Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গোঁসাইবাগানের ভূত || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 8

গোঁসাইবাগানের ভূত || Shirshendu Mukhopadhyay

দোল পূর্ণিমার জ্যোৎস্না রাতে

করালীবাবু দোল পূর্ণিমার জ্যোৎস্না রাতে তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তায় পায়চারি করছিলেন। ভারি শক্ত একটা রুটওভার সকাল থেকে কয়বার চেষ্টা করছেন। পারেননি। পারবেন কী করে? সারাদিন গায়ের ছেলেবুড়ো হুল্লোড় করে রং খেলেছে। অত হুল্লোড়ে কি অঙ্ক হয়? অঙ্ক হয়নি বলে করালীবাবুর মাথাটা তেতে আগুন হয়ে গেল। প্রায়ই এরকম হয়। আর মাথা গরম হলে বরাবর, কী শীত কী গ্রীষ্ম, কী দিন কী রাত, করালীবাবু গিয়ে পুকুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গলা অবধি ডুবিয়ে বসে থাকেন। আর এই অভ্যাসের ফলে করালীবাবু নিজের অজান্তেই খুব বড় সাঁতারু হয়ে গেছেন। ইচ্ছে করলে তিনি পাঁচ, সাত, এমন কি দশ মিনিট পর্যন্ত জলের নীচে ডুব দিয়ে থাকতে পারেন। বলতে কী, সাঁতারের কম্পিটিশনে নামলে করালীবাবুকে হারানোর মতো লোক নেই।

সে যাই হোক, করালীবাবুর রুটওভারের অঙ্কটা হয়নি আজ। সন্ধে অবধি পুকুরে ডুবে থেকে তাঁর মাথাটা এখন ঠাণ্ডা হয়েছে। রাস্তায় পায়চারি করতে করতে তিনি গোল চাঁদটার দিকে তাকিয়ে ‘জিরো’ সংখ্যাটার কথা ভাবছিলেন। আর এই ভেবে অবাক হচ্ছিলেন যে, জিরোর মতো এত রহস্যময় ব্যাপার আর কিছুই নেই। ভেবে দেখলে জিরো বা শূন্যই হচ্ছে সব সংখ্যার উৎস। পৃথিবীর যাবতীয় সংখ্যা-তত্ত্বের মূলে রয়েছে ওই শূন্য।

চারদিকে বান-ডাকা জ্যোৎস্নায় গাছপালা, আকাশ, মাটি এই যে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে, এর পিছনেও আছে একটা প্রোপোরশন বা অনুপাত। আকাশ কতটা পরিষ্কার থাকলে, কতখানি জ্যোৎস্না উঠলে কতগুলো গাছপালা এবং কতখানি মাঠ-ময়দান থাকলে কতটা সৌন্দর্যের সৃষ্টি হবে, তার পিছনেও কি অঙ্ক নেই?

আসলে আকাশে, বাতাসে, জ্যোৎস্নায় বা অন্ধকারে সর্বত্রই অঙ্কের প্রভাব। ভেবে ভারি মুগ্ধ হয়ে গেলেন করালীবাবু।

আর ঠিক এই সময়েই বাতাস ছিঁড়ে, জ্যোৎস্না কাঁপিয়ে ভয়ংকর এক বাঘের ডাক উঠল ‘ঘ্রা-ড়া-ড়া-ড়া-ম! একবার। দুবার। তিনবার। বাঘ! বাঘ! বলে চেঁচাতে চেঁচাতে চারদিকে লোজন দৌড়ে ঘরবাড়িতে ঢুকে পড়ছে। করালীবাবু একটু চমকালেন বটে, কিন্তু ঘাবড়ালেন না। শুধু আপনমনে বললেন, “সাউন্ড! সাউন্ড মিনস ভাইব্রেশন। অ্যান্ড ভাইব্রেশন মিস এনার্জি।”

অনেক ভেবে কালীবাবু দেখলেন এই সুন্দর প্রোপোরশনেট জ্যোৎস্না রাতের মধ্যে বাঘের ডাকের মতো একটা নতুন এনার্জি বা ভাইব্রেশন ঢুকে পড়ায় প্রোপোরশনটা নষ্ট হয়ে গেল। অর্থাৎ পূর্ণিমার সৌন্দর্যটা আর রইল না। মানুষ ভয় পেয়ে গেল। আচ্ছা, ভয়টাও কোনো এনার্জি? নাকি অ্যাবসেস অব এনার্জি?

বাড়ির লোকজন এসে করালীবাবুকে বাড়িতে ধরে নিয়ে গেল।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পুব আকাশের দিকে চেয়ে টকটকে লাল সূর্যটা দেখে করালীবাবু আবার শূন্য সংখ্যাটা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। শূন্যকে গুণ করা যায় না, ভাগ করা যায় না, শূন্য থেকে কিছু বিয়োগ করা যায় না–সব সময়েই নিটোল শূন্য থাকে।

এইসব ভাবতে ভাবতে করালীবাবু স্নান করলেন, খেলেন, ইস্কুলে গেলেন।

ইস্কুলে আজ বিশাল হট্টগোল। ছেলেরা কেউ ক্লাসে যাচ্ছে না। ইস্কুল বসবার ঘণ্টা পড়ছে না। চারদিকে লোকজন খুব গম্ভীর মুখে কথাবার্তা বলছে। শোনা গেল, কাল থেকে ইস্কুলের দুটি ছেলে বুরুন আর ভুতুম নিরুদ্দেশ। কোথাও তাদের হদিশ মিলছে না। আবার গতকালই গঞ্জে বহুবার বাঘের ডাক শোনা গেছে। সকলে তাই দুইয়ে-দুইয়ে চার করে নিয়েছে। বেশির ভাগ লোকেরই ধারণা, বুরুন আর ভুতুম এখন বাঘের পেটে। সুতরাং একদল ছাত্রের দাবি, বুরুন আর ভুতুমের নামে শোক-প্রস্তাব নিয়ে ইস্কুল ছুটি দেওয়া হোক। কেউ কেউ বলছে, ছেলেদুটোকে কোন দুষ্টু লোক চুরি করে নিয়ে গেছে। কেউ বলছে, তারা সমুদ্রদিঘিতে ডুবে গেছে।

সে যাই হোক, বুরুন নিরুদ্দেশ হওয়াতে করালীবাবু খুবই হতাশ হলেন। বুরুনের মতো ছাত্র তিনি জীবনে দেখেননি। যদিও গত বার্ষিক পরীক্ষায় বুরুন অঙ্কে তেরো পেয়েছিল, তবু ইদানীং অঙ্কে তার প্রতিভা দেখে করালীবাবুর দৃঢ় ধারণা হয়েছে যে, এ-ছেলে আইনস্টাইনের মতো বড় হবে। এরকম ছাত্র খোয়া গেলে কার না দুঃখ হয়? বুরুন তাকে একবার বলেছিল, “স্যার, অঙ্কের নিয়মে এক-এ এক-এ যোগ করে আমরা দুই করি, কিন্তু সেটা কি ঠিক? পৃথিবীতে কোনও একটা জিনিসই ঠিক আর একটার মতো নয়। একটা গাছের লক্ষ পাতার মধ্যে মিলিয়ে দেখলেও দেখা যাবে, একটা পাতা হুবহু আর একটার মতো হয় না, আকার গঠন রং ওজন ইত্যাদিতে কিছু না কিছু তফাত থাকবেই। এমন কি, এক কণা বালির সঙ্গেও আর-এক কণা বালির তফাত আছে। কাজেই একের সঙ্গে এক যোগ করে দুই হয় না, কারণ দুটো এক তো আলাদা।” করালীবাবু খুবই অবাক হয়ে বলেছিলেন, “তাহলে কী হবে?” বুরুন জবাব দিয়েছিল, “এক-এর সঙ্গে এক যোগ করলে পাই দুটো এক। তেমনি তিনটে এক বা চারটে এক।”

এইটুকু বয়সে বুরুনের মাথায় এক-এর তত্ত্ব খেলতে দেখে করালীবাবু আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন। করালীবাবুও জানেন, বস্তুতত্ত্বের নিয়ম অনুসারে পৃথিবীতে কখনও দুটো জিনিস ঠিক একরকম হতেই পারে না। তাহলে এক-এর সঙ্গে এক যোগ করে দুই হয় কি করে? এই নিয়ে করালীবাবু প্রায়ই ভাবেন।

হেডস্যার শচীন সরকার মাস্টারমশাইদের ডেকে বললেন, “যতদূর মনে হচ্ছে হতভাগ্য ছেলেদুটিকে বাঘেই নিয়েছে। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কনডোলেন্স মিটিং করতে পারি না। তবে বাঘের উপদ্রবে ছেলেদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে বলে ইস্কুল ছুটি দিয়ে দিচ্ছি। আপনারাও সতর্ক থাকবেন।”

হেডমাস্টারমশাইয়ের কথা শুনতে শুনতে এত দুঃখেও করালীবাবুর মাথায় অঙ্ক খেলছিল। তিনি ভাবছিলেন, দুটো ছেলেকে যদি একটা বাঘে খায়, তবে একের সঙ্গে দুই যোগ হয়ে অঙ্কের নিয়মে হয় তিন। কিন্তু আদতে দুটো ছেলে প্লাস একটা বাঘ ইজ ইকুয়াল টু হয় একটা বাঘ। বুরুন, ভুতুম আর বাঘ মিলে তিনটে প্রাণী হয়নি। অঙ্কের নিয়ম এখানে ব্যর্থ। আরও দুঃখের কথা, বুরুনের মতো অঙ্কের ভাল ছাত্রকে খেয়ে ফেলেও বাঘটার অঙ্কের মাথা খোলার কোনও সম্ভাবনাই নেই। বাঘটা টেরই পাবে না–সে অঙ্কের জগতের কত বড় একটা প্রতিভাকে ধ্বংস করেছে।

আবেগে করালীবাবুর চোখে জল এল। রাগে তাঁর গা ফুলতে লাগল। আপনমনে তিনি বললেন, “বাঘটাকে নিকেশ করতেই হবে।”

গেম টিচার পাশেই বসে ছিলেন। করালীবাবুর কথাটা তাঁর কানে যেতেই তিনিও চোখ মুছে ধরা গলায় বললেন, “বুরুনের ওপর আমার অনেক আশা ছিল। অলিম্পিক থেকে তার অন্তত

দশ বারোটা সোনার মেডেল আনার কথা। বদমাশ বাঘটাকে নিকেশ করার কথা আমিও অনেক ভেবেছি। কিন্তু শুনছি সেটা নাকি কোন তান্ত্রিকের বাঘ, সে তান্ত্রিক আবার মন্ত্র-তন্ত্র বশীকরণ জানে।”

করালীবাবু অঙ্ক আর বিজ্ঞান ছাড়া কিছুই মানেন না। তাই হা-হা করে হেসে বললেন, “কিছু ভাববেন না। আমাকে একটা মজবুত দেখে লাঠিসোটা যা হোক কিছু দিন তো! তারপর দেখবেন এনার্জি মোমেন্টাম আর ভেলোসিটির কাছে সব মন্ত্রতন্ত্র ধুলো হয়ে যাবে।”

গেম স্যার খুশি হয়ে বললেন, “সে আর বেশি কথা কী? জ্যাভেলিনটাই নিয়ে যান। বল্লমকে বল্লম, লাঠিকে লাঠি।”

তাই হল। ছেলেরা যখন যে যার বাড়ি গেল, রাস্তাঘাট যখন এন্টু নির্জন হল, তখন জ্যাভেলিনটা কাঁধে ফেলে করালীবাবু হন হন করে গোঁসাইবাগানের দিকে রওনা হলেন।

রাম কবিরাজ দাওয়ায় বসে তামাক খেতে খেতে আকাশ-পাতাল ভাবছিলেন। বাড়ির লোকেরা সব প্রবল কান্নাকাটি করছে। তিনিও কোনও উপায় বের করতে পারছেন

। বুরুন গোঁসাইবাগানের পাতালঘরে আছে। সেখানে পৌঁছানো শক্ত হলেও অসম্ভব নয়। খোনাসুর শর্টকাট রাস্তা বলে দিয়ে গেছে। যে-কোনও ভাল সাঁতারুর পক্ষেই সেখানে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু মুশকিল হল, বুরুনের ভিতরে মনের জোর সৃষ্টি করা। বুরুনের ইচ্ছাশক্তি না জাগলে সে মন্ত্র কাটিয়ে বেরোতে পারবে না।

ভেবে ভেবে রোগা হয়ে গেছেন কবিরাজমশাই। চোখের কোলে কালি।

হঠাৎ রাস্তা দিয়ে করালীবাবুকে একটা বল্লম কাঁধে হেঁটে যেতে দেখে রামবাবুর মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। তিন লাফ দিয়ে দাওয়া থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে গিয়ে করালীবাবুর কাছা টেনে ধরে বললেন, “করালীবাবু! চললেন কোথায়?”

করালীবাবু বুরুনের দাদুকে দেখে ব্যথিত মুখ করে বললেন, “বুরুনের জন্য আমরা সবাই দুঃখিত রামবাবু। আমি বাঘটাকে শিক্ষা দিতে যাচ্ছি।”

রামবাবু খুশি হয়ে তাঁর বিচক্ষণ চোখ দিয়ে কালীবাবুর চেহারাটা ভাল করে দেখে নিয়ে বললেন, “আপনার বীরত্বে ভারি আনন্দ পেলাম। যাওয়ার আগে দয়া করে আমার একটা পাঁচন খেয়ে যান, তাতে গায়ে বল হবে। আর সেই সঙ্গে দুটো-একটা গোপন শলা-পরামর্শও দিয়ে দেব। সব সময়ে বীরত্বে কাজ হয় না, কৌশলও চাই।”

এই বলে করালীবাবুকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন রামবাবু।

অনেকক্ষণ তাঁদের শলা-পরামর্শ চলল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress