Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু ও শিশুচোরের দল || Sunil Gangopadhyay » Page 8

কাকাবাবু ও শিশুচোরের দল || Sunil Gangopadhyay

কে যেন ঠেলছে। কে যেন কীসব বলছে। আস্তে-আস্তে চোখ মেললেন কাকাবাবু।

প্রথমে ভাল করে কিছু দেখতে পেলেন না, ভাল করে শুনতেও পারছেন না।

তারপর দেখলেন, তাঁর মুখের কাছেই ঝুঁকে আছে একটি মেয়ের মুখ। একবার চোখ রগড়ে নেওয়ার পর চিনতে পারলেন দেবলীনাকে।

দেবলীনা বলল, ওঠো, ওঠো, কখন থেকে ডাকছি। তুমি এত ঘুমোও কেন?

কাকাবাবু উঠে বসলেন। এটা ঘুম নয়। কোনও ওষুধ দিয়ে তাঁকে অজ্ঞান করে ফেলা হয়েছিল। এখনও মাথা ঝিমঝিম করছে।

দেবলীনা বকুনির সুরে বলল, তুমি কী করে ভাল ডিটেকটিভ হবে বলো তো? এত ঘুমোলে চলে? চারপাশে খুনে ডাকাতরা গিসগিস করছে!

দু-তিনবার মাথা ঝাঁকুনি দিলেন কাকাবাবু। চোখের দৃষ্টি খানিকটা পরিষ্কার হল। তিনি দেবলীনার একটা হাত চেপে ধরে বললেন, ওরে, তোকে দেখে আমার এত ভাল লাগছে! কী দারুণ দুশ্চিন্তা হয়েছিল। জ্বর কমেছে?

দেবলীনা বলল, জ্বরটর সব হাওয়া! মনটা আনন্দে ফুরফুর করছে।

কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, আনন্দে ফুরফুর করছে? তোকে জোর করে ধরে আনেনি?

দেবলীনা উচ্ছল গলায় বলল, হ্যাঁ, তোমাদের বাড়ি থেকে বেরোলাম, দুটো লোক আমার মুখ চেপে ধরে গাড়িতে তুলে নিল। সেইজন্যই তো আনন্দ হচ্ছে!

আনন্দ হচ্ছে? তার মানে?

বাঃ, আনন্দ হবে না! তোমরা প্রত্যেকবার দূরে দূরে কোথায় চলে যাও। আমাকে সঙ্গে নাও না! এবারে বোঝো মজা! আমাকে ধরে এনেছে, তাই তোমাকেও আসতেই হবে। বেশ হয়েছে, সন্তুকে ধরেনি! সন্তু আর জোজোটা কিছু জানতেই পারবে না।

দেবলীনা, তোর ওপর অত্যাচার করেনি তো? গায়ে হাত তুলেছে?

না, মারে-টারেনি! মারতে এলে আমিও ছাড়তাম নাকি?

খেতে-টেতে দিয়েছে কিছু?

হ্যাঁ, একটা মেয়ে এসে রুটি-তরকারি দিয়েছিল, বিচ্ছিরি খেতে। খুব খিদে পেয়েছিল বলে আমি আধখানা রুটি খেয়েছি।

এ-জায়গাটা কোথায়?

তা আমি কী করে জানব? শুধু কুকুর ঘেউ ঘেউ করে শুনতে পাই। তোমাকে ওরা কী করে ধরে আনল?

কাকাবাবু যে ইচ্ছে করে ধরা দিয়েছেন, সে কথা দেবলীনাকে জানালেন না।

তিনি দেখলেন, তাঁর কিংবা দেবলীনার হাত-পা বাঁধেনি। রিভলভারটা শুধু নিয়ে নিয়েছে।

ঘরখানা প্রায় অন্ধকার। একদিকে একটা বন্ধ জানলা, আর একটা জানলার একটা পাল্লা খোলা, সেটাও ঢেকে আছে একটা গাছের ডালপালা। মনে হয়, এখন বিকেল। রিভলভারটা নিয়েছে বলে চিন্তা করলেন না, কিন্তু তাঁর ক্রাচদুটো নেই বলে বিরক্ত বোধ করলেন। আবার ক্রাচ বানাতে হবে। এই নিয়ে যে কতবার গেল!

