আমাদের সময়ে
পাটাদার বড়ো ছেলে বিলুর বউভাতে বহু বহু বছর পরে দেখা হয়ে গেল ঝড়-এর, নিভাদির সঙ্গে।
বউ বসেছিল দোতলাতে।
বিয়ের জন্য ভাড়া নেওয়া বাড়িটির সিঁড়ি খুব সরু। আর গরমও ছিল সেদিন প্রচণ্ড। দোতলা থেকে বউ দেখে নামছে যখন ঝড়, তখনই সিঁড়িতে নিভাদির সঙ্গে দেখা।
কী রে! চিনতে পারছিস? ঝড়? ঝড় আর ঝঞ্চা কী আনকমন নাম ছিল রে তোদের ভাই-বোনের। তাই, তোদের ভোলা যে মুশকিল।
ঝড় প্রথমে চিনতেই পারেনি। প্রায় চল্লিশবছর পরে দেখা। কিন্তু একমুহূর্ত চেয়ে থাকার পরেই ওর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল।
ভেবেছিল, যাঁরা ভাবেন যে ঝড় শুধু উড়িয়েই নেয়, তাঁরা সবটুকু জানেন না। ঝড় থিতুও করে। অনেক সময়েই।
মাথার মধ্যে মুহূর্তের মধ্যে ফিরে চল্লিশ বছর আগেকার আসামের ধুবড়ি শহর, গৌরীপুর, কুমারগঞ্জ, ব্রহ্মপুত্র আর তার শাখানদীদের দু-ধার থেকে কুড়িয়ে আনা সাদাটে নুড়িটালা কাঁচাপথ। মনে ফিরে এসেছিল শিশিরের গন্ধ। শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবন। ক্লোরোফিল-উজ্জ্বল গাছগাছালি। মন-উদাস করা ডাক ডেকে যাওয়া পাখপাখালি। টি-এইট মডেল-এর কনভার্টিবল হুডখোলা ফোর্ড গাড়িটাড়ি সুদ্ধ ঝড়-এর জীবনে হারিয়ে-যাওয়া একটি পুরো অধ্যায়ই যেন নিটোল উঠে এসেছিল নিভাদির গলার স্বরের সঙ্গে। তাঁর হাসির সঙ্গে, অশেষ প্রসন্নতায়, নিভাদির হাতে বানানো আমপোড়া শরবত-এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে দূরের অনেক ভোর আর দুপুর, সন্ধ্যে আর রাত, চকিতে ফিরে এসেছিল।
আশ্চর্য! আপনি কিন্তু একটুও বদলাননি নিভাদি।
ঝড় বলল।
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন নিভাদি।
ঠিক যেমন করে গৌরীপুরে ওঁদের বাড়িতে বারান্দাতে বসে হাসতেন। হাসিটাও অবিকল একইরকম আছে।
ভাবল ঝড়।
সেই যুগে মেয়েদের অমন অট্টহাস্য করা বারণ ছিল। কিন্তু নিভাদি ছিলেন তৎকালীন মেয়েদের পক্ষে মান্য সমস্ত নিয়মের বিরুদ্ধে এক জাজ্বল্যমান বিদ্রোহ। লম্বা-চওড়া, হাসিখুশি, অবিবাহিতাঞ্জ, নিজের যৌবন ও হাসির তোড়ে পারিবারিক, আর্থিক, সামাজিক সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকেই বর্ষার ব্রহ্মপুত্রেরই মতো ভাসিয়ে নেওয়া একজন স্বরাট মহিলা। যাঁর সুন্দর, সপ্রতিভ, স্বাধীন জীবনের কথা জানলে উইমেনস-লিব-এর প্রবল প্রবক্তা আধুনিককালের যে কোনো মহিলাই আজ আশ্চর্য হয়ে যাবেন।
নিভাদি আজও অবিবাহিতা। ষাটোর্ধ্বা কিন্তু বার্ধক্য তো দূরস্থান, প্রৌঢ়ত্বও যেন স্পর্শ করতে পারেনি তাঁকে। এখনও যুবতীই।
হাসতে হাসতেই বললেন নিভাদি, বল রে ঝড়! ঝঞ্চা কেমন আছে রে?
নেই। চলে গেছে কবেই! পঁচিশ বছর বয়সেই।
ঝড় বলল।
কী হয়েছিল?
কিছুই হয়নি। কলকাতার পথে বাসে চাপা পড়ে গেছে।
বিয়ে হয়েছিল?
না।
বাঁচোয়া।
সত্যি! তোদের কলকাতার বাসগুলো প্রত্যেকটাই খুনি। আর পুলিশেরা …অথচ…খবর কাগজের ভাষায় যাকে বলে আত্মবিস্মৃত, তোরা হলি তাই।
সে কথা সত্যি! কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন কী করে নিভাদি? কত বছর, কী কত যুগ পরেতে দেখলেন। আমি তো বুড়োই হয়ে গেছি। খোলসটাতেই অবশ্য। গোরুর গাড়ির মধ্যে জেট-ইঞ্জিন বসালে যেমন অবস্থা হয়, আমার অবস্থা তেমনই। মনটা সেই পঁচিশ বছরেরই আছে। আর শরীরটা…।
ভারি কষ্ট হয় এই বৈপরীত্যে। জানেন!
মুখে একটু জর্দা ফেলে নিভাদি বললেন, আর বলিস না। আমারও তো সেই অবস্থাই। কী কষ্ট! কী কষ্ট! তুই-ই বুঝলি শুধু। অন্যে বোঝে না একেবারেই।
ঝড় হাসল। ভালো লাগল নিভাদি আজও তেমনই রসিক আছেন যে, তা লক্ষ করে!
তারপর জিজ্ঞেস করল, বিভাদি কোথায় আছে এখন?
বিভা?
হাসতে হাসতেই বললেন নিভাদি, পানের ঢোঁক গিলে মুখ দিয়ে ভুরভুর করে জর্দার গন্ধ বেরোচ্ছিল।
বললেন, সে তো পটল তুলেছে সেই কবেই।
কে যেন পাশ থেকে বলল, এত জর্দা খেও না নিভাদি। ক্যান্সার হবে। এনি ফর্ম অফ টোব্যাকো ইজ ব্যাড।
ছাড় তো।
নিভাদি বললেন, ঢোঁক গিলে।
তারপর বললেন, তোরাই বাঁচ অমন পুতুপুতু করে। আমরা এমনি করেই বেঁচেছি, এমনি করেই বাঁচব। এত খবরদারির মধ্যে বেঁচে থাকা মরারও অধম।
সে কী? নিভাদি। ঝড় বলল।
হ্যাঁ। তা তোর এত অবাক হওয়ারই বা কী আছে? পটলের খেতেই তো আমাদের বাস। কে কবে পটল তুলবে তার অপেক্ষাতেই তো দিন গোনা। অনুক্ষণ।
ইস।
তবুও বিভাদির শোকে বিহ্বল হয়ে ঝড় বলল।
তার সহোদরা ঝঞ্চারও মৃত্যু হয়েছে আরো অল্পবয়সে। কিন্তু বিভাদিও যে কোনোদিন চলে যেতে পারে, বিশ্বাসই হয় না। কালো, ছিপছিপে, চশমা-পরা, ফার্স্ট ইয়ারে পড়া, দুবিনুনি করা বিভাদির মিষ্টি বুদ্ধিমাখা মুখটা, চল্লিশ বছর আগে দেখা মুখটা, ঝড়ের মনের ফ্রেমে এমনইভাবে বাঁধানো রয়ে গেছে যে, সেই ছবিতে একটুও ধুলো-ময়লা, এমনকী চুল পরিমাণ আঁচড়ও পড়েনি। বড়ো উজ্জ্বল হয়ে আছে বিভাদির সেই ছবিটি। বরবাধা ফরেস্ট রেঞ্জ-এর বন-বাংলোর কাঠের বারান্দার কাঠের রেলিং ধরে শ্রাবণের এক মেঘলা দুপুরে আজও যেন দাঁড়িয়ে আছে বিভাদি। চিরটাকাল অমনি করেই থাকবে।
উদাস হয়ে গেল ঝড়।
নিভাদি বললেন, পান তো নিলি। জর্দা খাবি না?
নাঃ। জর্দা খাই না।
দাঁত সব ঠিক আছে তোর?
সব ঠিক নেই। একে একে নোটিস দিচ্ছে। তবে খাবি না কেন? জর্দা না খেলে পান খেয়ে কী লাভ? ঘাস খেলেই হয়।
নাঃ থাক। মাথা ঘুরবে।
আরে নে, নে একটু। তোদের কলকাতার এই আওয়াজে আর ধুলো-ধোঁয়াতেই যদি মাথা না ঘোরে তবে একটু জর্দা খেলেও ঘুরবে না। সত্যি! তোরা থাকিস কী করে রে এখানে? এই নরকে?
নিরুপায়েই। আর কী করে! অন্য উপায় থাকলে কী আর থাকতাম।
তোদের সেই কালীঘাটের বাড়িটা আছে তো, ঝড়?
বলেই বললেন, আয়, আয়। এখানে একটু বসি। সিঁড়ির নীচে। পাখার হাওয়াও খাব। আয় একটু সুখদুঃখের কথা বলি। পুরোনো দিনের কথা। আমাদের সময়ের কথা। কী যে ভালো লাগছে। তোর সঙ্গে দেখা হয়ে, কী বলব!
নিভাদির পাশে হলুদ-রঙা কাঠের চেয়ারে বসে ঝড় বলল, নাঃ, কালীঘাটের সেই বাড়িটা আর নেই, এজমালি সম্পত্তি ছিল তো! এক পয়সাওলা গুজরাটি কিনে নিয়েছে। কলকাতাতে বাঙালিদের বাড়ি এখন আর খুব বেশি নেই নিভাদি। ভবিষ্যতে আরও কমে যাবে।
তো এখন বাঙালিরা থাকেটা কোথায়?
সব দূরে দূরে। ডেইলি-পাষণ্ড হয়ে বেঁচে আছে তারা। সব বেচারামবাবু। মারোয়াড়ি-গুজরাটি পাঞ্জাবির চাকর।
সত্যি!
নিভাদি বললেন।
সত্যি।
এমন সময়ে লোডশেডিং হয়ে গেল হঠাৎ।
সামান্যক্ষণ অন্ধকার। সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎই নিস্তব্ধতাও নেমে এল। বরবাধার জঙ্গলের বর্ষা রাতের গন্ধ ও শব্দ যেন উড়ে এল বহু মাইল দূর থেকে।
তারপরেই জেনারেটর চালু হল। মাথার মধ্যের সব শান্তি ছিঁড়েছুঁড়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে।
আপনারা এখনও গৌরীপুরেই থাকেন? নিভাদি?
না। না। সেখানে কেউই নেই। আর সেই গৌরীপুর কী আর আছে?
মাটিয়াবাগ প্যালেস? আছে, কিন্তু সেই জৌলুস নেই। ঘিঞ্জি হয়ে গেছে শহরটা। মানুষ। মানুষ। বড়ো বেশি মানুষ। শুয়োরের মতো, হঁদুরের মতো। গাছ কমে গেছে, ছায়া কমে গেছে, শান্তি নেই কোথাও। মানুষই মানুষের সবচেয়ে বড়ো শত্রু। পুরো পৃথিবীটাই ছারখার করে দিল মানুষে। মানুষ থিকথিক করে চারদিকে কিন্তু মানুষের মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। সেই পৃথিবীটাই তো হারিয়ে গেছে। দুঃখ করে কী লাভ?
মনে মনে বলল, ঝড়।
তারপর বলল, আপনি গৌরীপুরেই থাকেন তো?
গৌরীপুরে নয় রে, এখন আমি কোচবিহারে থাকি। রিটায়ার করেছি তো বহুদিন। ওখানেই থাকি। পটার এক মেয়ে থাকে আমার সঙ্গে, কিন্তু ওদের পরিবারে থাকি না। মেয়েটাকে নিয়ে একাই থাকি। সারাজীবন ওই চ্যাঁ-ভ্যাঁ অ্যাভয়েড করার জন্য নিজে বিয়েই করলাম না, আর শেষ জীবনে অন্যের ঝামেলাতে জড়াব অমন বোকা আমি নই। পটার মেয়ে খুকুকেও সেই কথা বলে। দিয়েছি পরিষ্কার করে। যেদিন বিয়ে করবে, সেদিনই গেটআউট। তবে, মেয়েটা ভালো। পড়াশোনায়, গান-বাজনায়। সবচেয়ে বড়ো কথা, গভীরতা আছে, আমাদের যেমন ছিল। বই পড়ে। টিভি-র পোকা নয়ঞ্জ, আজকালকার অধিকাংশ ছেলে-মেয়েদের মতো অগভীর নয়, ছ্যাবলা নয়।
ননী এসে বলল, কী পিসি? তুমি যে এখানে মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসলে। বাড়ি যেতে হবে না?
আরে, ঝড়ের সঙ্গে দেখা হল কত যুগ পরে। একটু কথা বলি। কতই-না পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, কী বলব!
কিন্তু এখন না উঠলে হবে না। বিরাটি স্পেশ্যাল ছাড়বে এখুনি।
সেটা কী বস্তু?
ঝড় শুধোলো। ননীর দিকে চেয়ে।
রন্টু একটা ট্রাক্স গাড়ি কিনেছে। ডিজেল। গাড়িকে গাড়ি, বাস-কে বাস। মার্সিডিস-এর ইঞ্জিন। একেবারে স্মথ। মাখনের মতো। চমৎকার বডিও বানিয়ে নিয়েছে। বারো জন লোক আরামে বসা যায়। এখনই ছাড়বে সে গাড়ি। এই গাড়িতে না গেলে আমাদের দুর্ভোগ হবে।
রন্টু এখন বিরাটিতে থাকে নাকি? কী করে?
ঝড় শুধোলো?
বাঃ! ও তো বিরাট ব্যবসাদার। মস্ত কারখানা আছে।
তাই? ঝড় বলল।
তারপর বলল, বাঃ। বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। রন্টু বড়ো ভালো ছেলে চিরদিনই। হাসিখুশি। সরল কিন্তু বুদ্ধিমান।
নিভাদি উঠে পড়লেন। ঝড় মুগ্ধচোখে চেয়ে রইল। এখনও সোজা হয়ে দাঁড়ালে কচি শিমুলের মতো দেখায় নিভাদিকে। ঋজু, তরুণ, শ্যামলী। বয়সে দাগ পড়েনি একটুও।
তারপর ঝড়ের পিঠে একটা ছোট্ট আদরের চড় মেরে বললেন, চলি রে ঝড়। খুব ভালো লাগল তোর সঙ্গে এতদিন পরে দেখা হয়ে…আমাদের সময়ের…
ননী বলল, তুমি আবার দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? ও পিসি। ওরা সবাই যে বসে আছে গাড়িতে। গরমে ঘেমে নেয়ে গেল।
যাই রে, যাই। চলি রে ঝড়। ভালো থাকিস। তোর ছেলে-মেয়ে কী? বউ-এর নাম কী?
গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে জিজ্ঞেস করলেন নিভাদি।
নেই। একজনও না?
মানে একাধিক ছেলে-মেয়ের কথা বলছ? না বউ-এর?
কী ইয়ার্কি করছিস! সত্যি করে বল।
সত্যিই নেই।
সে কীরে!
আমি বিয়েই করিনি।
সত্যি?
বলেই, খুব লম্বা নিভাদি সামনে একটু ঝুঁকে হাতটা হাসিমুখে বাড়িয়ে দিলেন ঝড়ের দিকে।
বললেন, কনগ্রাচুলেশনস। পৃথিবীতে এখনও কিছু বুদ্ধিমান মানুষ আছে। অন্যরকম। ভেবেই, ভালো লাগে।
ঝড় বলল, অন্যরকম আর কী? মানুষ তো মাত্র দু-রকম। জীবিত আর বিবাহিত।
হাঃ হাঃ হাঃ করে হাসতে হাসতে জর্দার গন্ধ ছড়িয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন নিভাদি।
২.
খাওয়া-দাওয়ার পরে একা একা গাড়ি চালিয়ে ফিরে আসছিল ঝড়, ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস দিয়ে।
নিভাদির কথাটা কানে লেগেছিল ঝড়-এর। আমাদের সময়ে…
বাক্যটা আর শেষ করার সময় হল না ওঁর।
এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল একটু আগেই। ঠান্ডা হাওয়া বইছে এখন।
বিভাদির কথা মনে পড়ল ঝড়-এর। নামেই দিদি! ঝড়ের চেয়ে হয়তো বড়োজোর এক বছরের বড়ো ছিল। ঝড়, স্কুল-ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে গেছিল গৌরীপুরে। আর বিভাদি তখন ধুবড়ির কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। গরমের ছুটিতে সেও গৌরীপুরে এসেছিল। একদিন বরবাধার জঙ্গলে গেছিল ওরা সকলে মিলে, গৌরীপুর থেকে, পিকনিক করতে। মুনসের মিঞার বেডফোর্ড ট্রাকে চড়ে, ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে।
ওরা তখন সবে যৌবনে পা দিয়েছে। সেইসব দিনে, একটু ছোঁয়া, আচম্বিতে হাতের সঙ্গে হাত। লেগে যাওয়া, তাই ছিল আকাশকুসুম ভাবনার পক্ষে যথেষ্ট। তাই ছিল ভালোলাগার পরাকাষ্ঠা। শরীর, মনের কোনো কষ্টকেই কষ্ট বলে মনে হত না তখন। বন্যপ্রাণীর মতো শরীর এবং মনের সব ক্ষতেরই স্বাভাবিক নিরাময়ের এক অদৃশ্য ক্ষমতা ছিল। একটুতেই খুশি হবার ক্ষমতা ছিল। যে কোনো কথাতেই হাসির বান বয়ে যেত।
গুমা রেঞ্জ-এর বরবাধা বন-বাংলো৷ ব্লকের নাম মনে নেই এতদিন পরে আজ। সম্ভবত, বরবাধাই। কেয়াবন। কনকচাঁপার গাছ। আঃ। গন্ধটা যেন নাকে এখনও মাঝে মাঝেই পায় ঝড় কনকচাঁপা আর কেয়া-বনের গন্ধ, সদ্য বৃষ্টি-শেষের সেই বর্ষার দুপুরের, এবং বিভাদিরও।
একদিন আলোকঝারিতেও গেছিল। কুমারগঞ্জের কাছে। রাজমাটি আলোকঝারি, পর্বতজুয়ার, পাহাড়ে পাহাড়ে। গোরুর গাড়ি করে। চার-পাঁচটা গোরুর গাড়িতে। বোশেখ মাসে। সাতববাশেখির মেলা দেখতে। পাহাড়ের উপরে মেচ-সর্দারের বাড়িতে থেমেছিল। মেচরা, বোডো-রাভাদের মতোই এক উপজাতি। কাঁঠাল গাছের পাতা ঝরছিলঞ্জ, হলুদ, খয়েরি, লাল, পাটকিলে, কালো, খয়েরি। মেচ-সর্দারের যুবতী মেয়ে তাঁতে দোহর বুনছে বাড়িতে, রাঙানো। বহুবর্ণ সুতো জড়িয়ে, গোবর-লেপা ঝকঝকে উঠোনে বসে, কাঁঠাল গাছতলায় ঢল-নামা বাদামি চুল মেলে, চুলে কাঁঠাল কাঠের হলুদ কাঁকই খুঁজে। তার কালো কুকুরটি তার পাশে বসে আছে। ঘুঘু ডাকছে বাঁশবনে। প্রজাপতি আর কাঁচপোকা উড়ছে। রুখু পাহাড়তলির বুকে এঁকেবেঁকে। চলে-চাওয়া শুকনো বৈশাখী ঘুমন্ত নদীর বুকে একা জেগে-থাকা, শুকনো কালো গাছের ডালে, ঝুলের মতো লাল-হলুদ রঙা মোরগ-মুরগি ফুটে আছে।
সেই বৈশাখেই ঝর্নাতলির স্নিগ্ধ নির্জনে ল্যানটানার তিক্তকটু-গন্ধ-ভরা অসভ্য অবকাশে বিভা, বিভাদি ঝড়কে একটা চকিত কিন্তু কামগন্ধী চুমু খেয়েই অস্ফুটে বলেছিল, ঝড়! তুই আমার জীবনে আসবি? ঝড় হয়ে?
ঝড়ের মনে হয়েছিল, হঠাৎই খুব জ্বর এসেছে বিভাদির।
তখন বোঝেনি, আজ এতদিন পরে পিছনে ফিরে বোঝেঞ্জ, সে জ্বর, কামজ্বর।
বলেই, বিভা পরক্ষণে বলেছিল, ধৎ! তুই বড়োশান্তশিষ্ট, লেজবিশিষ্ট। আমি কোনো সত্যি ঝড়ের সঙ্গে ঘর করব। তার হাত ধরে এমনি কোনো বৈশাখী দিনে উড়ে যাব দু-ধারে শুকনো পাতার ঝর্না বইয়ে দিয়ে, এই লাল-হলুদ-পাটকিলে-খয়েরি-কালো বনে। তুই একটা
ক্যালকেশিয়ান। পুতুপুতু। ভিতুভিতু।
বিদ্যুৎ চমকাল একবার কালো চওড়া পিচ-ঢালা ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস-এর উপরে। আবারও হাওয়া উঠল। জোরে।
ঝড় আসছে আবারও। পথটা ভেজা। খুব জোরে গাড়ি চালাতে পারছে না ঝড়। কখনোই চালায় না। ঝড় নামটা ওকে একেবারেই মানায় না। বরং ঝঞ্চা নামটা মানাত ঝঞ্চাকে।
ঝড় এখনও পুতুপুতু-ভিতুভিতুই রয়ে গেছে। ক্যালকেশিয়ান।
কোথায় গেল বিভাদি কে জানে! ঝঞ্চারই মতো। মানুষ মরে কোথায় যায়? কোন ঝড়ের সঙ্গে মিতালি করল বিভা?
জীবনে সেই প্রথম চুমুঞ্জ, চকিত হলেও। তার আগে মায়ের চুমু অবশ্যই ঝড় অনেকই খেয়েছিল। মায়ের চুমু ছাড়া, ওর জীবনে সেই প্রথম অন্য কোনো মেয়ের চুমু।
রন্টুর গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে নিভাদি যেন কী বলতে গিয়ে বাধা পেয়েছিলেন…আরও বলতে যাচ্ছিলেন, আমাদের সময়ে…
ঝড় ভাবছিল, নিভাদির বাক্যটা শেষ না হলেও ঝড় জানে, বুঝেছে যেঞ্জ, তাদের সময়টা এতদিনের ব্যবধানেও, আশ্চর্য! একটুও ময়লা-কুচলা হয়নি। একেবারে হুবহু সেরকমই রয়ে গেছে। ফ্রেমে-বাঁধানো ল্যামিনেট-করা ছবিরই মতো। ক্লিষ্ট সময়ের কোনো কীট, অবিশ্বাস, অস্থিরতার, অকৃতজ্ঞতার কোনো ধুলোর আঁচড়ই সেই ছবিটিকে নষ্ট করতে পারবে না।
আসামের গোয়ালপাড়া জেলার সেইসব শান্ত, স্নিগ্ধ, অকলুষিত, সাদাসিধে, বক্রতাহীন, উজ্জ্বল গ্রীষ্ম-বর্ষার দিনগুলির ছবি–মধ্যবিত্ত মানুষের সুস্থ, সুন্দর, লোভহীন সাধারণ জীবনের উষ্ণতার ওম-এ এখনও বুক ভরে আছে ঝড়-এর। চোখ ভরে আছে সেই দিনের অকলুষিত নিসর্গে। ওদের সময়ের সেই সব শব্দ, গন্ধ, দৃশ্য ও উষ্ণতাতে।
চল্লিশটি বছর পরে, চমকে জেগে উঠে হঠাৎই আবিষ্কার করল ঝড়, সে রয়ে গেছে উষ্ণতাতে প্রাত্যহিকতার মালিন্য থেকে কী দারুণ এক দৈবীকৃপায় বেঁচে গিয়ে রয়ে গেছে, নিভাদির ভাষায় বলাঞ্জ, আজও রয়ে গেছেঞ্জ, আমাদের সময়।
ওদের সময়।
কী আশ্চর্য!