কাকাবাবুর ঘরে দুজন ফরসা বিদেশি
কলেজ থেকে ফিরে সন্তু দেখল, কাকাবাবুর ঘরে দুজন ফরসা বিদেশি বসে আছেন, বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা।
নিশ্চয়ই কোনও দেশ থেকে কাকাবাবুকে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন। এরকম আজকাল আসছে অনেকেই। কাকাবাবু সহজে যেতে চান না। বিদেশে তাঁর থাকতে ইচ্ছে করে না বেশি দিন।
সন্তুর আজ ব্যাডমিন্টন কম্পিটিশনের খেলা আছে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। ছটার সময়। সে একটু পরেই বেরিয়ে গেল।
সে ফেরার পর কাকাবাবু তাকে ডেকে বললেন, কী রে, তোর খেলার রেজাল্ট কী হল?
সন্তু বলল, জিতেছি। এবার সেমিফাইনাল। পরশু দিন আবার খেলা।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সেমিফাইনালে কার সঙ্গে খেলতে হবে?
সন্তু বলল, একটি জাপানি ছেলে। জুনিয়র গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
কাকাবাবু বললেন, জাপানিরা ব্যাক-হ্যান্ডে খুব ভাল খেলে। কাল একটু প্র্যাক্টিস করে নে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, আজ বিকেলে যে সাহেবরা এসেছিল, তারা কোন দেশের?
কাকাবাবু বললেন, নিউজিল্যান্ডের। ওদের মধ্যে একজন আমার অনেক দিনের চেনা। এবার মনে হচ্ছে একবার যেতেই হবে। কয়েকবার যাব বলে যেতে পারিনি। ওখানে একটা দ্বীপে মাঝে মাঝেই রাত্তিরবেলা আলো জ্বলে ওঠে। নীল রঙের, বেশ জোরালো আলো। কিন্তু সে দ্বীপে কোনও বাড়িঘর নেই। মানুষ থাকে না। জাহাজ থেকে আলোটা দেখা যায়। অথচ জাহাজ থেকে সে দ্বীপে নেমে খুঁজলেও সে আলোর কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না। ফিরে গিয়ে জাহাজে উঠলেই আবার দেখা যায় সেই আলো। ওরা দেশবিদেশ থেকে বেশ কয়েকজনকে ডাকছে, ব্যাপারটা দেখে যদি রহস্য উদ্ধার করা যায়।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কবে যেতে হবে তোমাকে?
কাকাবাবু বললেন, আর দিন দশেকের মধ্যে।
সন্তু অমনই আবদারের সুরে বলল, আমি যেতে পারি না? শুনেছি নিউজিল্যান্ড খুব সুন্দর দেশ।
কাকাবাবু বললেন, আহা! তোর এখন কলেজ খোলা, তা ছাড়া খেলা চলছে, তুই যাবি কী করে?
সন্তু আরও কিছু বলতে গেল, এমন সময় বেজে উঠল টেলিফোন। কাকাবাবু ইঙ্গিত করলেন সন্তুকে ফোনটা ধরার জন্য।
সন্তু ফোন তুলে গলা শুনে বলল, কর্নেলকাকা? কেমন আছেন?
মা থেকে ফিরে আসার পর এক মাস কেটে গিয়েছে। এর মধ্যে মাঝে মাঝেই ফোন করেন কর্নেল। কাকাবাবুর সঙ্গে গল্প হয়।
এখন তিনি বললেন, সন্তু? শোনো, বাঙালিদের সঙ্গে ফোনে কিংবা দেখা হলে প্রথম কথাই হচ্ছে, কেমন আছেন, তাই না? উত্তরে বলতে হয়, ভাল আছি। কিন্তু আমি আজ তা বলতে পারছি না। আমি ভাল নেই।
সন্তু বলল, কেন, কী হয়েছে?
কর্নেল বললেন, আমাকে বাঘে কামড়েছে!
সন্তু বলল, আঁ! কী বলছেন, আবার ওখানে বাঘ বেরিয়েছে?
কর্নেল এবার হাসতে হাসতে বললেন, না! সেরকম কিছু না। আমার পা ভেঙে গিয়েছে। আমি এখন শয্যাশায়ী।
সন্তু কাকাবাবুকে বলল, কর্নেলকাকার পা ভেঙে গিয়েছে।
ফোনটা সে কাকাবাবুর দিকে এগিয়ে দিল।
কাকাবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, কী ব্যাপার কর্নেলসাহেব, পা ভাঙল কী করে?
কর্নেল বললেন, সন্তুকে এমনই ভয় দেখাচ্ছিলাম। এমন কিছু হয়নি। যাকে বলে শুকনো ডাঙায় আছাড়। সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম, পায়ে রবারের চটি, এক পায়ের চটি হঠাৎ খুলে গেল, সেটাকে ধরতে গিয়ে গড়িয়ে গেলাম। একেবারে নীচে। এক পায়ে ফ্র্যাকচার, অন্য পায়েও বেশ লেগেছে। এখন একেবারে শয্যাশায়ী। আপনার মতো ক্র্যাচ বগলে নিয়ে কোনওরকমে বাথরুমে যেতে পারি। তাও নার্স রাখতে হয়েছে। এখন একমাস বাড়িতে বন্দি।
কাকাবাবু বললেন, ইস, দুটো পায়েই লেগেছে!
কর্নেল বললেন, অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট। কী আর করা যাবে। যে-কোনও লোকেরই হতে পারে।
কাকাবাবু বললেন, কী আর বলব? সাবধানে থাকবেন। বেশি নড়াচড়া করবেন না।
কর্নেল বললেন, শুনুন, আমার অ্যাকসিডেন্টের খবর দেওয়ার জন্য আপনাকে ফোন করিনি। আর-একটা খবর দিতে চাই। সেই সুরজ সিংহের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সে মোটেই বুনোর কাকা নয়। সে একটা সার্কাসের মালিক। সে বুনোকে দিয়ে তার সার্কাসে বাঘের খেলা দেখাচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, আঁ! ওইটুকু ছেলেকে দিয়ে সার্কাসের খেলা দেখাচ্ছে?
কর্নেল বললেন, এবার বুঝতে পারছেন, অন্য গরিবের ছেলে কিংবা রাস্তার ছেলের সঙ্গে বুনোর কী তফাত? সে বাঘকে ভয় পায় না? সেই জন্যই ওই সুরজ সিংহ অত দূর থেকে এসে ছেলেটাকে নিয়ে গিয়েছে। এখন নিজের কাজে লাগাচ্ছে। আরও খবর পেয়েছি যে, ওর সার্কাসে যে লোকটা বাঘের খেলা দেখাত, সে হঠাৎ মারা গিয়েছে। বাঘের খেলা না দেখালে সার্কাসে টিকিট বিক্রি হয় না, তাই ও বুনোকে সেই কাজে লাগাচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, কিন্তু অতটুকু ছেলেকে কাজে লাগানো তো বেআইনি। সার্কাসে বাঘ-সিংহের খেলা দেখানোও এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
কর্নেল বললেন, ওসব আইনটাইন শহরে মানা হয়। গ্রামের দিকে কেউ ওসব গ্রাহ্য করে না। কত বাচ্চাকে মারধর করে এখনও খাটানো হয়। শুনুন স্যার, খবরটা আপনাকে দিলাম, কিন্তু আপনি এ নিয়ে বেশি চিন্তা করবেন না। আপনি আর অত দূর থেকে কী করবেন? আমি একটু সেরে উঠি, তারপর ওই সুরজ সিংহ ব্যাটাকে ধরব। তখন কী হয়, আপনাকে আবার জানাব।
কাকাবাবু বললেন, কোথায় সার্কাস দেখাচ্ছে, আপনি জানেন?
কর্নেল বললেন, তাও জানি। চিত্রকূটে। সেটা কোথায় আপনি জানেন?
কাকাবাবু বললেন, মোটামুটি ধারণা আছে।
কর্নেল বললেন, যাই হোক, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি সেরে উঠেই ওই সুরজ সিংহের গলা টিপে ধরব।
কাকাবাবু বললেন, আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।
টেলিফোনটা রেখে দিয়ে কাকাবাবু একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। সন্তু একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তাঁর মুখের দিকে।
কাকাবাবু বললেন, বুনোর কী হয়েছে তুই শুনলি?
সন্তু বলল, ওকে দিয়ে সার্কাসের কাজ করাচ্ছে?
কাকাবাবু বললেন,হ্যাঁ। কাজটা খুবই অন্যায়। কিন্তু আমরা কী করে দায়িত্ব নেব বল? তা ছাড়া এখন এত কাজ, আমি যে বইটা লিখছি, সেটা শেষ করার জন্য তাড়া দিচ্ছে, এর মধ্যে নিউজিল্যান্ড যেতে হবে…।
সন্তু চুপ করে রইল।
কাকাবাবু বললেন, আমাদের দায়িত্ব নেই ঠিকই, তবু মনটা কেমন কেমন করছে।
সন্তু বলল, আমার খুবই খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে, এক্ষুনি ছুটে গিয়ে ছেলেটাকে দেখি। কাকাবাবু, চলো না যাই চিত্রকূটে?
কাকাবাবু বললেন, আমি যদি বা কাজ ফেলে যেতে পারি, তুই যাবি কী করে? তোর খেলা, কলেজ।
সন্তু বলল, পরেও অনেক খেলা যাবে। কলেজেও কয়েক দিন না গেলে কিছু হবে না। শনি-রবি তো ছুটিই। এটা একটা ছেলের জীবনের ব্যাপার। যদি কিছু করা যায়…!
কাকাবাবু বললেন, চল, তা হলে। জোজোকে কিছু জানাবার দরকার আছে?
সন্তু বলল, একেবারে কিছু না জানিয়ে গেলে ও দুঃখ পাবে। ওকে ফোন করে দেখি।
সন্তু ফোন নিয়ে বসল। কাকাবাবু মধ্যপ্রদেশের একটা ম্যাপ নিয়ে দেখতে লাগলেন।
পরদিনই ওরা তিনজন প্লেনে চেপে চলে এলেন গ্বালিয়র। রাত্তিরটা একটা হোটেলে থেকে, পরদিন একটা গাড়ি ভাড়া করে যাত্রা শুরু হল।
দিনটা সুন্দর, আকাশে পাতলা-পাতলা মেঘ, গরম কমে এসেছে। এদিককার রাস্তাও ভাল।
কিছুদূর যাওয়ার পর সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আমরা যে চিত্রকূটে যাচ্ছি, সেটাই কি রামায়ণের চিত্রকূট?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, রামায়ণে চিত্রকূটের সুন্দর বর্ণনা আছে। চিত্রকূট পাহাড় আর জঙ্গল, এখানেই নাকি রাম-সীতা-লক্ষ্মণ থেকেছেন অনেক দিন। তলায় মন্দাকিনী নদী। তবে রামায়ণের সময়কার মতো অমন শান্ত, সুন্দর জায়গা আর এখন নেই। পাশেই শহর হয়ে গিয়েছে। রেলস্টেশনও হয়ে গিয়েছে।
জোজো বলল, নিশ্চয়ই অনেক লোকজনও আছে। নইলে আর সার্কাস চলবে কী করে?
কাকাবাবু বললেন, এরকম এক-এক জায়গায় তিন-চারদিন সার্কাস চলে, তারপর তাঁবু গুটিয়ে আর-একটা শহরে চলে যায়। এখান থেকেও চলে গিয়েছে কি না দেখতে হবে খোঁজ নিয়ে।
চিত্রকূট রেলস্টেশনের কাছে পৌঁছে দেখা গেল সার্কাসের বিরাট বিজ্ঞাপন।
তলায় লেখা, আজই শেষ দিন।
সন্ধে হয়ে এসেছে।
কাকাবাবু বললেন, চলো, আগেই সার্কাস দেখে আসি। থাকার জায়গা পরে ঠিক করব।
ড্রাইভারকে যেতে বললেন সার্কাসের ময়দানে।
বেশ মস্ত বড় তাঁবু। চারদিকে আলো ঝলমল করছে। ভিতরে বাজনা বাজছে খুব জোরে।
গেটের কাছে গিয়ে জানা গেল, খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে আধঘণ্টা আগে।
কাকাবাবু বললেন, তাতে ক্ষতি নেই। বাঘের খেলা শেষের দিকেই হয়।
টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকে পড়লেন তিনজন।
তখন চলছে একজন ক্লাউনের খেলা।
তারপর চারটে ঘোড়া দৌড়োল, তাদের পিঠের উপর দাঁড়িয়ে দুজন পুরুষ আর দুজন মেয়ে। এরও পরে ট্র্যাপিজের খেলা, বাঁদরের খেলা।
একটু পরে স্টেজটা একেবারে খালি হয়ে গেল। তারপরই দুমদুম করে খুব জোরে বেজে উঠল ড্রাম। ভা-পো-পোঁ করে বিউগল। বোঝাই গেল, এবার বিশেষ কেউ আসছে।
একটা চাকা লাগানো বিরাট খাঁচা। ঘরঘর শব্দে সেটাকে পিছন থেকে ঠেলে নিয়ে এল তিনজন লোক। তারপর উপর থেকে তার টেনে খুলে দেওয়া হল সেই খাঁচার দরজা।
ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা বাঘ। বেশ বড়।
তার পা দুটো মোটা শিকল দিয়ে বাঁধা।
বাঘকে নিয়ে খেলা দেখার কেউ নেই। উইংসের পাশ থেকে একটা লোক একটা লম্বা চাবুক দিয়ে বাঘটাকে মারতে লাগল। সেই চাবুকটায় শব্দ হতে লাগল চটাস-চটাস করে।
সেই চাবুকটা লাগছে আর বাঘটা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে। চলতেই লাগল এরকম।
জোজো ফিসফিস করে বলল, বাঘটাকে শুধু শুধু এরকম কষ্ট দিচ্ছে। কেন?
সন্তু বলল, কষ্ট না দিলে বাঘটা আওয়াজ করবে না, তাতে লোকে ভয়ও পাবে না।
কাকাবাবু বললেন, জন্তু-জানোয়ারদের কষ্ট দিয়ে এরকম খেলা দেখানো এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
একটু পরে আরও একটা নিষ্ঠুর ব্যাপার শুরু হল।
উইংসের পাশ থেকেই একটা গামলাভরতি মাংস ঠেলে দেওয়া হল বাঘটার সামনে। সেই গামলার একটা আংটায় দড়ি বাঁধা।
বাঘটা যেই মাংসে মুখ দিতে আসছে, অমনি সেটা টেনে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এরকম চলল পাঁচ-ছবার।
অর্থাৎ বাঘটা চাবুক খেয়ে রেগে আছে। তার উপর সামনে মাংস দেখেও খেতে পারছে না। খিদেও পেয়েছে নিশ্চয়ই। রাগে সে অনবরত গরগর করছে।
এই সময় উপর থেকে দড়ি বেঁধে নামিয়ে দেওয়া হল একটা ছেলেকে। তারও পা-দুটো বাঁধা, হাতদুটো খোলা।
দর্শকরা সবাই ভয়ের আওয়াজ করে উঠল। ক্ষুধার্ত, রাগী বাঘটা নিশ্চয়ই ওকে এবার খাবে।
ছেলেটাকে উপর থেকে নামানোর সময় বাঘটা একটা জোর হুংকার দিয়েছে। ছেলেটা তার কাছে নামার পর সে একটা থাবা তুলেও থেমে গেল। তারপর মুখটা উপরের দিকে তুলে একটা অদ্ভুত অন্যরকম আওয়াজ বের করল।
জোজো বলল, এই তো আমাদের বুনো।
ছেলেটার গায়ে একটা কটকটে লাল রঙের জামা আর একটা সবুজ হাফপ্যান্ট। গলায় একটা ঘণ্টা বাঁধা। এদিক-ওদিক মুখ ফেরালেই টুং টাং শব্দ হচ্ছে।
বাঘটা ছেলেটার গায়ের গন্ধ শুকতে এলে সে যেন কী বলে উঠল। বাঘটাও শব্দ করল দুবার। ঠিক যেন কথা বলছে দুজনে।
কয়েকবার সেরকম কথা বলার পর বাঘটা বুনোর পিঠে মাথা ঘষে আদর করল একটুখানি। তারপর ঢুকে গেল খাঁচার মধ্যে।
সমস্ত দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে লাগল। সে হাততালি আর থামতেই চায় না।
একটা বাঘ মানুষকে আদর করছে। এই দৃশ্য কেউ কখনও দেখেছে? মানুষ আর বাঘ কথা বলছে, এরকম কেউ কখনও শুনেছে?
কাকাবাবুর মুখোনা রাগে গনগন করছে। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, যথেষ্ট হয়েছে। আর দেখার দরকার নেই। চল বাইরে।
বাইরে এসে তিনি একজন লোককে জিজ্ঞেস করলেন, মালিক কোথায় আছে?
লোকটি হাত তুলে পিছনের একটা ছোট তাঁবু দেখিয়ে দিল।
সেই তাঁবুর সামনে একজন লোক পাহারা দিচ্ছে। সে হাত তুলে বলল, কাঁহা যাতা?
কাকাবাবু বললেন, মালিকের সঙ্গে কথা বলব। এখনই।
লোকটি বলল, এখন দেখা হবে না। মালিক ঘুমোচ্ছেন।
কাকাবাবু বললেন, ডেকে তোলে। এই অসময়ে ঘুমোবে কেন?
লোকটি তবু বাধা দিতে গেলে, কাকাবাবু একটা ক্র্যাচ তুলে তার বুকে ঠেকিয়ে বললেন, হঠ যাও!
সেই তাঁবুর মধ্যে ঢুকে দেখা গেল, সত্যিই একটা ইজিচেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে বিশাল চেহারার সুরজ সিংহ। মেঘের মতো নাক ডাকছে।
কাকাবাবু গম্ভীরভাবে ডাকলেন, সুরজ সিংহ, উঠুন।
তাতেই লোকটির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে প্রথমে তিনি খুবই অবাক হলেন। তারপর উঠে বসে বললেন, রায়চৌধুরীসাব, আইয়ে, আইয়ে। সার্কাস দেখতে এসেছেন? কেমন লাগল?
কাকাবাবু বললেন, খুব খারাপ!
সুরজ সিংহ একগাল হেসে বললেন, আপনার ভাল লাগেনি, এই লেড়কা দুজনের নিশ্চয়ই ভাল লেগেছে। এরকম বাঘের খেলা আর কোথায় পাবেন?
সন্তু আর জোজো চুপ করে রইল।
কাকাবাবু আবার বললেন, ওইটুকু ছেলেকে দিয়ে আপনি খেলা দেখাচ্ছেন, সেটা অন্যায়। সার্কাসে বাঘের খেলা দেখানোই এখন বেআইনি। আপনাকে এ জন্য শাস্তি পেতে হবে। আপনি এ ছেলেটার কাকা নন। আপনি মিথ্যে পরিচয় দিয়ে ছেলেটিকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন। কেউ
আমাকে মিথ্যে কথা বলে ঠকালে আমি তা সহ্য করতে পারি না।
সুরজ সিংহ বললেন, আরে বসুন, বসুন। অত রাগারাগি করছেন কেন? আমি ছেলেটির কাকা নই, আপনিই বা ওর কে? কেউ নন, আপনারও কোনও রাইট নেই। আমি বরং ছেলেটাকে চাকরি দিয়েছি, এখানে খেতেপরতে পাবে, এতে দোষ কী হয়েছে?
কাকাবাবু বললেন, দশ বছরের ছেলের চাকরি? তাও হাত-পা বেঁধে? ওই বয়সের ছেলে এখন লেখাপড়া শিখবে, আর পাঁচটা ছেলের মতন খেলাধুলো করবে। তারপর আঠেরো বছর বয়স হলে ও বাঘের খেলা দেখাবে না কি অন্য কাজ করবে, তা ও নিজে ঠিক করবে। ওকে জোর করে আটকে রাখার কোনও অধিকার নেই আপনার। ছেলেটাকে ফেরত দিন।
টেবিল থেকে একটা মোটা খাম তুলে নিয়ে কাকাবাবুর দিকে ছুড়ে দিয়ে সুরজ সিংহ বললেন, এতে বিশ হাজার রুপিয়া আছে। এটা নিয়ে চুপচাপ চলে যান। কেন ঝামেলা করছেন? ও ছেলেকে আমি ফেরত দেব না, আমার সার্কাস কানা হয়ে যাবে।
কাকাবাবু এবার আরও দপ করে জ্বলে উঠলেন। দুপা এগিয়ে গিয়ে বললেন, কী, আমাকে ঘুষ দেবার চেষ্টা? সুরজ সিংহ, তুমি আমাকে চেনো না। আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী। আমি এখনই তোমার এই সার্কাসের তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দিতে পারি।
খামটা তুলে তিনি ছুড়ে মারলেন সুরজ সিংহের মুখে। তাতেও না থেমে তিনি বাঁ-হাতের উলটো পিঠ দিয়ে তাকে এক জোর থাপ্পড় কষালেন। তারপর বললেন, ছোট ছেলেদের যারা কষ্ট দেয়, তারা কি মানুষ? তাদের আমি সহ্য করতে পারি না। তোমার নিজের ছেলেমেয়ে নেই?
সুরজ সিংহ বললেন, ওসব বড় বড় কথা ঢের শুনেছি। বাঙ্গালিবাবু, তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছ, তুমি এখান থেকে জিন্দা বেরোতে পারবে না। তোমাকে মেরে বালিতে পুঁতে দেব? কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি?
তাঁবুর এক কোণে একটা রাইফেল দাঁড় করানো। সুরজ সিংহ সেটার দিকে হাত বাড়িয়েও ধরতে পারলেন না। কাকাবাবু তার আগেই পকেট থেকে রিভলভার বের করে তার হাতের তালু ফুটো করে দিলেন।
যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে সুরজ সিংহ চেঁচিয়ে ডাকলেন, জগদীশ, কাদের, জলদি ইধার আও!
সন্তু তড়াক করে টেবিলটা ডিঙিয়ে গিয়ে রাইফেলটা তুলে নিল। তার নলটা সুরজ সিংহের বুকে ঠেকিয়ে ধরল।
জোজো বলল, ও কিন্তু সত্যি রাইফেল চালাতে জানে।
দুজন গুন্ডামতো লোক ডান্ডা হাতে নিয়ে ঢুকে এল ভিতরে।
কাকাবাবু তাদের দিকে ফিরে বললেন, ওসব ডান্ডাফান্ডা ফেলে দাও। আমি যা বলছি শোনো। বাচ্চা ছেলেটিকে দিয়ে বাঘের খেলা দেখিয়ে তোমাদের মালিক অন্যায় করেছে। আমরা তাকে নিয়ে যাব। তোমরা মেনে নাও। আর যদি বাধা দিতে চাও, তোমাদের মালিকও মরবে, তোমাদেরও দু-চারজন মরতে পারে। এ ব্যাপারে আমার কোনও দয়ামায়া নেই!
যে লোকটি গালে রং মেখে ক্লাউনের খেলা দেখাচ্ছিল, সে এবার দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, আপনি ঠিক বলেছেন স্যার। ওই বাচ্চাটাকে দেখে আমাদেরও কষ্ট হয়। ওকে আফিম খাইয়ে রাখে। এই জগদীশ, এই কাদের, হাতিয়ার ফেলে দে।
সার্কাস শেষ হয়ে গিয়েছে। গুলির আওয়াজ শুনে আরও কয়েকজন খেলোয়াড় উঁকিঝুঁকি মারছিল। এবার তারাও কয়েকজন বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাচ্চাটাকে ফেরত দেওয়াই উচিত। অত ছোট ছেলেকে দিয়ে খেলা দেখাতে তাদেরও খারাপ লাগে।
এরপর সব ব্যাপারটাই সহজ হয়ে গেল। ওরাই বুনোকে ধরে-ধরে এনে তুলে দিল গাড়িতে। সে কখনও ঝিমোচ্ছে। কী ঘটছে তা বুঝতেই পারছে না। আফিম খাওয়ানোর কথাটা তা হলে সত্যি।
সে রাত্রেই ফিরে আসা হল গ্বালিয়র হোটেলে।
সকালেও বুনোর ঘুম ভাঙতে চায় না। সন্তু আর জোজো ঠেলা দিয়ে দিয়ে তাকে জাগাল।
সে চোখ মেলে অবাকভাবে দেখতে লাগল হোটেলের ঘর। ওদের দুজনকে। বোঝা গেল, চিনতে পেরেছে, খুশিও হয়েছে। কিন্তু মুখে কোনও কথা নেই।
জোজো বলল, আইসক্রিম খাবি? কলকাতায় যাবি?
সন্তু বলল, কলকাতায় প্রথম শহর দেখবে। অত বড় বড় বাড়ি। ও কতটা ঘাবড়ে যাবে কে জানে!
জোজো বলল, তার আগে তো প্লেনে চাপবে। আকাশে উড়বে। ওর কেমন লাগবে?
জোজো বুনোর দিকে তাকিয়ে বলল, কী রে, প্লেনে চাপবি? এই দ্যাখ, এইভাবে…?
দুহাত মেলে জোজো প্লেন ওড়ার ভঙ্গি করে ঘুরতে লাগল ঘরময়।
কাকাবাবুও তৈরি হয়ে নিয়েছেন। ফোনে প্লেনের টিকিটের ব্যবস্থাও হয়ে গিয়েছে।
এইসময় বেজে উঠল সন্তুর মোবাইল ফোন। কর্নেলের গলা।
তিনি বললেন, সন্তু, কনগ্রাচুলেশন!অপারেশন চিত্রকূট সাকসেসফুল। আমি কাল রাত্তিরেই খবর পেয়ে গিয়েছি। আমার ঠিক মনে হয়েছিল, তোমার কাকাবাবু এরকম খবর শুনে স্থির থাকতে পারবেন না। ঠিক ছুটে আসবেন।
কাকাবাবু ঠিক তখনই হোটেলের অফিসঘরে গিয়েছেন।
কর্নেল বললেন, ঠিক আছে, ওঁর সঙ্গে আমি পরে কথা বলব। তোমাদের আর-একটা কথা বলি। সেই বাঘিনিটাকে এখন থালিয়ার চিড়িয়াখানায় ট্রান্সফার করা হয়েছে। ওখানে একটা খাঁচা খালি ছিল। তোমরা বুনোকে যদি কলকাতায় নিয়ে যাও, তা হলে যাওয়ার আগে একবার বাঘিনিটাকে দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারো।
কাকাবাবু সেকথা শুনে বললেন, হ্যাঁ, ঠিক আছে। একদম তৈরি হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ব, এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে ঘুরে যাব চিড়িয়াখানা। বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।
সকাল সাড়ে নটায় চিড়িয়াখানা সবেমাত্র খুলেছে, এর মধ্যেই এসে গিয়েছে বেশ কিছু মানুষ। ওঁরা তিনজন ভিতরে ঢোকার পরই বুনো সোজা ছুটে গেল বাঘের খাঁচাগুলোর দিকে। কী করে ও চিনল কে জানে।
পর পর তিনটে বাঘের খাঁচা। যে-খাঁচাটায় বাঘিনিটা আছে, বুনো গিয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সেখানকার তারের জালে।
তারপর একটা অত্যাশ্চর্য কাণ্ড শুরু হল। বাঘিনিটা জাল ধরে দাঁড়িয়ে উঠে হাঁক হাঁক করে ডাকতে লাগল, আর বুনোও চাচাতে লাগল তারস্বরে।
সব লোক ছুটে এল সেই দৃশ্য দেখতে। চিড়িয়াখানার ম্যানেজারও এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?
কাকাবাবু তাঁকে সব বুঝিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ, এ ঘটনা শুনেছি বটে। ঠিক মনে হচ্ছে যেন আর ছেলে, তাই না?
মিনিট দশেক এরকম চলার পরই বাঘিনিটা হঠাৎ ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেল। আর নড়াচড়া নেই।
কাকাবাবু চমকে উঠে বললেন, এ কী, মরে গেল নাকি? আমরা এলাম, আর আজই মরে গেল?
ম্যানেজার বললেন, না, মরেনি। আগেও এরকম কয়েকবার হয়েছে। বাঘিনিটা খুবই অসুস্থ, বেশি উত্তেজনা সহ্য করতে পারে না, কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে যায়।
বাঘিনিটা নিস্তব্ধ, বুনোও সেখানে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়।
কাছেই চেয়ার-টেবিল পাতা, কাকাবাবু সেখানে বসলেন, কফি খাওয়ালেন ম্যানেজারবাবু। এরকমভাবে কেটে গেল আধঘণ্টা।
কাকাবাবু জোজোকে বললেন, আর তো দেরি করা যাবে না। আজকের ফ্লাইট ছেড়ে দেবে। এবার বুনোকে ডাক।
সন্তু জোজোর কাছে এসে বলল, চল বুনো, এবার আমাদের যেতে হবে।
বুনো শক্ত করে চেপে ধরে রইল জালটা।
জোজো বলল, কী রে, বাড়ি যাবি না আমাদের সঙ্গে? বুনো মুখও ফেরাল না। কয়েকবার টানাটানি করেও তাকে জাল থেকে ছাড়ানো গেল না।
কাকাবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, ও যদি যেতে না চায়, আমি জোর করে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী নই। যতদিন বাঘিনিটা বেঁচে থাকবে, ও হয়তো এখানেই থাকতে চাইবে।
ম্যানেজার বললেন, থাকতে চায়, থাক। না, না, ওকে দিয়ে কাজ করাব না। এমনি থাকবে।
কাকাবাবু জোজোদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা হলে চল, আর তো কিছু করার নেই! গাড়ির দিকে এগোনো যাক।
একেবারে গাড়ির কাছে পৌঁছে দেখা গেল, ছুটতে ছুটতে আসছে বুনো। সন্তুর পাশে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমি! একটু থেমে বলল, বাড়ি। আবার বলল, যাবে। একসঙ্গে বলল, আমি বাড়ি যাবে! আমি বাড়ি যাবে? সেই সঙ্গে কাঁদতে লাগল।
কাকাবাবু বললেন, ও কথা বলছে! তার চেয়েও বড় কথা, ও কাঁদছে। ঠিক মানুষের মতো!