হাসপাতালে সন্তুর কেবিনে
আজ হাসপাতালে সন্তুর কেবিনে সকলে এসেছে। ডাক্তাররা বলেছেন, বিপদ কেটে গিয়েছে, আর ভয় নেই। অন্য গুলিটাও বের করা গিয়েছে। দুটি গুলিই লেগেছিল হৃৎপিণ্ডের ঠিক নীচে। আর আধ ইঞ্চি উপরে লাগলেই তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হত।
অর্ধেকটা উঁচু হয়ে বসে একটু একটু করে সুপ খাচ্ছে সন্তু। দারুণ রোগা হয়ে গিয়েছে এর মধ্যে। গাল দুটো এমন চোপসানো যে, প্রায় চেনাই যায় না। ডাক্তাররা বলেছেন, সন্তুকে আরও দিনদশেক থাকতে হবে হাসপাতালে, তারপর বাড়িতে গিয়েও অন্তত দুমাস বিশ্রাম। সন্তুর গলার আওয়াজটাও চি-চি হয়ে গিয়েছে। শুধু জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ।
সন্তুর এক পাশে বসেছেন মা, অন্য পাশে জোজো। কাকাবাবু দাঁড়িয়ে আছেন দেওয়ালে ঠেস দিয়ে।
সন্তু বলল, আমি কি মরেই যাব ভেবেছিলি নাকি রে জোজো?
জোজো দুদিকে জোর মাথা নেড়ে বলল, না।
মা বললেন, আমি রোজ তোর নামে প্রার্থনা করেছি।
সন্তু বলল, মরব কেন? কত কাজ বাকি আছে। কাকাবাবু, আমাদের সেই অরুণাচলের গুহায় যেতে হবে না? সেটা কবে?
কাকাবাবু বললেন, না রে সন্তু, তোর আর এখন কোথাও যাওয়া হবে না। দাদা যেতে দেবেন না।
সন্তুর বাবা বললেন, মোটেই সেই কথা বলিনি আমি। এখন এই অবস্থায় তো কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। কয়েক মাস পরে চাঙা হয়ে উঠুক, তারপর কি আর ওকে আটকানো যাবে!
মা বললেন, আটকাতে হলে রাজাকেই আটকানো উচিত। ওর এত বারবার বিপদের মধ্যে যাওয়ার দরকার কী?
সন্তু বলল, কাকাবাবু রিটায়ার্ড লোকের মতো বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকবে, এ কি ভাবা যায়?
বাবা বললেন, রাজা ছেলেবেলা থেকেই ডানপিটে, সন্তুও সেরকম হয়েছে।
ডাক্তার আহমেদ মাত্র পনেরো মিনিট সময় দিয়েছেন। সন্তুর বেশি কথা বলা বারণ। দেখতে দেখতে কেটে গেল সময়, সকলকে বেরিয়ে আসতে হল।
কাকাবাবু জোজোর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, আজকের মতো আনন্দের দিন আমার জীবনে খুব কম এসেছে।
জোজো বলল, আজই আমার জীবনের বেস্ট দিন।
কাকাবাবু বললেন, তুমি কতদিন কিছু খাওনি। খুব ইচ্ছে করছে, আজ তোমাকে পার্ক স্ট্রিটের কোনও রেস্তরাঁয় নিয়ে গিয়ে ভাল করে খাওয়াই। কিন্তু সন্তুকে বাদ দিয়ে তো যাওয়া ঠিক নয়। সন্তু একেবারে সেরে উঠুক, ততদিন খাওয়াটা বাকি থাক।
জোজো বলল, আজ অবশ্য আমারও যাওয়ার উপায় নেই। অমিতাভ বচ্চন আমার বাবাকে আর আমাকে সোনার বাংলা হোটেলে রাতে খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছেন। বাবার কাছে হাত দেখাতে এসেছিলেন তো দুপুরবেলা। সচিন তেন্ডুলকর কনুইয়ের ব্যথা সারাবার জন্য আসছেন কাল।
জোজো আবার তার আগেকার স্বভাবে ফিরে গিয়েছে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন কাকাবাবু। তিনি বললেন, ঠিক আছে, তুমি বাড়ি যাও। আমি একবার ন্যাশনাল লাইব্রেরি ঘুরে যাব।
তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। এখন থেকে ছমাস একটা বিপদ যে সব সময় তাঁকে তাড়া করে বেড়াবে, সে-কথা তিনি এখনও কাউকে বলেননি। ইচ্ছে করে তিনি ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। কখন কোথা দিয়ে হুট করে এসে যাবে কর্নেল ধ্যানচাঁদ, তার ঠিক নেই। আসে তো আসুক। ধ্যানচাঁদ বলেছিল, পিছন থেকে কখনও আক্রমণ করবে না। আসবে সামনে দিয়ে। সেটাই যা ভরসা। আশা করি, কথা রাখবে। সামনের দিক থেকে কোনও লোকেকে আসতে দেখলেই কাকাবাবু চোখ সরু করে তাকাচ্ছেন। সবসময় শক্ত করে রাখতে হচ্ছে কাঁধ। এ কী জ্বালা! অথচ উপায়ও তো নেই। আজও দেখা গেল না কাউকে।
বাড়িতে এসে কাকাবাবু টেলিফোন করলেন ভোপালে। সেখানকার পুলিশের এক কর্তার নাম সুদর্শন পান্ডে, কাকাবাবুর বিশেষ পরিচিত। এঁর বড়ভাই কাজ করতেন কাকাবাবুর সঙ্গে। ভোপালের সব টেলিফোন নম্বর বদলে গিয়েছে। আজই লালবাজার থেকে কাকাবাবু কয়েকটা নতুন নম্বর উদ্ধার করেছেন। সুদর্শন পান্ডেকে সহজেই পাওয়া গেল তাঁর অফিসে। এঁরা সন্ধের পরেও কাজ করেন।
প্রথমে কুশল সংবাদ আর বাড়ির খবরটবর নেওয়ার পর কাকাবাবু বললেন, সুদর্শন, দু-একটা ব্যাপারে তোমার সাহায্য চাই যে।
সুদর্শন পান্ডে বললেন, বলুন রাজাদা, আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা করব। কী সাহায্য করতে পারি?
কাকাবাবু বললেন, পাঁচ-ছ বছর আগে তোমাদের ওখানে ভীমবেটকায় একটা ডাকাতির কেস হয়েছিল, মনে আছে?
সুদর্শন বললেন, হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন? বিখ্যাত কেস। আপনার বুদ্ধিতে রাত্তিরবেলা এক ডজন ক্রিমিনাল ধরা পড়েছিল। সেই জঙ্গলের মধ্যে, পাহাড়ে, আপনি এমন কায়দা করেছিলেন, কেউ পালাতে পারল না, ভীমবেটকার অমূল্য সব জিনিস বেঁচে গেল।
কাকাবাবু বললেন, সে রাতে ঠিক কারা কারা ধরা পড়েছিল, সেই নামগুলো আমায় দিতে পারবে?
সুদর্শন বললেন, সেসব নাম তো আমার মনে নেই। আমি কেসটার সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমি তখন পোস্টেড ছিলাম পাঁচমারি শহরে। তবে ফাইল দেখে বলে দিতে পারি।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তুমি ফাইল দেখে নামগুলো আমাকে জানাও। আর-একটা কাজ করতে হবে। সুরজকান্ত নামে কেউ সেই সঙ্গে ধরা পড়েছিল কিনা, সেটাও দেখবে।
সুদর্শন জিজ্ঞেস করলেন, ওই সুরজকান্তের পদবি কী?
কাকাবাবু বললেন, তা আমি জানি না। সেটা জানতে হবে। ওর ফ্যামিলি সম্পর্কেও জানতে চাই।
সুদর্শন বললেন, রাজাদা, শুধু নাম শুনে একটা লোকেকে ট্রেস করা খুব শক্ত কাজ।
কাকাবাবু বললেন, শক্ত কাজ বলেই তো তোমাকে অনুরোধ করছি।
সুদর্শন জিজ্ঞেস করলেন, কী করে সেই লোকটি?
কাকাবাবু বললেন, সে বেঁচে নেই। পাঁচ-ছ বছর আগে মারা গিয়েছে। সেই রাতে সম্ভবত ভীমবেটকায় উপস্থিত ছিল। সে হিস্ট্রি নিয়ে শখের চর্চা করত। খুব সম্ভবত সুরজকান্ত নামে সে পত্রপত্রিকায় দু-একটা লেখাও বের করেছিল। তুমি হিস্ট্রির কোনও পণ্ডিতের কাছে খোঁজ নাও, তিনি হয়তো চিনতে পারবেন।
সুদর্শন বললেন, ঠিক আছে রাজাদা, আমাকে কিছুটা সময় দিন। এক ঘণ্টার মধ্যেই সুদর্শন ফোন করে বললেন, রাজাদা, আমি ভীমবেটকার ফাইলটা পেয়েছি। যারা ধরা পড়েছিল, তাদের নামগুলো পড়ে শোনাব?
কাকাবাবু বললেন, শোনাও!
নামগুলো পড়ার পর সুদর্শন বললেন, এর মধ্যে সুরজকান্ত বলে কারও নাম নেই। অথচ আপনি যে বললেন, সেই রাতে সে ওখানে উপস্থিত ছিল?
কাকাবাবু বললেন, এই লিস্টে রামকুমার পাধি বলে একটা নাম আছে। সে কে?
সুদর্শন বললেন, ওরে বাবা, সে তো একটা খুব নটোরিয়াস ক্রিমিনাল। অনেক খুন করেছে। একেবারে গলা কেটে ফেলত। ওকে ধরিয়ে দিয়েই তো আপনি একটা সাংঘাতিক কাজ করেছেন।
কাকাবাবু বললেন, আমি ওকে চিনতামই না। অন্যদের সঙ্গে ধরা পড়তে পারে। সেই রামকুমার পাধির শেষ পর্যন্ত কী শাস্তি হল?
সুদর্শন বললেন, ফাইলে তো লেখা রয়েছে দেখছি, রামকুমার পাধি জেলের মধ্যে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। তবে, ওর যা ক্রিমিনাল রেকর্ড, বিচারে ওর ফাঁসি হতই। সেটা বুঝেই সে আত্মহত্যা করেছিল।
কাকাবাবু বললেন, সুদর্শন, গত মাসের খবরের কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে যে, হিমাচল প্রদেশের মান্ডি শহরে এক সকালে চায়ের দোকানে একজন লোককে তিনজন আততীয় এসে গুলি করে খুন করে যায়। পুলিশ আইডেন্টিফাই করেছে যে, ওই খুন হওয়া লোকটির নাম রামকুমার পাধি। সে একজন কুখ্যাত ক্রিমিনাল। এখন ভোপালের জেলে যে-রামকুমার পাধি আত্মহত্যা করল, আর ছবছর পরে মান্ডিতে যে রামকুমার পাধি খুন হল, তারা কি একই লোক, না আলাদা?
সুদর্শন বললেন, এই রে, ওটা হিমাচল প্রদেশের ব্যাপার। আমরা কিছুই জানি না। ঠিক আছে, আমি এটারও খোঁজ নিচ্ছি।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আর সুরজকান্ত সম্পর্কে কিছু জানতে পারলে?
সুদর্শন বললেন, সে তো আরও সময় লাগবে। এত তাড়াতাড়ি হবে না।
কাকাবাবু বললেন, সুদর্শন, তোমার অনেক সময় নিচ্ছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। ওই সুরজকান্তের ফ্যামিলির খবরটা জানা আমার খুব দরকার। হয়তো আমি ভোপালেও একবার আসব শিগগিরই। আর একবার ভীমবেটকা দেখতে যাব।
সুদর্শন উৎসাহের সঙ্গে বলল, আসুন আসুন, চলে আসুন। শুধু একটু খবর দেবেন, আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব।