Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জার্সি গোরুর উলটো বাচ্চা || Swapnamoy Chakraborty

জার্সি গোরুর উলটো বাচ্চা || Swapnamoy Chakraborty

রূপনারায়ণ পার হল গাড়িটা। অরুণাংশু বলে উঠল, রূপনারানের কূলে জেগে উঠিলাম, জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়…। তোচন সারখেল বলল, রূপনারানে ইলিশ কেমন আসে? ইলিশ? হরিসেবকবাবু বলল, আসুক না আসুক, বর্ষায় আসুন খাওয়াব। তোচন সারখেল কে চেনেন তো? বিখ্যাত কৌতুকশিল্পী। আজাদহিন্দ ফৌজের ওই গানটা— কদম কদম বাঢ়ায়ে যা, বিভিন্ন সুরে গেয়ে খুব নাম করেছেন, কাওয়ালি সুরে, খ্যামটায়, বিভিন্ন রাগে, পল্লিগীতির ঢং-এ, এমনকী কীর্তনের সুরেও গেয়েছেন। অনেক ক্যাসেট আছে ওঁর। ‘সারে যাঁহাসে আচ্ছা’ গানটারও প্যারোডি আছে। ‘সারে যাঁহাসে আচ্ছা’র পরের লাইনটা হাম সব শূয়ার কী বাচ্ছা, আর অমনি কী হাততালি। তোচন সারখেল (চলচ্চিত্র, ক্যাসেট) আছেন, উর্বশী অধিকারী আছে (লতাকণ্ঠী), মিস পাপিয়া আছেন (আশাকণ্ঠী), রন্‌চা ঘোষ আছেন (কিশোরকণ্ঠ), মিস সংঘমিত্রা আছেন (ছোটবৌ খ্যাত), আর ঘোষণায় আছেন অরুণাংশু বোস (বেতার, টিভি, সিনেমা)। অরুণাংশু বোস বসে আছেন জানলার ধারে, হাতে সিগারেট, মুখে স্মিত হাসি। ওর হাসিটাই আসল। মেয়েরা পাগল। অরুণাংশু বোস শুধু টিভির অ্যানাউন্সারই নয়, সুখেন মোদকের সুপারহিট ছবি ‘ভাসুরপো’-তে নায়কের বন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। ওখানে বাপ্পী লাহিড়ীর গানে লিপ দিয়েছেন, কাগজ খুললেই দেখবেন, ‘চ্যবনপ্রাস সব বয়সেই খাওয়া চলে’ লেখাটার তলায় অরুণাংশুর হাসি হাসি মুখের ছবি। অরুণাংশুর ঠিক পাশেই বসে আছে লতাকন্ঠি উর্বশী অধিকারী। অরুণাংশু রূপনারানের কূলে জেগে উঠে উর্বশীর কাঁধে হালকা হাত রেখেছিলেন। এ সময়, ঈশ্বর না করুন গাড়িটার যদি ভালমন্দ কিছু হয়ে যায়, বঙ্গসংস্কৃতির যে কতবড় ক্ষতি হয়ে যাবে ভাবা যায় না। আর্টিস্ট বোঝাই এই গাড়িটা যাচ্ছে নন্দকুমার গ্রামে। নন্দকুমার হাইস্কুল সংলগ্ন মাঠে নক্ষত্র সমাবেশ। সারারাত্ৰব্যাপী রেডিয়ো-দূরদর্শন-মঞ্চ-চলচ্চিত্র ও ক্যাসেট-শিল্পী সমন্বয়ে বিরাট বিচিত্রানুষ্ঠান। পরিবেশনায় হরিসেবক মাইতি। হরিসেবকও এই গাড়িতেই আছেন। নামটা শুনেই ভাববেন না হরিসেবক চিমসেপানা কেউ। না। একদম ইয়াং। ওই দেখুন গায়ে পলিয়েস্টার গেঞ্জি, পকেটে লেখা নাইটক্লাব। চোখে গগল্‌স। গাড়ি কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ পেরিয়ে আবার ঘুরল।

শস্যভারে নুয়ে পড়েছে ধানগাছগুলি। কতবার যে ধান হয় আজকাল, মাটির বিশ্রাম নেই। দু’পাশে সবুজ, আর সবজে হলুদ। মাঝে মাঝে দু-একটা গ্রাম, ঘর গৃহস্থালি, আমগাছগুলিতে ভরে আছে ফুলকচি সবুজ সবুজ গুটি। কিশোরকণ্ঠী রন্‌চা ঘোষ গেয়ে উঠল, আ গয়া আ গয়া— হালুয়া আলা আ গয়া। শস্যভারে নুয়ে আছে ধানগাছ। গৃহস্থের দেওয়ালে আলপনা, গাছভরা ফুলকচি আম… গাড়ি ছুটছে ত্রস্ত গোশাবক ছুটে সরে যায়। হরিসেবক বলে, চলুন, চা খাই।

