Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

অনেক রাত্রে কে জানে কি জন্যে নীচে নেমেছিল কৌস্তুভ। ভাড়ারঘরে এখনো আলো জ্বলছে!

বংশী নেই, এত রাত্তিরে কে কী করছে!

ঘরে এসে দেখল, চৈতালী কুটনো কুটছে বসে বসে।

এই এত রাত্তির অবধি এই সব করছে চৈতালী?

অথচ আজই ওকে কতখানি অপমান করা হয়েছে।

কৌস্তুভ আস্তে বলে, এখন এ সব কেন?

চৈতালী ঠোঁটের কোণে একটু হাসির আভাস মেখে বলে, করে রাখছি। সকালে উঠে মাসীমাকে যাতে বেশী অসুবিধেয় পড়তে না হয়!

বংশী কবে আসবে?

কি জানি!

আজ তোমার ওপর যা অত্যাচার হয়ে গেল!

চৈতালী বঁটি ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে কঠিন রুক্ষ গলায় বলে বসে, তবু তো আশ মেটে নি বলে মনে হচ্ছে। তাই বুঝি আরও যা যা বাকী আছে–

এ রকম বলছ কেন?

বলছি কেন? আপনি জানেন না এত রাত্রে এভাবে দুটো মানুষকে একত্রে দেখলে, লোকে তার কি অর্থ করে?

আমি তো চলে যাচ্ছি। আমি শুধু একটা কথা তোমায় বলতে এসেছিলাম—

জানি কি বলতে এসেছেন।

জানো?

হ্যাঁ। বলতে এসেছেন আমি যেন এখান থেকে রাগ করে চলে না যাই।

চৈতালী!

আপনার ছোট ভাই ঠিক এই সুরে ডাকে আমায়।

কৌস্তুভ আরক্ত মুখে বলে ওঠে, অপমানের শোধ নিলে? যাক, হয়তো এ আমার পাওনাই ছিল। তবু বলছি, হা ওই কথাই বলতে এসেছিলাম, রাগ করে চলে যেও না।

চৈতালী খুব ঠাণ্ডা মৃদু গলায় বলে, না, রাগ করে চলে যাব কেন?

.

-না, রাগ করে নয়—

কাগজের টুকরোটা মুঠোয় চেপে ধরে সুলক্ষণা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন সাদা দেয়ালের দিকে।

তারপর দেখলেন, সকালের জন্যে পরিপাটি রান্নার গোছ সাজানো। দেখলেন নিজের কোকালের পুরনো সরু যে দুগাছি বালা পরতে দিয়েছিলেন চৈতালীকে, সেই বালা দুগাছি বাসনের তাকে পড়ে আছে!

কাগজের টুকরোটায় চাপা দেওয়া ছিল যে চাবির থোলোটা, সেটা সুলক্ষণার হাত লেগেই মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

কাগজটা আর একবার চোখের সামনে তুলে ধরলেন–লেখা রয়েছে–না, রাগ করে নয়, লজ্জায়! চোরের মেয়েকে আদর করে ঘরে জায়গা দিয়েছিলে, এখন তোমাদের সংসারের কত সোনা চুরি করে নিয়ে চলে যাচ্ছি। তোমার লোকসান, আমার সারা জীবনের সম্বল।

কী এ?

স্বীকারোক্তি? এ কোন্ সোনা?

অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সুলক্ষণা ভাঙা গলায় ডেকে উঠলেন, ক্ষেণু!

ক্ষেণু এল।

বলল, মা?

সুলক্ষণা কাগজটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, চলে গেছে।

সুদক্ষিণা বোবা চোখ মেলে তাকাল, চলে গেছে!

.

চলে গেছে!

হ্যাঁ, চলে গেছে।

কে জানে কখন!

কে জানে কোথায়!

তার সেই চিরকালের খড়কুটোর বাসা তো ভেঙে গেছে, উড়ে গেছে নিশ্চিহ্ন হয়ে!

আবার কোথায় কোত্থানে জুটবে নতুন বাসা?

আর কি কেউ অজানা অচেনা একটা যুবতী মেয়েকে বলে বসবে, আমার কাছে থাকবি?

তা হয়তো বা বলবে।

এই শহরে পাপের বাসার তো অভাব নেই। প্রলোভনের হাতছানি দিয়ে কেউ হয়তো ডেকে নিয়ে যাবে। আর আদি অন্তকাল থেকে মেয়েমানুষের জন্যে অধঃপাতের যে একটাই পথ নির্দিষ্ট আছে, সেই পথের নিশানা চিনিয়ে দেবে।

সুলক্ষণা হেরে গেলেন।

সুলক্ষণা তো প্রমাণ করে দেখাতে পারলেন না, মানুষ অমৃতের সন্তান।

কিন্তু কে বলতে পারে, অমৃতের অধিকার পেল না বলে অভিমানে মৃত্যুটাকেই হাতে তুলে নিল চৈতালী।

এই শহরতলির আশেপাশে রেললাইনের তো অভাব নেই? মরণ ফাঁদ পেতে তো পড়ে আছে মাইলের পর মাইল।

সেখানেও সুবিধে না হয়, আছে খানা ডোবা পুকুর।

বাঁচবার ঘরের দেওয়াল পাথরে গাঁথা, তার দরজা খুঁজে পাওয়া কঠিন। মরবার রাস্তা খোলা চওড়া মসৃণ। তার কোথাও কোনখানে আগল নেই।

চৈতালী হয়তো সেই আগলহীন রাস্তাটাই বেছে নিয়েছে। এপথে মিলে যাবে তার সারাজীবনের পরাধীনতার মুক্তি, সমস্ত নিরুপায়তার মুক্তি।

আমি আমার এ কথা বোঝবার এই একটাই পথ।

.

কিন্তু চৈতালী এমন একটা কী প্রাণী যে তাকে নিয়ে আরও অনেক ভাবা হবে?

কে দিচ্ছে সে অবসর?

সংসার, সমাজ, না তার ভাগ্য?

কেউ দেবে না।

সংসার যদি বা একটা নিশ্বাস ফেলে একবার অন্তত অন্ধকার আকাশটার দিকে তাকায়, যদি ভাবে এ ভুলটা তো না করতেও পারতাম আমরা।

চৈতালীর কুগ্রহে গড়া ভাগ্য সে নিঃশ্বাস ছিনিয়ে নেবে আর একজনের জন্যে। সে নিঃশ্বাসকে হাহাকারে পরিণত করে তুলবে সেই ভাগ্যমন্তের সন্ধানে।

চৈতালী হয়তো মরে গেছে ভেবে কতক্ষণ ভাবনাবিলাস করবে সংসার, সংসারের সবচেয়ে দামী লোকটাই যদি সত্যি মরে গিয়ে টেক্কা দেয় তার ওপর?

রাত্তিরে ওরা সকলেই যথানিয়মে খেয়ে শুয়েছিল। কে জানে কে ওই রাত্রির আকাশটার দিকে তাকিয়ে বসেছিল, আর কে নিশ্চিন্ত নিদ্রায় মগ্ন ছিল।

অপর্ণাকেই শুধু ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল ঘুমের ওষুধ খাইয়ে। খুব হয়তো দরকার বুঝেছিল অপর্ণার স্ত্রৈণ স্বামী। স্ত্রীর এতটুকু অসুবিধে দেখলেই যে দিশেহারা হয়ে ওঠে।

তা ঘুমন্ত আর জাগন্ত যাই হোক, সব প্রাণীগুলোই তো নিথর হয়ে ছিল। রাত্রির স্তব্ধতা। ক্লেদাক্ত হয়ে ওঠে নি, অপবিত্র হয়ে ওঠে নি, রূঢ় আলোকপাতে, চঞ্চল পদপাতে।

রাত্রির কমনীয়তা একটুও কুৎসিত হয়ে ওঠে নি কারও ভয়ার্ত স্বরে।

.

কিন্তু শেষরক্ষা হল না।

শেষরাত্রির স্তব্ধতা ক্লেদাক্ত হয়ে উঠল। শেষরাত্রির কমনীয়তা কুৎসিত হয়ে উঠল।…

সমস্ত ঘরের আলো জ্বলে উঠল রূঢ় বাস্তবতা নিয়ে। সমস্ত বাড়িটা মুখর হয়ে উঠল চঞ্চল পদপাতে।

প্রথম ধাক্কা পড়ল সুলক্ষণার দরজায়।

সুলক্ষণা তন্দ্রায় আচ্ছন্ন নির্লিপ্ততায় শুনলেন সে শব্দ, কিন্তু আচ্ছন্নতা কতক্ষণ থাকে? ঘন ঘন ধাক্কা এসে পড়ে দরজার ওপর, ঘুমের ওপর, স্তিমিত উদাসীনতার ওপর।

মা, ওকে দেখবে এসো!

সুলক্ষণা অবিন্যস্ত আঁচল লুটোতে লুটোতে বেরিয়ে এলেন, দালানের আলোটা জ্বেলে দিলেন, তারপর ভয়ার্ত স্বরে চিৎকার করে উঠলেন, খোকা!

সুদক্ষিণা বেরিয়ে এল ওঘর থেকে।

তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠল, দাদা?

কৌশিক তিনতলা থেকে নেমে এল। চিৎকার করল না, শুধু দৃঢ় গলায় বলল, কখন?

কৌস্তুভ বলল, জানি না।

.

অপর্ণা আর ঘামবে না।

কোনদিনও না।

অপর্ণার চোখ দিয়ে আর জল গড়াবে না।

একবিন্দুও না।

অপর্ণার বুকের ওঠাপড়াটা আর মৃত্যুর সংকেতে সকলকে দিশেহারা করে তুলবে না। তবে কৌস্তুভ আর ব্যস্ত হয়ে ওঘরে গিয়ে বসবে কেন? দরকার নেই। তাই ঘরের বাইরে এসে বসে ছিল কৌস্তুভ মাথার চুলগুলো মুঠোয় চেপে।

আর কারও কথার উত্তর দেবার ছিল না।

ভাইয়ের কথার উত্তর দিল কৌস্তুভ। বলল, কি জানি! টের পাই নি। ঘুমের মধ্যে কখন—

সুলক্ষণা ঘরে ঢুকে গেছেন।

বসে আছেন।

একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন।

তাকিয়ে আছেন সদ্য মৃতার সাদা খড়ির মত মুখটার নীল হয়ে যাওয়া রঙের দিকে নয়, তাকিয়ে আছেন দেয়ালে ঝোলানো ওদের বিয়ের সময়কার সেই রঙিন ছবিটার দিকে!

ওই ছবিটার মধ্যে এত কী পাচ্ছেন সুলক্ষণা যে, দেখে দেখে আর শেষ করতে পারছেন না?

সুদক্ষিণা এক জায়গায় বসে থাকতে পারছে না। ও ঘরে ঢুকছে, বেরিয়ে আসছে। বসছে, দাঁড়াচ্ছে।

সুলক্ষণা একবার ক্লান্ত গলায় বললেন, এখানে বসতে না পারিস, বাইরে গিয়ে বসগে যা।

বসতে পারছি না– বলল সুদক্ষিণা।

তারপর বলল, আশ্চর্য! এতবার এত সমারোহ হল, কিছু হল না! আর সত্যি যখন একেবারে চলে গেল, তখন–চুপি চুপি চোরের মত

সুলক্ষণা বুঝি একটু হেসে বললেন, মৃত্যু রাজা, মৃত্যু চোর! ও কখনো ঘোড়ায় চেপে দেউড়ি দিয়ে আসে, কখনো নিঃশব্দ পায়ে পেছনের দেয়ালে সিঁদ কাটে!

.

তারপর আস্তে আস্তে ভোর হল, সকাল হল।

আর সকালের এই স্পষ্ট সাদা আলো যেন এতক্ষণে এদের বাস্তব জগতের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিল।

জানিয়ে দিল, অকারণ দেওয়ালে ঝোলানো একটা ছবির দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করার সময় আর নেই। জানিয়ে দিল মৃত্যু শুধু স্তব্ধ সুন্দর নয়, মৃত্যু সশব্দ কর্কশ।

সাদা গোলাপে ঢাকা শবদেহ সামনে নিয়ে শুধু বসে থাকার শান্ত ইচ্ছা হাস্যকর পাগলামি।

এই দেহ, এই খাট, এই সাজানো ঘর এখুনি তছনছ করে ফেলতে হবে। হৃদয়সম্পর্কহীন কতকগুলো লোক জড় করে এনে সাহায্য নিতে হবে তাদের, তারপর বিধানের পুঁথি খুলে বসে হিসেব করতে হবে, এরপর কী করণীয়।

অপর্ণা আর ঘামবে না।

অপর্ণার নাড়ি আর দ্রুত স্পন্দিত হবে না, অপর্ণার হৃদ্যন্ত্র থেমে যাব যাব বলে আর ভয় দেখাবে না, তবু ডাক্তারকে খবর দেওয়া হল। বহুদিন যাবৎ এ সংসারের নিত অতিথি তিনি। এবার সময় হয়েছে শেষ কর্তব্য সাধনের।

ডাক্তার এলেন।

আর ঠিক সেই তখন, যখন ডাক্তারের জুতোর শব্দ সিঁড়িতে শোনা যাচ্ছে, কৌশিক অপর্ণার ঘরে এসে ঢুকল। চুপ করে তাকিয়ে দেখল এক মিনিট, টেবিলের কাছে চলে এল, ঘুমের ওষুধের শিশিটা তুলে ধরল। নামিয়ে রাখল আরও একরাশি শিশি বোতল কৌটোর দঙ্গলের মধ্যে।

ফিরে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের দিকে তাকাল। আস্তে একটু হাসির মত করে বলল, আপনার কাজ কমে গেল এবার!

যে মৃত্যু প্রতিক্ষণ উঁকি দিয়েছে, যে প্রতিদিন দুএকবার করে দেখে গেছে বন্ধ তালাটা কতখানি মজবুত, মোচড় দিয়ে গেছে খানিকটা করে ভেঙে পড়ে কি না দেখতে, সে মৃত্যুকে আবার যাচাই করবার কি আছে?

ডাক্তার ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন একবার, বুকপকেট থেকে কলমটা বার করলেন।

ছাড়পত্র চাই।

প্রাণটা ছেড়ে যাবার পরও দেহটার জন্যে ছাড়পত্রের দরকার। ওটা যত্ন করে সঙ্গে নিতে হবে।

.

ডাক্তার চলে গেলেন। এবার সমারোহের দরজা খুলে দেওয়া হল। লোকে ভরে গেল বাড়ি। নীল হয়ে যাওয়া কপাল সাদা চন্দনের ছাপে ঢেকে গেল। ওর সেই সাদা খড়ির মত কপালটাই আবার ফুটে উঠল যেন।

অপর্ণার বিয়ের সময়ের অধিবাসের শাড়িটা বার করে দিলেন সুলক্ষণা, যেটা পরিয়ে ওই রঙিন ফটোখানা একদিন তুলিয়েছিলেন অপর্ণার শ্বশুর।

এবাড়ি থেকে তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন একদিন, আজ তার যত্ন করে খুঁজে আনা বৌ চলে গেল।

সুলক্ষণা শেষবারের মত কপালে একটা হাত রেখে ধীর কণ্ঠে বললেন, যিনি খুঁজে খুঁজে নিয়ে এসেছিলেন, তোমায়, তাকে এবার খুঁজে বার করগে তুমি।

কৌশিক মার পিঠে একটা হাত ঠেকিয়ে বলল, সব মৃত্যুই কি একই জায়গায় পৌঁছয় মা?

সুদক্ষিণা কথাটা শুনতে পেল।

ভাবল, একথা বলল কেন ছোড়দা? চৈতালীর কথা মনে পড়ল না ওর।

.

তারপর। অনেক দুর্ভোগের পর

অনেক রাত্রে বাড়ির সব আলো যখন নিভে গেছে, ছাতের দালানের সিঁড়ির, শুধু মৃতের ঘরের আলো নেবানো বারণ বলে কিসের যেন একটা ক্ষীণ আলো জ্বলছে, তখন সুলক্ষণা সে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন।

এসে তিনি দেখলেন, তাঁর বড় ছেলে জানলা ধরে দাঁড়িয়ে আছে পেছন ফিরে।

এই স্তব্ধতার ছবি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দেখলেন সুলক্ষণা, তারপর সাবধানে কাছে এসে ডাকলেন, খোকা!

ফিরে দাঁড়াল কৌস্তুভ।

এত অস্পষ্ট আলোয় ওর মুখ দেখতে পেলেন না সুলক্ষণা। নরম গলায় বললেন, ঘুম। আসছে না থোকা?

না।

খুব বেশী সহজ হবার জন্যেই বোধ করি বড় বেশী সাধারণ গলায় কথা বলল কৌস্তুভ।

বলল, না। সারাদিন অনেক ঝঞ্জাট গেল। মাথাটা বড্ড ধরে গেছে।

তারপর বলল, মা জানলার কাছে এসো!

কি? জানলার কাছে কি?

সুলক্ষণা যেন ভয় পেলেন।

কৌস্তুভ ভয় পেল না। কৌস্তুভ যেন হাসল। বলল, নীচের কার্নিসের দিকে তাকিয়ে দেখ।

সুলক্ষণা জানলার কাছে এলেন।

জানলার গরাদের খাঁজে মুখটাকে রাখলেন। লোহার এই শিকগুলৈ বাধা। তা হোক, তবু দেখতে অসুবিধে হচ্ছে না! কার্নিসটা চওড়া।

অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন সুলক্ষণা সেই নীচের দিকে। ওঁর মনে হল ওখানে যেন অনেকগুলো আগুনের ফুলকি জ্বলছে।

আমি জানতাম! আমি জানতাম! যেন মনের মধ্যে উচ্চারণ করছেন সুলক্ষণা, এই রকমই একটা কিছু যে হবে আগেই ভেবেছিলাম আমি!

মনের মধ্যে উচ্চারণ করলেন যেন।

তবু এই সদ্য মৃত্যুর ছমছমানি ভরা, একেবারে নিস্তব্ধ ঘরের পটভূমিকায় সেই উচ্চারণ শুনতে পেল কৌস্তুভ।

বাতাসের মত শব্দে বলল, যদি দেখতে না পেতাম!

সুলক্ষণা নিশ্বাস ফেলে বললেন, যদি শুধু আমিই দেখতে পেতাম! তারপর বললেন, কখন?

কাল কাল রাত্তিরে!

সুলক্ষণা বিড়বিড় করে বললেন, তাহলে আমার সব ধারণা ঠিক!

কৌস্তুভ জানলা থেকে সরে এল। বিছানায় বসে পড়ে বলল, হ্যাঁ, ঠিক। আমি জানতাম, তুমি বুঝতে পারবে। তোমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। কিন্তু মা, জানো? কৌস্তুভের গলার স্বরটা যেন ছায়ার মত শোনালোজানো, আজ আবার তাকিয়ে দেখতে দেখতে অদ্ভুত একটা মায়া হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এইটুকুর বেশী ক্ষমতা যার ছিল না, তাকে একটা মানুষই বা ভাবলাম কেন আমি!

সুলক্ষণা অন্ধকারে আন্দাজে ছেলের গায়ে একটা হাত রাখলেন। বললেন, তুইও তো মানুষ খোকা! রক্তমাংসের মানুষ!

.

কিন্তু অনেকক্ষণ পরে ঘরে কথার সাড়া আনলেন সুলক্ষণা।

কিন্তু ওরা ওঠবার আগে, ওরা জাগবার আগে ওর তো একটা ব্যবস্থা করতে হয় খোকা!

না মা! ওদের কাছে স্বীকার করব আমি, প্রকাশ করব। ওরা কেন মিছামিছি একজনকে দোষী ভেবে

সুলক্ষণা দৃঢ়স্বরে বললেন, তা হয় না খোকা!

কিন্তু কেন হয় না মা?

হয় না বলেই হয় না বাবা!

কিন্তু মা, জীবন বড়, না মৃত্যু বড়?

সুলক্ষণা বললেন, বড় ছোট বিচার করা শক্ত খোকা, শুধু জানি, মৃত্যু সম্মানের, মৃত্যু শ্রদ্ধার।

.

বংশী আসেনি, আর কেউ নেই, এখন সুদক্ষিণাকেই সকাল বেলা চা ঢালতে হবে।

আর বসে পড়ে বলা যাবে না, কই কোথায়?

ক্লান্ত মন আর ক্লান্ত ভঙ্গী নিয়ে চা ঢালতে ঢালতে সুদক্ষিণা আস্তে বলে, যখন বৌদির ঘরে কেউ থাকবে না, তখন তোকে একবার ওঘরে নিয়ে যাব ছোড়দা, একটা ভয়ঙ্কর জিনিস দেখাব।

কৌশিক চোখ তুলে বলে, জানি!

জানিস? জানিস তুই?

জানতাম! জানলাম!

কখন! কখন জানলি তুই?

এক সময়।

মাকে বলেছিস?

রুদ্ধ কণ্ঠ সুদক্ষিণার, রুদ্ধশ্বাস।

কৌশিক ম্লান হেসে বলে, পাগল হয়েছিস!

বলবি না? শুধু শুধু একটা মেয়েকে

কত লোকই তো শুধু শুধু কত কষ্ট পায় ক্ষে, কত লাঞ্ছনা সহ্য করে, ওটা তো পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কথা নয়। কিন্তু যে পৃথিবীর আওতা ছাড়িয়ে চলে গেছে, তাকে কেন আর?

তাই বলে তুই নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকবি?

হয়তো এখন আর চেষ্টা করার কোন মানেও নেই। খুব মর্মান্তিক ধিক্কারের মুহূর্তে মানুষ চরম পথটাই বেছে নেয়।

তুই তক্ষুণি কেন বেরোলি না ছোড়দা, ও চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে।

কৌশিক ম্লান হেসে বলে, কখন সময় পেলাম বল? সবটাই তো আকস্মিক ঘটে যাচ্ছে। যেখানে বাড়ির বৌয়ের মৃত্যুর সমারোহ, সেখানে বাড়ির রাঁধুনীর

ছিঃ ছোড়দা!

কৌশিক মিনিট খানেক চুপ করে থেকে আস্তে বলে, কিন্তু ক্ষেণু, ওর ঘর সার্চ করতেও আমাদের বাধেনি!

এই ঘর সার্চের ব্যাপারে সুদক্ষিণার ভূমিকা রয়েছে, তাই সুদক্ষিণা আরক্ত মুখে বলে, সে আমি ওকে সন্দেহ করে নয় মোটেই। মা দাদার ওপর রাগ করে।

তা জানি। শুধু ভাবছি ও সে কথা বুঝতে পেরেছিল কিনা। অভিমানে একদম পাথর হয়ে গিয়েছিল তখন।

হওয়াই স্বাভাবিক। আশ্চর্য, সেদিন আমরা সব জায়গা দেখলাম, অথচ ওই–ওই জানলার নীচেটা–

আমি দেখেছিলাম—

দেখেছিলি? তুই দেখেছিলি? কখন?

যখন আসামী কাঠগড়ায়—

ছোড়দা!

সুদক্ষিণা আর্তস্বরে প্রায় চীৎকার করে ওঠে, তবে? তবে কেন তুই… তখন তো বৌদি মারা যায়নি!

না, তা যায়নি। কিন্তু কৌশিক একটু হাসে, সত্য উদঘাটনের প্রতিক্রিয়ায় যদি মারা যায়, এই ভয়ে জানলা থেকে উদাসীন মুখ নিয়ে ফিরে এলাম। কিন্তু আশ্চর্য দেখ, শেষরক্ষা হল না। বৌদিকেও বাঁচানো গেল না।

ঘুমের ওষুধ এত বেশী বেশী আনা থাকত ছোড়দা?

খুব বেশীর দরকার হয়নি রে ক্ষেণু!

সুদক্ষিণা এই দুদিনেই অনেক বড় হয়ে গেছে। সুদক্ষিণার মুখে সেই পরিণতির ছাপ।

অথচ দেখ ছোড়দা, কারও কোথাও শাস্তি হল না! ডাক্তারও তাকিয়ে দেখল না।

হয়তো ডাক্তারেরও ধৈর্যের শেষ হয়ে গিয়েছিল।

থাক! ডাক্তারের আবার ধৈর্য অধৈর্য! দিব্যি একখানি কামধেনু পেয়েছিল।

ছিঃ ক্ষেণু, মানুষ সম্বন্ধে ও রকম শ্রদ্ধাহীন কথা বলিস না। টাকাই শেষ কথা, এমন মানুষ খুব বেশী নেই।

না থাকলেই মঙ্গল– সুদক্ষিণা ঠোঁট উল্টোয়।

কৌশিক আস্তে বলে, দেখ ক্ষেণু, ঘটনার চেহারা দেখে মানুষকে বিচার করলে বড় ভুল করা হয়। নিজেদের তো কেউই আমরা ভয়ানক একটা পাষণ্ড ভাবি নি, তবু দেখ যদি চৈতালীর দিক থেকে

ওদের কথা শেষ হয় না।

ওদের কথার মাঝখানে কৌস্তুভ এসে দাঁড়াল। শান্ত গলায় বলল, কেউই যে আমরা নিজেকে পাষণ্ড ভাবি না, এ কথাটাও তোর ভুল কুশী!

দাদা!

দুজনেই বলে উঠল ওরা।

সুদক্ষিণা তারপর বলল, খাওয়া দাওয়া না করে কোথায় গিয়েছিলে? এতখানি বেলা হয়ে গেল, মা খাননি।

মা খাননি, এমন কথাতেও বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করল না কৌস্তুভ। সেই ভাবেই বলল, মেয়েটাকে কি এমন করে অনায়াসেই হারিয়ে যেতে দেওয়া হবে ক্ষে?

কে, কে, কার কথা বলছ তুমি? ক্ষেণু চেঁচিয়ে ওঠে, দাদা! কথাটা কি ভূতের মুখে রামনামের মত হল না? দুজনে মিলে তোমরা ষড়যন্ত্র করে তাকে।

সুদক্ষিণা চুপ করে গেল।

মনে পড়ে গেল সেই দুজনের একজন আজ নেই। তার সম্বন্ধে বাকসংযমের প্রয়োজন। সে জিতে গেছে, সে ভয়ঙ্কর একটা অন্যায় করেও সংসারের বিচারের দৃষ্টির উর্ধ্বে উঠে গেছে।

কৌশিক চেঁচাল না।

কৌশিক নিথর হয়ে তাকিয়ে রইল তার দাদার পাথরের মত মুখের দিকে।

কৌস্তুভ বোনের সহসা রুদ্ধবাক উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত চোখে বলে, ধরলাম দুজনে মিলেই। কিন্তু–এও তো সত্যি, ভুল মানুষেই করে। আবার ভুল সংশোধনও মানুষেরই কাজ–

সুদক্ষিণার ব্যঙ্গ তীব্র হয়ে ওঠে, তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। বলে, এটা কী দাদা? অনুতাপ, না মহত্ত্ব?

ক্ষেণু! এবার কৌশিকের কণ্ঠে শব্দ ফোটে। সে শব্দে নিষেধের সুর।

সুদক্ষিণা কিন্তু এই নিষেধে কান দেয় না। সেই তীব্রতার সঙ্গেই বলে, কেন বারণ করছ ছোড়দা? মুখোশ এঁটে যে চিরদিন সংসারকে ভোলানো যায় না, সেটাও প্রকাশ করার দরকার আছে বৈকি। বৌদিকে যে তুমি একদিনের জন্যেও ভালবাসতে পারনি দাদা, সেটা তোমার চেয়ে আর বেশী কে জানে? তবু তুমি আদর্শ স্বামী সেজে রাতদিন তাকে ঠকিয়েছ। সেই ছলনার মুখোশখানা নেড়ে আহা আহা করে তার মুখ বন্ধ করে রেখেছ। বিদ্রোহ করবার তিলার্ধ সুযোগ দাওনি তাকে। হয়তো সে সুযোগ দিলে তার নার্ভগুলো এত বিকৃত হয়ে উঠত না। আর সেই বিকৃতির বোঝা নিয়ে এমন হাস্যাস্পদও হয়ে উঠত না। তিল তিল করে শুধু যত্নের অত্যাচারে মেরেছ তাকে তুমি, আর শেষ পর্যন্ত।

আবার সহসা থেমে যায় সুদক্ষিণা। মনে পড়ে যে কথা, যে ভয়ঙ্কর কথা, এখনো অনুক্ত আছে, সেটা উদঘাটন করে বসা চরম নিবুদ্ধিতা।

নিরাবরণ নিষ্ঠুর সত্যটা সমস্ত সংসারকে যেন দাঁত খিঁচিয়ে উঠবে।

কিন্তু কৌস্তুভ সেই চরম নির্বুদ্ধিতাটাই করে বসে।

কৌস্তুভ বোনের এই উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে যেন মৃদু হাসির সঙ্গে বলে, হ্যাঁ শেষ পর্যন্ত। কিন্তু পরে মনে হল এতটা না করলেও চলতো। কতটুকুই বা ক্ষমতা ছিল ওর? জানলা পর্যন্ত পৌঁছতেই

সুদক্ষিণা স্থির স্বরে বলে, জানলা পর্যন্ত পৌঁছবার ক্ষমতা তো ওর ছিল না দাদা!

ঠিকই বলেছিস ক্ষে, সে ক্ষমতা ছিল না ওর। তবু গিয়েছিল। দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। একেই হয়তো মরীয়া অবস্থা বলে। ঈর্ষার জ্বালায়–

কিন্তু কেন এই ঈর্ষা, কেন এই বিদ্বেষ বলতে পার দাদা?

সব কথাই কি বলা যায় ফেণু? না সব কথা বলার যোগ্য হয়? তবে ঈর্ষাই তো অক্ষমের সম্বল! তাই তোদের অনুরোধ করি, অক্ষম বলে অবোধ বলে তাকে তোরা একটু দয়া করিস। আমি কিছুদিনের জন্যে বাইরে যাব ঠিক করেছি, হয়তো সেই অবকাশে সংসারের সব জটিলতা সরল হয়ে যাবে, হয়তো সংসার তার অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করবার সুযোগ পাবে। হয়তো মার দুটো ছেলেই ব্যর্থ হয়ে যাবে না। কিন্তু এটা জেনে রাখিস ক্ষে, চেষ্টা করলেই কাউকে ভালবাসা যায় না। আর ইচ্ছে করলেই ভালবাসা ফিরিয়ে আনা যায় না। শুধু সে ভালবাসাকে মোহমুক্ত, নির্মল করে তোলার সাধনাই হচ্ছে মানুষের কর্তব্য।

.

দাদাকে আমরা ভুল বিচার করেছি

ক্ষেণু আস্তে বলে।

কৌশিকও সেইভাবে বলে, প্রতি পদেই তো আমরা ভুল বিচার করি ক্ষে, প্রত্যেকটি লোককেই ভুল বুঝি। আমাদের বিচারের দৃষ্টিটা যদি আর্শির মত স্বচ্ছ হত, তা হলে তো সংসারে কোনও সমস্যাই থাকত না।

দাদা হয়তো বৌদিকে সুখী করতেই চেষ্টা করত। হয়তো ঠকাবে ভেবে মুখোশ আঁটেনি, হয়তো দাদা নিজেও বুঝত না।

.

ওদের কথার মাঝখানে ছেদ পড়ল।

সুলক্ষণা দ্রুত ছুটে এসেছেন একখানা বাঙলা খবরের কাগজ হাতে, প্রকৃতিবিরুদ্ধ কণ্ঠ সুলক্ষণার, কুশী, কুশী, মেয়েটা বুঝি সেই সর্বনাশই করল রে–

সুলক্ষণার এত বছরের ঘরকরা রাজরাণীর মত বৌ বিষে নীল হয়ে নিথর বনে গেল, তবু উত্তেজিত হননি সুলক্ষণা, বিচলিত হননি। বিচলিত হচ্ছেন যে ঘুঁটেকুড়নীটাকে রাজরাণী করার স্বপ্ন দেখেছিলেন মাত্র, তার মৃত্যুর আশঙ্কায়!

আশ্চর্য বৈকি।

মাকে এমন কখনো দেখেনি সুলক্ষণার ছেলেমেয়েরা। বাবার মৃত্যুসময়েও না।

তখন সুলক্ষণা পাথর হয়ে গিয়েছিলেন।

এখন সুলক্ষণা কাতর হচ্ছেন।

সুলক্ষণা আছড়ে পড়ছেন।

মেয়েটাকে আমিই মেরে ফেললাম ক্ষেণু!

কৌশিক অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল।

.

কি? কি হল কি? কাগজে কি?

ঝুঁকে পড়ল সুদক্ষিণা

কাগজে কি দেখেছেন সুলক্ষণা, দেখালেন মেলে ধরে। তিনদিন আগের খবর।

গত সোমবার সকালে বাঁশধানী অঞ্চলে একটি পুকুর হইতে একজন তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তরুণীর পরনে সরু কালপাড় ফিকে নীল রঙের শাড়ী ও শাদা ব্লাউজ। দেহে কোথাও অলঙ্কারের চিহ্ন নাই। তরুণীটিকে কুমারী বলিয়া মনে হয়। পুলিশ ইহাকে একটি আত্মহত্যার ঘটনা অনুমান করিতেছে।

ও কি ওই রকম শাড়ী ব্লাউস পরেছিল সেদিন?

ক্ষেণু প্রায় ডুকরে ওঠে, কই কোনদিন তো

সুলক্ষণা আস্তে বলেন, না কোনদিন পরেনি, শুধু যেদিন প্রথম এসেছিল, ওর নিজের সেই শাড়ী পরে চলে গেছে। যাবার সময় আমার দেওয়া কিছুই নিয়ে যায়নি ক্ষেণু! আমার ভালবাসাটাও আমার পুরনো শাড়ীগুলোর মত ফেলে দিয়ে চলে গেছে।

সুলক্ষণা উদ্বেল হয়ে উঠেছেন।

সুলক্ষণা সেখানে যাবেন।

সুদক্ষিণাও।

কুশী এখনি চল। দেখ পুলিশ তাকে জ্বালিয়ে দিল কিনা। একবার দেখব গিয়ে এত বড় অভিমানে মুখটা তার কেমন হয়ে গেছে

কৌশিক এতক্ষণ চুপ করেই ছিল। এবারে সে আস্তে বলে, মা তুমি নাইবা গেলে? আমি যাই–

নারে কুশী, আমি তাকে একবার দেখব।

মা তুমি গেলে সেই মৃত্যুর সমস্ত দায়িত্ব তোমার ওপর পড়বে। যে তোমার কাছ থেকে এমন হঠাৎ চলে গিয়ে।

কৌশিক থেমে যায়।

তারপর একটু থেমে খুব মৃদু গলায় বলে, পুলিশের ব্যাপার তো জানো? হয়তো অকারণ কতকগুলো কদর্যতা টেনে এনে ভয়ানক একটা অপমানে ফেলবে তোমাকে। হয়তো বলবে

এখন বসে বসে তুই ঝামেলা ঝাটের ভাবনা করছিস কুশী, সুলক্ষণা ধিক্কার দিয়ে ওঠেন, সেটাই বড় হল তোর কাছে?

কৌশিক মার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকায়।

দৃঢ় গলায় বলে, ঝামেলা ঝঞ্জাট নয় মা, তোমার সম্মান। আমার কাছে তার চাইতে কোন কিছুই বড় হতে পারে না।

.

কিন্তু চিরদিনের বুঝমান সুলক্ষণা বুঝি অবুধ হয়েছেন। তাই কৌশিক তাকে কোন যুক্তিতেই রুখতে পারে না। তিনি যাবেনই। দেখবেন সেই অভিমানিনীর মুখ! যদি কৌশিক নিয়ে না যায়, তিনি বড় ছেলের কাছে গিয়েই দরবার করবেন।

বলবেন খোকা, তোকে তো কখনো কিছু কাজের ভার দিই না, আজ

.

না, সুলক্ষণার বড়ছেলে মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুক্তি প্রয়োগ করেনি, নিষেধ করেনি ঝঞ্ঝাট আর ঝামেলার ভয়ে। শুধু বলেছিল, বৃথা যাবে মা। সে নয়।

.

সেই কথারই উত্তর দিলেন সুলক্ষণা, সেই অনেক কষ্টের পারাবার পার হয়ে বাড়ি ফিরে। কিন্তু চুপি চুপি যেন নিজের কানে কানে বললেন, এ নয় বলেই কি আমি খোকার কথা মানব? না, সে আমার বড় অভিমানী। আমি জানি এখানে নয়, কিন্তু অন্য কোনখানে…।

.

সুলক্ষণার ব্যাকুল স্নেহ কি ভুলপথে হাতড়ে মরতে চাইছে? সুলক্ষণার ধীর স্থির বড় ছেলেই কি ঠিক বুঝেছে? সে যে বলেছিল, যেতে চাও চল, নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমি বলছি, সে হতেই পারে না। তার মধ্যে আগুন আছে, শক্তি আছে, সেই শক্তি মৃত্যুর কাছে পরাস্ত হতে আসেনি, সেই আগুন ওই পানাপুকুরের জলে নিভে যেতে যায় নি।

কিন্তু সুলক্ষণা বিশ্বাস করবেন না সে কথা। সুলক্ষণা খবরের কাগজ তন্ন তন্ন করে দেখবেন, কোথায় কোনখানে মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছে।

সুলক্ষণা তরুণী অথবা যুবতী শুনলেই সেখানে ছুটবেন। আসুক বিপদ, আসুক বিরক্তিকর প্রশ্ন, কিছুতেই যেন সুলক্ষণা হার মানবেন না।

কিন্তু দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে যে! এতদিন পরে কি চৈতালী রেলে কাটা পড়তে যাবে? জলে ডুবতে যাবে?

কৌশিক বলে, মা, এ কী পাগলামী করছ তুমি?

সুলক্ষণা বলেন, বল, পাগলই বল আমাকে।

সুদক্ষিণা বলে, মা, এত ভালই যদি বাসতে তাকে, তবে কেন সেদিন।

সুলক্ষণা নিঃশ্বাস ফেলেন।

বলেন, ভেবেছিলাম ও আমায় বুঝবে। ভেবেছিলাম ও আমায় মায়া করবে। ও নিষ্ঠুর, ও তা করল না!

.

আর কৌস্তুভ?

সে কি কিছু বলে না?

না, সে কিছু বলে না। সে দীর্ঘ কারাভোগের পর মুক্তি পেয়েছে, তাই বেড়াতে চলে গেছে। কিন্তু শুধুই কি বেড়াতে?

দাদার শূন্য ঘরটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে কৌশিক, দাদা কি শুধু মুক্তির আস্বাদ ভোগ করতেই বেরিয়ে পড়েছে, কাজে ছুটি নিয়ে?

কে জানে!

কৌস্তুভের মনের ভেতরের কথা কোনদিনই বোঝা যায় না।

.

তবু একদিন বোঝা গেল।

কৌস্তুভের চিঠি সেকথা বুঝিয়ে দিল। কোথায় বেড়াতে গেছে কৌস্তুভ, সে কথা এরা জানে না। কৌস্তুভ যে চিঠি দিয়েছে, তাতে নিজের ঠিকানা জানায় নি। হঠাৎ একদিন অন্য একটা ঠিকানা দিয়েছে। একটা চিঠির সঙ্গে। দমদমের কোন একটি উদ্বাস্তু কলোনির ঠিকানা।

কৌশিককে লেখা এই চিঠিতে ঠিকানা পাঠাবার কোন কারণ উল্লেখ নেই।

তবু বুঝতে পারে কৌশিক।

দাদাকে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে।

কিন্তু কী সংবাদ নিহিত আছে এই পরিচয়হীন একটা তুচ্ছ ঠিকানার মধ্যে? এতদিন ধরে সুলক্ষণা যা ভেবে এসেছেন তাই কি?

অনেক পথ অতিক্রম করে খুঁজে খুঁজে পৌঁছে আবার কি একখানা মৃত্যুনীল মুখ দেখতে হবে কৌশিককে? নাকি কোনো মৃত্যুপথ যাত্রিণীকে? না এ ঠিকানা শুধু সন্ধানবার্তা?

আশা এক আনা, আশঙ্কা পনেরো আনা। সেই আশা আর আশঙ্কা, বোঝা আর না বোঝার দ্বন্দ্বে কম্পিতহৃদয় নিয়ে একাই বেরোয় কৌশিক।

সুলক্ষণা বলেছিলেন, আমি যাইরে?

কৌশিক কেমন একরকম করে তাকিয়ে বলেছিল, যদি তুমি সহ্য করতে না পার?

আমি পারব না, তুই পারবি?

আমার সম্পর্কে ধারণা একটু বদলাও মা!

তোর কি মনে হচ্ছে বল তো কুশী?

সর্ববিধ মনে হওয়া থেকে মনকে আমি একেবারে মুক্ত করে ফেলেছি মা।

সুদক্ষিণা বলে, আমি তা পারিনি। আমি ওর মত অত মুক্তজীব নই মা। আমার মনে হচ্ছে, এ ওরই ঠিকানা। ও আছে। দাদা খুঁজেছিল, দাদা ওর সন্ধান পেয়েছে।

সুলক্ষণা কথা বললেন না, নিঃশ্বাস ফেললেন। আর কৌশিক চলে গেলে সহসা মেয়েকে ডেকে বলে উঠলেন, যদি তোর কথাই সত্যি হয় ক্ষে, কুশী কী করবে সে তো বলে দেওয়া হল না!

সুদক্ষিণা আস্তে বলে, এ তো তুমি আমি বলে দিয়ে করাবার জিনিস নয় মা, ওর মন যা বলবে, তাই করবে ও।

ও যদি শুধু নিজের মনের নির্দেশটাই না দেখে? যদি আর কারও মনের কথা ভাবতে বসে?

তা যদি হয় মা, সুদক্ষিণা বলে, বুঝতে হবে ওর মন এখনো কঁচা আছে। নিজেকে বোঝে।

কিন্তু আমরা কেউই কি আমাদের বুঝি ক্ষে?

.

এতদিন পারেননি, এতদিন একবারও এ ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখেননি।

আজ সুলক্ষণা চৈতালীর সেই পুরনো ঘরটায় এসে দাঁড়ালেন। দেখলেন আলনায় কয়েকখানা শাড়ী ঝুলে আছে।

ধূলিধূসর বিবর্ণ মলিন।

যে শাড়ীগুলো সুলক্ষণা নিজের আলমারি থেকে একখানি একখানি করে বার করে দিয়েছিলেন। সেই অবধি আর কেউ হাত দেয়নি এগুলোয়।

হঠাৎ মনের ভাবনাটা উচ্চারণ করে ফেললেন সুলক্ষণা, তুমিও আর কোনদিন হাত দেবে না! এবার তুমি যদি আমো, আপন অধিকার নিয়ে রাজ-সমারোহে আসবে। আমার ঘরের কোণের দিকের ছোট্ট এই এক ফালি ঘরের দিকে আর তাকিয়েও দেখবে না তুমি। তাকিয়ে দেখবে না আমার দেওয়া জিনিসের দিকে। যা তুমি ফেলে চলে গেছ, যার দিকে আমি এখনো পর্যন্ত তাকাতে পারি না।

চৈতালী এসে এসবের দিকে কী অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখবে, সেটাই ভাবতে লাগলেন সুলক্ষণা।

ধুলোভরা কয়েকটা শাড়ী, আলনার কোণে ঝুলে থাকা দুটো রঙিন ব্লাউজ, ব্র্যাকেটে রাখা একখানা চিরুনি, আর একটা তেলের শিশি, এই তো! এই তুচ্ছ বস্তুগুলোর জন্যে এমন জ্বালাভরা হাহাকার অনুভব করছেন কেন সুলক্ষণা?

.

ছত্র সেই চিঠিটা পড়বার পর যে হাহাকার উঠেছিল সুলক্ষণার মনে, নতুন করে আবার যেন সেই হাহাকার অনুভব করলেন সুলক্ষণা।

অথবা তার চাইতেও বেশি।

সেদিন শুধুই মর্মান্তিক একটা বেদনা ছিল, আজ তার সঙ্গে যেন একটা দাহ। কিসের এই দাহ? কী এত চিন্তা?

চৈতালী ফের আর তার পুরনো জায়গাটায় এসে দাঁড়াবে না, সেই ফাঁকা হয়ে যাওয়া ফাঁকটা ভরাট করে তুলবে না, এই চিন্তা? সে চিন্তাটা কি এতও তীব্র হল যে চিরতরে হারিয়ে ফেলা জিনিসটাকে ফিরে পাওয়ার আশা দেখেও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারছেন না সুলক্ষণা!

নাকি এখনো বিশ্বাসে আসতে পারছেন না তিনি, চৈতালী আছে! চৈতালী ফিরে আসবে।

সে কথা জানেন সুলক্ষণা আর তার ভগবান। কিন্তু একটু পরেই উঠে পড়লেন তিনি। কৌশিক না আসতেই, কোন খবর না পেতেই সুদক্ষিণাকে ডেকে তিনি বললেন, ক্ষেণু, ধর আমি যদি তোদের দাদাকে নিয়ে আর কোথাও গিয়ে থাকি, তুই এ সংসার চালিয়ে নিতে পারবি না?

সুদক্ষিণা ভুরু কুঁচকে বলে, তার মানে?

মানে কিছু না। কুশী সংসার পাতলে, আমার বোধ হয় অন্য কোথাও গিয়ে থাকাই উচিত।

বটে নাকি? ক্ষেণু ক্ষুব্ধ গলায় বলে ওঠে।

তা হলে তো তোমার কুশীর সংসার না করাই উচিত। হঠাৎ এমন অদ্ভুত চিন্তা তোমার মাথায় এল কেন বল তো?

সুলক্ষণা, চিরদিনের দৃঢ় আর স্থিরচিত্ত সুলক্ষণা, তিনি কি তাহলে অস্থির হয়ে গেলেন? দুর্বল হয়ে গেলেন? তাই কেমন যেন অসহায়ের মত তিনি বললেন, খোকার কথাটা তো আমায় ভাবতে হবে ক্ষেণু!

ভাবতে বারণ করছে কে? ভাবো না যত পার। কিন্তু সংসার ত্যাগ করতে যাবে কেন? খোকাকেই বা সংসারছাড়া করবার দরকার কি?

আমার মনে হচ্ছে ক্ষেণু, সংসার সে আপনিই ছাড়বে।

দেখব কে তাকে ছাড়তে দেয়।

কিন্তু ক্ষেণু, সুলক্ষণা হতাশভাবে বলেন, বৌমার সেই চোখ দুটোকে কি এ সংসার থেকে উপড়ে ফেলতে পারব? পারব না। সেই চোখ প্রতিনিয়ত আমাকে ভর্ৎসনা করবে। আমাকে ছুঁচ দিয়ে বিধবে

মা, তুমি তো এমন দুর্বল ছিলে না?

হয়তত ছিলাম না। কিন্তু কেবলই বুঝি মনে হচ্ছে ভেতরের সব জোর ফুরিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কোথায় যেন মস্ত বড় একটা অপরাধ করেছি।

সুদক্ষিণা মায়ের এই অপরিচিত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে বলে, সত্যিই অবাক লাগছে।

আমিও অবাক হচ্ছি, ক্ষে।

হঠাৎ সুদক্ষিণা অন্য এক চাল চালে। বলে, তোমার ছেলেদের ব্যাপারে তাহলে সব জোর ফুরিয়ে ফেললে? এই মেয়েটা বোধহয় ফাউয়ের খাতায়?

সুলক্ষণা কথাটা শোনেন, বোঝেন। তারপর বলেন, আমি কারও জন্যে কিছু করতে পারি, এ ভরসা আর নেই রে ক্ষে। আমার ছুটি নেবার মন হয়েছে।

মা, বৌদিকেও যে তুমি এত বেশী

সুলক্ষণা বাধা দিয়ে বলেন, মা হওয়া যে কত জ্বালা, সে তুই এখন কী করে বুঝবি ক্ষেণু?

ওই চিরকেলে পুরনো কথাটা তোমার মুখে শোনার আশা করিনি মা।

সুলক্ষণা এবার একটু হাসেন।

বলেন, মানুষ জীবটাই যে চিরকেলে পুরনো, ক্ষেণু! কালের প্রলেপে হয়তো তার রঙ বদলায়, পালিশ ঝলসায়, কিন্তু ভেতরের কাঠামোয় যখন হাত পড়ে, তখনই ধরা পড়ে তার পুরনোত্ব। তোর কথায় তাই আমি লজ্জা পেলাম না ক্ষে।

কিন্তু মা, ছোড়দারও তো মা তুমি? তাকে ত্যাগ করতে তোমার কষ্ট হবে না।

ত্যাগ? বলিস কি ক্ষেণু? ষাট ষাট! এ তো শুধু দূরে থাকা, সরে গিয়ে থাকা। সুখের দিনে, ঔজ্জ্বল্যের দিনে, সাফল্যের দিনে মাকে না হলেও চলে যায় ক্ষেণু, সে জীবনে মা শুধু একটা ডাক মাত্র, একটা সম্পর্কের বন্ধন মাত্র, আশ্রয় নয়। তাই মা চিরদিন থাকে তার দুঃখী সন্তানের দিকে, অভাগা অনুজ্জ্বল, ব্যর্থ সন্তানের দিকে।

ক্ষেণু তর্কের সুরে বলে, আর কোনো মায়ের যদি সব ছেলেমেয়েগুলোই সুখী সফল হয়, মা কি তবে তখন আমাকে আর কারও দরকার নেই–বলে গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে যাবে?

সুলক্ষণা হেসে ফেলেন।

বলেন, তা নয় ক্ষেণু। তখন শুধু মা ছুটি পাবে।

সুদক্ষিণা মায়ের মুখে যে সঙ্কল্পের ছায়া দেখতে পেয়েছে, তাতে আর ভরসা নেই। তবু সাহস করে বলে, যদি চৈতালীকে খুঁজে পাওয়া যায়, যদি ছোড়দা তাকে আনে, তাকে নিয়ে তুমি সংসার করবে না?

না ক্ষেণু, সংসার করার সাধ আমার বড় বৌমা ঘুচিয়ে দিয়েছে। পাপ যেখানে যে কোন কারণেই আসুক, তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। সেই প্রায়শ্চিত্তটাই রইল এখন আমার ভাগে।

মা, তবে তুমি চৈতালী চৈতালী করে অমন অস্থির হয়েছিলে কেন?

সুলক্ষণা হাসেন, ওই একটা ব্যাপারই মানুষের আয়ত্তের বাইরে, ক্ষেণু। ভেবে চিন্তে সঙ্কল্প স্থির করে কেউ অস্থির হয় না। যাক তবু তো বুঝলি, তোদের মা কাঠ পাথরে তৈরি নয়, নেহাই রক্ত মাংসের মানুষ?

ক্ষেণু আস্তে মাথা নাড়ে।

না, ঠিক বুঝলাম না। বরং মনে হচ্ছে কাঠেরও নয়, পাথরেরও নয়, স্রেফ স্টিলের।

.

ক্ষেণু চলে গেলে সুলক্ষণা চুপ করে বসে রইলেন। ভাবলেন, ওরা কোনদিনই আমাকে বুঝল না সে অভিমান ছিল আমার, কিন্তু এখন সে অভিমান ঘুচেছে। নিজেই কি আমি নিজেকে বুঝতাম? আর ওদেরই কি বুঝতে পারি?

.

না, কেউ কাউকে সহজে বুঝতে পারে না। বুঝতে চায় না বলেই হয়তো পারে না।

তাই চৈতালী বুঝতে পারছে না কৌশিককে?

তার মুখের ওপর হেসে উঠছে?

নাকি আত্মহত্যার এই পদ্ধতিটাই বেছে নিয়েছে চৈতালী? গায়ে আগুন ধরিয়ে নয়, আগুন নিজের মধ্যে জ্বেলে!

চৈতালী এত নিষ্ঠুর হল কবে?

চৈতালীর কথাগুলো কৌশিককে কতটা আঘাত হানছে বুঝতে পারছে না বলেই কি? নাকি ইচ্ছে করেই নিষ্ঠুর হচ্ছে চৈতালী? তাই লহরে লহরে হেসে হেসে বলছে, থানায়? হাসপাতালে? বল কি? খোঁজবার আর জায়গা পাওনি? কিন্তু কেন বল তো এখনো এত খোঁজাখুঁজি? পুলিশে দেবে বলে? সোনা চুরির দায়ে ওয়ারেন্ট এনেছ?

কৌশিক সেই অস্বাভাবিক হাসির পর্দার নীচেকার অস্বাভাবিক পাণ্ডুর কৃশ মুখটার দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ ঠিক বলেছ চৈতালী, সোনা চোরকে কে ছেড়ে দেয়?

তাই নাকি? ও বরেন, ঘরের মধ্যে কি করছ? বেরিয়ে এসে দেখো। আমার সেই মনিব বাড়ির দাদাবাবু

ভয়ঙ্কর হাসির দাপটেই বুঝি চৈতালীর গলা বুজে আসে।

.

কিন্তু বরেন কেন?

বরেন কোথা থেকে এল এখানে?

চৈতালীর সঙ্গে বরেনের সম্পর্ক কী?

না, সত্যিকার সম্পর্ক তো কিছুই নেই। আর পূর্বজন্মে চৈতালীর সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল, সে তো শুধু বিরক্তির। শুধু তিক্ততার।

তবু এক ছাদের নীচে আছে দুজনে।

হয়তো এটা বিধাতার কৌতুকের একটা জোরালো নিদর্শন। মানুষ যাকে সংক্ষেপে বলে, অদৃষ্টের পরিহাস। সেই অদৃষ্টের পরিহাসেই চৈতালী সুলক্ষণার আশ্রয় ত্যাগ করে এসে জলে ডুবল না, আগুনে পুড়ল না, রেল লাইনে মাথা পাততে গেল না। বরেনের কাছে আশ্রয় চাইল!

.

শচীন মজুমদারের যখন শেষ হল, বরেন তখন নিতাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে একদিন এসে উঠেছিল দমদমের এই উদ্বাস্তু কলোনিতে। অনেক চেষ্টায় এ ঠিকানা সংগ্রহ করেছিল চৈতালী। গিয়ে পৌঁছতেও অনেক কষ্ট পেয়েছিল। তাই প্রথম দর্শনেই বলে উঠেছিল, সব আগে, কোন কথা বলার আগে এক গ্লাস জল দাও দিকি। খুব ঠাণ্ডা! নাকি জল-পাত্তরই নেই? রাস্তার কলে জল খাও?

বরেন তাড়াতাড়ি করে ঘরের ভেতর থেকে একটা পাটা মোটা কাঁচের গ্লাসে করে এক গ্লাস জল এনে নীরবে এগিয়ে দিয়েছিল। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি, কোন আকুলতা দেখায় নি, কৌতূহল ব্যক্ত করেনি।

চৈতালী গ্লাসটাকে একবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিয়ে ঠিক আছে বলে এক নিঃশ্বাসে জলটা নিঃশেষ করে গ্লাসটা বরেনের হাতে ফিরিয়ে দেয়, তারপর বলে ওঠে, কই বসতে বললে না?

বরেন অনেক আত্মস্থ হয়ে গেছে, অনেক স্থির ধীর। তাই শান্ত গলায় বলেছিল, বসবার যদি হয়, বসবেই জানি। আর যদি না বসবার হয়, বলে লাভ নেই তাও জানি।

হু, বুদ্ধিটা তো বেশ পরিষ্কার পরিষ্কার লাগছে, তাহলে দাও একটা কিছু, বসে পড়ি। কিন্তু অবহিত থেকো, বসতে পেলেই শুতে চাইব, খেতে চাইব।

বরেন ঘর থেকে একটা নীচু জলচৌকী এনে পেতে দিয়ে বলেছিল, সবই চাইতে পার।

হু! বলে চৌকীটায় বসে পড়ে চৈতালী এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, তারপর খাপছাড়া বলে ওঠে, বাবার খবর জানো?

বরেন মাথা কাৎ করে সম্মতি জানিয়ে বলে, হাসপাতালের বাইরে থেকে খবর নিয়ে এসেছিলাম।

এখানে চলে এলে কবে?

ওই একদিন!

চৈতালী কী আবার তার পুরনো জীবনে ফিরে যেতে চায়? তাই তার সেই পুরনো পরিবেশের সন্ধান করে?

নিতাইকাকা কোথায়?

জানি না।

তাই নাকি? তার মানে ঝগড়া? তা চেহারাটা তো দেখছি আরও লক্ষ্মীছাড়া লক্ষ্মীছাড়া হয়ে গেছে, বিয়ে করনি? ·

বরেন চৈতালীর এই অকারণ ব্যঙ্গে জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে বলে, না।

কেন?

হয়ে ওঠেনি।

হয়ে ওঠেনি? শুধু হয়ে ওঠেনি বলে? কেন, বাঙলা দেশে কি পাত্রীর এতই আকাল পড়েছে?

.

বরেন সহসা কোন উত্তর দেয় না। শুধু নীরবে তাকিয়ে থাকে এই নিষ্ঠুর কৌতুকময়ীর দিকে। অকারণ এই আঘাত কেন?

কোথায় ছিল এতদিন এই নিষ্ঠুরা রুদ্রাণী?

হঠাৎ এই মূর্তি নিয়ে আবির্ভাবের কারণ কি?

এতদিন পরে কি পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে এল ও?

হ্যাঁ হত্যাই সে বলেছিল।

বরেনের মনে আছে। নিতাই যখন বলেছিল, টাকার জোগাড় করতে পারিস তত তোর বাপের চিকিচ্ছে হবে। ডাক্তারে বলে দিয়েছে।

তখন ক্রুদ্ধ মেয়েটা দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, ঠিক আছে, এনে দেব ইনজেকশনের দাম। কিন্তু বাবা যদি না বাঁচে, তোমাদেরও আর এই ধরাধামে টিকে থাকতে হবে না।

নিতাই ক্যাবলা হাসি হেসেছিল, বাঃ, আমরা কী চোরদায়ে ধরা পড়লাম? আমাদের কী দোষ?

রুদ্রাণী গর্জে উঠেছিল, জান না তোমাদের কী দোষ? কে খুন করেছে আমার বাবাকে? দিনে দিনে তিলে তিলে তোমরাই করেছ খুন। সভ্য ভদ্র শান্ত ভাল একটা মানুষকে খুন করে ফেলে, তার জায়গায় একটা ভূতকে প্রতিষ্ঠা করেছ। তোমাদের কবলে না পড়লে, এমন করে খুন হতে হত নাকি বাবাকে?

ভরাসন্ধ্যাবেলা ঝটকা মেরে বেরিয়ে গিয়েছিল সেদিন চৈতালী, আর তার পাত্তা পাওয়া যায়নি। বরেন বলেছিল, ও সব ঝগড়া টগড়া ছল, বুঝল বাবার হয়ে গেছে, তাই মনের মানুষের সঙ্গে কেটে পড়েছে।

বিশ্বাসের সঙ্গে বলেনি বরেন, তর্কের মাথায় বলেছিল। কিন্তু মেয়েটা যে গেল কোথায়, তা ও ঠিক করতে পারেনি।

.

সেই তারপর এই আজ।

পরনে তার সেই সেদিনের সাজ, হা সেই চেহারাটা একেবারে মনে আঁকা আছে বরেনের। শুধু সেদিনের সেই রোগা পটকা মেয়েটা, আজ যেন স্বাস্থ্যের জোয়ারে ভরা গঙ্গা। মুখটা শুকনো, অথচ কেমন যেন অস্বাভাবিক প্রখর।

প্রতিশোধ নেবার উপযুক্ত হয়ে ওঠবার বাসনাতেই কী এতদিন কোনখানে বসে শক্তির সাধনা করছিল চৈতালী?

.

ঠিক এমন ভাবে ভাবতে না পারলেও এই রকমই একটা কিছু ভেবেছিল বরেন। আর নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে দেখছিল সেই মুখরার দিকে।

চৈতালী আবার বলেছিল, তা পাত্রীর যদি আকাল পড়ে থাকে তো বল আমিই একগাছা বরমাল্য গেঁথে ফেলি। কী বল! রাজী আছ? রাজী না থাকো তো তাও বলে ফেল!

বরেন রুষ্টকণ্ঠে বলেছিল, কোথায় তুমি ছিলে এতদিন তা জানি না, আবার এতদিন পরে এসে হঠাৎ এমন কাটার চাবুক মারছ কেন, তাও বুঝছি না। সবটাই তো গোলকধাঁধাঁ লাগছে।

চৈতালী হেসে উঠেছিল।

বাঃ, তুমি তো বেশ গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছ বরেন। ঠিক বলেছ, গোলকধাঁধাঁ! গোলক ধাঁধাঁ। ওর মধ্যে পড়েই ঘুরে মরছি আমরা। এই মনে হচ্ছে সশরীরে স্বর্গে গিয়ে উঠলাম বুঝি, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি–আরে দূর! যে নরক, সেই নরক। যাক, এত কথা তুমি বুঝবে না। মোট কথা, তোমার বাসায় একটু জায়গা চাইতে এসেছি, দাও তো থাকি।

.

বরেনও বুঝি তখন গোলকধাঁধাঁর ফেরে পড়ে ভেবেছিল, স্বৰ্গই বুঝি পেলাম! নাকি অতটা মুখ নয় সে?

তবু রুদ্ধকণ্ঠে বলেছিল সে, তোমার বাবা আমার হাতেই তোমাকে দেবে ভেবে রেখেছিল কিন্তু আমি পাগল নই চৈতালী! আমাকে তুমি যদি

এই দেখ! লোকটা কাঁদতে বসল। আরে বাবা, আমিও তো সেই পিতৃইচ্ছে পালন করতেই

চৈতালীও কথা শেষ করতে পারেনি সেদিন। তবু থেমে গিয়েছিল। শুধু কদিন পরে একদিন বলেছিল, বাপ-মা মারা গেলে এক বছর কাল-অশৌচ থাকে, তাই তো বরেন?

মেয়েদের বেলায় তা হয় না, সেকথা বলেনি বরেন, চুপ করে থেকেছিল।

.

তারপর চৈতালী এই কলোনির মধ্যে একটা বর্ণপরিচয়ের পাঠশালা খোলবার তোড়জোড় করেছিল। বলেছিল, এখন থেকেই তো আর তোমার অন্ন ধ্বংসাতে পারি না। যা হয় একটা কিছু করতেই হবে।

তাছাড়া বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেলাইয়ের অডার আনতে সুরু করে চৈতালী। কলোনির খদ্দেরদের যার যতটুকু প্রয়োজন। তবু তা থেকে একটা পেট নিশ্চয়ই চলে যাবে। রাজভোগে না হোক, শাকভাতে তো হবে।

.

কিন্তু কেন?

কেন চৈতালীর এই নির্বাচন?

মরতে ভয় পেল কেন চৈতালী? সেটাই তো সম্ভ্রমের ছিল। বরেনের কাছে এসে আশ্রয় নেওয়ার চেয়ে শ্রেয় ছিল না কি সেটা? বেঁচে থাকবার দরকার কী ছিল চৈতালীর?

হয়তো তাই ছিল।

কিন্তু মানুষের মন বড় জটিল বস্তু। হয়তো সেই মরা আর এই বাঁচার মধ্যে কোন প্রভেদ খুঁজে পায়নি চৈতালী। তাই তার চিরদুঃখী বাবার গোপন বাসনাটুকু নিজের মধ্যে সে পূর্ণ করতে চেয়েছিল।

.

অথবা তা নয়।

এ চৈতালীর নিজের ওপর প্রতিহিংসা গ্রহণ। যেন তীব্র ধিক্কারে বলে ওঠা, বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়েছিলি তুই! হয়েছে তো তার শাস্তি। বিধাতার লৌহদণ্ড এসে ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়েছে তো সেই হাত!

এখন মাটিতে মুখথুবড়ে ধুলো খা! সেটাই তোর উপযুক্ত!

বরেনকে ঘেন্না করতিস তুই?

কেন?

কিসের জন্যে?

বরেনই তোর যোগ্য বর। খুঁটেকুড়নীর আবার রাজরাণী হবার শখ!

আত্মহত্যার এই অভিনব পথটাই হয়তো গ্রহণ করেছিল চৈতালী, প্রতিহিংসা চরিতার্থের অমোঘ উপায়।

বিয়ে করে যুগলে একবার ও-বাড়ি বেড়িয়ে এলে কেমন হয়? কেমন হয় সুদক্ষিণাকে দিদিমণি আর তার সেই ভাইকে দাদাবাবু বলে সম্বোধন করে পেন্নাম করতে গেলে?

আর আর–সেই তাদের আদরের আদরিণী বৌয়ের কাছে?

বখশিশ চাইবে?

বলবে নাকি, বিয়ে-থা তো করলাম বৌদিদি, একটু বখশিশ মিলবে না?

.

ঈশ্বর জানেন, চৈতালীর ঈশ্বর জানেন, কোন চিন্তায় কী করেছিল চৈতালী। তবে তার ঈশ্বর একটা রক্ষা করেছেন, কাল অশৌচের কাল এখনো তার শেষ হয়নি।

বরেন এখন শুধু তার খিদমতগারি করে চলেছে।

.

সত্যিই বরেন বেরিয়ে আসে ভেতরকার একখানা কাঁচা বেড়ার ঘরের মধ্যে থেকে। কৌশিকের দিকে একটা নীচু জলচৌকী এগিয়ে দিয়ে বলে, বসুন। বুঝতে পেরেছি আপনি কে! ভেবেছিলাম লুকিয়ে আপনাদের কাছে খবর দেব, কিন্তু ওর মরা বাপের নামে ও দিব্যি দিয়ে রেখেছে।

কৌশিক নিতান্ত হতভাগা চেহারার এই লোকটার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে, আপনি?

আমি?

বরেন যেন বাইরের রোদে ভরা আকাশের কাছে নিজের পরিচয় খোঁজে। তারপর বলে, আমি–মানে, আমাকে ওর ভাই বলেই জানবেন। ওর বাবাকে আমি কাকা বলতাম।

চৈতালীকে কি ভূতে পেল?

তাই চৈতালী আবার হাসছে।

হিস্টিরিয়া রোগীর মত!

বল কি বরেন? কালাশৌচ পার হলে তোমাকে যে আমি বিয়ে করব বলেছিলাম! খামোকা তুমি আমার ভাই হয়ে বসলে? আমি কি করব গো।

চৈতালী, পাগলামী করো না!

হতভাগা বরেনও ধমক দিচ্ছে চৈতালীকে। তবে আর কি করে হাসি বজায় রাখবে চৈতালী? তবে কেন হঠাৎ পাথর হয়ে যাবে না সে?

কৌশিক আস্তে বলে, চৈতালী, অপরাধের শাস্তি থাকে জানি, কিন্তু তার মাত্রাও থাকে। মার অবস্থা যদি দেখো

চৈতালী নীরব।

চৈতালী, চল!

চৈতালী আবার কেমন একরকম বিচিত্র হাসি হেসে বলে ওঠে, তোমার তো সাহস কম নয়। কে বলতে পারে–চুড়ির পর এবার সাতনরী হার কিনা!

চৈতালী চুড়ির মালিক আর নেই!

কী-কী বললে? চৈতালী চমকে ওঠে, শিউরে ওঠে, চেঁচিয়ে ওঠে।

হ্যাঁ চৈতালী! তুমি যেদিন চলে এলে সেই রাত্রেই

কৌশিক, এ কী তুমি আমায় শাস্তি দেবার জন্যে বানিয়ে বলছ?

চৈতালী সত্যি!

আমায় মাপ কর কৌশিক। আমার নিষ্ঠুরতার জন্যে, নির্লজ্জতার জন্যে, বাঁচালতার জন্যে মাপ চাইছি আমি।

কে কার কাছে মাপ চাইবে, সে কথা থাক চৈতালী, চল, গাড়ি আছে সঙ্গে।

কৌশিক, তুমি বুঝতে পারছ না, তুমি ছেলেমানুষ, হয়তো এই ঠিক হয়েছে। বিধাতার নিয়ম উল্টে দিতে চাইলে এই রকমই হয় হয়তো। যাকে যেখানে মানায় না–

মানায় না!

কৌশিক বুঝি এবার তার স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকপ্রিয়তা ফিরে পাচ্ছে। তাই কৌশিক হেসে উঠে বলে, মানায় না মানে? চোরকে জেলখানাতেই মানায়! বারে বারে কি তুমি চুরি করে পার পাবে? সুলক্ষণা দেবীর লোহার সিন্ধুকের সবচেয়ে দামী মালটিই চুরি করে এনেছ, ভুলে যেও না সে কথা!

কৌশিক, বেচারা বরেনকে আমি আশা দিয়েছিলাম।

বরেন কি একটা অস্ফুট প্রতিবাদ করে ওঠে।

কৌশিক মৃদু হেসে বলে, তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ আমি ওঁকে শালা বলব?

শালা!

হ্যাঁ, তাই তো। নিয়মমত! তুমি তো নিয়মকানুনেরই ভক্ত।

কৌশিক তোমার এই স্বভাবই আমার কাল। এইতেই আমার মাথা খেয়েছ তুমি।

যাক বাঁচা গেল! মাথাটা খেতে পেরেছি, তার স্বীকৃতি পেলাম তাহলে! কিন্তু আর দেরী করা যাচ্ছে না চৈতালী!

কিন্তু কৌশিক বড় ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে সেখানে বৌদির সেই বড় বড় আর ভয়ঙ্কর দুটো চোখ

ভয় করলে চলবে না চৈতালী। জগতের সমস্ত চোখকে অস্বীকার করব, এই তো আমার পণ। যেখানে যত চোখ আছে, তাদের ভয় করতে করতে যে নিজেদের চোখের মাথা খেয়ে বসি আমরা। সত্যের চোখ, ন্যায়ের চোখ, বিচারের চোখ। যাক্ তর্ক রইল সারা জীবনের জন্যে, এখন বিনা তর্কে পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলে এস দিকি!

কৌশিক, তা হয় না, চৈতালী আস্তে বলে, আজ হয় না। আমাকে ভাবতে দাও, সময় দাও–

সময় তো অনেক নিলে চৈতালী।

না কৌশিক, সময় আমি নিইনি, শুধু নিজেকে নিয়ে সরে এসেছিলাম। আবার যদি যাই, নিজেই যাব।

এটা তো তাড়িয়ে দেওয়ার কথা, ফিরিয়ে দেওয়ার কথা।

না কৌশিক, ভুল বুঝো না, শুধু ভিক্ষে চাইছি, মনটাকে একটু প্রস্তুত হতে দাও।

যদি না দিই, যদি লুঠ করে নিয়ে যাই?

বরেন এদের কথার মধ্যে যেন খাপছাড়া ভাবে বলে ওঠে, তাই নিয়ে যান, নইলে ও যা মেয়ে, আবার পালাবে, আবার লুকিয়ে পড়বে।

চৈতালী মৃদু হেসে বলে, বেশ তো, তাহলে ও আবার খুঁজে বেড়াবে। বোঝা যাবে চাহিদাটা কত জোরালো।

ঠিক আছে। কৌশিক বলে, চাহিদার জোরটাই পরীক্ষা কোরো, তবু বিশ্বাস করব তুমি নিজে থেকে যাবে।

যদি যাই তাই যাব কৌশিক। তোমার সঙ্গে সমারোহ করে গাড়ি চড়ে গেলে মার কাছে মুখ দেখাব কি করে! ভিখিরির মেয়ে, ভিখিরির মতই গিয়ে দাঁড়াব মার কাছে।

ভিখিরির মেয়ে এইটাই শুধু তোমার পরিচয়?

চৈতালী মৃদু হেসে বলে, আর যা পরিচয় থাক না আড়ালে, সে তো রইলই, স্ট্যাম্প কাগজের পাকা দলিল।

সেদিন সে কথা মাননি চৈতালী!

ভুল করেছিলাম। আজ মানলাম।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *