খাবারের তালিকা দেখে
খাবারের তালিকা দেখে জোজো খুব নিরাশ হয়ে গেল।
চিংড়ি মাছ তো নেই-ই, কোনওরকম মাছ-মাংসই পাওয়া যাবে না। এই হোটেলে সবই নিরামিষ। ইডলি, বোসা, সম্বর এইসব, ভাতও আছে।
কাকাবাবু বললেন, এবেলা এইসবই খেয়ে দেখা যাক। বাইরে অনেক রেস্তরাঁ আছে। রাত্তিরে সেরকম কোনও জায়গা থেকে খেয়ে এলেই হবে।
সন্তু বলল, আমি ধোসা খুব পছন্দ করি।
খাবারগুলোর বেশ স্বাদ আছে। ভাতের সঙ্গে একটা তরকারি ছিল, টক-টক-ঝাল-ঝাল, চমৎকার খেতে। জোজো তিনবার চেয়ে নিল সেই তরকারি।
সন্তু মাঝে মাঝে চোরা চোখে দেখছে কোণের টেবিলটা, বড় জুলপিওয়ালা লোকটি এদিকেই তাকিয়ে আছে, তার সঙ্গীদের কী যেন বলছে ফিসফিস করে।
সন্তুদের খাওয়া শেষ হওয়ার পরেও ওরা বসে রইল।
হাত ধুয়ে ওপরে উঠে আসার পর কাকাবাবু বললেন, তোরা দুজনে গড়িয়ে নিতে চাস তো নে। আমাকে কয়েকটা ফোন করতে হবে।
কাকাবাবু ব্যাগ থেকে নোটবইটা খুঁজতে লাগলেন। এই সময় দরজায় টক টক শব্দ হল।
সন্তু দরজা খুলে অবাক হলেও মুখে কোনও ভাব দেখাল না।
সেই বড় জুলপিওয়ালা লোকটি ও আর দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।
বড়জুলপি হিন্দিতে বলল, একটু ভেতরে আসতে পারি? তোমার আঙ্কেলের সঙ্গে দুটো-একটা কথা বলতে চাই।
সন্তু দরজার পাশ থেকে সরে দাঁড়াল।
প্রথমে বড়জুলপি ভেতরে ঢুকে কাকাবাবুর দিকে হাত তুলে নমস্কার করে খুব বিনীতভাবে বলল, সার, খুবই দুঃখিত, অসময়ে এসে আপনাকে ডিসটার্ব করলাম। হয়তো এখন বিশ্রাম নিতেন। খুব বিপদে পড়ে আপনার সাহায্য চাইতে এসেছি। যদি অনুমতি করেন—
কাকাবাবু বললেন, না, না, ঠিক আছে। বসুন। কী ব্যাপার বলুন।
ঘরে একটিমাত্র চেয়ার। বড়জুলপি বসল সেখানে। অন্য দুজন খাটে।
বড়জুলপি পকেট থেকে এখটা কার্ড বার করে বলল, সার, আমার নাম এস প্রসাদ। আমি একটা ফিল্ম কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার। বম্বে থেকে এসেছি। এখানে আমাদের একটা হিন্দি ফিমের শুটিং চলছে। সেই ব্যাপারে আপনার একটু সাহায্য চাই।
কাকাবাবু বললেন, ফিল্মের শুটিংয়ের ব্যাপারে আমি কী সাহায্য করব তা তো বুঝতে পারছি না?
প্রসাদ বলল, আপনার সঙ্গে যে ছেলেদুটি এসেছে, এদের একজনকে পেলে বড় উপকার হয়।
সে জোজোর দিকে ফিরে তাকাল।
কাকাবাবু বললেন, ও কী করবে?
সে বলল, ব্যাপারটা কী হয়েছে, একটু খুলে বলি। আজকের রাত্তিরের শুটিংয়ে এই ছেলেটির বয়েসি একটি ছেলের পার্ট আছে। যে ছেলেটির সেই পার্ট করার কথা, আজ সকাল থেকে তার কলেরা শুরু হয়ে গেছে, তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছে। সে কিছুতেই পারবে না। শুটিং বন্ধ রাখলে আমাদের বহু টাকা লোকসান হয়ে যাবে। তাই বলছিলাম কী, এই ছেলেটি যদি পার্টটা করে দেয়, তা হলে বেঁচে যাই। ওই পার্টে ওকে খুব মানাবে।
কাকাবাবু হেসে ফেলে বললেন, ও, এই ব্যাপার! তা হলে ওকেই জিজ্ঞেস করা যাক। কী হে জোজো, সিনেমায় পার্ট করবে নাকি?
জোজো গম্ভীরভাবে বলল, কী ধরনের পার্ট আগে শুনি?
প্রসাদ বলল, হিরোইন একটা খুঁটিতে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকবে। রাত্তিরে ডাকাতের দল ঘুমোবে। শুধু পাহারায় থাকবে একজন। তুমি পেছন দিক দিয়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে আসবে। পাহারাদারটাও ঝিমোচ্ছে। তুমি হিরোইনের বাঁধন খুলে দেবে। তারপর তার হাত ধরে দৌড়াবে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দৌড়বে দৌড়বে। কাট। ব্যস, তারপর হিরো ঘোড়ায় চড়ে এসে হিরোইনকে তুলে নেবে।
জোজো অবজ্ঞার সঙ্গে ঠোঁট উলটে বলল, এইটুকু পার্ট! এর মধ্যে আমি নেই।
প্রসাদ বলল, একটু করে দাও না ভাই!
জোজো বলল, হলিউড থেকে স্পিলবার্গ কতবার আমাকে অনুরোধ করেছে। আমি বলেছি, ছোট পার্ট কক্ষনও করব না। যদি সিনেমায় পার্ট করতেই হয়, প্রথমেই হিরো হব।
প্রসাদ বলল, তোমার বয়েসে তো হিরো হতে পারবে না। আগে ছোটখাটো পার্ট করার পরই হিরো হতে পারবে। এটায় যদি তোমার পাৰ্ট চোখে লেগে যায়—
জোজো বলল, না, না, যারা ছোটখাটো পার্ট করে, তারা চিরকালই ছোটই থেকে যায়।
প্রসাদের সঙ্গী একজন বলল, টাকার কথাটা বলো।
প্রসাদ বলল, মাত্র একদিনের শুটিং, তিন-চার ঘণ্টা, তার জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হবে।
জোজো তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, টাকার দরকার নেই আমার। হলিউডে ওইটুকু পার্ট করলে পাঁচ লাখ টাকা দেয়, সেটাই আমি নিইনি—
লোকটি আরও কয়েকবার অনুরোধ করল, জোজো কানই দিল না।
তখন সে সন্তুর দিকে ফিরে বলল, তা হলে তুমি করে দেবে পার্টটা? তোমাকে দিয়েও চলবে।
সন্তু বলল, আ-আ-আমি তো-তো-তো-তোতলা। ক-ক-ক-কথা বলতেই পা-পা-পা-পারি না!
প্রসাদ একটু চমকে গেলেও বলল, তাতে ক্ষতি নেই। ডায়ালগ খুব কম। পরে ডাব করে নেওয়া যেতে পারে।
সন্তু বলল, আ-আ-আ-আমার ভ-ভ-ভয় করে। ক্যা-ক্যা-ক্যামেরা দেখলেই ভ-ভ-ভয় করে।
প্রসাদ কাকাবাবুর দিকে তাকাল।
কাকাবাবু বললেন, ওরা রাজি না হলে আর আমি কী করতে পারি বলুন! আমাকে দিয়ে তো আর ওই পার্ট হবে না। লোক তিনটি নিরাশ হয়ে চলে গেল।
দরজা বন্ধ করার পরই কাকাবাবু হো-হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন, শেষ পর্যন্ত এই? সিনেমায় পার্টের ব্যাপার। ওরে সন্তু, তোর ওই বড়-জুলপিওয়ালাটা তো নিরীহ সিনেমার লোক!
সন্তু জোজোকে বলল, তুই রাজি হলি না কেন রে? আমরা বেশ শুটিং দেখতে যেতাম।
জোজো বলল, ওইসব এলেবেলে পার্ট আমি করি না।
সন্তু বলল, হিরোইনের সঙ্গে পার্ট ছিল। হিরোইনের হাত ধরে দৌড়োতি। তাতেই লোকে তোকে হিরো বলত!
জোজো বলল, তোকেও তো বলেছিল। তুই নিলি না কেন? তুই হঠাৎ তোতলা সাজতে গেলি?
সন্তু বলল, পাঁচ হাজার টাকা পেলে আমার ভালই হত। রাজি হতাম। কিন্তু লোকটা আগে তোকে বলেছে, আমায় তো বলেনি! সেইজন্যই আমার রাগ হয়ে গেল।
কাকাবাবু বললেন, আমায় তো পার্ট দিতে চাইলই না। কলেজে পড়ার সময় দু-তিনবার নাটকে অভিনয় করেছি! খোঁড়া লোককে আর কে চান্স দেবে!
কাকাবাবু এবার টেলিফোন তুলে একটা লাইন চাইলেন।
একটু পরে অপারেটর জানাল যে, নম্বরে নিশ্চয়ই কিছু ভুল আছে। কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
কাকাবাবু বললেন, ভুল আছে? এঁর নাম আবু তালেব, ইতিহাসের অধ্যাপক। আমাকে দু-তিনবার ফোন করেছেন এখান থেকে, নিজে এই নম্বর দিয়েছেন। তা হলে কি নম্বর বদলে গেল?
অপারেটর জানালেন, টেলিফোন বইতে আবু তালেবের নাম নেই।
কাকাবাবু বললেন, মুশকিল হল, লোকটিকে খুঁজে পাব কী করে?
তিনি বললেন, আর একটা নম্বর দেখুন। বিক্রমন নায়ার। ইনি একজন সাংবাদিক। এটা ওঁর বাড়ির ফোন।
এবারে রিং হল বটে। কিন্তু একজন কেউ ধরে বলল, এখানে বিক্রমন নায়ার নামে কেউ থাকে না।
কাকাবাবু খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে রইলেন। তারপর একজন পুলিশ অফিসারের নম্বর দিলেন, তাতেও কোনও লাভ হল না, সাড়া পাওয়া গেল না।
কাকাবাবু বললেন, এখানকার সব টেলিফোন নাম্বার বদলে গেল নাকি? এরাই বলতে গেলে আমাকে ডেকে এনেছে। এদের দু-একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার।
ক্রাচ দুটো নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি সন্তুদের বললেন, এই গরমে তোদের আর বেরোতে হবে না। আমি একটু ঘুরে আসছি।
নীচে এসে তিনি অ্যান্টনিকে বললেন, চলো তো এখানকার বড় থানায়।
গরমের জন্য রাস্তা একেবারে সুনসান। থানার সামনেও বেশি লোকজন নেই।
কাকাবাবু সোজা ভেতরে ঢুকে গেলেন, কেউ বাধা দিল না। বড়সাহেবের ঘরের দরজা খোলা, সেখানে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভেতরে আসতে পারি?
কাকাবাবুর চেহারাতেই এমন একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে যে কেউ তাঁকে সাধারণ মানুষ মনে করে না। অফিসারটি বললেন, হ্যাঁ, আসুন, বসুন।
কাকাবাবু ভেতরে এসে বললেন, নমস্কার। সার্কল অফিসার বাসুদেবন-এর সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি?
অফিসারটি বললেন, কোন বাসুদেবন?
কাকাবাবু বললেন, এস কে বাসুদেবন।
অফিসারটি বললেন, ওই নামে তো এখানে কেউ নেই।
কাকাবাবু বললেন, নেই? তা হলে কি ট্রান্সফার হয়ে গেছেন? আমি পনেরোদিন আগেও টেলিফোনে কথা বলেছি।
অফিসারটি বললেন, আমি এখানে আড়াই বছর আছি। ওই নামে কোনও সার্কল অফিসার কিংবা কোনও অফিসারই ছিল না। আপনি যার সঙ্গে কথা বলেছেন, সে কি পুলিশ হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছে?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। ফোন করেছেও থানা থেকে। বেশ কয়েকবার।
অফিসারটি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?
কাকাবাবু নাম বললেন, পরিচয় দিলেন। অফিসারটি চিনতে পারলেন না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি ওই বাসুদেবন নামের লোকটিকে কখনও এই থানায় ফোন করেছেন কলকাতা থেকে?
কাকাবাবু বললেন, না, তা অবশ্য করিনি। উনি নিজেই করতেন।
অফিসারটি খুবই কৌতূহলী হয়ে বললেন, ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। একজন লোক মিথ্যে পরিচয় দিয়ে আপনাকে ফোন করেছে। কী মতলব? কী বলেছে আপনাকে?
কাকাবাবু কোনও উত্তর দিলেন না। পকেট থেকে একটা কাগজ বার করলেন। তাতে পনেরোজন লোকের নাম লেখা। সেই কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, দেখুন তো, এঁদের কাউকে আপনি চেনেন কি না?
অফিসারটি দু-তিনবার সেই তালিকায় চোখ বুলিয়ে বললেন, এইসব নামের কোনও লোক কালিকটে থাকে না। আপনি নামগুলোর পাশে পাশে লিখেছেন, কেউ অধ্যাপক, কেউ সাংবাদিক, কেউ ডাক্তার। অন্তত কয়েকজনকে আমার চেনা উচিত ছিল। সাংবাদিকদের প্রত্যেককে চিনি। বিক্রমন নায়ার নামে কোনও সাংবাদিক এখানে থাকে না। তা জোর দিয়ে বলতে পারি।
কাকাবাবু বললেন, আশ্চর্য, বিক্রমন নায়ার নামে একজন আমাকে এখান থেকেই ফোন করেছে।
আর একজন তরুণ পুলিশ অফিসার এই সময় একটা ফাইল নিয়ে ঢুকে টেবিলের কাছে এসে থমকে গেলেন। কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনি…আপনি রাজা রায়চৌধুরী না?
কাকাবাবু মাথা নাড়লেন।
সেই অফিসারটি বললেন, দিল্লিতে নরেন্দ্র ভার্মার বাড়িতে আপনাকে দেখেছি। আমি ওঁর বোনের ছেলে। অর্থাৎ উনি আমার মামা। ওঁর কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। আমার নাম ওম প্রকাশ।
কাকাবাবু বললেন, নরেন্দ্র ভার্মা আমার বিশেষ বন্ধু।
ওম প্রকাশ অন্য অফিসারের দিকে ফিরে বললেন, সার, রাজা রায়চৌধুরী বিখ্যাত লোক। অনেক দারুণ রহস্যের সমাধান করেছেন। বহু অভিযানে গেছেন।
এর একটা ডাকনাম আছে, অনেকেই এঁকে কাকাবাবু বলেন।
অফিসারটি কাকাবাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুশি হলাম। আমার নাম রফিক আলম। আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারলে খুবই খুশি হব।
ওম প্রকাশ বললেন, কাকাবাবু, আপনি কি এখানে কোনও রহস্য সমাধান করতে এসেছেন?
কাকাবাবু এবারে চেয়ারে হেলান দিয়ে হাসলেন।
ওম প্রকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, সেরকম কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি। কিন্তু আসবার পরে খুব ধাঁধায় পড়ে গেছি। কালিকট থেকে বেশ কয়েকজন লোক ফোন করে একটা ব্যাপার জানিয়েছে। ফোন করেছে, চিঠিও লিখেছে। কিন্তু রফিক আলম সাহেব বলছেন, এখানে সেরকম কোনও লোকই নেই। বাসুদেবন নামে একজন লোক এখানকার পুলিশ অফিসার বলে পরিচয় দিয়েছেন।
ওম প্রকাশ কাগজটা নিয়ে নামগুলো পড়তে পড়তে বললেন, আমিও তো এদের কাউকেই চিনি না। বাসুদেবনটা আবার কে?
রফিক আলম বললেন। এই লোকেরা ফোন করে আপনাকে কী বলেছে?
কাকাবাবু বললেন, সে ব্যাপারটা শুনলে হয়তো আপনারা হাসবেন। আমি বম্বের একটা কাগজে ভাস্কো দা গামা সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তাতে অনেকে ধরে নিয়েছে, আমি ভাস্কো দা গামা সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ। সেইজন্যই কালিকট থেকে কয়েকজন লোক বারবার আমাকে একটা কথা জানিয়েছে।
আলম বললেন, সেই কথাটা কী?
কাকাবাবু বললেন, প্রতি বছর এই দিনটাতে নাকি এখানকার বন্দরে ভাস্কো দা গামার ভূত দেখা যায়!
আলম আর প্রকাশ পরস্পরের দিকে তাকালেন।
কাকাবাবু বললেন, জানি, আপনারা ভাবছেন, ভূতের গল্পে বিশ্বাস করে আমি এতদূর ছুটে এসেছি, তার মানে আমি একজন বোকা লোক! বিশ্বাসের কোনও প্রশ্নই নেই। তবে একজন-দুজন নয়, পনেরোজন লোক, তারা সমাজের বিশিষ্ট লোক, এরা সবাই মিলে একই কথা বললে খটকা লাগে না? এরা অনেকেই জানিয়েছে যে, এরাও ভূত-টুতে বিশ্বাস করে না, কিন্তু নিজের চোখে দেখেছে। ভাস্কো দা গামার ভূত। আবার সেই ভূত নাকি বিড় বিড় করে কীসব কথাও বলে।
আলম বললেন, আমরা তো এরকম কখনও কিছু শুনিনি। প্রতি বছর এরকম কিছু ঘটলে পুলিশের কানে আসত না?
প্রকাশ বললেন, যে-লোকগুলোর নাম লিখে এনেছেন, তাদের কোনও অস্তিত্ব নেই। এরাই তো দেখছি আসল ভূত!
আলম বললেন, ফোন নম্বর রয়েছে। ফোন করে দেখা যেতে পারে। আমরা চিনলেও যদি কেউ থাকে।
কাকাবাবু বললেন, কয়েক জায়গায় আমি ফোন করেছি। প্রত্যেকটি নম্বরই ভুল। এখন বোঝা যাচ্ছে, কেউ আমার সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল জোক করেছে। এতবার ফোন করে, চিঠি লিখে এতদূর টেনে এনে বোকা বানিয়েছে।
আলম বললেন, আপনি এখানে আসবার আগে একবার ফোন করে কনফার্ম করেননি?
কাকাবাবু বললেন, না, করিনি। আমি তো জানিই, এ-ভূতের গল্প সত্যি হতে পারে না। হয়তো নকল কাউকে ভূত-টুত সাজায়। এমনিই কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, তাই ভাবলাম, একবার এখানে এসে মজাটা দেখাই যাক না! এখন বুঝতে পারছি, আমাকে নিয়েই অন্য কেউ কেউ মজা করেছে।
আলম বললেন, এবারে একটু চা খাওয়া যাক। যে আপনার সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল জোক করেছে, সে নিশ্চয়ই পরে আপনার সঙ্গে দেখা করে খুব হাসবে।
চা বিস্কুট খেতে খেতে কিছুক্ষণ গল্প হল।
হোটেলে ফিরে কাকাবাবু দেখলেন, সন্তু আর জোজো দিব্যি ঘুমোচ্ছে। তিনি ওদের জাগালেন না। গরম থেকে এসে হোটেলের ঠাণ্ডা ঘরে বেশ আরাম হল, তিনিও শুয়ে পড়লেন।
ঘুম ভাঙল সন্ধেবেলা।
জোজো সবচেয়ে আগে উঠেছে, সে একটা কেক খাচ্ছে।
কাকাবাবুকে চোখ মেলতে দেখে সে বলল, দুপুরে নিরামিষ খেয়েছি তো, তাই খিদে পেয়ে গেল। হোটেলের সামনেই একটা দোকানে কেক পাওয়া যায়। কিনে আনলাম। কেকের মধ্যেও নারকোল। এটা একেবারে নারকোলের দেশ!
সন্তু একটা কেকে কামড় দিয়ে বলল, খেতে খারাপ নয়!
জোজো বলল, কাকাবাবু, দুপুরের স্বপ্ন কি সত্যি হয়?
কাকাবাবু বললেন, দুপুরে স্বপ্ন দেখেছ তুমি?
জোজো বলল, ভাস্কো দা গামাকে স্বপ্ন দেখলাম। একেবারে স্পষ্ট। বন্দরে একটা মস্ত বড় জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। তার ডেকের ওপর একলা ভাস্কো দা গামা, এক হাতে তলোয়ার, সারা গা দিয়ে যেন আগুন বেরুচ্ছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পর্তুগিজ ভাষায় কী যেন বলছে!
কাকাবাবু বললেন, তুমি আগেই দেখে ফেললে? হয়তো তোমার স্বপ্নটা সত্যি হতেও পারে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই কী করে বুঝলি পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলছে? তুই পর্তুগিজ জানিস?
জোজো বলল, ভাস্কো দা গামা পর্তুগিজ ভাষা না বলে কি বাংলা বলবে?
সন্তু বলল, ভূতেরা সব ভাষা জেনে যায়! গল্পে সেরকমই থাকে।
জোজো বলল, কয়েকবার পাঁউ পাঁউ শব্দটা বলছিল। পর্তুগিজ ভাষায় পাউ মানে রুটি, জানিস না? সেই থেকেই আমরা বলি পাউরুটি।
সন্তু বলল, আহা রে, ভূতটার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছিল। না হলে পাউরুটির কথা বলবে কেন?
এমন সময় জানলার কাছে পটাপট শব্দ হতেই সবাই সেদিকে তাকাল।
বৃষ্টি নেমেছে খুব জোরে। সেইসঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া।
কাকাবাবু জানলার কাছে এসে বাইরের বৃষ্টি দেখতে দেখতে বললেন, আঃ বাঁচা গেল, এবার গরমটা আশা করি কমবে।
সন্তু বলল, ভাস্কো দা গামা মে মাসে এসেছিল। এই সাঙ্ঘাতিক গরম সহ্য করেছিল কী করে?
কাকাবাবু বললেন, স্পেন-পর্তুগালে এক-এক সময় খুব গরম পড়ে। ওদের গরম সহ্য করার অভ্যেস আছে।
সন্তু বলল, গরমের মধ্যেও অত জামাকাপড় পরে থাকত?
কাকাবাবু বললেন, অভিজাত লোকদের ওরকম পরতেই হত, না হলে সাধারণ লোকরা তাদের মানবে কেন?
সন্তু বলল, অভিজাত লোকদের বুঝি ঘামে গেঞ্জি ভিজে যায় না?
জোজো বলল, তা তো যায়ই, সেইজন্য ওদের খুব সর্দি হয়। স্বপ্নে দেখলাম, কথা বলতে বলতে ভাস্কো দা গামা কয়েকবার হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করে উঠল!
সন্তু বলল, ভূতের সর্দি!