সামনে একটা বাজার মতো, ওখানে একটা মিষ্টির দোকানের সামনে গাড়ি থামল। হরিসেবক দৃপ্ত হুকুম করল, কাপ প্লেটগুলো সব গরম জলে ফাসক্লাস করে ধোও। তারপর চা দিতে বলা হল। আর গজা। উর্বশী আধিকারী প্রথম কামড় মেরেই থু থু করে ফেলে দিল। ইস রেপসিডের গন্ধ। তাইতে আর কেউ গজা খেল না। হরিসেবক একবার মিনমিন করে বলেছিল, রেপসিডে হার্টের দোষ হয় না…। গাড়িটা ছাড়বার সময় হরিসেবকবাবু গাড়িটার ডান দিকে না উঠে বাঁ দিকে উঠলেন। ফলে মিস পাপিয়ার পাশের সিটটাই ওর হল। এই সূক্ষ্ম ব্যাপারটা বোধহয় অরুণাংশু লক্ষ করে থাকবে। নইলে গাড়িটা ছাড়তেই উর্বশীর কানে কানে অরুণাংশু কিছু বলতেই উর্বশী পিছনের দিকে তাকিয়ে হেসে নিল কেন!

সূর্য ডুবছে, ছাগলছানা ঘরে ফিরছে। পিচরাস্তার উপর ধান শুকোতে দিয়েছিল যেসব চাষিবউ, ওরা ধান তুলে নিচ্ছে। হরিসেবক বলল, ওই যে দেখুন আমার নাম। আলকাতরায় লেখা পোস্টার। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে পঞ্চায়েত সমিতিতে হরিসেবক মাইতিকে ভোট দিন।

ভোট হয়ে গেছে না? অরুণাংশু জিজ্ঞাসা করে।

হ্যাঁ, হয়ে গেছে, চিহ্ন রয়ে গেছে।

আপনি পঞ্চায়েতের মেম্বার?

হতে পারতাম, নিজেদের দোষে হলামনি।

নিজেদের দোষে, মানে?

সি পি এম ক্যান্টিডেট দিল, আর এস পি-ও দিল, মাঝখান থেকে সুড়ুৎ করে কংগ্রেস বেরিয়ে গেল আর কী।

আপনার কী পার্টি?

বুঝে নেন।

হরিসেবকবাবুর নাইটক্লাব লেখা পলিয়েস্টার গেঞ্জির ওপর মিস পাপিয়ার কাঁধছাটা চুল খলবল করছিল। বলল, এম এল এ মিনিস্টাররা আমাকে চিঠিপত্র লেখেন। একবার আমাদের পার্টির মিনিস্টার নিজে হাতে চিঠি লিখে রিকোয়েস্ট করলেন লোকজন নিয়ে মেদিনীপুরের রবীন্দ্রমঞ্চে গিয়ে উষা উত্থুপকে আটকাও। উষা উত্থুপ খুব অপসংস্কৃতি করছে। দুশো লোক নিয়ে গেলাম, পুলিশ লাঠি চালাল, খেলাম ক’ঘা। পার্টির জন্য কম করিনি স্যাকরিফাইশ।

অরুণাংশু বলে, আপনি তো উষা উত্থুপের বিরুদ্ধে লড়াই করলেন। এদিকে এসব ফাংশন করছেন, পার্টি বলবে না কিছু?

হরিসেবক হাসল। বলল, গরমেন্টের মিনিস্টাররা নিজেরা দাঁড়িয়ে থেকে আপনাদের সল্টলেক স্টেডিয়ামে কিমি কাতকারকে নাচাচ্ছে, মিঠুনকে নাচাচ্ছে, সংস্কৃতির নাম খগেন করে দিল, আমি কোন হরিদাস, হরিসেবক উত্তেজিত।

এই ড্রাইভার! একটু থামাও। এখানে থামাও। অরুণাংশু হঠাৎ চিৎকার করে। গাড়ি থামলে অরুণাংশু মুখ বাড়িয়ে ডাকে, শিবপদদা…। একজন রোগামতো লোক, পাজামা পাঞ্জাবি পরা, হাওয়াই চটি, এগিয়ে আসে। অরুণাংশু গাড়ি খুলে নেমে যায়, লোকটা অরুণাংশুকে জড়িয়ে ধরে। অরুণাংশু বলে— শিবপদদা, এখানে কীভাবে?

