Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জঙ্গলগড়ের চাবি (১৯৮৭) || Sunil Gangopadhyay » Page 26

জঙ্গলগড়ের চাবি (১৯৮৭) || Sunil Gangopadhyay

রাজকুমারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ছ সাত জন লোক। আজ আর এদের। ছদ্মবেশ ধরার কোনও চেষ্টা নেই। মুখ দেখলেই বোঝা যায় এরা বেশ হিংস্র ধরনের মানুষ। ওদের পেছনে দেখা যাচ্ছে তিনটে ঘোড়া। সবেমাত্র সন্ধে হয়েছে, আকাশ এখনও পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি। মশালের আগুন কেমন যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

রাজকুমারের মুখখানা গম্ভীর, থমথমে। সে ম্যাপটা নেবার জন্য হাত বাড়াতেই কাকাবাবু নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললেন, উঁহুঃ। আগে সন্তুকে ডাকো। তুমি সন্তুকে ফেরত দেবে, তারপর আমি তোমায় ম্যাপটা দেব, এইরকমই তো কথা!

রাজকুমার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, রায়চৌধুরী, তোমার সাহস আছে বটে! একথা মানতেই হবে! ভেবেছিলুম, তোমাকে তুলে আনবার জন্য আবার অনেক ঝামেলা করতে হবে। কিন্তু তুমি নিজেই এসে ধরা দিয়েছ। তুমি খোঁড়া, তাও একা। আমরা এখানে এতজন আছি। এবারে কিন্তু তোমাকে আর কেউ এখানে বাঁচাতে আসবে না! সে ব্যবস্থা করা আছে।

কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, বাঁচাবার প্রশ্ন উঠছে কী করে? তোমরা। আমাকে মারবে কেন? তোমরা যা চেয়েছিলে, তা তো দিয়েই দিচ্ছি! ম্যাপ নাও। সন্তুকে ফেরত দাও!

বাঃ! তুমি কি আমাদের এতই বোকা পেয়েছ? ওই ম্যাপটা যদি জাল হয়? সন্তুকে আমরা এ বাড়িতে আটকে রেখেছি। সে ভাল আছে। এই ম্যাপ অনুযায়ী তুমি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের কাজ উদ্ধার হয়ে গেলে তারপর সন্তুকে ফেরত পাবে!

আমাকে আবার অতদূর নিয়ে যাবে? তার চেয়ে এক কাজ করো না! আমিও এখানে সন্তুর সঙ্গে থাকছি। তোমরা এই ম্যাপ নিয়ে চলে যাও। গেলেই বুঝতে পারবে আমি ঠিক ম্যাপ দিয়েছি, না ভুল দিয়েছি।

দেখি ম্যাপটা!

বললুম না, আগে সন্তুকে দেখাও, তারপর ম্যাপ পাবে?

কেন পাগলামি করছ, রায়চৌধুরী? আমরা তোমার কাছ থেকে ওটা জোর করে কেড়ে নিতে পারি না? দেরি করে লাভ নেই! চলো, রওনা হয়ে পড়া যাক।

আমাকে যেতেই হবে বলছ? তবে সন্তুকে ডাকো। সে-ও আমাদের সঙ্গে যাবে।

না! সে ছেলেমানুষ, তাকে নিয়ে যাবার দরকার নেই!

একটু আগে থেকেই চলন্ত ঘোড়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। এই সময় দুজন অশ্বারোহী সেখানে এসে পৌছল। ঘোড়া থেকে নেমে তারা ছুটে এল রাজকুমারের কাছে। একজন ফিসফিস করে বলল, কোথাও পাওয়া গেল না! সব জায়গায় তল্লাস করেছি–

রাজকুমার সেই লোকটির ঘাড়ে হাত দিয়ে ঠেলা মেরে ছিটকে ফেলে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, অপদার্থ! উল্লুক?

তারপর রাজকুমার চোখ ফেরাতেই দেখল কাকাবাবু তার দিকে তীব্র চোখে তাকিয়ে আছেন।

রাজকুমার বলল, তোমার কাছে গোপন করে আর লাভ নেই। তোমার গুণধর ভাইপোটি পালিয়েছে। মহা বিচ্ছু ছেলে!

কাকাবাবু বললেন, পালিয়েছে? এটা কি সত্যি কথা বলছ?

হ্যাঁ। ভোরবেলা সে চম্পট দিয়েছে। সারাদিন ধরে খোঁজা হচ্ছে তাকে। শুধু শুধু পালিয়ে তার কী লাভ হল? এই জঙ্গলের মধ্যে না খেয়ে থাকবে! বেশি দূর তো যেতে পারবে না!

এই জঙ্গলে জন্তু-জানোয়ারের ভয় নেই?

প্রায়ই ভাল্লুকের উপদ্রব হয়। বুঝতেই পারছ, আমাদের কোনও দায়িত্ব নেই। আমরা তাকে ভালভাবেই রেখেছিলাম এখানে, কোনও অত্যাচার করিনি।

ওর চিঠিতে এক ফোঁটা রক্ত দেখেছি। সেটা কার?

রাজকুমারের পাশ থেকে কর্নেল বলল, রাজকুমার, শুদুমুদ কথা বাড়িয়ে লাভ আছে? এই বুড়োটাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলুন না!

রাজকুমার বলল, রায়চৌধুরী, ঘোড়ায় ওঠো। ঘোড়া চালাতে জানো নিশ্চয়ই। এক পায়ে পারবে?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, পারব। চলো তা হলে! কিন্তু তোমরা কথা রাখতে পারলে না!

মোট পাঁচটা ঘোড়া। সেগুলোর পিঠে চড়ে পাঁচজন যাত্রা শুরু করল, আর বাকি রয়ে গেল সেখানেই।

কাকাবাবু ম্যাপটা রাজকুমারের হাতে দিয়ে বললেন, এ সব রাস্তা তোমরাই ভাল চিনবে। তোমরাই পথ ঠিক করো। আসল জায়গায় পৌঁছে তারপর আমি দেখব।

রাজকুমার আবার ম্যাপটা কর্নেল-এর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি এটা দেখে আগে আগে চলো

কর্নেল পকেট থেকে একটা টর্চ বার করে সেটা ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, এ জায়গাটা তো আমার চেনা!

রাজকুমার বলল, জায়গাটা তো আমিও আগে দেখেছি। কিন্তু সেখানে গোপন একটা দরজা আছে। তার সন্ধান শুধু এই রায়চৌধুরীই জানে।

তারপর শুরু হল অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাত্রা। মশালগুলো ওরা নিভিয়ে ফেলেছে। আকাশে অল্প জ্যোৎস্না আছে। জঙ্গলটাকে মনে হচ্ছে। ছায়ার রাজ্য।

কর্নেল চলেছে আগে আগে। কাকাবাবুকে মাঝখানে রেখে ঠিক তার পেছনেই রয়েছে রাজকুমার। তার হাতে রিভলভার।

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ কর্নেল-এর ঘোড়াটা চি-হি-হি-হি ডাক তুলে সামনের দু-পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল। কর্নেল টর্চের আলো ফেলল সামনে। কিছুই দেখা গেল না। কিন্তু ঘোড়াটা আর যেতে চায় না।

রাজকুমার চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হল?

কর্নেল বলল, মনে হচ্ছে কোনও বড় জানোয়ার আছে। ঘোড়া ভয় পেয়েছে।

রাজকুমার বলল, গুলি চালাও! যাই থাক না কেন, সরে যাবে!

কর্নেল বলল, যদি হাতির পাল থাকে? তা হলে গুলি চালালে তো আরও বিপদ হবে!

রাজকুমার বলল, না, না, এ জঙ্গলে হাতির পাল নেই, আমি জানি! চালাও গুলি!

রাত্রির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে পরপর দুবার গুলির প্রচণ্ড আওয়াজ হল। অনেক দূরে যেন একটা হুড়মুড় শব্দ শোনা গেল। আর কিছু না।

একটুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার এগোতে লাগল ওরা। এক জায়গায় নদী পার হতে হল। কর্নেল মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে ম্যাপ দেখে নিচ্ছে। প্রায় তিন ঘণ্টা পরে তারা পৌছে গেল জঙ্গলগড়ে। সবাই ঘোড়া থেকে নামবার পর আবার জ্বালানো হল মশাল।

রাজকুমার বলল, এ জায়গাটায় আমি আগে অন্তত তিনবার এসেছি। তন্নতন্ন করে খুঁজে কিছু পাইনি। রায়চৌধুরী, তুমি ধোঁকা দিচ্ছ না তো? এটাই আসল জঙ্গলগড়? উদয়পুরের কাছে যেটা সেটা নয়?

কাকাবাবু বললেন, এক সময় এখানেই আমি তাঁবু গেড়ে ছিলাম কয়েকদিন।

রাজকুমার বলল, সে খবর আমরা রাখি। কিন্তু তুমি আরও অনেক জায়গায় ঘুরেছ। স্বর্ণমুদ্রা তুমি কোথায় পেয়েছিলে?

কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, এখানেই। তবে গুপ্তধন কোথায় আছে, চটপট দেখিয়ে দাও! গুপ্তধনের সন্ধান আমি জানতে পারলে এখানে ফেলে রেখে যাব কেন? সেবারেই তো নিয়ে যেতে পারতুম।

গুপ্তধনের সন্ধান তুমি পেয়েছিলে ঠিকই। তুমি চেয়েছিলে একলা তা উদ্ধার করতে। তোমার সঙ্গে যারা ছিল, তাদের জানতে দিতে চাওনি। কিন্তু সেই সময় হঠাৎ তুমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে—

এই সময় কাছেই একটা ঝোপের আড়ালে দপ করে একটা মশাল জ্বলে উঠল। তারপর একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল। ঠিক আগেকার দিনের সৈন্যের মতন সাজপোশাক পরা দুজন লোক বেরিয়ে এল সেখান থেকে। তাদের হাতে লম্বা বশ। আর তাদের পেছনে দেখা গেল আর একজন লোককে। এর গায়ে মখমল আর জরির পোশাক। মাথায় মুকুট। অনেকটা যাত্রাদলের রাজা কিংবা সেনাপতির মতন দেখতে। হাতে খোলা তলোয়ার।

সেই লোকটিকে দেখেই রাজকুমারের সঙ্গীরা সম্মান দেখিয়ে মাথা নিচু করল। রাজকুমার বলল, আসুন স্যার!

কাছে আসার পর লোকটিকে চিনতে পেরে কাকাবাবু অস্ফুট স্বরে বললেন, শিশির দত্তগুপ্ত!

পুলিশের বড়সাহেব শিশির দত্তগুপ্ত এই রকম পোশাক পরার পর তাঁর চেহারাটাই যেন বদলে গেছে। মুখের হাসিটাও অন্যরকম। এক দিকের ঠোট বেঁকিয়ে হেসে তিনি বললেন, আমি সেনাপতি দেবেন্দ্র বর্মার বংশধর! রাজা অমরমাণিক্যের লুকনো ধনসম্পদের আমিই উত্তরাধিকারী!

কাকাবাবু হো-হো করে হেসে উঠলেন। যেন এমন মজা তিনি বহুদিন পাননি!

রাজকুমার কাকাবাবুর গালে ঠাস করে এক চড় কষিয়ে বলল, চুপ কর, বেয়াদপ! ওঁর সামনে তুই হাসছিস?

শিশির দত্তগুপ্ত বললেন, এই! ওঁর গায়ে হাত তুলো না! উনি ভদ্দরলোক। উনি নিজেই সব দেখিয়ে দেবেন! মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি বিদেশি! আমাদের ধনসম্পদের ওপর আপনার কোনও অধিকার নেই। আপনি জায়গাটা আমাদের দেখিয়ে দিন। তারপর আপনাকে আমরা নিরাপদে বাড়ি পোঁছে দেব।

কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? আপনার পরিচয় আমি জেনে ফেলেছি, তারপরও আপনি আমায় বাঁচিয়ে রাখবেন? আপনি এত বোকা? আপনি পুলিশের বড়কর্তা, তাই এইসব গুণ্ডা বদমাইশগুলোকে কাজে লাগিয়েছেন। সেইজন্যই এরা এত বেপরোয়া!

শিশির দত্তগুপ্ত বললেন, আমরা বনেদি বংশের লোক। কথা দিলে আমরা কথা রাখি। আমি ত্রিপুরেশ্বরীর নামে শপথ করেছি, আপনার কোনও ক্ষতি করা হবে না। আমাদের কাজ উদ্ধার হলেই আপনাকে আমরা সসম্মানে বাড়ি পৌঁছে দেব।

কাকাবাবু ঠাট্টার সুরে বললেন, আর যদি কাজ উদ্ধার না হয়?

শিশির দত্তগুপ্ত এবারে তাঁর তলোয়ারটা কাকাবাবুর বুকের কাছে তুলে কর্কশভাবে বললেন, তা হলে এক কোপে আপনার মুণ্ডুটা ধড় থেকে নামিয়ে দেব। তারপর আমার কপালে যা-ই থাক!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *