কাকাবাবু বললেন, আঃ, কী আরাম
দুহাত ছড়িয়ে কাকাবাবু বললেন, আঃ, কী আরাম! চোখ একেবারে জুড়িয়ে গেল। মাথার মধ্যেও কী শান্তি। জানিস সন্তু, এমন সুন্দর দৃশ্যও তেমন ভাল লাগে, যদি মনের মধ্যে কোনও দুশ্চিন্তা থাকে। এবারে সব ঝামেলা চুকে গেছে, আর কোথাও দৌড়োদৌড়ি করতে হবে না!
সন্তুও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। এক-একটা জায়গায় এসে মনে হয়, এমন চমৎকার দৃশ্য যেন পৃথিবীর আর কোথাও নেই। পাহাড়ের চূড়ায় লাইট হাউজ, আর ঠিক যেন পায়ের নীচেই সমুদ্র। পাহাড় এখানে- খাড়া নেমে গেছে। সমুদ্র এখানে একেবারে গাঢ় নীল, যতদূর দেখা যায় আকাশ আর সমুদ্র, শুধু অনেক দূরে একটা সাদা রঙের জাহাজ, এখান থেকে দেখাচ্ছে ছোট্ট, খেলনার মতন।
জোজো বসে আছে একটা পাথরের ওপর। তার বেশ শীত করছে। শহরের মধ্যে এখন বেশ গরম, কিন্তু এখানে হুহু করছে হাওয়া, তাতে কাঁপুনি লাগে। জোজো এমনিতেই শীতকাতুরে, তার এখন সমুদ্র দেখার মন নেই। সে ভাবছে, কতক্ষণে হোটেলে ফিরে যাবে।
এই লাইট হাউজ পাহাড়ে প্রত্যেকদিন সাধারণ মানুষদের আসতে দেওয়া হয়। কাকাবাবুর জন্য বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বেশি লোকজন এসে হল্লা। করলে এমন সুন্দর জায়গাটা এত ভাল লাগত না।
কাকাবাবু বললেন, বিশাখাপত্তনম জায়গাটা এইজন্য আমার খুব পছন্দ, এখানে পাহাড় আর সমুদ্র একসঙ্গে দেখা যায়। ভারতে এরকম জায়গা আর নেই।
সন্তু বলল, এত উঁচু থেকে আগে কখনও সমুদ্র দেখিনি। ঠিক যেন প্লেন থেকে দেখা।
কাকাবাবু জোজোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের জোজো এত চুপচাপ কেন?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী রে জোজো, তুই এরকম পাহাড়ের ওপর থেকে সমুদ্র দেখেছিস আগে?
জোজো বলল, অনেকবার।
জোজো এত সংক্ষেপে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেয় না। সন্তু ভেবেছিল, জোজো বোধ হয় কামস্কাটকা কিংবা উলান বাতোর এই ধরনের কোনও জায়গার নাম বলবে। সে একটু অবাক হল।
কাকাবাবু বললেন, আমরা এখন ভূগোল পড়ে জেনে গেছি, পৃথিবীতে কত সমুদ্র আছে, কোন্ সমুদ্র কত বড়। তবু, এরকম। সমুদ্রের ধারে দাড়ালে মনে হয়, এর যেন শেষ নেই। আদিকালের মানুষদের তো গোটা পৃথিবী সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। কলের জাহাজও আবিষ্কার হয়নি, তখনও যারা নৌকোয় চেপে সমুদ্রে ভেসে পড়েছিল, তারা কত সাহসী ছিল।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, রামায়ণে যে পুষ্পক রথের কথা আছে, সেটা নিশ্চয়ই কল্পনা?
কাকাবাবু বললেন, কল্পনা তো নিশ্চয়ই। পুষ্পক রথ মানে তো এরোপ্লেন। তার আবিষ্কার হয়েছে বলতে গেলে এই তো সেদিন! তার আগে আকাশে ওড়ার কোনও উপায়ই মানুষের জানা ছিল না। তবে কল্পনায় সব সময়েই মানুষ যেখানে ইচ্ছে উড়ে যেতে পারে।
সন্তু বলল, তা হলে বাল্মীকি কী করে আকাশ থেকে সমুদ্র দেখার বর্ণনা লিখলেন?
কাকাবাবু বললেন, বড় বড় কবিরা কল্পনায় অনেক কিছু দেখতে পান। সত্যি, রাম যখন লঙ্কা থেকে সীতাকে নিয়ে পুষ্পক রথে ফিরছেন, তখন আকাশ থেকে সমুদ্রের যা বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে সত্যিই যেন মনে হয়, তিনি নিজের চোখে দেখেছেন।
জোজো উঠে দাড়িয়ে বলল, সন্তু, দ্যাখ তো আমার জ্বর এসেছে কি না।
সন্তু জোজোর কপালে হাত দিল, বুকে হাত দিল। তারপর বলল, কই, না তো?
জোজো বলল, তবে আমার এত শীত করছে কেন? সন্তু বলল, তোর শীত করছে? বাতাস একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা, আমার তো চমৎকার লাগছে। জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর।
জোজো বলল, তা হলে বোধ হয় আমার খুব খিদে পেয়েছে।
কাকাবাবু হেসে বললেন, বোধ হয়। আমাদের খিদের সময়। সত্যি সত্যি খিদে পায়। আর জোজোর বোধ হয়’ খিদে পায়। তা হলে চলো, ফেরা যাক। সন্ধেও হয়ে আসছে।
সন্তু বলল, একটু আগেই তো আমরা চারখানা করে কচুরি ও জিলিপি খেলাম।
কাকাবাবু বললেন, সমুদ্রের হাওয়ায় তাড়াতাড়ি হজম হয়ে যায়।
তারপর তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বললেন :
দুদিকে ছড়িয়ে আছে দুই কালো সাগরের ঢেউ
মাঝখানে আজ এই সময়ের ক্ষণিকের আলো…
দ্যাখ নীল সমুদ্রের রং এর মধ্যেই কীরকম কালো হয়ে আসছে। আর সেই জাহাজটা, এখন ঝলমল করছে আলোয়।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, এটা কার কবিতা?
কাকাবাবু বললেন, জীবনানন্দ দাশ। তোরা পড়িসনি বোধ হয়। পড়ে দেখিস, তোদের এই বয়েসটাই তো কবিতা পড়ার সময়।
লাইট হাউজের কর্মচারীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাকাবাবু ফেরার পথ ধরলেন।।
রাস্তাটা পাহাড়ের গা দিয়ে ঘুরে ঘুরে গেছে। এক দিকে। আলো-অলা শহর, অন্যদিকে অন্ধকার সমুদ্র।
কাকাবাবু বললেন, আমাদের জোজোসাহেবের মেজাজ খারাপ, সত্যিই খুব খিদে পেয়েছে বুঝতে পারছি। রাত্তিরে প্রোফেসর ভার্গবের বাড়িতে নেমন্তন্ন, ভালই খাওয়াবে মনে হয়।
সন্তু বলল, নিরামিষ?
কাকাবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, হ্যাঁ, আমি আগে দু’বার খেয়েছি, ওরা মাছ-মাংস খায় না। তা নিরামিষই বা খারাপ কী? নিরামিষেও অনেক ভাল খাবার হয়, অনেকরকম মিষ্টি!
সন্তু বলল, যতই ভাল ভাল নিরামিষ খাবার থাকুক, একটু মাছ বা মাংস না থাকলে ঠিক যেন জিভের স্বাদ মেটে না।
কাকাবাবু বললেন, ওসব নিছক অভ্যেসের ব্যাপার। ইচ্ছে। করলেই অভ্যেস বদলানাে যায়। এখন থেকে আমি শুধু নিরামিষই। খাব ভাবছি।
হঠাৎ কাকাবাবু হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন, জোজো তাকে ধরে ফেলল। ক্রাচ নিয়ে পাহাড়ের ওপরে ওঠা যেমন শক্ত, নামাও মোটেই সহজ নয়। অবশ্য পুরোটা নামতে হবে না, কাছেই একটা সমতল জায়গায় গাড়ি রাখা আছে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু টর্চ আনিসনি?
সন্তু বলল, এই রে, সেই সকালবেলা বেরিয়েছি, টর্চ আনার কথা। মনে পড়েনি।
ঠিক তখনই সামনের দিকে দুটি জোরালো টর্চ জ্বলে উঠল।
একজন কেউ বলে উঠল, হল্ট। রেইজ ইয়োর হ্যান্ডস!
কাকাবাবু বললেন, এ আবার কে?
যার হাতে টর্চ থাকে তাকে দেখা যায় না। শুধু একটা কালো। ছায়ামূর্তি। সে কয়েক পা এগিয়ে এসে ইংরিজিতে বলল, মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী, মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও। তোমার সঙ্গের ছেলে দুটিকেও তাই করতে বলো!
কাকাবাবু বললেন, কেন, হাত তুলে গৌরাঙ্গ হতে হবে কেন? আমি ক্রাচ নিয়ে চলি। দুহাত তুললে ক্রাচ ধরব কী করে?
লোকটি এবার ধমকের সুরে বলল, ক্রাচ ফেলে দিয়ে এক পায়ে দাঁড়াও। তোমার দিকে রিভলভার তাক করা আছে। যা বলছি চটপট শোনো!
কাকাবাবু বিরক্তির সঙ্গে বললেন, এ কী উটকো ঝামেলা! তুমি কে? তোমার সঙ্গে আমার কীসের শত্রুতা?
লোকটি বলল, হাত তুলতে আর দেরি করলে আমি গুলি চালাব।
কাকাবাবু বললেন, সন্তু, জোজো, হাত তুলেই ফেল! এত করে যখন বলছে!
তিনি ক্রাচ দুটো মাটিতে ফেলে দিলেন।
লোকটি বলল, রাজা রায়চৌধুরী, আমি তোমাদের এখনই কোনও ক্ষতি করব না। তবে তোমাকে একটি কাজ করতে হবে। পিন্টু ডিমেলোকে পুলিশের হাত থেকে তোমাকে ছাড়িয়ে আনতে হবে।
কাকাবাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন। দারুণ অবাক হয়ে বললেন, পিন্টু ডিমেলো? সে আবার কে? এইরকম কারুকে আমি চিনি না, নামও শুনিনি!
লোকটি বলল, তুমি তার নাম শোনোনি? তুমি ধুমল কোলকে তো জানো? তুমি তাকে অ্যারেস্ট করে জেলে ভরিয়ে দিয়েছ। সেই সূত্রে কাল পিন্টু ডিমেলোও ধরা পড়েছে।
কাকাবাবু বললেন, আমি কারুকে অ্যারেস্ট করব কী করে? আমি কি পুলিশ নাকি? ধুমল কোল… মানে যে লোকটা মুঘল বাদশাহদের আমলের টাকা জাল করে? এক-একটা টাকার দাম দশ-পনেরো লাখ টাকা, এটা একটা দারুণ বড় ব্যবসা! আমি জাল টাকাগুলো ধরে ফেলে ধুমল কোলের ডেরার সন্ধান দিয়ে দিয়েছি সরকারকে। তারপর পুলিশের কাজ পুলিশ করেছে। ধুমলের দলে কে যে ছিল, আমি তা জানব কী করে?
লোকটি বলল, ধুমলটা একটা বাজে লোক। ওকে সারাজীবন জেলে ভরে রাখো কিংবা ফাসি দাও, যা খুশি করো। কিন্তু পিন্টু ডিমেলোকে ছেড়ে দিতেই হবে। আর সে দায়িত্ব নিতে হবে তোমাকে।
কাকাবাবু বললেন, আমি দায়িত্ব নেব? আমি ছেড়ে দিতে বললেও পুলিশ ছাড়বে কেন?
লোকটি বলল, কেসটা তো টাকা জাল করার। তুমি বলবে, ডিমেলোর নামে কোনও চার্জ নেই। ওসব বাজে কাজ ডিমেলো করে না। ডিমেলো ইচ্ছে করলে ওরকম পাঁচটা ধুমলকে কিনে আবার বিক্রি করে দিতে পারে। ধুমলটা নিজের দোষ ঢাকার জন্য ডিমেলোর নাম বলে দিয়েছে। পুলিশ যখন আসে তখন ডিমেলো ঘুমিয়ে ছিল, তাই পালাতে পারেনি।
কাকাবাবু বললেন, খুবই আপশোশের কথা। পুলিশের আগে থেকে খবর দিয়ে আসা উচিত ছিল।
লোকটা বলল, পুলিশ এর আগেও একবার হঠাৎ ডিমেলোকে ধরেছিল। সেবার ওর নামে পাঁচটা খুনের চার্জ দিয়েছিল। একেবারে ফল্স চার্জ। আমাদের লাইনে সবাই জানে। ডিমেলো এ-পর্যন্ত নিজের হাতে মাত্র দুটো মার্ডার করেছে। পাঁচটা হতে এখনও দেরি আছে। পুলিশ সে দুটোরও প্রমাণ পায়নি।
কাকাবাবু বললেন, দুটো মার্ডার তো অতি সামান্য ব্যাপার। অন্তত পাঁচটা না হলে শাস্তির প্রশ্নই ওঠে না!
জোজো আর সন্তু চুপ করে সব শুনছে, এই সময় জোজো হুহু করে হেসে উঠল।
লোকটি তার দিকে ফিরে বলল, শাট আপ!
কাকাবাবু বললেন, আমি তো চোর-ডাকাত কিংবা খুনিদের নিয়ে কারবার করি না। ওসব আমার এক্তিয়ারের বাইরে। তুমি ডিমেলোকে ছাড়াবার জন্য আমার কাছে এসেছ কেন? বরং কোনও মন্ত্রীর কাছে গেলে—
লোকটি বলল, এখন অন্য পার্টির সরকার। মন্ত্রীটন্ত্রিতে সুবিধে হবে না। পুলিশের বড়কর্তারা সবাই তোমার কথা শোনে। এখনও কেস ওঠেনি, তুমি বললে ছেড়ে দেবে। আমরা ওকে চুপচাপ ছাড়িয়ে নিতে চাই।
কাকাবাবু বললেন, প্রথম কথা, পুলিশের কর্তারা আমার এ অন্যায় অনুরোধ শুনবেন না। দ্বিতীয় কথা, আমি এরকম অন্যায় অনুরোধ করতে যাবই বা কেন?
লোকটি বলল, অন্যায় আবার কী? টাকা জাল করার কেসের সঙ্গে ডিমেলোর কোনও সম্পর্ক নেই। ধুমল কোল ইচ্ছে করে তাকে জড়িয়েছে। তুমি টাকা জাল করার ব্যাপারটা ধরতে এসেছ। তুমি বলবে, ডিমেলো তোমার কেসের বাইরে।
কাকাবাবু বললেন, এসব কোর্টেই প্রমাণ হবে, তোমার বা আমার মুখের কথার কোনও মূল্য নেই।
লোকটি এবার বিরক্তভাবে বলল, বললাম না, কেসটা কোর্টে ওঠার আগেই সব ব্যবস্থা করতে হবে। কালকের মধ্যেই..
তারপর সে হাঁক পাড়ল, ভিকো, ভিকো…
এবার দেখা গেল অন্ধকারে আর একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। সে এগিয়ে এল।
এরই মধ্যে একটু একটু চাঁদের আলো ফুটেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, যার হাতে টর্চ আর রিভলভার, সে লম্বা ছিপছিপে। আর ভিকো নামে লোকটি গাঁট্টাগোট্টা।
লম্বা লোকটি বলল, রায়চৌধুরী, তোমার সঙ্গের একটি ছেলেকে আমি সঙ্গে নিয়ে যাব। ডিমেলো ছাড়া না পেলে সে মুক্তি পাবে না। তবে ওর ক্ষতি করা হবে না।
কাকাবাবু এখনও হালকাভাবে বললেন, ওদের একজনকে নিয়ে যাবে? সর্বনাশ! ওরা দারুণ বিচ্ছু ছেলে। তোমাকে একেবারে জ্বালাতন করে মারবে।
লোকটি কোনও রসিকতার ধার ধারে না। গম্ভীরভাবে বলল, সে আমি বুঝব। ভিকো, এই ছেলেটাকে ধরো।
সে টর্চের আলো ফেলল জোজোর মুখে।
সন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ওকে নয়, ওকে নয়, ওর বদলে আমাকে নিন।
জোজো বলল, না, না, আমাকে বলেছে।
সন্তু বলল, না, জোজো, উনি দুজনের একজনকে বলেছেন, আমিই যাচ্ছি…
জোজো বলল, তুই অত হিংসুটেপনা করছিস কেন রে। আমার কথা আগে বলেছে, আমার ফার্স্ট চান্স।
সন্তু বলল, তুই খিদে সহ্য করে থাকতে পারবি না!
জোজো বলল, কে বলেছে পারব না? আমি একবার রকি অ্যান্ডিজে আটকা পড়ে তেরো দিন না খেয়ে ছিলাম। দরকার হলে আমি সব পারি।
লম্বা লোকটি বলল, অত কথা কীসের। ভিকো, ওই ছেলেটাকেই ধরে নিয়ে চলো।
ভিকো জোজোর কাধে হাত দিয়ে জামার কলারটা খিমচে ধরল।
এইবার কাকাবাবু গর্জে উঠে বললেন, খবরদার, ওর গায়ে হাত দেবে না। আমার সঙ্গে এখনও কথা শেষ হয়নি।
তিনি জোজোকে আড়াল করার জন্য এগিয়ে আসতে গেলেন। আবার একটা পাথরে পা লেগে আছাড় খেয়ে পড়লেন। খুব জোরে মাথা ঠুকে গেল।
তারপর তিনি আর কোনও শব্দও করলেন না, উঠেও বসলেন না।
লম্বা লোকটি টর্চ ফেলল কাকাবাবুর মুখে। কাকাবাবু চিত হয়ে পড়ে আছেন হাত-পা ছড়িয়ে। চোখের পাতা খোলা, চোখের মণি স্থির।
সন্তু হাঁটু গেড়ে পাশে বসে পড়ে ডাকতে লাগল, কাকাবাবু, কাকাবাবু!
কোনও সাড়া নেই। সন্তু কাকাবাবুর বুকে মাথা রেখে হৃৎস্পন্দন শোনার চেষ্টা করল।
লম্বা লোকটি জিজ্ঞেস করল, কী হল? অজ্ঞান হয়ে গেছে?
সন্তু অদ্ভুত ফ্যাকাসে গলায় বলল, বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, হার্ট বিট নেই।
জোজো চেঁচিয়ে বলল, কী বলছিস সন্তু! নাকের কাছে হাত নিয়ে দ্যাখ।
লম্বা লোকটি বলল, হার্ট বিট নেই মানে? বললেই হল! একটা আছাড় খেয়েই. ওসব ভড়ং আমার কাছে খাটবে না। তুমি সরে যাও, আমি দেখছি?
সে টর্চটা ভিকোর হাতে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল কাকাবাবুর পাশে।
তারপর কড়া গলায় বলল, রায়চৌধুরী, আমার সঙ্গে চালাকি করে লাভ নেই। উঠে বোসো!
কাকাবাবু একইভাবে পড়ে রইলেন।
লোকটি কাকাবাবুর দুগালে ছোট ছোট থাপ্পড় মারতে লাগল। নাকের তলায় আঙুল রেখে দেখল, দুতিনবার চাপ দিল বুকে।
রীতিমতন ঘাবড়ে গিয়ে সে বলল, মাই গড! সত্যি মরে গেল নাকি লোকটা? কিছুই তো পাওয়া যাচ্ছে না। আমার বসদের কী কৈফিয়ত দেব? তারা ভাববে, আমিই মেরে ফেলেছি।
পাশে দাড়ানো সন্তুকে সে জিজ্ঞেস করল, এর হার্টের অসুখ ছিল?
সন্তু মুখ নিচু করে চোখ মুছছে। মাথা নেড়ে জানাল, না।
লোকটি কাকাবাবুর বুকে কান ঠেকিয়ে শব্দ শোনার চেষ্টা করল। আর তক্ষুনি মৃত কাকাবাবু বেঁচে উঠলেন। লোহার মতন দুহাতের মুঠোয় লোকটির গলা চেপে ধরলেন প্রচণ্ড শক্তিতে। লোকটা শুধু একবার শব্দ করল, আঁক!
সন্তু সঙ্গে সঙ্গে লোকটির রিভলভার ধরা হাতটায় একটা ক্যারাটের লাথি কষাল।
রিভলভারটা উঠে গেল শূন্যে, জোজো আর ভিকো দুজনেই ছুটে গেল সেটা ধরতে। জোজোর পাতলা চেহারা। সে উঁচুতে লাফিয়ে ক্যাচ করে ফেলল। সেটা সে নিজের কাছে না রেখে সঙ্গে সঙ্গে ছুড়ে দিল সন্তুর দিকে।
সন্তু সেটা লুফে নিয়েই ভিকোকে বলল, পিছু হঠো, পিছু হঠো।
লম্বা লোকটা এর মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
কাকাবাবু তাকে পাশে নামিয়ে রেখে নিজে উঠে বসলেন। কোটের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, রাবিশ! আজকালকার গুন্ডা বদমাশগুলো কোনও ট্রেনিং নেয় না। ভাবে যে হাতে একটা রিভলভার পেলেই সব কিছু জয় করে ফেলবে। রিভলভার ধরাটাও তো শিখতে হয়। ওর উচিত ছিল, রিভলভারটা আমার কপালে ঠেকিয়ে তারপর আমাকে পরীক্ষা করে দেখা।
সন্তু বলল, কাকাবাবু, তোমার হার্ট বিট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল?
কাকাবাবু বললেন, দূর পাগল। হার্ট বিট বন্ধ হয়ে গেলে কি মানুষ বাঁচে নাকি? বড় জোর তিরিশ সেকেন্ড। ইচ্ছে করলে, মানে শিখলে, কয়েক মিনিট নিশ্বাস বন্ধ করে থাকা যায়।
সন্তু বলল, আমি তোমার বুকে কোনও শব্দ পাইনি।
কাকাবাবু হেসে ফেলে বললেন, তুই ভয় পেয়ে গিয়েছিলি নাকি রে? আমি তো ভেবেছিলাম, তুই অভিনয় করছিস।
জোজো বলল, আমি ভয় পাইনি। আমি জানতুম, তুমি কিছু একটা ম্যাজিক দেখাচ্ছ।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক ম্যাজিক নয়। যোগব্যায়াম করে এটা শিখেছি। মাঝেমাঝে হৃৎপিণ্ডটাকে একটু বিশ্রাম দেবার জন্য আস্তে করে দেওয়া যায়। তখনও চলে ঠিকই, তবে আস্তে। ঘুমের মধ্যে যেমন হয়। বাইরে থেকে সহজে বোঝা যায় না।
জোজো বলল, আমি রিভলভারটা কীরকম ক্যাচ ধরলুম দেখলেন? ওটা যদি এই ভিকো ধরে নিত, তা হলে সবকিছু আবার অন্যরকম হয়ে যেত, তাই না?
কাকাবাবু বললেন, ততক্ষণে আমি আমারটা বার করে ফেলতাম। তবু যা হোক, তুমি দারুণ ক্যাচ ধরেছ ঠিকই।
জোজো বলল, আমি ক্রিকেটে উইকেট কিপার হয়ে খেলেছি।
কাকাবাবু বললেন, তুমি অনায়াসে রঞ্জি ট্রফিতে খেলতে পারো।
জোজো তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, মোহনবাগান ক্লাব থেকে আমাকে কতবার ডেকেছে। কিন্তু আমি ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিয়েছি, এখন পিয়ানো শিখছি।
সন্তু রিভলভারটা তাক করে আছে ভিকোর দিকে। সে দুহাত তুলে আছে। এ পর্যন্ত সে একটাও কথা বলেনি। বোবা কি না কে জানে!
কাকাবাবু লম্বা লোকটার গলায় হাত বুলিয়ে বললেন, বেশ ফুলে গেছে। তবে ওর জ্ঞান ফিরে আসবে একটু বাদেই। কিন্তু ততক্ষণ কি আমরা এখানে বসে থাকব?
ভিকোর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ওহে, একে নিয়ে যাও। নীচে গিয়ে মুখে জলের ছিটেটিটে দাও।
ভিকো এগিয়ে এসে লম্বা লোকটাকে কাঁধে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতেই সে উঃ আঃ করে উঠল। তার জ্ঞান ফিরে আসছে।
সে আচ্ছন্নভাবে বলল, কেয়া হুয়া?
জোজো বলল, হুক্কা হুয়া!
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার নাম ধরে ডাকছিলে, তুমি আমাকে চেন?
লোকটি কোনও উত্তর দিল না। কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নামটা কী, তা তো জানা হল না।
লোকটি তার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, মাই গান, হোয়ার ইজ মাই গান?
কাকাবাবু বললেন, ওটা তুমি ফেরত পাবে না। পুলিশের কাছে জমা দেব। যদি তোমার লাইসেন্স থাকে, সেখান থেকে ফেরত নিয়ে!
লোকটি এবার বলল, রাজা রায়চৌধুরী, এর শাস্তি তুমি পাবে। তোমাকে এমন শাস্তি দেওয়া হবে—
কাকাবাবু তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, যাও যাও, এখন বাড়ি যাও! গলায় গরম গরম সেঁক দাও, না হলে আরও ফুলে যাবে।
এবারে ভিকো তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। ওরা অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার পর কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চল, আমাদের হোটেলে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। জামাটামা বদলে বেরুতে হবে আবার। রাত্তিরে নেমন্তন্ন আছে না?