আমি তো এখানেই থাকি। ওই তো নন্দকুমার গ্রামে, গেছিলাম কাজে, ফিরছি।

তবে ওঠো গাড়িতে। আমরা তো নন্দকুমারেই যাচ্ছি। অরুণাংশু আরও একটু সরে জায়গা করে দিল।

কতদিন পর দেখা— শিবপদ বলল। ফাংশানে যাচ্ছিস তো? পোস্টারে তোর নাম দেখেছি, ‘ভাসুরপো’-খ্যাত প্রখ্যাত দূরদর্শন নক্ষত্র অরুণাংশু বসু। ভেবে রেখেছিলাম স্টেজে গিয়ে দেখা করব। এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। দুটো বাস ছেড়ে দিয়েছি, উঠতে পারিনি। সবাই ফাংশানে যাচ্ছে। ভিড়। ভাগ্যিস হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম।

কোত্থেকে ফিরছিলে শিবপদদা?

রুগি দেখে। একেবারে ফুলো পেট!

তুমি ডাক্তার শিবপদদা?

ডাক্তার কী করে হব রে বোকা? জানিসনা আমি বি এস সি ফেল? আমি সামান্য একজন স্বাস্থ্যকর্মী। হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল গতকাল ডাক্তারবাবু ছিলেন না। উনি সপ্তাহে দু’দিনের বেশি থাকেন না। কম্পাউন্ডারবাবু ওষুধ দিলেন। আমার মনটা আঁকুপাঁকু করছিল, ভাবলাম— যাই দেখে আসি…

কতদিন পর দেখলাম। কী ভাল যে লাগছে, সেই যে পাড়া ছেড়ে চলে গেলে…

চলে গেলাম কোথায়, চলে যেতে বাধ্য হলাম বল। হ্যাঁরে সেই ব্যোমকেশ বক্সির খবর কী রে, যে আমাদের ওঠাল?

জানো না, ও তো কাউন্সিলার হয়েছে।

বেশ।

এখনও লেখো শিবপদদা?

হ্যাঁ, লিখি তো…

এখন আর লিটল ম্যাগাজিন-ট্যাগাজিন পড়াও হয় না। কলেজ স্ট্রিটের দিকে যাওয়াই হয়ে ওঠে না আমার। আর কলেজ স্ট্রিটের বাইরে লিটল ম্যাগাজিন তো পাওয়াই যায় না। কাল ভোরবেলা তোমার ঘরে যাব শিবপদদা, কবিতা শুনব। কোথায় তোমার ঘর?

ওই তো নন্দকুমার স্কুলের পিছনেই। ১৮০ টাকা ভাড়ায় থাকি।

ক’দিন হল শিবপদদা?

মালদায় ছ’বছর ছিলাম। এখানে ছ’ মাস।

কলকাতার আশেপাশে ট্রান্সফার চাও? আমার সঙ্গে হেল্‌থ-এর ডেপুটি সেক্রেটারির আজকাল খুব…

না রে, চাই না। খুব ভাল আছি। আমাকে এরা ছোট ডাক্তারবাবু বলে। আমি তো ওদের জন্য কিছুই করতে পারি না, ওরাল রিহাইড্রেশনের নিয়ম শেখাই, টিপল অ্যান্টিজেন দি, স্বাস্থ্যের সাধারণ নিয়মকানুনের কথা বলি। অনেক সাধ আছে, কিন্তু ক্ষমতা নেই রে। বড় অন্ধকারে পড়ে আছি আমরা।

নন্দকুমার গ্রামে এখন কত আলো। কত লোক, গাড়ি থামতেই ভিড়। ভলান্টিয়াররা ভিড় রুখতে রুখতে আর্টিস্টমণ্ডলিকে নিয়ে গেল নন্দকুমার হাইস্কুলে। মহারাজ নন্দকুমার, যাঁকে ব্রিটিশরা ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল তার নামে এই গ্রাম, এই স্কুল। সারা স্কুলে আজ আলোর মালা। ব্যবসায়ী সমিতির প্রেসিডেন্ট দীনবন্ধু সাউ হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন স্কুলের ঠিক দরজাটায়, যেখানে তমসো মা জ্যোতির্গময় লেখা আছে। তারই তলায় লাল শালুতে ঝুলছে গণেশ পূজা উপলক্ষে ব্যবসায়ী সমিতি দ্বারা পরিচালিত বিরাট বিচিত্রানুষ্ঠান। অভ্যর্থনা কেন্দ্র। আর্টিস্টমণ্ডলী ঢুকছে। ক্যামেরার ফ্লাস জ্বলে জ্বলে ওঠে। হরিসেবক পরিচয় করিয়ে দেয়— এঁকে তো চেনেন নিশ্চয়ই, অরুণাংশুদা। দীনবন্ধু বলে, আপনাকে টিভিতে কত দেখি, হেঁ হেঁ। এই যে উর্বশী, এই যে পাপিয়া। শিবপদ পাশে সরে গিয়েছিল। অরুণাংশু শিবপদের হাত ধরে টেনে নিল। বলল, এঁনাকে চেনেন তো? শিবপদ মজুমদার। আমার শিক্ষক, ওঁর কাছেই আবৃত্তি শিখেছি। ভাগ্যক্রমে আজ দেখা। এখানেই থাকেন।

দীনবন্ধু সাউ সবার ক্ষেত্রেই হেঁ হেঁ করছিলেন, শুধু শিবপদর বেলায় বললেন— ‘ও’ অরুণাংশু তখন বলল, তা ছাড়া ইনি একজন সাহিত্যিক। খুব ভাল লেখেন।

গদাধর পই বাংলা টিচার! ফাংশান কমিটিতে আছেন। যদিও ফাংশানটা করছে ব্যবসায়িরা, এর মধ্যে মাস্টারমশাই কেন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। হাটতলার মোড়ে গদাধরবাবুর একটা কোচিং আছে বলে কি? তা, দু’বেলায় ডেলি একশো ছেলেমেয়ে পড়ে। উনি শিবপদর কাছে এসে বলেন— আমিও একটু সাহিত্যসেবা করি। আপনিও সাহিত্য করেন শুনলাম, ‘দেশ’-এ লেখেন?—উঁহু। তা হলে কোথায় লেখেন? শিবপদ পরিচয়, অনুষ্টুপ, শিলী, প্রমা কী সব পত্রিকার নাম বলল, তা শুনে নিয়ে গদাধরবাবু মিস পাপিয়ার কাছে চলে গেল। অরুণাংশু গলা উঁচু করে বলল, ও খুব উঁচু দরের লেখক, কত গ্রুপ থিয়েটার ওর গল্প নিয়ে নাটক করেছে, এমনকী শমীক ব্যানার্জির মতো লোক…। পাপিয়া আর সংঘমিত্রা হেসে উঠল। গদাধর পই কিছু একটা রসের কথা বলেছে বোধহয়। এইমাত্র পোস্টমাস্টার মশাই তাঁর কলেজ স্টুডেন্ট মেয়েকে নিয়ে এলেন। মেয়েটি শিবপদ ছাড়া সবার থেকে অটোগ্রাফ নিল। অজিত সামন্ত আলাদা ফটোগ্রাফার নিয়ে এলেন। দীনবন্ধু সাউ প্রেসিডেন্ট হতে পারেন কিন্তু তিন হাজার এক টাকা চাঁদা দিয়েছে কে?— অজিত সামন্ত। উনি মহাকালী কোল্ড স্টোরেজের মালিক। উনি একপাশে সংঘমিত্রা অন্যপাশে পাপিয়াকে নিয়ে ছবি তুললেন। টুং টাং শব্দ, গ্লাস এল বোতল এল, আর হইহই করে এসে ঢুকল পাঁশকুড়া ফাইভস্টার অর্কেস্ট্রার শিল্পীরা। শিবপদ বলল, যাই রে অরুণাংশু।— ফাংশান দেখবে না?— তা তো দেখতেই হবে। ঘরেও কি ঘুমুতে পারব? যা মাইক। —তুমি কিন্তু সামনের চেয়ারে বসবে, তুমি আমার গেস্ট। অজিত সামন্ত বললেন, নিশ্চই। নিশ্চই।

মাঠ জুড়ে ধান গাছের গোড়া এখনও কিছুটা সবুজ। পরিপূর্ণ হলুদ হবার আগেই কেটে নিতে হয়েছে বোধহয়। গাঁয়ের ফাংশান। শিবপদর পায়ে খোঁচা খোঁচা লাগে। হাজার হাজার লোক। সবাই বসতে পারেনি। কত লোক দাঁড়ানো। বউ ঝি-রা আসছে, আলতা রাঙা পায়ে দাঁড়িয়ে আছে কাটা ধান গাছের গোড়ায়। মুখে পান, কোলে সন্তান। পা-টা এ রকম কেন? পোলিওর টিকে-টা নিয়েছিল? কত লোক। কত অ্যানিমিয়া, ম্যালনিউট্রিশন, ভিটামিনের অভাব, স্কার্ভি, হেপাটাইটিস দাঁড়িয়ে আছে। জল ফুটিয়ে খেয়ো বুঝলে? কীসে ফুটাব ডাক্তারবাবু। মঞ্চে এলেন অরুণাংশু, সবাই হো হো করে উঠল। অরুণাংশু বলছে আকাশ নীল, সমুদ্রও নীল। নীলে নীলে নীলাকার। সমুদ্রের আছে ঢেউ, সুরেরও আছে ঢেউ। সুরের ঢেউ তুলতে আজ আপনাদের কাছে আসছেন আপনাদের চির আকাঙিক্ষত, আপনাদের চির…

কেটে নেওয়া ধান গাছগুলো তখনও কিছুটা সবুজ। সেখানে দাঁড়িয়েছে আলতা রাঙা পা, বেজে ওঠে অ্যাকর্ডিয়ান, গিটার, মাউথ অর্গান। মাঠ দাপিয়ে ছুটে যাচ্ছে ঝিন চাগ ঝিন। শিবপদ ওর ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করে।

বলাকা সংঘের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অরুণাংশু ফার্স্ট হয়েছিল। শিবপদ ছিল জাজ। ও অরুণাংশুর পিঠ চাপড়ে বলেছিল, পরে দেখা কোরো। শিবপদ যুব উৎসবে ফার্স্ট হয়েছিল। পাড়ায় ওর খুব নামডাক। পাড়ার এক দাদা বলেছিল, একবার রেডিয়োতে যাও শিবপদ, ওখানে চেষ্টা করো। এক অফিসারের চেয়ারের উলটো দিকে দেড়ঘণ্টা বসেছিল শিবপদ। তারপর অফিসারটি বলেছিলেন— কিছু মনে কোরো না ভাই, এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসবে? সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। এরপর আর ও মুখো হয়নি শিবপদ।

অরুণাংশুর গলা ভাল। তা ছাড়া ও পেরেছে। ওর উন্নতি হয়েছে, নাম করেছে। ভালই লাগছে শিবপদর। দু’বছর ওর কাছেই তো তালিম পেয়েছিল অরুণাংশু। অরুণাংশু তো এ কথা অস্বীকার করে না…

শিবপদ ফিরে আসতেই খপ করে হরিসেবক ওকে ধরল। —সেই থেকে খুঁজছি, কোথায় গিসলেন অ্যাঁ? অরুণাংশুদা বলেছে আপনাকে একটু খাতির যত্ন করতে, চলুন একটু জলটল খাবেন। শিবপদ কিছুতেই খাবে না। হরিসেবকও এঁটুলি। না আপনাকে খেতেই হবে। অনলি ফর মাই পেস্টিজ। শিবপদকে নিয়ে গেল নন্দকুমার হাইস্কুলের ওই ঘরটায়, ক্লাস নাইন বি। বোর্ডে লেখা ভাব সম্প্রসারণ করো:—

ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়

বাংলার নদী মাঠ ভাটফুল ঘুঙুরের মতো তাঁর কেঁদেছিল পায়।

হরিসেবক গ্লাসে ঢালল হুইস্কি। শিবপদ বলল, করছেন কী?

অল্প, অ্যাঁ? অনলি ফর মাই পেস্টিজ।

শিবপদ বলল— আমি উঠছি।

হরিসেবক বলল, তা হলে আপনি কাজু খান, চিপ্‌স আছে। মিষ্টিও বোধহয় আছে। আমি একটু জল খাই, অ্যাঁ? আমাকে সব্বাই চেনেন। পিন্টুদা আমাকে চিঠি লেখেন। আরতিদি, হৈমন্তীদি, শিবাজীদা সবাই আমাকে ভালবাসেন। শিবাজীদা আগে বিরাটিতে থাকতেন, এখন অরুন্ধতীদিকে বিয়ে করে সল্টলেক চলে গেছেন, একটা যা অ্যালসেশিয়ান আছে না। শিবপদ বলে, ঠিক আছে, বিশ্বাস করছি।

হরিসেবক বলে— তিরিশটার মতো ফাংশান করেছি এই মেদিনীপুর জেলায়। আগে আগে দু-এক জন বলত আমি অপসংস্কৃতি করছি, এখন আর কেউ বলে না, বলার মুখ নেই, বললেই হোপ, লাইট দেখিয়ে দেব, বুঝলেন না?

শিবপদ বলে, স্থানীয় শিল্পীদের চান্স দেন না কেন, এখানে কত ভাল শিল্পী আছে।

কেন, দিলাম তো, ওই যে পাঁশকুড়া ফাইভস্টার অর্কেস্ট্রা?

আমি বলছি পল্লিগীতি, ঝুমুর, রং, তরজা।

ধুস।

ওখানে খুব হইচই। অরুণাংশুর গলা শোনা যাচ্ছে— আপনারা শান্ত হোন… ব্যাপারটা কী? জানা গেল, বনলতা সেন কলকাতা থেকে এসে গেছেন। গুজব ছিল উনি আসবেন না।

অবশেষে এলেন। তাই আনন্দ। অরুণাংশু চিল্লাচ্ছে, আপনারা দয়া করে সংযত হোন। নইলে মিস বনলতা স্টেজেই উঠবেন না। হরিসেবক আর শিবপদ স্কুলের মাঠের সামনেটায় বসেছিল।

হরিসেবকের এইসব নাচটাচ দেখার ততটা উৎসাহ নেই। জীবনে অনেক দেখেছে হরিসেবক। মিস শেফালি, মিস জে, কিছু বাকি নেই। এখানে ফুরফুরে হাওয়া।

এমন সময় এক বুড়ি এল। হরিসেবককে দেখেই এক্কেবারে গলে গেল। বলে, খোদ আপনার দেখাই পালাম যদি, আমার উপ্‌কার করেন। আমার লাতি দুটারে এট্টু খপর করে দ্যান, আমার ঘরে বড় বিপদ আজ্ঞা, জার্সি গোরু উলটো ছানা বিয়োচ্ছে।

হরিসেবক নাতি দুটোর নাম লিখে নেয়। বলে, লাতিগুলা ইখানে তো, লাতিগুলার বাপ কুথা!

বুড়ি বলে, বাপ মানে আমার ছেল্যা, সে তো নাই। ঘরে বউ একা কী করবে, বিকলো গোরুর পঁদে ঝল দেখ্যে বললাম, খকারা যাসনি, এখন ঠ্যাং বেরোয়ে এটকে রইছে।

শিবপদ ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝে। বাচ্চা হবার সময় আগে মাথা বেরোয়। বুড়ির গোরুর বাচ্চাটা পেটের মধ্যে উলটে গিয়ে আগে ঠ্যাং বেরুচ্ছে। ঠিকমতো বার করতে না পারলে বাচ্চাটা তো মরবেই, গোরুটাও মরে যেতে পারে।

হরিসেবক নাম লেখা কাগজটা পকেটে পুরে স্টেজের দিকে যায়। শিবপদকে বলে, সোশ্যাল সার্ভিস করি বলেই না গাঁয়ের লোক আমার কাছে আসে।

স্টেজে বনলতা সেন এসে গেছেন। এতদিন কোথায় ছিলেন? শিবপদ মনে মনে বলে। আমি শো করছিলাম। স্টারে, জানেন তো, প্রেমতৃষ্ণা নাটকের আমিই হিরোইন। আপনাদের ডাকে শো শেষ করেই সোজা গাড়ি নিয়ে চলে এসেছি। গ্রহণ করুন আমার উষ্ণ অভিনন্দন।

দর্শক আত্মহারা। হাজার হাজার অ্যামিবায়োসিস-হেপাটাইটিস-অ্যানিমিয়া-একজিমা দু’হাত তুলে নাচতে লাগল। অরুণাংশু বলল, নাচের ময়ূরী এবার খুলে দিচ্ছেন তার পাখনা। বেজে উঠল ট্রালালা। হরিসেবক ছুটে গিয়ে একটা স্লিপ দিল অরুণাংশুর হাতে। অরুণাংশু একবার পড়ে কপাল কুঁচকাল। হরিসেবক অরুণাংশুর কানে কানে কী যেন বলল। তারপর অরুণাংশু বলল— একটি বিশেষ ঘোষণা। হারু সেনাপতি আর নাড়ু সেনাপতি আপনারা যেখানেই থাকুন, এক্ষুনি বাড়ি চলে যান। আপনাদের জার্সি গোরুর উলটো বাচ্চা হচ্ছে।

নৃত্য করেন বনলতা। চ্যাংড়া ছেলেপিলেরা দাঁড়িয়ে যায়। নাচে। ওদের পায়ের তলায় খোঁচা মারে বাংলার মাঠের ধান গাছের অবশেষ। ‘নাচো রে রঙ্গিলা, রক্তে এক কর স্বর্গ ও হার্লেম।’

উদ্দাম নাচ আধঘণ্টা হল। গাড়ি রেডি ছিল, বনলতা উঠে বসলেন। অজিত সামন্ত শেষ মুহূর্তে বনলতার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লেন, ফটোগ্রাফার ছবি তুলল, হরিসেবকও ধেয়ে এল। ততক্ষণে বনলতা গাড়িতে ঢুকে গেছেন। ওর আর ছবি তোলা হল না।

হাস্যকৌতুক শুরু হবার আগে মাইকে অরুণাংশু ঘোষণা করল, শিবপদ মজুমদারকে মঞ্চে আহ্বান করা হচ্ছে।

ব্যাপারটা কী! শিবপদ খুব আশ্চর্য।

শিবপদ মঞ্চের পিছনে যায়। দীনবন্ধু সাউ ওকে সমাদর করে নিয়ে যায়। বলে, আপনি এই গাঁয়েই আছেন, আপনি একজন রত্ন, অরুণাংশুবাবু বলছিলেন, অথচ আমরাই জানিনে, স্টেজে চলুন। হরিসেবকও এসে গেছে। বলে, একটা সারপ্রাইজ। নিজেই মাইক তুলে নেয় হরিসেবক। বলে, বন্ধুগণ! আমাদের ভাগ্যক্রমে আজ আমাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রীশিবপদ মজুমদার। তিনি বর্তমানে এই গ্রামেই থাকেন। নন্দকুমারের জনসাধারণের পক্ষ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা দিতে পেরে আমরা ধন্য।

শিবপদ কী করে ফিরে হতচকিত সম্মোহিতের মতো স্টেজের কোনায় চলে এসেছিল।

দীনবন্ধু সাউ কাগজ মোড়া কী একটা তুলে দিল শিবপদর হাতে। অরুণাংশু বলল, তালি বাজান, অমনি, সারা মাঠ জুড়ে তালি বেজে উঠল। সারা মাঠ যেন পোষমানা। শিবপদ কী ঘটে গেল ঠিক বুঝতেই পারল না, মৃত সন্তান কোলে করা দুঃখী মায়ের হাসপাতালের সিঁড়ি পেরোনোর মতো ওই প্যাকেটটা নিয়ে কোনওরকমে মঞ্চ থেকে নেমে আসে শিবপদ। পোস্টমাস্টারের মেয়েটা খাতা খুলে এগিয়ে আসে, একটা অটোগ্রাফ। স্টেজে হাস্যকৌতুক শুরু হয়ে গেল। শিবপদ কাগজ খুলে দেখে কাচ বাঁধানো লেখা—

শিবপদ তোমার লেখায় পল্লি মায়ের কথা

তোমার গায়ে লেগেই আছে পল্লি মায়ের ব্যথা

তোমায় পেয়ে ধন্য মোরা আজিকার এই রাতে

ক্ষুদ্র স্মৃতি চিহ্নখানি তুলে দিলাম হাতে

—ইতি নন্দকুমারের অধিবাসীবৃন্দ।

॥ লেখাই ও বাঁধাই চিন্তামণি আর্ট স্টুডিয়ো ॥

শিবপদ ওই প্যাকেটটা নিয়ে মাঠে, একেবারে পিছন দিকে চলে যায় যেখানে অন্ধকার। ধানগাছের কাছে, মাঠের সিক্ততার কাছে চুপচাপ বসে থাকে। ওকে যেন কেউ ধর্ষণ করে গেছে। কীর্তনাঙ্গে কদম কদম বাঢ়ায়ে যা হচ্ছে। ধর্ষিত হচ্ছে সমস্ত মাঠ, মাঠ কি বোঝে না? ওইসব শেষ হলে মৃগী রুগির মতো কেঁপে উটল মাঠ। হাততালি। এবার অরুণাংশুর ভারী কণ্ঠস্বরে শুনতে পায় শিবপদ—

হারু সেনাপতি, নাড়ু সেনাপতি, এক্ষুনি বাড়ি চলে যান। আপনাদের জার্সি গোরুর উলটো বাচ্চা হচ্ছে।

কাচ বাঁধানো ওই জিনিসটা মাঠের অন্ধকারে ফেলে আসে শিবপদ। আঙুলে উঠে আসা ফ্রেমের বার্নিশের রং মাথার চুলে মুছে ফেলে। আর্জেন্ট অর্ডার দিয়ে ওটা করানো হয়েছিল নিশ্চয়ই।

স্কুল মাঠের পিছন দিয়ে ঘরে ফেরে শিবপদ। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। এখানেও অরুণাংশুর গলা। পাঁশকুড়া ফাইভস্টার অর্কেস্ট্রা। জিলে লে জিলে লে। হাইড্রোসেফালাসের একটা শিশুর মা শিবপদর পা জড়িয়ে ধরেছিল। বাঁচান ডাক্তারবাবু। শিবপদ ডাক্তার না। ও কিচ্ছু জানে না। হাসপাতালে ডাক্তার থাকে না। শিবপদ দেখেছিল বাচ্চাটার মাথাটা বিরাট, চোখ বেরিয়ে এসেছে, স্কাল নরম। এর চিকিৎসা এখানে হবে না, শিবপদ এটুকু শুধু জানে। কলকাতায় নিয়ে যাওয়া, একবার পারে, বারবার পারে না। ছেলেটা মরবেই। শিবপদ কিচ্ছু করতে পারবে না। ওর কিছু ক্ষমতা নেই। জিলে লে জিলে লে… ভোর হয়ে আসছে। অরুণাংশুর গলা শুনতে পায় শিবপদ— সুরের এই উৎসব, গানের এই উৎসব শেষ হতে চলল। পুব আকাশ লাল হয়ে এল। এটাই শেষ আইটেম। গজল গাইবেন…

এবার হরিসেবকের গলা শুনতে পেল শিবপদ। হরিসেবক উত্তেজিত। একটি জরুরি ঘোষণা: হারু সেনাপতি, নাড়ু সেনাপতি এক্ষুনি বাড়ি চলে যান। আরে যা না রে উল্লুক। তোদের ঠাকমা এইমাত্র বলে গেল তোদের জার্সি গোরুটা বাছুরসহ মরে গেছে।

শিবপদ এবার ওঠে। অরুণাংশু এখানে আসবে বলেছিল, বিশ্রাম নেবে বলেছিল। স্টেজের পিছনে যায় শিবপদ। অরুণাংশু বলে, সেই থেকে তোমায় খুঁজছিলাম। অরুণাংশু সমাপ্তি ঘোষণা করে বলে— সামনের বছর দেখা হবে আবার! বিদায়!

অরুণাংশুকে স্টেশনে পৌঁছে দেবার জন্য রিকশা রেডি ছিল। কথা ছিল হরিসেবক পৌঁছে দেবে স্টেশনে। অরুণাংশু বলল স্টেশনে যাবে না, শিবপদর সঙ্গে ওর ঘরে যাবে। হরিসেবক মনঃক্ষুণ্ণ হল। হাজার হাজার মানুষ দেখতে পেল না হরিসেবক অরুণাংশুর পাশে বসে রিকশায় চলেছে। হরিসেবক লম্বা করে হ্যান্ডসেক করল। রিকশার চারদিকে ভিড়।

হরিসেবক শিবপদর দিকেও বাড়াল হাত। দীনবন্ধু সাউ, অজিত সামন্ত, সবাই এসেছে। অরুণাংশুর দিকে হাত বাড়ানো। ভিড়। শিবপদকেও দেখছে অনেকে। একজন শিবপদকে বলল, আপনি রাধেশ্যামবাবুর বাড়ি ভাড়া থাকেন না? শিবপদ বলে—হ্যাঁতো।— আপনি অরুণাংশুবাবুর বন্ধু? বাব্বা! রিকশা ছাড়ল। ভিড় ঠেলে এগুচ্ছে, এমন সময় একজন ছুটতে ছুটতে আসে। হাতে কাচ বাঁধানো ওই মানপত্রটা। বলে, মাঠে ভুলক্রমে ফেলে গেইছিলেন আজ্ঞা। অরুণাংশু ওটা নেয়।

শিবপদ বলে, ব্যাপারটা কী অরুণাংশু, এইসব মানপত্র…টত্র…

অরুণাংশু বলে— তোমাকে দেওয়া হল।

কেন?

তোমার পাওয়া উচিত।

কে বলল।

আমি বললাম ওদের, বললাম, আপনারা জানেন না, উনি কে?

আমায় পাইয়ে দিলি?

না, মানে আমি বললাম ওদের…

ছিঃ!

কিছু অন্যায় করেছি শিবপদদা?

তুই বুঝতে পারছিস না অরুণাংশু। তুই এতটাই ব্লান্ট হয়ে গেছিস। তুই তালি দিতে বললে ওরা তালি দেয়, তুই নাচতে বললে ওরা নাচে। তাই বলে তুই আমাকে মানপত্র পাইয়ে দিবি? করুণা করবি?

শিবপদদা, তুমি তো তোমার লেখায়…

ওদের কাছে আমার লেখা পৌঁছতে পারে না। ওদের জন্য আমরা আঁতেল কাগজে আঁতেল কায়দায় কাঁদি আর ওই কান্নার ক্যাসেট আঁতেলরাই বাজিয়ে শুনে সুখ পায়। ওদের কাছে আমি কিচ্ছু না। তুই ওদের দেবতা।

বাড়ির সামনে ভিড়। অনেকে আগেভাগেই খবর পেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাড়িওলার স্ত্রী কড়কড়ে শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে রিকশাটা ঢুকতে দেখেই বলে, শিবপদবাবু, উনি আপনার বন্ধু? আগে কখনও বলেননি তো…

শিবপদ রিকশাওলাকে বলে— ঘোরাও। স্টেশনে চলো।

অরুণাংশু অবাক হয়। শিবপদ বলে— তুই দেবতা। আমি প্রসাদ হতে চাই না।

চৌমাথার মৌড়ে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিল। শিবপদ রিকশা থামিয়েই মানপত্রটা পেট্রোল ট্যাঙ্কারের উপর আস্তে করে রেখে আসে। রাস্তার পাশে বসে প্রাতঃকৃত্য করছিল ড্রাইভার, পরিষ্কার না করেই হইহই করে ছুটে আসে!

শিবপদ ওটা বার করে বোঝায়—বিপজ্জনক কিছু নয়। বোঝায়— কলকাতা নিয়ে যেতে অসুবিধা হচ্ছে, তাই এখানে রেখে যাচ্ছে! ভাল করে পরীক্ষা করে ড্রাইভার। তারপর পিছন দিকটা খুবলে ফেলে। বলে, হনুমানজির ছবিটা এখানে সেট হয়ে যাবে! আচ্ছাই হুয়া।

ম্লান বসে থাকে অরুণাংশু! শিবপদও কথা বলে না কিছু। রাত্রির গর্ভ থেকে উঠে আসছে। গো-শাবকের মতো একটা ম্লান গ্রাম। রিকশা চলে।

শিবপদ বলে—

আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার

জীর্ণ করে ওকে কোথায় নেবে?

ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর

আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক ॥

আপাতত ওই মানপত্রে ঢুকে থাকে হনুমানজি।

একান্তর, ১৯৮৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *