সাহেবি ধাঁচের গাড়িবারান্দাওয়ালা দোতলা ছড়ানো বাড়ি
সাহেবি ধাঁচের গাড়িবারান্দাওয়ালা দোতলা ছড়ানো বাড়ি, সামনে একটা ছোট বাগান, পিছনেও সবুজ দেখে মনে হল বোধহয় টেনিস কোর্ট জাতীয় কিছু আছে। গেটের গায়ে শ্বেতপাথরের ফলকে অম্বরবাবুর বাবার নাম, নামের পরে অনেকগুলো ইংরিজি অক্ষর, কমা, ফুলস্টপ। সব শেষে ব্র্যাকেটের মধ্যে এডিন কথাটা দেখে বুঝলাম ভদ্রলোককে স্কটল্যান্ড যেতে হয়েছিল ডাক্তারি পড়তে।
যিনি আমাদের ট্যাক্সির শব্দ পেয়ে বেরিয়ে এলেন তাঁর সঙ্গে আম্বরবাবুর আদল আছে ঠিকই, কিন্তু ইনি বেঁটে, মোটা আর কালো। অর্থাৎ মুখের মিল বাদ দিলে ইনি অম্বরবাবুর ঠিক উলটা।
আমাদের দেখে ভদ্রলোকের মুখে হাসি ফুটে উঠলেও, দুশ্চিন্তার ফলে সেটা সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেল।
আসুন ভিতরে।
শ্বেতপাথরের মেঝেওয়ালা ল্যান্ডিং পেরিয়ে বৈঠকখানায় গিয়ে ঢুকলাম। এখানেও মাৰ্বল, তার উপর কাৰ্পেট, আর তার উপর দামি দামি ফারনিচার। যে সোফায় বসলাম, সেটার গদি এত নরম যে, আমার ভারেই প্ৰায় ছ। ইঞ্চি বসে গেল!
রুনা, এসো।
একটি ফ্রক-পরা মেয়ে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক চোখে চেয়ে আছে ফেলুদার দিকে। অম্বুজবাবু ডাকতেই সে গুটি গুটি ঘরের ভিতরে এগিয়ে এল।
ইনি কে জান? জিজ্ঞেস করলেন অম্বুজবাবু!
ফেলুদা, চাপা গলায় উত্তর এল।
আর ইনি?
তোপ্সে।
বাঃ, তুমি তো আমাদের দুজনকেই চেনো দেখছি, বলল ফেলুদা।
জটায়ু কোথায়? জিজ্ঞেস করল মেয়েটি। বোঝা গেল সে এই তৃতীয় ব্যক্তিটিকে না দেখে কিছুটা হতাশ হয়েছে।
তিনি তো আসেননি, বলল ফেলুদা। তবে তাঁকে এক’দিন নিশ্চয়ই নিয়ে আসব।
তোপ্সে এত মিথ্যে কথা বলে কেন?
এই রে!—আমার সম্বন্ধে হঠাৎ এমন বদনাম কেন?
মিথ্যে মানে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
একটা বইয়ে লিখেছে ফেলুদা ওর মাসতুতো ভাই, আরেকটায় লিখেছে জ্যাঠতুতো ভাই। মিথ্যেই তো।
ফেলুদাই আমাকে বাঁচিয়ে দিল। বলল, ওহো–প্রথমে মাসতুতো ভাই লিখেছিল বটে, তখন ও গপপের মতো বানিয়ে লিখতে চেষ্টা করছিল। আমি ধমক দিতে তারপর সত্যি কথাটা লিখতে শুরু করল। আসলে জ্যাঠতুতো ভাইটাই ঠিক।
আপনার সব অ্যাডভেঞ্চার ওর পড়া, বললেন অম্বুজ সেন।
জেঠুকে খুঁজে বার করে দিতে পারবে তুমি? ফেলুদার দিকে সটান তাকিয়ে প্রশ্ন করল রুনা।
চেষ্টা করতে হবে। বলল ফেলুদা; তুমি যদি কোনও কু জোগাড় করে দিতে পারো তা হলে তো কথাই নেই!
ক্লু?
ক্লু জানি তো?
জানি।
আছে তোমার কাছে কোনও ক্লু, যাতে আমরা চট করে বের করে দিতে পারি তোমার জেঠুকে?
ক্লু তো তুমি বার করবে। তুমি তো ডিটেকটিভ।
ঠিক বলেছ। খুব চালাক মেয়ে তুমি। কী নাম তোমার? একটা নাম তো জানি, অন্যটা কী?
ভাল নাম ঝর্না।
ফেলুদা অম্বুজবাবুর দিকে ফিরল।
দেখুন, আপনাদের দিক থেকে কতকগুলো ব্যাপারে সাহায্য না পেলে কিন্তু আমার পক্ষে এগোনো মুশকিল হবে।
কী সাহায্য বলুন।
প্রথমত, আপনাদের সকলের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হবে। আপনার দাদার সঙ্গে আমার মাত্র কয়েক মিনিটের আলাপ। তাঁকে আমার আরেকটু ভাল করে চিনতে হবে। তাঁর কাজের ঘরটাও একবার দেখা দরকার। এমনকী, দরকার হলে তাঁর জিনিসপত্র একটু ঘেঁটে দেখতে হতে পারে। আশা করি আপত্তি হবে না।
মোটেই না, বললেন অম্বুজবাবু।
আর আপনার দাদা যেখানে মর্নিং ওয়াকে যেতেন, সেই জায়গাটাও একবার দেখে আসা দরকার।
কোনওই অসুবিধে নেই। আমাদের ড্রাইভার বিলাস আপনাদের গাড়ি করে নিয়ে গিয়ে সব দেখিয়ে আনবে।
ফেলুদা সোফা ছেড়ে উঠে পায়চারি আরম্ভ করেছে। তিনটে বড় বড় বুককেস বোঝাই বই, সেইদিকে তার দৃষ্টি।
এ সব বই কার?
সবই দাদার।
নানান বিষয়ে ইস্টারেস্ট আছে দেখছি।
অজ্ঞে হ্যাঁ।
এমনকী গোয়েন্দাগিরি সম্বন্ধেও তো বই আছে।
হ্যাঁ। এক সময় ওটা নিয়েও পড়াশুনা করেছেন।
বিজ্ঞান, ইতিহাস, রান্নার বই, মুদ্রা সংগ্ৰহ, থিয়েটার…
থিয়েটারটা দাদার নেশা বলতে পারেন। আমাদের মাঠে পুজোর সময় স্টেজ বেঁধে নাটক হয়। দাদাই নির্দেশক; ফ্যামিলির সকলেই রংটং মেখে নেমে পড়ে। এমনকী ইনিও। রুশনার দিকে দেখিয়ে দিলেন অম্বুজবাবু। রুনা এখনও সেইভাবেই হাঁ করে চেয়ে আছে ফেলুদার দিকে।
এবারে অম্বরবাবুর কাজের ঘরটা একটু দেখতে পারি?
আসুন আমার সঙ্গে।
অম্বুজবাবু উঠে পড়লেন সোফা থেকে।
বৈঠকখানার পাশে একটা প্যাসেজ, সেইটা পেরিয়ে পিছনের মাঠের দিকের একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলাম আমরা।
পুব দিকের জানালা দিয়ে রোদ এসে ঘরটাকে আলো করে দিয়েছে। একটা বড় ডেস্ক, তার সামনে একটা রিভলভিং চেয়ার, উলটা দিকে আরও দুটো চেয়ার। জানালার ধারে একটা আরাম-কেদারা। এ ছাড়া টেবিলের পিছন দিকে রয়েছে একটা শেলফ, একটা ক্যাবিনেট আর একটা গোদারেজের আলমারি। তার পাশের দেয়ালে একটা ফোলডিং ব্র্যাকেট থেকে হ্যাঁঙ্গারে ঝুলছে একটা ছাই রঙের কোট।
ডেসকের উপরটা দেখলে মনে হয় অম্বরবাবু বেশ গোছানো লোক ছিলেন। কাগজপত্ৰ টেলিফোন পেনহালডার পিনকুশন পেপার-ওয়েট চিঠির র্যাক, সব পরিপাটি করে সাজানো। একটা ডেট-ক্যালেন্ডার রয়েছে, তার তারিখটা তিনদিন আগের। ব্যাপারটা আমারও খটকা লেগেছিল, ফেলুদা সেটার দিকে অম্বুজবাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করায় ভদ্রলোক বললেন, দাদাকে কয়েক’দিন থেকেই অন্যমনস্ক দেখছিলাম। সচরাচর দাদার এরকম ভুল হয় না কিন্তু।
ফেলুদা খুঁতখুঁতে মানুষ, সে নিজেই শনিবার দোসরাটা বদলে মঙ্গলবার পাঁচই করে দিল।
দেরাজ খুলে দেখতে পারি কি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
দেখুন না।
তিনটে দেরাজই পরপর খুলে তার ভিতরের জিনিসপত্র হাতড়ে দেখল ফেলুদা। ওপরের দেরাজ থেকে পাওয়া এক টুকরো কাগজ সম্বন্ধে মনে হল তার একটু কৌতুহল হয়েছে, কারণ সেটা সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে।
হিমালয়ান অপটিক্যালস থেকে চশমা করাতেন বুঝি আপনার দাদা?
হ্যাঁ।
একটা ক্যাশমেমো দেখছি। তারিখটা সাতদিন আগের। নতুন চশমা করিয়েছিলেন বুঝি?
কই, না তো! বলে উঠল। রুনা। সে-ও আমাদের পিছন পিছন এসেছে।
তুমি কী করে জানলে, রুনা? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
আমাকে তো দেখায়নি জেঠু!
অম্বুজবাবু একটু হেসে বললেন, দাদা যে কখন কী করছেন তার খবর আমরা সব সময়ে পেতাম না।
আমরা অম্বরবাবুর স্টাডি থেকে বেরিয়ে এলাম।
আপনাদের এক আত্মীয় এখানে থাকেন বোধ হয়, প্যাসেজে বেরিয়ে এসে বলল ফেলুদা, আপনাদের এখানেই মানুষ হয়েছেন?
কে, সমরেশ? হাঁ, থাকে বইকী।
ফেলুদার অনুরোধে সমরেশকে ডেকে পাঠানো হল। বছর পয়ত্রিশ বয়স, মুখে বসন্তের দাগ, চোখে পুরু চশমা। একটু যেন আড়ষ্টভাব নিয়ে ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন আমাদের দিকে হাত দশেক দূরে।
বসুন, বলল ফেলুদা।
বেশ কিছুটা দূরে একটা চেয়ারে বসলেন সমরেশবাবু।
আপনার পদবিটা কী?
মল্লিক।
কদ্দিন আছেন। এ-বাড়িতে?
বছর পঁচিশ।
কী করেন?
একটা ফিল্ম ডিসট্রিবিউশন আপিসে কাজ করি।
কোথায়?
ধরমতলায়।
কী নাম কোম্পানির?
কোহিনুর পিকচার্স।
কদ্দিন আছেন। ওখানে?
সাত বাচ্ছর।
তার আগে কী করতে?
এই বাড়ির কাজকর্ম।
হাত দুটোকে ভাঁজ করে হাঁটুর মধ্যে চেপে রেখেছেন ভদ্রলোক-যাকে বলে জবুথবু ভাব।
আপনি অম্বরবাবুর অন্তর্ধনের ব্যাপারে কোনও আলোকপাত করতে পারেন?
সমরেশবাবু চুপ। ফেলুদা বলল, তিনি একটা হুমকি-চিঠি পেয়েছিলেন জানেন?
জানি।
আপনার ঘর কি এ-বাড়ির একতলাতে?
হ্যাঁ।
অম্বরবাবুর কাছে বাইরের লোকজন দেখা করতে আসত?
তা আসত, মাঝে-মাঝে।
সম্প্রতি এমন কোনও লোককে আসতে দেখেছেন, যাকে আগে দেখেননি?
সেটা লক্ষ করিনি। তবে,–
তবে কী?
এই পাড়ায় কিছু ছেলেকে দেখেছি, যাদের আগে দেখিনি।
কোথায়?
মোড়ের মাথায়।
কী করত তারা?
মনে হত এই বাড়ির দিকে চোখ রাখছে।
বয়স কীরকম তাদের?
বিশ থেকে পাঁচিশের মধ্যে বলে মনে হয়।
কজন ছেলে?
চারজন।
ফেলুদা একটুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ঠিক আছে। আপনি আসতে পারেন।
এইসব কথা থেকে ফেলুদা কোনও কু পেল। কিনা জানি না। যেটাতে মনে হয়। সত্যি করে কাজ হল, সেটা হল অম্বুজবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তায়।
রীতিমতো সুন্দরী মহিলা, তার উপর যাকে বলে ব্রাইট। বয়স চল্লিশের উপর হলেও দেখে বোঝার জো নেই। দোতলার একটা ছোট বৈঠকখানায় বসে কথা হল।
ফেলুদা প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিল ভদ্রমহিলাকে বিব্রত করার জন্য। তাতে কী হয়েছে, বললেন মিসেস অম্বুজ সেন, গোয়েন্দাকে যে এভাবে জেরা করতে হয় সে তো ফেলুদার গল্প পড়েই জেনেছি। খুব ভাল লাগে পড়তে গোয়েন্দার কাহিনী।
তা হলে তো ভালই হল, বলল ফেলুদা। আমার প্রধান মুশকিলটা কোথায় হচ্ছে বলি। অম্বরবাবু একটা হুমকি-চিঠি পেয়েছিলেন জানেন বোধহয়।
তা জানি বইকী।
দেখেছেন সে চিঠি?
তাও দেখেছি।
আমি অম্বরবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাঁর জীবনে এমন কোনও ঘটনা ঘটেছিল কি না যার ফলে অন্য কোনও মানুষের সর্বনাশ হতে পারে। উনি বলেছিলেন তেমন কোনও ঘটনা তাঁর জানা নেই। অবিশ্যি আমার বলা উচিত ছিল যে, রিসেন্ট ঘটনা হবার দরকার নেই, অতীতের ঘটনা হলেও চলবে, কেন না প্রতিহিংসার ভাবটা মানুষ অনেক সময়ে অনেক দিন পুষে রাখে। আমি এখন আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই, আপনি কি এমন কোনও ঘটনার কথা জানেন? দশ-বিশ বছর আগের হলেও চলবে।
ভদ্রমহিলা একটুক্ষণ চিন্তিতভাবে চুপ করে থেকে বললেন, তা হলে আপনাকে বলি। আপনি দেখুন। এমনি ঘটনার কথাই বলছেন কি না। এটা আমার কাল রাত্তিরে হঠাৎ মনে পড়ে। আমার স্বামীকেও এখনও বলিনি।
কী ঘটনা বলুন তো।
একটা অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপার।
অ্যাক্সিডেন্ট?
অনেক’দিন আগে। তখনও রুনা হয়নি; বোধহয় তার পরের বছরই হল। আমার ভাসুর তখন নিজেই গাড়ি চালাতেন। আমার শ্বশুরের গাড়ি। অস্টিন। উনি শ্যামবাজারের দিকে একজন লোককে চাপা দেন। সে-লোক মারা যায়।
আমরা দুজনেই চুপ। ঘরে থমথমে ভাব। অম্বুজবাবু পাশেই ছিলেন, চাপা গলায় বললেন, আশ্চর্য, এটা আমার মনেই ছিল না।
আর কী মনে পড়ছে? ফেলুদা দুজনকেই প্রশ্নটা করল।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি, বললেন অম্বুজবাবু, ক্লার্ক ছিলেন ভদ্রলোক।
নাম মনে পড়ছে?
উঁহু।
স্ত্রী ছিল, আর তিনটি ছেলেমেয়ে, বললেন মিসেস সেন। ছেলেটির বয়স তেরো-চোদ্দো। মেয়ে দুটি আরও ছোট। পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেন বিধবার হাতে।
কে, অম্বরবাবু?
হ্যাঁ।
সেই থেকেই দাদা ড্রাইভিং বন্ধ করে দেন, বললেন অম্বুজবাবু।এখন মনে পড়ছে।
হুঁ… ফেলুদা গম্ভীর। তার মানে এখন সে-ছেলের বয়স বছর পাঁচিশ। পরিবারটির যে সর্বনাশ হবে এই ঘটনার ফলে, এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। পাঁচ হাজার টাকা আর কদ্দিন চলে?
এর বেশি আর কিছু মনে পড়ছে না, জানেন, বললেন মিসেস সেন।
আমারও না, বললেন অম্বুজবাবু।
অম্বরবাবু কি ডায়রি রাখতেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
কই, সে রকম তো শুনিনি এখনও, বললেন অম্বুজবাবু।
ফেলুদা উঠে পড়ল।
অনেক ধন্যবাদ, মিসেস সেন। আপনি অন্ধকারে একটা আলো দেখিয়েছেন আমাদের, তার জন্য আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ।
আমরা কিন্তু মনেপ্ৰাণে চাইছি যে, আপনি ব্যাপারটার একটা সুরাহা করেন।
কথাটা যে ভদ্রমহিলা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।