেগে আছে সেকদিনের ঘটনাবলী। মৈত্রেয়ীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞ রেখে, অর্থাৎবাইশে শ্রাবণে রবীন্দ্রমণ্ডপে রবীন্দ্রমূর্তি প্রতিষ্ঠায় এতটুকু সমস্যা হতে পারে সে সম্বন্ধে কোনও আভাস

দিয়ে ফিরে গেলাম ভুবনেশ্বরে। কিন্তু দুশ্চিন্তা গেল না। কার্যকরী সমিতির কেউ না কেউ প্রতিদিন মনে করায়,

—দাদা, আমাদের চিঠিটার কিন্তু কোনও উত্তর এল না।

–কোন চিঠি? আমি ভাল করেই জানি। তবু।

—বা, ভুলে গেলেন। সেই যে সেক্রেটারি কালচারকে আবেদন করা হল!একতার তরফ থেকে রবীন্দ্রমণ্ডপে একটি মর্মর রবীন্দ্রমূর্তি উপহার দেওয়ার সংকল্প। নালকো দিচ্ছে গ্রানাইটের পেডেস্টাল। এসবের অনুমতি প্রার্থনা। সব ভুলে গেলেন?

-না, না ভুলব কেন। তা ব্যস্ত হবার কী? দু এক দিনের মধ্যে সেক্রেটরিয়েটে গিয়ে হাতে হাতে নিয়ে আসব।

-ওটা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত সবাই খুব টেন্স হয়ে আছে।

—কেন টেনশানের কী?

-ওই ওড়িয়া কাগজে কী সব লিখেছিল না, তাই। কাগজটার মালিকতো মুখ্যমন্ত্রীর এক নম্বরের চেলা। সেই আবার সম্পাদক।

-তোমরা অকারণে তিলকে তাল কর। সব ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা সরকারের এতে কী আছে বল? বিনা খরচে একটা স্ট্যাচু কমপ্লিট উইথ পেডেস্টাল পাচ্ছে, তাতে ডোনারের নাম পর্যন্ত নেই। অসুবিধাটা কোথায়? আর রবীন্দ্রনাথ তো হেঁজিপেজি কেউ নন, ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের স্রষ্টা, প্রথম ভারতীয় যিনি নোবেল

-ও সব তো দাদা সবাই জানে। তা সত্ত্বেও লেখাটা বেরিয়েছিল। কথাটা আমার মনে বিলক্ষণ আছে। কলকাতা থেকে ফিরে এসে ভুবনেশ্বরে বাংলা দৈনিক, ভারতে সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র অখণ্ড বাজার-এর স্থানীয় প্রতিনিধি সায়ন্তন দাশগুপ্তর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ছেলেটি ভাল কথাবার্তায় চৌখশ। সাংবাদিকদের যেমন হওয়ার কথা। আমার অফিসে বসে সব বৃত্তান্ত শুনে বলল,

-মুশকিল কি জানেন কলকাতার অফিস ওসব ওড়িয়া বাঙালি ব্যাপার ছাপতে চায় না। আমাদের ইংরিজি কাগজটা এখানে ইংলিশমানের চেয়ে বেশি চলে জানেন তো? তাই সব সময় বুঝতেই পারেন গা বাঁচিয়ে চলা। তবু আমি একবার নিউজ এডিটরকে জিজ্ঞাসা করি।

কদিন বাদে টেলিফোন।

—অমলবাবু, আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তা উনি বললেন শুধু আপনাদের কথা তো ছাপা যায় না ওদের কী দাবি সেটাও দিতে হবে। আমি বললাম, মানে ওড়িয়া প্রতিবেদনটির সারাংশ পড়ে শোনালাম। তাতে কী বলল জানেন? ওহহা ওরা ওড়িয়া লেখকের মূর্তি চায় এই তো? তোমাদের একতা সেরকম দুচারখানা রবীন্দ্রমূর্তির সঙ্গে বসিয়ে দিলে পারে। তা হলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।

—আশ্চর্য কথা। ওদের নিজেদের রাজ্য, পুরো স্টেট পাওয়ার নিজেদের হাতে। ওরা তো নিজেরাই যেখানে ইচ্ছে সেখানে যতগুলো ইচ্ছে নিজেদের লোকেদের মূর্তি বসাতে পারে। আমরা একটা সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। সাময়িক বাসিন্দা, প্রবাসে নিজেদের সংস্কৃতি বজায় রাখার চেষ্টা করছি। আমরাও যদি ওদেরই সংস্কৃতি ওদেরই সব কিছুতে মিশে যাই তা হলে বাঙালি হিসাবে আমাদের অস্তিত্ব কী থাকে? নাকি আপনাদের নিউজ এডিটার বলছেন বাঙালি অস্তিত্বের দরকার নেই?

–দেখুন অমলবাবু আমি আপনি এখানে বাস করি, আমরা যেটা অনুভব করি কলকাতার লোকে করে না। এই ভারত ব্যাপারটা বাস্তবে কী ওদের একেবারে অভিজ্ঞতা নেই। ওরা ভাবে ওড়িশা মানে বাঙালি ট্যুরিস্টের দেশ উড়িষ্যা। তা ছাড়া কলকাতায়, অন্য প্রদেশের লোকেরা যেমন বুক ফুলিয়ে থাকে ওদের ধারণা আমরাও বাইরে সে ভাবে থাকি। আমাদের ক্ষেত্রে যে টাইটরোপ ওয়াকিং সেটা কে বোঝে।

—তা হলে ছেড়ে দিন।

—ভেরি সরি। না না ঠিক আছে।

—কী হল শেষ পর্যন্ত জানাবেন। –আচ্ছা।

সেক্রেটারিয়েটে গেলাম। প্রথমে ডিরেক্টর অফ কালচার, দেখা যাক বেটা কী করেছে পিটিশানটা। এত বছর ধরে খাইয়েছি দাইয়েছি ছেলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। অন্তত চোখের চামড়াটা তো থাকবে।

-নমস্কার স্যার।

—এই যে মিঃ দাস নমস্কার। আজি মু টিকি-এ ব্যস্ত আছি।

–আপনাকে বেশিক্ষণ ডিস্টার্ব করব না। আমি খালি স্যার রিমাইন্ড করতে এলাম ওই একতার পিটিশানটার ব্যাপারে, মানে আই মিন আওয়ার রিকোয়েস্ট ফর পারমিশান টু প্রেজেন্ট আ স্ট্যাচু অফ রবীন্দ্রনাথ অ্যাট রবীন্দ্রমণ্ডপ।

-হাঁ, চিঠি কণ গোটিএ আপন দেইথিলে। খালি মতে দেইথিলে না ডায়েরি হেইথিলা? ডায়েরি হেইচি? তেবে তো ঠিক অছি। কনসর্ল্ড সেকসন পুট আপ করিব। ডোন্ট ওয়ারি।

—কিন্তু স্যার বেশি দিন আর দেরি নেই। বাইশে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দিন। আমরা তো প্ল্যান করেচি সে দিনই মূর্তি প্রতিষ্ঠা হবে। কলকাতা থেকে একটি নাট্যসংস্থা আসছে। ভাল বাংলা নাটক করবে। আর রবীন্দ্রসঙ্গীত তো থাকবে বটেই। ভোগ্রাম হয়ে গেছে। চিফ মিনিস্টার জানেন। কিন্তু অফিসিয়ালি সরকার অনুমতি না দিলে তো পি ডবলিউ ডি কাজ শুরু করতে পারে না।

—ইন ডিউ কোর্স হব। আপন এক্সপিরিয়েন্সড লোক পরা, জানি নাহান্তি সরকারি কাম-এ এত্তে জলদি হুয়ে নি? মোর গোটিএ মিটিংকু যিবার অছি, পছরে কথা হব। কিছি মাইন্ড করিবে নি। নমস্কার।

-নমস্কার।

এই কি এতদিনের বন্ধু অনিলেন্দু? ভাবভঙ্গি ভাষায় যেন এক অচেনা আমলা। বেটা তো প্রথমে চিঠির ব্যাপারটাই চেপে দিতে চাইছিল, যেন পায়নি। তবে আমিও অমল কুমার দাস। এক যুগ ওড়িশাতে বাস করছি। অফিসিয়াল চ্যানেল জানতে বাকি নেই। আমলাদের সঙ্গে যতই ভাবভালবাসা থাক কোনও চিঠি ডায়েরি না হলে কিছুই হয় না। অর্থাৎ সরকারের প্রাপ্তিস্বীকারের খাতায় ওঠা এবং নম্বর ও তারিখ পড়া। কিন্তু কাজটাই যদি করতে না চায়? না না চাইবে না কেন। অনিলেন্দুর এতে কী আছে। এসব ভাবতে ইচ্ছে হয় না। বরং সেক্রেটারি পি ডবলিউ ডি-র ঘরে একটু ছুঁ মারি।

–নমস্কার স্যার।

–নমস্কার, কেমন আছেন মিঃ দাস? বসুন চা খাবেন?

–না না থাক। কিছু দরকার নেই।

–তা আপনাদের সেই রবীন্দ্রমূর্তি কী হল? কই পারমিশানের চিঠি তো পেলাম না।

—সেটার খোঁজেই তো স্যার এসেছিলাম।

–হয়ে গেছে?

–কোথায় আর স্যার হল। ডিরেক্টর অফ কালচারকে আমি নিজে দিয়ে গেছি। আলোচনাও হয়েছে। অথচ আজ মনে হল চিঠিটাই যেন ট্রেস করা যাচ্ছে না। তলা থেকে যা করে পাঠাবে। ওঁর তেমন গা নেই।

-আরে এই সবও এ এস,আই এ এসরা বুঝলেন হাইলি ওভাররেটেড। এফিসিয়েন্সি অত্যন্ত লো। পাওয়ার অতিরিক্ত। সব জেনারেল স্ট্রিমের মিডিওকার স্টুডেন্ট। আর আমরা মানে ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার আমরা সব গোড়া থেকে ভাল ছাত্র ছিলাম। যারা সায়ান্স পারেনা তারা আর্টস ফার্টস পড়ে। অথচ দেখুন এখন ওই সিভিল সার্ভিসের ছাপ লাগিয়ে আমাদের ওপর কর্তাতি করে।

-আপনার ওপর আর কী করে, আপনি নিজেই তো সেক্রেটারি।

—আরে সে জানেন তো কত ফাঁইট করে। একটা আই এ এস পোস্টবাইরের কাউকে দেবেনা। তাও আমি শুধু সেক্রেটারি। আই এ এস-দের দেখুন, কমিশনার কাম-সেক্রেটারি, প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি কত কী। বুঝলেন মিঃ দাস যত দিন এই সিভিল সার্ভিসের রিফর্ম না হচ্ছে আমাদের দেশের উন্নতি নেই। কাজই তো হয় না। আপনার নিজের ব্যাপারটাই দেখুন না।

—তাই তো স্যার আপনার কাছে এলাম। কী করা যায় বলুন তো?–সেক্রেটারি কালচারের সঙ্গে দেখা করেছেন? ওঁকে একবার সরাসরি বলে দেখুন। অরিজিনাল চিঠির কপি নিয়ে যাবেন। ওপরে লিখে দেবেন অ্যাডভান্স কপি। কারণ রেগুলার চ্যানেল মানে ডিরেক্টরের থু দিয়ে না গেলে তো অফিসিয়েলি পেয়েছে বলে স্বীকার করবে না। মানে পেলেও অ্যাকশান নেবে না।

—আপনার কী মনে হয় ওঁকে বললে কিছু হবে?

—হলেও হতে পারে। ইনি তো আবার কবি। এই আরেকটা ধান্দা সব ব্যুরোক্র্যাটদের। সকলেই কবি, সকলেই পালা করে প্রাইজ-টাইজ পায়। এটা থেকেই বোঝেন না এ স্টেটের কালচার কী? আপনাদের বেঙ্গলি লিটারেচার তো এত রিচ, কটা আই এ এস লেখক সেখানে? আর যদিইবা থাকে, প্রাইজগুলো কি সব তারাই পায়? আই টেল ইউ মিঃ দাস দিস স্টেট ইজ রুইন্ড বাই আওয়ার ব্যুরোক্র্যাটস…

ওড়িশায় যারা আই এ এস নয়, তারা সবাই ছেলেমেয়েদের আই-এ এস করার জন্য বা আই এ এসের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য প্রাণ দিতে পারে অথচ সর্বদা আই এ এসদের কুৎসাও করে। বরাবর দেখেছি। আমি ওর মধ্যে যাই না। অতঃপর প্রত্যাশিত উত্তর দিয়ে বিদায় নিই। এবারে টারগেট সংস্কৃতি দপ্তরের সচিব। তার ঘরের সামনে ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় প্রাইভেট সেক্রেটারি স্টেনো প্রভৃতির প্রারম্ভিক বাধা উত্তরণ। ঘরে ঢুকে নমস্কারের পালা সেরে বক্তব্য নিবেদন করি। ভদ্রলোকের মুখের ভাবে কোনও বদল দেখা গেল না। নাকি আমিই বুঝতে অপারগ। রংহাড়ির কালি তার ওপর দাড়িভর্তি মুখ। অনেকটা আফ্রিকান আফ্রিকান। যেন জোমো কেনিয়াট্টার ছোট ভাই। মোটেই পরিচিত ওড়িয়া মধ্যবিত্ত উচ্চবর্ণের চেহারা নয়। ভদ্রলোক অবশ্য জাতে ব্রাহ্মণ। যাই হোক কর্তব্য করা দরকার। চিঠিটা ওঁর সামনে দিই। একবার চোখ বুলিয়ে জোমো কেনিয়াট্টার ছোট ভাই বললেন,

—আপনংকর একতা কালচারল অর্গানাইজেসন?

–ইয়েস স্যার।

—আপন তার প্রেসিডেন্ট?

—ইয়েস স্যার।

–আচ্ছা, আজিকালি বঙ্গলারে বিজয় গোস্বামী কণ বঢ়িয়া লেখুছন্তি শুনুছি। আপন তাংক বিষয়রে কিছি জানন্তি?

আমার মাথায় বজ্রঘাত। বাংলা কবিতা পড়ার পাট স্কুল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, চুকে গেছে। রবীন্দ্রনাথ নজরুল ছাড়া কারো এক লাইনও মনে নেই। একতার ঘরোয়া অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি-টাবৃত্তি হয়। আর বাচ্চাদের ফাংশানে সুকুমার রায়। আমার জ্ঞানের বহর সেই অবধি। অতএব মাথা চুলকে বলি,

—ওঁর কবিতা স্যার আমার তেমন পড়া নেই। তবে আপনি যদি কোনও খবর চান ওঁর সম্পর্কে সেটা আমি জোগাড় করে দিতে পারি। বিজয় গোস্বামী সম্বন্ধে একজাক্টলি কী স্যার জানতে চান?

-না না সিমিতি স্পেসিফিক ইনফরমেসন দরকার নাহি। তাংকর কবিতা সম্পর্করে জানিবাকু চাহুথিলি। তা হউক পছরে দেখিবা।

-স্যার আমাদের কেসটা একটু দেখবেন। চিমিনিষ্টারের ইচ্ছে স্ট্যাচু একটা বসুক, আমরা তৈরিও করিয়েছি। এখন ইনস্টল করার পারমিশানটা…

-ইয়েস ইয়েস আই আন্ডারস্ট্যান্ড। বাট ইট মাস্ট কম থ্রু প্রপার চ্যানেল। ডাইরেক্টর ফাঁইল পাঠাইলে তারপর যা করিবার করিবা। আগরুতো কিছি হেই পারিব নি..

অর্থাৎ যে তিমিরে সে তিমিরে। এ দিকে একতার কার্যকরী সদস্যরা রোজ মাথা খাচ্ছে, দাদা খবর পেলেন, পারমিশান হল। সবাইকে ঠেকিয়ে রাখছি স্তোকবাক্যে। অনিলেন্দু পট্টনায়েকের বাড়িতে টেলিফোন করে পাই না। যে ধরে সে আমার পরিচয় জানতে চায় এবং তারপর এক উত্তর সাহেবঅ নাহান্তি। কেন্তে বেলে ফেরিবে কহি পারিবি নি। ব্যস। ঘুম ভেঙে যায় প্রায় প্রতি রাত। সকালে উঠতে পারি না। কাজকর্ম গয়ং গচ্ছ ভাবে চলছে। একদিন আমাদের প্রেসিডেন্সি কলেজের ভাল ছেলে সৌম্যেন (নামের ইংরেজি বানানে যে এখনও ওয়াই যোগ করে বলে যার ডাক নাম ওয়াই, টেলিফোন করে বলল, কলকাতা থেকে বিখ্যাত কবি সুহাস চট্টোপাধ্যায় ভুবনেশ্বরে এসেছেন দুদিনের জন্য। ওড়িয়া সাহিত্য আকাদমির কী যেন অনুষ্ঠানে অতিথি। উঠেছেন পান্থনিবাসে। দেখা করলে কেমন হয়।

আমার এসব কবি-টবিদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। স্কুলে আমাদের ক্লাসে বাংলায় ফার্স্ট হত বিজন। বিজন বসু। পরীক্ষায় ওর লেখা রচনা বাংলার স্যার পরে ক্লাসে পড়ে শোনাতেন। ওর কবিতা ছাপা হত স্কুল ম্যাগাজিনে। ওই বাংলালেখার সম্পাদক। আমার মতো যারা বাংলায় কাঁচা তাদের সঙ্গে পারতপক্ষে কথাই বলত না। একবার হাফইয়ার্লিতে আমার সামনে ওর সিট। ওকে একটা এক্সপ্ল্যানেশান জিজ্ঞাসা করেছি, শুধু কবিতাটার নাম। কিছুতেই বলল না, শুনতে পায়নি এমন ভান করল। পরে শুনেছি বিজন নামকরা কবি হয়েছে, কোন প্রাইভেট কলেজে পড়ায়। বাংলায় লেখালেখি করা মানুষের সঙ্গে ওইটুকুই আমার সম্পর্ক। কাজেই সুহাস চট্টোপাধ্যায় সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণাই নেই।

—ওঁর সঙ্গে দেখা করে কী হবে?

-এই আলাপ করা যাবে আর কি। কলকাতায় ওঁর মতো নামকরা কবিকে এমন হাতের কাছে হয়তো পাব না। কলকাতার সঙ্গেই বা আমাদের আর যোগাযোগ কী? তা ছাড়া আমাদের ঐ রবীন্দ্রমূর্তির ব্যাপারটা ওঁকে বললে হয় না।

–কী হবে বলে? উনি এখানে এসেছেন অতিথি। ওঁর পক্ষে তো এসব নিয়ে কথা বলা সম্ভব নয়।

—না না আমি ওঁর কিছু করার কথা বলছি না। কিন্তু দৈনিক খবর-এ যা বেরিয়েছে সেটা তো ওঁর মতো বাংলা ভাষার লেখক সাহিত্যিকদের জানা দরকার।

–ঠিক আছে। চলো যাওয়া যাক।

পান্থনিবাসে গিয়ে দেখি পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কবি শ্রীসুহাস চট্টোপাধ্যায়কে দোতলায় একখানা ভাল ঘরই দিয়েছে। শুধু দেওয়ালে এসি লাগানোর জায়গায় একটা মস্ত ফোঁকড়। কবি সুহাস চট্টোপাধ্যায় একটি সোফায় বসে। পাতলা লম্বা গড়নের ভদ্রলোক। শরৎচন্দ্র মার্কা সাদা ধবধবে চুল এক মাথা। সামনে ওড়িশা সাহিত্য আকাদমির সম্পাদক কানু মিশ্র আর মধ্যবয়সি শিক্ষিত চেহারার এক ভদ্রমহিলা।

কবি সুহাসের হাঁটুর কাছে সেন্টার টেবিলে একটি চটি বই। যথাবিহিত আলাপ পরিচয়ের পালা। আমরা প্রবাসী বাঙালি একতানামে সাংস্কৃতিক সংস্থায় আছি। ভদ্রমহিলা তিলোত্তমা বিশোয়াল, ওড়িয়া কবি, রমা দেবী মহিলা কলেজে ওড়িয়া বিভাগের প্রধান। কানু মিশ্র এবং তিলোত্তমা বিশোয়াল দুজনেই কবি সুহাসের সামনে গদগদ মুখে ভক্তের মতো বসে। আমরাও গদগদ ভাব মুখে আনতে চেষ্টা করি। কবি সুহাস একটি চটি বই টেবিল থেকে তুলে হাতে নিয়ে খুললেন। এ পাতা ও পাতা চোখ বোলাতে বোলাতে বললেন,

—তিলোত্তমার কবিতা। ইংরিজি অনুবাদ। কী সুন্দর। ঠিক বাংলার মতো। সেই গ্রাম সেই গাছপালা ধান ক্ষেত মানুষ প্রকৃতি, একই অনুভূতি। কোনও তফাত নেই ওড়িয়া আর বাংলায়।

তিলোত্তমা নববধুর মতো সলজ্জ হেসে সবিনয়ে মাথা নত করে রইলেন। আমি অমলকুমার দাস স্বর্গত হরিচরণ দাস বি এ বি এল, কংগ্রেসকর্মী জাতীয়তাবাদীর পুত্র, জন্ম থেকে দেখেছি দিদির হাতে ক্রসস্টিচে গেরুয়া সাদা সবুজে মহান মন্ত্র লতার ভঙ্গিতে সেলাই করা ঘরের দরজার মাথায় সযত্নে বাঁধানো একজাতি এক প্রাণ একতা। অতএব তৎক্ষণাৎ সুর মেলাই,

–নিশ্চয় নিশ্চয়, সে তো বটেই। এক দেশ, পাশাপাশি থাকা। কত শত শত বছরের সম্পর্ক। কবি সুহাস হাসি হাসি মুখে বলে চলেন,

–হ্যাঁ। সব কিছুই আমাদের মতো। জানেন ইনি–কানু মিশ্রকে দেখিয়ে বলছিলেন, এখানেও নাকি কলকাতার মতো বলিষ্ঠ নবনাট্য আন্দোলন আছে। প্রচুর প্রতিবাদী নাটক লেখা হয়। নিয়মিত অভিনয় চলে। কটকে অন্নদা থিয়েটার খুব বিখ্যাত। আপনারা দেখেছেন নিশ্চয়? প্রশ্নটা আমাকে ও সৌম্যেনকে লক্ষ্য করে।

আমি একটু অবাক। এক যুগ ওড়িশাবাসে মাঝে মাধ্যে সারা রাত ধরে পালা বা যাত্রা অভিনয়ের কথা শুনি, কিন্তু নিয়মিতভাবে টিকিট বিক্রি করে নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে এমনটি তো জানা নেই। এক সময়ে কটকেনাটক করত এক বাঙালি দম্পতি, উকিল স্বামী অধ্যাপিকা স্ত্রী। তারা দুজনেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্র পড়বার সময় বহুরূপীর নাটক দেখে মোহিত ও উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। কটকে ফিরে গিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বাংলায় বিদেশি নাটকের ভাবানুবাদ মঞ্চস্থ করলেন। গাঁটের পয়সা খরচ করে। দর্শক সব বিনেপয়সার আমন্ত্রিত। তা সত্ত্বেও দু-চারটির বেশি শো করতে পারেননি। স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে মাগনায় নাটক দেখার শখও নেই। তারপর এঁরা ওড়িয়াতে লিখলেন সামাজিক নাটক, এখানে ওখানে বিভিন্ন জেলা সদরে কটি শো হল। আর্থিক সাফল্য শূন্য। এখন আর করেন না। এঁদের দলের দু-চারটি ছেলে একতার ইনহাউস নাটকে অভিনয় করেছে। তাই ভাল করে জানি। সুতরাং আস্তে করে না বলে পারলাম না।

-আমি তো এখানে বেশ কবছর আছি। কই অন্নদা থিয়েটারের নাম তো শুনিনি। কবি সুহাস উত্তেজিত হয়ে বললেন–

-এই তো বাঙালিদের দোষ। সব সময় নিজেদের সাহিত্য নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে মেতে থাকে। অন্যকে জানবার, অন্যের কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করবার মানসিকতা নেই। কানু মিশ্র এতক্ষণ একটু বিব্রত মুখে শুনছিল, এখন তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,

—নাহি নাহি, সিমিতি কিছি নুহে। ঘটনা কণ কি, কেত্তে দিন হেলা অন্নদা থিয়েটার বন্ধ অছি। তাই দাসবাবু জানি নাহান্তি।

এবারে বিরক্ত লাগে। কটক ভুবনেশ্বর খোরদায় যত দল বিভিন্ন প্রোদানুষ্ঠান করে প্রত্যেকের নাড়ীনক্ষত্র আমার জানা। বিলিতি ঢং-এর কনসার্ট, ওড়িশি নৃত্য, ক্ল্যাসিক্যাল গান, বেহালা বাজনা কে কেমন করে, কার কত রেট,কী বাহানা সব আমার নখদর্পণে। এই তো বিখ্যাত ওড়িশি নাচিয়ে ওড়িশি গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর ঝুমঝুম মহান্তির প্রচণ্ড শুচিবাই, ওঁর ছাত্রীদের একতার বার্ষিক সমাবেশে নাচতে দেন না। বলেন হোটেলের খিয়াপিয়া সাঙ্গরে ওড়িশি চালিবনি। হোটেল স্বস্তি, কি হোটেল মেঘদূত-এর ব্যাংকোয়েট হল যেন বাইনাচ বা ক্যাবারের জায়গা এমন ভাব। কানু মিশ্রকে জব্দ করার জন্য বলি,

—আচ্ছা কটকে অন্নদা থিয়েটারে কবে লাস্ট শো হয়েছিল? কী নাটক ছিল সেটা কানু মিশ্রর মনে নেই। তিলোত্তমা বিশোয়ালও ঠিক জানেন না। কবি সুহাস চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এসব কিছুই কানে নিচ্ছেন না। তিনি তিলোত্তমার কবিতার ইংরিজি অনুবাদের ইতস্তত পাতা ওল্টাচ্ছেন আর বলে যাচ্ছেন সত্যি সবই আমাদের মতো। কোনও ভেদ নেই কোনও ভেদ নেই।

তিলোত্তমা বিশোয়াল কানু মিশ্রকে কবি সুহাসের খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো দেখাশুনা করতে অনুরোধ করে উঠে পড়েন, তাঁর কলেজে পরীক্ষা সংক্রান্ত কী কাজ আছে। কানু মিশ্র নট নড়ন চড়ন। কী আর করা। আমিও সৌম্যেনকে নিয়ে উঠে পড়ি। কানু মিশ্রর সামনে তো রবীন্দ্র মুর্তিটুর্তির ব্যাপার তোলা যাবে না। সে তো এখন বসে বসে আরও জ্ঞান দিয়ে যাবে, ওড়িয়াদের কী কী ঠিক বাঙালিদের মতো।

একতার আমরা সবাই খেয়াল করেছি স্থানীয় ওড়িয়ারা কথায় কথায় একটা মজার ইডিয়ম ব্যবহার করে, আম্ভে আউবঙ্গালি মানে, আমরা আর বাঙালিরা। যেমন সব পাঁচমিশালি পার্টিতে শোনা যায় আম্ভে আউ বঙ্গালি মানে সবুবেলে মাছ খাউঁচু। তারপর নির্ঘাৎ দেখব মিশ্র পাণিগ্রাহী পট্টনায়েক মহান্তি-মিস্টারনা হোক মিসেস গুটি গুটি চলেছে নিরামিষ টেবিলের দিকে, আজি সোম গুরু (বৃহস্পতি) শনিবার অথবা কার্তিকমাস বা অমুক ও বা ব্রত কিংবা সংক্রান্তি অতএব সাদা খাইবা, নিরামিষ আহার।

আম্ভে আউ বঙ্গালি মানে ধুয়াটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ভুবনেশ্বরে আসার পর পরই অফিসে এক বিড়াখানায় বড়বাবুর অবসর গ্রহণ উপলক্ষে স্টাফের সঙ্গে দ্বিপ্রহরিক আহারে। আতপচালের ভাত অড়হর ডাল, রসুন দিয়ে শাক, ফুলকপি আলুর তরকারি এবং কড়া ভাজা ছোট পোনার ঝোল। দুটি পদই পেঁয়াজ-রসুন গরগরে অতএব যথাসম্ভব ঝোল বাদ দিয়ে খাচ্ছি। এমন সময় প্রচুর পেঁয়াজ কাঁচালঙ্কা ও সামান্য টমাটো শশাকুচি ভর্তি পাতলা দই হাতা হাতা দিয়ে গেল। শেষ হতে না হতে সমস্বরে রব উঠল ক্ষীরি কাঁই, ক্ষীরি আন। পিয়ন নিরঞ্জনের সসম্ভ্রমে পরিবেশন ক্ষীরি সার ক্ষীরি। একটা ধোঁওয়াওঠা মাটির খুরি এঁটো পাতায় ঠক করে বসল। পাশে বসা বিদায়ী বড়বাবু সাগ্রহে ব্যাখ্যা করলেন, আম্ভে আউ বঙ্গালিমানে সার বহুৎ মিঠা খাউঁচু। আপনমানংকর পায়েস আউ আম ক্ষীরি। একা জিনিস। নিয়ন্তু সার। আরে নিরঅ আউ টিকিএ সারকু দেলু। বলাবাহুল্য তাকেও আউ টিকিএ আরও একটু।

ইতিমধ্যে আমি সাবধানে একটু মুখে দিয়েছি–গরম ফ্যানা ভাতে খানেকটা দুধ ঢালা কিটকিটে মিষ্টি মাঝে মাঝে কিশমিশ ও কাঁচা চিনেবাদাম। হে ঈশ্বর এ কী পরীক্ষায় আমাকে ফেললে। এ যে ধর্মসঙ্কট। আমি কিনা খাঁটি ক্যালকেশিয়ান। তিন পুরুষ কলকাতায় ক্লিয়ার পেডিগ্রি। আমার জিভ তৈরি হয়েছে দ্বারিক ভীমনগনকুড় হয়ে বাঞ্ছারামে। বাড়িতে পায়েসে গোবিভোগ চাল আর দুধের অনুপাত এক আর দশ। আর আমাকে কিনা এ পদার্থ পায়েস হিসাবে মেনে নিতে হল। তারপর যে কোনও নেমন্তন্নে ক্ষীরি বস্তুটি দেখলেই বলি মাপ করবেন। সুগারের প্রবলেম। মিষ্টি বারণ। অতঃপর জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কত ক্ষীরিকে পায়েস হিসেবে দেখাবার সুযোগ কানু মিশ্ররা সদ্ব্যবহার করবে কে জানে। নাট্য আন্দোলন তো সামান্য দৃষ্টান্ত।

কবি তিলোত্তমা বিশোয়লের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নীচে নামি। একতা ক্লাবের কাজকর্ম সম্পর্কে দু-চারটে মামুলি প্রশ্নোত্তরের পরে ভদ্রমহিলা একটু ইতস্তত করে বললেন তার একটি অনুরোধ আছে। বাংলা হাতে লেখা একটি চিঠি তিনি পেয়েছেন সেটি কি আমরা একটু পড়ে দিতে পারি। আরও জানালেন যে তিনি বিশ্বভারতীর এম-এ, বাংলা প্রচুর পড়েন, স্বদেশ নেন নিয়মিত, কলকাতার অনিলদা মুক্তিদার সঙ্গে সর্বদা যোগাযোগ। সকলেরই তিনি আশীর্বাদধন্যা। কলকাতা বইমেলা, সাহিত্য আকাদেমির আলোচনা অনুষ্ঠানগুলিতে নিমন্ত্রণ পান। শুধুহাতে লেখা বাংলা পাঠোদ্ধারে একটু যা অসুবিধা। আমি যদি দয়া করে ইত্যাদি। বেরুবার মুখে লাউঞ্জে বসা হল। ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে দিলেন তিলোত্তমা। আশ্চর্য এত বছর বাদে আজও চিঠিটির প্রায় প্রতিটি ছত্র আমার মনে আছে।

স্নেহের তিলোত্তমা,

এত সুন্দর বাংলা তুমি কোথায় শিখলে? শান্তিনিকেতনে? তোমার চিঠি পড়ে সত্যি আমি অভিভূত। লিখেছ আমার আকাদেমি পুরস্কার পাওয়া বই কলকাতার বিশু তুমি ওড়িয়াতে অনুবাদ করতে চাও। আমার সানন্দ সম্মতি রইল। কিছু কিছু অনুবাদ ওড়িয়া পত্র পত্রিকায় প্রকাশনার কথাও ভেবেছ। সে তো অতি উত্তম প্রস্তাব। ছাপা হলে আমাকে খবর দিও।

গত মাসে ভূপালে কালিদাস সম্মেলনে রজনীকান্ত মিশ্রর সঙ্গে দেখা। তার শ্রীগণেশ সম্মান পাওয়ার পর এই প্রথম যোগাযোগ পুরস্কৃত কাব্য আজিকার পার্বতীর অংশবিশেষ পাঠ করলেন। সত্যি অপূর্ব। যোগ্য পাত্রেই সম্মান অর্পিত হয়েছে। এমন শক্তিশালী কলম বাংলায় কই। শ্রীনিশিকান্ত পট্টনায়েক খবর কী? বিদ্যাপীঠ পুরস্কার পাওয়ার সময় তো উনি দিল্লিতেই ছিলেন। শোনা যাচ্ছে অবসর গ্রহণের পর সাহিত্য আকাদমি বা ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের দায়িত্ব নেবেন। ওঁর নির্বাচিত কবিতাগুচ্ছের ইংরেজি অনুবাদ জগা কালিয়া অ্যান্ড আদার পোয়েমসআমাকে এক খণ্ড পাঠিয়েছিলেন। ওড়িয়া কবিদের যে বৈশিষ্ট্যটি আমাকে গভীর ভাবে নাড়া দেয় সেটা হল তাঁদের ঐতিহ্য চেতনা। শিবপার্বতীর কাহিনী জগন্নাথদেবের মাহাত্ম্য আজও তাদের প্রেরণা জোগায়। বাঙালি কবিদের ঐতিহ্যের বা মাটির সঙ্গে এমন যোগ আর দেখা যায় না। সত্যি জনজীবন থেকে আমরা বড় দুরে সরে এসেছি।

শুনলাম ওড়িশা সরকারের সংস্কৃতি দপ্তরের ভার নিয়েছেন ব্রজেন্দ্র রথ। গুয়াহাটিতে পূর্বাঞ্চল কবি সম্মেলনে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ভারীন বিনয়ী সংবেদনশীল। একজন কবির ঠিক যেমনটি হওয়ার কথা। তোমার সঙ্গে তো বোধহয় এঁদের যোগাযোগ হয়। সবাইকে আমার প্রীতিও শুভেচ্ছা জানিও।

লিখেছ ভুবনেশ্বর গেলে যেন তোমাদের বাড়িতে উঠি। তোমার আতিথেয়তার তুলনা নেই। গতবারে তোমার স্বামী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্পগুজবের সন্ধ্যাটি স্মরণীয় হয়ে আছে। তোমার ছেলে বুরলা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে আর মেয়ে ভুবনেশ্বরে জ্যাভেরিয়ান ইনস্টিটিউটে এম বি এ কোর্স করছে জেনে সুখী হলাম। শ্রীযুক্ত বিশোয়াল তো এখন সেক্রেটারিয়েটে মৎসদপ্তরের উঁচু পদে আছে। তাই না? সপরিবারে তোমাদের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি।

ইতি
শুভাকাঙ্খী
নরেন্দ্রনাথ চাকলাদার

আমার জীবনের সঙ্গে এদিনের ঘটনা বা এ চিঠির কোনও সম্বন্ধ নেই। তবু প্রতিটি শব্দ প্রতিটি ছত্র আজও মনে আছে। কেন কে জানে। কার্যকারণ যোগ পাই না, যুক্তি তোনয়ই। সে সময় কবি সুহাসের কথা শুনে,নরেন্দ্রনাথ চাকলাদারের চিঠিটা পড়ে কেমন একটা কষ্ট হয়েছিল। যেন কেউ আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। অথচ কে কবি নরেন্দ্রনাথ চাকলাদার তার সঙ্গে আমার কস্মিনকালে কোনও যোগাযোগ নেই। যেমন নেই তিলোত্তমা বিশোয়ালের সঙ্গে। তাহলে এদের মধ্যে চিঠি চালাচালিতে আমার গায়ে হুল ফোটে কেন। বুঝতে পারি না। তাই ছায়া দেবনাথকে এসব কথা বলি না। যে সব ঘটনা আদ্যোপান্ত বেশ যুক্তিটুক্তি দিয়ে পরিষ্কার বুঝি, সেগুলোই শুধু বলি। অন্য একজনকে কি মনের সব কথা বলা যায়। আমি তো মৈত্রেয়ীকেই কত কথা বলিনি। ছায়া দেবনাথ তো কোথাকার কে। সেদিনকার মেয়ে। পরের দিন যখন হাসি হাসি মুখে এসে চেয়ার টেনে বসবে এসব স্মৃতি কিছুই মনে পড়ে না এমন ভান করব। জীবনের বেশির ভাগ পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ মানুষের সঙ্গে আমরা তো ভানই করি। আসল কথা সর্বদা মনের কোন অতলে চাপা।

–বাঃ এক দিন দেখি ভালই ঘুমাইসেন, সহাস্য মন্তব্য ছায়া দেবনাথের। ওর এই ঘরে ঢুকে প্রেসার মাপা, গায়ের তাপ দেখা, এসব আজকাল স্রেফ ভড়ং বলে মনে হয় অমলের। পোশাকটাও তো অদ্ভুত, নার্সের ক্যাপ নেই মাথায়। পরনে নেই সাদা থান, গায়ে আবার ডাক্তারদের মতো সাদা কোট। জিজ্ঞাসা করলে বলে ও নাকি স্পেশাল নার্স, ট্রেনিং-এ আছে। রীতিমতো সন্দেহজনক। মেয়েটা এক নম্বরের মিথ্যেবাদী। আজকে ঘরে ঢুকেই সবেধন নীলমণি চেয়ারটা টেনে অমলের কাছে এসে বসে। অমল যথারীতি জানালার পাশে খাটে আধবসা।

–আচ্ছা আপনার হিরো আর হিরোইন দুইজন দুইটা শহরে। কখনও চিঠিপত্র ল্যাখে না? একটা.জব্বর এ্যামপত্র না হইলে আর কাহিনী কি।

-দুর! এসব মান্ধাতার আমলের বাঙালি ন্যাকামি রাখো তো। প্রেমপত্র, ফুলকাটা নীলরঙের চিঠির কাগজ, পাখীআঁকা নীল রঙের খামে যাও পাখী বলো তারে সে যেন ভোলে না মোরে।

-হা হা হা, হি হি হি। এসব ছিল নাকি আপনাগো ব্যাংগলে। ছায়া দেবনাথ হেসে কুটোপাটি। একবার শুনেই তার মুখস্থ, বারবার আওড়ায় যাও পাখী আঃ কী হচ্ছে ফাজলামি, ধমক লাগায় অমল। হাসি থামায় ছায়া।

-তাহলে আপনার কাহিনীতে চিঠিপত্রের কারবার নাই বলসেন?

আছে বৈকি চিঠিপত্রের কারবার। পুরো একতাগোষ্ঠী প্রেমিকের মতো অধীর প্রতীক্ষায় ছিল একটি উত্তরের। অবশেষে বাইশে শ্রাবণের দিনদশেক আগে অমলের হাতে পৌঁছাল সেই বহু প্রত্যাশিত পত্র। নীলনয় বালি রঙের খামে, পাখীর ছবির বদলে বেগুনী সীলমোহরে আবছা ডিপার্টমেন্ট অফ কালচার, গভনমেন্ট অফ ওড়িশা। দুরু দুরু বক্ষে প্রেমপত্রটি খোলা হল। সরকার অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছেন যে একতা সাংস্কৃতিক সংস্থার রবীন্দ্রমণ্ডপে রবীন্দ্রমুর্তি উপহারদানের প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করছেন কারণ সরকারি গৃহে বেসরকারি দান গ্রহণ নিয়ম বহির্ভূত।

দু লাইনের সংক্ষিপ্ত চিঠি। অমল তবু বার কয়েক পড়ে। সবসুদ্ধ ছত্রিশটা শব্দ। কয়েকটি মাত্র শব্দে, দুটি মাত্র ছত্রে লুকিয়ে আছে কত অসীম ক্ষমতা। একটি অণুর অন্তরে হিরোসিমা। বাইরে তার প্রকাশে অমলকুমার দাসের পুরো দুনিয়াটাই বিধ্বস্ত হয়ে যেতে পারে। আর তার তেজস্ক্রিয়ার রেশ মারক ব্যাধি হয়ে কত জীবন কত সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে দেবে হয়তো চিরতরে। একযুগ ধরে যে অস্তিত্ব সে তিল তিল করে গড়ে তুলেছে, যে বিশাল কাট আউট সাইজে আমি–যেন জয়ললিতা কি অমিতাভ বচ্চন-আজ তার পায়ের তলায় শক্ত ভিতটা কই। সবচেয়ে বড় কথা মৈত্রেয়ী। তার সামনে অমল দাঁড়াবে কোন মুখ নিয়ে। যে অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তাদের মরে হেজে যাওয়া সম্পর্কে এক নতুন জোয়ার আসব আসব করছে—সেটাই যদি না হল তাহলে স্রোতটার পরিণতি কী?

বা, এত সহজে অমলকুমার দাস হার মানবে না। তাছাড়া সরকারের এরকম মত শেষ কথা হতেই পারে না। মানে যাকে আদালতের ভাষায় বলে উইদাউট অ্যাপ্লাইং মাইন্ড, যথাবিহিত মনঃসংযোগ না করে কে না কে দুম করে দুলাইন লিখে দিয়েছে। যতসব রুল অন্তপ্রাণ কেরানি সেকশান অফিসারের কাজ। উচ্চস্তরের কেউ হয়তো পড়েইনি। অভ্যাসমতো না দেখে সই মেরেছে। একেই তো বলে আমলাতন্ত্র।

অমল বেরিয়ে পড়ে। সেক্রেটারিয়েটে তার প্রথম টারগেট সংস্কৃতি দপ্তর। পি এ প্রাইভেট সেক্রেটারি সবাইকে সাধ্যসাধনা যথোচিত পূজানৈবেদ্য নিবেদন। আপাতত জলখিয়ার প্রতিশ্রুতি ও অদূর ভবিষ্যতে একতার অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণপত্র। দয়ার প্রাণ একজন ফাঁইলটি খুঁজে নিয়ে এলেন। অমলের চোখের সামনে এখন ফাঁইলের পাতায় বিস্তারিত নোটশিট, একতা ক্লাব একটি সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক সংস্থা বলে দাবি করে বটে কিন্তু এটি আসলে এক অনওড়িয়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এর বেশির ভাগ সদস্য বহিরাগত, একটি প্রতিবেশী রাজ্যের। বম্বে থেকে আর্টিস্ট এনে এরা হিন্দি ফিল্ম সঙ্গীত পরিবেশন করে প্রচুর মুনাফা লোটে। ওড়িশার মাটিতে এরা এক ঐতিহ্যবিরোধী অপসংস্কৃতির বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে (উদাহরণ দৈনিক খবর তারিখ এত সন এত) দেখা যায় জনমত সংস্থাটির ঘোর বিরোধী। সন্দেহহতে পারে এমন একটি সংস্থার রবীন্দ্রমূর্তি স্থাপনের প্রয়াসে গভীর ষড়যন্ত্র আছে। ইত্যাদি।

অমল পড়ে যায় বটে কিন্তু প্রথমে যেন বুঝতে পারেনা। আবার পড়ে। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থে নির্মিত সভাঘরটিতে যে প্রথমে রবীন্দ্রনাথের একটি বিশাল চিত্র ছিল এবং এই সভাঘরটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যে রাজ্য সরকারের এ সব প্রসঙ্গের বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই। যেন মূর্তিপ্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি একতার এক হঠাৎ উৎপাত। নোট-এর তলায় সই, এ পট্টনায়ক। অনিলেন্দু নিজের হাতে লেখা সুচিন্তিত মতামত। ফাঁইলটা ফেরত দিয়ে অমল খানিকক্ষণ বসে থাকে। সরকারের সিদ্ধান্ত বলাবাহুল্য অনিলেন্দুর মন্তব্যের ভিত্তিতে। সংস্কৃতি দপ্তরের সচিব শ্ৰীব্রজেন্দ্র রথ আই এ এস সংবেদনশীল কবি। কলকাতায় বাঙালি কবিদের বন্ধু। তারই নির্দেশে সরকারের উত্তর লেখা।

অমল সোজা চলে যায় মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে। আগে থেকে বন্দোবস্ত না করে সাক্ষাতের চেষ্টা কেবল তার মতো দুকান কাটা সর্বত্রগামী জনসংযোগ বিশেষজ্ঞর পক্ষেই সম্ভব। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। অবশেষে সাক্ষাৎ। একতাকে লেখা সংস্কৃতি দপ্তরের চিঠিটা অমল মুখ্যমন্ত্রীর সামনে মেলে ধরে। তিনি চোখ বোলান নীরবে। অমল দৈনিক খবর-এর প্রতিবেদনটির কথা তোলে। তাঁ, মুখ্যমন্ত্রীর জানা। ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক, রাজনীতি ঢুকে গেছে, নিস্তেজ গলায় যোগ করেন। ভাববাচ্য। যেন ঝড়বৃষ্টি বাদলার মতো প্রাকৃতিক নিয়মে আপনা-আপনি হয়েছে। কোনও মানবশক্তির সক্রিয় ভূমিকা নেই।

-স্যার আপনার কথাতেই মুর্তি গড়তে দিয়েছিলাম, সবিনয়ে মনে করায় অমল। নিরুপায় ভঙ্গিতে হাত ওল্টান মুখ্যমন্ত্রী।

—দেখ, জনমত রবীন্দ্রনাথের মূর্তি প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে। আমি কী করব। জনমত গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা এবং সংবাদপত্রের মালিকানায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের স্বার্থ ইত্যাদি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যেত। কিন্তু অমল তুলতে পারল না। ভোলার অধিকার কি তার ছিল? সে তো এখানে বহিরাগত, এ মাটিতে তার শিকড় নেই, কেউ তার আপন নয়। কোনও রাজনৈতিক দল, কোনও সংস্থা তার হয়ে কড়ে আঙুলটি ওঠাবে না। সংবাদপত্র নেহাত করুণা হলে নীরব থাকবে,নইলে বিরোধিতা করবে। যেমন এ ক্ষেত্রে করেছে। অতএব সে শুধু বলে

-স্যার, আপনার কংগ্রেস দল থেকেই প্রস্তাবটা এসেছিল। ওয়েস্ট বেঙ্গলের হেমেন মিত্রর কথাটা নিশ্চয় মনে আছে?

সামান্য মাথা হেলালেন মুখ্যমন্ত্রী, হ্যাঁ। অমল অপেক্ষা করে। মুখ্যমন্ত্রী আবার হাত ওল্টান—যেন ওই একটি মুদ্রাই মুখ্যমন্ত্রীপদে স্বাভাবিক,

–পাবলিক হস্টাইল। কিছু করবার নেই।

-কিন্তু স্যার আমরা যে মূর্তিটা গড়িয়ে ফেলেছি। ভুবনেশ্বরে সেটা আনানো হয়ে গেছে। ফাংশানের প্রোগ্রাম সব রেডি। শুধু তো মূর্তি বসানো নয়, তার সঙ্গে একটা নাটক হবে। কলকাতার বিখ্যাত শুভনাট্য সংস্থা আসবে। রবীন্দ্র মণ্ডপ বুকিং হয়ে গেছে, তাদের অ্যাডভান্স দিয়েছি, কার্ড ছাপানো অন্যান্য ব্যবস্থা সব কমপ্লিট। এত কাকুতি মিনতি অমল জীবনে আর কখনও করে নি (অবশ্য টাকার কথাটা বানানো। শুধু টিকিটের খরচ দেওয়া হয়েছে)। যেন একশো বছর আগের কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা। বিয়ের আসর থেকে পাত্র উঠে চলে যাচ্ছে, যে কোনও মূল্যে তাকে সম্প্রদান সারতে হবে, নইলে জাত যাবে। সে আর সে থাকবেনা। গল্পে উপন্যাসে সিনেমায় এই পরিস্থিতিতে একজন উদার তরুণের পরিত্রাতা হিসেবে উদয় হয়—বলাবাহুল্য তিনি নায়ক এবং আসল পাত্রের চেয়ে সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ-কিন্তু অমল কুমারের কাহিনী কল্পনাপ্রসূত, যা হলে ভাল হয় এমন প্রত্যাশাপূরণ নয়। নেহাৎ প্রতিদিন যা ঘটে। অতএব একই রকম নিস্তেজ গলায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন,

–ফাংশানটা পিছিয়ে দাও। পাবলিক মেমরি ইজ সর্ট। আজকে হৈ চৈ করছে ব্যাপারটা গরম আছে বলে। কিছুদিন বাদে ভুলে যাবে।

—তাহলে স্যার একটা টেনটেটিভ ডেট কাইন্ডলি যদি দেন। জাহাজড়োবা যাত্রীর ভেসে থাকবার শেষ চেষ্টা। একখানা তক্তা অবলম্বন। আপাতনির্দিষ্ট তারিখের আশ্রয়ে মানরক্ষা। পৃথিবীর কাছে অমলকুমার দাসের মুখ দেখানোর শেষ আশা।

—সে পরে দেখা যাবে, মুখ্যমন্ত্রী ঘন্টি বাজান। পরবর্তী দর্শনপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বলবেন। অমলের জন্য আর সময় নেই।

-নমস্কার স্যার কথাটা একটু মনে রাখবেন, অমল উঠে পড়ে। উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী অতি অল্প মাথা হেলান।

অফিসে ফিরে আসে অমল। ভাবতে চেষ্টা করে যেন কিছুই হয়নি। সত্যি এমন কি হয়েছে। বড়দা ঠিকই বলেছিলেন ওড়িশাতে রবীন্দ্রনাথের একটা মূর্তি বসল কি বসল না তাতে কার কী এসে যায়। মূর্তিটি পড়ে আছে অমলের গ্যারেজে। থাক না। তার জীবিকা দেশে নতুন শিল্পোদ্যোগে সহায়তা। আজ ভুবনেশ্বর কাল হয়তো হায়দ্রাবাদ বা বম্বে। আর পাঁচজন প্রবাসী বাঙালির সঙ্গে মিলে একটা ক্লাব করেছে। সেখানে বিধিমতো এর বউ-এর গান ওর মেয়ের নাচ কি ছেলের আবৃত্তি হওয়ার কথা। অত্যন্ত নিচু পর্দায়। স্থানীয় জনগণের অর্থাৎ প্রভাবশালী মধ্যবিত্তের গায়ে জ্বালা ধরাবে না। স্থায়ী কিছু করার স্বপ্ন, অন্য মাটিতে শিকড় ফেলার চেষ্টা কি প্রবাসীর সাজে। ওড়িশা কর্ণাটক মহারাষ্ট্র গুজরাটে কেন বাঙালির নিজস্ব সত্তা বজায় রাখার চেষ্টা? বাঙালির আছেটাই কী?

ঠাকুরদার সময় কবেই গত। সত্তরের দশকে সে জীবিকা অর্জনে নেমেছে। তখন থেকে একটানা দেখে আসছে ব্যবসাবাণিজ্য শিল্পায়নে অর্থাৎ তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বাঙালির সম্পূর্ণ ব্যর্থতা। কলকাতায় তার চাকরি জীবনে প্রথম কবছরের কথা মনে পড়লে এখন আর ক্ষোভ দুঃখ রাগ কিছুই হয় না। শুধু কতগুলো ছবি মনে ভাসে। প্রথম ছবিতে টিটাগড় বা হাওড়ার একটি বিরাট শেড, বিশাল প্রাগৈতিহাসিক চেহারার যন্ত্রপাতি তলায় শিরোনাম,উপনিবেশে শিল্পোদ্যোগ ১৮৮০। এর মধ্যে একটির কাজকর্ম দেখাশুনার দায়িত্ব ছিল অমলের ১৯১৯ সালে। দ্বিতীয় ছবিতে বড় সাহেব বারীন মিটার, সুদর্শন অভিজাত একদা ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান, পরনে নিখুঁত থ্রিপিস স্যুট, মুখে পাইপ, দেখলেই বোঝা যায় থ্রি কোর্স লাঞ্চ খান টলি বা বেঙ্গল ক্লাবে ড্রাই মার্টিনি সহ, জিভের স্বাদ তৈরি হয়েছে। নির্ভুল সাহেবি ইংরিজি উচ্চারণে। এ ছবির তলায় লেখা, কোই হ্যায় জমানা, ১৯৩৮। অমল অবশ্য তার অধীনে কাজ করেছে ১৯১৯ থেকে। তৃতীয় চিত্রটিতে বিরাট পোস্টার তাতে একসার উদ্ধত মুষ্টি বাহু, মাধো গিরিধারি পঞ্চা জগু মধু মানিকদের। পিছনে এক সারি লাল তেরঙা পতাকা। তলায় লেখা জাতীয় শ্রমিক সংহতি ১৯৭১। যে যার সময়ের খাঁচায় আটকা। সেই টাইম মেসিন।

কিন্তু কাস্তে হাতে ভয়ঙ্কর দর্শন সময়প্রভু তো কাউকে ছেড়ে দেন না। ছবি সব মুছে যায় কোলাহলে, শ্লোগানের পর শ্লোগান, ভাঙচুর, গেট বন্ধ কারখানা। বারীন মিটারের পাইপটা পায়ে পায়ে ভেঙে টুকরো টুকরো, টাই মেঝেতে গড়াগড়ি। আজও এই ১৯১৪ সালেও অমলের কানে ভাসে আকাশ ফাটানো পুঁজি তাড়ানো দেবব্রত মুখুজ্যে কি বেণীপদ বাঁড়ুজ্যের জ্বালাময়ী বক্তৃতা। না, এঁরা কারখানার মজদুর নন, পেশাদার শ্রমিক নেতা। জাতে তালাওয়ালা। চাবিওয়ালারা যেমন হেঁকে হেঁকে যায় তাদের চাবি তৈরির কুশলতা, এঁরা জারি করে বেড়ান তালা লাগানোর প্রতিভা। এঁদের ভাষা বাংলা হিন্দি, হিন্দ বাংলা, হিন্দি হিন্দি বাংলা, হিন্দি হিন্দি….। যেন হিন্দি বললেই হিন্দুস্থানের সব মজদুর এক হবে, যেন হিন্দি হিন্দুস্থানের মজদুরদেরই ভাষা, হিন্দুস্থানি পুঁজিপতির ভাষা নয়, যেন হিন্দিভাষী বাঙালি মজদুরের মুখের গ্রাস হিন্দিভাষী গুজরাটি মরাঠি কন্নড় মজদুর কেড়ে নেবে না। যে জাত নিজেদের ছেলেমেয়েরা কী খাবে কেমন করে বাঁচবে কী ভাষা বলবে চিন্তা করে না তাদেরই একজন অমলকুমার দাস। ভারতীয় উপমহাদেশে তার জন্মকর্ম এমন সময়ে যখন বাঙালি মানে একটি দুর্ভাগ্য; পৃথিবীর একমাত্র মানবগোষ্ঠী যারা পরাধীনতার বদলে বেছে নিয়েছে দাসত্ব।

কী লাভ বাঙালি হয়ে। অমল তো বাংলা ভাষাটাই তেমন জানে না। বাংলা সাহিত্যে তার দৌড় স্কুলের দরজা ডিঙোনো পর্যন্ত। বাঙালির চিত্রকলা ভাস্কর্য তার কাছে কটা আবছা নাম, অবনীন্দ্রনাথ কি নন্দলাল দেবীপ্রসাদ বা রামকিঙ্কর। খবরের কাগজে পড়েছে। বটে জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার চুরি করে কোন সাহেব নোবেল প্রাইজ পেয়েছে। সত্যেন বসু আইনস্টাইনের খুব নীচে নন। কবে কোন্ বাঙালি বিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সম্মান লাভ করেছেন বা করেননি এসব নিয়ে তার রক্ত গরম হয় না। শুধু বাংলা গান শুনতে তার ভাল লাগে, বাঙালি রান্না খেয়ে তার তৃপ্তি। মাত্র এটুকুর জন্য ওড়িশা কর্ণাটক মহারাষ্ট্র গুজরাটে অর্থাৎ ইন্ডিয়ায় স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা হাস্যকর নয় কি? ইন্ডিয়ান পরিচয়ই যথেষ্ট। হ্যাঁ যথেষ্ট।

যথেষ্ট হলেও চিঠিটা অমলের সামনে। এখনও। টেলিফোনে লাগায় একতার সেক্রেটারি সুজিতকে। জরুরি বৈঠক ডাকা দরকার। কঘণ্টার নোটিস হলেও একজিকিউটিভ কমিটির সকলেই হাজির। পত্রবোমাটি পড়ল। বিস্ফোরণ আলোড়ন জখম যন্ত্রণা। সকলের একসঙ্গে কথা। ক্ষোভ রাগ দুঃখ। একমাত্র সুজিত চুপ। অমল জিজ্ঞাসা করে,

—কী হল সুজিত? তোমার দেখছি কোনও রিঅ্যাকসানই নেই।

—আমি দাদা প্রথম থেকেই ভয়ে ভয়ে ছিলাম। ব্র্যহস্পর্শ তো। পিণ্ডি জ্বলে যায় অমলের। ক্যারাদের ক্যাওড়ামি। পাঁজি দেখে ওঠাবসা।

—শনি রাহুফাহু কিছু করল বলছ?

-না দাদা তার চেয়েও ভয়ঙ্কর। ওড়িয়াতে একটা প্রবাদ আছে, কাদের কাছ থেকে সাবধানে থাকতে হয়—পুরী ব্রাহ্মণ কটক করণ ভদ্ৰকপঠান জাজপুর সর্বসাধারণ। আপনার সেক্রেটারি অফ কালচার কবি ব্রজেন্দ্র রথ পুরীর ব্রাহ্মণ, চিফ মিনিস্টার কটকের করণ অর্থাৎকায়স্থ আর আপনার ডিয়ার ফেন্ড অনিলেন্দুর গাঁ জাজপুরে। তাই বলছিলাম ত্র্যহস্পর্শ।

সবাই হাসে। উত্তেজিত টান টান ভাবটা একটু শিথিল হয়। রণজিৎ প্রশ্ন করে,

—জাজপুর ব্যাপারটা একটু খোলসা কর। আর পঠান কী?

—চলিত ওড়িয়ায় মুসলমানদের পঠান বলে, ভদ্রকে বেশ কিছু মুসলমানের বাস, বহুদিন ধরে। জাজপুর হচ্ছে ওড়িশার সবচেয়ে ঘঁাচোড় বদমায়েশদের জায়গা। ওখানে লোকে রাতে ঘুমোবার সময় বুড়ো আঙুলে ন্যাকড়া জড়িয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে শোয়, পাছে ঘুমের মধ্যে কেউ টিপসই নিয়ে যায়। আপনার অনিলেন্দু জাজপুরের যোগ্য সন্তান। সুবিনয় যোগ করে,

-কত খেয়েছে আর মাল টেনেছেএকতার ঘাড় ভেঙে। আপনি তো দাদা অনিলেন্দু অনিলেন্দু করে একেবারে অস্থির। আমাদের সব জমায়েতে ব্যাটার ফ্রি নেমন্তন্ন।

প্রদীপ ছাড়ে না।

-আর ওর ছেলের সেই কলকাতার ডেন্টাল কলেজে অ্যাডমিশান? আপনিই তো কলকাতায় গিয়ে সি-পি-এম হেল্থ মিনিস্টারকে ধরাধরি করে কত কাঠখড় পুরিয়ে…

অমল বাধা দেয়,

–থাকগে ওসব পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। এখন আমাদের কী কর্তব্য ঠিক কর। অনিলেন্দু নিয়ে কোনও আলোচনায় যায় না। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে কার ভাল লাগে।

-কিছুই কর্তব্য নেই, আমার এই মত, সুজিতের উত্তর।

–নেই মানে। বলি ফাংশানের কী হবে? কদিন মোটে হাতে সময় খেয়াল আছে?

—আছে বলেই তো বলছি। ফাংশানে টাংশানে দরকার নেই। এখানে আর কোনও বাঙালি অনুষ্ঠান নয়। সুজিতের দৃঢ় মত এবং সকলের সমবেত প্রতিধ্বনি। ঠিক ঠিক আর ওসব দরকার নেই। এত ঝামেলা এখানে।

-কিন্তু শুভমনাট্যসংস্থা কী দোষ করল? ওদের সম্বন্ধে কাগজে কেউ কিছু লেখেনি। তাছাড়া ওদের বায়না দেওয়া হয়েছে। এদিকে ওদের থাকাখাওয়া বন্দোবস্ত রেডি।

-কিন্তু ফাংশানটা আদৌ হবে কী করে? কার্ডে তো পরিষ্কার লেখা ২২ শে শ্রাবণ রবীন্দ্রমূর্তি প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে অনুষ্ঠান। তার কর্মসূচীর একটি শুভম-এর নাটক। মূর্তি প্রতিষ্ঠা নেই, অনুষ্ঠান হবে, এটা কী রকম?

—নতুন বয়ান তৈরি কর, আরেক সেট কার্ড ছাপাও।

–কে করবে? কে দায়িত্ব নেবে? একদিনের মধ্যে ছাপিয়ে বিলি করবে কে?

–স্থানীয় লোকেরা যে হল্লা করে ফাংশান বানচাল করবে না তার গ্যারান্টি কী?

–পুলিশের ছব্বা তো জানা আছে। ভুবনেশ্বরে রেপ-মার্ডার এসব ক্রাইমেরই কনভিকশান হয় না। কাগজে তারপর আবার কী লিখবে দেখ!

–এই তো সুজিত কদিন আগেই বলছিল একজন অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি অফিসার ভুবনেশ্বরে তাঁর বাড়িটা বিক্রি করে দিল্লিবাসী হয়েছেন বলে ওড়িয়া কাগজে কী প্রচণ্ড বিরুদ্ধ সমালোচনা বেরিয়েছে। নিজের আইনসঙ্গত উপার্জনে তৈরি সম্পত্তি ইচ্ছেমত বিক্রির অধিকার পর্যন্ত এখানে আমাদের নেই। এই তো অবস্থা। অমল ডান হাত তোলে, অভয়দান মুদ্রা।

-আকী যে শুরু করেছ তোমরা। অবস্থাটা সেরকম খারাপ নয়। ওভার রিঅ্যাক্ট করছ কেন। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো। এই সুজিতই আমাকে গল্প করেছে, কটকে কত পয়লা বৈশাখ রবীন্দ্রজন্মোৎসব বিজয়া সম্মিলনীতে কলকাতা থেকে নামী কবি সাহিত্যিক এসেছেন। বারবাটি স্টেডিয়ামে তিন দিন ধরে উৎপল দত্তের গ্রুপ নাটক করে গেছে। ব্যারিকেড, টিনের তলোয়ার আরও কী। ভুবনেশ্বরে ওই রবীন্দ্র মণ্ডপেরই চৌহদ্দির মধ্যে খোলা জায়গায় করাত ধরে চলেছে শান্তিগোপালের বাংলা যাত্রা। কই কেউ আওয়াজ দেয়নি তো।

-সেটা দাদা আগেকার কথা। তখনও নতুন ভুবনেশ্বর ছিল পুরনো কটকের লেজুড়। আর কটকে তো জানেন ওড়িয়া বাঙালি বহু বছরের সম্পর্ক। সুখেদুঃখে ভালমন্দে একসঙ্গে পাশাপাশি জীবন। বাঙালিদের প্রতি ন্যায্য অন্যায্য রাগ-ঈর্ষা যতই থাকুক কোথাও একটা পারস্পরিক আদানপ্রদানের ইচ্ছে ছিল, মেধা-প্রতিভা স্বীকারের ঔদার্য ছিল। কটকে আমি যে স্কুলে পড়েছি তার হেডমাস্টার হরিহর মিশ্র চমৎকার বাংলা বলতেন। রবীন্দ্রনাথের কত কবিতা ওঁর মুখে শুনেছি। এছাড়া হিস্ট্রির স্যার। উকিল রামকৃষ্ণ পট্টনায়ক, ডাক্তার নিকুঞ্জ মহান্তি সবাই বাংলা উপন্যাসের ভক্ত। বাড়িতে ওঁদের মিসেসরা পর্যন্ত অনুরূপা দেবী নিরুপমা দেবীর লেখা পড়তেন। তারপর আমাদের চোখের সামনে সব পাল্টে গেল। এখন সরকারই সব। ভুবনেশ্বর নতুন দিল্লির হাবভাব চালচলন কপি করে। কটক হয়ে গেছে মফস্বল। পয়লা বৈশাখ অনুষ্ঠান হয় ওড়িয়াতে। কলকাতা থেকে আদৌ যদি কিছু আনা হয় তা সতী পেল না পতি গোছের যাত্রা। এত লম্বা স্পিচ সুজিত জীবনে আর কখনও দিয়েছে?

-তবে ওই দেখুন। না, না দাদা লেন্স ড্রপ দ্য হোল আইডিয়া। ধরুন যদি অডিয়েন্স হয়? ওই সতী পেল না পতি যদি ওড়িয়া বাঙালিদের রুচিসম্মত নববর্ষ অনুষ্ঠান, তা হলে শুভম-এর নাটক দেখবে কারা? হ অর্ধেক খালি থাকলে একটা নামকরা গ্রুপ ইনসাল্টেড ফিল করবে না? আমরাই বা তাদের কাছে মুখ দেখাব কী করে? অমলের ধৈর্যচ্যুতি হয়,

—এসব কথা আগে ভাবোনি তো। স্থানীয় বাঙালিরা কী মাল তো জানতেই। এই ভুবনেশ্বরেই তো কালীবাড়ি আছে একটা। পুজোটুজোতে তো যাও। দেখনি কী পদের। যত সব এল (লোয়ার) এম (মিডল) সি (ক্লাস)র আচ্ছা। বাংলায় ঠিক মতো কথা পর্যন্ত বলতে পারে না। যেন অমল বরাবর পারে।

-তখন দাদা কেমন একটা বাঙালি বাঙালি এনথু এসে গিয়েছিল। ওই ফিয়ারলেসের ভদ্রলোকের কথাতে আর কি। রণজিতের বিশ্লেষণে সকলের সায়।

অনেক দিন বাদে সন্ধেয় বাড়িতে অমল একা। সাধারণত সে বাড়িতে থাকে না, একা প্রায় কখনওই নয়। তার জীবিকা, তার কর্ম অন্যকে টাকা ধার দেওয়া। পৃথিবীতে সর্বদা ধার চাওয়া লোক প্রচুর। অতএব প্রায় সন্ধেয় তার নিমন্ত্রণ। ভুবনেশ্বরে এখন বেশ কটি তারাওয়ালা হোটেল এবং প্রতিটিতে এক বা একাধিক বাররেস্তোরাঁ। এন্টারটেইনিং বা খাদ্যপানীয় সহকারে সেবা আর্থিক লেনদেনের প্রচলিত অনুষঙ্গ। আজও অমলের যাওয়ার কথা ছিল। হোটেল স্বস্তিতে—একমাত্র ওড়িয়া মালিকানার হোটেল-হোটেল প্রাচী তো প্রাক্তন রাজন্যবর্গের একজনের অতএব খাঁটি ওড়িয়া মনে হয় না। খাওয়াটা ভাল। বিশেষ করে চিংড়ির পদগুলি। অমলের প্রিয়, কলকাতায় বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতিতে যে মাছটি এখন শুধুই স্মৃতি, কালেভদ্রে বিশেষ অনুষ্ঠানে কেনা ও রান্না। অতএব ভুবনেশ্বরে বাজোরিয়া সিংহানিয়া অরোরা বা নন্দ কি সান্ত্র আতিথেয়তা অমল নির্লজ্জভাবে এই মাছটির দিকে চালিত করে। সত্যি বলতে কি তারাও মাইন্ড করে না। কেনই বা করবে। খরচ তত শেষ পর্যন্ত উঠবে অমলের ব্যাঙ্ক থেকে পাওয়া ধার থেকে। টাকা দিচ্ছে গৌরী সেন। এ জন্মে ধোঁদোল চোষ পরজন্মে ফলার খাবে—এ ধরনের সনাতনী নীতিবোধ টোধের ধার সে ধারে না।

কিন্তু আজকে সেই চিংড়িতেও তার আগ্রহ নেই। কিছু ভাল লাগছে না। গতকাল একতার জরুরি বৈঠকে মীমাংসা কিছুই হল না। ভবিষ্যৎ কর্মসূচী সেই অনিশ্চিত রয়ে গেল। একতার এক যুগের ইতিহাসে এই প্রথম কার্যকরী সমিতির বৈঠক শেষ হল সিদ্ধান্ত ছাড়া। এই প্রথম অমল কুমার দাসের মতামত গ্রাহ্য হল না। রাতে সোজা বাড়ি ফিরে এসেছিল অমল। গোটা চারেক হুইস্কি ও যথারীতি সুপ সহকারে মাংসরুটি খেয়ে শোবার ঘরে ঢুকেছে। সামনে ড্রেসিং টেবিল, আয়না। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে কেমন যেন কমে গেছে না? টেলিফোন লাগায় মৈত্রেয়ীকে।

–শোনো একটা অসুবিধা হয়ে গেছে, অমল যথাসম্ভব উত্তেজনাহীন গলায় শুরু করে, গভর্মেন্ট আমাদের ওই স্ট্যাচুটা অ্যাকসেপ্ট করতে পারবে না। আসলে ওদের কি রুলটুল-এ বাধছে। রবীন্দ্রমণ্ডপ সরকারি জায়গা তো, আর আমরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তাই আমাদের দান নেওয়াটা ভাল দেখায় না।

–দান তো নয়, উপহার, মৈত্রেয়ীর প্রধান শিক্ষয়িত্ৰী সুলভ ভ্রম সংশোধন।

–ও সেই এক কথা। মোটের ওপর ধরে নাও ২২শে শ্রাবণ ফাংশানটা হচ্ছে না।

—সয়োজদার নাটক তো নিশ্চয় হচ্ছে? ওটা তো সরকারি কিছু নয়।

-না, ওটাও আর করা সম্ভব হচ্ছে না। কার্ডে তো মূর্তি প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে অনুষ্ঠান লেখা, না? মূর্তি নেই, অনুষ্ঠান হবে কী করে। একতার সকলেরই খুব মন খারাপ। ক্লাব থেকে শুভম-এ অফিসিয়াল লেটার অফ রিগ্রেট যাবে। তবে তুমি একটু ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বল। অবশ্য তোমার পক্ষে খুবই এমব্যারাসিং হবে, এ দুমাসে এত ক্লোজ হয়ে গিয়েছিলে…

-ঠিক আছে। অনেক রাত হল। কাল সকালে স্কুল আছে। ছাড়ছি। বরফের মতো ঠাণ্ডা গলায় মৈত্রেয়ীর উত্তর। অমলের বুকের ভেতর সিরসির করতে থাকে। এখনও। এই ১৯১৪ সালের জুন মাসেও করে।

শুভম নাট্যগোষ্ঠীর বলাবাহুল্য শো বাতিল হওয়াটা একেবারেই ভাল লাগেনি। তবে ভদ্রলোকের পেশাদারী দল, মঞ্চস্থ করার পুরো দক্ষিণা ক্ষতিপুরণ হিসেবে চায়নি। চাইতে পারত। অমল বুদ্ধি করে লিখেছিল যে অভাবনীয় পরিস্থিতির জন্য নাটকটি মঞ্চস্থ করা সম্ভব হচ্ছে না তার জন্য যেহেতু শুভম-এর কোনওই দায়িত্ব নেই অতএব আগাম টাকাটি ফেরৎ দেবার প্রয়োজন নেই তো বটেই বরং ভুবনেশ্বর যাত্রার প্রস্তুতিতে তাদের যে ব্যয় হয়েছে তার অঙ্কটি যদি তার বেশি হয়ে থাকে একতা তার ভার নেবে। শুভম দুঃখ এবং হতাশা প্রকাশ করেছে কিন্তু টাকা চায়নি। ভবিষ্যতে নাটক করার সুযোগ হবে আশায়।

তাদের অবশ্য রবীন্দ্রমূর্তি নিয়ে এত সব কাণ্ডের কথা বলা হয়নি। বললে হয়তো বুঝতও না। মূর্তি স্থাপন করা না করার সঙ্গে তাদের নাটক মঞ্চস্থ হওয়া না হওয়ার সরাসরি সম্পর্ক নেই। তাদের কাছে এটাই বাস্তব। সত্য। কিন্তু অমলের কাছে, একতা ক্লাবের সদস্যদের কাছে নয়। তাদের বাস্তব ভিন্ন। বাস্তব তো একটা নয়, অনেক। যার কাছে যা। অতঃপর বাস্তব বা সত্যের তত্ত্ব বিশ্লেষণে না গিয়ে শুভমকে বলা হয়েছে যে শেষ মুহূর্তে রবীন্দ্র মণ্ডপ হলটা পাওয়া যায়নি, ভুলে একই দিনে দুটো পার্টিকে বুকিং দিয়ে দিয়েছে। একটা স্থানীয় অন্যটা বাইরের। বাইরের দল জোগাড়যন্ত্র করে এসে অসুবিধায় পড়বে কাজেই তাদেরই বারণ করে দেওয়া হল। কদিন আগে সত্যি এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে। কলকাতা থেকে আমন্ত্রিত একজন কথক নাচিয়ে অনুষ্ঠান করতে এসে দেখে ঠিক সেই দিন সেই সময়ে মঞ্চে চলছে কোন আই এ এস না আই পি এস লেখকের শৌখিন ওড়িয়া নাটক অভিনয়। খবরের কাগজেও বেরিয়েছিল। অমল বুদ্ধি করে ঘটনাটা কাজে লাগিয়ে ফেলে। অর্ধসত্য তো পূর্ণ সত্যের চেয়েও শক্তি ধরে, ফলে শুভম নাট্যগোষ্ঠী আশায় রইল ভবিষ্যতে হল খালি পেলে সুযোগমতো নিশ্চয়ই আমন্ত্রণ পাবে।

—আপনাদের বাংলা নাটক তা হলে আর হলই না? ছায়া দেবনাথ আজ হঠাৎ গম্ভীর। আর গম্ভীর হলেই তার বাংলাটা ঠিকঠাক। অমল উত্তর দেয় না। মাথা নাড়ে। খানিক বাদে আস্তে আস্তে বলে,

—সবই কেমন বদলে গেল। একতা যেন আর একতা রইল না। আমাদের একটা শ্লোগানে ছিল আমরা থাকি বা না থাকি একতা থাকবে। প্রবাসীদের সংস্থা। সর্বদা কেউ না কেউ আসছে। আবার অন্য কেউ বা চলে যাচ্ছে। নতুন সদস্য আসে পুরনোরা বিদায় নেয়। প্রায় বলতে পার আমাদের জীবনের ছাঁচ। নতুন মানুষ আসছে, পুরনোরা চলে যাচ্ছে। এই পৃথিবীতে মানুষই বা কি। বলতে গেলে পরবাসী। কদিন হাসিকান্না মেলামেশা। ব্যাস খেল খতম।

-বাপরে, আপনি দেখি আবার ফিলজফি কপচান। এই না বারবার বলেন আপনি কাঠখোট্টা ব্যাঙ্কার, খালি লাভক্ষতি হিসাব বোঝেন। আদি অকৃত্রিম বাঙালের পুনরাবির্ভাব।

—সেই লাভক্ষতির অঙ্কই তো কষছি। কী পেয়েছি কী পাইনি তার হিসেব।

–আমি অত হিসাব বুঝি না। গল্পটার কী হইল বলেন। শ্যাষ কই?

–শ্যায় নয় শেষ। বলেন নয় বলুন। কত শেখাবো?

–মানলাম না হয় শেষ, বলুন। তা শেষ করবেন তো। আপনি তো লাইফের মাঝখানে আইস্যা ঠেইক্যা রইলেন। কতই বা বয়স তখন আপনার। ঘরসংসার কিছুই তো দেখি এখনও হইল না। জমিবাড়ি করসিলেন তো? আর আপনার হিরোয়িন মৈত্রেয়ী গ্যালেন কই?

অমল চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বাড়ির গায়ে বাড়ি। পুরনো। সেই সময়ের নির্মাণ যখন সুস্থনগরায়ণের ধারণা ছিল না। তবু এখান ওখান থেকে সবুজ উঁকিঝুঁকি মারছে। তার মতো জন্ম কংগ্রেসীও মানে যে বামফ্রন্ট সরকার এক আধটা ভাল কাজ করেছিল যার একটা হল সামাজিক বনসৃজন, প্রকৃতি পরিষেবা। (এত শক্ত বাংলাও অমল বামফ্রন্টের কল্যাণে শিখে ফেলেছে)। চুন বালি ইট সিমেন্ট কংক্রিটের ফাঁকফোকরে অনেক ঘটাপটা করে লাগানো হয়েছিল গাছগাছালি। কিছু বেঁচেওছে।

আশ্চর্য এই বাংলার মাটি। চেয়ে চেয়ে দেখে অমল। রোজই দেখে। দিনের অধিকাংশ সময় তার এই সবুজটুকু দেখেই কাটে। কোথা থেকে, আশ্চর্য মাটির কোন গভীরে পায় সঞ্জীবনী স্পর্শ? আহা মানুষ যদি গাছ হত। বিশ্বাসভঙ্গ ঈর্ষা ক্ষোভ তিক্ততার নিরেট স্তর ভেদ করে কোন অতলে কোমলের একটু ছোঁওয়া খুঁজে নিয়ে আবার বেঁচে উঠত। বুকের ভেতর ধুক ধুক করাই তো প্রাণ নয়। একটু কোমলতার জন্য বেঁচে থাকা। পাঁচতারা হোটেলে খাওয়া, বোমকাই ঢাকাই কাঞ্জিভরম কেনা, মঞ্চে টি ভি ক্যামেরা আলোতে দাঁড়ানো—সবই অমল মৈত্রেয়ীকে দিয়েছিল। তবু মৈত্রেয়ী কেন শেষে হারিয়ে গেল? সেও কি একটু কোমলতার ছোঁওয়া চেয়েছিল? বাইরের দিকে চেয়ে দেখে বেশ সবুজ রয়েছে গাছটা, কলকাতার গাড়িঘোড়া ধুলোময়লার মধ্যেও।

-কী হইল? চুপ ক্যান? গল্পটা বলবেন তো।

–আজ থাক। আর মনে পড়ছে না।

—সে আবার কী। সংসারধর্ম করলেন কি না, জমিবাড়ি হল কি হল না, এগুলোতে মোটা কথা। এসব ভোলা যায় না কি?

-আঃ বিরক্ত কোরো না। সব ভোলা যায়। তেমন অবস্থায় পড়লে লোকে নিজের নামও ভুলে যায়। এতদিন এরকম একটা জায়গায় নার্সগিরি করছ, তোমার তো জানার কথা। কাজটাজ কর, না খালি ঐ পেশেন্টদের জীবন কাহিনী লেখ। যাও অন্য পেশেন্টদের দেখতে যাও। সব সময়ে আমার ঘরে কেন।

পরের দিন সকালে হাসি হাসি মুখে ছায়া দেবনাথ ঢোকে। নমোনমো করে প্রেসার দেখে, চেয়ার টেনে সামনে বসে।

-আচ্ছা আপনার অ্যাকটা কুকুর ছিল না? সেই যে ইংরাজদের কোন নামজাদা প্রধানমন্ত্রীর নাম দিসিলেন তারে? গ্ল্যাডস্টোন না ডিজরেলি না কি?

-ফাজলামি কোরো না। তুমি ভাল করেই জানো তার নাম ছিল চার্চিল।

-হ্যাঁ হ্যাঁ চার্চিল। ভারি অসভ্য ছিল কুকুরটা। আপনারা একজাতি এক প্রাণ একতা কোরাস ধরলেই কুকর্ম করত। পার্টি বানচাল হইত। তার কথা কই আর বলেন না তো।

—তার আর কী কথা। একটা পোষা বুল ডগ আদরে গোবর হয়েছিল এই তো। খেত আর ঘুমোত, নিয়মিত দৌড়ানো বল খেলা কিছুই করাতে পারতাম না। আমার সময় কোথায়। চাকরবাকরদের জিম্মায় কি আরও জাতের কুকুর ভাল থাকে।

-ক্যান, শরীরটরির খারাপ ছিল না কি।

–তা নয়। তবে ব্যায়াম না থাকলে ও সব কুকুর ঠিক ফর্মে থাকে না।

–তবে আপনারে খুব ভালবাসত।

–হ্যাঁ, ভাল জাতের কুকুর সর্বদা ওয়ান মাস্টার ডগ। আমার কথাই শুধু শুনত, যদিও ওর সবই করত বীর সিং। আশ্চর্য, কুকুরদের মতো এত শ্রেণীসচেতন জীব মানুষও নয়। ওদের গ্রাহ্যই করত না। আমার কাছাকাছি থাকাটা তার জীবনের সব। এত বুদ্ধিমান ছিল যে কী বলব। সমস্ত বুঝত। কারা আমার আপনজন, কারা নেহাত কাজের সুত্রে আসে যায়। তাদের সঙ্গে তার ব্যবহার আমার সঙ্গে সম্পর্ক অনুযায়ী। মৈত্রেয়ী তার পুরোপুরি আপনার, যদিও সর্বদা থাকত না। তাকে যে মানতে হয় ওটা কী করে বুঝল কে জানে। যখনই আসত প্রথমেই আদর অভ্যর্থনা। যতদিন থাকত পায়ে পায়ে ঘুরত।

—দ্যাখেন। ভাষা নাই তবু ক্যামন বুঝাইতে পারে। তা কতদিন ছিল আপনার সাথে? মনে পড়ে?