তিনি এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘরটা ঘুরে দেখলেন। ইটের দেওয়াল, ওপরে টালির ছাদ। দরজাটা বেশ মজবুত, জানলাটাও ভাঙা যাবে না। বাইরে দুএকজন লোকের গলা শোনা যাচ্ছে। ঘরে একখানা খাটিয়া, তার ওপর একটা ময়লা চাদর। আর কিছু নেই।

দেবলীনা বলল, শোনো, একবার না একবার তো কেউ খাবার দিতে আসবেই। তুমি দুমদাম ঘুসি মেরে তাকে অজ্ঞান করে ফেলবে। আমি এই বিছানার চাদর দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলব। তক্ষুনি কিন্তু আমরা পালিয়ে কলকাতায় ফিরে যাব না। বাইরে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থেকে সব দেখব। তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেলে মজা নেই।

কাকাবাবু হাসলেন। এইসব লোক যে কী সাংঘাতিক ধরনের হয়, সে সম্পর্কে দেবলীনার কোনও ধারণাই নেই। এরা চোখের পলকে মানুষ খুন করতে পারে। কনস্টেবল বিমল দুবেকে মেরে ফেলেছে, আরও কতজনকে মেরে রেললাইনে ফেলে দেয়, কে জানে!

কাকাবাবু বললেন, আসল কাজটা বাকি রেখে আমরা পালাব কেন?

চোখ বড় বড় করে দেবলীনা জিজ্ঞেস করল, আসল কাজটা কী বলো তো?

কাকাবাবু বললেন, যে বাচ্চাদের চুরি করে এনেছে, তাদের উদ্ধার করা!

দেবলীনা বলল, অ্যা! বাচ্চাগুলোকে এরা চুরি করেছে। তবে তো এরা খুব খারাপ লোক!

কাকাবাবু বললেন, খারাপ লোক না হলে তোকেই বা এরা ধরে আনবে কেন?

দেবলীনা বলল, আমাকে ধরুকগে যাক, তাতে কিছু হয়নি। বাচ্চাদের চুরি করে, এদের খুব শাস্তি দেওয়া উচিত। সকালবেলা কয়েকটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনেছিলাম বটে।

কাকাবাবু বললেন, সকালে শুনেছিলি? সারাদিন আর শুনিসনি? দেবলীনা বলল, না।

কাকাবাবু বললেন, ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রাখে। তা হলে ওদের এখানেই রেখেছিল, এর মধ্যে সরিয়ে নিয়ে যায়নি তো?

দেবলীনা বলল, কেউ আসছে না কেন? জল চাইব? তা হলে ঠিক আসবে।

সে জল জলবলে কয়েকবার চিৎকার করল। তখন দরজা খোলার শব্দ হল, দেখা গেল ময়নাকে।

কাকাবাবু দেবলীনাকে জিজ্ঞেস করলেন, একে কি ঘুসি মারা উচিত?

দেবলীনা বলল, খবরদার না। মেয়েদের গায়ে হাত তুলবে না। একে আমি চিনি।

কাকাবাবু বললেন, আমিও চিনি।

ময়নার চোখদুটি এখনও ছলছল করছে। একটা ড়ুরে শাড়ি পরে আছে। হাতে এক ঘটি জল।

কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে সে কান্না কান্না গলায় বলল, আমার ছেলেকে তুমি ফেরত দাও!

কাকাবাবু দেখলেন, দরজার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। কিন্তু দূরে মানুষের গলা শোনা যাচ্ছে।

তিনি ময়নাকে বললেন, সময় হলেই ফেরত দেব। চিন্তা কোরো না।

ময়না চোখ মুছে ফেলে বলল, শোনো বুড়ো, তুমি বেশি জেদ কোরো না।

দেবলীনা বলল, এই, আমার কাকাবাবুকে বুড়ো বলবে না! মোটেই বুড়ো নয়!

ময়না তাকে মুখঝামটা দিয়ে বলল, এই খুকি, তুই চুপ কর!

আবার সে বলল, শোনো বুড়ো, তুমি বেশি জেদ কোরো না। আমি শুনেছি, ওরা বলাবলি করছে, তোমাকে ওরা মেরে ফেলবে! আজই!

কাকাবাবু দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, না, মারবে না। আমাকে মারলে তোমার ছেলেকে ফেরত পাবে কী করে? আর তো কেউ জানে না। সারা জীবনেও তার সন্ধান পাবে না!

ময়না বলল, আমার ছেলের যদি কোনও ক্ষতি হয়, তা হলে তোমাকে আমিই খুন করে ফেলব! তোমার হাত-পা কুচি কুচি করে কাটব!

