Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কুড়িয়ে পাওয়া পেনড্রাইভ || Suchitra Bhattacharya » Page 5

কুড়িয়ে পাওয়া পেনড্রাইভ || Suchitra Bhattacharya

০৯-১০. জেলাপুলিশের সদর দপ্তর

আজ আর দেরি করতে দেয়নি মিতিন। ঝটপট লটবহর গাড়িতে তুলে সকাল দশটার মধ্যে সোজা কুলু। প্রথমে জেলাপুলিশের সদর দপ্তর। সেখানে তখনও আসেননি আশুতোষ। অগত্যা যেতে হল তার বাংলোয়।

কাছেই পাঁচিলঘেরা কম্পাউন্ডের মধ্যিখানে এস পি সাহেবের বাসস্থান। তেমন একটা দেখনবাহার নয়, তবে আয়তনে বেশ বড়সড়। বাড়ি ঘিরে সবুজ ভেলভেটের মতো ঘাসের লন। গেটে প্রহরী দাঁড়িয়ে।

গাড়ি থেকে নেমে মিতিন বলল, অবনীদা, একটু ওয়েট করতে হবে কিন্তু।

অবনী খুশি মনে বললেন, আমার কোনও অসুবিধে নেই। বরং তোমার দিদিকে জিজ্ঞেস করো। তিনি অল্পেই অধৈর্য হয়ে পড়েন কিনা।

অমনি সহেলির প্রশ্ন, তোদের কতক্ষণ লাগবে?

আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা।

অত?

এক কাজ করুন না, পার্থ বলল, আপনি, অবনীদা আর বুমবুম ততক্ষণ রাজবাড়িটা দেখে আসুন। তিনশো বছরের পুরনো প্রাসাদ।

চড়াই ভাঙতে হবে না তো?

না-না। গেট পর্যন্ত গাড়ি চলে যাবে।

বুমবুম গোঁজ মুখে বলল, তার আগে আমার চিপস চাই।

পাবে পাবে।

অবনীদের নিয়ে টিঙ্কু রওনা দেওয়ার পর রাইফেলধারী মারফত খবর পাঠাল মিতিন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডেকেছেন আশুতোষ। নিজস্ব অফিসঘরটিতে বসালেন মিতিন-পার্থ-টুপুরকে। মুচকি হেসে বললেন, আপনারা তা হলে মানালিভ্রমণ ক্যানসেলই করলেন?

না তো। তবে আজ বোধহয় যাচ্ছি না, মিতিন স্মিত মুখে বলল, আসলে চুরিটা আমায় এমন হন্ট করছে। যে সে জিনিস তো নয়, ওই সব ছবি আমাদের জাতীয় সম্পদ।

বুঝেছি। কেসটা আপনাকে গেঁথে ফেলেছে।

প্রায়। শেষ না দেখে নড়তে মন চাইছে না।

তা হলে তো আপনাকে আরও দু-চারটে সমাচার দিতেই হয়। তার আগে বলুন চা না কফি?

ঠান্ডাটা আজ বেড়েছে। কফিই ভাল।

বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডেকে নির্দেশ দিলেন আশুতোষ। গদি আঁটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, একটা-একটা করে শোনাই? প্রথমত, আপনার অনুমান সঠিক। প্রসাদ লোকটি মোটেই নির্দোষ নয়। চোর দুটো ওকে সত্যিই হাত করেছিল। অ্যাকর্ডিং টু প্রসাদ, ওরা নাকি রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ আচমকা এসে ওকে রিভলভার দেখায়। ওর রাইফেলও নাকি কেড়ে নিয়েছিল। উপায়ান্তর না দেখে লোক দুটোর প্রস্তাবে প্রসাদ রাজি হয়ে যায়। কোথায় বেঁধে ফেলে রাখলে সহজে কারও চোখে পড়বে না, তা নাকি প্রসাদই দেখিয়ে দিয়েছিল তখন। তবে পেয়েছে নাকি মোটে পাঁচশো টাকা।

ওরা যে ছবি চুরি করতে এসেছে, প্রসাদ কি জানতেন?

সেটা এখনও স্বীকার করছে না। বলছে, যা কিছু ঘটেছে, সবই নাকি তার অজ্ঞাতসারে। তাকে ঝোপে রেখে আসার পরে। তখন নাকি এতই ঘাবড়ে ছিল, কোনও কথা জিজ্ঞেস করার সাহস পায়নি!

প্রসাদকে ছেড়ে দিয়েছেন?

প্রশ্নই আসে না। আজ ওকে কোর্টে তোলা হবে। আরও সাত দিন পুলিশ কাস্টডি চাইছি।

হুম। আর আপনার দ্বিতীয় সংবাদ?

চোর দুটো বৈজনাথ সম্পর্কে রীতিমতো খোঁজখবর নিয়ে তাকে দিয়ে ছবি আঁকাতে এসেছিল।

জানি তো। ওরা ইন্টারনেটে বৈজনাথজির নাম-ঠিকানা পেয়েছে। ইন ফ্যাক্ট, বিভব শর্মার কটেজে ওঠার আগেই নাকি ওরা বৈজনাথজির সঙ্গে যোগাযোগ করে।

এক সেকেন্ড, আশুতোষের ভুরুতে পলকা ভাঁজ, আপনাকে এ কথা কে বলল?

বৈজনাথজি স্বয়ং। মেলায় যখন দেখা হয়েছিল।

রং। ওরা কটেজে ওঠার পর বৈজনাথের কাছে যায়।

তাই কি?

ইয়েস। ভাড়া নেওয়া মারুতি ভ্যানটির ড্রাইভার খুব জোরের সঙ্গে কথাটা জানিয়েছে।

বৈজনাথজি তা হলে মিথ্যে বললেন? টুপুরের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ইস, আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।

হয়তো বৈজনাথকে চোর দুটো ওরকমই বলেছিল। মানে ওই সব ইন্টারনেটের গল্প।

কফি এসে গিয়েছে। সঙ্গে বড় প্লেটে কাজু। হাতের ইশারায় মিতিনদের নিতে বলে একটা কাপ টানলেন আশুতোষ। ছোট চুমুক দিয়ে বললেন, আরও একটা খবর। বিভব শর্মার কটেজে ওদের আগাম বুকিং ছিল। টানা বারো দিনের। অর্থাৎ চুরির দিনটাও আগেই ফিক্স করা ছিল।

টুপুর চমকিত। মিতিনের অবশ্য কোনও হেলদোল নেই। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, পেমেন্টটাও নিশ্চয়ই অ্যাডভান্স করা ছিল?

হ্যাঁ। রুম-রেন্টটা। ক্রেডিট কার্ডে। ভায়া ইন্টারনেট।

ক্রেডিট কার্ডের নম্বরটা নিয়েছেন?

স্লিপ আছে বিভব শর্মার কাছে। রেখে দিতে বলেছি, আশুতোষ গলা ঝাড়লেন, বিভব শর্মার বদ মতলব থাকলেও তো ওই নম্বর লুকোতে পারবে না। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সব বলে দেবে।

ঠিক। একদম ঠিক, মিতিনের ঠোঁটে হাসি, আপনি তো খুব ভাল এগোচ্ছেন।

কিন্তু আসল কাজটাই তো বাকি। এত রাস্তা আটকালাম, গাড়িঘোড়া সার্চ করলাম, টিভিতে নিউজ হল, পাজি দুটোর এখনও নো ট্রেস। এই মেলার ভিড়ে গলে বেরিয়ে গেল কিনা সেটাই এখন আমার দুশ্চিন্তা।

টেনশন করবেন না মিস্টার শাহ। তারা এখনও কুলু ডিস্ট্রিক্ট ছাড়েনি।

কী করে বলছেন?

নিজের গোয়েন্দাবুদ্ধি দিয়ে, মিতিন নড়ে বসল, বাই দা বাই, বৈজনাথজির স্কেচ দু’খানা একটু দেখতে পারি?

অবশ্যই। আজই তো ফোটোকপি করে গোটা ভ্যালিতে ছড়িয়ে দেব। সমস্ত প্রমিনেন্ট প্লেসে টাঙানো থাকবে। বাসস্ট্যান্ড, এয়ারপোর্ট, সর্বত্র।

বলতে বলতে ড্রয়ার থেকে একটা বড় খাম বের করেছেন আশুতোষ। মুখটা খুলতেই দু’খানা ফুলস্ক্যাপ কাগজে দুই মূর্তির অবয়ব। স্কেচ পেনসিলে আঁকা। মিতিন মন দিয়ে নিরীক্ষণ করছিল ছবি দুটো। ঝুঁকে পড়ে পার্থ আর টুপুরও। ছবি অনুযায়ী নবীন ডিগডিগে রোগা। চৌকো মুখ, চোখ খুদে খুদে, নাকের নীচে সরু গোঁফ। আর সুখদেব গোলগাল, কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, দাড়ি-গোঁফ কামানো। কারও চেহারায় তেমন বিশেষত্ব নেই, যা দিয়ে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা যায়।

আশুতোষ যেন হালকা শ্লেষের সুরে বললেন, মুখস্থ করে নিচ্ছেন নাকি? যাতে পথেঘাটে দেখলেই চিনতে পারেন?

এই ছবি দেখে তা সম্ভব নয়, মিতিন দু’দিকে মাথা নাড়ল, দু’জনের মুখেই অনেক গোঁফ-দাড়ি লাগাতে হবে। সঙ্গে মাথায় পাগড়ি।

কেন?

কারণ, ওরা সর্দারজির ছদ্মবেশে আছে যে।

একটুক্ষণ বুঝি বাক্যস্ফূর্তি হল না আশুতোষের। তারপর কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বললেন, আ-আ-আপনি জানলেন কী করে?

সংক্ষেপে নজ্ঞর আর কাতরেইনে সংগৃহীত প্রতিটি তথ্যই আশুতোষকে বলল মিতিন। লোক দুটো যে মানালি যাবে বলেছে, সেটাও জানাতে ভুলল না এবং ওই কারণেই যে মিতিন ফের কুলুতে ফিরেছে, তাও শুনিয়ে রাখল।

আশুতোষ মুগ্ধ স্বরে বললেন, আপনি তো ডেঞ্জারাস মহিলা! একাই পুলিশের কাজ করে দিচ্ছেন?

না না, তাই কি পারি? মিতিন যেন বিনয়ের অবতার, আমি শুধু সাধ্যমতো আপনাদের সাহায্য করতে চাই।

থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। আমি এক্ষুনি চতুর্দিক চষে ফেলছি। প্রতিটি সর্দারজিকে…

ভুলেও ও কাজটি করবেন না মিস্টার শাহ। তাতে হিতে বিপরীত হবে। কালপ্রিটরা আরও সতর্ক হয়ে যাবে, মিতিন ঠান্ডা স্বরে বলল, যদি আমার পরামর্শ নেন, টেলিভিশনের ঘোষণাও বন্ধ করে দিন। পারলে খবর চাউর করুন, সম্ভাব্য দুই অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এদিকে তলে তলে অনুসন্ধান চালিয়ে যান।

আইডিয়াটা মন্দ নয়। অপরাধীরা নিশ্চিন্ত বোধ করলে তাদের ধরতে সুবিধে হয়।

এখন তা হলে আসি?

কুলুতে থাকছেন তো? নাকি চলে যাচ্ছেন?

দেখি!

মিতিন ইশারায় পার্থ-টুপুরকে উঠতে বলল। নিজেও দাঁড়িয়েছে। ঘর থেকে বেরোতে গিয়েও কী ভেবে থমকাল যেন। তারপর হনহন হাঁটা দিয়েছে।

কম্পাউন্ডের বাইরে এসে টুপুর দেখল, গাড়ি এখনও ফেরেনি। পার্থ তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক। ঘড়ি দেখে বলল, আমরা কি মেলার দিকে যাব?

চলো। দিদিকে ফোন করে দিচ্ছি, গাড়ি ওখানেই আসুক।

মিতিন মোবাইল বের করেছে। কথা সারছে সহেলির সঙ্গে। টুপুর পাশে পাশে হাঁটছিল। মাসির কাজের ধারাটা বোঝার চেষ্টা করছিল মনে মনে। লোক দুটোর গতিবিধি সম্পর্কে খানিকটা হয়তো আন্দাজ করেছে মিতিনমাসি, কিন্তু শুধু তা দিয়েই কি ওদের পাকড়াও করা সম্ভব? এত বড় একটা উপত্যকা, এখন মেলার সময় বাইরে থেকে আরও কত যে মানুষ এসেছে তার হিসেব নেই। তার মধ্যে থেকে দুই ভেকধারীকে খোঁজা তো খড়ের গাদায় ছুঁচের সন্ধান করার চেয়েও দুরূহ। তা ছাড়া পাহাড়-পর্বতের কোন ফাঁকফোকর দিয়ে তারা পিঠটান দিয়েছে, কে বলতে পারে! এ তো বুনো হাঁসের পিছনে তাড়া করে বেড়ানো! আড়চোখে পার্থমেসোকে একবার দেখল টুপুর। মেসোর কপালেও যেন চিন্তার রেখা।

নিচু গলায় টুপুর জিজ্ঞেস করল, ও মেসো, তুমি কী ভাবছ গো?

পার্থ ঠোঁট ছুঁচলো করে বলল, একবার বিভব শর্মার কাছে গেলে হয়।

গিয়ে?

একবার ক্রস করে দেখা যেত। ভদ্রলোক যদি কোনওভাবে ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তা হলে স্টেটমেন্টে একটা না-একটা অসংগতি ধরা পড়বেই। তখনই চাপ দিয়ে…।

বাক্য অর্ধসমাপ্ত থেকে গেল। কী কাণ্ড, মিতিনমাসি যে বিভব শর্মাকেই ফোন লাগিয়েছে! এবং পার্থ-টুপুরকে সংলাপ শোনাতে যথারীতি স্পিকার চালু!

মিতিন স্বর উঠিয়ে বলল, হ্যালো মিস্টার শর্মা? আর কোনও ঝঞ্ঝাটে পড়েননি তো?

বিভব শর্মা যথারীতি হাউমাউ জুড়েছেন, আমার তো এখন বিপদই বিপদ। স্বয়ং এস পি সাহেব যার উপর বুরা নজর ফেলেছেন, তার দিন কীভাবে ভাল কাটবে ম্যাডাম?

কেন, আজ তো দিনটা অন্যরকম। কটেজে ফরেন টুরিস্ট আসছেন।

আরে, সে পাবলিকও তো এখন আমায় ল্যাজে খেলাচ্ছে।

সে কী? আজও আসছেন না বুঝি?

না, আসবে। তবে এবেলা নয়, রাত্তিরে।

স্ট্রেঞ্জ! এতক্ষণ কী করবেন সাহেব? ভুন্টারে প্লেন সব ল্যান্ড করে তো সকালবেলায়।

জানি তো। ভোরে আজ রবার্তো সাহেবকে রিংও করেছিলাম, দেখি লাইন বন্ধ। তারপর তো সাহেবেরই ফোন এল। খানিক আগে। কুলুতে ঢুকতে নাকি সাহেবের রাত নটা-দশটা বাজবে, আমি যেন কামরা রেডি রাখি।

তা হলে বোধহয় বাই রোড আসছেন।

হতে পারে। সাহেবের খেয়াল। যাক গে, আমিও স্থির করেছি, ও নিয়ে আর মাথা ঘামাব না। দু’দিনের ঘরভাড়া তো নেওয়াই আছে, নয় আজ আর কাল একখানা রুম ফাঁকা রাখব।

সাহেব বুঝি টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন?

ক্রেডিট কার্ডে। থ্রু ইন্টারনেট।

হুম। আর কী খবর? বৈজনাথজির সঙ্গে সাক্ষাৎ হল!

খেপেছেন? আর ওর সংস্রবে থাকি? পুলিশের কোন চক্করে ফেঁসে যাব, ঠিক আছে?

সেই তারকুণ্ডেরাও আর নিশ্চয়ই ফোন টোন করেনি?

না ম্যাডাম। যদি ভুল করেও যোগাযোগ করে, আমি এস পি সাহেবকে সঙ্গে সঙ্গে জানাব। যদি বলেন তো আপনাকেও।

পুলিশকে জানালেই হবে। এখন ছাড়ি।

মিতিন লাইন কাটতেই পার্থ হাঁ হাঁ করে উঠেছে, এ হে হে, একটা ইম্পর্ট্যান্ট পয়েন্ট তো জিজ্ঞেস করলে না?

কী?

শর্মার কটেজে ঢোকার আগে তারকুণ্ডে আর ভাটিয়া নিজেদের আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়েছিল, কি না।

জেনে কী লাভ? দেখাক আর নাই দেখাক, কটেজে একটা অ্যাড্রেস দিয়েছে নিশ্চয়ই! এবং তারা এত নির্বোধ নয় যে, সেই ঠিকানায় খোঁজ করলেই এক্ষুনি তাদের সন্ধান মিলবে!

টুপুর সহমত হল, বটেই তো। আসল ঠিকানা তারা দেয় নাকি?

পার্থ বলল, তা কেন? দিতেই বা অসুবিধে কোথায়? তারা তো জানত না প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায় বলে এক ডিটেকটিভ ঠিক পরে পরেই কটেজে উপস্থিত হবে! প্লাস, পেনড্রাইভটাও তারা নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে ফেলে যায়নি!

ঠিকই বলছ, মিতিন ঘাড় নাড়ল, তাদের আসল নাম-ঠিকানা দিতেও কোনও সমস্যা ছিল না, নকল দিতেও নয়। তারা তো স্ট্রেট নজ্ঞর যেত, গ্যালারির ছবি পালটে মানে মানে কেটে পড়ত। আমরা না জানালে চুরিটাই হয়তো আবিষ্কার হত না সঙ্গে সঙ্গে। পরে যখন ব্যাপারটা ধরা পড়ত, তখন তো আর তাদের টিকি ছোঁয়ার উপায় নেই। সেই হিসেবে বিভব শর্মার কটেজও পিকচারের বাইরে থাকত। অতএব তারা সঠিক আত্মপরিচয় দেখিয়েছিল কিনা, তা আমাদের ধর্তব্যে আনারও দরকার নেই।

কথা বলতে বলতে ঢালপুর ময়দানের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে টুপুররা। মিনিট দু-তিনেকের মধ্যে টিঙ্কু সিং-এর গাড়িও হাজির। বুমবুম মুখ বাড়িয়ে ডাকছে টুপুরদের।

গাড়ির সামনে গিয়ে পার্থ জিজ্ঞেস করল, কী অবনীদা, কেমন দেখলেন রাজবাড়ি?

সহেলি আগ বাড়িয়ে জবাব দিলেন, খুব খারাপ। অমন জরাজীর্ণ দশা জানলে কখনও যেতাম না। তার চেয়ে রঘুনাথজির টেম্পলটা ঢের ভাল।

মন্দিরও ঘুরে এলেন বুঝি? পার্থ হাসল, এবার চলুন, একটা ভাল রেস্তরাঁ দেখি। সকালের টোস্ট-অমলেট তো কখন হজম। আশুতোষের ওখানে চাট্টি কাজু দিল। তাও আপনার বোনের ভয়ে দাঁতে কাটতে পারলাম না।

কেন, আমি তো কাজু খেতে মানা করিনি!

প্লেট তো তোমার সামনে ছিল। এগিয়ে তো দাওনি!

পার্থর বলার ভঙ্গিতে সবাই হাসছে। বুমবুমও। হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠল টুপুররা। টিঙ্কুকে বলতেই সে গাড়ি নিয়ে সোজা কুলুর আখারা বাজারে। একটা সাজানো-গোছানো বড় রেস্তরাঁয় ঢুকে ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেনের অর্ডার দেওয়া হল। সঙ্গে স্থানীয় নদীর ট্রাউট মাছের ফ্রাই। পাশেই দু’খানা টেবিল জড়ো করে আহার সারছে জনা দশেক সর্দারজি৷ মেনু রুটি মাংস।

তেরচা চোখে তাদের দেখে নিয়ে পার্থ বলল, কে জানে এদের মধ্যেই তারকুণ্ডেরা আছে কিনা!

টুপুর বলল, যাঃ, এই দঙ্গলে তারা ঢুকবে কী করে?

মিতিন যেন আনমনা ছিল। পার্থ-টুপুরের কথায় চমকে তাকিয়েছে। টিঙ্কু একই সঙ্গে খেতে বসেছে, ফস করে তাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, এখানে অনেক সর্দারজিও আসেন নাকি?

কুলু টাউনে খুব একটা নয়। ওঁরা বোধহয় মণিকরণ যাচ্ছেন।

টুপুর জিজ্ঞেস করল, মণিকরণে কি আপনাদের কোনও তীর্থস্থান আছে?

হা বহিন। গুরু নানকজি মণিকরণে ছিলেন কিছুদিন। ওখানে বড় গুরদোয়ারা আছে। তিন-চার হাজার আদমি একসাথ থাকতে পারে।

অবনী বললেন, মণিকরণ হিন্দুদেরও তীর্থস্থান। একটা উষ্ণ কুণ্ডও আছে।

এক সেকেন্ড অবনীদা, মিতিন ফের ফিরেছে টিঙ্কুতে, মণিকরণের রুটটা কী ভাই?

ভুন্টার আর কুলুর মাঝামাঝি মেন রোড থেকে একটা রাস্তা ঘুরেছে।

তার মানে ভুন্টার থেকে কুলু না এসেও মণিকরণ যাওয়া যায়?

হাঁ জি।

মিতিনের চোখ যেন জ্বলে উঠল। পলকেই অবশ্য স্বাভাবিক। বিড়বিড় করে বলল, কুলুতে আর সময় নষ্ট নয়। সকলে খেয়ে নাও চটপট। এবার মণিকরণ।

.

১০.

পার্বতী নদী চলেছে পাশে পাশে। প্রায় গোটা পথ ধরে। নাচতে নাচতে। ঝমরঝমর শব্দ বাজিয়ে। রাস্তার অন্য ধারে পাহাড়ি জঙ্গল। রীতিমতো ঘন। অরণ্যের ছায়ায় চড়াই উতরাই, সবই কেমন অন্ধকার অন্ধকার। যেন রহস্যমাখা।

টুপুর বিভোর হয়ে নিসর্গ দেখছিল। তারা যে চোর ধরতে চলেছে, তা বুঝি এখন স্মরণেই নেই। বাঁয়ে, খরস্রোতা নদীর ওপারে, কী মনোরম উপত্যকা! মাঝে মাঝেই ঘন সবুজ চারণভূমি। চরছে ভেড়া-ছাগলের পাল। আরও খানিক দূরে খাড়া খাড়া পাহাড়। পাইন-চির-দেবদারুতে ছাওয়া। চোখে পড়ে আপেল বাগান, শস্যশ্যামল মাঠ। হঠাৎ হঠাৎ উঁকি দিচ্ছে ধবধবে সাদা পাহাড়চূড়া, আবার হারিয়েও যাচ্ছে পরমুহূর্তে। আহা রে, এই তো স্বর্গ!

আপন মনে টুপুর বলে উঠল, আমাদের টুর প্রোগ্রামে মণিকরণ ছিল না কেন?

পার্থ বলল, সত্যি, না এলে খুব লস হত কিন্তু। দিব্যি একটা জঙ্গলও দেখা হয়ে গেল।

সহেলি কিঞ্চিৎ শঙ্কিত স্বরে টিঙ্কুকে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁগো, এই পাহাড়ে কি জন্তুজানোয়ার আছে?

হাঁ জি, টিঙ্কু ঘাড় নাড়ল। পাহাড়ের একটা বাঁকে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, চিতা, ভল্লুক, হরিণ। তবে রাস্তায় নামে না, থোড়া দূর দূর থাকে।

অবনী বললেন, শুনেছি এখানে নাকি কস্তুরীমৃগ দেখা যায়?

হাঁ জি৷ এক টাইপের বিল্লি ভি আছে। গায়ে মিঠা মিঠা স্মেল।

সিভেট? সে তো খুব বিরল প্রাণী!

হাঁ জি। এখানে বহুত কিসিমের জানোয়ার আছে, পাখি আছে।

পার্থ চোখ বড় বড় করে বলল, গুরু নানক এইসব জঙ্গল ভেদ করে এসেছিলেন?

একা নন, সঙ্গে আরও লোক ছিলেন। মণিকরণে পৌঁছে তাদের খুব খিদে পায়। কাছে চাল-আটা থাকা সত্ত্বেও উনুনের অভাবে রান্না করতে পারছিলেন না। তখন গুরু নানক একটা প্রকাণ্ড পাথর সরিয়ে গরম জলের ধারাটা বার করে দেন। জলের তাপ এত বেশি, চাল-ডাল সুন্দর সেদ্ধ হয়ে যায়। এখনও তো গুরদোয়ারার খাবার দাবার ওই গরম জলে রান্না হয়।

সহেলি বললেন, ভারী মজার ব্যাপার তো! আমরাও মণিকরণের জলে চাল ফুটিয়ে দেখতে পারি।

অসুবিধে নেই। তবে একটু সালফারের গন্ধ পেতে পারো, অবনী মতামত জানালেন, হট স্প্রিং-এ প্রচুর গন্ধক থাকে তো।

আহা, ওই জলে রান্না তা হলে লোকে খায় কী করে?

টিঙ্কু বলল, সহি বাত। রোজ কত আদমি গুরদোয়ারাতে খাচ্ছে, রামমন্দির ধরমশালাতেও খেতে যাচ্ছে।

রাম কোত্থেকে এলেন? অবনীর ভুরুতে বিস্ময়, মণিকরণে তো শিবের থাকার কথা।

টুপুর জিজ্ঞেস করল, কেন?

কারণ, এটা শিবের এলাকা। মণিকরণ নামটা কী করে হয়েছে শুনবি? শিব আর পার্বতী একদিন এখানে বেড়াচ্ছিলেন, তখন পার্বতীর কান থেকে মণিকুণ্ডল খসে পড়ে। শেষনাগ নামের এক সাপ সেই মণিকুণ্ডলটি নিয়ে পাতালে ঘাপটি মারে। শিব তো রেগে কাই, অমনি বসে গেলেন কঠোর তপস্যায়। ধ্যানের দাপটে তার তৃতীয় নয়ন ফুঁড়ে বেরোলেন নয়নাদেবী। তিনি গিয়ে হানা দিলেন পাতালে। শেষনাগ তো বেজায় ঘাবড়ে গেল, একগাদা মণি উপহার দিয়ে তুষ্ট করতে চাইল শিবকে। তা মহাদেবের তো লোভ টোভ নেই, তিনি শুধু পার্বতীর গয়না পেয়েই খুশি। বাকি মণিগুলোকে পাথর বানিয়ে গরম জলের ধারাটিকে ঢেকে দিলেন শিব। ওই মণির সূত্রেই জায়গাটা হল মনিকরণ।

বেড়ে গল্প তো! পার্থ হেসে ফেলল, কেসটা কেমন যেন মিতিনদেবীর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে না? রোয়েরিখ সাহেবের গ্যালারি থেকে রত্ন হাপিশ করে এক জোড়া শেষনাগ চম্পট দিয়েছে, আশুতোষ শাহ বসেছেন কঠোর তপস্যায়, তারই তেজে বলীয়ান হয়ে থার্ড আইয়ের মিতিন ওরফে নয়নাদেবী চলেছেন রত্ন উদ্ধারে!

অবনী হো হো হেসে উঠলেন, এখন প্রশ্ন হল, এই শেষনাগরা কি আদৌ ঘাবড়েছে? আশুতোষের চরণে গিয়ে কি সমর্পণ করবে ছবি তিনখানা?

সে গুড়ে বালি। মিতিনদেবীকে ভেলকি দেখাতেই হবে। নইলে শেষনাগদের কবজায় আনা মুশকিল।

যাকে নিয়ে এত মশকরা, সেই মিতিনের উদাসী চোখ জানলার বাইরে। কানে কিছু ঢুকছে কিনা বোঝা দায়। হঠাৎই কী ভেবে যেন দৃষ্টি ঘোরাল। দূরমনস্ক স্বরে টিঙ্কুকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ভাই, বলো তো, মণিকরণ থেকে আর কোথায়-কোথায় যাওয়া যায়?

কুলু ছাড়া মণিকরণে বাসরুট তো আর একটাই ম্যাডাম। মণিকরণ থেকে বারসোনি।

জায়গাটা কত দূর?

মণিকরণ পেরিয়ে আরও বারো-চোদ্দো কিলোমিটার।

কী আছে সেখানে?

হাইডেল প্রোজেক্ট। পার্বতীর জল থেকে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। আর আছে পাহাড়ের মাথায় জমলু মহাদেবের মন্দির।

বারসোনিতে থাকার কী বন্দোবস্ত?

নেই। ওখান থেকে হেঁটে পুলগাঁ গেলে বাড়িঘর মেলে।

কাছাকাছি আর কোনও জায়গা?

মণিকরণ থেকে হেঁটে ক্ষীরগঙ্গা যেতে পারেন। যেখানে পার্বতী নদীর শুরু।

আর?

দু-চারজন মালানাতেও যায়।

সেখানে কী আছে?

মালানা এক আজব উপত্যকা ম্যাডাম। বহুকালের পুরনো। লোকে বলে, সিকান্দার শাহের কিছু সৈন্য ওখানে রয়ে গিয়েছিল। তাদের বংশধররাই নাকি মালানার বাসিন্দা।

পার্থ জিজ্ঞেস করল, সিকান্দার শাহ…..মা-মানে কি গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার?

হাঁ জি। মালানার মানুষ নিজেদের মতো আইনকানুন বানিয়ে নিয়েছে। কেউ ওদের বিরক্ত করে না। ওখানে নাকি রাশি রাশি ধনরত্ন, কিন্তু কোনও চুরি-ডাকাতি নেই। পাহারারও প্রয়োজন হয় না। ওরা কথা বলে কানাশি ভাষায়। ভোট দিয়ে নিজেরাই নিজেদের নেতা নির্বাচন করে, তারা ওদের দেখভাল করে।

মালানায় হোটেল টোটেল আছে?

না জি। ট্রেকিং পার্টি গিয়ে তাঁবুতে থাকে। বাইরের লোকদের ব্যাপারে ওরা ভীষণ কড়া। গাঁয়ের মধ্যে বাঁধানো রাস্তা ছাড়া কাউকে হাঁটতে দেবে না। ওদের কাউকে আপনি ছুঁতে পারবেন না। কোনও জিনিসে হাত লাগালে হাজার টাকা জরিমানা।

এমন আবার হয় নাকি? টুপুরের বিশ্বাস হচ্ছিল না। জিজ্ঞাসু চোখে পার্থর দিকে তাকাল।

পার্থর আগে অবনীই বললেন, এরকম কিছু কিছু উপজাতি কিন্তু এখনও টিকে আছে ভারতে। এই তো, লাদাখের কাছে একটা গ্রামে বাস করে আট-দশ ঘর খাঁটি আর্য পরিবার। অসমে আছে কিছু থাইল্যান্ডের অধিবাসী। মুর্শিদাবাদ ঢাকা কোথায় যেন কয়েকটা পতুর্গিজ পরিবারও আছে বলে শুনেছিলাম।

মিতিন ফের কী যেন ভাবছিল। টিঙ্কুকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা, ট্রেকারদের মালানা যেতে কতক্ষণ লাগে?

এক দিনে পৌঁছোনো খুব কঠিন ম্যাডাম। অনেকটা দূর। কম করে বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার। রাস্তা বলতেও তো প্রায় কিছু নেই, পাহাড় ধরে এগোতে হয়।

ও।

মিতিন আবার চিন্তার সাগরে। এমন গম্ভীর করে রেখেছে মুখখানা, কথা বলতে সাহস হয় না। ট্রেকিং রুটের খবর কেন নিচ্ছিল, তা জানারও উপায় নেই। অগত্যা কী আর করা, কৌতূহল গিলে প্রকৃতির শোভা দেখছে টুপুর।

খানিকক্ষণ পর হঠাৎ টিঙ্কুর গলা, একটা সওয়াল করতে পারি ম্যাডামজি?

মিতিনের বদলে পার্থর প্রশ্ন, কী?

আমি জানি, কাল নজ্ঞরে তসবির চুরি হয়েছে। তখন থেকেই দেখছি, ম্যাডামজির সঙ্গে পুলিশের খুব জান পহেচান। ম্যাডামজি কি এনকোয়ারি করছেন?

হুম। ম্যাডাম একজন গোয়েন্দা। চোর ধরায় ওস্তাদ।

সচ? টিঙ্কুর চোখে সম্ভ্রম ফুটে উঠল। মাথা দুলিয়ে বলল, ওউর এক বাত। ম্যাডামজি কি কোনও সর্দারকে সন্দেহ করছেন?

ঠিক তা নয়। তবে যারা চুরি করেছে, তারা সর্দারজি সেজেছিল। এখনও বোধহয় সেই বেশেই আছে।

মণিকরণ সাহিবে তাদের ধরবেন?

দেখা যাক। যদি ইতিমধ্যে না ভেগে থাকে।

লেকিন…ওরা তো কাসোল থেকেও পালাতে পারে।

কাসোল? মিতিনের ঘাড় হঠাৎ স্প্রিং-এর মতো ঘুরেছে, সেটা কোথায়?

এই তো, সামনেই। মণিকরণের তিন-চার কিলোমিটার আগে। ওখানেই তো দূরপাল্লার বাসস্ট্যান্ড। দিল্লি, চণ্ডীগড়, সিমলা, কোথাকার না বাস ছাড়ে। বহুত আচ্ছা সার্ভিস। রাতে স্টার্ট করে, সকালে পৌঁছে দেয়।

তাই নাকি?

হাঁ জি। কাসোল ভি বড়িয়া টুরিস্ট স্পট। পার্বতী নদী, জঙ্গল, পাহাড়, সুন্দর-সুন্দর ভিউ। অনেক ফরেনার তো মণিকরণের বদলে কাসোলেই থাকে। ভাল ভাল লজ আছে।

উৎসাহ নিয়ে বলছে টিঙ্কু। কিন্তু মিতিনের যেন আর আগ্রহ নেই। ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বের করল। কী একটা নম্বর টিপতে গিয়েও থেমেছে মাঝপথে। মোবাইল ফের ব্যাগে চালান করে আপন মনে বলল, নাঃ, মণিকরণই যাওয়া যাক।

তা মণিকরণ পৌঁছোতে আরও আধ ঘন্টাটাক লাগল। প্রথমেই শিখদের বিশাল গুরুদ্বার। মণিকরণ সাহিব। টিঙ্কু গাড়ি থামাবে কিনা জিজ্ঞেস করল, না বলল মিতিন। আর একটু এগোতেই পার্বতী নদীর ব্রিজ, তারপর মূল জনপদ। ছোট, তবে বেশ জমজমাট শহর। প্রচুর দোকানপাট, দু’পা অন্তর মন্দির, পথের ধারে যত্রতত্র উষ্ণ কুণ্ডে স্নান করছে লোকজন। হালকা একটা গন্ধও ভাসছে বাতাসে। তুবড়ি তুবড়ি ঘ্রাণ। নিশ্চয়ই সালফারের। চতুর্দিকে পেল্লাই উঁচু উঁচু পাহাড় যেন জেলখানার পাঁচিল হয়ে ঘিরে রেখেছে মণিকরণকে। শুধু পুব দিকেই যা একটুকু ফাঁক। সেখান থেকে উঁকি দিচ্ছে হিমালয়ের বরফ চুড়ো। ওই পথেই লাফাতে লাফাতে নামছে পার্বতী। স্রোতের কী গর্জন, বাপস!

মিতিনের নির্দেশে টিঙ্কু বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে গেল গাড়ি। দরজা খুলতে খুলতে মিতিন জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি এখন জায়গাটা ঘুরে দেখবে?

সহেলি বললেন, আগে একটু জিরিয়ে নিলে হত না?

পাশেই তো ধরমশালা। আপাতত ঢুকে পড়ো।

আমরা হোটেল নেব না?

সে হবে’খন। এখন ফ্রেশ তো হয়ে নাও। তারপর টাউনটা দ্যাখো।

আর তুই?

পরে জয়েন করছি।

টুপুর মাসির সঙ্গ ছাড়তে রাজি নয়। রয়ে গেল পার্থ আর বুমবুমও। সহেলি-অবনীকে নিয়ে রামমন্দির ধরমশালায় গেল টিঙ্কু।

বুমবুম বড় বড় চোখে জিজ্ঞেস করল, মা, তুমি কি এখনই চোর ধরবে?

আগে একটু চা তো খাই।

মিতিন পায়ে পায়ে বাসস্ট্যান্ডের চায়ের দোকানটায় ঢুকল। টুপুর আর বুমবুমকে চিপস কিনে দিয়ে পার্থর সঙ্গে চুমুক দিচ্ছে মশলাদার চায়ে। আয়েশ করে। সামনেই একটা বাস দাঁড়িয়ে। প্রায় ফাঁকা। একটা-একটা করে লোক উঠছে। এক অল্পবয়সি পাহাড়ি ছেলে যাত্রীদের মালপত্র তুলে দিচ্ছে ছাদে। বাসটাকে দেখতে দেখতে মিতিন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, এটা যাচ্ছে কোথায়?

কুলু। আখারা বাজার।

ছাড়বে কখন?

টাইম তো সাড়ে তিনটে। তবে লাস্ট বাস তো, গাড়ি বোঝাই না হলে নড়বে না।

সে কী? সাড়ে তিনটের পরে আর বাস নেই?

একটা ছিল। তার ইঞ্জিন গড়বড় করছে। আজ যাবে না।

ও। মিতিন আবার নির্লিপ্ত মুখে চুমুক মারছে কাচের গ্লাসে। টুপুর খানিক অসহিষ্ণু স্বরে বলল, আমরা এখানে বসে আছি কেন?

চান্স নিচ্ছি।

কীসের চান্স?

আলটপকা আশমান থেকে যদি কিছু খসে পড়ে!

পার্থ গজগজ করে উঠল, ফালতু টাইম নষ্ট করছ কিন্তু। এভাবে গা এলিয়ে দিলে কালপ্রিটদের হদিশ পাবে?

তা হলে কী করা উচিত শুনি?

গুরদোয়ারায় গিয়ে খোঁজ নাও।

কীভাবে?

এই যেমন ধরো, লোক দুটো যদি কাতরেইন থেকে তিনটে-সাড়ে তিনটেয় রওনা দেয়, তা হলে তারা এখানে কখন পৌঁছেছে? অ্যারাউন্ড সন্ধে সাত-আটটা? আমরা যদি গুরদোয়ারায় গিয়ে চেক করি, সন্ধে সাতটার পর কারা কারা এসেছে।

প্রথমত, তারা অ্যালাও করবে কেন? দ্বিতীয়ত, যদি তোমার আবদার শুনে পুলকিত হয়ে নামধাম জানায়, দেখে কিছু বোঝা যাবে কি? নাকি তুমি জনে জনে ডেকে দাড়ি টেনে দেখবে?

বুমবুম হি হি হাসছে। পার্থ গুম। দু-চার সেকেন্ড পরে ফের বলল, তবু…ওই গুরদোয়ারাই কিন্তু লুকোনোর আসলি জায়গা। ওখানে প্রচুর লোক থাকে। তা ছাড়া ভিতরে যদি না-ও যাই, সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। দু’মক্কেল যদি ভুলক্রমেও তখন গুরদোয়ারা থেকে বেরোয়…।

অমনি তাদের চিনে ফেলবে? সকালের স্কেচ দুটোয় মনে মনে দাড়ি পাগড়ি লাগিয়ে?

তা হলে তুমি চাইছটা কী? মণিকরণে এলে কেন?

টুপুর বলল, অন্তত পুলিশের কাছে চলো। তারপর তাদের নিয়ে…

অ্যাই, চুপচাপ বসবি? না পোষায় তো তোরা দু’জনে সোজা উষ্ণ কুণ্ডে যা। গরম জলে গা ডুবিয়ে বসে থাক। চমৎকার মাসাজ হবে।

টুপুর গোঁজ হয়ে গেল। পার্থ রেগেমেগে দোকানের বাইরে। গোমড়া মুখে আকাশ দেখছে। ঠিক তখনই ভোজবাজি!

মিতিন আচমকা তড়াক লাফিয়ে উঠেছে বেঞ্চি ছেড়ে। তির বেগে ছুটছে বাসটার দিকে। গালপাট্টাধারী এক রোগা সর্দারজি পাহাড়ি ছেলেটাকে একটা বোঁচকা দিচ্ছিল, ঝাঁপিয়ে পড়ে চেপে ধরেছে লোকটার হাত। তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল, নবীন তারকুণ্ডে, ইয়োর টাইম ইজ ওভার।

চমকে তাকিয়েছে লোকটা। পলকের জন্য থতমত। পরক্ষণে চোখা হিন্দিতে তেড়ে উঠল, কে তারকুণ্ডে? আপনিই বা কে?

চালাকি করবেন না তারকুণ্ডে। কড়াটা আপনি অন্য হাতে পরেছেন। প্রকৃত শিখ কখনও এই ভুলটা করে না।

লোকটা আরও চমকেছে। পরিবর্ত ক্রিয়াতেই বুঝি কড়াখানা লুকোতে চাইল। খিঁচিয়েও উঠেছে সঙ্গে সঙ্গে, কী আজেবাজে বকছেন?

আর একজন স্বাস্থ্যবান সর্দারজি একটু তফাতে ছিল। তড়িঘড়ি এগিয়ে এসেছে। উদ্ধত ভঙ্গিতে বলল, হচ্ছেটা কী এখানে? তীর্থস্থানে এসে আপনি আমাদের সঙ্গে অসভ্যতা করছেন?

প্রথমজন আঙুল তুলে শাসাল, যান যান এখান থেকে। নইলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।

তড়পে লাভ নেই। গোটা বাসস্ট্যান্ড পুলিশ ঘিরে রেখেছে। মানে মানে দু’জনে সারেন্ডার করেন তো ভাল। নইলে…

কী করবেন, অ্যাঁ?

সম্ভবত রিভলভার বের করতে যাচ্ছিল তারকুণ্ডে, তবে সময় পেল না। জনা পাঁচেক সাদা পোশাকের পুলিশ ঝটিতি ঘিরে ফেলেছে দুই মূর্তিমানকে। মুহূর্তে পরিয়ে দিল হাতকড়া। টানতে টানতে নিয়ে চলেছে থানায়।

মিতিন পার্থকে ঠেলল, এবার নিশ্চিন্ত মনে দাড়ি টেনে দেখতে পারো।

টুপুর হতভম্ব মুখে বলল, তু-তু-তুমি…পুলিশকে কখন…?

মিতিন হাত ঝাড়ছে। টুপুরের গালে আলতো টোকা দিয়ে বলল, এখনও অনেক কিছু দেখতে পাবি রে।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *