দেবলীনা চোখ খুলল
জগাই মল্লিক বেরিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। সন্তু দেখল, এ-ঘরের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ করার কোনও ব্যবস্থা নেই।
কাকাবাবু বসে পড়ে দেবলীনার মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ইশ, কেটে রক্ত বেরিয়ে গেছে!
দেবলীনা চোখ খুলে বলল, আমার বেশি লাগেনি।
কাকাবাবু বললেন, শোনো, ছেলেখেলার ব্যাপার নয়। একটু ভুল হলেই এরা যখন-তখন মেরে ফেলতে পারে। নিজে থেকে কিছু করতে যাবে না। আমি যা বলব, তাই-ই শুনবে। সন্তু, তোকেও এই কথাটা বলে রাখছি।
দেবলীনা বলল, নীচে পুলিশ এসেছে, আপনারা সবাই মিলে চ্যাঁচালেন না। কেন?
কাকাবাবু বললেন, তাতে কি কিছু লাভ হত? পুলিশ মানেই তো সবাই ভাল নয়? ঘুষখোর পুলিশও আছে। এরা টাকা পয়সা দিয়ে অনেক পুলিশকে হাত করে রাখে। সেরকম পুলিশ কেউ যদি জানতেও পারে যে আমরা এখানে বন্দী হয়ে আছি, তাও কিছু করবে না।
দেবলীনা অবিশ্বাসের সুরে বলল, পুলিশ ডাকাতদের ধরবে না? তা হলে আমরা এখান থেকে বেরুব কী করে?
কাকাবাবু পকেট থেকে রুমাল বার করে দেবলীনার মাথার রক্ত মুছে দিতে-দিতে সন্তুকে বললেন, তুই আমার একটা ক্রাচ দিয়ে এই ঘরের সব দেয়াল আর মেঝেটা ঠুকে ঠুকে দ্যাখ তো। যে দেয়াল দিয়ে আমরা ঢুকলাম সেটা বাদ দিয়ে।
সন্তু ঠিক বুঝতে না পেরেও একটা ক্রাচ তুলে নিয়ে দেয়ালে ঠুকতে লাগল।
কাকাবাবু দেবলীনার মাথায় একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন কোনওরকমে। তারপর বললেন, পুরনো আমলের বাড়ি। এতে যেমন আধুনিক লিফট বসিয়েছে, ইলেকট্রিক আলো আছে, তেমনি আবার গুপ্ত কুঠুরিও রেখে দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, এই ঘর থেকেও বেরুবার একটা রাস্তা আছে।
সন্তু ঠুকে-ঠুকে কোথাও ফাঁপা শব্দ পেল না।
কাকাবাবু ঘরের চারপাশটা দেখলেন। এক কোণে অনেকগুলো মূর্তি আর ছোট-ছোট বাক্স রয়েছে, সেগুলো সরিয়ে ফেলে বললেন, এইখানটা ঠুকে দ্যাখ তো!
সন্তু এসে সেইখানে জোরে-জোরে ঠুকতেই ঠং ঠং শব্দ হল।
কাকাবাবু বললেন, দেখলি? তলাটা ফাঁকা। গুপ্ত কুঠুরি মানেই তা যাওয়া-আসার দুটো ব্যবস্থা থাকবেই। ফাঁদে পড়ে গেলে পালাবার একটা থাকে।
একটা চতুষ্কোণ দাগ রয়েছে মেঝের সেই জায়গাটায়। কিন্তু সেখানকার পাথরটা সরানো যাবে কী করে? সন্তু অনেক টানাটানি করেও সুবিধে করতে পারল না।
কাকাবাবু বললেন, অনেকদিন বোধহয় খোলা হয়নি। জ্যাম হয়ে গেছে। দেখি, আমি চেষ্টা করি, এটা খুলতেই হবে।
তিনি প্রথমে ক্রাচ দিয়ে সেই রেখার চারপাশ ঝুঁকলেন। কোনও লাভ হল না। তারপর তিনি হাত দিয়ে টিপতে লাগলেন। চতুষ্কোণ রেখার একধারে একবার দুহাতের তালু দিয়ে জোরে চাপ দিতেই আর একটা দিক উঁচু হয়ে উঠল।
পরিশ্রমে কাকাবাবুর কপালে ঘাম জমে গেছে। তবু তিনি খুশি হয়ে বললেন, এইবার হয়েছে। তোরাও দুদিকে ধর, এই পাথরটা টেনে তুলতে হবে।
তিনজনে মিলে জোরে হ্যাঁচকা টান দিতেই একটা চৌকো পাথর খুলে বেরিয়ে এল। তার নীচে অন্ধকার গর্ত।
সন্তু তার মধ্যে হাত ঢোকাতে যেতেই কাকাবাবু বললেন, দাঁড়া, আগে আমি দেখে নিই!
তিনি তার মধ্যে ক্রাচটা ঢুকিয়ে দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, হ্যাঁ, যা ভেবেছিলুম তাই-ই। একটা সিঁড়ি রয়েছে।
সন্তু সেই সিঁড়ি দিয়ে নামবার জন্য পা বাড়াতেই দেবলীনা বলল, আমি আগে যাব?
সন্তু বলল, ছেলেমানুষি কোরো না! আমাকে দেখতে দাও!
দেবলীনা বলল, মোটেই আমি ছেলেমানুষ নই। আমি বুঝি কিছু করব না।
সন্তু বলল, এটা মেয়েদের কাজ নয়।
ইশ, ছেলেরা যা পারে, মেয়েরা বুঝি তা পারে না? সব পারে। কাকাবাবু, আপনি ওকে বারণ করুন, আমি আগে যাব।
কাকাবাবু বললেন, তলায় কিন্তু অনেক রকম বিপদ থাকতে পারে।
দেবলীনা বলল, আপনি ওকে সেই বিপদের মধ্যে পাঠাচ্ছেন, তাহলে আমি কেন যাব না? আমি যাবই যাব, আমি আগে যাব!
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, যাও। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে নামবে। পায়ের তলায় কিছু না পেলে অন্য পা বাড়াবে না, সেখান থেকে ফিরে আসবে! এই বাড়িটা গঙ্গার ধারেই। এমনও হতে পারে, এই সিঁড়িটা একেবারে গঙ্গায় নেমে গেছে। তুমি ভাল সাঁতার জানো না, জলে নেমো না!
আর যদি সিঁড়ির নীচে কোনও লোক দাঁড়িয়ে থাকে?
থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে! যদি পুলিশ এই বাড়িটা ঘিরে ফেলে থাকে তা হলে তুমি পুলিশের হাতে ধরা দিয়ে সব কথা খুলে বোলো! আর যদি ওদের লোক থাকে, তবে সেটা তোমার…নিয়তি!
তবু আমি যাব!
খুব সাবধানে, অ্যাঁ? দেবলীনা, তোমার কোনও বিপদ হলে আমাদের খুব কষ্ট হবে, মনে রেখো।
সন্তু বলল, কাকাবাবু, ওকে বারণ করুন! ও পারবে না!
কাকাবাবু বললেন, না, যেতে চাইছে যাক!
দেবলীনা সেই গর্তের মধ্যে নেমে গেল। কাকাবাবু আর সন্তু দুদিক থেকে বুকে ওকে দেখবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু একে তো অন্ধকার, তার ওপর সিঁড়িটা সম্ভবত খাড়া নয়, বেঁকে গেছে, তাই কিছুই দেখা গেল না।
কাকাবাবু মুখ তুলে বললেন, এ-বাড়িটার অনেক রকম কায়দা। মাটির নীচে আরও দুটো তলা রয়েছে।
সন্তু বলল, লিফটে তাই ছটা বোতাম দেখলুম। বাইরের লোক তো ওই লিফট দেখলেই বুঝে ফেলবে।
নীচের তলা দুটো সম্ভবত মাল-গুদাম। যেখানে সাধারণ জিনিস রাখা আছে। পুলিশ সন্দেহ করলে সেই দুতলা খুঁজে দেখবে। ওপরে ঠাকুরঘরের পেছনেও যে আরও একটা ঘর আছে, সেটা মনে আসবে না। আগেকার দিনে ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য বড়লোকরা এইরকম ব্যবস্থা করে রাখত। এখন এরা নিজেরাই ডাকাত!
নীচে কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না?
আর একটু অপেক্ষা করে তোকেও যেতে হবে।
কাকাবাবু, এই বিষ্ণুমূর্তিটা আপনি গত বছর আবিষ্কার করেছিলেন না?
হুঁ। আসল কষ্টিপাথরের তৈরি, ফোর্থ সেঞ্চুরির। অতি দামী জিনিস। বিদেশে এর দাম তো দশ-বারো লাখ টাকা হবেই! আমি বলেছিলাম, মূর্তিটা কলকাতার মিউজিয়ামে রাখতে। কিন্তু বালুরঘাটের লোক দাবি তুলল, আমাদের জিনিস, আমরা দেব না, আমাদের মিউজিয়ামেই রাখব। সেখান থেকে তিন-চার মাসের মধ্যেই চুরি হয়ে গেল।
এখন এরা এই দামী মূর্তিটা বাইরে পাঠিয়ে দেবে।
প্ৰথম চোরটা অতি চালাক। সঙ্গে-সঙ্গে একটা কপি তৈরি করে ফেলেছে। এখন এরা আর আসলটা চিনতে পারছে না।
এরা তো দুটোই বাইরে পাঠিয়ে দিলে পারে!
পাগল নাকি! বাইরের ক্রেতা যদি জানতে পারে যে, এই মূর্তির আরও কপি আছে, তা হলে হু-হু করে দাম পড়ে যাবে।
কাকাবাবু, কোনও সাড়া-শব্দ পাচ্ছি না। আমি এবার যাব?
হ্যাঁ, সাবধানে নেমে দ্যাখ। মেয়েটি যেন বুঝতে না পারে যে, তুই ওকে সাহায্য করতে গেছিস।
সন্তু প্ৰথমে পা দুটো গলিয়ে বলল, সিঁড়ি বেশ চওড়া আছে, পড়ে যাবার ভয় নেই।
তারপর সে নেমে গোল কয়েক ধাপ। সন্তু অদৃশ্য হয়ে যাবার পর কাকাবাবু নিজেও একটা পা গলিয়ে দেখে নিলেন। এই সিঁড়ি দিয়ে নামতে তাঁরও অসুবিধে হবে না। কিন্তু তিনি নামলেন না।
তিনি মূর্তি দুটি পরীক্ষা করতে লাগলেন।
একটুক্ষণের মধ্যেই সুড়ঙ্গের মধ্যে শব্দ পেয়ে তিনি মুখ ফেরালেন। সন্তু উঠে এল, হুড়মুড়িয়ে। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল, ওই মেয়েটা ফিরে আসছে। আমায় দেখতে পায়নি।
কাকাবাবু বললেন, তুই এপাশটায় এসে বোস।
দেবলীনা মুখ বাড়াতেই কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরে তাকে উঠতে সাহায্য করলেন। তারপর বললেন, সত্যি সাহসী মেয়ে! কী দেখলে?
দেবলীনা অনেকখানি সিঁড়ি একসঙ্গে উঠে এসেছে, একটু হাঁপাতে লাগল। তারপর ভাল করে দম নিয়ে বলল, আমি দুদিন কিছু খাইনি তো, তাই খুব দুর্বল হয়ে গেছি।
কাকাবাবু বললেন, ইশ, ছতলা সিঁড়ি ভাঙা তো সোজা কথা নয়। কেউ তোমায় দেখতে পায়নি তো?
দেবলীনা বলল, নামবার সময় কী যেন একটা আমার পায়ের ওপর দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। বোধহয় সাপ।
ইঁদুরও হতে পারে। তোমায় কামড়ায়নি তো?
না, কামড়ায়নি। সিঁড়ির দুপাশের দেয়াল শ্যাওলায় ভর্তি, অনেকদিন কেউ যায়নি বোধহয়।
একদম নীচে পর্যন্ত গিয়েছিলে?
হ্যাঁ, কিন্তু ছতলায় নয়, তিনতলা। আমি গুনেছি। সেখানেই সিঁড়ি শেষ। তারপর একটা ছোট বারান্দা। সেই বারান্দার একপাশে একটা দরজা, সেটা বন্ধ।
সিঁড়িটা তা হলে মাটির তলা পর্যন্ত যায়নি। সেই বারান্দায় কী দেখলে?
কাছেই গঙ্গার জল চকচক করছে। ঢেউয়ের শব্দও শুনলুম। সেখানে কোনও লোক নেই মনে হল।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, সেই বারান্দা ডিঙিয়ে নীচে নামা যায় না?
দেবলীনা একটু ভেবে বলল, হ্যাঁ, তা যেতে পারে। একটু লাফাতে হবে। ওটুকু আমিও লাফাতে পারব। কিন্তু…কিন্তু কাকাবাবু পারবেন কি?
কাকাবাবু বললেন, আমার আর একটা পা-ও খোঁড়া হয়ে যাবে বলছ? সে দেখা যাবে। তা হলে, ওখানে কেউ পাহারা দিচ্ছে না?
না, কোনও সাড়া-শব্দ নেই। ওদিকটায় বোধহয় কেউ আসে না। বারান্দার নীচে ঝোপঝাড় হয়ে আছে মনে হল। আমি উঁকি মেরে দেখেছি। চাঁদের আলোয় একটু-একটু দেখা যাচ্ছে।
বাঃ, দেবলীনা, ইউ হ্যাভ ডান আ ভেরি গুড জব! এবারে তোমাতে আর সন্তুতে মিলে একটা কাজ করতে হবে।
কাকাবাবু বিষ্ণুমূর্তি দুটোকে আবার পরীক্ষা করলেন। তারপর বললেন, ইতিহাসে যার একটুখানি জ্ঞান আছে, সে-ই কোনটা আসল, কোনটা নকল চিনতে পারবে। কিন্তু চোর-ডাকাতদের তো সে বিদ্যেটুকুও থাকে না।
একটা মূর্তি তিনি দুহাতে উঁচু করে তুলে বললেন, প্রচণ্ড ভারী। দ্যাখো তো, তোমরা দুজনে এটা বয়ে নিয়ে যেতে পারো কি না? তারপর বললেন, না, না, অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে, দুটো হাত এনগেজড থাকলে পড়ে যেতে পারিস। তাতে দারুণ ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সন্তু, তুই আর দেবলীনা আগে নেমে যা, তারপর আমি মূর্তিটা তোদের হাতে তুলে দিচ্ছি।
সন্তু বলল, এটা নীচে নিয়ে গিয়ে কী করব?
কাকাবাবু বললেন, তোরা এটাকে খুব সাবধানে নিয়ে যাবি। দেখিস, কিছুতেই যেন হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে না যায়। এসব জিনিস অমূল্য, শুধু টাকার দাম দিয়ে এর বিচার হয় না। দিনাজপুরের একটা টিবি খুঁড়ে এটা আবিষ্কার করার সময় আমাকে সাপে কামড়েছিল। সন্তু, তোর মনে আছে?
সন্তু বলল, ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেবার আমার জ্বর হয়েছিল, আমি সঙ্গে যাইনি।
এই মূর্তিটা পাওয়ার জন্য আমায় প্রাণের ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। এটা আমার ভীষণ প্রিয়। এটা কেউ বিদেশে পাচার করবে, তা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। এটা যদি তোরা নামাতে গিয়ে ভেঙে ফেলিস, তা হলেও আমার বুক ফেটে যাবে।
দেবলীনা বলল, না, না, আমরা সাবধানে নামাব।
কাকাবাবু বললেন, এটাকে বারান্দা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে খুব সাবধানে তলার গাছপালার ঝোপে ফেলে দিবি, তারপর তোরা দুজনে বারান্দা ডিঙিয়ে নীচে নেমে এটাকে আবার গড়িয়ে ফেলে দিবি জলে।
দেবলীনা বলল, জলে ফেলে দেব? কেন?
কাকাবাবু বললেন, আমাদের যদি পালাতে হয়, তা হলে এত বড় একটা ভারী জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়া মুশকিল হবে। জলে ফেলে দিলে নষ্ট হবে না। পরে আবার খুঁজে বার করা সহজ হবে। আর দেরি কোরো না, নেমে পড়ে।
দেবলীনা বলল, আর আপনি? আপনি যাবেন না। আমাদের সঙ্গে? আপনি রং আগে আগে নামুন।
কাকাবাবু বললেন, আমি একটু পরে যাচ্ছি!
সন্তু বলল, পরে কেন? আমরা একবার বারান্দা দিয়ে নীচে নেমে পড়লে আপনার একলা নামতে অসুবিধে হবে।
কিছু অসুবিধে হবে না। আমি ঠিক চলে যাব। এখানে আর কী কী চোরাই জিনিস আছে, আমাকে একবার দেখে নিতেই হবে। তোরা আর দেরি করিসনি। এগিয়ে পড়?
দেবলীনা বলল, না, আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন। এসব জিনিস আর দেখতে হবে না।
কাকাবাবু বললেন, উঁহু, আমার কথা শুনে চলতে হবে। আমি যা বলছি, তাই করো?
সন্তুরও এই ব্যবস্থাটা পছন্দ হল না। তবু সে প্রতিবাদ করল না। নামতে শুরু করল। কাকাবাবু ওদের হাতে মূর্তিটা তুলে দিয়ে বললেন, দেখো, খুব সাবধানে?