কাকাবাবু বললেন, তা তুমি, পারবে না। শোনো, মাথা গরম কোরো না। তোমার ছেলে খুব ভাল জায়গায় আছে। তার হুপিং কাশি হয়েছে, তোমরা চিকিৎসা করাওনি। আমি ভাল ডাক্তার দেখিয়েছি, সে সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে। তুমি ওদের গিয়ে বলো। সবকটা বাচ্চাকে ফেরত দিক, এই দেবলীনাকে ছেড়ে দিক, আমি সঙ্গে সঙ্গে তোমার ছেলেকে ফেরত আনার ব্যবস্থা করব। আমার কথার খেলাপ হবে না।

ময়না বলল, বাচ্চাগুলোকে ওরা কিছুতেই ফেরত দেবে না।

দেবলীনা বলল, হ্যাঁ, আগে ওদের ফেরত দিতেই হবে!

ময়না বলল, এই খুকি, তুই আবার কথা বলছিস? জানিস, ওরা তোর হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখতে চেয়েছিল। আমিই অনেক বলে-কয়ে ওদের বাঁধতে দিইনি।

দেবলীনা ঠোঁট উলটে বলল, হাত-পা বাঁধত তো বয়েই যেত। আমি বুঝি খুলতে জানি না! জানো, আমার কাকাবাবু ম্যাজিক জানে, লোহার শেকল দিয়ে ওঁর হাত বেঁধে দাও, তাও খুলে ফেলবেন এক মিনিটে!

ময়না বলল, নেকি! এ মেয়েটার দেখছি বুদ্ধিশুদ্ধি কিছুই হয়নি। ম্যাজিক না ছাই! যখন ফস করে পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেবে, তখন ম্যাজিক কোথায় থাকবে। এরা যখন-তখন ছুরি চালায়। তোকেও যে বিক্রি করে দেয়নি, এই তোর সাত পুরুষের বাপের ভাগ্যি?

দেবলীনা বলল, এ, আমাকে বিক্রি করবে! ইল্লি আর টকের আলু! সেরকম কেউ এখনও জন্মায়নি! আমাকে যে কিনবে তার চোখ খুবলে নেব না?

ময়না বলল, তুই থাম তো!

তারপর কাকাবাবুকে বলল, একের বদলে এক। আমরা এই মেয়েটাকে ছেড়ে দিচ্ছি, তুমি আমার ছেলেকে ফেরত দাও!

কাকাবাবু বললেন, আগে বাচ্চাগুলোকে চাই। নইলে কোনও কথা শুনব না।

ময়না বলল, বাচ্চা ওরা ফেরত দেবে? তুমি কি পাগল? ওদের জন্য কত টাকা পাবে তা জানো?

কাকাবাবু বললেন, তুমি নিজে মা হয়ে অন্য মায়েদের কষ্ট বোঝো না? এই বাচ্চাদের মেরে ফেলার জন্য পাঠাবে, ওদের মায়েরা কত কাঁদবে, তা একবারও ভেবে দ্যাখো না?

এবার ময়না কেঁদে ফেলল। ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল চোখ দিয়ে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমি কী করব? আমার কথা কি ওরা শুনবে? আমি কিছু বলতে গেলে উলটে আমাকেই মারতে আসে!

কাকাবাবু বললেন, তা হলে তুমি এদের দলে থাকো কেন?

ময়না উত্তর দেওয়ার আগেই দরজা ঠেলে ঢুকল দুজন লোক।

এরা সেই ওস্তাদ আর ডাবু। ওস্তাদের হাতে একটা সরু লিকলিকে বেত।

সে ধমক দিয়ে বলল, এই ময়না, এখানে বসে বকবক করছিস কেন? যা, রান্নাঘরে যা।

ময়না তবু দাঁড়িয়ে রইল।

ডাবু কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, এই বুড়ো, এবার চটপট বলে ফেলো, ময়নার ছেলে কোথায় আছে? তোমাকে আমরা বসে বসে খাওয়াব নাকি?

কাকাবাবু বললেন, সে ভাল জায়গাতেই আছে। খাওয়ালে আর কোথায়? এ পর্যন্ত তো কিছুই খেতে দাওনি। বেশ খিদে পেয়েছে বটে!

ডাবু বলল, তোমাকে কচুপোড়া খাওয়াব!

ওস্তাদ তাকে বাধা দিয়ে বলল, বাজে বকিস না, চুপ কর। আগে কাজের কথা হোক।

তারপর সে হাতের বেতের চাবুকটা দুবার হাওয়ায় শপাং শপাং করে বলল, রায়চৌধুরী, তুমি কী চাও? তোমার সামনে এই মেয়েটাকে চাবুক পেটাব?

কাকাবাবু বললেন, এটা কী অদ্ভুত প্রশ্ন। আমি কি তা চাইতে পারি?

ওস্তাদ বলল, তা হলে কি এই মেয়েটার সামনে তোমায় চাবুক মেরে রক্ত বার করে দেব?

দেবলীনা বলল, ইস, কাকাবাবুর গায়ে একবার হাত তুলে দ্যাখো না! কাকাবাবু হলে তোমাদের এমন শাস্তি দেবেন!

ঠিক সিনেমায় বদমাশ লোকদের মতন ওরা দুজন বিশ্রীভাবে হা-হা করে হেসে উঠল। একে বলে অট্টহাসি।

ওস্তাদ বলল, তাই নাকি? দেখবি তবে?

সে শপাং করে একবার চাবুক কষাল কাকাবাবুর বুকে।

কাকাবাবু একটুও নড়লেন না। ওস্তাদের চোখে চোখ রেখে তিনি শান্ত গলায় বললেন, দেবলীনা ঠিক বলেছে। আমার গায়ে কেউ হাত তুললে তাকে আমি শাস্তি না দিয়ে ছাড়ি না!

ওস্তাদ আবার চাবুক তুলতেই কাকাবাবু সেটা খপ করে ধরে ফেললেন। এক হ্যাঁচকা টানে সেটা ছাড়িয়ে এনে ফেলে দিলেন নিজের পায়ের কাছে।

ওস্তাদ আর ডাবু দুজনেই ততক্ষণে রিভলভার বার করে ফেলেছে।

কাকাবাবু ধমকের সুরে বললেন, এসব ছেলেমানুষি করছ কেন? কাজের কথা বলতে এসেছ, সে কথা বলো! চুরি করে আনা বাচ্চাগুলোকে কোথায় রেখেছ বলো। তাদের ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা না করলে ময়নার ছেলেকে তোমরা ফেরত পাবে না। এই আমার শেষ কথা!

ওস্তাদ বলল, খুব তেজ দেখাচ্ছ, অ্যাঁ? তোমার হাত-পা বাঁধিনি। এখন যদি হাত-পা বেঁধে তোমায় জঙ্গলে ফেলে দিই, তা হলে কী করবে! বাঘগুলো অনেকদিন না খেয়ে আছে। তোমাকে পেলে দারুণ খুশি হবে। কিংবা তার আগেই সাপের কামড়ে খতম হয়ে যেতে পারো!

কাকাবাবু সুর করে বললেন, বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি/আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই, নাগেরই মাথায় নাচি… সত্যেন দত্তর কবিতা পড়োনি!

ডাবু বলল, চোপ! ব্যাটা পদ্য শোনাচ্ছে আমাদের!

ওস্তাদ বলল, তুমি এমন ভাব দেখাচ্ছ, যেন কিছুতেই ভয় পাও না!

কাকাবাবু বললেন, ভয়কে যারা মানে, তারাই জাগিয়ে রাখে ভয়, এটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা।

দেবলীনা খিলখিল করে হেসে উঠল।

ডাবু বলল, ওস্তাদ, এ লোকটা বড্ড জ্বালাচ্ছে, খতম করে দিলেই তো হয়! পদ্য শুনলেই আমার গা জ্বালা করে!

দেবলীনা বলল, কাকাবাবু, আর একটা বলো!

ওস্তাদ বলল, যথেষ্ট হয়েছে! শোনো রায়চৌধুরী, তোমাকে আমি শেষবারের মতন বলছি, তোমার কোনও শর্ত আমরা মানব না, তুমি ময়নার ছেলেকে ছেড়ে দেবে কি না!

কাকাবাবু বললেন, সে প্রশ্নই ওঠে না!

ওস্তাদ বলল, রায়চৌধুরী, তুমি আমাদের অনেক কিছু জেনে ফেলেছ। তুমি নিজেই জোর করে মাথা গলিয়েছ। তোমাকে মেরে ফেলা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় নেই!

কাকাবাবু বললেন, কেন বারবার এই বাজে কথা বলছ? আমাকে মারলে ময়নার ছেলেকে আর কোনওদিনই ফেরত পাবে না। এ একেবারে ধ্রুব সত্যি কথা!

ওস্তাদ মুখোনা বিকৃত করে বলল, ময়নার ছেলেকে পাওয়া যাক বা না যাক, তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না।

ময়না আঁতকে উঠে বলল, অ্যাঁ? কী বলছ? আমার ছেলে—

ওস্তাদ বলল, ডাবু, এই ময়নাটাকে বাইরে নিয়ে যা তো।

ডাবু অমনই ময়নার ঘাড় ধরে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল। ময়না আর্ত চিৎকার করতে লাগল, আমার ছেলে, আমার ছেলে—

দেবলীনা বলল, এরা বড় বাজে লোক!

ওস্তাদ বলল, রায়চৌধুরী, তুমি ময়নার ছেলের নাম করে আমাদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে চাইছিলে! চুলোয় যাক ওর ছেলে। একটা ময়না গেলে আর একটা ময়না আসবে। কিন্তু তোমাকে মরতেই হবে।

আর একটা লোক বাইরে থেকে ওস্তাদ, ওস্তাদ বলে ডাকতে ডাকতে ছুটে এল। সে হাঁপাচ্ছে।

ওস্তাদ জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে রে, ছোটগিরি? ছোটগিরি বলল, ওস্তাদ, জেটি ঘাটে লঞ্চ এসে গেছে! ওস্তাদ বলল, এসে গেছে? ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। আগে এদের দুজনের ব্যবস্থা করে যাই।

ছোটগিরি বলল, বড়সাহেব বললেন, এক্ষুনি জিনিস পাচার করতে হবে। পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি দেরি করা যাবে না। একটা বাচ্চা বোধ হয় নিতে-নিতেই শেষ হয়ে যাবে!

ওস্তাদ বলল, বড়সাহেব নিজে এসেছে?

ছোটগিরি বলল, হ্যাঁ। পুরো একদিন দেরি হয়েছে বলে খুব রেগে আছে। তার ওপর বাচ্চা যদি কমে যায়—তুমি এক্ষুনি গিয়ে কথা বলো—

ওস্তাদ বলল, ঠিক আছে, চল, যাচ্ছি।

কাকাবাবু ও দেবলীনার দিকে একবার জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে সে বেরিয়ে গেল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল বাইরে থেকে।

এখানে ছাড়া-ছাড়া ভাবে চারখানা একই রকমের ঘর। পেছন দিকে জঙ্গল। একটা সরু ইটের রাস্তা চলে গেছে একেবারে নদীর ধারে। খুব চওড়া নদী। জোয়ারের সময় অনেকখানি জল উঠে আসে। এখন সবে জোয়ার শুরু হয়েছে, ছলাত ছলাত শব্দ হচ্ছে জলে।

খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা লঞ্চ। ওস্তাদ সেই লঞ্চের ধারে গিয়ে একজন লোকের সঙ্গে কথা বলল। সে লোকটি সাহেবদের মতন ফরসা, কিন্তু খাঁটি সাহেব নয়, কথা বলছে হিন্দিতে। খুব ধমকাতে লাগল ওস্তাদকে।

একটুক্ষণের মধ্যে সেই লঞ্চে নানা জিনিসপত্র তোলা হতে লাগল। বড়-বড় সব বাক্স। আর একটা ঘরের দরজা খুলে বার করে আনা হল কতকগুলো বাচ্চা ছেলেকে। তারপর, যেমন ভেড়ার পাল তাড়িয়ে নেওয়া হয়, সেইভাবে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে যাওয়া হল লঞ্চের দিকে। তারা সবাই কাঁদছে।

ময়নাও কাঁদছে, কিন্তু সে শব্দ করতে পারছে না, কে যেন তার মুখটা বেঁধে দিয়েছে এর মধ্যে। তাকেও ঠেলতে ঠেলতে লঞ্চে তোলা হল।

লঞ্চের ইঞ্জিন চালু হয়ে গেছে, ছাড়বে এক্ষুনি। ওস্তাদ নামের লোকটি বলল, দাঁড়াও এক মিনিট, আমি আসছি।

সে একবার ফিরে এল কাকাবাবুদের ঘরটার কাছে।

তারপর আবার দৌড়তে দৌড়তে ফিরে গিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ল লঞ্চে।

লঞ্চটা এগিয়ে গেল মাঝনদীর দিকে।

সেই সাহেবের মতন লোকটি ওপরের ডেকে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ওস্তাদের সঙ্গে। হঠাৎ জলে ঝপাং করে একটা জোর শব্দ হল।

কে যেন বলল, এই রে, ময়না নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। লঞ্চ থামাব? না হলে তো ও মরবে!

ওস্তাদ বলল, না, লঞ্চ থামাতে হবে না। মরুক ময়না!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress