Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জঙ্গলগড়ের চাবি (১৯৮৭) || Sunil Gangopadhyay » Page 10

জঙ্গলগড়ের চাবি (১৯৮৭) || Sunil Gangopadhyay

সন্তু তো আর সাধারণ শহরের ছেলেদের মতন নয় যে, সাপ দেখেই ভয়ে আঁতকে উঠবে! সে কত দুর্গম পাহাড় আর কত গভীর জঙ্গলে গেছে, সাপ-টাপ দেখার অভিজ্ঞতা তার অনেক আছে।

সাপটার চোখের দিকে তাকিয়ে সন্তু একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ফুল দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে আর একটু হলেই সে সাপটাকে মাড়িয়ে দিত। তা হলেই হয়েছিল আর কী!

সেবার আন্দামানে যাবার পথে কাকাবাবু সন্তুকে সাপ সম্পর্কে অনেক কিছু জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাই সন্তু জানে, যে সাপ ফণা তুলতে পারে, সে সাপের বিষ থাকে। তা হলেও বিষাক্ত সাপ চট করে মানুষকে কামড়ায় না। মানুষ তো আর সাপের খাদ্য নয়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে সাপ নিজে থেকেই চলে যায়।

কিন্তু এই সাপটা তো যাচ্ছে না। সন্তুর দিকেই ফণাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটু একটু দুলছে। চিড়িক চিড়িক করে বেরিয়ে আসছে তার লম্বা জিভটা। এবার সন্তুর গায়ে ঘাম দেখা গেল।

সাপটার দিকে চোখ রেখে সন্তু খুব সাবধানে আস্তে আস্তে তার পাঞ্জাবির বোতামগুলো খুলতে লাগল। তারপর বিদ্যুৎগতিতে পাঞ্জাবিটা খুলে ফেলেই ছুঁড়ে মারল সাপটার গায়ে। সাপটা অমনি পাঞ্জাবিটার মধ্যে পাক খেতে-খেতে ছোবল মারতে লাগল বারবার।

সন্তু এই সুযোগে সরে গেল অনেকটা দূরে। এই কায়দাটাও কাকাবাবুর কাছ থেকে শেখা। ছোটখাটো লাঠি কিংবা পাথর ছুঁড়ে সাপ মারার চেষ্টা না করে গায়ের জামা ছুঁড়ে মারলে অনেক বেশি কাজ হয়। সাপটার যত রাগ পড়েছে ওই পাঞ্জাবিটার ওপরে, ওটার মধ্যে কুণ্ডলি পাকিয়ে ছোবল মেরে যাচ্ছে। বারবার।

সন্তুর ভাবভঙ্গি দেখে বারান্দায় বসে-থাকা পুলিশ দুজনের কী যেন সন্দেহ। হল। একজন উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, খোকাবাবু?

এই খোকাবাবু ডাকটা শুনলে সন্তুর গা জ্বলে যায়। আর কদিন বাদে সে কলেজে পড়তে যাবে! এখনও সে খোকাবাবু!

যেন কিছুই না, একটা আরোলা বা গুবরে পোকা, এইরকম তাচ্ছিল্য দেখিয়ে সন্তু বলল, কুছ নেহি, একঠো সাপ হায়!

ত্রিপুরায় সবাই বাংলায় কথা বলে, তবু সন্তু হিন্দিতে কেন জবাব দিল কে জানে! বোধহয় পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আপনিই হিন্দি এসে যায়!

সাপ! একজন পুলিশ খানিকটা অবিশ্বাসের সঙ্গে বাগানের মধ্যে নেমে এসে বলল, কোথায়?

সন্তু আঙুল দিয়ে পাঞ্জাবিটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, ওই যে!

এবারে পুলিশটি চমকে উঠে বলল, বাপ রে! সত্যিই তো সাপ! লাঠি, লাঠি কোথায়। এই শিবু, লাঠি আনো!

তখন অনেকে দৌড়ে এল।

সাপেরা এমনিতে কানে কিছুই শুনতে পায় না। কিন্তু লোকজন চলার সময় মাটিতে আর হাওয়ায় যে তরঙ্গ হয়, সেটা ঠিক শরীর দিয়ে টের পায়। এক সঙ্গে অনেক লোকের পায়ের ধুপধাপে সাপটা বুঝে গেল যে বিপদ আসছে। এবারে সে পাঞ্জাবিটা ছেড়ে সরসর করে ঢুকে পড়ল পাশের একটা ঝোপে।

পুলিশ দুজন আর রান্নার লোকটি সেই ঝোপটায় লাঠিপেটা করতে লাগল। সেই লাঠির চোটে আহত হল কয়েকটা ফুলগাছ, সাপের গায়ে লাগল না। সন্তু দেখতে পেয়েছে সাপটা একটা গর্তে ঢুকে পড়েছে। সাপেরা কিন্তু বেশ বোকা হয়। গর্তের মধ্যে প্রথমে ঢুকিয়ে দেয় মুখটা, লেজের দিকটা অনেকক্ষণ বাইরে থাকে। যে-কেউ তো লেজটা ধরে টেনে তুলতে পারে।

পুলিশরা ফুলের ঝোপে তখনও লাঠি পিটিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় হৈ-হৈ। করে ছুটে এল বাগানের মালি। সাপের ব্যাপারটায় সে কোনও গুরুত্বই দিল না, ফুলগাছ নষ্ট হচ্ছে বলে সে খুব রাগারাগি করতে লাগল। ওটা নাকি বাস্তুসাপ, কারুকে কামড়ায় না।

সন্তু অবশ্য বাস্তুসাপের ব্যাপারটা বিশ্বাস করল না। গায়ে পা পড়লেও সাপটা কামড়াত না? তা কখনও হয়! তাহলে তো জামার ওপর অত ছোবল মারল কেন? আর তার বাগানে আসার শখ নেই।

মালি সন্তুর পাঞ্জাবিটা মাটি থেকে তুলতে যেতেই সন্তু বলল, ছোঁবেন না, ওটা ছোঁবেন না, ওতে সাপের বিষ আছে!

মালি কিন্তু বিয়ের কথা শুনেও ঘাবড়াল না। বলল, আপনার জামা? ও কিছু হবে না, একটু ধুয়ে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

সন্তু অবশ্য আগেই ঠিক করে ফেলেছে যে, ও জামা সে আর গায়ে দেবে না। সাপের বিষ মাখা জামা কেউ গায় দেয়? সে ওটা আর ছুঁয়েই দেখবে না।

মালি জামাটা তার দিকে এগিয়ে দিতেই সন্তু বলল, ওটা আমার চাই না।

তারপরই সে দৌড়ে চলে গেল ওপরে। এতবড় একটা খবর কাকাবাবুকে জানালে চলে!

কিন্তু কাকাবাবুর সঙ্গে দুএকটা কথা বলেই তার উৎসাহ চুপসে গেল। কাকাবাবুর যেন এ ব্যাপারে কোনও আগ্রহই নেই।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, সাপ! এই অ্যাত্ত বড়!

ইচ্ছে করেই সন্তু সাপের সাইজটা একটু বাড়িয়ে দেখাল, কিন্তু কাকাবাবু শুকনো মুখে তাকিয়ে রইলেন। সন্তু আবার বলল, ঠিক আমার পায়ের কাছে, আর একটু হলেই কামড়ে দিত।

কাকাবাবু তবু কোনও কথা বললেন না। যেন শুনতেই পাচ্ছেন না। মনে হল, কোনও কারণে কাকাবাবুর খুব মন খারাপ।

সন্তুরও মন খারাপ হয়ে গেল। সাপটা যদি তাকে কামড়ে দিত তা হলে কী হত? সন্তু মরেও যেতে পারত। সাপে কামড়ালেই অবশ্য সব সময় মানুষ মরে না।

তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চিকিৎসা করালে সেরে যায়। কিন্তু হাসপাতাল-টাতাল সন্তুর খুব বিচ্ছিরি লাগে। সে মরে গেলে কিংবা হাসপাতালে শুয়ে থাকলে কাকাবাবুর দেখাশুনো করত কে? কাকাবাবুর মাথার একেবারেই ঠিক নেই!

সন্তু বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। তারপর দেখল রিকশা করে একজন মহিলা এসে নামল গেটের কাছে। একটু বাদেই একজন পুলিশ সেই মহিলাকে সঙ্গে করে নিয়ে এল ওপরে।

সেই মহিলা একজন নার্স। দেববর্মনবাবু এঁকে পাঠিয়েছেন। বেশ শক্ত-সমর্থ চেহারা মহিলার, কাজে বেশ পটু মনে হয়। সন্তু তাকে কাকাবাবুর। অসুবিধেগুলো বুঝিয়ে দিল। কাকাবাবুও বেশ শান্তভাবে মেনে নিলেন এই নার্সের ব্যবস্থা। সন্তু অনেকটা নিশ্চিন্ত হল।

দুপুরবেলা শুয়ে শুয়ে সস্থর মনে হল, এখানে পড়ে থাকার কোনও মানে হয়। কাকাবাবুকে নিয়ে এখন কলকাতায় ফিরে যাওয়াই ভাল। কাকাবাবু যদি নিজেই কোনও নির্দেশ না দেন, কখন কী করতে হবে বলে না দেন, তা হলে আর এখানে থাকার কোনও মানে হয় না। এবং কলকাতায় গিয়ে কাকাবাবুর চিকিৎসা করানো দরকার। বিকেলবেলা গভর্নমেন্টের লোকেরা এলেই সন্তু এই কথা বলবে।

বিকেলবেলা ওঁরা আসবার আগেই আর একজন এলেন, যাঁকে দেখে সন্তু খুব খুশি হয়ে উঠল। এর নাম নরেন্দ্র ভামা, দিল্লির খুব বড় অফিসার, কাকাবাবুর অনেক দিনের বন্ধু। নরেন্দ্র ভার্মা এসে গেছেন, আর সন্তুর কোনও চিন্তা নেই।

ভার্মাকে জিপ থেকে নামতে দেখেই সন্তু ওঁকে অভ্যর্থনা করবার জন্য নীচে নেমে গেল। ভামা কলকাতায় পড়াশুনো করেছেন বলে বাংলাও মোটামুটি বলতে পারেন।

সন্তুকে দেখে ভামা বললেন, আরে আরে সনটুবাবু, কেমুন আছ? সব ভাল তো?

ভার্মা সন্তুকে জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নিলেন। ভার্মা খুবই লম্বা মানুষ, নস্যি রঙের সাফারি সুট পরে আছেন, তাঁর চোখ দুটো খুব তীক্ষ্ণ।

সন্তু অভিমান ভরা গলায় বলল, না নরেনকাকা, এবারে কিছুই ভাল না; সব গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে।

ভার্মা বললেন, হ্যাঁ, আমি কিছু কিছু শুনেছি। আমি দুপুরে এসে পৌঁছেই সার্কিট হাউসে গেলাম তোমাদের ছুঁড়তে। তোমাদের না পেয়ে ফোন করলাম দেববর্মনকে। তার কাছে শুনলাম কী এর মধ্যেই রায়চৌধুরীকে স্ন্যাচ করার অ্যাটেম্পট হয়ে গেছে। বড় তাজ্জব কথা। আগরতলায় আমিই তোমাদের পাঠাতে বলেছি, এখানকার কোনও লোকের তো জানবার কথা নয়।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, এত জায়গা থাকতে আমাদের এই আগরতলাতেই পাঠালেন কেন?

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভার্মা বললেন, ত্রিপুরার কথা তোমার কাকাবাবু খুব বলাবলি করছিলেন তখন। মানে ত্রিপুরাতে উনি কী যেন একটা ধান্দা করেছিলেন। তাই আমরা ভাবলাম কী, উনি ত্রিপুরাতে হাজির হয়ে শরীরটা সারিয়ে নিন্ আর এখানে কিছু খোঁজখবরও নিন। একটা গুড নিউজ দিই সনটুবাবু তোমাকে, যে বদমাসটা তোমার কাকাবাবুকে গুলি করেছিল, সে ধরা। পড়ে গেছে।

ধরা পড়েছে? সে কী বলল? কেন গুলি করেছিল?

লোকটা গুংগা…মানে কী যেন বলে, হ্যাঁ, বোবা?

বোবা? যাঃ!

তাতে কোনও অসুবিধা নেই। ওকে কে পাঠিয়েছিল সে কানেকশান আমরা ঠিক বার করে নিব।

নরেনকাকা, এখানে কাকাবাবুর কোনও চিকিৎসা হচ্ছে না। এখন আমাদের কলকাতায় ফিরে গেলে ভাল হয় না?

কলকাতার জন্য মন ছটফট করছে? কেন, ঘুড়ি উড়াবার সিজন বুঝি? আচ্ছা রায়চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করে দেখি!

কাকাবাবু পিঠের নীচে দুটো বালিশ দিয়ে আধ-বসা হয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন।

ঘরের মধ্যে পা দিয়ে নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এই যে রাজা, কেমুন আছ? তবিয়ৎ তো বেশ ভালই দেখছি।

কাকাবাবু মুখ ফিরিয়ে ব্যঙ্গের সুরে বললেন, এ আবার কে? এই লম্বা ধ্যাঙ্গো লোকটা কোথা থেকে এল?

ভামা যেন বুকে একটা ঘুষি খেয়ে থমকে গেলেন। তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল বিস্ময়। তিনি আস্তে-আস্তে বললেন, রাজা, আমি নরেন্দ্র, আমায় চিনতে পারছ না?

কাকাবাবু বললেন, নরঃ নরৌঃ নরাঃ আর ফলম্ ফলে ফলানি! আর একটা আছে, সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি, গানের আমি কী জানি! আসলে কিন্তু আমি সব জানি! আমায় কেউ ঠকাতে পারবে না।

নরেন্দ্র ভার্মা হতভম্ব মুখে বললেন, এটা কী ব্যাপার! তুমি কী বলছ, রাজা।

সন্তু স্নান গলায় বলল, কাকাবাবু কোনও কথা বুঝতে পারছে না। ওই গুলি খাওয়ার জন্য বোধহয় মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে।

সর্বনাশ!

কাকাবাবু আবার ঠাট্টা করে বললেন, কী সর্বনাশ? কেন সর্বনাশ? কার সর্বনাশ? তুমি সর্বনাশের কী বোঝো হে ছোকরা।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এ যে খুব খারাপ কেস।

কাকাবাবু কটমট করে তাকিয়ে রইলেন ওঁর দিকে।

নরেন্দ্র ভার্মা জাদুকরের ভঙ্গিতে একটা হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমি হিপনোটিজম্ জানি। দেখি তাতে কোনও কাজ হয় কি না! রাজা, আমার চোখের দিকে তাকাও! এবার মনে করার চেষ্টা করো, তুমি কে? মনে করো দিল্লির কথা–তুমি দিল্লিতে গত মাসে আমায় কী বলেছিলে–ডিফেন্স কলোনিতে আমার বাড়িতে.সেদিন খুব বৃষ্টি পড়ছিল..

উনি এক পা এক পা করে এগিয়ে কাকাবাবুর চোখের সামনে হাতটা নাড়তে লাগলেন।

কাকাবাবু একবারও চোখের পলক না ফেলে একই রকম গলায় বললেন, বাঃ বেশ নাচতে জানো দেখছি। এবার ধেইধেই করে নাচো তো ছোকরা!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আশ্চর্য, কোনও কাজ হচ্ছে না কেন? আচ্ছা, এক কাজ করা যাক, ঘর অন্ধকার করতে হবে। সনটু জানলা-দরোয়াজা বন্ধ করে দাও, আর তোমরাও বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করো।

নার্সকে সঙ্গে নিয়ে সন্তু চলে গেল বাইরে। নরেন্দ্র ভার্মা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *