হঠাৎ সব কেন চুপচাপ
দেবলীনা বলল, হঠাৎ সব কেন চুপচাপ হয়ে গেল বলো তো? সবাই চলে গেল নাকি?
কাকাবাবু বললেন, চলে গেলেও আবার ফিরে আসবে।
দেবলীনা বলল, তুমি কী করে জানলে যে ফিরে আসবে?
কাকাবাবু বললেন, ওই যে ওস্তাদ নামে লোকটা বলে গেল, আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না, মেরে ফেলবে? মারার জন্যই আবার আসবে নিশ্চয়ই!
তখন তুমি কী করবে?
সে তখন দেখা যাবে! এ পর্যন্ত তো কতবার কতজন আমাকে খুন করতে চেয়েছে, কেউ তো শেষ পর্যন্ত পারেনি!
তোমার গায়ে কখনও গুলিও লাগেনি?
একবার লেগেছিল, বাঁ কাঁধে। সে এমন কিছু নয়।
কাকাবাবু, তুমি সত্যি-সত্যি ম্যাজিক জানো?
একটু-আধটু জানি তো বটেই। কিন্তু কেউ সত্যি সত্যি সোজাসুজি বুকে গুলি চালালে ম্যাজিক দিয়ে তা আটকানো যায় না। কিন্তু আমি অন্য কথা ভাবছি। তুই একটু আগে বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ শুনেছিস?
হ্যাঁ, শুনেছি।
একটা লঞ্চের শব্দও শুনেছি। তবে কি ওরা বাচ্চাগুলোকে এখান থেকে নিয়ে গেল?
তা হতে পারে!
ময়নার ছেলেকে আর ওরা ফেরত চায় না। ময়না যতই কান্নাকাটি করুক, ওরা গ্রাহ্য করবে না। কী সাঙ্ঘাতিক লোক! ময়নার স্বামীই বা কোথায় গেল? সে হয়তো অন্য জায়গায় আছে।
আমার একটা অন্য কথা মনে হচ্ছে।
এই বলে দেবলীনা বসে পড়ল খাটিয়ায়। ময়না যে ঘটিটা রেখে গেছে, তার থেকে একটু জল খেয়ে নিয়ে বলল, আমাদের কোনও খাবার দেয়নি। যদি ওরা আর ফিরে না আসে? আমাদের না খাইয়ে মারতে চায়?
কাকাবাবু দেওয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, সেটা ওদের পক্ষে বোকামিই হবে! না খেয়েও কি আমরা সহজে মরব?
দেবলীনা বলল, আমি না খেয়ে অনেকদিন থাকতে পারি। একবার পিসির ওপর রাগ করে দেড়দিন খাইনি।
কাকাবাবু বললেন, দেড়দিন, না এক বেলা?
দেবলীনা জোর দিয়ে বলল, দেড়দিন! দেড়দিন! শনিবার বিকেল থেকে রবিবার রাত্তির পর্যন্ত। ভাত-টাত কিছু খাইনি, শুধু চকোলেট!
কাকাবাবু বললেন, এখানে চকোলেটই বা কোথায় পাবে বলো! তা ছাড়া, বাড়িতে খাবার আছে, তুমি রাগ করে খাচ্ছ না, সেটা তবু পারা যায়। কিন্তু খাবার নেই ভাবলেই খিদে পায় খুব। আমার তো এর মধ্যেই বেশ খিদে পাচ্ছে!
দেবলীনা বলল, তুমি তো সারাদিন কিছুই খাওনি!
কাকাবাবু বললেন, কাল রাত্তিরেও খেয়েছি বলে মনে পড়ছে না। আমারও দেড়দিন হয়ে গেল। এই জায়গাটা যে কোথায়, তা এখনও বুঝতে পারছি না। কাছাকাছি মানুষজন নেই?
তিনি দরজাটার কাছে গিয়ে একবার ধাক্কা দিলেন।
তারপর ওপরের দিকে তাকিয়ে বললেন, দরজাটা শক্ত। জানলাটা অনেক উঁচুতে। টালির ছাদ ভেঙেও তো বেরনো যাবে না।
দেবলীনা বলল, আমার কিন্তু বেশ মজা লাগছে। এর পর কী হবে, কিছুই জানি না! সন্তু-জোজোরাও জানে না আমাদের কথা।
কাকাবাবু নাক দিয়ে বড় বড় শ্বাস নিয়ে বললেন, কীসের যেন পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি। দেবলীনা, হঠাৎ খুব গরম লাগছে না?
দেবলীনা বলল, কাকাবাবু, ওই দ্যাখো আগুন!
কাকাবাবু তাকিয়ে দেখলেন, যে-জানলাটা বন্ধ ছিল, সেখান দিয়ে লকলক করছে আগুনের শিখা। জানলাটা পুড়ছে। আগুনের শিখা টালির চালের একদিকেও দেখা যাচ্ছে।
কাকাবাবুর মুখোনা উৎকট গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি বুঝে গেলেন ওস্তাদের মতলব। তাঁদের আগুনে পুড়িয়ে মারবে ঠিক করেছে। তা হলে আর খুন মনে হবে না, মনে হবে দুর্ঘটনা।
ইটের দেওয়ালে সহজে আগুন লাগার কথা নয়। নিশ্চয়ই কেরোসিন ছিটিয়ে দিয়েছে। টালির ছাদ বাঁশের পাল্লা দিয়ে বাঁধা থাকে, সেখানে সহজেই আগুন ধরে যাবে, তারপর ছাদ ভেঙে পড়বে মাথায়!
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘরের একটা দিক দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল।
এতক্ষণে ভয় পেয়েছে দেবলীনা, সে কাকাবাবুকে জড়িয়ে ধরল, বিবর্ণ হয়ে গেছে তার মুখ।
এরকম অবস্থায় কাকাবাবু আগে কখনও পড়েননি। শেষপর্যন্ত খাঁচায় বন্দি প্রাণীর মতন আগুনে পুড়ে মরতে হবে!
দেবলীনাকে অন্তত যে-কোনও উপায়ে বাঁচাতেই হবে।
আর বেশিক্ষণ সময়ও পাওয়া যাবে না। তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, দেবলীনা, ভয় পাসনি। মাথা ঠিক রাখ, আমি ব্যবস্থা করছি।
তিনি খাটিয়াটা তুলে আছাড় মারতে লাগলেন মেঝেতে। কয়েকবার জোরে আছাড় মারার পর একটা পায়া খুলে এল।
সেটা হাতে নিয়ে তিনি চলে এলেন অন্য জানলাটার কাছে। দেবলীনাকে বললেন, এবারে তুই আমার কাঁধের ওপর উঠে দাঁড়া। দেবলীনা কাকাবাবুর গা বেয়ে কাঁধে উঠে গেল।
কাকাবাবু বললেন, জানলাটা ধরেছিস তো? এবার তুই খাটিয়ার পায়াটা দিয়ে মেরে মেরে ছাদের টালি ভাঙার চেষ্টা কর। আগুন এখনও এদিকে আসেনি। একটা টালি ভাঙতে পারলেই অন্যগুলো আলগা হয়ে যাবে।
দেবলীনা গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে টালিতে আঘাত করতে লাগল। খুব বেশি চেষ্টা করতে হল না, ভেঙে পড়ল একটা টালি। কাকাবাবু ব্যস্তভাবে বললেন, আর দেরি করিস না। তুই ছাদ দিয়ে গলে গিয়ে পাশের গাছটা দিয়ে নেমে পড়!
দেবলীনা ছাদের ওপর উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, তুমি কী করে ওপরে উঠবে?
কাকাবাবু জানলার কাছ থেকে সরে এসে বললেন, আমি অন্য ব্যবস্থা করছি, তুই নেমে পড় শিগগির!
দেবলীনা বলল, না, তুমি না এলে আমি যাব না!
কাকাবাবু বললেন, পাগলামি করিস না। দরজাটায় আগুন লাগলে আমি তার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যাব। তুই নেমে গিয়ে দরজাটার কাছে গিয়ে দ্যাখ, ওটা এখনও খোলা যায় কি না!
দেবলীনা বলল, আমি যদি খুলতে না পারি? যদি তার আগেই ছাদ ভেঙে পড়ে?
কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, যা বলছি, তাই শোন! বাইরে অন্য লোক থাকতে পারে, তোকে যেন কেউ দেখতে না পায়। গাছটা ধরেছিস? নামতে শুরু করেছিস?
হুড়মুড় করে একদিকের ছাদ ভেঙে পড়ল।
ইটের দেওয়াল সহজে ভাঙবে না, ছাদই ভাঙবে। কাকাবাবু মাথা বাঁচিয়ে এগিয়ে গেলেন দরজাটার দিকে। কাঠের দরজাটায় সবে. আগুন লেগেছে। দেবলীনা পৌঁছবার আগেই যদি দরজাটা পুরোপুরি জ্বলে ওঠে, তা হলে আর সে কাছাকাছি আসতে পারবে না।
কাকাবাবু ঠিক করলেন, সেই জ্বলন্ত দরজার মধ্য দিয়েই তিনি লাফিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন, তাতে শরীর খানিকটা ঝলসে গেলেও বাঁচার আশা থাকবে।
তার আগেই দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল। কাকাবাবু সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে পড়লেন বাইরে। উঠে দাঁড়াবার আগেই একটা মেয়ে তাঁর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল দূরে।
সেই মুহূর্তেই ভেঙে পড়ল ছাদ।
দেবলীনাও অন্যদিক থেকে এসে পৌঁছে বলল, এ তো ময়না!
ময়নার সারা গা, পরনের শাড়ি জবজবে ভেজা। সে ব্যাকুলভাবে বলল, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেবেন তো? আমি আপনাদের জন্য ফিরে এসেছি।
জ্বলন্ত বাড়িটা থেকে সবাই সরে এল দূরে।
দেবলীনা বলল, আমি জানতাম, কাকাবাবর সঙ্গে থাকলে ঠিক বেঁচে যাব।
সে কথায় কান না দিয়ে কাকাবাবু ময়নাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাচ্চাগুলো কোথায়?
ময়না বলল, তাদের নিয়ে গেছে।
কাকাবাবু বললেন, কোথায়?
ময়না বলল, তা জানি না। লঞ্চে নিয়ে গেল। আমি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে এসেছি!
কাকাবাবু সমস্ত মুখটা কুঁচকে বললেন, ইস! ধরা গেল না! এখন কী করা যায়? সামনে একটা নদী দেখছি। এটা কী নদী?
ময়না বলল, রায়মঙ্গল।
কাকাবাবু বললেন, তার মানে এটা সুন্দরবনের একটা দ্বীপ। এখান থেকে যাওয়া যাবে কী করে?
ময়না বলল, সকালবেলা কোনও নৌকো গেলে ডাকতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, তার মানে এখানে বসে থাকতে হবে সারা রাত? ছি ছি ছি ছি!
দেবলীনা বলল, দূরে একটা কীসের আলো দেখা যাচ্ছে?
কাকাবাবু দেখলেন, অন্ধকার নদীর বুকে দেখা যাচ্ছে একটা লঞ্চের সার্চ লাইট। সেটা আসছে এদিকেই।
কাকাবাবু বললেন, ওটা কাদের লঞ্চ? ওস্তাদদের নাকি?
ময়না বলল, সেটার তো অনেক দূরে চলে যাওয়ার কথা। কিংবা ফিরেও আসতে পারে। রাত্তিরে এদিক দিয়ে অন্য লঞ্চ চলে না।
দেবলীনা বলল, হয়তো দামি কোনও জিনিস ফেলে গেছে।
ময়না বলল, আমাকে ধরার জন্যও আসতে পারে।
কাকাবাবু বললেন, লঞ্চটা যে এখানেই আসছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গাছপালার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে থাকো। দেখা যাক।
সেই বাড়িটায় এখনও আগুন জ্বলছে। কাছে এক জায়গায় অনেক কাঠ জমা করা ছিল, সেখানেও ছড়িয়ে পড়েছে আগুন।
ধক ধক শব্দ করতে করতে লঞ্চটা এসে থামল এই দ্বীপে। সঙ্গে সঙ্গে কেউ নামল। কারা যেন কথা বলছে। সার্চ লাইটটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা হচ্ছে চতুর্দিকে।
দেবলীনা ফিসফিস করে বলল, কাকাবাবু, ওই লঞ্চে সন্তু আছে, আমি গলা চিনতে পেরেছি।
ময়না বলল, এটা পুলিশের লঞ্চ। সার্চ লাইটের রেখা আবার এদিকে আসতেই কাকাবাবু দুহাত তুলে উঠে দাঁড়ালেন।
সঙ্গে সঙ্গে সন্তু আর জোজোর উল্লাসধ্বনি শোনা গেল। এবার ওরা লঞ্চ থেকে নেমে ছুটে এল এদিকে।
কাকাবাবু দাঁড়িয়ে রইলেন এক জায়গায়।
সন্তু আর জোজো তাঁকে ডাকতে ডাকতে আসছে, তিনি যেন তা শুনতেও পেলেন না। তাকিয়ে রইলেন, ওদের পেছনে রফিকুল আলমের দিকে।
তিনি কাছে আসতেই কাকাবাবু বললেন, আশ্চর্য! যতসব অপদার্থের দল।
রফিকুল কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, কেন, কিছু ভুল করে ফেলেছি?
কাকাবাবু বললেন, এলেই যখন, আর একটু আগে আসতে পারোনি? পাখি উড়ে গেল। সব ব্যাটা পালিয়েছে, বাচ্চাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে গেছে।
সন্তু বলল, যাঃ! পালিয়ে গেছে? কীসে করে গেল?
ময়না বলল, লঞ্চে। ওদের নিজেদের লঞ্চ আছে।
সন্তু বলল, আপনি এখন আর ওদের দলে নেই?
রফিকুল জিজ্ঞেস করলেন, কতক্ষণ আগে গেছে? ময়না বলল, অন্তত আধঘণ্টা তো হবেই!
রফিকুল সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে বললেন, সবাই এক্ষুনি উঠে পড়ুন। আমাদের লঞ্চের স্পিড অনেক বেশি। এখনও ওদের ধরে ফেলতে পারি।
দুমিনিটের মধ্যে ছেড়ে দিল পুলিশের লঞ্চ। আগের লঞ্চটা কোন দিকে গেছে, তা দেখিয়ে দিল ময়না।
রফিকুল বললেন, কাকাবাবু, দৈবাৎ সন্তুদের সঙ্গে দেখা না হয়ে গেলে আমি কিছুই জানতে পারতাম না।
সন্তু বলল, সব কৃতিত্ব মামুনভাইয়ের। ইনিই তো জায়গাটা চিনিয়ে দিলেন।
কাকাবাবু বললেন, ওসব কথা পরে শুনব। এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে। না। আগে দেখা যাক, কার্য উদ্ধার করা যায় কি না।
সবাই দাঁড়িয়ে রইল লঞ্চের সামনের দিকে। কেউ কোনও কথা বলছে না। কিছুক্ষণ পরেই একটা লঞ্চ দেখা গেল দূরে।
রফিকুল একটা চোঙা মুখে দিয়ে বলল, পুলিশ বলছি। সারেন্ডার করো। সারেন্ডার। পুলিশ।
লঞ্চটা অমনই দাঁড়িয়ে গেল।
এই লঞ্চটা খানিকটা এগিয়ে যেতেই ময়না বলল, এটা ওদের নয়। ওদেরটার নাম সাংগ্রিলা।
অন্য লঞ্চের সারেংয়ের কাছ থেকে জানা গেল যে, সমুদ্রের মোহনার দিকে আর-একটা লঞ্চকে সে যেতে দেখেছে কিছুক্ষণ আগে।
রফিকুল বললেন, সমুদ্রে পড়লেও এ লঞ্চ নিয়ে তো মুম্বই যেতে পারবে না। মাঝপথে কোথাও নেমে গাড়িতে উঠকে৷ তার আগেই ধরতে হবে ওদের।
কাকাবাবু বললেন, স্পিড বাড়াতে বলো!
রফিকুল বললেন, যদি ওরা টের পেয়ে যায় যে, আমরা ফলো করছি, তা হলে কোনও খাঁড়িতে ঢুকে পড়বে। তাতে খুঁজে পাওয়া শক্ত হবে।
কাকাবাবু বললেন, দরকার হলে সারারাত প্রত্যেকটা খাঁড়ি খুঁজে দেখতে হবে। ওদের কিছুতেই পালাতে দেওয়া হবে না।
এর পর যে লঞ্চটি দেখতে পাওয়া গেল, সেটি বেশ আস্তে-আস্তেই যাচ্ছে। পুলিশ যে তাদের তাড়া করতে পারে, তা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি।
এবারেও রফিকুল একটা চোঙায় মুখ দিয়ে পুলিশের নাম করে সারেন্ডার করতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে ওদিক থেকে একঝাঁক গুলি ছুটে এল।
রফিকুল বললেন, কাকাবাবু, শুয়ে পড়ুন, শুয়ে পড়ুন। সন্তু, তোমরাও। এবার ব্যাটাদের পাওয়া গেছে!
ডেকের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে কাকাবাবু বললেন, তোমার সঙ্গে কজন পুলিশ আছে?
রফিকুল বললেন, পাঁচজন। এদের খুব ভাল ট্রেনিং আছে। আজ সকালেই কজন ব্যাঙ্ক-ডাকাতকে কাবু করেছি।
কাকাবাবু বললেন, তোমাদের পুলিশদের হাতে তো মান্ধাতার আমলের রাইফেল। স্মাগলারদের কাছে অনেক আধুনিক অস্ত্র থাকে। সাব মেশিনগান থাকলে আমরা পারব না ওদের সঙ্গে।
দুপক্ষেই গুলিচালনা শুরু হয়ে গেছে। ওদিক থেকে শুধু বন্দুক-রিভলভারের গুলির শব্দই শোনা যাচ্ছে। ওদের সাব মেশিনগান থাকলে এতক্ষণ পুলিশের লঞ্চ ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
রফিকুল এক-একবার মাথা তুলে নিজের রিভলভার দিয়ে গুলি চালিয়েই আবার লুকোচ্ছেন একটা ট্যাঙ্কের আড়ালে।
মিনিট পাঁচেক পরই তিনি বললেন, কাকাবাবু, ওদের ফায়ার পাওয়ার কম। বোধ হয় দু-তিনটের বেশি বন্দুক নেই। এর মধ্যে কয়েকজন জখম হয়েছে মনে হচ্ছে, কেউ কেউ নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছে।
জোজো বলল, ওরা পালাবে? ধরা যাবে না?
রফিকুল বললেন, এতবড় নদী, জোয়ারের সময় দারুণ স্রোত, তার ওপর কুমির আর কামঠ আছে। কামঠ মানে ছোট ছোট হাঙর, পা কেটে নেয়।
কাকাবাবু বললেন, ওদের ধরার জন্য এখন চিন্তা করতে হবে না। বাচ্চাগুলোকে উদ্ধার করাই বড় কথা।
ওদিকের লঞ্চের গুলিচালনা হঠাৎ থেমে গেল।
পুলিশের লঞ্চটা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। রফিকুল আবার চোঙা নিয়ে বললেন, পুলিশ থেকে বলছি। সারেন্ডার। অস্ত্র ফেলে দাও, নইলে সবাই মরবে।
এবার ওদিক থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল, আপনারা গুলি চালানো বন্ধ করুন। আমার কথা শুনুন!
সার্চ লাইট ফেলে দেখা গেল, ডেকের ওপর আহত হয়ে কাতরাচ্ছে ফরসা সাহেবের মতন লোকটি। আর ওস্তাদ দাঁড়িয়ে আছে, তার বুকে চেপে ধরে আছে একটা পাঁচ-ছ বছরের বাচ্চা ছেলেকে, তার একটা কানের মধ্যে গোঁজা রিভলভারের নল।
সে বলল, আমি জানের পরোয়া করি না। মরব, তবু ধরা দেব না। কিন্তু তার আগে, তোমরা একটা গুলি চালালেই আমি এই বাচ্চাটাকে খতম করব। কিংবা, তোমাদের গুলিতে ও আগে মরবে!
বাচ্চাটা ঠিক বুঝেছে, তীব্র স্বরে কেঁদে উঠল।
রফিকুল জিজ্ঞেস করলেন, কাকাবাবু, কী করব?
কাকাবাবুর মুখোনা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তিনি আস্তে-আস্তে বললেন, ওরা পারে! ওরা বাচ্চাদেরও মেরে ফেলতে পারে।
রফিকুল বললেন, ঝুঁকি নিতে পারি। একটা বাচ্চা যদি যায়ও, অন্যগুলো বেঁচে যাবে।
কাকাবাবু বললেন, না, না, না, আমি একটা বাচ্চারও মৃত্যু সহ্য করতে পারব। ছেড়ে দাও! তবু তো বাচ্চারা আরও কিছুদিন অন্তত বেঁচে থাকতে পারবে!
রফিকুল বললেন, ছেড়ে দেব?
এদিক থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে ওস্তাদ আবার বলল, আমাদের পিছু ধাওয়া করতে পারবে না। তা হলে আমি নিজে মরার আগে সব কটা বাচ্চাকে খতম করব, তোমাদের হাতে তুলে দেব না কিছুতেই।
রফিকুল কিছু বলতে পারলেন না।
ওস্তাদ হাঃ হাঃ করে জয়ের হাসি হেসে বলল, সারেংসাহেব, চালাও!
পুলিশের লঞ্চটা থেমে রইল। অন্য লঞ্চটা চলতে শুরু করল। দূরে সরে যাচ্ছে, দূরে সরে যাচ্ছে। কাকাবাবু একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন সেদিকে।
রফিকুল বললেন, আমার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। এত কাছে। পেয়েও—
কাকাবাবু বিদ্যুদ্বেগে রফিকুলের হাত থেকে রিভলভার কেড়ে নিয়ে গুলি চালালেন। অব্যর্থ লক্ষ্য। ওস্তাদ সামান্য পাশ ফিরে ছিল, গুলি খেয়ে দড়াম করে পড়ে গেল!
কাকাবাবু রিভলভারটা ধরে রেখে বললেন, মনে হচ্ছে আর কেউ বাকি নেই। আমি মানুষ মারতে চাই না। দ্যাখো তো, ও লোকটা এখনও বেঁচে আছে কি না!
পুলিশের লঞ্চটা অন্য লঞ্চটার গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
সন্তু, জোজো, মামুনরা লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেল সেই লঞ্চে। ওস্তাদের বুকে-ধরা বাচ্চাটা আছড়ে পড়েছে মাটিতে, কিন্তু তার গায়ে গুলি লাগেনি। ওস্তাদের হাতের রিভলভারটা ছিটকে পড়ে গেছে খানিকটা দূরে। সে যন্ত্রণায় চিৎকার করছে আহত পশুর মতন। সেই অবস্থাতে এদিক-ওদিক খুঁজছে রিভলভারটা।
সন্তু সেটা দেখতে পেয়ে পা দিয়ে চেপে রইল।
ওস্তাদ ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে সন্তুর পায়ের কাছে এসে কাতরভাবে বলল, আমায় মেরে ফেলো! আর-একটা গুলি চালাও! আমি ধরা দিতে চাই না।
সন্তু রিভলভারটা ঠেলে দিল পেছনে। রফিকুল আলম কাকাবাবুর কাছে এসে বললেন, ওঃ, কী সাঙ্ঘাতিক টিপ আপনার! তবে, এবারেও মানুষ মারেননি। ওস্তাদের ঠিক ডান কাঁধে গুলি লেগেছে, চিকিৎসা করলে বেঁচে যাবে।
বাচ্চাটা দারুণ কাঁদছে, তাকে কোলে তুলে নিয়েছে ময়না। আদর করে, চুমো দিয়ে চেষ্টা করছে কান্না থামাতে।
একটু পরে সে কাকাবাবুর কাছে এসে বলল, দেখুন, দেখুন, এই বাচ্চাটাকে অনেকটা আমার কেতোর মতন দেখতে। মুখের খুব মিল আছে।
কাকাবাবু আস্তে-আস্তে বললেন, এর মা যখন কাঁদে, তখন তাকেও বোধ হয় তোমার মতনই দেখায়!