রোগীর সঙ্গে বন্ধুত্ব
ছায়া দেবনাথের গবেষণা, কেস নং ৯
রোগীর সঙ্গে এখন আমার অর্থাৎ অল্প শিক্ষিত বাঙাল নার্সরূপী আমার বেশ বন্ধুত্ব। নড়বড়ে হলেও যোগাযোগের একটা সেতু স্থাপন করা গেছে। একদিন তা নিয়ে বিকট পরিহাসও হল। তুমি যদি দীপ জ্বেলে যাই মার্কা সেবিকা হতে চাও তাহলে খোমাটা আগে পালিশ করে আনন। কোথায় সুচিত্রা সেন আর কোথায় ছায়া দেবনাথ। হরিদ্বার আর গুহ্যদ্বার। হাসিমুখে শুনি। জানি মুখ খারাপ করা যৌন অবদমনের লক্ষণ।
রোগীর স্মৃতিমন্থনে একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করি। অতীতের কোনও কোনও অংশে একটা নির্দিষ্ট ঘটনার প্রতি যেন ফ্লাড লাইট পড়ে–দৃশ্যটি আদ্যপ্রান্ত সমস্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ এক বারে জীবন্ত হয়ে ওঠে যেন অতীত নয় বর্তমান, এখনই ঘটছে। আবার জীবনের এক বিরাট অংশে ঘোর অন্ধকার। জানি স্মৃতি মহাফেজখানা নয়। জীবনের সব অভিজ্ঞতা অনুভূতি যথাযথ সংরক্ষণ সম্ভব হয় না। ঝাড়াই বাছাই বাদ-ছাদ স্বাভাবিক। সুস্থ মানুষ বেদনাদায়ক ঘটনাগুলি মনে রাখে বটে কিন্তু তার যন্ত্রণাটা আর বোধ করে না। সেগুলি যেন বহুকালের পুরনো অস্ত্রোপচারের দাগ, শুধু চিহ্ন, ব্যথা কবে সেরে গেছে। অমলকুমার দাসের কাছে স্মৃতি পুনরুদ্ধার এত দুরূহ নে?
সেদিন ছায়া দেবনাথ ঘরে ঢুকেই প্রশ্ন করল,
–আচ্ছা এই যে আপনারা বিয়া-সাদিকরলেন না অথচ আপনার হিরোয়িন ভুবনেশ্বরে আইস্যা বাড়িতে থাকে। এদিকে আপনি ব্যাচেলার মানুষ একলা, কেউ কিছু বলত না?
—প্রথম প্রথম আমি সম্পর্কের বোন বলতাম। কলকাতা হলে আমি দাস মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী আমাদের আগের জেনারেশানে জাতপাত না মেনে বিয়ে থা হয়েছে বিশ্বাস করানো সোজা ছিল না। আসলে কি জানো বিদেশে থাকার এইটাই মস্ত সুবিধা, তুমি নিজের সমাজ থেকে দূরে, আবার যেখানে আছ সেখানকার সমাজের ভেতরেও ঢাকনি। প্রবাসী মানেই প্রাবাসী। ভুবনেশ্বরে আমার পরিচয় ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশানের ম্যানেজার। জাতে বাঙালি, ব্যস। দুটি মাত্রাই সব। আমার ব্যক্তিগত জীবন পরিবার শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি জীবনযাত্রা মতামত, এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মৈত্রেয়ী সম্বন্ধেও তাই। হ্যাঁ, একতার সদস্যদের কৌতূহল ছিল সন্দেহ নেই। তারা ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে সহজে। হয়তো মৈত্রেয়ী মাঝে মাঝে আসত বলে। আসল কথা সময়। এসবে আসতে আসতে আমাদের দুজনেরই যৌবন গতপ্রায়। মৈত্রেয়ীর বাবা স্বর্গে, মা সম্পর্কটা মেটে নিয়েছেন, ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে হস্টেলে। অতএব, ফ্রিডম অ্যাট মিডলাইফ। মৈত্রেয়ী মিশুকে মেয়ে তারপর হেডমিস্ট্রেস, একতার সবাইয়ের দিদিভাই হয়ে উঠতে দেরি হয় নি। তার চেষ্টা ছিল সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বের। কারণ ভুবনেশ্বর তার কাছে একঘেয়ে ক্লান্তিকর চাকরি ও প্রাত্যাহিক সাংসারিক জীবন থেকে অব্যাহতি অবসর বিনোদন। এখানে সে আমার গাড়িতে চড়ে, ক্লাব-হোটেলে খায়, ভাল শাড়ি পরার সুযোগ পায়। রোজ পার্টি গল্পগুজব হৈ হৈ। আর ফাংশান থাকলে তো কথাই নেই। প্রতিবারেই মঞ্চে, ক্যামেরার সামনে, হয় বিশেষ উপহার নিচ্ছে, নয়তো প্রধান অতিথিকে মালা দিচ্ছে। মোটমাট সি হ্যাজ ফান।
—তা হলে আপনি ছিলেন মৈত্রেয়ী চক্রবর্তীর উইকএন্ড। কিছু মনে করবেন না। তার জন্যই কি আপনার হিরোয়িন এতকাল টিকল না কি?
অমল চুপ করে থাকে। উত্তর দেয় না। খানিক পর আস্তে আস্তে বলে,
–তুমি এখন যাও। আর কথা বলতে ভাল লাগছে না।
বেশ কদিন অমলের কথা বলতে ভাল লাগল না।
.
মৈত্রেয়ীকে ভুবনেশ্বরে আনার জন্য আমি এত ব্যগ্র থাকতাম। যখন ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে অল্পবয়সি মেয়েদের গায়ের গন্ধ শুকতাম, তখনও। যদিও ও বেশির ভাগ সময় কলকাতায় থাকত, তবু ওর অনুপস্থিতিতে কেন যেন আমার নারী সংসর্গে লোভ হত না। ও যখন কাছে আসত, তখনই আমার অন্য স্ত্রীলোকের প্রয়োজন। ওকে কষ্ট দিয়েই কি আমার উত্তেজনা, ওর যন্ত্রণা ওর অপমান আমার কাছে পালঙ্কজোড় বটিকা। নিজের কাজে নিজেকে ওর নিশ্চয় হেয় লাগত। অবশ্য এমন একটা বিন্দুতে কখনই পৌঁছতে চাইনি যেখানে ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছেদ হয়। আমার বরাবর ধারণা নারী-পুরুষের ভালবাসার ভিত্তি দেহজ কামনা। ওবেরয় ভুবনেশ্বরে মৈত্রেয়ীর সেই কাণ্ডতে বুঝলাম ওটা প্রায়ই একটা অস্ত্রমাত্র, ধ্বংস করে, জোড়া লাগাতে পারে না।
আমরা একে অন্যকে দেখতে পাই, উপস্থিতি অনুভব করি, কিন্তু ছুঁতে পারি না। দুজনেই দুজনের নাগালের বাইরে। অ্যাকশান ফিল্মে যেমন দেখা যায় রোমহর্ষক দৃশ্য। নায়ক নায়িকা পাহাড়ি খরস্রোতা নদীতে পড়ে গেছে, প্রবল স্রোতে পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ক্রমে দেখা যাচ্ছে একজনের হাত অন্যজনের মাথা, প্রাণপণ চেষ্টা দুজনেরই স্রোতের বিরুদ্ধে যাবার। এদিকে সামনে আসছে এক বিশাল ঢল, নদী শতধারায় জলপ্রপাত হয়ে পড়ছে সেই কতনীচে, তার তরঙ্গাভিঘাতেনায়ক নায়িকার অস্তিত্ব কোথায়? তবে সিনেমায় তো এসব ক্ষেত্রেও চমৎকার কাকতালীয় কিছু ঘটে, শেষরক্ষা হয়। বাস্তবে নায়ক নায়িকার কী হয়?
আমাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দুরত্বের প্রবলস্রোতে উজান ঠেলে উৎসে ফিরতে চেয়েছিলাম। যেনতেন-প্রকারেণ। যাকে বলে সর্বাত্মক চেষ্টা এমন একটা প্ল্যান চাই। এমন একটা কার্যক্রম যাতে দুজনে মেতে যাব একসঙ্গে পাশাপাশি আবার কাজ করব। কাজের মধ্যেই তো এক হওয়া যায়। একটা মেগাফাংশান দরকার যেখানে আমার কৃতিত্ব, আমার গৌরব সব কিছু ছাপিয়ে যাবে। যার পটভূমিতে আমার ইমেজ হবে একটা বিশাল, লার্জার দ্যান লাইফ কার্ডবোর্ডে টেকনিকালার চিত্র, যেন জয়ললিতা কি অমিতাভ বচ্চন। তাই তো
প্ল্যান করলাম কটকে ইনডোর স্টেডিয়ামে বম্বের টপস্টারকে নিয়ে বিচিত্রানুষ্ঠান, অ্যান ইভনিং উইথ কুমার ভানু। বাঙালি ভবেন চক্রবর্তী বম্বে গিয়ে অর্থাৎ ন্যাশনাল স্টার হতে গিয়ে নামটাকে বদলে ফেলেছে যাতে বাঙালিত্ব প্রকট না হয়। ছোঁকরা এখন একেবারে টপে–এই নিয়ে পরপর কবার ফিল্মফেয়ার অ্যানুয়েল বেস্ট মেইল সিংগার অ্যাওয়ার্ড পেল। তাকে ধরা কি চাট্টিখানি কথা। কতমাস আগে থেকে এই কুমার ভানুর পেছনে পেছনে লেগে আছি। হেড অফিসে ট্যুর ফেলে ফেলে তাকে বারবার খোশামোদ ওনলি ফিস-এ খাতির যত্ন কলকাতায় তার প্রোগ্রামের সময় সেখানে ছুটি নিয়ে গিয়ে ধরা। শুধু ধরা নয় কোয়ালিটি-ইন-এ ভেটকি পাতুরি আর চিংড়ি-মালাইকারি খাওয়ানোনা, কুমার ভানুর টাকার অভাব নেই। সে কি আর এসব খেতে পারে না। এসব হচ্ছে দস্তুর। কুমার ভানুকে ওড়িশায় আনার পিছনে যে লম্বা ইতিহাস তাতে খরচের চেয়ে বড় কথা ঝামেলা। যাই হোক সব প্রোগ্রাম পাকা।
এমন সময় কিনা মেন স্পন্সর গীতা থাপারের টি আই এল আমাকে পথে বসালে। ভেরি সরি মিঃ দাস। কিন্তু দেখছেন তো কোম্পানির একটার পর একটা লাগাতার ক্রাইসিস। ইনকামট্যাক্স রেইড, ফেরা ভায়োলেশানের চার্জ, শেয়ারবেচাকেনা নিয়ে এনকোয়েরি…।
গীতা থাপারের ঠোঁটের রং কিন্তু তেমনি অত্যাধুনিক গাঢ় খয়েরি অর্থাৎ কি না মাটির রং বা আর্থকালার রয়েছে। গলে ফ্যাকাশে হয়নি একটুও এত সংকট সত্ত্বেও। বিজ্ঞান ও কারিগরির কী মাহাত্ম।
গীতা থাপার পিছু হটল। উপুড় হাত চিত হল। তবু আমি কুমার ভানুকে ওড়িশায় আনতে পেরেছিলম। কী ভাবে যে শুধু আমিই জানি। টিকিট বিক্রির টাকায় অনুষ্ঠানের খরচ ওঠে না, আর কটক ভুবনেশ্বরে কীইবা এমন বিক্রি। আমজনতা কেনে সবচেয়ে সস্তার টিকিট। যারা সমাজের উপরতলার মানুষ অর্থাৎ রেস্তদার, বেশিদামের টিকিট কিনতে পারেন তারা বিনে পয়সার নিমন্ত্রণ পেতে অভ্যস্ত। অগত্যা অজন্তা টি ভি আর রুবার্ড রেফ্রিজারেশান, এ দুটো কোম্পানির আনুকুল্য জোটাতে হল। দুটোরই স্থানীয় প্রতিনিধি একজর সদস্য, তাছাড়া দুটো সংস্থাই ওড়িশায় অদূর ভবিষ্যতে কিছু করতে চায় এবং আই পি বি আই অর্থাৎ আমার সাহায্যপ্রার্থী।
অতএব ঠিক দিনে শুভমুহূর্তে কুমার ভানু ও তার নবতম সঙ্গিনী হাজির। বাদ সাধল অর্কেস্ট্রা। দেনাপাওনার গণ্ডগোলে শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছল না। আজকালকার গাইয়েরা সম্পূর্ণভাবে অর্কেস্ট্রা নির্ভর। সেই কবে হারিয়ে গেছে শ্রী রামচন্দ্রের জমানা যখন শুধু হারমোনিয়ামটি কোলের কাছে, শিল্পীরা গেয়ে চলেছেন গণ্ডাগণ্ডা গান, সঙ্গতে সবেধন নীলমণি তবলচি এবং তাতেই আপামর শ্রোতাজনতা মন্ত্রমুগ্ধ ঘন্টার পর ঘণ্টা। এখন যত বড় আটিস্ট, যত নামকরা শিল্পী, সঙ্গে তত বেশি বাদ্যযন্ত্রের আসর। তত লেটেস্ট সাউন্ড সিস্টেম।
কটকের সে সন্ধের কথা মনে এলে এখনও ঘাম হয়। সেপ্টেম্বর মাস। বাইরে ভাদ্রের অসহ্য পচা গরম। একবার ইনডোর স্টেডিয়ামের ঠাণ্ডায় ঢুকছি পরক্ষণেই বেরোচ্ছি আর হাঁচছি। যদিও গেটের কাছে একতার দুজন একজিকিউটিভ কমিটির সদস্য ও সাধারণ সম্পাদক মজুত। লোকজন এসে গেছে, স্টেডিয়াম প্রায় ভর্তি, কুমার ভানু ও কুমারী দীপিকার সাজপোশাক প্রসাধন সব শেষ। কিন্তু অর্কেস্ট্রা তখনও এসে পৌঁছয়নি। আমি তো চোখে অন্ধকার দেখছি, সুজিতের নার্ভাস ব্রেকডাউন হবার উপক্রম।
হঠাৎ মনে পড়ল কটকে শ্যাডোজ নামে স্থানীয় ছেলেদের একটা অর্কেস্ট্রা পার্টি আছে। একতার ছোট ফাংশান গেটটুগেদার-এ সর্বদা ডাকি। প্রতিবছর বেশ কবার পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। সেদিন বিকেলে তাদের ডেকে বললাম এই একটা তোমাদের ওয়ান্স ইন এ লাইফটাইম চান্স। বোম্বের টপ আর্টিস্টের সঙ্গে বাজাবে। ওড়িশাতে আর কেউ তোমাদের কোনওদিন এ চান্স দিতে পারবে না। কী বল বাজাতে পারবে তো?
এদিকে নিজের বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটছে। যদি না বলে তো কী করব? বলল না। ছেলেগুলি নিরীহ গ্রাম্য, মহানগরের গ্ল্যামার তাদের কাছে স্বপ্ন। হাজির হয়ে গেল মঞ্চে। যার যা সেরা পোশাক আছে বা শেষমুহূর্তে ধারটার করে জোটাতে পেরেছে, তাই পরে। হ্যাঁ, অনুষ্ঠান একখানা হল বটে। সারা ওড়িশায় কখনও এমন হয় নি। হিউজ সাকসেস। কিন্তু তার আগে এমন টেনশান যে এতবার বলেবলে মুখস্ত করা স্পিচটা অর্ধেক ভুলে গেলাম। কোনওক্রমে চ্যারিটির চেকটা মুখ্যমন্ত্রীর হাতে ধরানো গেল। খবরের কাগজ টিভির ক্যামেরা অবশ্যই রেডি। তাদের কাজে ক্রটি হল না।
শুধু টেনশনই নয়। মেগাফাংশান করার আসল ড্যামেজ তো পকেটে, একতার ভাড়ে মা ভবানী। মোটা ডোনেশান দিয়ে আমার মুখ এবং একতার প্রাণরক্ষা করল বাঙালি ফিনানসিয়াল কোম্পানি ফিয়ারলেস, যারা কলকাতার স্ব মোক্ষম জায়গায়, ইএম বাইপাসে বিশাল বিশাল হোর্ডিং-এ বিজ্ঞাপন দেয় জনগণকে ছাড়া কাউকে ভয় পায় না ফিয়ারলেস।
হ্যাঁ, সেই ফিয়ারলেস-এর এম ডি স্বয়ং অভিজিৎ গুপ্ত, যাঁর সমস্ত ভারতবর্ষে নাম আর্থিক লেনদেনের যাদুকর, তিনি স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ক্ষতির অঙ্কটি পূরণ করলেন। অবশ্য গুপ্তর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তার আগে বছর পাঁচেক ধরে। বহু বার ওঁর কাছে গিয়েছি যথাসম্ভব করেছি। তবুও সাহায্য করাটা ওঁর তো সম্পূর্ণ মর্জির ওপর। মুশকিল হল টাকাটা দেওয়ার সময় আমাকে একটা কথা বললেন,
–এসব মেগা ফাংশান টাংশান কী করেন? প্রবাসী বাঙালি সংস্থা বম্বে থেকে আর্টিস্ট এনে হিন্দি ফিল্মের নাচগান করছে কেন? বাংলা গানের অনুষ্ঠান করুন। বাংলা নাটক আনান। কত ভাল ভাল গ্রুপ থিয়েটারের দল রয়েছে কলকাতায়। অনেক কম খরচ। খাঁটি বাঙালি সংস্কৃতি। কী এসব হিন্দিফিন্দি করেন। টিকিট বিক্রি হবে না ভাবছেন? না হোক। শুধু ইনভিটেশানে অনুষ্ঠান করুন। আমি স্পনসর করব।
অভিজিৎ গুপ্তর এনথু পেয়েই কি আমার ভুবনেশ্বরে অবস্থিতির শেষ পর্যায়ে বাংলা বাংলা করে মেতে ওঠা? না কি মনে হল এবং কাজে দেখলাম এই একটা ক্ষেত্র যেখানে মৈত্রেয়ী ও আমি আবার পরস্পরের কাছাকাছি আসতে পারি? ও সাহিত্যের ধার ধারে না, আমি না, তা হলে? হ্যাঁ, প্রচুর বাংলা গান, আধুনিক রবীন্দ্রসঙ্গীত অতুলপ্রসাদ ফোক, ওর কণ্ঠস্থ। আমিও গানটান শুনি। দু-চারকলি মনেও থাকে। মাছভাত খাই। শরৎকালে নীল আকাশ দেখলে পুজোর বাজনার জন্য প্রাণটা অস্থির অস্থির করে। শুধু এই কি বাঙালি অস্তিত্ব যেখানে আমরা দুজনে মিলিত হই? এমনতো কত কোটি বাঙালির।
.
অমল দেখে ছায়া দেবনাথের আজকাল আর কাজেকর্মে মন নেই। আগে তবু এসে নিয়মমাফিক টেম্পারেচার দেখত, রক্তচাপ মাপত, ওষুধ পত্র এগিয়ে দিত। তারপর তার ছায়াবাজি নিয়ে বসত, এখন সেসব উঠে গেছে। এইতো আজ ঘরে ঢুকেই চেয়ারে বসে পড়ে জিজ্ঞাসা,
-আচ্ছা, ভুবনেশ্বরে আপনার একতা ক্লাবের শেষ ফাংশান কোন্টা বললেন না তো? যেন অমলের জীবনকাহিনী লিখে যাওয়াই তার একমাত্র কাজ। আর কোনও কাজ নেই। অমল না বলে পারে না,
—তা তোমার কী সর্বদা ওই এক চিন্তা? আমার জীবনে কী ঘটেছিল?
–আহা, গল্প একটা চলতাসে। তারপর কী হইল জানুম না?
–উঃ তোমার ওই বাঙাল ভাষাটা একটু ভদ্রস্থ করবে। কানে লাগে।
—ভাষার কথা সাড়েন। আমরা তো তবু বাঙালি আছি। বর্তমান কাল। আপনারা তো বাঙালি সিলেন। অতীত কাল। একদিন বাঙালি সিলাম রে, সুর করে গেয়ে ওঠে ছায়া।
-ওই বোকাবোকা গানটা আমার সামনে গাইবে না। একদিন বাঙালি ছিলাম মানে? আজকে আমরা নই? অমল রাগরাগ স্বরে বলে।
-ওই, আপনাদের কি মেগাফাংশান করবার কথা ছিল। টি আই এল-এর গীতা থাপার স্পনসর, তার কী হল? শেষ পর্যন্ত ফাংশান হল? এখন কেমন দিব্যি স্বাভাবিক বাংলা বলছে। মেয়েটা বড্ড পাজি।
—হ্যাঁ, দিব্যি হল। অ্যান ইভনিং উইথ কুমার ভানু। কটক ইনডোর স্টেডিয়ামে কুমার ভানুর সঙ্গে একটি সন্ধ্যা। ইট ওয়াজ আ গ্র্যান্ড সাকসেস। কী ভাবো কী অমল কুমার দাসকে? কত গীতা থাপারকে আমি একহাটে কিনে অন্য হাটে বেচেছি। স্পনসরের অভাব আছে? ফিয়ারলেস কোম্পানি যেচে টাকা দিল। বিশাল ফিনানসিয়াল কোম্পানি ওই ফিয়ারলেস। কত স্টেট গভর্নমেন্টকে টাকা ধার দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল। জানো তো বাঙালির কোম্পানি?
—না আমি ওসব খবর রাখি না।
—তা রাখবে কেন। তোমরা বাংলাদেশিরা আছ কেবল পশ্চিমবঙ্গের খুঁত ধরতে। আচ্ছা তোমরা তো বিদেশি, এমন আরামসে কলকাতায় চাকরিবাকরি করছ কী করে? এদিকে আমাদের মেয়েরা তো কাজ পায় না। ছায়া দেবনাথের মুখের ভাব পাল্টে গেল।
-দেখুন আমি এখানে কী ভাবে আছি কোথাকার নাগরিক এ সমস্ত কথা আপনার সঙ্গে আলোচনা করব না। আপনি তো পুলিশ নন, পেসেন্ট। আপনার ওসব কথায় লাভ কী।
বাপরে। এ তো মেয়ে নয় নেতা নিশ্চয়। অমল ঠিক করে ফেলে পরের দিন ডাক্তার রাউন্ডে এলে কথাটা পাড়বে।
পাড়ে। না, কোনও পরিষ্কার জবাব নেই। মেট্রনের ভাষাভাষা উত্তর। পশ্চিমবঙ্গে নার্সিং ট্রেনিং-এ প্রবেশ বা ভর্তি হওয়াই এত শক্ত। পঞ্চাশ বছর আগে যা যযাগ্যতা চাওয়া হত এখনও তাই। তখন সাধারণ ঘরের মেয়েদের দুটিই জীবিকা ছিল–নার্সিং আর বাচ্চাদের ইস্কুলে টিচারি। তাই একটু ভাল পড়াশুনা জানা মেয়ে পাওয়া যেত। এখন মেয়েদের চাকরির ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। যে সব মেয়ের অত যোগ্যতা আছে তারা আরও অর্থকরী আরও সম্মানের কাজ পাচ্ছে। তা ছাড়া প্রচুর সংখ্যায় মেয়ে বাড়ির বাইরে বেরচ্ছে কাজের ধান্দায়। কাজেই প্রতিযোগিতা সাংঘাতিক।
অমল অবাক হয়ে মন্তব্য করেছিল, সেক্ষেত্রে বাইরের এত মেয়ে আসছে কী করে? তা ছাড়া রাজ্যের বাইরে থেকে আদৌ যদি নিতে হয় তা হলে কি বিদেশ থেকেও নেওয়া হবে? বাংলাদেশ তো আইনের চোখে অন্য দেশ না কি? ডাক্তার মেট্রন কথাটা শুনতেই পেলেন না। তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে গেলেন।
দুদিন ছায়া দেবনাথের পাত্তা নেই। কোনও ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় না তার অনুপস্থিতির। তিন দিনের দিন আবার হঠাৎ হাজির। সেই একমুখ হাসি। পরনে সেই এক সাদা কোট যা দেখে অমল প্রথম দিনই জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি নার্সের ড্রেস পর না? কোট তো ডাক্তাররা পরে।
-স্পেশাল পারমিশান, স্পেশাল পারমিশান। হৈ হৈ করে দুদ্দার কাজে লেগেছিল ছায়া।
আজকে ঘরে ঢুকেই বলেকি,
—তা সেই কুমার ভানুর মেগাফাংশানের পর কী হইল? আপনি খালি চটেন ক্যান? আমি কি অত সরকারি আইনকানুন কিছু বুঝি? বুঝি খালি রোগী আর গল্প। আপনি হইলেন গিয়া রোগী, আর আপনার কাহিনীটা হইল গিয়া অ্যাকটা গল্প। বলেন বলেন।
চেয়ার টেনে ছোট মেয়ের মতো কাগজকলম নিয়ে অমলের সামনে বসে যায়। অগত্যা। ফিয়ারলেস কোম্পানির উৎসাহ অমলের পরবর্তী অনুষ্ঠানের প্রেরণা। তবে এম ডি অভিজিৎ গুপ্তর প্রবাসী বাঙালি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যা ধারণা তাতে চলে বাংলা আঁতেল নাটক, রবীন্দ্রসঙ্গীত নজরুল দ্বিজেন্দ্রলাল অতুলপ্রসাদ, সাহিত্যসভা ইত্যাদি। অমলের কাছে গানটান ঠিক আছে। কিন্তু অন্যগুলো বিশেষ করে গ্রুপ থিয়েটারমার্কা নাটকে তার অ্যালার্জি। খালি সেই গরিবের শ্ৰেণী-সংগ্রাম শোষণ অথবা বিলিতি নাটকের কপি। তার চেয়ে বাবা আদি অকৃত্রিম স্টার রঙমহল কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ, বিজন থিয়েটারের জমাটি পালা ভাল। অর্থাৎ যাকে আঁতেলরা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেন বাণিজ্যিক রঙ্গমঞ্চ। অমল বা মৈত্রেয়ী এবং একতার বেশির ভাগ সদস্য নবনাট্য আন্দোলন সম্পর্কে খোঁজখবর রাখে না। তবে সৌম্যেন রণজিৎ এক্স-প্রেসিডেন্সি। তারা ওসব জানে ফানে। বিভিন্ন সংস্থার নাম টামও কণ্ঠস্থ। এ একটা জগৎ অমলের সম্পূর্ণ অচেনা। সে বম্বে মাদ্রাজ এমন কি ঢাকা থেকেও সুপারস্টার আর্টিস্ট এনেছে। কিন্তু নিজের রাজ্যর কোনও উচ্চকোটি নাট্যসংস্থার সঙ্গে সে রকম যোগাযোগ হয়নি। একতার সদস্যদের মধ্যে জানাশোনা কার আছে খোঁজ করতে বেরিয়ে পড়ল কলকাতার শুভম গোষ্ঠীর পরিচালক নাট্যকার সরোজ মিত্রের সঙ্গে একক্লাসে পড়ত রিজিওনাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির কৃষ্ণেন্দুব্যানার্জি। ব্যস হয়ে গেল। কৃষ্ণেন্দুকে কলকাতায় পাঠানো হল সরোজ মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগ, কথাবার্তা বাজেট, আনুমানিক তারিখ ইত্যাদি আলোচনা ধাপে ধাপে এগোতে থাকে। ক্রমে বলাবাহুল্য অমলের সঙ্গে টেলিফোনে শুভ নাট্যসংস্থার সভাপতি সুরজিৎ চক্রবর্তীর যোগাযোগ হয়।
এরই মধ্যে কোন এক পর্যায়ে জানা গেল মৈত্রেয়ীর স্কুলের টিচার ছন্দা বিশ্বাস নাকি শুভম গ্রুপে আছে, সাইড রোল করে। মৈত্রেয়ীর উৎসাহ দেখে কে। নিজে অগ্রণী হয়ে সরোজ মিত্রের সঙ্গে আলাপ করে ফেলে, বলা বাহুল্য ছন্দা বিশ্বাসের মারফত। তারপর প্রায়ই অমল টেলিফোনে শোনে নাট্যকারের মাহাত্ম্য বর্ণনা, তার কোন নাটক কী পুরস্কার পেয়েছে, বাংলায় যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন নাট্যকার মৌলিক নাটক লেখেন ইনি তাদের মধ্যে প্রধান, এঁর সব নাটকে সামাজিক ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান ইত্যাদি। প্রায়শই নাটক পর্যালোচনা অমল শোনে। যদিও সে আদার ব্যাপারী, জাহাজ সম্বন্ধে মাথাব্যথা নেই। তার চিন্তা এঁরা কজনের দল, সেট কী ভাবে আনবেন, ট্রেনে না বাসে। ট্রেনে হলে সকলেই কি সেকেন্ড ক্লাস নাকি মুখ্য কজনের এসি চেয়ার বা স্লিপার। কদিনের থাকার বন্দোবস্ত। কেউ ভেজ আছে কি না ইত্যাদি। ভুবনেশ্বরের সব গেস্ট হাউস অমলের জানা। তবে এত লোককে রাখতে হলে একটু কাঠখড় পোড়াতে হবে। অর্থাৎ কারা একতাকে, মানে অমলকুমার দাসকে সুবিধা দিতে রাজি এবং কী মূল্যে? কোন সুযোগ বা কী সাহায্য পাবার পরিবর্তে বা আশায় সেটা পরিষ্কার থাকা দরকার।
মৈত্রেয়ীর সঙ্গে অমলের এ সব নিয়ে প্রায়ই কথা হয় টেলিফোনে। শোনে মৈত্রেয়ী ইতিমধ্যেনাট্যকার পরিচালকের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে শুভমসংস্থার দুখানা শো কমপ্লিমেন্টারি পাস-এ অ্যাকাডেমিতে দেখে ফেলেছে। একেবারে মোহিত মৈত্রেয়ী। অবাক অমল টেলিফোনে তার উচ্ছ্বাসের ছোঁয়া পায়। সেরকম গরিব-টরিব নিয়ে আতলেমি, সি পি এম মার্কা জেহাদ না কি নেই। সব সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক। অমলের নিশ্চিন্ত লাগে। দীর্ঘ মনোমালিন্যের পর স্বামী স্ত্রী যেমন কোনও তৃতীয় ব্যক্তির প্রশংসা বা নিন্দায় এক হয়। জীবনটা কি সর্বদাই ত্রিভুজ। কেবল দুজন মানেই সংঘর্ষ, তৃতীয় বাহুর ওপর ভর করে ভারসাম্য বজায় থাকে।
মৈত্রেয়ীর বাংলা আধুনিক নাটকে উৎসাহের সঙ্গে অমলও এবারে পাল্লা দিতে নামে। বাঙালি সংস্কৃতি প্রচারে তার বরাবরের একটা বিশিষ্ট অভ্যাস আছে। গোটা কতক ইংরিজি গীতাঞ্জলি তার সর্বদা কেনা থাকে। যখনই ওড়িশায় কোনও মন্ত্রী, অধ্যাপক-সাহিত্যিকদের একতার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বিশেষ অতিথি সভাপতি হিসেবে নিমন্ত্রণ করতে যায় একখানা করে ইংরিজি গীতাঞ্জলি উপহার। সকলেই খুশি এবং অবধারিত মন্তব্য, মু তো অরিজিনাল বঙ্গলাটা পড়িছি। হউক। নোবেল প্রাইজ পাইবা বহি, খন্ডে আনিলে, ভল হেলা। অমল নিজে সত্যি কথা বলতে কি গীতাঞ্জলি বাংলা বা ইংরিজি কিছুই পড়েনি। তবে হ্যাঁ যে সব কবিতা গান হয়েছে, সেগুলোর ক্যাসেট অমলের কেনা। মাঝে মাঝে শোনে। এক আধটা কলি স্নানের সময় গুনগুন করে।
মন্ত্রিত্ব বদলে যাবার পর নতুন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন হয়েছে। এবারেতাকে এককপি গীতাঞ্জলি দেবার কথা। সামনে ৮ই মে, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। সেটাকে ছুতো করে আলাপ-সালাপ আরও একটু ঘনিষ্ঠ করার ইচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর ইলেকশান ক্যামপেনে অমল বেশ কখানা গাড়ির বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। প্রতিটি অ্যামসাভারের সঙ্গে ট্যাংক ভর্তি পেট্রোল ও ড্রাইভার। হাজার হলেও কংগ্রেস অমলের রক্তে, শিরায় শিরায়। পরিবারের সঙ্গে মৈত্রেয়ীকে কেন্দ্র করে মনকষাকষি যাই হোক না কেন এ কথা তো মুছে যায় না যে তারা উত্তর কলকাতায় বিশেষ করে তাদের ওই বিবেকানন্দ রোড কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের মোড়ের খাস ঘটি এলাকায় কংগ্রেসের খুঁটি। পশ্চিমবঙ্গে হাড়হাভাতে বাঙাল রিফিউজিদের জন্য সি পি এম আদি ঘটিদের কোণঠাসা করে রেখেছে। ওড়িশাতে তো নয়। এখানে অমলের একটা দাঁড়াবার জায়গা আছে। হাঁক দিলে পাঁচটা লোক শোনে। মন্ত্রিদের ঘরে তার অবারিতদ্বার। বিশেষ করে শিল্পমন্ত্রী তো তার পেছনে শক্ত দেওয়াল।
অতএব, নির্ভয়ে অমল মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে ঢুকে ইংরিজি গীতাঞ্জলিখানা তার টেবিলের ওপরে রেখে বলে,
-আ স্মল অফারিং স্যার, ফর দ্য কামিং বার্থডে অফ টেগোর।
মৃদু হেসে বইটি হাতে তুলে নেন মুখ্যমন্ত্রী। ধুতি পাঞ্জাবি কটকি উড়নিতে টিপটপ পোশাক, মুখে সর্বদা স্মিতহাসি, গলা একই গ্রামে, কখনো ওঠে না, সকাল থেকে মধ্যরাত কাজ করেন, অসম্ভব পরিশ্রমী।
—ইংরাজি গীতাঞ্জলি আনিলে। হউক। নোবেল প্রাইজ পাইথিলা। মু কিন্তু পিলা বেলরুবঙ্গলাটা পড়িছি। মোর পাখে পরা রবীন্দ্ররচনাবলী পুরা সেট অছি। অমল তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয়,
–নিশ্চয় থাকবে। ও তো জানা কথা। আপনি বাংলা ওড়িয়া সংস্কৃতে এত বড় স্কলার। তবুও আনলাম। খুশবন্ত সিং কী কমেন্ট করেছে দেখেছেন তো? তা স্যার আপনার কী ওপিনিয়ন?
মুখ্যমন্ত্রী আবার মৃদু হাসলেন।
—দূর! খুশবন্ত সিং কণ টাগোর পড়িবে আউ বুঝিবে? তাঙ্ক কথা ছাড়ন্তু। এমানন্ধু জানিছন্তি? টেবিলের বাঁ দিকে দুটি চেয়ারে বসা ভদ্রলোকেদের দিকে সঙ্কেত। অমল চেয়ে দেখে চেনা মুখ। একজন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের চাঁই হেমেন মিত্তির যার সঙ্গে অমলের বিলক্ষণ চেনাজানা, আর একজন বাংলা খবরের কাগজ প্রত্যহর মালিক নুটু দত্ত। এর সঙ্গেও অমলের সামান্য আলাপ আছে। হেমেন মিত্তির অমলকে দেখে এতক্ষণে বলে উঠল,
-এই যে, অমল এখানে। খুব যে রবি ঠাকুরের গীতাঞ্জলি উপহার দিচ্ছ, এদিকে ভুবনেশ্বরে রবীন্দ্র মণ্ডপটা কী করে রেখেছ অ্যাঁ?
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত রাজ্যকে রবীন্দ্রনাথের নামে সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের জন্য একটিস, প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের অর্থ দিয়েছিলেন। অতএব ভুবনেশ্বরেও একটি রবীন্দ্রমণ্ডপ তৈরি হয়েছে। মঞ্চ অত্যন্ত নিরেস, হও তেমনই, বসার সিটগুলো শক্ত, সরু সরু। শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। প্রত্যেকবার গানবাজনার অনুষ্ঠান করতে তার সাউন্ড সিস্টেম নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়। তবু একটা হল তো,নইলে আগে তো কিছুই ছিল না। কাজেই অমল ওড়িশার পক্ষ নিয়ে প্রতিবাদ করে,
–কেন, দিব্যি ভাল হ। চারিদিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, বিরাট জায়গা আপনাদের পুরো রবীন্দ্রসদন, নন্দন কমপ্লেক্স ধরে যায়।
-না, না সে সমস্ত সব ঠিক। বলি রবীন্দ্রনাথের নামে হত্ অথচ কোথাও তার ছবি বা মূর্তি নেই। অন্যান্য সব এরকম হ ট এ যেন কিছু না কিছু চিহ্ন আছে বলে মনে পড়ে।
নুটু দত্ত এবারে মুখ খোলেন,
—অমলবাবু তো কি সাংস্কৃতিক সংস্থা টংস্থা করেছেন। চিফ মিনিস্টার আপনার কথাই বলছিলেন এইমাত্র। খুবনাকি অ্যাকটিভ অর্গানাইজেশান। তা আপনারা একটা রবীন্দ্রনাথের মূর্তি করে দিতে পারছেন না? দক্ষ ফিল্ডার অমল তৎক্ষণাৎ সুযোগটা লুফে নেয়।
–নিশ্চয় পারি। একতা উইল ফিল অনার্ড টু ডু সো। স্যার, এবারে মুখ্যমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে,
—স্ট্যাচু তৈরি করতে দিই?
—হউক। দিয়স্ত। হেই সারিলে মতে থরে দেখাই নেবে।
—নিশ্চয়।
একতার কার্যনির্বাহী কমিটির পরের অধিবেশনেই কথাটা পাড়া হল–অধিবেশন তড়িঘড়ি ডাকাই হয়েছিল সেইজন্য। সবাই হইহই করে একমত। শুধু সেক্রেটারি সুজিত যেন একটু চিন্তিত।
—কী হল সুজিত, তোমার যেন অনিচ্ছা মনে হচ্ছে?
-না না, দাদা, অনিচ্ছার প্রশ্নই উঠছে না। আমি খালি ভাবছি রবীন্দ্রমণ্ডপের বিল্ডিং এ ঢুকে সামনে যে জায়গাটা তার দেওয়ালে তো রবীন্দ্রনাথের একটা বিশাল রঙিন ছবি রাবর টাঙানো ছিল। সেই পরিচিত ভঙ্গিতে দাঁড়ানো, সেটা গেল কোথায়?
-রবীন্দ্রনাথের ছবি ছিল না কি? কবে ছিল? কই আমরা ভুবনেশ্বরে এসে অবধি তো দেখি নি? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ছিল, তোমরা তো সেদিন এসেছে, আগে ছিল, সুজিত ঠিকই বলছে পি ডবলিউ ডি চুনকাম টুনকাম করতে গিয়ে বোধহয় নামিয়েছে, তারপর হয়তো খেয়াল নেই লাগাতে। সরকারি বাড়ি কে এতো দেখে. সদস্যদের মধ্যে আলাপ আলোচনায় সুজিত একেবারে চুপ। সে তো সবচেয়ে বেশি বকবক করে। অমলের খটকা লাগে। ওড়িয়াদের ও বোঝে, কিন্তু এই ওড়িশা প্রবাসী বাঙালি অর্থাৎ ক্যারাদের বোঝা তার সাধ্যে নেই। কী যে সবসময় ভাবে কে জানে। আরে মনের কথাটা মুখ ফুটে বললেই তো পারিস, অত ঢাকচক গুড়গুড় কিসের। না সেটি হওয়ার জো নেই। সব সময় মনের মধ্যে কী প্যাঁচ কষছে। একতার সেক্রেটারি হয়ে ব্যাটার লাভ কম। যত বাঙালি মেম্বার সব ওর গাঙ্গুরাম থেকে দইমিষ্টি কেনে। প্রায়ই গেট টুগেদার পিকনিক আউটিং-এ ও সাপ্লাই করে। দিব্যি একখানা সেকেন্ডহ্যান্ড বাড়ি কিনে ফেলেছে শহীদনগরে, মারুতি জিপসি হাঁকাচ্ছে। বড্ড বিরক্ত লাগে অমলের। বলে,
-তাহলে একজিকিউটিভ কমিটি কী ঠিক করল? মূর্তি করা হবে কি হবে না?
–কে তৈরি করাবে এবং কোথায়? চার্জ কে নেবে?
এবারে সুজিত মুখ খোলে।
-কেন, কলকাতায় দিদিভাই তো আছে, তাকেই দাদা ভারটা দিন না।
সবাই একবাক্যে হ্যাঁ হ্যাঁ। আইডিয়াটা প্রথম থেকেই অমলের মাথায় ছিল, তবে প্রস্তাবটা অন্য কারও কাছ থেকে আসা ভাল। সুজিত এদিকে খুব চালু।
-ঠিক আছে, আজ রাতেই বাড়ি ফিরে মৈত্রেয়ীর সঙ্গে কথা বলব। আচ্ছা, কী রকম মূর্তি হলে ভাল হয় বলতো? ফুল ফিগার না বাস্ট? কিসের তৈরি ব্রোঞ্জ না…
আলোচনার পর ঠিক হল শ্বেত পাথরের আবক্ষমূর্তি। কালো গ্রানাইটের স্তম্ভের ওপর বসানো থাকবে।
-পেডেস্টালের খরচ কে দেবে? সুজিতের অতিপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। দোকানদার তো, মাটিতে পা ছুঁড়ে আছে সবসময়। এইজন্যই ওকে সেক্রেটারি রাখা।
-আমরা দেব। নালকো উইল প্রোভাইড দ্য পেডেস্টাল, তৎক্ষণাৎ এগিয়ে এলেন নালকোর এম ডি বিশ্বেশ্বর দ্বিবেদী, একতার উনি অন্যতম উপদেষ্টা। ভাগ্যে সেদিন বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। শুধু খরচই নয়, নালকো কালো গ্রানাইটের পেডেস্টাল একেবারে তৈরি করে দেবে ঠিক হল।
অতঃপর অমলের জীবনের স্বর্ণযুগ ভুবনেশ্বরবাসের শেষ অধ্যায়ের শুরু রবিঠাকুরের মূর্তি স্থাপন কর্মপরিকল্পনা। টেলিফোনে মৈত্রেয়ীর সঙ্গে সে উপলক্ষে কথাবার্তা। তার স্কুলের টিচার মৃদুলা পাল-এর জানাশোনা বেরুল কুমারটুলিতে।
-দুর! ওরা তো কুমোর, প্রতিমা তৈরি করে ঠিক আছে। কিন্তু এটাতো মাৰ্বল স্ট্যাচু হবে, ওরা পারবে কেন।
-আরে না না। ওদের মধ্যে আজকাল কেউ কেউ মূর্তিফুর্তি করছে। শুনলাম ভালই করে। আমরা তো চাইছি মাস তিনেকের মধ্যে মূর্তি রেডি হোক, তাই না? নামকরা ভাস্কর কেউ কখনও এত অল্পসময় করে দিতে পারবে না। পারলেও সেই অনুপাতে মোটা টাকা চাইবে। তাছাড়া আমাদের কারও সঙ্গে তো চেনাজানা নেই। হঠাৎ পাব কোথায়?
দু-তিনবার আলোচনার পর ঠিক হল শক্তিরঞ্জন পাল রবীন্দ্রনাথের আবক্ষমূর্তি মাস দেড়েকের মধ্যে প্রস্তুত করে ট্রেনে ভুবনেশ্বর পাঠাবার বন্দোবস্ত করে দেবে। তাকে ভুবনেশ্বর স্টেশনে নামিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব একতার।
এদিকে মূর্তি স্থাপনের প্রাথমিক কার্যক্রম আছে। রবীন্দ্রমণ্ডপের লবির আয়তন অনুপাতে বেদিস্তম্ভের উচ্চতা ও পরিধি হওয়া চাই। তাছাড়া ঠিক কোথায় বসানো হবে জানা দরকার। খোঁজখবরের জন্য অমল চলল পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলতে। তখন শ্রীদেবেন্দ্র পানিগ্রাহী টেকনোক্র্যাট সেক্রেটারি, অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার। উনি প্রস্তাব শুনে একটু বিস্মিত হলেন, তবে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর অভিলাষ জেনে অধঃস্তনদের ডেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে দেরি করলেন না। তারপর অমলকে বললেন,
–দেখুন মিঃ দাস, আপনি বললেন মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছে আমি মেনে নিলাম। কিন্তু রিটুন অর্ডার এবং সেটা প্রপার চ্যানেলে না আসলে কিন্তু কাজটা হতে পারবে না।
-অর্ডার কি চিফ মিনিস্টার নিজে দেবেন?
-না। আপনাদের ক্লাব ডিপার্টমেন্ট অফ কালচারের সেক্রেটারিকে একটা পিটিশান পাঠাবে। ডিরেক্টর অফ কালচারের মারফত। আপনারা অনুরোধ জানাবেন যে রবীন্দ্রমণ্ডপে আপনাদের রবীন্দ্রনাথের মূর্তি প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হোক। ওটাতে আপনারা স্পষ্ট উল্লেখ করে দেবেন যে নালকো অর্থাৎ ন্যাশনাল অ্যালয় করপোরেশন পেডেস্টাল দিতে রাজি নালকো থেকে সেই মর্মে একটা চিঠিও করে নেবেন যার কপি আপনাদের আবেদনটির সঙ্গে থাকবে। বুঝলেন রবীন্দ্রমণ্ডপ তো সরকারি সম্পত্তি, একটু নিয়মকানুন মানতে হবে।
-আচ্ছা মন্ডপটা তো সেন্ট্রাল গর্ভমেন্টের টাকায় হয়েছে তাই না? স্টেট গর্ভমেন্টের তো নয়।
হলেও, তার মেনটেনেন্স মানে দেখাশুনা রক্ষণাবেক্ষণ রাজ্য সরকারের। আমাদের তো একটা দায়িত্ব আছে।
-ঠিক আছে, তাই লিখি। কিন্তু স্যার দেখবেন কাজটা যেন আটকে না যায়।
-না না তা হবে না। সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমরা এদিকে প্রিলিমিনারি কাজ সব করে রাখছি। রিটন অর্ডার এলে ইমিডিয়েট একজিকিউশান।
-থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার থ্যাঙ্ক ইউ। আমি সত্যি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। ওড়িশা সরকারের কাছ থেকে আমি সর্বদা কো-অপারেশান পেয়ে এসেছি। একেবারে পূর্ণ সহযোগিতা।
-এবারেও পাবেন। কিছু চিন্তা করবেন না।
—স্যার, অনুষ্ঠানে কিন্তু আপনাকে আসতেই হবে, ফ্যামিলি নিয়ে।
—যাব, নিশ্চয় যাব। কার্ড একখানা পাওয়া যাবে তো?
—কী যে বলেন স্যার, একখানা কি বলছেন কত কার্ড আপনার চাই আমাকে কাইন্ডলি বলবেন আমি নিজে এসে দিয়ে যাব।
-ঠিক আছে। সে হবে খন।
অতঃপর সেক্রেটারির পরামর্শ অনুযায়ী ইঞ্জিনিয়ার ওভারশিয়ারদের বগলদাবা করে অমল নিয়ে গেল রবীন্দ্রমণ্ডপে। মাপজোক প্ল্যান সব হল। বেদিস্তম্ভের কতটা উচ্চতা ও ঘের কাম্য জেনে দ্বিবেদীও কাজ শুরু করে দিলেন।
একতার একজিকিউটিভ কমিটির ঘন ঘন অধিবেশন বসছে আজকাল। প্রত্যেকটি পদক্ষেপ সবাইকে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া। অমল যেন মনে মনে ধরেই নিয়েছেতার ভুবনেশ্বর বাসের বিবিধ কর্মকাণ্ডে রবীন্দ্রমূর্তি স্থাপন হবে উপযুক্ত পরম পরিণতি। আ ফিটিংক্লাইম্যাক্স। অন্যান্য সদস্যরা আপনি থেকে তার সঙ্গী। এবারে প্রশ্ন মূর্তির স্তম্ভমূলে কী লেখা হবে। সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হল একতাবানালকোরনাম থাকবেনা। শুধু লেখা থাকবেরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১-১৯৪১। ব্যস। কী ভাষায় লেখাটা হবে? দ্বিবেদী অবাক হয়ে বললেন, -আংরেজি আউর হিন্দিমে। এ ক্যায়া সোঁচনে কো বাত হ্যায়।
একজিকিউটিভ এঞ্জিনিয়ার বিজয় মহান্তিকে সেদিন মিটিং-এ ডাকা হয়েছে। মতামতের জন্য। তার তৎক্ষণাৎ আপত্তি, ওড়িশার রাজধানী ভুবনেশ্বরে একটা মূর্তি স্থাপিত হচ্ছে, ওড়িয়া ভাষায় নাম লিখতে হবে। সকলে সহমত। অমল একবার ভাবল, সবাইকে মনে করিয়ে দেয় স্তম্ভমুলের চারটি দিক, তিনদিকে তিনটি ভাষা তো হল। চতুর্থদিকে বাংলায় নাম লেখা হলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
রবিঠাকুর কবি সাহিত্যিক মানুষ, যদিও তিনি আঁকা-ফঁকা নাচ গান নাটক থেকে শুরু করে বাটিক গ্রাম উন্নয়ন অনেক কিছু করেছেন। বাংলা ভাষা তার আত্মপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম, গ্যেটের যেমন জার্মান, টলস্টয়ের রুশ, শেক্সপিয়ারের ইংরিজি। গ্যেটে টলস্টয় শেক্সপিয়ারের ছবি বা মূর্তির তলায় কি পরিচয় লেখা হয় না জার্মান রুশ ইংরিজি ভাষার লেখক? অমল এইখানে ভারতীয়আখ্যার মানে বুঝতে পারে না। তবে সে তো আঁতেল বা জাতীয়তাবাদী নয়, ব্যাঙ্কার। লাভ-ক্ষতি নিয়ে তার জীবন। তার দৃঢ় বিশ্বাস কোনও এক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কোনওরকম ফায়দা ওঠাবার জন্যই রবিঠাকুরের বাঙালি পরিচয়টি লোপ পেয়েছে।
একজিকিউটিভ কমিটি মিটিংএ কেন জানি না অমল কথাটা প্রকাশ করতে পারে না। দ্বিবেদী ও মহান্তির উপস্থিতি কি তার মুখ বন্ধ রাখল? কে জানে। তবে সেদিন বেশি রাতে এসটিডিতে ধরে মৈত্রেয়ীকে।
-জানো পেডেস্টালের তিন দিকে ইংরিজি হিন্দি ওড়িয়া ভাষায় রবি ঠাকুরের নাম লেখা হচ্ছে। আমি বলছিলাম কি ফোর্থ সাইডে বাংলায় দিলে হত না?
-কথাটা মন্দ নয়। পেডেস্টালের তো চারটে দিক। না হয় বাংলাটা মুর্তিটা পেছন দিকেই থাকল। আফটার অল তিনি তো সারাজীবন বাংলাতেই লিখেছেন। তবে দেখো ওরা আবার বাংলা বানান টানান ঠিকমতো লিখতে পারবে তো? অবশ্য বাংলা বানানের এখন কোনও মা বাপ নেই, সবাই সম্পূর্ণ স্বাধীন। তবু টিভির বাংলা বিজ্ঞাপনের মতো আসোল অপনার যেন না হয়।
—ভাবছি মূর্তিস্থাপন উপলক্ষে একটা পুরোপুরি বাঙালি অনুষ্ঠান করব। এখন তো আমরা বাঙালি অনুষ্ঠান শুধু নিজেদের মধ্যে করি, সব বাই ইনভিটিশান। আর টিকিট করে পাবলিক ফাংসান মানে তো ইংরিজি হিন্দি গান, বড়জোর ক্লাসিক্যাল ডান্স।
-কথাটা মন্দ নয়। তবে সাবধানে ভেবেচিন্তে কর বাবা। মনে আছে সুমিতকুমার আর মীনা পায়েলা মঞ্চে বাংলা বলছিল বাংলা গান গাইছিল বলে কী রকম আওয়াজ দিল অডিয়েন্স?সুমিতকুমার ঘাবড়ে গিয়ে হিন্দিতে সুইচ আর বাংলাদেশি মীনা সাবাস কালান্দার গেয়ে তাড়াহুড়ো করে প্রোগ্রাম শেষ।
–তবে ভুবনেশ্বরের অডিয়েন্স জব্দ হয়েছিল বেলিয়াপ্পার বাংলা গানে, মনে আছে? ওই বিশাল কালো দশাসই চেহারা ইয়া চওড়াপেড়ে কাঞ্জিভরম,নাকে কানেহীরে। এককেবারে সেদো তেঁতুলাম্মা, সে কিনা গলা খুলে গাইতে লাগল কলকাতা তুমি কত অপরূপাসবাই দিব্যি সোনামুখ করে শুনল।
-যা বলেছ। আর ঐ ছোঁকরা পাঞ্জাবি প্রীত সিং আনন্দ যখন পাগড়ি মাথায় কুর্তা–চোস্ত গায়ে পরিষ্কার বাংলায় নিজের পরিচয় দিয়ে ধরল আমি বাঙালি হব?
–হা হা হা হা।–হা হা হা হা।
–এবারে শোনো,বাঙালি বাংলা বলবে বাংলা গাইবে। মূর্তিস্থাপন খাঁটি বাঙালি অনুষ্ঠান হবে।
—জানো,ভাবছি একজিকিউটিভ কমিটির মেম্বারের স্ত্রী বাড়ির মেয়েরা সবাই লালপাড় কোরা শাড়ি পরবে,সঙ্গে লাল ব্লাউজ,কপালে লাল টিপ।
–এখন থেকে সবাইকে বলে দিতে হবে। আজকালকার মেয়েদের লালপার শাড়ি আছে কি না সন্দেহ। চেয়ে চিন্তে যেমন করে তোক জোগাড় করবে। করতেই হবে। বেশ ভাল দেখাবেকী বল? একেবারে টিপিকাল বোং। ভুবনেশ্বরে মোস্ট পোবাবলি এটাই আমার শেষ ফাংশান।
–কেন,বদলির কিছু শুনলে নাকি?
–গতবার যখন অর্ডার এসেছিল, দেখলে তো কত কাঠখড় পুড়িয়ে ধরা করা করে বন্ধ করলাম। কী না করেছি বল। কটক ভুবনেশ্বরের তিন তিনটে স্পেশালিস্ট সার্টিফিকেট দিয়েছে অসুস্থ বিধবা মা আমার কাছে, চিকিৎসা চলছে, তার যা শরীরের অবস্থা তাতে নড়ানো চড়ানো যাবে না। এ ছাড়া চিফ মিনিষ্টারকে দিয়ে প্রাইম মিনিষ্টারের অফিসে পারসোনাল রিকোয়েস্ট করিয়েছি। যাকে বলে নো স্টোন আনটানড। এম ডি আগরওয়াল কী বলে জানো? আমি নাকি শুধু একতাক্লাব আর ফাংশান নিয়েই থাকি, ব্যাঙ্কের কাজকর্ম কিছুই করিনা। ব্যাটা হরিয়ানভি কালচারের কী বোঝে? সবাই ভেতরে ভেতরে আন্টিবেংগলি।
-আচ্ছা, তোমার সেই এ সি চ্যাটার্জি, তাঁর না এম ডি হবার কথা? সেবার ভুবনেশ্বরে এলেন। তুমি কত খাতির করলে, বড় রাস্তায় ব্যানার ওয়েলকাম টু এ সি চ্যাটার্জি।
–তিনি আর হলেন কই। আগরওয়াল অপোজিট ক্যাম্পের সেই লেংগিটা মেরে উঠল। তাই তো আজ আমার এত দুশ্চিন্তা। সবাই তো জানে এক স্টেশনে একনাগাড়ে বারো বছর কেউ পায় না। হেড অফিস আগরওয়াল গ্রুপ পেছনে লেগে গেছে আর কি। রুলফুল দেখাচ্ছে।
– এবারে তুমি কদিন কলকাতা ঘুরে যাও। ভুবনেশ্বর যা গরম, আমি বর্ষা আসলে পর যাব।
– ভাল কথা মনে পড়ল। পরশু দিন সকালে অফিসে ঢুকেছি, প্রাইভেট সেক্রেটারি বিভু মহান্তিকে জানো তো? ও একগাল হেসে বলল,
–সার,আম ভুবনেশ্বর বিব্বিসিরে আসিলা। কালি কণ নিউজরে দেইথিলা, সার শুনিলে? আমি তো অবাক। ভুবনেশ্বরে হঠাৎ এমন কি ঘটল যে বি বি সি নিউজে দেবে। আর এত ইম্পর্টেন্ট ঘটনা আমি জানি না।
উত্তর দিলাম, না তো শুনি নি। কী বলল কী? সগর্বে মহান্তি উত্তর দিল,
–গত দুইদিন ধরি সার ভুবনেশ্বর ইজ দ্য হটেস্ট প্লেস ইন সাউথ এশিয়া। সতে সার বিব্বিসিরে দেলা।
–হো হো হো। -হা হা হা—
–এবার ছাড়ি। তোমার ব্যাঙ্ক তত ফতুর হয়ে যাবে এসটিডি বিল দিতে দিতে।
ব্যাঙ্ক টেলিফোন বিল দেয় বলে যে অমল এতক্ষণ ধরে মৈত্রেয়ীর সঙ্গে এসটিডি-তে কথা বলে সেটা ঠিক নয়। ব্যাঙ্ক না দিলেও বোধ হয় করত। এত মন খুলে কথা বলছে তারা। এত হাসছে। প্ল্যান করছে একসঙ্গে কিছু করার, এটাই তো বিরাট লাভ। গত বছর দুয়েক কেমন একটা ভাটা এসেছিল তাদের সম্পর্কে। আগে আগে তারা একসঙ্গে হত নাটক করতে। না, গ্রুপ থিয়েটার মার্কা আঁতেল বা গরিব দেখানো নাটক নয়। অফিস ইউনিয়নের জমাটি প্লে। মৈত্রেয়ী কত কলকাতা থেকে এসে এসে রিহার্সাল দিয়েছে। যার জন্য নাটক মঞ্চস্থ হত বিচ্ছিরি সিজনে, জুলাই আগস্টের ঘোর বর্ষায়। স্কুলের গরমের ছুটিটা পুরোদমে মহড়ায় লাগানো হত তো।
এ দু বছর নাটকও আর হয় নি। কার স্ত্রীকে ক লাইনের বেশি কলাইনের কম রোল দেওয়া হয়েছে সে নিয়ে মেয়েদের মধ্যে রেষারেষি। স্বামীদের মুখভার, গেট টুগেদার-এ ড্রিংক ফ্রিংক করে কথা কাটাকাটি। এই জন্যই তো বাঙালিদের কিছু হয় না। আরে তোমার স্ত্রীর রঙ ফর্সা, তোমার স্ত্রীর মুখোনা সুন্দর, তাতে কি হল?অভিনয় করতে জানে মৈত্রেয়ীর মতো? হিংসে করার কোনও লজিক্যাল বেস-ই নেই। যাই হোক এসবের পর ইনহাউস নাটক বন্ধ। ফলে অমল আর মৈত্রেয়ীর কাছাকাছি হওয়াটা কমে গেল। মৈত্রেয়ী ইদানীং কেমন নির্বিকার। ভুবনেশ্বরে আসাটা যেন সপ্তাহান্ত রুটিন, বাকি পাঁচ দিন যেমন স্কুল, কাজ।
অমলের অস্বস্তি হয়। মাঝে মাঝে গভীর রাতে নেশা কেটে গেলে ঘুম ভেঙে যায়। তখন অন্ধকারে কেমন ভয়ানক একা লাগে। ভয় করে। বাকি রাতটা আর ঘুম আসে না। সকালে অফিসের জন্য তৈরি হতে কী ভীষণ ক্লান্তি। মনের মধ্যে খচখচ করে মৈত্রেয়ী কি সত্যি উদাসীন হয়ে পড়েছে? অমল কী করে না করে তাতে যদি তার কিছুই এসে যায় না তাহলে তাদের সম্পর্কের জোড়টা কী রইল? নাকি সম্পর্ক মানে শুধু রিচ্যুয়েল, নিত্য অভ্যাসমত আচার অনুষ্ঠান মাত্র? নাঃ, এমন একটা ফাংশান করতে হবে যার কর্মযজ্ঞে দুজনে আবার একসঙ্গে জড়িয়ে পড়বে। আবার আগেকার মতো।
একদিকে মৈত্রেয়ী, অন্যদিকে একতার একজিকিউটিভ কমিটি, মাঝখানে সেতুঅমল। দুদিকে আলোচনা করে স্থির হল ঘটা করে রবীন্দ্র জন্মোৎসব করা যাবেনা। সময় খুব কম। এদিকে সামনের বছরের জন্য ফেলে রাখা অসম্ভব, তখন অমল কোথায় থাকবে তাই ঠিক নেই। অতএব, ২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিনে মূর্তির আনুষ্ঠানিক স্থাপনা। অর্থাৎ আবরণ উন্মোচন।
কে করবেন? প্রথম ক্যান্ডিডেট রাজ্যপাল (বাঙালি আই এ এস উপদেষ্টারা যদি ব্যবস্থা করে দিতে পারেন), না পাওয়া গেলে মুখ্যমন্ত্রী। অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীকে ডাকতেই হবেইন এনি কেস। প্রথমে বাইরে অনুষ্ঠান পর্দা সরানো–এখানে টিভির লোকদের ভাল করে ব্রিফিং দরকার। মৈত্রেয়ীর নেতৃত্বে লালপাড় লাল ব্লাউজ পরা মেয়েরা ঘিরে থাকবে। তারপর সবাইহ এবসবে—এইসময় একটু প্যান্ডোমোনিয়াম হবার সম্ভাবনা, তার জন্য ভল্যান্টিয়ার চাই, পুলিশ তো থাকবেই। উদ্বোধনীরবীন্দ্রসংগীত হবে কোরাসে—গান মৈত্রেয়ী বাছবে। রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী সংস্কৃতি দপ্তরের মন্ত্রী ছাড়াও মঞ্চে থাকবেন উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওড়িয়া বিভাগের প্রধান বিশ্ববিন্ধু শতপথী। কে যেন বলছিল ওঁর গবেষণার বিষয় ওড়িয়া কাব্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব। বইটইও নাকি আছে। ভাষণ সব শেষ হলে সমাপ্তি সঙ্গীত। সমুখে শান্তি পারাবার গাইবে এক্স। তারপর পাঁচ মিনিটের বিরতি। এবারে কলকাতার বিখ্যাত নাট্যগোষ্ঠী শুভম-এর বহুসমাদৃত নাটক পরিবেশন কাহিনী বেগম সাহেবা।
একটু তাড়াতাড়ি অর্থাৎ বিকেল পাঁচটায় আরম্ভ। ভাষণের সময় তো এমনিতেই লোকে আসে না, নাটকটা যাতে সাড়ে ছটায় শুরু হয়ে যায়। কারণ সেই রাতেই শুভ ফিরে যাবে কলকাতা জগন্নাথ এক্সপ্রেসে,দশটা পঁয়তাল্লিশ রাইট টাইম তবে এগারোটার আগে কখনও আসেনা। সঙ্গে প্যাকরা ডিনার। ব্যস। একজিকিউটিভ কমিটির মিটিং ডেকে সব পয়েন্ট বাই পয়েন্ট আলোচনা করে চূড়ান্ত হল, কে কোন্ দায়িত্ব নেবে শুভম-এর থাকা খাওয়া ট্রান্সপোর্ট এদিকে রবীন্দ্রমণ্ডপে গেস্টদের রিসেপশন, এমন কি লাল পাড় কোরা শাড়ি পরা কেউ না কেউ খবরদারি করবে। দু-একজন অবশ্য জিজ্ঞাসা করেছিল,
– কোরা শাড়ি কী?
–আরে অফ হোয়াইট, আসলে আনব্লিচড। জ্ঞান দান হল।
যদিও এর মধ্যে মৈত্রেয়ী শুভ গোষ্ঠীর সঙ্গে এমন জমে গেছে যে শুভ-এর পরের নাটকে কোনও ক্যারেকটার রোলে নেমে পড়তে পারে এমন অবস্থা তবুও অমল একতার সভাপতি হিসেবে একবার সরাসরি পাকা কথা বলবে স্থির হল।
দরকার বুঝলে দুদিনের জন্য কলকাতায় একটা ট্রিপ মেরে দেবে।
তার দরকার হল না। শুভ গোষ্ঠীর সম্পাদক অরিন্দম সেনকে টেলিফোন করতেই সব ফাঁইনালাইজ করে ফেলা গেল। তিনিই বললেন, আপনার এজন্য কলকাতায় আসার কী দরকার। মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে তো আমাদের সব কথা হয়েই গেছে। টাকাটাও মৈত্রেয়ীর মারফত হাতে হাতে পৌঁছে যাবে ঠিক হল। ওদের শুধু একটা বক্তব্য ছিল। মাত্র একটা শো-এর জন্য এত লোকলস্কর সেটিং লটবহর সব নিয়ে যাওয়া কি পোষায়, কটকে যদি আর একটা শো-এর ব্যবস্থা করা যায় বা ভুবনেশ্বরেই অন্তত দুটো তাহলে একতারও সুবিধে, ওদেরও খেটে তৃপ্তি। অমল চুপ করে শোনে। কিছু কথা দেয় না। তার তো বরাবর ওইটাই মাথাব্যথা। ভুবনেশ্বরে বাংলা নাটক দেখার দর্শক কজন? বিশেষ করে টিকিট কিনে। কোনওক্রমে কুড়িয়ে বাড়িয়ে একটি শো দাঁড় করানো যেতে পারে নইলে তো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্গসংস্কৃতি অনুষ্ঠানের মতো শুধু চেয়ারই দর্শক থাকবে। ওটা দেখার পর থেকে অমলের কাছে বাংলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রায় দুঃস্বপ্ন। অথচ কেন কে জানে পাকেচক্রে আজ সেই বাংলা অনুষ্ঠানের জন্যই উঠে পড়ে লেগেছে।
তার তত ধারণা ওড়িশায় স্থায়ী বাসিন্দা বাঙালিদের ভরসায় ভুবনেশ্বরে বাংলা নাটক করা যায় না। তাদের দরদ তো স্থানীয় কালীবাড়ির যে কোনও অনুষ্ঠানেই দেখা যায়। এদের সবকিছুই প্রায় ওড়িয়াতে। চেহারা চালচলনে একশো বছর আগের বাঙালি কেরানিবাবু। এখনকার কলকাতায় কেরানিরা ঢের ঢের সংস্কৃতিমনস্ক। তাদের পরিবার অনেক সীমিত। সংসারের বোঝায় ঘাড় অতটা নুয়ে পড়ে না, দৈনন্দিনের যাবতীয় বাজার-দোকান-হাট ছেলেমেয়ের স্কুলকলেজ যাতায়াত তাদের দু-চাকাবাহনের ওপর নির্ভরশীলনয়। কলকাতায় অজস্র ট্রাম বাস মিনি অটো ট্যাকসি। স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে সকলে সচল। ভুবনেশ্বরে সে উপায় নেই। ভারতবর্ষের বোধহয় এটা একমাত্র স্টেটক্যাপিটাল যেখানে নিয়মিত সারাদিন যথেষ্ট সংখ্যায় জন-পরিবহণ নেই। অফিস টাইমে খাস দুতিনটে রাস্তায় যাও বা কিছু পাওয়া যায় বাকি সময় মফঃস্বল শহরের মতো সাইকেল রিক্সা সম্বল।
অথচ ছড়ানো ছিটানো আধুনিক শহর। বড় বড় রাস্তা, কোথাও উঁচু কোথাও রা নিচু। রিক্সাচালকের অতিরিক্ত শ্রম ও যাত্রীর অতিরিক্ত ব্যয়। সবচেয়ে বড় কথা রাত দশটায় চার নম্বর ইউনিটের রবীন্দ্রমণ্ডপ থেকে সেই পুরনো ভুবনেশ্বর বা শহীদনগর আচার্য বিহার যেতে রিক্সা আদৌ পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। ফাঁকা নিঝুম রাস্তাঘাট, নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। এখন আর সে ওড়িশা নেই, হিন্দি সিনেমা টিভি সিরিয়ালের কল্যাণে চুরি ছিনতাই নারীঘটিত অপরাধ আকছার। এতএব, এ শহরে সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ ও অনুষ্ঠানাদি একান্তভাবে শ্রেণীনির্ভর। যাদের গাড়ি আছে বা গাড়ি জোগাড়ের ক্ষমতা আছে সেই মুষ্টিমেয় কিছু পরিবারই প্রথম সারির দর্শক। বাকিতে আমজনতা, সাইকেল স্কুটার আরোহী ছেলেছোঁকরা লফংগা-চ্যাংড়ার দল। বাংলা নাটক তো দুরের কথা কটা ওড়িয়া নাটক টিকিট বেচে ওড়িশার রাজধানীতে হয়। অন্তত অমলকুমার দাসের মনে পড়ে না।
হঠাৎ ছায়া দেবনাথ বাধা দেয়।
—এইটা কী বলতাসেন? ওড়িয়ারা নাটক-ফাটক করে না। তাই কি কখনও হয়। এই শহরে পাড়ায় পাড়ায় যে ব্যাঙের ছাতানার্সিহোমগুলা, সেইখানে গিয়া দ্যাখেন কামকরতাসে কত ওড়িয়া নার্স। যারা এত শিক্ষা পাইতাছে দ্যাশের বাইরে যাইতাসে আর নাটক কখান লিখব না। এটা কি অ্যাকটা কথা হইল।
–উঃ ছায়া। তুমি তো দিনকে দিন আরও বাঙাল হয়ে যাচ্ছ। একটা লাইনও ঠিকমত বলতে পার না। এদিকে খসখস করে আবার লিখছ। মা গঙ্গাই জানেন কী লেখ। বুদ্ধিতা বাঙালের মতো। দেশের বাইরে কাজের সঙ্গে নাটকের সম্পর্ক কী?
–বাঃ, সম্পর্ক নাই? যে জাত যত দ্যাশবিদ্যাশ দেখে সেই তো পাঁচটা নূতন জিনিসের স্বাদ পায়। নূতন বিদ্যা শ্যাখে, নূতন চিন্তাভাবনা মাথায় আসে। নিজেরে বদলাইতে চেষ্টা করে। বদল মানেই তো আগাইয়া চলা। সেই যে শ্রীচৈতন্যদেব বাহির হইলেন মায়ের কোল ছাইড়া, দক্ষিণযাত্রা, উত্তরযাত্রা, সেই তো হইল বাঙ্গালি জাতির অগ্রগতির শুরু।
বাব্বা। এতো সাধারণ মেয়ের মতো কথাবার্তা নয়। ভাল করে ছায়ার দিকে তাকায় অমল। না সেই এক চেহারা। ছোটখাটো শ্যামলা, দাঁত উঁচু। কোথাও কোনও বৈশিষ্ট্যের ছাপ নেই। তাহলে বাংলাদেশের ইস্কুলে শ্রীচৈতন্যদেব সম্পর্কে এসব পড়ায় না কি। হবেও বা। পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার জন্য বাঙালিত্বের মহিমা উপলব্ধির চেষ্টা। অথচ গত পঞ্চাশ ষাট বছরের কথা বললে যেন শুনতেই পায় না। এই বাংলাদেশিরা সত্যি অদ্ভুত, তাল পাওয়া যায় না।
—তুমি এত বড় বড় কথা শিখলে কোথা থেকে?
–বড় বড় কথা না কি? কে জানে কোথায় পড়সিলাম। নির্বিকার উত্তর।
–তা আপনাগো বাংলা নাটক কী হইল? আর বাঙ্গালি অনুষ্ঠান? কোনও প্রশ্ন উত্তর পাওয়া পর্যন্ত ছায়া দেবনাথ চালিয়ে যাবে। একেবারে বাঙালের গোঁ। অমল চুপ করে থাকে। খানিক পরে বলে,
-আজ আর কথা বলতে ভাল লাগছে না। কী হবে জেনে? কোথায় একটা বাংলা নাটক হল কি হল না তাতে পশ্চিমবঙ্গে কার কী এসে যায়? আর রবি ঠাকুর। তার ছবি মূর্তি তো ছড়াছড়ি। তাকে শ্রদ্ধা করলেও কিছু না, গালাগালি দিলেও কিছু না। বাঙালিদের কিছুতেই কিছু আসে যায় না। মনে মনে বলে শালা হারামির জাত, এই বাঙালি। সেদিনের মতো ছায়া দেবনাথের বিদায়।
.
কিন্তু প্রশ্নটা তো বিদায় নেয় না। স্মৃতি সর্বদাই সজাগ। ভুবনেশ্বরে অর্থাৎ ভারত নামে দেশের একটি রাজ্যের রাজধানীতে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থে নির্মিত রবীন্দ্রমণ্ডপে, অন্য একটি রাজ্যের কিছু অনাবাসীদের উপহার রবীন্দ্রমূর্তি প্রতিষ্ঠা, একটি নাট্যগেষ্ঠীর বিশেষ ভারতীয় ভাষায় নাটক উপস্থাপনা, সেটা এমন একটা কী ব্যাপার যে আমার জীবনে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়ের শেষ পরিণতি হিসেবে চিরস্থায়ী হয়ে রইল?
সনাতন জীবনচর্যার বিরুদ্ধে বিদ্রোহীইংরেজভক্ত বিষ্ণুপদ দাসের পৌত্র, জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসকর্মী হরিচরণ দাস বিএ বিএল-এর পুত্র, স্বাধীন ভারতের নাগরিক, জনগণের সেবায় সরকারিভাবে নিয়োজিত এই আমি শ্রী অমল কুমার দাস যার অস্তিত্বের তাৎপর্য একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশিত। অনুষ্ঠান ভাল হোক বা মন্দ হোক বা আদৌ না হোক একটি সময় ও স্থান বিশেষের ঘটনামাত্র। জীবন তত বহতা স্রোত, অথচ তার গতিপ্রকৃতি নির্দিষ্ট হয়ে গেল স্থানকালের মিলিত এক বিন্দুতে। আসল প্রশ্ন তো রয়ে যায়। যে ভীষণ দর্শন পুরুষের হাতের কাস্তেতে মানবজীবনের সব সম্পর্ক কর্মকীর্তির ফসল নির্মমভাবে কচুকাটা হয়, তার অনিবার্য কোপ কি এড়াতে পেরেছিল সামাজিক সমর্থন বঞ্চিত জীর্ণ শীর্ণ প্রেম?
এ প্রশ্নের উত্তর প্রাজ্ঞজনের জানা। তবু ছায়া দেবনাথের মতো সরল আগ্রহী শ্রোতা না শুনে ছাড়ে না। তার কাছে আদর্শ টিভি সিনেমার পর্দা, যেখানে খাদের ওপর দু আঙুলে ঝুলে থাকা নায়ক বেঁচে যায়, পাহাড়ের ওপর লাফিয়ে ওঠে, মহাবলে পরাস্ত করে ভিলেনকে। অতঃপর লক্ষ্মীনায়িকাটি বাহুবন্ধনে। হ্যাপি এন্ডিং, মধুর সমাপ্তি। অথবা একহাত ফেরৎ অতএব ততযোগ্য নয় নায়িকার কোনও কুমারী তরুণীর হাত নায়কের হাতে তুলে দিয়ে মৃত্যুবরণ, কাশীপ্রবাসটা এখন আর তেমন চলে না। মোদ্দা কথা হয় কমেডি নয় ট্রাজেডি। মিলন অথবা মৃত্যুর অপেক্ষা করে আছে ছায়া দেবনাথ।
.
একদিকে অমলের রবীন্দ্রমূর্তি স্থাপনা ও শুভ নাট্যসংস্থার ভুবনেশ্বরে অবস্থানের জোগাড়যন্ত্র, অন্য দিকে কলকাতায় মৈত্রেয়ীর মূর্তি প্রস্তুতকার শক্তি রঞ্জন পাল ও নাট্যকার পরিচালক সরোজ মিত্রর সঙ্গে ঘন ঘন যোগাযোগ পাল্লা দিয়ে চলছে। কোমর বেঁধে লেগে গেছেএকতার কার্যনির্বাহী সদস্যরা। দেখতে দেখতে মূর্তি তৈরি, সেটি সপ্তাহান্তে পাঠানো স্থির, কারণ মৈত্রেয়ীও সে ট্রেনে থাকবে। পেল্লাই প্যাকিং বাক্সটি ভুবনেশ্বরে নামাতে জনা ছয়েক কুলি হিমসিম। কোনওক্রমে তাকে এনে ফেলা হল অমলের গ্যারেজে—ভাগ্যে অমলের ফিয়াট গাড়ি, গ্যারেজে খানিকটা জায়গা ছিল। সাবধানে প্যাকিং বাক্স কেটে খড় ছাড়িয়ে যখন মূর্তিটি উদঘাটিত হল উপস্থিত সকলেরই এক প্রতিক্রিয়া—এই ভাস্কর্য কীর্তিটি প্রাচীন ভারতের যে কোনও মুনি ঋষির মূর্তি বলে চালানো যায় যা বিশাল দাড়ি ও দশাসই বক্ষ। ওয়াই অর্থাৎ সৌম্যেন আর রণজিত একসময়ে প্রেসিডেন্সিতে পড়েছে তাই ফোড়নকাটা ওদের দুজনেরই বদঅভ্যেস। এদেরই মধ্যে কে যেন মন্তব্য করল, মুখের সঙ্গে রবিঠাকুরেরমিল তেমন নেই, আরেক জন টিপ্পনি কাটল ব্যাসদেব বাল্মীকি ও কবিগুরুর পাঞ্চ। অমল গায়ে মাখে না। সাধারণত কে কি বলে তাতে ওর কিছু এসে যায় না। বলুক না বলুক, কাজটাতো হয়ে গেছে। রবীন্দ্রমূর্তির ভুবনেশ্বরে অর্থাৎ অমলের গ্যারেজে আগমন উপলক্ষে রাতে একটা ছোটখাট গেটটুগেদার হল। সেখানে মৈত্রেয়ী একেবারে টপফর্মে। শুভ-এর পরিচালিত নাটকের অংশবিশেষ অভিনয়, অবশ্যই ক্যারিকেচার, যারা নাটকটি কলকাতায় আগে দেখেছে তাদের উৎসাহ দেখে কে। যারা দেখেনি তারাও দিদিভাইয়ের গুণমুগ্ধ। বিশেষ করে দিদিভাইয়ের হাতে রান্না লেটেস্ট ম্যাক্স-রসুন আর পুদিনা বাটা দিয়ে আলুর শুকনো দম—পেটের ভেতর দিয়ে মরমে পশেছে। এমন সময় হঠাৎসুজিত মনে করিয়ে দিল,
-মূর্তি তো এসে গেল। এদিকে আমরা যে গভর্মেন্টকে আবেদন দিয়েছিলাম মূর্তি বসানোর অনুমতি চেয়ে তার কিন্তু কোনও উত্তর আজও এল না।
অমল গায়ে মাখে না।
—আরে ওটা একটা ফরম্যালিটি। চিফ মিনিস্টার নিজে বলেছেন স্ট্যাচু করতে দাও। তাছাড়া অনিলেন্দু আছে। ও ঠিক হয়ে যাবে। আমি নেকস্ট যেদিন সেক্রেটারিয়েট যাব, হাতে হাতে অর্ডার নিয়ে আসব। নাথিং টু ওয়ারি। লেন্স হ্যাভ অ্যানাদার রাউন্ড। গান কে করবে? পার্টি চলল যথারীতি। রবীন্দ্রমূর্তির সম্মানে শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত। শেষে অবশ্যই একজাতি একপ্রাণ। আজ চার্চিলও সভ্য, কারণ ওকে বিশেষ মুখরোচক মশলাদার খাবার দেওয়া হয়নি। সভ্যতা এবং খাদ্যের নিবিড় সম্পর্ক কে না জানে, অন্তত ইন্ডিয়াতে সবাই।
একতার পক্ষ থেকে সরকারকে আবেদনটি সবাই মিলে বেশ যত্নের সঙ্গে মুসাবিদা করেছিল। বক্তব্য ও ভাষা অতি বিনীত। পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার দীর্ঘ প্রীতির সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতার সম্মানে একতার তরফ থেকে ওড়িশাবাসীদের বিনম্র উপহার। রণজিতেরর ইলেকট্রনিক টাইপরাইটারে ঝকঝকে ছাপার অক্ষরে তৈরি। অমল নিজের হাতে নিয়ে গিয়েছিল ডিরেক্টর অফ কালচার অনিলেন্দুপট্টনায়েককে পৌঁছাতে। তার ঘরে তো অমলের অবারিত দ্বার।
—স্যার একটা রিকোয়েস্ট ছিল। এমন কিছুনয়। টাকাপয়সা চাই না। শুধু পারমিশান একটা করে দিতেই হবে।
অনিলেন্দু পট্টনায়েক অমলের তুলনায় এমন কিছু উচ্চপদস্থ নন। বয়সেও কাছাকাছি। এতদিনের যাতায়াত, একত্র কত পানভোজন গল্পগুজব। বলতে গেলে বন্ধু। তবু ওড়িশায় আমলাতন্ত্রের সর্বাত্মক প্রতিপত্তিকে ওড়িয়াদের মতোই সমীহ করে চলে অমল। রোমে রোমানদের অনুসরণই বিধেয়। অতএব, উঁচুনিচু মাঝারি সব আমলাই তার কাছে স্যার।
–আসন্তু মিঃ দাস, বসন্তু। কণ খবর? চাহা পিবে?
—নো নো, থ্যাংক ইউ স্যার, জানেনই তো নো মাইনর ভাইসেজ। তারপর আগমনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে। ভদ্রলোক চুপ করে শোনেন। আবেদনটি হাতে নিয়ে চোখ বোলান। তারপর বললেন,
–হউক মুপঠাই দেবি। তারপর গভমেন্ট ডিসিসন নেবে।
অর্থাৎ ডিপার্টমেন্ট-এর সেক্রেটারিরহাতে সিদ্ধান্ত। সেটা অমলেরও জানা। কিন্তু ডিরেক্টর জোরকলমে সুপারিশ করলে সেক্রেটারি সাধারণত একমতই হন। অমলের একটু খটকা লাগে। যখনই কোনও আমলা বলেন, তার হাতে ক্ষমতা নেই উধ্বতনই সব, তার মানে কাজটি করার ইচ্ছে নেই। আমলাতন্ত্রের স্তরবিন্যস্ত কাঠামোয় বাস্তব ক্ষমতা তলায় ও মাঝের ধাপের কর্মচারীদের, তারাই বিষয়টি পরীক্ষা করে মতামত দেয়। তাদের মতের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে হলে ওপরওয়ালার আবার নতুন করে নোট তৈরি করতে হয়। কে এই ঝামেলা নেবে, আর কেনই বা। একযুগ ওড়িশায় কাটিয়ে সেক্রেটারিয়েটের অন্ধিসন্ধি অমলের জানা। অতএব, অন্য রাস্তা নেয়।
-ছেলের খবর কী? কেমন লাগছে কলকাতা?
অর্থাৎ পট্টনায়েকের ছেলে যে অমলকুমার দাসের সাহায্যে পিছনের দরজা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী মন্ত্রীর স্পেশাল কোটায় কলকাতার ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিল সে কথাটা মনে আছে তো।
পট্টনায়েক স্মিত হেসে জবাব দিলেন।
—ভল। সি এ তো আউ কালকাটারে নাহি, ফেরি আসিচি, কোর্স সরিলানি।
-বাঃ একেবারেফুলি কোয়ালিফাইড ডেন্টিস্ট। ভেরি গুড। তা কোথাও চেম্বারটেম্বার করে বসিয়ে দিচ্ছেন না?
-সেআ পরা প্লান। শহীদনগরে ঘর দেখুচি। ডেন্টিস্ট্রির ইকুইপমেন্টগুড়া বহুৎ এক্সপেনসিভ। আমে চাকরিয়া লোক, একাবেলে এত্তে টংকা কোউ পাইবা। ভাবুচি জিপিএফরু উঠাইবাকু পড়িব। আউ কণ করিবি।
অমল মনে মনে ভাবে ওড়িশার কজন আমলা ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার সত্যি সত্যি প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে ছেলের চেম্বার সাজিয়েছে একবার জিজ্ঞাসা করে। ঢপ মারবার জায়গা পায়নি। মুখে অবশ্য বলে,
—সে তো স্যার করতেই হবে। এটা তো একসপেন্স নয়, ইনভেস্টমেন্ট। কবছর যেতে না যেতে টাকা সুদে আসলে ফিরবে। প্র্যাকটিস একবার জমুক না। ভুবনেশ্বরে তেমন ভাল ডেন্টিস্টকটা?শহীদনগর স্যার ভেরি ওয়াইজ সিলেকশান। প্রাইভেট চাকুরেতে ভর্তি। একতার প্রচুর মেম্বার ওখানে। সব আপনার ছেলের ফিউচার পেশেন্ট..ইত্যাদি।
আমড়াগাছি। মিষ্টি কথা আশ্বাস পেলে চিড়ে ভেজানোর চেষ্টা, শেষে বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ ফর আ ড্রিংকস্যার। অতঃপর পিটিশানটা একটু তাড়াতাড়ি ফরওয়ার্ড করে দেবেন। চিফ মিনিস্টার ইজ ভেরি কীন। ওঁর ইচ্ছেতেই তো স্ট্যাচু করতে দিয়েছি। মোক্ষম অস্ত্রটি ঝেড়ে উঠে পড়ে।
সে তো বেশ কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেল এর মধ্যে কোনও খবরাখবর নেই। সাধারণত পট্টনায়েকের কাছ থেকে সপ্তাহে একবার অন্তত টেলিফোন আসে। কণ খবর মিঃ দাস, একতার প্রোগ্রাম কিছি নাহি কি? নিয়মিত ফরম্যাল ডিনারগুলিতে অতিথি, দু-চারবার অমলের বাড়ির পার্টিতেও এসেছেন। উপলক্ষ ছাড়াও আসেন বসেন, কয়েক পেগ হুইস্কি খান। অনেক ভারতীয় ক্ষমতাসীন পুরুষের মতো তারও পছন্দ অন্যের বাড়িতে অন্যের পয়সায় পানভোজন। অমল এসব মাইন্ড করে না। যে পুজোয় যে নৈবেদ্য। তবে এতদিন সাড়াশব্দ নেই দেখে উদ্বিগ্ন হয়নি। বোধহয় কাজকর্মে ব্যস্ত। তাছাড়া যা গরম চলছে। এর মধ্যে অফিস থেকে ফিরে সন্ধেয় আবার বেরুনো রীতিমত শক্ত। সবাই ধুকছে।
—দাদা আজ সন্ধেয় বাড়ি আছেন? একদিন অফিসে সুজিতের টেলিফোন।
-কেন বলো তো?সন্ধ্যায় সচরাচর অমল বাড়িতে থাকে না। ক্লাবে হোটেলে পার্টিতে তার নিমন্ত্রণ লেগেই আছে। সেদিন সামার কুইন সিলেকশান হোটেল স্বস্তিতে, অমল একজন জাজ। ভুবনেশ্বরে সব সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অমল বিচারক। এ নিয়ে একতায় প্রচুর ঠাট্টা তামাসা চালু।
-একটু জরুরি কথা ছিল।
—ঠিক সাড়ে ছটায় এসো। আমি ছটা নাগাদ ফিরে রেডি হয়ে নেব। সাতটায় বেরুব। তার মধ্যে এলে কথা হবে।
-আসব।
সাড়ে ছটার আগেই সুজিত হাজির। বিমর্ষ মুখ।
–এদিকে একটা কাণ্ড হয়েছে। দাদা জানেন কিছু?
—না তো। কী ব্যাপার?
—দুদিন আগে দৈনিক খবরপত্রিকায় ফ্রন্ট পেজ-এ একটা বিশাল প্রতিবেদন বেরিয়েছে একতাকে নিয়ে। দেখেছেন?
—না তো। একতাকে নিয়ে? আশ্চর্য। কই আমি তো কিছু ছাপতে দিইনি।
ওড়িয়া অনেক পত্রিকায় মাঝে মাঝে সংবাদ প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট পক্ষের ইচ্ছেমতো ছাপা হয়, বলা বাহুল্য কোনও কিছুর বিনিময়ে। অমল নিজেও একতার অনেক বিজ্ঞাপন খবর হিসেবে এই রাস্তা ধরেই ছাপিয়েছে।
-আপনার ছাপতে দেওয়ার প্রশ্ন উঠছেনা। কাগজের লোকেরাই করেছে। সুজিতের মুখ আরও গম্ভীর।
—ব্যাপারটা কী খুলে বলতো। কাগজটা এনেছ? পড় দেখি কী লিখেছে। সুজিত বগলদাবা করা কাগজটি বের করে খুলে পড়তে শুরু করে দেয়।
ভুবনেশ্বর ২২ শে মে, আম্ভে অতি বিশ্বস্ত সূত্রে জানিঅছু–
—আরে আমি কি তোমাদের ওড়িয়া জানি নাকি। বাংলায় বল মোদ্দা কথাটা কী। অতঃপর ওড়িয়া প্রতিবেদনের বাংলা সারাংশ শোনায় সুজিত।
রাজধানীর একটি অনওড়িয়া সংস্থা রবীন্দ্রমণ্ডপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তি স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে। ওড়িয়া ভাষায় বহু বহু বড় বড় কবিসাহিত্যিক আছেন। তাদের কজনের মুর্তি ওড়িশায়, বিশেষ করে রাজধানী ভুবনেশ্বরে এ পর্যন্ত স্থাপিত হয়েছে? শহরে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে একটি প্রেক্ষাগার আছে সেটাই কি যথেষ্ট নয়? সেখানে আবার তার মূর্তি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা কী? উল্লেখিত অনওড়িয়া সংস্থাটি বম্বে থেকে আর্টিস্ট আনিয়ে হিন্দি ফিল্ম সঙ্গীতের অনুষ্ঠান করে ওড়িশায় মাটিতে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করছে। এরকম একটি সংস্থার এই মূর্তিস্থাপনের উদ্যোগ কী উদ্দেশ্যে? রাজ্য সরকার যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তি স্থাপনে এতই ইচ্ছুক তাহলে কি সরকারি টাকায় সেটি করা যেত না? আমাদের রাজ্য কি এতই দরিদ্র যে অনওড়িয়া সংস্থার দান গ্রহণ করতে হবে? রাজধানীর নাগরিকরা গভীরভাবে ক্ষুব্ধ যে রাজ্য সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট নীতি নেই ইত্যাদি।
শুনতে শুনতে অমলের মনে হয়, সে যেন একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে আছে। এখনই জেগে উঠবে, এ সব মিথ্যে হয়ে যাবে। কিছু লেখা হয়নি, কোনও বিরুদ্ধতা শত্রুতা শ্লেষ নেই। সুজিতের সারাংশ পুরো শোনার পরও খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে অমল। বেটা ক্যারা উল্টোপাল্টা অনুবাদ করে অমলকে তাতাতে আসে নি তো।
–দাও দেখি কাগজটা। এটা আমার কাছে এখন থাক।
—আমাদের তো দাদা কিছু একটা করতে হয়।
—একজিকিউটিভ কমিটির মিটিং ডাক। ইমিডিয়েটলি। কালইবসা যাক। একটা প্রোটেস্ট পাঠাতে হবে। তারপর দেখা যাক কী হয়।
অমল আর কিছু বলে না। পরদিন অফিসে পৌঁছে প্রাইভেট সেক্রেটারি মহান্তিকে ডেকে দৈনিক খবরকাগজটি দেয়। প্রতিবেদনটির আক্ষরিক ইংরিজি অনুবাদ চাই। সারাটা দিন আর কাজে মন লাগে না। জরুরি কত কী পড়ে আছে। হেড অফিসের চিঠি। যে সব কোম্পানিকে সরকারি টাকা ধার পাওয়ার উপযুক্ত বলে সে সুপারিশ করেছিল তাদের কশতাংশ ব্যবসায়ে সফল, কটা লালবাতি জ্বেলেছে, কটাইবা জ্বালব জ্বালব করছে তার পুরো হিসেব দিতে হবে। সে পাবলিক সেক্টর আভারটেকিং-এর ম্যানেজার। এই গত দশক তার জীবনের স্বর্ণযুগ। সে যুগে জনগণের সেবা কতদুর করতে পেরেছে?
অমল ভাবে উত্তর দেবে টাকাটা কারও না কারও তত লাভ হয়েছে, উবে তা আর যায়নি। অর্থাৎ প্রচুর সংখ্যায় ব্যক্তিবিশেষের সেবা। তা ব্যক্তিকে নিয়েই তো সমষ্টি। এই তত একবার ওড়িশার জঙ্গলে বহু দামি গাছ নির্বিবাদে চোরাগোপ্তা কেটে ফেলা হয়েছে বলে সবাই হৈ হৈ করে উঠলে উচ্চতর পর্যায়ে জঙ্গল বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত আমলা না কি বলেছিলেন, কাটা গাছ তো আর ফেলা যায়নি। জনসাধারণেরই কাজে লেগেছে, এতে ক্ষতি কী হয়েছে। এরকম একটি কৈফিয়ত অমলও তো বম্বে হেড অফিসে পাঠাতে পারে। ফলাফল অবশ্য সুখকর হবে না। যদিও সেই গরিষ্ঠ আমলাটির কর্মজীবনে কোনও দাগ পড়ে নি, শুধু তদানীন্তন মেজাজি মুখ্যমন্ত্রীর স্বভাবসিদ্ধ চলিত ওড়িয়ায় তার বর্ণনাটি সবার মুখে মুখে ফিরছে—লোকটা মাই নুহ কি গাই নুহ অর্থাৎ এতই অপদার্থ যে না মাগী না গাই।
সন্ধ্যায় একতার মিটিং। সকলের একসঙ্গে কথা, উত্তেজনা, রাগারাগি। সব সময় বেটারা কৌশল করছে। আপনি দাদা মিছিমিছি এদের ভাল ভাল বলেন। খবরের কাগজের লোক এত খবর পায় কী করে? সেক্রেটারিয়েটে কে ফাঁস করেছে? নিশ্চয়ই কোনও মতলবে লেখা। রাজধানীর নাগরিকরা গভীরভাবে ক্ষুব্ধ না ঘেঁচু। এদের জীবনে খাওয়া ঘুম পরনিন্দা ছাড়া আর কিছু আছে…। অমল বাধা দেয়।
—মাথা গরম করে লাভ নেই। শান্ত হও। এত উত্তেজিত হওয়ার কী আছে? একতা একটা সাংস্কৃতিক সংস্থা, তার কার্যকলাপ তো গোপন কিছুনয়। আমরা যে চিঠি গভমেন্টকে দিয়েছি সেটাও কনফিডেনশিয়াল নয়। আলোচনা হতেই পারে।
-সেক্রেটারিয়েটে কত শত শত পিটিশান পড়ছে। কই তার কটা নিয়ে পাবলিক মাথা ঘামায় বলুন তো? না। না, এর ভেতরে গভীর চক্রান্ত আছে।
–রণজিৎ ঠিক বলেছে। আমাদের বেলায় শুধু বদমায়েসি।
—ঈর্ষাও আছে। দেখছেন না লিখছে আমরা নাকি বম্বের আর্টিস্টদের দিয়ে লাখ লাখ টাকা রোজগার করছি!
–নিজেরা কখনও এ স্কেলে ফাংশান করে না তো তাই জানে না হাউ মাচ প্যাডি মেক্স হাউ মাচ রাইস। লাখলাখ টাকা রোজগার! তাও আবার কটক ভুবনেশ্বরে। যেখানে টিকিট বিক্রি করাই দুঃসাধ্য। স্পনসর খুঁজতে হন্যে হতে হয়।
—আগের বারের কুমার ভানুর ধাক্কা সামলাতে ফিয়ারলেসের পায়ে পড়তে হয়েছিল। আর দেখুন আমরা যে একটা ক্ল্যাসিকাল গানেরও ফাংশান করেছিলাম সেকথা দিব্যি চেপে গেছে।
-থামো থামো। এসব কথা আলোচনা করে কী হবে? আমরা বললে বা হিসেব দিলে কেউ বিশ্বাস করবে ভেবেছ? একটা কনস্ট্রাকটিভ কিছু সাজেস্ট কর। কী সুজিত, তুমি তো সেক্রেটারি। তোমার কী বক্তব্য?
-আমার আর আলাদা করে কী বলার আছে। সবাই যা ঠিক করবে, আমারও তাই মত।
উঃ এই ক্যারাদের এত অসহ্য লাগে। জীবনে কখনও মনের ভাব মুখে প্রকাশ করতে পারে না। কিসের এত ভয়, অ্যাঁ? সব সময় জুজু হয়ে আছে। মিটিং-এ প্রতিবাদের খসড়া ঠিক হয়। পরে টাইপ ও ওড়িয়া অনুবাদসহ পাঠানো।
কমাস ধরে অমলের কেমন যেন ক্লান্ত লাগছিল সব সময়। মৈত্রেয়ী বহুবার গজগজ করেছে হবেনা প্রতিদিন চারপাঁচ পেগ হুইস্কি আর ক্লাব হোটেলের খাওয়। এই করবে না সেই করবে না। ডাক্তার দেখাতে হবে। মৈত্রেয়ীর আবার কলকাতার ডাক্তার ছাড়া চলে না। অমল কানে তোলেনি। এই তো কসপ্তাহ বেশ চাঙ্গা লাগছে। হৈ হৈ করে রবীন্দ্রমূর্তি প্রতিষ্ঠা ও শুভ নাট্যসংস্থার বাংলা নাটকের ব্যবস্থাট্যবস্থায় মেতেছে। কিছু অসুবিধে নেই। আজ হঠাৎ ভীষণ অবসাদ। প্রচুর হুইস্কি খেয়ে ঘুম ভেঙে গেল রাত আড়াইটে নাগাদ। যথারীতি গলাটলা শুকনো, গা-টা কেমন গুলচ্ছে। চারদিক কী ভীষণ অন্ধকার। হাতেপায়ে জোর নেই, বেড সুইচটা পর্যন্ত জ্বালতে পারছেনা। কেমন দম আটকে আসছে। কী ভয়ানক একা। শোওয়ার আগে ভেবেছিল মৈত্রেয়ীকে ফোন করবে। করেনি, দৈনিক খবর-এ ব্যাপারটা বলার ইচ্ছে নেই। ওর সম্পাদককেও তো কতএকতার কত অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করেছে। মৈত্রেয়ীর আবার ওকে বরাবর অপছন্দ,
—ধুতি পাঞ্জাবি পরা ওড়িশার উড়ে ঠিক আছে। কিন্তু ওই দিল্লি এলাহাবাদ ঘোরা আলিগড়ি চোস্তপরা উড়ে ডেনজারাস। অমল অনেক প্রতিবাদ করেছে,
—আমি এবারে আলিগড়ি হাইনেক লম্বাঝুল পাঞ্জাবি পরব। আচ্ছা পোশাকে কি আসে যায় বলতো? বেচারিরা একটু স্মার্ট, একটু প্যানইন্ডিয়ান হতে চায়। এতে দোষের কী?
—প্যানইন্ডিয়ান না আরও কিছু। এরাই সবচেয়ে প্যারোকিয়েল। বাইরে বেরিয়ে তো বুঝতে পারে নিজে মালটি কী।
এ ধরনের টিপিকাল বোংমার্কা আলোচনা অমল একেবারে বরদাস্ত করতে পারে না। বাঙালিদের সাধে কি সবাই অপছন্দ করে। একতার সদস্যদের কানে পৌঁছে গেছেদৈনিক খবর-এর কীর্তি, অমলের কাছে টেলিফোন, দেখা হলে জিজ্ঞাসাবাদ। অমল জবাবই দেয় না অথবা ওটা এমন কিছু ব্যাপার নয়, বলে এড়িয়ে যায়। যেন প্রতিবেদনটি বেরোয়নি, যেন কিছুই ঘটেনি, যেন একতার সদস্যদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লেখা দীর্ঘ প্রতিবাদটি দৈনিক খবর-এর শেষ পৃষ্ঠায় ছোট্ট এতটুকু চোখে না লাগা সংবাদে রূপান্তরিত হয়নি। যেন আমরা সকলে ভাই ভাই, সকলে ভারতীয় ভুবনেশ্বরে চেনাজানাদের কাছ থেকে অমল পালিয়ে বেড়ায়। নিজের কাছ থেকেও।
একটা ব্রেক, একটা চেঞ্জ দরকার। অতএব, জুন মাসের মাঝামাঝি কলকাতা। কদিনের জন্য। মৈত্রেয়ী তো বলেইছিল বৃষ্টি পড়ে ঠাণ্ডা না হলে ভুবনেশ্বর যাবে না। তাছাড়া ওর তো গরমের ছুটিও ফুরতে চলল। মাসান্তে দেখা-সাক্ষাতের চালু রুটিনে এবারে অমলের পালা। সেই পুরী এক্সপ্রেসে হাওড়া পৌঁছনো, ট্যাক্সির জন্য নিত্যনৈমিত্তিক দুটি উপায়ের একটি গ্রহণ—হয় সরকারি ব্যবস্থায় অনন্তকাল লাইনে দাঁড়ানো,নয় বেসরকারি উদ্যোগের দরকষাকষিতে হার-জিত। শেষোক্ত উপায়টিতে অর্থদণ্ড সুনিশ্চিত। কিন্তু এই গরমে শারীরিক কষ্টের রেহাই। অতঃপর কোনওক্রমে একটি লজঝর অ্যাম্বাসাডারে আধভেঁড়া সিটে বসে নিঃশ্বাস ফেলা। কলকাতা প্রত্যাবর্তনে ট্যাক্সি পর্বের অধ্যায়টি সমাপ্ত।
ভোরের শহর। রাস্তায় এখানে ওখানে শুকনো পচা শাকপাতা,বাতিল সবজি, গতকালের বেচাকেনার পরিশিষ্ট। প্রচুর তাপ্পি লাগানো এবড়ো খেবড়ো হাওড়ার ব্রিজে বিকৃত মুখ বদমেজাজ ট্যাক্সিড্রাইভারের গাড়ি চালানো পরীক্ষা। এবার গঙ্গার এপারে। দুদিকে শ্রীহীন জরাজীর্ণ বাড়ির সারি। স্পষ্টত আদ্দিকালের ভাড়ায় মালিকের স্থাবর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ বহুকাল ধরে আর লাভজনক নয়। আর ভাড়াটেদের অধিকার প্রচুর, দায়িত্বের পাট নেই। অতএব এখন গৃহগুলি বেওয়ারিশ মালের মতো যদৃচ্ছ ব্যবহৃত।
ফুটপাত জুড়ে পলিথিনে মোড়া হকারের পশরা। এখনও রাতের ঢাকা খোলা হয়নি। মালিকদের অনেকে প্রাতঃকৃত্য সেরে রাস্তার কলে স্নানে ব্যস্ত। বাকিরা ফুটপাতে নির্বিঘ্নে নিদ্রায় আচ্ছন্ন। অমলের ইংরেজভক্ত ঠাকুরদা, জাতীয়তাবাদী বাবা অর্থাৎ যারাই ভারত নামে একটি আইডিয়াগ্রস্ত, তাদের কাছে এরা হয় শিল্পায়নের অবশ্যম্ভাবী ফল, নয়তো গ্রামীণ সমাজচ্যুত অভাগার দল। অমলের চোখে এরা অভিশাপ। এদের চোদ্দোপুরুষ চাষবাস হাতের কাজ কিছুই ভালভাবে রপ্ত করতে পারেনি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম এরা আকাশের নীচেই কাটিয়েছে। বরং ইংরেজ এবং আধুনিকতার দৌলতে পাচ্ছে হাতের কাছে কলের জল, জাতপাত থেকে রেহাই, বাঁধানো ফুটপাত। কলকাতার রাস্তা এদের স্বর্গ। আর এঁদেরই জন্য অমলের মতো শহরের আদি বাসিন্দাদের কাছে রাস্তা হয়ে উঠেছে। নরক। আচ্ছা, ছেলেবেলায় তো কই এতটা শ্বাসরোধকারী হয়ে ওঠেনি। হয়তো মনে-মনে ভুবনেশ্বরের কাফকা সবুজেঘেরা চমৎকার চওড়া চওড়া পরিষ্কার রাস্তাঘাট তার কাছে স্বাভাবিক সুস্থ নগরায়ণের মাপকাঠি। দুঃস্বপ্নের নগরী যার জন্মস্থান, প্রবাসেই তাকে বেঁচে থাকতে হয়।
তবু বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতিতে পা দিয়ে কেমন যেন নিশ্চিন্ত লাগে। সরু গলি গায়ে-গায়ে সামনে-পেছনে বাড়ি, সূর্যের অবাধগতি প্রচণ্ড তাপ থেকে সুরক্ষিত। আগেকার তৈরি মোটামোটা দেওয়ালের ঘর, গরম তাতেও খানিকটা আটকায়। তার ওপর লাল সিমেন্টের মেঝে দুবেলা মোছায় ঠাণ্ডা তেলালো। তিন পুরুষের আশ্রয়ে আরাম। তবে পরিবারের বিভিন্ন শাখা বিস্তৃত হয়ে অন্য মাটিতে ঝুরি নামিয়েছে। জ্যাঠারা যে যার নিজস্ব বাড়ি করে উঠে গেছে বহুদিন। হরিচরণ দাস বি এ বি এল যাননি কারণ ভেবেছিলেন আমৃত্যু তার স্কন্ধে জাতীয় কংগ্রেসের স্থানীয় দায়িত্ব ন্যস্ত। ভুল ভাঙতে খুব বেশি বছর লাগেনি। প্রৌঢ়ত্বে আবার ওকালতিতে ফেরবার করুণ প্রচেষ্টা করেছেন।
তবে তিনি যেখানে হেরে গেছেন সেখানে জিতেছেতার বড় ছেলে। জ্যেষ্ঠের উত্তরাধিকার সম্পর্কে অতিসচেতন অমলের বড়দা সুবিধামত ওকালতি এবং রাজনীতি করে। কংগ্রেসের নবতম ফাটলে ফায়দা তোলায় সে সিদ্ধ। মেজদা প্যাথলোজিস্টআর জি কর-এ। সপরিবারে এখানেই বাস। সেজদাও ইঞ্জিনিয়ার পোস্টেড দুর্গাপুরে। দিদি বহুকাল বিবাহিত। প্রতিষ্ঠিত তার সংসারে। বাদ বাকি অমল, তিনতলার একটি ঘর তার জন্য বরাদ্দ। যতদিন মা জীবিত সেখানে তার মৌরসি পাট্টা। প্রায়ই শোনা যায় ঘরটাতো পড়েই আছে। অমল তো ন মাসে ছমাসে দুদিনের জন্য আসে। বুলুবুলা-খুকু-খোকা কারও কাজে লাগতে পারত। মা শুনেও শোনেন না, কখনও বা দেন ঘরখানা খুলে।
তিনতলার ঘরখানায় এসে ছোট ভিআইপি সুটকেসটা রাখে। সেই পুরনো তক্তপোশে বিছানা পাতা। আদ্দিকালের টেবিল চেয়ার বইয়ের র্যাক। ছাত্রাবস্থায় অমল ও তার সেজদার বই থাকত। একদিকে আলনা। তলায় জুতো রাখার ব্যবস্থা। একটা পুরনো সেকেলে আলমারি সেগুন কাঠের। জানালায় স্প্রিং দেওয়া পর্দা একটু ঝুলে আছে। অমল জানে মৈত্রেয়ী এটা দুচোখে দেখতে পারে না। অমলের প্রত্যেকটি বাড়িতে সে হয় কাঠের পেলমেট নয়তো অ্যালুমিনিয়াম রডে রিং দিয়ে পর্দা ঝোলায়। এ বাড়িতে এখনও তা ঢোকেনি।
হরিচরণ দাস বি এ বি এল-এর সন্তান সন্ততি প্রবাসী অপ্রবাসী মিলিয়ে যে যৌথ পরিবার সেখানে বলাবাহুল্য ঐক্য নেই, তবুও কোথাও একটা একাত্মতা আছে। হয়তো পারস্পরিক সমালোচনা তারই একটা রূপ। পুরোপুরি অচেনাকে নিয়ে কারও মাথাব্যথা থাকে না। অমল একেই প্রবাসী তায় অবিবাহিত। অতএব পারিবারিক চিরন্তন ঠাণ্ডাযুদ্ধে তার বর্ম অনাসক্তি যা কোনও শ্লেষ, কোনও ঠেশ দিয়ে কথা ভেদ করতে পারে না। বড়দার মেয়ে কার সঙ্গে রেজিস্ট্রিকরেবসেছে, মেজদার ছেলের এতগুলো টিউটার কোন উপার্জনের পয়সায় রাখা, সেজবউদির সাজপোশাক ফ্যাশান দেখলে কী মনে হয় ইত্যাদি বিষয়ে জোরালো বা মৃদু কোনও গ্রামের আলোচনাতেই অমল নেই।
তবে রবীন্দ্র মূর্তি প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত ওড়িয়া প্রতিবেদনটির কথা অমল বড়দার কাছে পাড়ে। শত হলেও জ্যেষ্ঠ, পরিবারের কর্তা। তাছাড়া রাজনীতি করেন, হেমেন মিত্তিরের সঙ্গে বিলক্ষণ আলাপ। সব শুনেটুনে বড়দা বললেন,
—দ্যাখ রবীন্দ্রনাথের একটা মূর্তি ভুবনেশ্বরে বসল কিনা বসল তাতে কী আসে যায় ব? তিনি তো সমস্ত পৃথিবী থেকে হায়েস্ট রেকগনিশান পেয়ে গেছেন। বাংলায় লিখেছেন, আমরা বাঙালিরা চিরকাল ওঁর লেখা পড়ব। ব্যস। আর কী চাই?
-কিন্তু বড়দা, প্রশ্নটা তো তা নয়। রবীন্দ্রনাথকে তো শুধু বাঙালি বলা হয় না। তার তো ন্যাশনাল ইম্পর্টেন্স আছে। তার লেখা গান ন্যাশনাল অ্যানথেম। আমরা ইন্ডিয়ানরা তো একটা নেশান? অন্তত হতে তো চাই। তাহলে তার মূর্তি ইন্ডিয়ান একটা স্টেট ক্যাপিটেলে থাকলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে কেন? যেমন ধর ইউ এস এ। সেখানে ইয়োরোপের ভিন্ন ভিন্ন জাতের লোক আছে। কিন্তু সব স্টেটই তো জর্জ ওয়াশিংটন বা আব্রাহাম লিংকনকে ন্যাশানাল ফিগার হিসেবে সম্মান করে। আমেরিকান লেখকও তো সব স্টেটেই সমান সম্মান আদর পান।
—তোর আর কোনওদিন জ্ঞানবুদ্ধি হল না। ইউ এস এ একটা মেলটিং পট সেখানে ইয়োরোপের ভিন্ন ভিন্ন জাতির মানুষ গেছে বটে, কিন্তু কয়েক জেনারেশানে সব মিলেমিশে এক। সবাই ইংরিজি বলে, লেখে। নতুন দেশ, তাই অতীতটা ধুয়েমুছে শুরু করতে পেরেছে। আর আমরা যে যার জায়গায় কত শত বছর ধরে আলাদা ভাষা আলাদা কালচার নিয়ে আছি। আমাদের অবস্থাটা তো অন্য। ওড়িয়ারা বাঙালি লেখককে অতটা সম্মান দিতে রাজি না হতে পারে। তাদের সে অধিকার আছে। সবচেয়ে বড় কথা তুই এ সব ফালতু ঝামেলায় আদৌ যাস কেন? তুই আর কদিনই বা ভুবনেশ্বরে থাকবি, তোর তো বদলি বহুকাল আগেই হবার কথা। ঠেকিয়ে রেখেছিস কলকাঠি নেড়ে। ওসব একতা ফেকতা ছেড়ে ঠিক মতো চাকরি ক। সংসারি হ। এত বয়স হল এখনও স্থিতু হলি না….
এইবার অতিপরিচিত রেকর্ডের কেটে যাওয়া জায়গাটা, মৈত্রেয়ী প্রসঙ্গ। ওখানেই আটকে যাবে, চলবে আপসোস উপদেশের চিরন্তন পুনরাবৃত্তি। অমল উঠে পড়ে। আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। পাড়ায় বেরোয়। নেতাজী ব্যায়ামগারে ছেলেদের সঙ্গে কী-রে কেমন-আছিস করা যাক।
-এই যে অওঁলদা কদ্দিন বাদে। আবনি তো দাদা আঙাদের ভুলেই গ্যাচেন,
—আওঁরা ভাবছি আঙাদের অওঁলদা ও দেসে বাড়িফাড়ি কোরে বসে গিয়েছেন,
—সেসমেস বাংলাফাংলা ভুলে আঙাদের অওঁলদা উড়ে ভাসা বোলবে রে…
-আরে দূর। কোম্পানির চাকর। কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম বুঝিস না। যতদিন যেখানে রাখবে ততদিন সেখানে থাকার মেয়াদ। একি আমার হাতে।
—তা অওঁলদা, দেসূসে আর ফিরবেন না?
—কে বলেছে ফিরব না। তোরাও যেমন। জন্মভূমি বলে কথা। বঙ্গলক্ষ্মীতে আরম্ভ, বঙ্গলক্ষ্মীর কোলেই শেষ।
-হা হা হা। বেস বোলেচেন মাইরি।
অমল অবশ্য ইচ্ছে করেই কলকাতায় স্থায়ীভাবে ফেরার কথাটা বলে। যদিও জানে সেটা স্তোকবাক্য মাত্র। হাওড়া থেকে বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতিতে আসতেই অমলের অবস্থা কাহিল। এ শহরের যা ছব্বা। ছেলেগুলোকে তো আর সে কথা বলা যায় না। এদের সে জানে এতটুকু বয়স থেকে। সব ঝড়তিপড়তির দল। কোনওক্রমে স্কুলের চৌকাঠ ভিঙিয়েছে কি ডিঙোয়নি। দুচারজন কবারের চেষ্টায় পাসকোর্সের বি এ তে ঢুকেছিল, বেরতে পারে নি। এ রাজ্যে যে ধরনের প্রতিযোগিতা তাতে চাকরি এদের নাগালের বাইরে। আর অন্য রাজ্যে তো সেখানকার ভূমিপুত্রের সর্বক্ষেত্রে অগ্রাধিকার। প্রতিবেশী রাজ্যে এমনও অমল দেখেছে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে সব নিয়মকানুন মেনে একটি চাকরিতে একজন বহিরাগতের নাম ইন্টারভিউর জন্য সুপারিশ করাতে ভাঙচুর মারধোর হয়ে গেছে। সাধারণ শিক্ষিত ও অর্ধ-শিক্ষিতদের স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ এই সোনার বাংলা। অতঃপর অমলকেও বাঙালি সাজতে হয়। সেও একই পাড়ার ছেলে, ইঞ্জিনিয়ার ব্যাংক ম্যানেজার, বাইরে চাকরি করে ভাল থাকে। মিঠুন চক্রবর্তীর মতো স্টার না হলেও ছোটখাটো হিরো।
—তা তোমরা এখন কার দলে? হেমেনদার না সমতাদির?
তৎক্ষণাৎ নির্ধধায় সমস্বরে উত্তর,
—আর এমেনদা টেমেনদা নয়। ক্ষেপেছেন? এখন সব সতাদিদি। কী ফাঁইটটা দিচ্ছে দিদি দেকেচেন? দিদি না থাকলে সল্লা সিপিএম কবে আঙাদের সেস্ কোরে দিত।
ও তাই হেমেন মিত্তিরের ভুবনেশ্বরে রবীন্দ্রমূর্তি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে বড়দার এত অনাসক্তি। এরা তো শুধু পড়শী নয়, বড়দার সক্রিয় রাজনীতির কর্মীবাহিনী। বাড়িতে আর অমল মূর্তিপ্রসঙ্গ তোলে না। বিকেলে মৈত্রেয়ীকে নিয়ে বেরোয় দোকান বাজারে। সচরাচর অমলের যাকে যা দেবার মৈত্রেয়ী একাই কেনে। এবারে অমল ভাবল বহুদিন গড়িয়াহাটে বাজার করা হয়নি, কলকাতার সেরা পছন্দসই জিনিস নাকি সেখানেই পাওয়া যায়। তাছাড়া দুজনে একসঙ্গে কিছু একটা করা যাবে। মৈত্রেয়ীর সাগ্রহ সম্মতি।
প্রথমে মায়ের ইঞ্চিপাড় সাদা শাড়ি এবং মৈত্রেয়ীর বহু আপত্তি সত্ত্বেও তার জন্য লাল পাড় কোরা ঢাকাই কাজের টাঙ্গাইল। কেনার পর ঢাকেশ্বরী থেকে বেরুতে না বেরুতে শোনে খুশিখুশি মন্তব্য ২২শে শ্রাবণ ভুবনেশ্বরে রবীন্দ্রমূর্তি প্রতিষ্ঠার দিন পরা যাবে কী বল। অমল বিনা বাক্যব্যয়ে মাথা হেলায়। দৈনিক খবরের ওড়িয়া প্রতিবেদনটির বৃত্তান্ত মৈত্রেয়ীকে জানায়নি। কী দরকার। মিথ্যে দুশ্চিন্তা। হয়তো আপনি থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো সেরকম গুরুগম্ভীর ব্যাপারই নয়। একতার সদস্যরা মিছিমিছি তিলকে তাল ভাবছে—মাইনরিটি কমপ্লেক্স। ভারি তো একটা ওড়িয়া দৈনিক তাও ওড়িশার সবচেয়ে প্রাচীন সমাজ পত্রিকা নয়। কী বা তার গুরুত্ব, কজনইবা পড়ে। চুপচাপ থাকলে ঘোলা জল আপনি থিতিয়ে যাবে। অতঃপর অমল ভাইপো-ভাইঝিদের জন্য কিছু কেনাকাটার চেষ্টায় লাগে। পায়ে হেঁটে এ দোকান ও দোকান।
সন্ধে সাড়ে ছটার গড়িয়াহাট। আলোয় আলো চারমাথার মোড়। হ্যালোজেন নিয়ন বা। থিক থিক লোক, ছেলেবুড়ো নারী-পুরুষ। অফিস ফেরত মানুষ দোকান বাজারের ক্রেতা ও উদ্দেশ্যবিহীন পথচারী যারা চোখে লাগলে জিনিস কিনবে, খাবার শখ হলে খাবে অথবা কিছুই না করে খানিকটা সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে। চারটি দিকে প্রতিটি ফুটপাতের ওপর রাস্তায় সারি সারি পরস্পর মুখোমুখি হকারদের স্টল অর্থাৎ দোকান। দুটি সারির মাঝে আকাশ প্রায় দেখা যায় না। মেঝেতেও ইতঃস্তত বসা কিছু জিনিস।
কী নেই এই চারমাথায়। দুনিয়ার ভোগ্যপণ্যের পশরা। চামড়া-সোয়েড ফোমের ভ্যানিটি ব্যাগ, স্লিং ব্যাগ পার্স, চট ও পাটের ক্যারিব্যাগ বিগশপার, সর্ববিধ রঙের শাড়ি ফলস্ প্রসাধন কেশবিন্যাসের অজস্র প্রকরণ, ধাতু পাথর প্লাস্টিক টেরাকোটার কস্টিউম জুয়েলারি, শোওয়ার পোশাক বাড়ির আটপৌরে হাউসকোট, সালোয়ার কামিজ, দোপাট্টা, সায়া ব্লাউজ ব্রা, বাচ্চাদের বাবাস্যুট, ফ্রক, সোফাসেট টিভি-রসুচিশিল্পশোভিত বা লেসের ঢাকনা,কমদামি শাড়ি ধুতি, ব্লাউজের কাটপিস, লম্বাহাতা ছোটহাতা সুতি তত টেরিভয়েল টেরিসিল্কের প্লেন কাজ করা ছাপা কথাচ্চি বিভিন্ন রকমের পাঞ্জাবি সুতি টেরিট, প্লেন আলিগড়ি পাজামা, বিভিন্ন বয়সের বাচ্চা ছেলেদের সেলাই করা ধুতি ও মানানসই পাঞ্জাবি, বালিশের ওয়াড় বিছানার চাদর ঢাকা ভোয়ালে,নারী ও পুরুষের ভিন্ন সাইজেরকমারি সুতি-সিনথেটিক তোয়ালে, রুমাল, চটিজুতো, হাওয়াই, গ্লাভস্, মোজা, গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া, প্যান্টি, ভাঙে বা ভাঙে না, আটপৌরে বা শৌখিন কাপডিশ, বাটি, চায়ের সেট, ডিনার সেট, ফুলদানি, অ্যাশট্রে, কাঁচের গেলাস, স্টেনলেস স্টিলের কাঁটাচামচ, হাতা সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয়, শুধু সাজানোর হাজারটা টুকিটাকি। লোহার সাঁড়াশি থেকে টেরাকোটা গণেশ।
পুরনো বইয়ের স্টলগুলোতে ভাড়া খাটছেরুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চ-চেজ কার্টার-ম্যাকলিন্স ব্যাগলে ও রগরগে উত্তেজক রবিনস-কলিনস্-শেল্ডন-আর্চার বা বিলিতি সাময়িক পত্রিকা—টাইম, নিউজ উইক, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি; অন্যত্র ছোটদের নতুন বাংলা বই—বড়দের জন্য নতুন বাংলা প্রায় নেই। এদিকে সার বেঁধে ফলের দোকান, কাঁচা বাজারের দিনগত ময়লার স্তূপ, কয়লার ভোলা উনুনে গরম গরম তেলে ভাজা ও চা। অপর ফুটপাতে একসারি স্ন্যাক্স বারে জ্বলছে গ্যাস, হাতে তৈরি মটন-চিকেন এগরোল, ফিশফ্রাই, ভেজিটেবল চপ বা চাউমিন। যেখানে খাওয়া সেখানেই ফেলা উচ্ছিষ্ট। মুখোমুখি জমিয়ে বসেছে বয়মে পলিথিনের সারি সারি আচার। একপাশে ফুল, সবুজ পাতার ঝোপে লাল-হলদে গোলাপকুঁড়ি, সিঙ্গল-ডবল সাদা রজনীগন্ধার গুচ্ছ, ছানারজল যুঁইয়ের বৃত্তাকার গোড়ে মালা।
ভটভট ভটাভট চলছে জেনারেটর। ডিজেলের কালো ধোঁওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে অভিজাত দোকানঘরগুলির শীততাপ যন্ত্র থেকে নির্গত গরম হাওয়া। পথচলতি বাস-ট্যাক্সি ইত্যাদির স্বাস্থ্যবিধিকে কলাদেখানো ডিজেল-পেট্রোলের পোড়া গ্যাসে সম্পূর্ণ পরাস্ত মাটনবোল আচার গোলাপের জীবন-মুখী সম্ভার। ইন্দ্রিয়ের ওপর সবচেয়ে শক্তিশালী আক্রমণ আসছে রাস্তার দিকে পিঠ হকারদের স্টল ও আরোহীহীন স্থিতু গাড়িগুলোর মাঝখানের সামান্য একান্তে স্বল্পপরিসর নালায় রিকসাওয়ালা কুলীব্যাপারী পথচারীদের দিনভর মূত্রত্যাগের ঝঝ, যার কাছে হার মানে ট্রামবাসে ভিড়ঠেলা জনতার গায়ের ঘাম। শুধুহার মানেনা একটি ফুটপাতের মাথায় পথসভার কানফাটানো চিৎকার—অদূর ভবিষ্যতে হকার-উচ্ছেদ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে গরম গরম বক্তৃতা।
অনুভূতির ওপর সর্বাত্মক আক্রমণে অমল দিশেহারা। তবে তার পথচলার সমস্যা নেই। জনতার অবিরাম স্রোতে ভেসে থাকলেই হল। আপনিই এগিয়ে যায়, প্রায় বিনা চেষ্টায়। বিউটি সেলুনচর্চিত যে মৈত্রেয়ী অমলের দিদি বউদি বোনেদের তুলনায় আধুনিক ও ফ্যাশনদুরস্ত, তার কিন্তু দুর্গন্ধে-গরমে ভিড়ে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। একেবারে ইন্দ্রিয়বিজয়িনী বৈদিকযুগের নারীঋষি। সার্থকনামা মৈত্রেয়ী যার কাছে পার্থিব সংশ্রব তুচ্ছ। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ভিড়ের অগ্রগামী স্রোতকে অনায়াসে ব্যাহত করে সোৎসাহে তার দরাদরি চলছে। সালোয়ার কামিজ হ্যান্ডব্যাগ-কুইজবুক।
–ছেলেদের জন্য কিছু উপহার কেনা যে কী শক্ত। একটা কাজ করো না। প্রত্যেককে আলাদা কিছু না দিয়ে সকলের জন্য একটা বড় কেক বা এক বাক্স রকমারি পেস্ট্রি নিয়ে যাও না। কাছেই আছে আপার ক্রাস্ট হটব্রেড মংগিনি। তোমাদের পাড়ায় বোধহয় ওসব তেমন পাওয়া যায় না।
দক্ষিণ কলকাতার আধুনিক আভিজাত্য সচেতন মৈত্রেয়ীর কাছে অমলের পরিবারের সব খামতি সেকেল আউটডেটেড উত্তর কলকাতার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, সঁকড়ি নীলষষ্ঠী থেকে গামছাকলতলা। অমল অবশ্য কোনওদিনই তর্কবিতর্কে যায় না। সর্ববিষয়ে দক্ষিণের শ্রেষ্ঠত্বে তার নিজেরও বিশ্বাস, শুধু মিষ্টির দোকান ছাড়া। এই মুহূর্তে তার কাছে সবচেয়ে জরুরি গড়িয়াহাট থেকে নিষ্কৃতি। উচ্চ মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনচর্যার পীঠস্থানের যদি এই ছব্বা তাহলে সনাতন হাতিবাগান শ্যামবাজারে তো পা ফেলাই যাবে না। মৈত্রেয়ী যেন তার মনের কথা বুঝতে পেরেই বলে,
-এখানে আর কী ভিড় দেখছ। গত বছর পুজোর সময় স্কুলে পাঁচজন বলল চলুন মৈত্রেয়ীদি একসঙ্গে পুজোর বাজার করি। নর্থ ক্যালকাটায় তাঁতের শাড়ি সায়াব্লাউজ সব এই সাউথের চেয়ে সস্তা। একদিন কষ্ট করে চলে যাই। গেলাম আমরা জনা চারেক হাতিবাগানে। বিকেলবেলা। সেদিন আবার কী কারণে ট্রামগুলো দাঁড়িয়ে গেছে, ইলেকট্রিক লাইনে গণ্ডগোল। এদিকে সিনেমা ভেঙেছে। রাধা মিত্রা মিনার থেকে পিলপিল করে লোক বেরুচ্ছে। রাস্তায় পর পর ট্রাম, বাকি জায়গায় হকারদের স্টল। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। শেষে কী করলাম জানো? একটা খালি ট্রামে উঠে বসে রইলাম। ভীড় কমলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যে যার বাড়ির দিকে। পুজোর বাজার মাথায় উঠল।
বিনা বাক্যব্যয়ে সবচেয়ে কাছের দোকান আপার ক্রাস্ট থেকে একটি কেক কেনে অমল। খেতে কেমন হবে কে জানে, দামে অন্তত বনেদী পার্ক স্ট্রিটের ফুরিজকে ধরে ফেলেছে। প্যাকেটের বোঝা হাতে দুজনে ট্যাক্সিতে ওঠে, রাস্তায় মৈত্রেয়ীকে নামিয়ে দিয়ে যাবে। না, আজ আর তার বাড়িতে বসবে না। বসাটা এমনিতেই কোনওদিন প্রীতিপদ নয়। পরিবারের পরিবেশে অমলের কেমন অস্বস্তি হয়। মৈত্রেয়ীর ছেলে যখন ছোট ছিল তখন পুজো-জন্মদিন ইত্যাদিতে বিধিমতো উপহার হাতে হাজির থেকেছে। প্রায়ই জামার মাপ ঠিক হয়নি, রঙচঙে মোড়ক খুলে দেখা গেছে খেলনাটা বার্বি ড (অমলের দোকানে গিযেএত বছরের বাচ্চার জন্য এত দামের মধ্যে ভাল কিছুদিন তোবলার ফল)। মৈত্রেয়ীর বাবা যতদিন বেঁচেছিলেন তার সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তাই বলতেন না। মা তবু ওরই মধ্যে একটু ভদ্রতা বজায় রাখেন। কিন্তু আজ কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। বালীগঞ্জ ফঁড়ি ছরাস্তার মোড় এবং বলাবাহুল্য বিশাল যানজট। ঘামে অমলের সার্টটা পিঠের সঙ্গে চেপ্টে গেছে। একদিকে মিনিবাস, অন্যদিকে মারুতি জিপসি, মাঝখানে অমলদের অ্যামবাসাডার ট্যাক্সি। জৈষ্ঠ্যমাসের সন্ধ্যা। পড়ন্ত রোদে তাতা ঘরবাড়ি রাস্তা, সঙ্গে অসংখ্য গাড়ির চালু ইঞ্জিনের তাপ। যেন নিঃশ্বাস ফেলা দায়। অমল ভাবে কলকাতাবাসীদের মরার পর স্বর্গলাভ সুনিশ্চিত। নরক ভোগ তো এখানেই হয়ে যাচ্ছে। মুখ ফস্কে বলে ফেলে,
-উঃ এশহরটা একেবারে বাসের অযোগ্য। ভুবনেশ্বরে ফিরতে পারলে বাঁচি। মৈত্রেয়ী কলকাতার হয়ে কিছু বলতে চেষ্টা করার আগে হঠাৎ সামনে থেকে ড্রাইভারটি বলে,
—আপনি ওড়িশার লোক? উচ্চারণ ওড়িসারঅ লোকর।
—প্রায় তাই বলতে পার। তোমার দেশ তো ওড়িশা মনে হচ্ছে। কোন্ জেলা? কটক না বালেশ্বর?
—আজ্ঞে ঢেনকানল। জানেন ঢেনকানল ডিস্ট্রিক্ট?
–জানি বই কি। তা তোমার নাম কী? কতদিন ট্যাক্সি চালাচ্ছ কলকাতায়?
–আজ্ঞে, বংশীধর জেনা। ট্যাক্সি আমার নয়। বদলিতে চালাচ্ছি। তবে লাইসেন্স তিন বছরের। বাংলা উচ্চারণে ওড়িয়া টান প্রকট।
–থাক কোথায়? ভবানীপুরে ওড়িয়াপাড়ায়?
–না, গড়িয়া। ওখানে ঢেনকানলের অনেক ছেলে আছে। –তাই নাকি। কত?
–বহুৎ। হজার হজার।
–বটে! কী করে তারা সব?
–এই ড্রাইভারি।
অন্য রাজ্যের হাজার হাজার যুবক কলকাতায় গাড়ি চালাবার লাইসেন্স পায়। হবেও বা। বেঙ্গলে সিপিআইএম-ই বল আর কংগ্রেস-ই বল, বাঙালি ছেলেদের মুখের অন্ন কেড়ে নিতে সকলে এক। এই না হলে আর হারামির জাত বাঙালি।
—তা তুমি কটক ভুবনেশ্বর রুড়কেল্লা না গিয়ে কলকাতায় আছ কেন? ওসব জায়গায় তো ড্রাইভারের খুব অভাব। বিশেষ করে ভুবনেশ্বরে।
—এখানে ছোটকাল থেকে অছি। ওড়িশার কিছি জানি না।
—প্রথমে কী কাজ করতে?
—এই টুকটাক। গ্যারেজে কাজ শিখেছি। আসলে আমর বাপ এখানে, তাই।
–বাবা কী করে?
–তেলেভাজা দুকান।
দুপুরুষে দিব্যি উঠেছে শ্রীমান বংশীধর জেনা। দেখতে দেখতে গড়িয়া উৎকল সমাজের কেষ্ট বিষ্ণু হয়ে যাবে। আর এদের অর্থনৈতিক উন্নতির ভিত্তিভূমি যে মাটি তার কী হাল করে রাখছে! মনিঅর্ডার তো চলে যাচ্ছে পরিবারে, নিজের গাঁয়ে, অন্য রাজ্যে। খায় দায় পাখিটি বনের পানে আঁখিটি।
ট্রাফিক সিগন্যাল বদলায়। সামনের গাড়িগুলো চলতে শুরু করেছে। বংশীধর জেনাও স্টার্ট দেয়। মৈত্রেয়ী এতক্ষণ নির্বাক শ্রোতা। এখন রাস্তা বাড়ায়।
—ডানদিকে।
পরদিন সন্ধ্যায় কোথায় দেখা হবে, ডিনার কোন রেস্টুরেন্টে ইত্যাদি ঠিক করে মৈত্রেয়ীকে বাড়ির দরজায় নামিয়ে দেয়।
—মাসিমাকে বলো আজ আর দেখা করতে পারলাম না। কাল আসব।
মৈত্রেয়ী ঘাড় নাড়ে। ঠোঁটের কাছটা যেন একটু শক্ত হল। সত্যি অমলের উচিত ছিল নেমে অন্তত পাঁচ মিনিট মৈত্রেয়ীর মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলা। ভদ্রমহিলার শরীর ভাল নেই। কিছুদিন আগে মধ্য কলকাতার একটি নার্সিং হোমে ছিলেন কদিন। কী যেন অপারেশান হল, অমলের ঠিক খেয়াল নেই। এসব ডাক্তারি ব্যাপার-স্যাপার আবার তার মনে থাকে না। তবে মৈত্রেয়ীর নার্সিং হোম সমালোচনাটা ভোলেনি, পয়সার শ্রাদ্ধ, ডাক্তারদের বেআক্কেলে ব্যবহার নার্সের অভাব ইত্যাদি। আসলে এই নার্সের প্রসঙ্গতেই অমলের মনে পড়ে যায় মৈত্রেয়ীর মায়ের অপারেশানের কথা। নার্সগুলো সবই অল্পবয়সি, আনাড়ি একেবারে কিছু জানে না। নালিশ করতে মেট্রন জানিয়েছিলেন তিনি নিরুপায়। সব সাবস্ট্যান্ডার্ড নার্স জেনেশুনে রাখা হয় কারণ পশ্চিমবঙ্গে নার্সি পড়া এত কঠিন, এত কম মেয়ে নার্সিং-এ ঢুকতে পারে, এত প্রতিযোগিতা যে প্রচুর বাইরের রাজ্যের নিম্নমানের মেয়েরা চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। দুঃখ করে বললেন, দেখুন বাইরের কি ভেতরের সেটাতো কোনও কথা নয়। আসল হচ্ছে সার্ভিস, সেটা ঠিক দিতে পারছে কি না। এরা নিজেদের রাজ্যে কিস্যু শেখে না খালি সার্টিফিকেট ধরে আসে। এখানে আমরা হাতে ধরে একেবারে বেসিক থেকে শেখাই। বললে বিশ্বাস করবেন না রোগীর বিছানার চাদর বদলাতে পর্যন্ত জানে না। অথচ যেই নিজেদের স্টেটে একটা পোস্ট খালি হয়, অমনি ব্যস চম্পট। আরেক আনাড়ি আসে তার জায়গায়, আমরা আবার তাকে শেখাই। এইভাবে কী সার্ভিস আমরা আপনাদের দেব বলুন? মৈত্রেয়ীর এত পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণের একটি কারণ ছিল। সব বলেটলে প্রশ্ন,
-বলো দেখি কোন রাজ্য থেকে এত নার্স আসছে?
–কেরালা?
—মোটেই না। তোমার উড়িষ্যা। সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের নার্সগুলো নাকি রয়ে যাচ্ছে।
অমল অবাক। তার ধারণা ছিল ওড়িশা থেকে গত কয়েকশবছর ধরে যে অবিরত কর্মপ্রার্থীরা বাংলায় আসেন তাদের সকলে না হলেও অন্তত সিংহভাগ অতি দরিদ্র ভূমিহীন নিম্নবর্গের মানুষ। এরা তো দিব্যি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। আজকে বংশীধর জেনার সঙ্গে সাক্ষাতে সামাজিক রূপান্তরের মানচিত্রটি যেন আরও সুস্পষ্ট।
–সার, সিআইটি দিয়ে শিয়ালদা হয়ে যাব?
–না, না বাইপাস ধর।
–তাহলে ভিআইপি উল্টোডাঙা হয়ে হাতিবাগানে আসতে হবে। সেখান থেকে—
–ঠিক আছে ঠিক আছে তাই চল। শেয়ালদায় এখন প্রচণ্ড জ্যাম হবে।
যেতে যেতে বংশীধর জেনার সঙ্গে আলাপ চালায় অমল। ওড়িশার বিভিন্ন জেলা থেকে প্রচুর যুবক এখন দক্ষিণ কলকাতার বস্তিগুলোতে, মনোহরপুকুর থেকে গড়িয়া। এক একটি ঘরে চার কি পাঁচজন মাথাপিছু ভাড়া একশো। খায় হোটেলে, সেটাও অনেক ক্ষেত্রে নিজের দেশের লোকের। এর ওর কাজে নিয়মিত বদলি খাটে। সকলেরই লক্ষ্য কোম্পানি বা কোনও কর্পোরেশনে স্থায়ী চাকরি। সেটা কারও নেই। সবাই প্রাইভেট, অর্থাৎ কোনও ব্যক্তি বিশেষের গাড়ি চালায়। তাও নিজেদের মধ্যে পালা করে।
—পালা করে কাজ কর কেন? এক জায়গায় পার্মানেন্ট করলেই তো ভাল।
–রেট বাড়াতে হবে।
–কী করে রেট বাড়াও?
—যেমন ধরুন, অক্ষয়সাহু বারশ টাকার কাজ পেল। ও দশ-পন্দর দিন কাজে গেল। তারপর ছুটি নিল। বদলি পাঠাল রবি বেহুরাকে। রবি দুদিন গেল, তারপর দুদিন গেল না। মালিক এদিক হয়রান হচ্ছে। রবি তিন দিনের দিন হাজির। গম্ভীর মুখে বলল সে বদলির কাজ করিব নি, মাস-মাইনেতে করি পারে। বেশির ভাগ জায়গায় সাহেব কহন্তি, ঠিক অছি, কর কত চাই। তখন রবি রেট বঢ়ায় পরশ চায়। দরাদরিতে চৌদ্দশ। কদিন চালায়। আবার কামাই। এবার আসিব শংকু। শংকর মহান্তি। সে ভি চৌদ্দশ পাবে। মানে দুজনের রেট চৌদ্দশ হয়ে গেল।
-তোমার সেই অক্ষয় সাহুর কী হল? তার তো কাজ রইল না।
–থাকবে না কেন। সি এ পরা আউ কাহারো বদলিরে যাইচি। সেইঠি রেট বাড়াচ্ছে।
—তা তোমরা গোড়া থেকেই তো পনেরোশো কি আঠারোশো যার যা পোষায় বললে পার।
–সোজাসুজি কেই দিবনি। একেবারে বাজে কথা। অমল জানে অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশানে দৈনিক হিসাবে ড্রাইভাররা ভাড়া খাটে আট ঘণ্টায় সত্তর টাকা। আসলে এরা কৌশলঅনা করে বাঁচতে পারে না। কি কর্মে কি চিন্তায়, সর্বদা সর্বত্র ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জীববিশেষের মতো আঁকা বাঁকা পথে এদের আনাগোনা। অফিসে রোজ দেখে কেউ যদি একদিন ক্যাজুয়ের লিভ চায় তার জন্য ঘণ্টাখানেক ধরে হাজারটা ছুতো দেখাবে। স্ত্রীর-মা বাবার-ছেলেমেয়েদের যায়-যায় অসুখ ও তার বিস্তারিত ইতিহাস। নিবিতো একদিনের সি এল, তোর প্রাপ্যেরই মধ্যে। অত ধানাই পানাই কি। স্বাভাবিক প্রবণতাই কপটতা।
—তা তোমরা বিয়েটিএ করলে বউ ছেলেকে কোথায় রাখ?
—পিলাপিলি গায়ে থাকে। আমরা সব বিহারীদের মত তিনিমাসঅ চারিমাসঅ গাঁ-এ চলে যাই না। চারি ছদিন কি বড়জোর পর দিন মাসে। অন্যেরা বদলি করে দেয়। জমি চাষঅর ভি সেআ করে।
সব পালা করে নিজেদের মধ্যে। অর্থাৎ চাকরির শর্ত-স্থায়িত্ব-বেতন-ছুটি সব কিছু মালিকের সম্পূর্ণ অজান্তে একটি পুরো নেটওয়ার্ক দ্বারা পরিচালিত। এই জন্যই অমল ওড়িয়ালের প্রশংসা করে। এদের পারস্পরিক সহযোগিতা শুধু রক্তের সম্পর্ক বা গাঁয়ের ভিত্তিতে নয়, ওড়িয়া হিসাবে জন্মের জন্য। আর বাঙালিদের?
প্রতিটি ক্ষেত্রে একটিই চিন্তা, কী করে অন্য একজন বাঙালিকে ল্যাং মারবে। নিজভূমে তো বটেই প্রবাসেও। এই তো একতার মধ্যে কি কম খাওয়াখেয়ি। অমল থাকা সত্ত্বেও। বছর দুয়েক আগে বাঙালি মেয়েদের কাজ চাই কাজ চাই শুনে শুনে বিরক্ত অমল প্রস্তাব করল একতার একটা লেডিজ উইং খোলা হোক, সকলেই রাজি। স্ত্রীদের উপচেপড়া এনার্জিতে স্বামীরা তো বরাবরই ভীত। একটা চ্যানেলে বের করে দিতে পারলে সকলের শান্তি আর একতারই শাখা, অতি নিরাপদ, সংস্কৃতি নিয়ে থাকবে। চেয়ারপারসন হলো ইন্দ্রাণী, যার স্বামী জয়ন্ত সরকার (ইংরিজি বানান লেখেন এস আই আর সি এ আর, সিরকার)। ভদ্রমহিলা স্মার্ট, কনভেন্ট ইংরিজি বলেন। বাংলাও সুন্দর। তাঁর পরিচালনায় বেশ চলতে লাগল নানা রকম অনুষ্ঠান, বাচ্চাদের বসে আঁকা, মহিলাদের ক্যালোরিশুন্য রান্নাবান্না, উঠতি বয়সিদের জন্য কুইজ-ট্যুইজ। হলে হবে কি, দুদিন যেতে না যেতেই স্বমূর্তি প্রকাশ। প্রচণ্ড ইগো। পুজো উপলক্ষে ইনহাউস প্রোগ্রামে মেম্বারদের বাচ্চাদের কী নাটক করবে সে বিষয়ে মৈত্রেয়ী দুটো কথা বলেছিল—যেমন বরাবরই করে, এ বিষয়ে ওর চেয়ে ভাল আর কে জানে—ও বাবা, একেবারে কেউটে সাপের মতো ফনা তুলল ইন্দ্রাণী সরকার (ইংরিজি সিরকার)। কে মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী, উনি তো কলকাতায় থাকেন, একতার সদস্য পর্যন্তনন। তিনি কিনা লেডিজউইং-এর প্রেসিডেন্ট ইন্দ্রাণী সরকার (ইংরিজি সিরকার)-এর উপর ছড়ি ঘোরাতে এসেছেন ইত্যাদি। ব্যাপারটা এতদূর গড়াল যে শেষ পর্যন্ত জয়ন্ত ও ইন্দ্রাণী সরকার (ইংরিজি সিরকার) ছেড়েই দিল একতা। আর তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল অরুণ-মিতালী ও নিশীথবাঁশরী। অর্থাৎ ওদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদম্পতিরা।
এইতো প্রবাসী বাঙালির পারস্পরিক সম্প্রীতির নমুনা। কোনও মতবিরোধই মেনে নিতে পারে না। পান থেকে চুন খসল তো ব্যস সম্পর্কটাই কাটান হয়ে গেল। পাঁচটা বাঙালি একসঙ্গে হওয়া মানেই তিনটে সংস্থা, একের সঙ্গে অন্যের মুখ দেখাদেখি নেই। অবাঙালিরা তো হাসবেই। আর সুবিধাও নেবে। এই সিরকার-পর্বের আগে পর্যন্ত কত কষ্টে অমল একতা-কে এক করে রেখেছিল। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। যাই হোক এবারে বাইশে শ্রাবণ রবীন্দ্রমূর্তি প্রতিষ্ঠা আর শুভম-এর বাংলা নাটক তার ভুবনেশ্বরে শেষ অনুষ্ঠান। খাওয়ার পর মৈত্রেয়ীকে টেলিফোন করে। সত্যি গড়িয়াহাটে ওই ভীড়গরম আর যানজটে কথাবার্তাই হয় নি।
—আচ্ছা সরোজ মিত্তিরের সঙ্গে একবার কথা বললে হত। অবশ্য ওঁর গ্রুপের ম্যানেজারের সঙ্গে আমার শো-এর ব্যাপারে ফাঁইনাল কথা হয়ে গেছে। তবু–
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাকে বলে কার্টেসি কল। মৈত্রেয়ীর গলায় উৎসাহ উপচে পড়ে।
-কাল পরশুর মধ্যে কোন শো থাকলে দেখেও আসা যায়। আমি সরোজদাকে টেলিফোনে ধরি তারপর তোমাকে বলবখন। ওকে বেশি রাতের আগে পাব না। উনি তো সিনেমা-টিভি-সিরিয়েল সবেতেই অ্যাকটিং করেন। শুটিং নিয়ে সবসময় ব্যস্ত। এই তো এখন… মৈত্রেয়ী গরগর করে বলে যায় নাট্যকার অভিনেতা সরোজ মিত্রের বর্তমান দিনপঞ্জী।
–তুমি তো দেখছি খুব জমিয়ে ফেলেছ ভদ্রলোককে, অমল মন্তব্য করে। বছর দশেক আগেও মৈত্রেয়ী যদি অন্য কোনও পুরুষ সম্বন্ধে এতটা ওয়াকিবহাল হত বেশ একটা ঈর্ষা-কলহ মান অভিমানের তরঙ্গ উঠত তাদের স্রোতহীন নিশ্চয়তায়। একটা ফাঁইটিং সিন না হলে জমাটি কাহিনী কি। পরদিন সকাল সাড়ে সাতটা বাজেনি, মৈত্রেয়ীর ফোন,
—সরোজদার সঙ্গে কথা হল। উনি ও দুদিনই খুব ব্যস্ত, আউটডোর শুটিং-এ যাচ্ছেন। ভারি দুঃখ করছিলেন তোমার সঙ্গে দেখা হল না। আচ্ছা শোনো উনি বলছিলেন যে, তুমি থাকতে থাকতে তো ওঁর কোনও শো নেই তবে ওঁর লেখা একটা নাটক বিজন থিয়েটারে শনি রবিবার অভিনয় হয়। উনি বারবার বলছেন, কাল মানে রোববার আমাদের দেখতে যেতে।
– টিকিট কাটাফাটার ঝামেলা–
—আরে—দুর। উনি তো আমাদের ইনভাইট করছেন। কাউন্টারে বলে রাখবেন। চল যাই দেখে আসি।
অর্থাৎ সে সন্ধেটাও মৈত্রেয়ীর সঙ্গে কথাবার্তা হবে না। অবশ্য বলার মতো বিশেষ কিছু নেই। গেলেই হয়। অতএব, গেল। নাটক দেখা হল। ঠিক অফিস-ইউনিয়নের ড্রামার মতো নয়। তবে বেশি আঁতলেমিও নেই। গত শতাব্দির বাঙালি অভিনেত্রীর জীবন। কী করে তারা উঠল। নট ব্যাড। তবে অমলের সত্যি কথা বলতে কি হাসির প্লে-ই সবচেয়ে ভাল লাগে। নাটকের পর ফাঁড়িতে ঢাবার দোতলায় খেয়ে মৈত্রেয়ীকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। এক ফাঁকে মৈত্রেয়ী প্রশ্ন করে,
–এ দিকে সোজদার সঙ্গে তো সব অ্যারেঞ্জমেন্ট কমপ্লিট। স্ট্যাচুও হাজির। ভুবনেশ্বরে তোমাদের ওদিকে সব ঠিকঠিক মতো এগুচ্ছে তো?
-–হুঁ। চিন্তা করার কিছু নেই। অমল প্রসঙ্গটার মধ্যে যেতেই চায় না।
–আচ্ছা সমতা চ্যাটার্জি সাউথ ক্যালকাটা থেকে দাঁড়ান, তাই না? আজকাল কি খুব ব্যস্ত? পাল্টা প্রশ্ন করে অমল।
-সমতা, মৈত্রেয়ী হেসে ফেলে, এক কাজ করলে হয় সমতাকে নিয়ে চল না প্রধান অতিথি করে। সবাই একেবারে বোমকে যাবে। ওড়িয়াদের শক থেরাপি। ওতো হাত পা ছুঁড়ে দাবি করবে বাইশে শ্রাবণ ছুটির দিন করা হোক। সমতার বক্তৃতা তো। আর সিপিএম রবীন্দ্রনাথের কী কী অসম্মান করেছে তার ফিরিস্তি পাওয়া যাবে। তা ক্ষতি কি। তোমার একতাতে ভর্তি কংগ্রেসি।
–দুর। ঠাট্টা করি না। আমি অন্য একটা ব্যাপারে ওঁর কথা ভাবছিলাম। আজকাল কী বলছেন, মানে ওঁর লেটেস্ট কী?
-ওমা জানো না? সামনের নভেম্বর ডিসেম্বরে নাকি বামফ্রন্ট সরকার কলকাতায় হকার উচ্ছেদ করবে। আমাদের সমতাদি হকারদের পক্ষে। এই তো রোজ পথসভা মাঠসভা চলছে। গতকাল গড়িয়াহাটে শুনলে না?
—আর বল না। একেই লোকের ভীড়ে দমবন্ধ হয়ে আসে তার মধ্যে আবার পথসভা। পথ কোথায় বাকি আছে ওখানে।
–আরে ওর মধ্যে। ওইতো ট্রেডার্স অ্যাসেম্বলি দোকানটার সামনে হচ্ছিল।
-কলকাতাতেই এসব চলে। ভুবনেশ্বরে তো সব ও ধরনের স্টল দুদিন যেতে না যেতে মেরে তুলে দেয়। কেউ কিস্যু করতে পারে না। বড়জোর একদিন বন্ধু। তা দে, তোদেরই ক্ষতি সরকারের কী। ওড়িয়ারাই ঠিক করে। দেখ তো ভুবনেশ্বর কেমন চমৎকার পরিষ্কার ঝকঝকে শহর।
-আর এদিকে যাদের মেরে তুলে দিচ্ছে তারা যাচ্ছেটা কোথায়? ভোট দিলেই যেখানে রাস্তায় যা খুশি তাই করা যায় সেখানে। তোমাদের সত্যনগর-এ স্টল ভাঙার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ পত্রটি প্রাক্তন স্টল মালিকরা সেই লম্বা-চওড়া মুখ্যমন্ত্রীর হাতে ধরালো কোথায়,
কলকাতায়। সত্যি ওদের হাতে বেগুনি ফুলুরি আলুরচপ না খেলে কি আমাদের আশ মেটে, না কি গাঁটের পয়সা খরচ করে সুন্দর ঝকঝকে শহর ভুবনেশ্বর না দেখলে প্রাণ জুড়োয়। আমরা যে সব উদার বাঙালি!
-তুমি সেই টিপিক্যাল কলকাতার বোং রয়ে গেলে। অমল মৃদু অনুযোগ করে, তোমাদের এরকম মেন্টালিটির জন্যই আমাদের বদনাম। ওড়িয়ারা কত উন্নতি করেছে। জান? বিদ্যাপীঠ ফিঠ পেয়েছে। আই এ এস তো সব ওরাই। এ ছাড়া ইঞ্জিনিয়র উকিল ডাক্তার পাবলিক সেকটর একজিকিউটিভ ছড়াছড়ি।
-নার্সও, মৈত্রেয়ী রণে ভঙ্গ দেবার পাত্রীনয়। পরশু ট্যাকসি ড্রাইভারকে তো দেখলে, শ্রীমান বংশীধর জেনা।
—তুমি তাহলে নেক্সট ভুবনেশ্বর আসছ সেই বাইশে শ্রাবণ? না এবারে জোর করে কথা ঘোরাতে হয়।
-হ্যাঁ। ততদিনে মা একেবারে ঠিক হয়ে যাবেন।
—কাল তোত মোটামুটি ভালই দেখলাম। অমলের অবশ্যকর্তব্যকর্ম সমাপ্ত, পাঁচ মিনিটের কুশল সম্ভাষণ। অতঃপর সোমবার সকালে ধৌলি। বিদায়, বিদায় কলকাতা, বিদায় জন্মভূমি।
.
ভুবনেশ্বরে ট্রেন পৌঁছল দুপুর দুটোয় আজ বেশি লেট করেনি। এসি চেয়ার কম্পার্টমেন্ট থেকে বেরুতে ঠাঠা রোদ যেন ঠাস করে চড় মারল অমলকে। তবু অনেক ভাল। সামনে পিছনে মাথার ওপরে খোলা আকাশ। স্টেশন থেকে বেরিয়ে ডান দিকের রাস্তায় ঘোরার মুখে সেই পরিচিত ট্রাফিক আইল্যান্ডটা। সুন্দর ছাতার মতো আকারের পরপর দেবদারু গাছ। ছোট ছোট। ঘন সবুজ মসৃণ পাতা রোদে ঝকঝক করছে। বাড়ি ফিরে স্নান খাওয়া সেরে তিনটে নাগাদ অফিস। রাত আটটা পর্যন্ত এসি তে আরাম করে জমে যাওয়া কাজ সারা।
অতঃপর বেরিয়ে সোজা ভুবনেশ্বর ক্লাবের দিকে। কী রাস্তা। বিশাল প্রস্থ, দুদিকে গাছ। কী গাছ কে জানে, তবে আকারে বিরাট এবং ঝকড়া, ডালপালা পাতায় ভরা। এই গরমেও সেক্রেটারিয়েট আর অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল অফিসের বাগানে কিছু না কিছু ফুল ফুটে আছে। বাঁ দিকে যে বিরাট মাঠটা এক সময়ে ছিল সরকারের বিরুদ্ধে সব শোভাযাত্রার গন্তব্যস্থল ও গলাবাজির প্রশস্ত স্থান, সেটি এক মুখ্যমন্ত্রীর বিচক্ষণতায় মনোরম উদ্যানে পরিণত। ইন্দিরা গান্ধী পার্ক। এখন সেখানে গাছলতাফুল আলো, সকালসন্ধ্যায় স্বাস্থ্যান্বেষীর পদচারণা ও শীতের মরশুমে পুষ্পপ্রদর্শনী। যখনই পার্কটির দিকে অমল তাকায় ওড়িয়াদের প্রতি নতুন করে তার শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়। ডানদিকে বাঁক নেয়। রাজপথ, সোজা চলে গেছে রাজভবনে। এ পাড়ায় সব ধ্বজাগজাদের বাস। চওড়া ফুটপাত ও বাড়িগুলোর মধ্যে ছোটবড় গাছের সারি। এখানে শুধু সরকারি বাসস্থান। এক একটি বাড়ির সামনে বিশাল বাগান। ভিআইপিরা থাকেন।
যখন অমল সদ্য ভুবনেশ্বরে পোস্টেড, একবার সারাদিনের কাজে কটক গেছে। দুপুরে কটকের সারকিট হাউসে খাবার বন্দোবস্ত। সেখানে একটু পরেই এলেন এক বয়স্ক বাঙালি ভদ্রলোক, ওড়িশা ক্যাডারের আই এ এস তখন অবসর গ্রহণের মুখে। শান্ত ধীর স্থির ভারি একা। স্ত্রী মারা গেছেন। একমাত্র মেয়ে বিয়ে হয়ে দিল্লিতে। এসব খুঁটিনাটি অমল সারকিট হাউসে ঢুকতে না ঢুকতে অতি কর্মদক্ষ মহিলা ম্যানেজারের কাছে পেয়ে গেছে। ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হতেই জিজ্ঞাসা করে,
–রিটায়ারমেন্টের পর কোথায় সেক্স করবেন?
–কলকাতাতেই ফিরে যাব।
—এখানে বাড়ি করেননি? ভুবনেশ্বরে আই এ এসদের সবতো প্রাসাদের মতো বাড়ি। ভদ্রলোক মৃদু হেসে মাথা নাড়েন, না এখানে বাড়ি করেননি।
-কতদিন হল স্যার আপনার এখানে।
-চৌত্রিশ বছর। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টাই কাটিয়েছি এ রাজ্যে। তাই আজকে এখানে এলাম। এ মাসেই রিটায়ার করছি। কটকেই আমার চাকরিজীবন শুরু। প্রথমে এসে সারকিট হাউসে উঠেছিলাম। না, এই সারকিট হাউস নয়, এটা তো নতুন বিল্ডিং। সামনের দিকে ছিল পুরনো ইংরেজ আমলের চারিদিকে ঘোরানো বারান্দা কাঠের খড়খড়ি দেওয়া বাড়ি। তখন আমি ট্রেনিং-এ। দোতলায় কোণের ঘরে থাকতাম। পিছনের বারান্দা থেকে বিকেলে বসে বসে দেখতাম সামনে মহানদী।
-এতদিনে এখানে কাটিয়ে এখন ছেড়ে যেতে খারাপ লাগছে না? ভদ্রলোক আবার মৃদু হাসেন। ম্লান হাসি।
—হে দেব, হে দেবীগণ আজি মোর স্বর্গ হতে বিদায়ের দিন। রবীন্দ্রনাথ পড়ি। তিনিই একমাত্র সান্ত্বনা।
এ পাড়াতেই ভদ্রলোকের সরকারি বাসস্থান ছিল। ঠিকানা দিয়েছিলেন, ওড়িশা ছাড়বার আগে অমলের সঙ্গে আবার দেখা হলে খুশি হবেন। নেহাত ভদ্রতা। অমল অবশ্য যায়নি। কবিতাটবিতা আওড়ানো সে বরাবর ভয় পায়। তখনও তো একতা নামে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হওয়া কল্পনায় ছিল না। তবে এ পাড়াতে এলেই ভদ্রলোকের কথা ও কবিতার লাইনটি মনে পড়ে। হ্যালোজেনের উজ্জ্বল আলো ঘন সবুজ গাছ, দুধারে বিস্তৃত বাগান থেকে ফুলের মৃদু সুবাস। এর নাম স্বর্গ। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয় অমল। আঃ কী আরাম। এই জৈষ্ঠের গরমেও।
ক্লাবের চত্বরে অভ্যস্ত কোনায় গাড়ি রেখে ভেতরে ঢোকে। মখমল ঘাসে ঢাকা লন, একদিকে ঘন দেবদারুর দেওয়াল। আধো অন্ধকারে এখানে ওখানে বেঁটে স্তম্ভে জ্বলছে সাদা কাঁচের ঘেরাটোপে আলো। ইতঃস্তত টেবিল চেয়ার কিছু খালি কিছু ভর্তি। উর্দিপরা বেয়ারার ডান হাত্রে তালুতে ট্রেবসিয়ে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা। চারদিকে স্বল্প পরিচিত অপরিচিত সব মুখ। এই হচ্ছে ভদ্রলোকের মতো বাঁচা। গড়িয়াহাট বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতি, কলকাতা একটা দুঃস্বপ্ন। অমল ফিরে আসে তার নিশ্চিত স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনে। খাও পিও জিও। মানুষের আর কী চাই।
—আপনার লাইফ হিস্ট্রির আবার ফিলজফি আছে দ্যাখসি। ছায়া দেবনাথ টিপ্পনি কাটে।
—ফিলজফি আর কি। যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।
–সেতো বটেই। কারণ এই জীবনই একমাত্র জীবন, একবার মরে গেলে আর মানুষ এ পৃথিবীতে ফেরে না। যা ভোগ করবার আজই, এখনই।
বাঙাল মেয়েটা থেকে থেকে অমলকে চমকে দেয়।
-এই তো দিব্যি চমৎকার বাংলা বলছ। এত জ্ঞানের কথা কোথায় শিখলে?
-কে জানে। এই আপনাগো পত্রপত্রিকায় পড়সিলাম আর কি। বাংলাদেশের লাইব্রেরিতে পুরাতন কপি দ্যাখতাম কি না। নির্বিকার উত্তর, আবার নিজস্ব বুলি, মেয়েটার তাল পায় না অমল।
—তা বড় বড় কথা তো বললেন কিন্তু ঘটনাটাতো কিছুই আগাইলো না। রবীন্দ্রনাথের মূর্তি কী হইল? শুভম-এর নাটক? বড্ড ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যাংটায় মেয়েটি। বাঙাল বলে কি এটুলি হতে হবে।
–বকবক কোরো না, যাও অনেক হয়েছে। ভয়ংকর বিরক্ত লাগে অমলের। বিনা বাক্যব্যয়ে কাগজ কলম ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে উঠে পড়ে ছায়া।
.
তারপর কদিন তার আর পাত্তা নেই। হঠাৎ সকালে এসে যেন কিছুই হয়নি যেন প্রতিদিন নিয়মিত এসেছে এমন ভাব করে জিজ্ঞাসা করে,
—কী রাতে ক্যামন ঘুমাইছিলেন? চোখদুইটা লাল ক্যান? কয় রাত নাইট্রাসুন খাইলেন, ঘুমান না কান?
অমল জবাব দেয় না। কথা বলতে ইচ্ছে নেই।
-ওষুধপত্র খাইতাসেন তো? দেখি কী কী খাইলেন, হাতে ধরা ফাঁইলটা খুলে পড়তে থাকে। ঠিকই তো আছে। তবে চুপ ক্যান?
এক নম্বরের মিথ্যেবাদী মেয়েটা। ঢং দেখ, ঠিকই তো আছে। ঠিক থাকলে আর ওষুধের ডোজ এত বাড়িয়ে দেয়। প্রত্যেকটি মিল ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ টি ডিনারের সময় ফ্লোর নার্স নিজে এসে দেখে অমল ঠিক মতো খেল কিনা। অমল কি এতই বোকা, কেন আসছে জানে না। চা কি দুধ কি জলে নির্ঘাৎ ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছে। তাই চেক্ করতে এসেছে। ওষুধটা ঠিকমতো অমলের পেটে গেল তো। অথচ অত ন্যাকামির কোনও কারণ নেই। অমল এমন কিছু সাংঘাতিক কাজ করে ফেলেনি। ভীম নামে যে ছোঁকরা তার বাথরুম ঘর বারান্দা সব সাফ করে, যার পুরী জেলায় বাড়ি, যার গুষ্টিসুদ্ধ সবাই এ পাড়ার বিভিন্ন নার্সিংহোম হাসপাতালে বাথরুম-ঘর বারান্দা সাফ করে, তাকে ধরে অমল বলেছিল,
-তোর নাম তো শকুন।
—না সার আমর নাম ভীমঅ।
-চুপ, ফের মিথ্যে কথা, তোর নাম শকুন। তোর বাপের নাম শকুন। তোর গুষ্টির নাম শকুন।
-আজ্ঞে না সার। আমর নাম ভীমঅ, বাপার নাম—
অমল এক লাফে খাট থেকে নেমে ছেলেটার কলার চেপে ধরে,
-মিথ্যে কথা বলার জায়গা পাসনি। বস্ তোর নাম শকুন, তোর বাপের নাম শকুন তোর গুষ্টির নাম শকুন। বল্ ব– প্রাণপণে চেঁচাতে থাকে অমল। ছেলেটা হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলে, নার্স বয় সবাই ছুটে আসে। অতঃপর ওষুধ, মানে আরও ওষুধ। কদিন বাদে ফ্লোর সিস্টার মায়াদি হাসিহাসি মুখে অমলকে জিজ্ঞাসা করেন,
-আচ্ছা এতগুলো লোকের কি এক নাম শকুন হয় অমল বাবু?
–কেন হবে না? এত প্রাণীর নাম মানুষ না?
-ও আপনি সেই সেন্সে বলছে। তা এদের শকুন কেন বললেন, এরা তো মানুষ আপনার আমার মতো, দুটো হাত দুটো পা।
–ভুল। ওরা কীভাবে বেঁচে থাকে দেখেছেন?মৃতদের মাংস খেয়ে। এ রাজ্যটা জুড়ে শুধু মরা। মরা হাসপাতাল, মরা ব্যবসা, মরা শিল্প, মরা ভাষা। ভাগাড় ঘাঁটছে সব বাইরে থেকে আসা শকুনের দল।
– তা মরাটাও তো জীবনেরই নিয়ম। জন্মিলে মরিতে হবে। প্রকৃতি ব্যবস্থা নেয়, ভারসাম্য বজায় রাখে। তাতে রাগ হবার কী আছে। আমাদের সবই যদি মরে গেছি তা হলে মরা পরিষ্কার করা তো দরকার। আপনি এতে এত ক্ষেপে যাচ্ছেন কেন? উত্তর দেয় না অমল। ভয়ংকর বিরক্ত লাগে ফালতু কথা শুনলে। এদের যেন কিছুই গায়ে লাগে না। মৃত্যু প্রকৃতির নিয়ম। চমৎকার। বলি নিজের মা মরলে কাদিস, না কি কাঁদিস না? আর যেখানে অকালমৃত্যু সেটা কি শোকের নয়? বাঙালির অদৃষ্টে যা কিছু পাবার ছিল সবই কি অতীতকাল? বর্তমানে শুধু আলোচাল আর কঁচকলা। যত্ত সব ন্যাকামি। মাথায় আগুন ধরে যায় অমলের।
পরের দিন সকালে রাউন্ডে এসে ডাক্তার বর্মনের বদলে ডাক্তার মারিক অনেকটা সময় কাটান অমলের সঙ্গে।
-কী হল হঠাৎ মেজাজ আবার খারাপ হল কেন? দিব্যি চমত্তার ছিলেন, অ্যাবসোলিউটলি নরম্যাল। আমরা তো ভাবছিলাম কিছুদিনের মধ্যে ফিরে যাবেন। কী যেন একটা বেশ আনইউজুয়েল নাম আপনার বাড়ির? হা হা মনে পড়েছে, এই তত ফাঁইলেই আছে, বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতি। মানেটা কী বলুন তো? কী চুপ কেন? বাড়িটা বোধ হয় আপনাদের বেশ পুরনো, আজকাল তো বঙ্গফঙ্গ দিয়ে নাম রাখলে লোকে প্যারোকিয়েল বলে। তা কবেকার তৈরি?
-১৯১০।
–মাই গড, বলেন কি। আপনাদের বাড়ি তো সেঞ্চুরি করে এখনও নট আউট।
—মানেটা কিন্তু অমলবাবু এখনও বলেননি, স্যার, মৃদু হেসে সঙ্গের নার্স মনে করিয়ে দেয়। বলে ফেলুন অমলবাবু বলে ফেলুন। আপনার তিন পুরুষের বাড়ি, আপনাকে বলতেই হবে। যেন বাচ্চা ছেলেকে নার্সারি রাইম জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, বলতো সোনামনি জ্যাক অ্যান্ড জিল তুমি তো খুব ভাল বল ওটা তোমাকে বলতেই হবে দেখ এই আংকল আন্টি কাকু কাকী কত শুনতে চাইছে, রাগে মাথাটা কেমন করে অমলের। ইচ্ছে করেই চেপে যায় অমল আসল ঘটনা। গম্ভীর মুখে বলে,
—ইন দ্য মেমোরি অফ বেঙ্গল দ্যাট ওয়াজ ওয়ান্স ব্লেসড় বাই ফরচুন। যে বাংলা একদিন শ্রীময়ী ছিল তার স্মৃতি।
-বাঃ কবিতাটবিতা লেখার অভ্যাস আছে নাকি? না? লিখতে আরম্ভ করুন। ইটস নেভার টু লেট টু স্টার্ট। একটা সময় ছিল সব বাঙালি বাংলায় লেখালেখি করত, বিজ্ঞানী জগদীশ বসু থেকে নেতা সুভাষ বসু। এখন আমরা নিজের মা-কেও বাংলায় চিঠি লিখতে পারি না। সময়ের সঙ্গে সবই পাল্টে যায়। কী বলেন অমলবাবু? সময়কে তো অস্বীকার করা যায় না। মন ভাল করুন। এত চুপচাপ থাকেন কেন? খবরের কাগজ পড়েন? প্রতিদিন কত কী ঘটছে। জানতে ইচ্ছে হয়? উত্তর দেয় না অমল। খবরের কাগজ, বাইরে কী ঘটছে, কী এসে যায় অমলের। এসমস্ত কিছুর মানেই নেই। অমল জানে ডাক্তার তার অনাসক্তিকে অসুখ বলে দেখে। বাস্তবের সঙ্গে যোগ না থাকা কী ভয়ংকর যেন এইচ আই ভি পজিটিভ।