হ্যাঁ, এখন মনে পড়ে। সেই ২২ শে শ্রাবণের ঝামেলার সময়েই ঘটেছিল ব্যাপারটা। অগস্টমাসের পচা গরমে না কে জানে কেন পাড়াজুড়ে কুকুরদের মড়ক লাগল। ডিসটেম্পার, মারাত্মক অসুখ, সাধারণত এক বছরের কম বয়সের কুকুরদের হয়। কিন্তু সেবার সব বয়সের কুকুরদেরই হচ্ছিল। ঘণ্টাকয়েক প্রচণ্ড কষ্ট ছটফটানি থেকে থেকে খিচুনি, ব্যাস জলজ্যান্ত প্রাণীটা খতম। বোধহয় সান্ত্বনা দিতেই ভেট, ওর ডাক্তার জানাল প্রাক্তন এক মুখ্যমন্ত্রীর পোষা স্পিৎজ কুকুরটিও গতকাল এই রোগে মারা গেছে। অর্থাৎ স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী (হলেই বা প্রাক্তন) যার দাপটে কাবু, তার কাছে অমল কুমার দাস তো কোন ছার।

অমল পুরুষ মানুষ এবং পূর্ণ বয়স্ক, বলতে গেলে মাঝবয়সী। চোখে জল তার নিশ্চয় শোভা পায় না। তবু চার্চিলের দেহটাকে জড়িয়ে ধরে, তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে সে চোখের জল না ফেলে পারেনি। তার শোকে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল কুনিয়া,নতুন কাজের ছেলেটা। বছর খানেক হল তার কাছে চাকরি করছে। পুরনো কম্বাইন্ড হ্যান্ড বীর সিং-এর বার্ষিক ছুটির মেয়াদ এক মাস থেকে ক্রমে বেড়ে প্রায় তিন মাস হয়ে ওঠায় বাধ্য হয়ে বীর সিং-এর সহকারী এবং বিকল্প রূপে মোতায়েন। ছেলেটা এর মধ্যে কাজকর্মে বেশ পটু হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে রান্না ও বাজারে। হেঁশেল তার হেফাজতে থাকায় সংসারের খরচ অবশ্য অমল থাকলে যা হয় না থাকলেও দেখা যায় ঠিক তাই হচ্ছে।

এ নিয়ে মৈত্রেয়ী অনেক রাগারাগি করেছে। কিন্তু অমল নিজে যা খায় কাজের লোককে তাই খাওয়ায়। বাঙালি বাড়ির মতো বাজার করবে ভালমন্দ আমিষ রাঁধবে আর খেতে পাবে ওড়িয়া ধাঁচে পখাল আর শাকভাজা বা ভাত ডালমা বা সাঁতলা, তা তো হতে পারে না। কাজেই কুনিয়া অমলের অতি অনুগত, চোখ তুলে কথা পর্যন্ত বলে না সর্বদা নতমস্তক, একেবারে অনুগত ভৃত্য। একতার পারিবারিক জমায়েতে দু পেগ পেটে পড়লেই ঠোঁটকাটা রণজিতের বাঁধাধরা পরিহাস-দাদার কুকুর একটা নয়, দুটো, একটা ল্যাজওয়ালা অন্যটি ল্যাজছাড়া।

সেই কুনিয়া কিনা চার্চিল মারা যাওয়ার পর এক সপ্তাহ যেতে না যেতে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে গেল। অমলের অফিসের ড্রাইভার রমেশের গাঁয়ে ওর বাড়ি, রমেশই ওকে এনেছিল, বলাবাহুল্য চাকরি দেওয়ার বিনিময়ে কুনিয়ার প্রথম মাসের মাইনেটা তারই পকেটে গেছে। চার্চিল মারা যাওয়ার সময় বীর সিং দেশে, কুনিয়া একলা যাবতীয় করণীয় কর্ম করেছে। ভাগ্যিস অমলের ওড়িয়া বাঙালি অর্থাৎ ক্যারা বাড়িওয়ালা সে সময় সস্ত্রীক চাকুরে ছেলে ছেলের বউ-এর বাচ্চা সামলাতে দিল্লিতে প্রায় স্থায়ী বাসিন্দা। এখানে থাকলে কি আর অমল কুনিয়া মিলে তার সাধের একফালি লনের কোণে মাটি খুঁড়ে চার্চিলকে কবর দিতে পারত? কুনিয়া আবার কোত্থেকে এক গাছা লাল জবার মালা এনে চার্চিলের গলায় পরিয়ে দিয়েছিল। পরদিন রমেশকে দিয়ে লাল মুসান্ডার চারা কিনিয়ে এনে তার ওপর লাগানো হল। চার্চিলের সমাধি। অন্তত দামি গাছ হওয়ার দরুণ ভবিষ্যতে যত্ন পাবে এই আশা। দিব্যি আগ বাড়িয়ে এত সব কাজকর্ম করে তারপর কিনা ছেলেটা হাওয়া। আশ্চর্য।

রমেশকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল চার্চিলের মৃত্যুর পর আশেপাশের বাড়ির কাজের লোক, মোড়ের চায়ের দোকানের কর্মচারী অফিসের পিয়ন সকলে কুনিয়াকে কী সব বুঝিয়েছে। তাদেরই বুদ্ধিতে নাকি কুনিয়া অন্য একজন পশু চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করতে গেছে চার্চিলকে ছোঁওয়ায়ির দরুণ তার কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা আছে কি না। এমন মওকা কোনও ডাক্তার ছাড়ে! ভেটও টোপ ফেলল, কুকুরটার অসুখ ছিল মারাত্মক, যেই তার সংস্পর্শে এসেছে তাকেই সাতটা ইনজেকশান দিতে হবে। ভড়কে গেলেও কুনিয়া জিজ্ঞাসা করেছে, সাহেব তো মরা কুকুরটাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন কতক্ষণ তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসেছিলেন, কই তাঁর তো ইনজেকশান ওষুধ কিছু লাগছে না। ভেট খুব গম্ভীর মুখে জবাব দিয়েছে—সি এ পরা বঙ্গালি তাংক কিছি হবে নি। তু গরিব ওড়িয়া পিলা তু মরিবু।

ওড়িয়া বঙ্গালির মৌলিক ভেদাভেদ বিচারে বেচারা কুনিয়া সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত। অতএব আর পাঁচজন ভূমিপুত্র চাকুরিক্ষেত্রে অনুরূপ সমস্যার উদয় হলেই যা করে তাই করল জীবনরক্ষার্থে গাঁয়ে চম্পট। ঢেনকানল জেলার তালচের মহকুমার মহান শক্তিধর নীলমণি ওঝার নাম কত গাঁয়ের লোকের মুখেমুখে ফেরে। কুনিয়ার মামুপুঅ ভাই (নিজের মামা নয় মায়ের পিসতুতো দাদার ছেলে) তাকে চেনে। তারই সাহায্যে কুনিয়ার নীলমণি ওঝার পদতলে আত্মসমর্পণ। বলাবাহুল্য কুনিয়ার বাবা-মা-জ্যাঠা-খুড়ো কেউ তাকে আর এমন বিপজ্জনক কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসতে দিচ্ছে না। দেবেও না। এখানেই চার্চিলের মৃত্যু পর্বের সমাপ্তি।

হঠাৎ অমল একেবারে একলা। চার্চিল নেই, কুনিয়া নেই। এমন কি বীর সিং-ও এবারে বার্ষিক ছুটি ভোগ করে অমলের কাছে ফিরল না। অবশ্য গত দুতিন বছর ধরেই ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছিল, গাঁয়ে যেটুকু জমি আছে ঠিকমতো চাষ করা যাচ্ছে না, বাপ বুড়ো হয়েছে, ছেলেটা বখে যাচ্ছে কারও কথা শোনে না ইত্যাদি। চার্চিলের সঙ্গে সঙ্গে বীর সিং-এর বাপও বোধহয় মরল। অমলের শুধু আশ্চর্য লাগে বীর সিং একটা খবর পর্যন্ত দিল না। অথচ দীর্ঘ ষোলো বছব তার কাছে কাজ করেছে। অন্য কাউকে দিয়েও তো দুলাইন লেখাতে পারত। অমল বরাবব ওর সব বিপদ-আপদে সাহায্য করেছে। স্ত্রীর অসুখ, ছেলে মেযের জন্ম আঁতুড় বাড়ির চাল ছাওয়া—যাবতীয় প্রয়োজনে টাকা-ছুটি কী দেয় নি। বীর সিং-ই কি কম পেয়েছে। পোশাক-আশাক খাওয়া-দাওয়া রীতিমত মধ্যবিত্ত ঘরের মাপে। তাহলে? অমল যেহেতু চাকরিদাতা অতএব বরাবরই সেই শোষকের ভূমিকায়? এবং চাকরিজীবী বীর সিং শুধু শোষিত? মানুষের সম্পর্কের মাত্রা কি একটি? এসব প্রশ্নের কোনও জবাব পায় না। একতার সদস্যবা একবাক্যে বলে,—দুর আপনিও যেমন, কাজের লোকের সঙ্গে আবার সম্পর্ক। ওই ক্লাসের লোক ওরকমই হয়। বাংলা সিনেমায় সেই পুরাতন-ভৃত্য-কাম-অভিভাবক অর্থাৎ পরিবারের সদস্য, কবে আউটডেটেড হয়ে গেছে। সেই জন্যই তো বাংলা সিনেমা আর কেউ দেখে টেখে না।

এরই মধ্যে অর্থাৎ বাইশে শ্রাবণের অনুষ্ঠান বাতিল, চার্চিলের মৃত্যু, কুনিয়ার অন্তর্ধান, বীর সিং-এর একটানা অনুপস্থিতি বা না-ফেরা ইত্যাদি প্রসূত সঙ্কটের মধ্যে অমলের বম্বে হেড অফিসে বদলির প্রত্যাশিত এবং অনাকাঙিক্ষত আদেশটি এসে পড়ল। আসবাবপত্র গেরস্থালি বেঁধেহেঁদে চার্চিলসহ বীর সিং-এর নতুন জায়গায় নতুন বাড়িতে নতুন করে সংসার পাতার পরিচিত কার্যক্রমটিতে এবারে ছেদ। অমলের তখন আর জিনিসে সংসারে আগ্রহ নেই যদিও মনে মনে জানে সবই প্রয়োজন। কিন্তু বাঁধা-ঘঁদার ঝামেলা পোষাচ্ছে না।

ড্রাইভার রমেশ এতবছর ধরে ভুবনেশ্বরেনবাগত একতারনতুন সদস্যদের সংসারপাতা এবং বিদায়ী পুরনো সদস্যদের সংসার তুলে নিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে একটি সাইড বিজনেস চালু করে ফেলেছে-পুরনো ফার্নিচার ফ্রিজ-টিভি কেনা-বেচা। তার সাহায্যে অমলের সব আসবাবপত্র ইলেকট্রিক্যাল জিনিস বিক্রি হয়ে গেল, বেটা রমেশ কত পারসেন্ট কমিশান পেল কে জানে। টিভিটা বোধহয় ও-ই বেনামে কিনল। মৈত্রেয়ী সপ্তাহান্তের সঙ্গে দুদিন যোগ করে বাকি প্যাকিং তদারকি সারল। স্কুলে তখন ওর পুরো সেশান চলছে, তারও সময় নেই। শুধু একেবারে জলের দামে জিনিসগুলো অমল বেচে দিল এই দুঃখ করা ছাড়া বিশেষ কীই বা করবে।

সেপ্টেম্বর মাসের বম্বে। ভয়াবহ। কলকাতার বর্ষা সে তুলনায় কাব্য। আকাশ বাতাস ঘর অফিস মেঝে ছাদ সর্বত্র ভিজে ভিজে। বম্বে মানে এখানে ওখানে ওপরে নীচে বিন্দু বিন্দু জল আর জল। অমলের স্মৃতিতে বম্বে আর বর্ষা একাকার। এমন কি তার মধ্যে গণেশ চতুর্থও মনে পড়ে না।

—কী যে বলেন। মুম্বাই হইল গিয়া ইন্ডিয়ার কমার্শিয়াল ক্যাপিটাল। আর আপনার কি না মনে আছে শুধু জল। অমল চুপ করে থাকে।

—সত্যি আমার আর কিছু মনে নেই। কত মাস কিছু মনে পড়ল না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 7 of 7 ): « পূর্ববর্তী1 ... 56 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress