এখানে জীবন অনিশ্চিত
সুমিষ্ট আজানের ধ্বনি আর পাখিদের কিচির মিচির শব্দে জেগে উঠছে প্রকৃতি। ঘোর ফিকে হচ্ছে। শীত শেষ,ভোরে হালকা শিরশিরে ঠাণ্ডা,কাঁথা মুড়ি দিয়ে গুটিশুটি ঘুমাচ্ছে সুলতান।
আলি ঘুম ভেঙে উঠে পড়ল নামাজে যাবে। ওজু করে মসজিদে যাওয়ার আগে বউকে বলল, “সুলতানকে ডেকে তোলো, সব গোছগাছ করে দাও।” মিনারার বুকটা মুচড়ে উঠলো, এতটুকু ছেলেকে বনে জঙ্গলে পাঠাতে তার মন সায় দিচ্ছে না। কিন্তু উপায়ও নাই,অভাব অনটন আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে।
সুলতানের বয়স মাত্র দশ। এই বয়সেই তাকে কাজ করতে হচ্ছে। লেখা পড়ার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ নাই। মক্তবে আরবি পড়া আর মাঝেমধ্যে ব্র্যাক স্কুলে যাওয়া। প্রাইমারি স্কুল সে কয়েক ক্রোশ দূরে। সারাদিন নদীর খাড়িতে মাছ ধরা বাবার সাথে নৌকা বানানোর কাজে সাহায্য করা। সাধ থাকলেও আলির সাধ্য নাই ছেলেমেয়েদের লেখা পড়া করানোর।
আলি একজন দরিদ্র বাওয়ালি,তাছাড়া সে অন্য সময় নৌকা বানানোর কাজ করে।সরকারি পারমিট নিয়ে সুন্দর বনের গভীর থেকে গোলপাতা, মধু সংগ্রহ করা তার কাজ। পরিবারে পাঁচজন সদস্য, তিন ছেলে মেয়ে সে আর স্ত্রী মিনারা।
মিনারা ভোরে উঠে রান্না শুরু করেছে। কোলের বাচ্চাটা বুকের সাথে লেপ্টে আছে, আজ ক’দিন কাজের বিরাম নাই। এই গ্রামের প্রতিটি ঘরে এক অন্য রকম ব্যস্ততা।ভোর হতেই হাঁকডাক শুরু হয়েছে। বিশাল খাড়ির মুখে সারি সারি বড় বড় নৌকা বাঁধা। দূর পাল্লায় যাত্রার প্রস্তুতি চলছে। নিবারন হাঁক দিয়ে উঠলো,” ও আলি দাদা, তোমার সব কাজ সারা হলো নাকি গা..”
“হ্যাঁ হলো, কিছু জিনিস এখন নৌকায় তোলা শুধু বাকি।” আলি সাড়া দেয়।
সুলতান আলস্য জড়ানো চোখে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। আলি বেশ কিছুক্ষণ আগে নামাজ পড়ে ফিরেছে,তিনি ডাকলেন “সুলতান, চল বাবা সব জিনিস পত্র নৌকায় তুলতে হবে” গতকাল সে জেনেছে , তাকে এবার বাবার সাথে বনে যেতে হবে। রোমাঞ্চ আর ভয় বুক তোলপাড় করছে। এখানে তার বয়সি ছেলেরা ছোট বেলা থেকেই বাপ-দাদার কর্ম রপ্ত করে। বাওয়ালি জীবনের সংগ্রাম, বিপদ-আপদ আর ভয়কে জয় করে বাঁচতে শেখে। জীবনের সবুজ নির্যাস আহরণে পদে পদে মৃত্যুর চোরা ফাঁদ। এখানে জীবন অনিশ্চিত!
সুন্দর বনের কোল ঘেঁষে সোনাখালি গ্রাম। গোল পাতার ছাওনি, কাঠ আর হোগলার বেড়া দেওয়া ঘরদোর, উঠান বাড়ি।
গ্রামের অদূরে বিরাট খাড়ি, এখান থেকেই জোয়ারের সময় নৌকা বনে প্রবেশ করে। এখানে বড়ো বালু পাথরের বাঁধ, যাতে সুন্দর বনের নদীর নোনা পানি গ্রামে ঢুকে ফসলের ক্ষতি করতে না পারে।
প্রকৃতির কোলে সবুজের পটভূমিতে সোনাখালি অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঘেরা গ্রাম। সূর্য উঠছে, বনের গাছগাছালি, নদী সব কিছু স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। গ্রামের লোকজন মাথায় করে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নৌকায় তুলছে। দীর্ঘ এক মাসের জন্য চাল ডাল, লবন, তেল, চিড়ামুড়ি ছাতু, খাবার পানি নিয়ে রওনা দিচ্ছে সবাই । নৌকাতে রান্নাবান্না থাকা খাওয়া সব। চুলা হাঁড়িপাতিল মাছ ধরার সরঞ্জাম সব তোলা শেষ। এখন জোয়ারের অপেক্ষা। নৌকাগুলো বোঝাই ক’রে গোলপাতা আনবে সবাই। হারান, নিতাই, নিবারন তাদের ছেলেদের সাথে নিচ্ছে, দাঁড় বাওয়া, পাতা কাটা, নৌকায় তোলা এসব কাজে বাবাকে সাহায্য করবে।
বনে সাপখোপ, বিছে, আর ভয়ঙ্কর বাঘের ভয়। প্রায় প্রতি বছর সাপের কামড়ে নয় তো বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায় বাওয়ালিরা। জীবন তুচ্ছ করে চলে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
জোয়ারের জল খাড়িতে ঢুকতে শুরু করেছে। নৌকায় ওঠার জন্য কাঠের পাটাতন লাগান হয়েছে। আলি আল্লাহ নাম নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে পাটাতনের ধাপে পা রাখলো।
নিবারনের হাতে বনবিবির মূরতি নিবিষ্ট মনে প্রার্থনা করছে, বনের দিকে প্রণাম করে সবাই নৌকায় উঠে পড়লো ।
সুলতান মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, চোখ ছলছল করছে। মায়ের চোখেও পানি,যেতে দিতেই হয়,এ যাওয়া জীবনের চলার পথে টিকে থাকার প্রথম পাঠ। এ যেনো প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়ে প্রকৃতির অংশ হয়ে ওঠা। জীবন জীবিকার অন্বেষণে অবিচ্ছেদ্য লড়াই। আলি হাঁক দিয়ে উঠলো, “সুলতান তাড়াতাড়ি আয় বাপ,” মিনারা সুলতানের মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে, “ভয় কী! তোমার বাবা তো আছেন সাথে।” আল্লাহ তুমি রক্ষা কোরো বলো ছেলের মাথায় ঠোঁট ছোঁয়ালেন। সুলতান নৌকার দিকে দৌড় দিলো, একবার পিছু ফিরে দেখলো মা ছোট ভাইবোনকে। পাটাতন বেয়ে বাবার হাত ধরে উঠে পড়লো নৌকায়।
আলি নৌকা ছেড়ে দিলো,সুলতান পাড়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। গ্রামের অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে। দেখতে দেখতে খাড়ি পেরিয়ে গেলো সারি বদ্ধ নৌকাগুলো।
আগুপিছু, সবুজ অরন্যের টানে ছলাৎছল দাঁড় বেয়ে এগিয়ে চলল। পিছনে রয়ে গেলো পরিজন।
মিনারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাচ্চাদের নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলো। অন্য বাওয়ালিদের বউ ঝিয়েরাও নিজের স্বজনদের বিদায় দিয়ে ঘরে ফিরলো। এখন শুধু সোনাখালি গাঁয়ের মানুষের, স্বজনদের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় দিন গোণা।
নৌকা গুলো জল কেটে বনের গভীরে চলেছে। সুলতান অবাক বিস্ময়ে চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে। এই অরণ্য তার কাছে অপরিচিত। নদী পাড়ের গাছ গুলো হেলে পড়েছে সবুজ ছাদের মতো। ঝুকে পড়া সেই ডাল পাতার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে নীল আকাশ, গাছের ফাঁকে তেরসা সূর্যের আলো, বনের ভিতরে আলো-আঁধার । এতো পাখির কিচিরমিচির ডাক অন্য এক শব্দের জগৎ।মানুষের কোলাহল নেই।পাখিদের রাজ্য। মাঝ নদী দিয়ে চলেছে সবাই। সুন্দরী, গড়ান, গেওয়া সুলতান জানেনা এমন নাম না জানা অনেক গাছ। নদীর পাড়ের দিকে পানির ভিতর, উঁচু হয়ে আছে অজস্র শিকড়। সে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, “বাজান ওই গুলান কী “
বাবা বলে,” শ্বাস মুল, গাছ পানির ভিতর শিকড় দিয়ে নিশ্বাস নেয়।” গাছের ডালে বাঁদরের দল লাফালাফি করছে। বন পশু-পাখিদের সম্রাজ্য, অবাধ প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য। সুলতান দেখে আর অবাক হয়।
আজ তিনদিন হলো বনে এসেছে সবাই। মাঝে মাঝেই বন বিভাগের চেকপোস্ট চোখে পড়ছে। অস্ত্র হাতে বনরক্ষীরা পাহারা দিচ্ছে। এরা বনকে চোরা শিকারিদের কবল থেকে রক্ষা করে। রক্ষীরা ডেকে বললো, “কারা যায়? থামো “
আলিদের পারমিট চেক করে যেতে দিলো।
যত ভিতরে যাচ্ছে ততই বন গভীর হচ্ছে। চারিদিকে গাছ আর গাছ ডালপালায় ছাওয়া,বনের ভিতর আলো আঁধারীর ছায়া। একদল চিতল হরিণ গাছের ফাঁকে কচি পাতা খাচ্ছে। “ওই যে হরিণ” সুলতান চেঁচিয়ে ওঠে, নিমেষে হরিণের দল উধাও…।
বনে সময় ঠাহর করা যায় না। নৌকা গুলো এগিয়ে চলেছে গভীরে। কোথায় ভালো গোলপাতা পাওয়া যায় আলি জানে।
সুলতান আর বেলাল হাল ধরে বসে আছে, এতো বড় নৌকা সামলানো কঠিন। আলি চুলায় ভাত রান্না করছে, নদী থেকে মাছ ধরেছে টাটকামাছ দিয়ে খাওয়া হবে তিনজনের। তাদের গ্রামের ছেলে বেলাল বেশ শক্তসমর্থ, আলি তাকে সাথে এনেছে কাজে সাহায্যের জন্য ।
অন্যান্য নৌকা গুলো দু-তিন দলে ভাগ হয়ে অন্য দিকে চলে গেছে। আলির সাথে নিবারন আর হারান। বনে দল বেঁধে কাজ না করলে বাঘের আক্রমণ ও অন্যান্য বিপদ ঘটতে পারে। সজাগ আর শতর্ক থাকতে হয় সবসময়।
গভীর রাতে বন জেগে ওঠে শ্বাপদের পদ চারণে। অন্ধকারে চোখ জ্বলে ওতপেতে থাকে, শিকারে বের হয়। শোনা যায় নানা ভীতিকর শব্দ। সুলতান বাবার কাছঘেঁষে শুয়ে আছে, হঠাৎ দূরে গর্জন শোনা গেলো, সে ভয় পেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। আলি ছেলেকে সাহস দিলো ভয় নাই আমরা নিরাপদ আছি।
মা আর ভাইবোনের জন্য তার মন কেমন করছে। আব্বা আমরা কবে বাড়ি যাবো?
“কাজ শেষ হলেই যাবো। “
বনের এই দিকটায় প্রচুর গোলপাতা গাছ। আলি পাতা কাটছে, সুলতান আর বেলাল পাতা নৌকায় তুলছে। ভীষণ পরিশ্রম, গাছগাছালির ভিতর পথ করে খুব কষ্টে কাজ করছে ওরা। সুলতান ভয়ে চিৎকার করে উঠল, বিরাট সাপ পায়ে শীতল স্পর্শ দিয়ে বনের গভীরে চলে গেল, যেন প্রকৃতির সাবধান বাণী। রাতে বিশ্রাম, সারাদিন কাজ। ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে পড়তে চায়।আলি কঠিন পরিশ্রম করে, ওদেরও করতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ে নৌকা বোঝাই পাতা নিয়ে ফিরতে হবে, পারমিট এক মাস মেয়াদের। মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে সবাই, পাতা দিয়ে শোধ করতে হবে। জীবনের এক কঠিন লড়াই, প্রকৃতির ভাণ্ডার থেকে সংগ্রহ করতে হয় জীবিকা।
মিনারা দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে, খাবার প্রায় ফুরিয়ে এসেছে । ওদিকে আলিদেরও একই অবস্থা খাবার শেষ প্রায়।
নৌকা গুলো পাতা বোঝাই। এবার বাড়ি ফেরার পালা সবার।
হঠাৎ ভীষণ গরম পড়তে শুরু করেছে। সবার মনে আশংকা ঠিকঠাক বাড়ি পৌঁছাতে পারবে তো।
রাত নামলো থমথমে, গুমোট, বাতাস নাই। বন নিথর হয়ে আছে। পশুপাখি কী এক আশঙ্কায় নিশ্চুপ। আলীর মন কু-ডাকছে, এমন পরিস্থিতিতে আগেও সে পড়েছে।এবার তার চিন্তা সাথে সুলতান আছে।সে আল্লাহ কে স্মরণ করতে লাগলো। অন্যরা সব যাত্রার জন্য এক যায়গায় মিলিত হলো। সবারই বাড়ি ফেরার তাড়া। ভোর হতেই বাড়ির উদ্দেশ্যে নৌকা ছেড়ে দিলো। প্রাণপণে দাঁড় বাইছে সবাই। আলি আকাশের দিকে তাকালো, যেটুকু দেখা যায় কালোমেঘ ছেঁয়ে ফেলছে আকাশ। সকাল তবুও বনের ভিতরে রাতের মতো আঁধার নেমে এলো। নদীর পানি দেখতে দেখতে ফুলেফেঁপে উঠছে। হঠাৎ গাছগুলো যেন অসুরের শক্তি পেলো, শুরু হলো প্রবল বাতাস। প্রাণপণে হাল ধরে রাখতে আলী আর বেলাল হিমসিম খাচ্ছে। সকলের অবস্থা একই। এমনিতেই বোঝাই নৌকা তার উপর প্রচণ্ড বাতাস, আলী আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে যুঝছে হালের সাথে। সবকিছু যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রকৃতির রুদ্র রোষের কাছে মানুষ কত তুচ্ছ, বিশালতার কাছে ক্ষুদ্র ধুলি কণার মতো। প্রতিটি নৌকা থেকে আল্লাহ হু আকবর, ভগবানের নাম ভয়ার্ত চিৎকার, প্রচণ্ড ঝড়োবাতাসে হারিয়ে যাচ্ছে । কাছে পিঠে কোথাও বাজ পড়ার বিকট শব্দ, গাছ পোড়া ধোঁয়া উঠছে। ডালপালা ভাঙ্গা আর গাছ উপড়ে পড়ার শব্দ শুধু চারিদিকে। অসীম আক্রোশে ঝড় তার অজস্র ফনা বিস্তার করে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মুহূর্তে সব ছত্রখান প্রবল বাতাস বৃষ্টি আর ফুলেফেঁপে ওঠা পানির তোড়ে কে কোথায়!
মনিরা আকাশের থমথমে অবস্থা দেখেই দোয়া দরুদ পড়ছে আশংকায় ভেতরটা কাঁপছে। এমন সময় মাইকিং শুনতে পেলো সবাইকে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। সব বাড়িতে কান্না, কী হবে!! “যারা বনে গেছে তারা নিরাপদে ফিরতে পারবে তো? মিনারা উৎকণ্ঠায় ছটফট করছে, ছোট দুই সন্তানকে বাঁচাতে হবে। যার যা সম্বল আছে ছোট বাচ্চা আর বয়স্কদের নিয়ে সবাই আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে রওনা হলো।
মিনারা বনের দিকে করুণ চোখে তাকালো। বুক কাঁপা আহাজারি বেরিয়ে এলো । এতো দূর থেকে ঝড়ের গর্জন শুনতে পেলো সে। বাতাস বেগে ধেয়ে আসছে বনবাদাড় ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে ধেয়ে আসছে সোনাখালি গ্রামকে গ্রাস করতে।
দুই সন্তানকে বুকে চেপে ছাগল আর গরুটাকে নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় নিলো মিনারা।
শুরু হলো তাণ্ডব, প্রবল বাতাস ভারি বর্ষণ তুমুল ঝড়। সবাই কায়মনে প্রার্থনা করছে। দুর্যোগ মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকাই যেন তাদের ভবিতব্য। স্বামী সন্তানের অমঙ্গল আশঙ্কায় সবাই অধীর। দেখতে দেখতে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় মুহূর্তে সোনাখালি ও অন্যান্য গ্রাম গুলোকে তছনছ করে দিলো। কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল ঘরের চাল, বেড়া খড়কুটোর মতো। মনে হচ্ছে এখানে কখনো গ্রামই ছিলো না,নিশ্চিহ্ন সব। বাঁধ ভেঙে নোনা পানি ঢুকছে ফসলের মাঠে। এইঝড় মূর্তিমান অভিশাপ। চাষ-আবাদের জমির মাটিকে তিক্ত বিষাক্ত, বন্ধ্যা করে দিলো। প্রকৃতির রুদ্ররোষ আশা ভরসা স্বপ্ন এক নিমেষে কেড়ে নিলো।
এই প্রকৃতি বেঁচে থাকার রসদ যোগায় আবার কেঁড়ে নেয় প্রাণ, লালিত স্বপ্ন। বাওয়ালিদের মৃত্যুর সাথে নিরন্তর লড়াই করে যাওয়া সংগ্রামী জীবন।
টানা তিনদিন মিনারা ছেলে মেয়ে নিয়ে গাদাগাদি করে রইলো আশ্রয় কেন্দ্রে। ক্ষুধা তৃষ্ণা আর দুশ্চিন্তা, চোখে ভাসছে স্বামী সন্তানের মুখ। মাঝে মাঝে ডুকরে কেদে উঠছে সে। প্রবল বৃষ্টি আর বাতাসের বেগ কমে এলো।ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে সূর্য উঁকি দিলো। সবাই ফিরে এলো যার যার ভিটায়, পানি কাদায় এক হাঁটু, শুধু ঘরের উঁচু ভিটেটা শূন্য, সেখানে গৃহস্থালির জিনিস পত্র কিছু নাই ।রান্না ঘরের চুলার ভিতর পানি, কিছু কয়লা ভাসছে। ঘরের কোণে ভাঙ্গা আয়নার টুকরাতে সূর্যের আলো পড়তেই ঠিকরে উঠলো শতরঞ্জিত আলো। এভাবেই বুঝি শত ঝড়-ঝঞ্ঝার ভিতরে জ্বলে ওঠে মানুষের জীবন। নতুন আশায় বুক বাঁধে।
মিনারা মাথায় হাত দিয়ে কাদার উপরে বসে ছিলো , তার সব শক্তি যেন শুষে নিয়েছে কেউ, হতাশায় মুহ্যমান। কী খাবে কোথায় থাকবে দিশাহারা মিনারা, ভাবছিলো স্বামী সন্তানের কথা। তাদের তো ফেরার সময় হয়েছে!
ছোট ছেলেটা “মা ভাত দাও খিদা লাগছে ” বলে উঠতেই সে ঘোরের ভিতর জেগে উঠলো। কোলের শিশুটি শুকনো স্তন মুখে নিয়ে কাদছে।সবার অবস্থাই করুণ, খোলা আকাশের নিচে বসে আছে অসহায় ।
খাড়ির পাড় থেকে নিবারনের ছোট ছেলেটা দৌড়ে এলো, হাফাতে হাফাতে বললো, “মা বাবা আসতেছে, নদীতে দূরে নৌকার গুলুই দেখা যায়। “শোনা মাত্রই মিনারা উঠে দাঁড়ালো, অন্যন্য সবার সাথে খাড়ির পাড়ে এসে দাঁড়ালো..
চোখ কুঁচকে তাকালো দূরে নদীর সীমা রেখায়, প্রতীক্ষিত চোখে ধরা পড়লো ছোট ছোট কালো বিন্দু। ক্রমশ বিন্দু গুলো নৌকার আকার নিচ্ছে …..।