Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অগ্নিরথ || Samaresh Majumdar » Page 5

অগ্নিরথ || Samaresh Majumdar

তখন বিকেল

তখন বিকেল। কিন্তু দুপুরের পর মেঘ জমতে শুরু হওয়ায় বিকেল এগিয়ে এসেছিল অনেক আগেই। সংসারের কাজ শেষ করে মিসেস অ্যান্টনি যখন বেরিয়েছিলেন তখন তাঁর ঘড়িতে বিকেল হলেও প্রকৃতি রাতের সাজ সাজতে চলেছে। যেদিন আকাশে মেঘ থাকে না সেদিন সন্ধে হবার আগে এই পাহাড়ে একটা জোরালো হাওয়া বয়ে যায়। গাছপালা কাঁপে, পাখিরা চেঁচায়। মেঘ জমলে সেই হাওয়ার পাত্তা পাওয়া যায় না।

মিসেস অ্যান্টনি যখনই বাইরে বের হন তখনই নিজের পোশাক সম্পর্কে সচেতন থাকেন। ধবধবে সাদা চওড়া পাড় শাড়ির ঘোমটা মাথায় ক্লিপ দিয়ে আঁটা থাকে তাঁর। চোখে চশমা। একটা বড় চামড়ার ব্যাগ বুকের কাছে চেপে ধরে মাথা ঝুঁকিয়ে হাঁটেন। স্বামীর মৃত্যুর পর এখন অর্থের অভাব জানান দিলেও তাঁর পোশাক এবং ভঙ্গির কোনও পরিবর্তন কেউ দেখেনি।

পিচের পথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি খাদের দিকে তাকালেন। বিশাল জায়গা জুড়ে কুয়াশা জমজমাট। চা বাগান, নদী, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ওখানে ঝাঁপ দিয়ে পড়লে পৃথিবীর কেউ কি খুঁজে পাবে? স্বামীর মুখ মনে পড়ল। মানুষটি ভাল ছিলেন। ওঁর নেপালি বন্ধুবান্ধবদের থেকে বেশ আলাদা। প্রায়ই বলতেন, আমি যদি ভানুভক্তের এক কণা ক্ষমতা পেতাম তা হলে কবিতা লিখতাম। মিসেস অ্যান্টনি উৎসাহ দিয়েও একটাও লাইন লেখাতে পারেননি। অথচ মুখে মুখে কবিতার লাইন বলতেন মানুষটা। সেই লাইনটা, যিশুর ছায়া এড়িয়ে চলেন ঈশ্বর কারণ নিজের জন্যে কিছুই রাখেননি তিনি, পৃথিবীকে ধনী করে নিঃস্বতা নিয়ে যিনি এসেছেন তাকে কতক্ষণ সহ্য করা যায়?

মিসেস অ্যান্টনি চমকে উঠেছিলেন, এ কী কবিতা? তুমি ঈশ্বরকে ছোট করছ?

মিস্টার অ্যান্টনি হাসলেন, সে কী? এই পৃথিবীটা তো ঈশ্বরের। পৃথিবীকে ধনী করলে ঈশ্বরের তো লাভ।

কীরকম উল্টোপাল্টা কথা। এই যে বিশাল জায়গা জুড়ে কুয়াশা চাপ চাপ বসে আছে, এইরকম এক বিকেলে তিনি বললেন, আমাদের হাড়ের কনকনানি নিয়ে তোরা বসে থাক পায়ের তলায়, এই শীতে নৃত্যনাট্য থেকে বাঁচা যায় তা হলে।

লোকটার সব ভাল ছিল শুধু একটাই গোলমাল। ছেলের জন্যে খুব ভাবত দিনরাত। বললেই বলত, আশ্চর্য! আমার পূর্বপুরুষের রক্ত যাতে ঠিকঠাক থাকে সেটা নিয়ে ভাবব না। ওঁদের প্রতি আমার কর্তব্য নেই?

সেই ছেলে যখন জোর করে আমেরিকায় গেল তখন বললেন, কী কাণ্ড! আমি ভেবেছিলাম ওরা ওকে ভিসা দেবে না। একে যুবক তার ওপর অবিবাহিত। আমেরিকানরা এইরকম লোককে অ্যাটম বোমর চেয়ে বেশি ভয় পায়। অথচ উনিই টাকা দিয়েছিলেন। দিয়ে ভেবেছিলেন ছেলে দিল্লি থেকে ফিরে আসবে। সেই ছেলে আর এল না। পৌঁছোনোর পর একটা দু লাইনের চিঠি এসেছিল। তার উত্তরে ষাট লাইনের চিঠি লিখেছিলেন মানুষটা। স্ত্রীকে দেখিয়েছিলেন। ছেলে কবে ফিরবে, কী কাজ করছে এ সব জানতে চাওয়ার পর লিখেছিলেন, তোমার পূর্বপুরুষের নাম জানা উচিত।

সাত জন পূর্বপুরুষের নাম উল্লেখ করে লিখেছিলেন, এদের রক্ত তোমার শরীরে আছে। এরা প্রত্যেকে বিয়ে করেছেন বংশের নিয়ম এবং নীতি অনুসরণ করে। তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। রিলে রেসে যেভাবে ব্যাটন নিয়ে যাওয়া হয় তোমার ওপর দায়িত্ব এই রক্তের পবিত্রতা রক্ষা করার। তুমি যে-দেশে গিয়েছ সে-দেশে এইডস-এর প্রকোপ খুব বেশি। তোমার রক্তে যেন ওই রোগের জীবাণু না প্রবেশ করে এ ব্যাপারে সচেতন থেকো। চিঠি পড়ে মিসেস অ্যান্টনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এ সব কথা তুমি লিখলে?

তিনি বলেছিলেন, হিন্দুদের পৃথিবীকে কোনও এক বিখ্যাত সাপ মাথায় নিয়ে রয়ে গেছে অনন্তকাল। কিন্তু মানুষের রক্তে অজস্র সাপ কিলবিল করে প্রতিক্ষণ। শৃঙ্খলা না থাকলেই তারা ছোবল মারবেই। ওকে সেটাই লিখলাম।

মানুষটা কি বোকা ছিলেন? আজ এতদিন পরে সেই পুরনো প্রশ্নটা মনে আসতেই মিসেস অ্যান্টনি মাথা নাড়লেন। না, মানুষটা ভাল ছিলেন, এইটুকুই যথেষ্ট।

মিসেস অ্যান্টনি সেইখানে পৌঁছলেন যেখান থেকে পিচের রাস্তা ছেড়ে আর একটা পথ খাড়াই ওপরে উঠে গিয়েছে। জায়গাটায় এত গাছগাছালি যে পিচের রাস্তার যাত্রীরা বুঝতেই পারে না ওপরে একটা সুন্দর পাহাড়ি গ্রাম রয়েছে।

লোকজন নামছে দেখে অবাক হলেন মিসেস অ্যান্টনি। এই পথে এত মানুষ একসঙ্গে কোনও অনুষ্ঠান না থাকলে চলাফেরা করে না। বয়স্কদের পোশাক দেখে বুঝতে পারলেন ওরা কোথায় গিয়েছিল। মনে পড়ল মিস্টার রায় নামের এক ভদ্রলোক মারা গিয়েছেন বলে গতকাল কেউ বলেছিল। মিস্টার রায়কে তিনি দেখেছেন, আলাপ ছিল না।

নিরাময়ের সামনে পৌঁছে একটু দাঁড়ালেন তিনি। কুয়াশা এ দিকের পাহাড়েও। তার কিছুটা রাস্তা দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি ঠিক কী কথা বলবেন ভেবে আসেননি। দুপুরে শহর থেকে ফেরার সময় মিস্টার ব্রাউনের মুখে শোনার পর থেকেই তাঁর মনে অস্বস্তি শুরু হয়ে গিয়েছিল। মিস্টার ব্রাউনকে সবাই শ্রদ্ধা করে। বাজে কথা বলার লোক তিনি নন। ছেলেটি সম্পর্কে এত বড় কথা যখন বলেছেন তখন তাকে একবার না-দেখে স্থির হতে পারছিলেন না তিনি। কিন্তু এখন সমস্যায় পড়েছেন। কী করে বলবেন ছেলেটিকে তিনি দেখতে চান।

জি!

মিসেস অ্যান্টনি দেখলেন একটি লোক নিরাময়ের গেটে এসে দাঁড়িয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এখানকার কর্মচারী। তিনি এগিয়ে গেলেন, আচ্ছা, ভেতরে যাওয়া যাবে?

ছোটবাহাদুর জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করবেন?

উত্তর খুঁজে না পেয়ে মিসেস অ্যান্টনি বললেন, হ্যাঁ।

আসুন।

ওকে অনুসরণ করে মিসেস অ্যান্টনি প্যাসেজের শেষে ভিজিটার্স রুমে গিয়ে পৌঁছোলেন। তাঁকে বসতে বলে ছোটবাহাদুর চলে গেল। ঘরটির দেওয়ালে বেশ কয়েকটা পোস্টার টাঙানো। রক্তদান করার জন্যে আবেদন। পৃথিবীর কত মানুষ রক্তহীনতায় মারা যাচ্ছে তার পরিসংখ্যান। সুস্থ মানুষের শরীরে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি রক্ত রয়েছে। তার কিছুটা যদি কারও জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে তা হলে দাতার কোনও ক্ষতি হয় না।

ঘরের ভেতর আলো জ্বলছিল। এই সময় ডাক্তারবাবু ঢুকলেন। নমস্কার করে জানতে চাইলেন তিনি কী প্রয়োজনে লাগতে পারেন।

মিসেস অ্যান্টনি নিজের পরিচয় দিলেন, আমি ঝোরার পাশে থাকি। আমার স্বামী মারা গিয়েছেন। মিস্টার অ্যান্টনি প্রতিবছর নিয়ম করে রক্তদান করতেন। অন্যকে উৎসাহিত করতেন। আপনার পেশেন্টদের জন্যে রক্তের প্রয়োজন নিশ্চয়ই হয়। আমার রক্ত কাজে লাগাতে পারলে খুশি হব।

ডাক্তারের মুখে হাসি ফুটল, খুব ভাল কথা। আপনি এইভাবে এগিয়ে এসেছেন বলে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করব না। কিন্তু নিরাময় আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। আপনি আমার অফিসঘরে আসুন। আপনার রক্ত পরীক্ষা করে কোন গ্রুপ তা জেনে নিয়ে নাম ঠিকানা লিখে রাখব।

মিসেস অ্যান্টনি ডাক্তারকে অনুসরণ করলেন। অফিসঘরে তাঁকে বসিয়ে ডাক্তার আঙুল থেকে দুফোঁটা রক্ত পরীক্ষার জন্যে তুলে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন। মিনিট কয়েক বাদে ফিরে এসে বললেন, আপনার রক্ত ও গ্রুপের। খুব ভাল হল। তারপর খাতা খুলে নাম ঠিকানা জেনে লিখে রাখলেন।

মানুষটিকে ভাল লাগল মিসেস অ্যান্টনির। যে উদ্দেশ্যে এসেছেন সেটা এখন মনে সক্রিয় ছিল না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এই সব কাজ আপনি একা করেন?

ডাক্তার বললেন, প্রথমে এক ভদ্রলোককে রেখেছিলাম। কিন্তু তিনি নিয়মমাফিক চাকরি করতে চেয়েছিলেন। তাঁর পোষাল না। তা ছাড়া আমার পক্ষে তাঁকে মাইনে দিতে অসুবিধে হচ্ছিল।

আপনার ওপর চাপ পড়ছে না?

অস্বীকার করব না। পড়ছে। কিন্তু একটা লোককে দুহাজার টাকা মাইনে না দিয়ে সেই টাকায় যদি আমার ছেলেদের ভাল খাবার দিতে পারি তাহলে এই চাপ মেনে নিতে আপত্তি নেই। ডাক্তার হাসলেন, চা খাবেন?

না। মাথা নাড়লেন মিসেস অ্যান্টনি। একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল তাঁকে।

ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু বলবেন?

আপনার পেশেন্টদের আমি একবার দেখতে পারি? মুখ তুললেন তিনি।

ডাক্তার ইতস্তত করলেন, সাধারণত আমি ওদের ওখানে ভিজিটার্সদের নিয়ে যেতে চাই না। ওরা তো দ্রষ্টব্য বস্তু বা প্রাণী নয়।

না, আমি সেইরকমভাবে দেখার কথা বলছি না। শুনেছি এদের বয়স খুব অল্প। আমিও একসময় সন্তানের মা ছিলাম–! থমকে গেলেন মিসেস অ্যান্টনি।

ছিলেন মানে? আপনার সন্তান জীবিত নেই?

আমার কাছে নেই। থাক, ওকথা। আচ্ছা, আমি চলি। উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলা। ডাক্তার একবার তাকালেন। তারপর বললেন, দাঁড়ান। ঠিক আছে, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। ডাক্তার চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে গেলেন।

যদি কোনও অসুবিধে থাকে, আমি নিশ্চয় ভাঙতে চাই না।

ডাক্তার হাসলেন। তারপর মাথা নেড়ে অনুসরণ করতে বললেন।

এক অদ্ভুত জগৎ। আট থেকে পনেরো বছরের বাচ্চাগুলো ক্যারাম খেলছে, বই পড়ছে, কেউ বা রেডিও শুনছে। আপাত চোখে কাউকেই অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু মিসেস অ্যান্টনি লক্ষ করলেন ওদের উচ্ছলতা যেন স্বাভাবিক নয়। মুখ চোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। ডাক্তার আলাপ করিয়ে দিচ্ছিলেন প্রতিটি ঘরে গিয়ে। এদের মধ্যে কেউ কি সায়ন? জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছেটাকে প্রবলভাবে দমিয়ে রাখছিলেন তিনি। মিস্টার ব্রাউন বলেছেন, ওর কাছাকাছি গেলে বোঝা যায় যিশুর আশীর্বাদ ও পেয়েছে। কথাটা যদি মিথ্যে না হয় তাহলে তো দেখামাত্রই তিনি অনুভব করবেন।

একটি বাচ্চা ছেলে এগিয়ে এল, তুমি কে?

আমি? আমি তোমার মাসি। ইচ্ছে করেই বাংলা শব্দটিকে ব্যবহার করলেন তিনি। ছেলেটি তার হাত ধরল, সত্যি? তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে?

ডাক্তার ছেলেটির চুলে আঙুল বোলালেন, বাবা, ওঁর তো অনেক কাজ আছে, নিজের বাড়ি আছে এখানে, সেসব ছেড়ে তোমাদের সঙ্গে থাকবেন কি করে? তবে হ্যাঁ, আমি ওকে বলব সময় পেলেই এসে তোমাদের সঙ্গে দেখা করে যেতে।

বারান্দায় বেরিয়ে এসে মিসেস অ্যান্টনি জিজ্ঞাসা করলেন, এই বাচ্চাটারও কি–?

হ্যাঁ। তবে ভগবানের অশেষ করুণা যে ওর শরীর রেসপন্স করছে। কিন্তু এই যে ছেলেটি একে নিয়ে আমি খুব চিন্তায় পড়েছি। ওর বাবা-মাকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে। একটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার বললেন।

ওর নাম কী? কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন মিসেস অ্যান্টনি।

অম্লান। দুদিন আগে ওর হেমারেজ হয়েছিল। সেই রক্ত বন্ধ হয়েছে। কিন্তু আমার আশংকা রক্ত ওর পেটেও পড়েছিল। খুব সামান্য, এইটেই রক্ষা। সেটা এখন দলা পাকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে। সেই দলাটা ওর পায়খানা পরিষ্কার হতে দিচ্ছে না। ইমিডিয়েটলি অপারেশন করে ওটাকে বের করা দরকার।

অপারেশন কোথায় হবে?

আমার এখানেই ব্যবস্থা আছে। তখন আমি লোক্যাল নার্স এবং অ্যানাসথেসিস্ট-এর সাহায্য নিই। মুশকিল হল ওর হেমোগ্লোবিন এত কম যে বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়া অপারেশন করতে আমি সাহস পাচ্ছি না। আসুন।

ডাক্তার ঘরে ঢুকলেন। সেখানে একটি ছেলে শুয়ে আছে। পাশের বিছানা খালি। ডাক্তার হেসে বললেন, কেমন আছ অম্লান?

পেটে ব্যথা।

ডাক্তার পেট দেখলেন। একটু ফুলেছে। তারপর বললেন, আজ তো তোমার পায়খানা হয়েছে। দুদিন রেস্ট নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে। এই মাসির সঙ্গে আলাপ করো।

মিসেস অ্যান্টনি বিছানার পাশে এগিয়ে গেলেন। প্রায় সাদা দেখাচ্ছে বাচ্চাটাকে। কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা?

ছেলেটি বলল, হুঁ। মা কবে আসবে?

মিসেস অ্যান্টনি বললেন, উনি নিশ্চয়ই রওনা হয়েছেন। তোমার পেটে কষ্ট হচ্ছে শুনে উনি কি না এসে পারেন? ডাক্তারবাবু বললেন সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি একটু সহ্য করো বাবা!

আমি আর পারছি না। কতদিন স্কুলে যাইনি। আমার বন্ধুরা আর চিঠি দেয় না।

যখন ভাল হয়ে যাবে তখন ওদের খুব বোকো।

ডাক্তার বললেন, আমি একটু পরে আবার আসছি অম্লান। আসুন মিসেস অ্যান্টনি। বাইরে বেরিয়ে এসে মিসেস অ্যান্টনি জিজ্ঞাসা করলেন, ও বাঁচবে তো?

ডাক্তার বললেন, চেষ্টা করতেই হবে। তবে সব কিছু ওর বিরুদ্ধে যাচ্ছে।

হঠাৎ শব্দ করে কেঁদে ফেললেন মিসেস অ্যান্টনি। তাঁর শরীর কাঁপছিল, চোখে আঁচল।

ডাক্তার কড়া গলায় বললেন, স্টপ ইট। আমি ওদের কান্নার শব্দ শোনাতে চাই না।

মুহূর্তে স্থির হয়ে গেলেন মিসেস অ্যান্টনি। একটু সময় নিয়ে চোখ মুছে বললেন, আমি দুঃখিত, আর এমন হবে না।

হাঁটতে শুরু করে ডাক্তার বললেন, আমরা যদি ভেঙে পড়ি তাহলে এরা কী করবে?

মিসেস অ্যান্টনি দেখলেন একটি তরুণ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল, ঠিক আছি। ডাক্তার বললেন, আমি বুঝতে পারছি বাইরে যাওয়ার জন্যে ছটফট করছ। কিন্তু আরও দুদিন যাক। ওহো, তোমার মা বাবার আসার কথা ছিল না?

হ্যাঁ। তাইতো জানতাম।

খুব ধমকে দিয়ে চিঠি লিখে ফ্যালো। আলাপ করিয়ে দিই, ইনি মিসেস অ্যান্টনি। শহরে যাওয়ার পথে একটা ঝোরা পড়ে, তার কাছে থাকেন। ইনি নিজে এসে বলেছেন ব্লাড ডোনেট করতে চান।

থ্যাঙ্ক ইউ মিসেস অ্যান্টনি। আপনি খুব ভাল মানুষ। সায়ন হাসল।

ডাক্তার বললেন, এর নাম সায়ন।

আপনি বলার আগে বুঝতে পেরেছি। মিসেস অ্যান্টনি একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন।

কী করে? আপনি কি আমাকে আগে দেখেছেন? সায়ন জিজ্ঞাসা করল।

না দেখিনি। তবে শুনেছি। মিস্টার ব্রাউন বলেছেন।

ও। উনি আমাকে খুব স্নেহ করেন।

ডাক্তারের মনে পড়ল, বলতে ভুলে গিয়েছি, তুমি যখন খুব অসুস্থ ছিলে তখন মিস্টার ব্রাউন এসে খোঁজখবর নিয়েছেন।

ডাক্তার বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, মিসেস অ্যান্টনি বললেন, আমি একটু ওর সঙ্গে কথা বলতে পারি?

ডাক্তার তাকালেন। তারপর বললেন, স্বচ্ছন্দে।

ডাক্তার বেরিয়ে গেলে মিসেস অ্যান্টনি ঘরে ঢুকতেই সায়ন চেয়ার এগিয়ে দিল। মিসেস অ্যান্টনি বললেন, আহা, তুমি কেন করছ। তুমি বোসো।

সায়ন বসলে মিসেস অ্যান্টনি চেয়ারে বসে তাকালেন, এই জায়গাটাকে কেমন লাগছে?

খুব ভাল। এখানকার মানুষরা খুব ভাল। আচ্ছা, আপনার বাড়ি কি অনেক দূরে?

না। তবে বেশ ওঠানামা করতে হয়।

এখানে আসার পর আমি ওই দিকে যাইনি।

ডাক্তারবাবু অনুমতি দিলে তোমাকে নিয়ে যাব। আমি তো একা থাকি।

আপনি একা থাকেন?

হ্যাঁ। আমার স্বামী মারা গিয়েছেন।

একা থাকতে নিশ্চয়ই ভাল লাগে না?

কার লাগে বলো?

লাগে। মিস্টার ব্রাউনকে আপনি চেনেন? ও। উনি কিন্তু একা ভালই আছেন। সবসময় যিশুর কথা ভাবেন বলে বোধহয় সঙ্গীর অভাব টের পান না।

তার মানে তুমি বলছ যিশুর কথা ভাবলে একাকিত্ব চলে যায়?

আপনি যাকে ভালবাসেন তার কথা ভাবলেই দেখবেন সময় কেটে যায়। এই যে আমি এখানে আছি, আমি সবসময় মায়ের কথা ভাবি।

কষ্ট হয় না?

হয়। তবে মনে হয় মা-ও তো আমার কথা ভাবছে।

যিশু যে আমার কথা ভাববেন তা বুঝব কী করে?

আমি ঠিক জানি না। তবে, ধরুন, খুব ভাল গান শুনলে মনে আনন্দ হয়। খুব সুন্দর সকাল এলে মন ভাল হয়ে যায়। তেমনি আপনি যদি কোনও মহামানুষের কথা ভাবেন, তাঁর বাণী পড়েন আর তা পড়ে যদি আনন্দ হয় তাহলে দেখবেন আর একা বলে মনে হচ্ছে না। সায়ন হাসল। এই প্রৌঢ়ার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছিল তার।

কিন্তু আমার যে উল্টোটা হয়।

কীরকম?

কোনও ভাল গান শুনলে বা সুন্দর দৃশ্য দেখলেই মনে হয় আর কাউকে ডেকে আনি। তারও আমার মতো ভাল লাগুক।

আপনার মন খুব ভাল তাই এরকম ভাবেন। বলতে বলতে সায়ন চোখ ছোট করল, কিছু মনে করবেন না, আপনার কনুই-এর কাছে কী হয়েছে?

ও কিছু নয়। মিসেস অ্যান্টনি আঁচলে হাত আড়াল করলেন।

কিন্তু–!

এটা এক ধরনের অ্যাল্যার্জি।

ডাক্তার দেখিয়েছেন?

না–, সেরে যাবে।

সায়ন উঠল। তার টেবিলের ওপর রাখা একটা বাক্স খুলে কিছু খুঁজল। তারপর বলল, এইটে আমি লাগিয়ে দিচ্ছি। আঁচলটা সরান।

কী আশ্চর্য। মিসেস অ্যান্টনি অস্বস্তিতে পড়লেন।

বাঃ। অসুখ হলে তার চিকিৎসা করানো উচিত। এই মলমটা কয়েকবার লাগালে ওটা মিলিয়ে যাবে। আঁচলটা সরান।

আপত্তি টিকল না। আঁচল সরাতে সায়ন টিউব থেকে সাদা মলম বের করে মিসেস অ্যান্টনির কনুই-এর পাশে লাগিয়ে দিল। আঙুলের স্পর্শ পেতেই ভদ্রমহিলা চোখ বন্ধ করলেন। তার মনে হচ্ছিল, মলম নয়, ওই আঙুলের স্পর্শ তার সমস্ত ক্ষত সারিয়ে দিচ্ছে।

এই মলমটা আপনি রেখে দিন।

কী আশ্চর্য! এটা তোমার জিনিস, আমি নেব কেন?

আমার তো কোনও কাজে লাগছে না। কলকাতা থেকে আসার সময় মা সবরকম ওষুধ ওই প্যাকেটে দিয়েছিল। আপনার অ্যালার্জি সেরে গেলে না হয় আমাকে দিয়ে যাবেন। সায়ন বলল।

তুমি হাতটা ধুয়ে নাও।

ঠিক বলেছেন। আমার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব কম। ঘরের মধ্যে রাখা একটা বালতি থেকে জল নিয়ে হাতে সাবান মেখে বেডপ্যানের মধ্যে হাতধোওয়া জল ফেলল সে।

এই সময় বড়বাহাদুর দরজায় এসে দাঁড়াল, ডাক্তারসাহেব ডাকছেন।

মিসেস অ্যান্টনি উঠে দাঁড়ালেন, আচ্ছা সায়ন, তুমি কি খ্রিস্টান?

না তো! আমি হিন্দু। কথাটা ঠিক বললাম না। আমার বাবা-মা হিন্দু তাই ওদের ধর্মই আমার ধর্ম। কেন বলুন তো?

তুমি তোমাদের যে ভগবান, দুর্গা কালী শিবকে পুজো কর?

সায়ন হাসল, আমার মা করেন। আমি তাঁর বিশ্বাসকে অমর্যাদা করি না। আমি বিবেকানন্দের ভক্ত। তাঁর কথাই আমার মন্ত্র।

বিবেকানন্দ? ও হ্যাঁ, কিন্তু তিনি তো ভগবান নন!

ভগবান মানে কী? সায়ন জিজ্ঞাসা করল।

বড়বাহাদুর বলল, আপনি আর কথা বলবেন না, ডাক্তারবাবু রাগ করবেন।

সায়ন হাসল, আপনার সঙ্গে পরে এ বিষয়ে কথা বলব। কেমন?

নিশ্চয়ই। মিসেস অ্যান্টনি সায়নের সামনে এগিয়ে গেলেন, তুমি আমার ছেলের থেকেও ছোট। তোমাকে একটু স্পর্শ করছি। তিনি তাঁর ডান হাত সায়নের বুকে রাখলেন। তারপর বড়বাহাদুরকে পেছনে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হনহন করে হেঁটে নীচে নেমে অফিসঘরে পৌঁছে দেখলেন ডাক্তার কিছু লিখছেন। পায়ের শব্দে মুখ তুলে ডাক্তার বললেন, আমি খুব দুঃখিত মিসেস অ্যান্টনি। আপনাকে বিরক্ত করতে বাধ্য হলাম কারণ এখন সায়নের এত বেশি কথা বলা উচিত নয়। কদিন আগে ওর ব্লিডিং হয়েছিল। তা ছাড়া সন্ধে হয়ে গিয়েছে। পাহাড়ি পথে আপনাকে যেতে হবে।

মিসেস অ্যান্টনি বললেন, আমি কি বসতে পারি?

ডাক্তার অবাক হলেন, অবশ্যই।

মিসেস অ্যান্টনি ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। আবার ব্যাগ বন্ধ করলেন। তারপর সরাসরি ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার কাছে আমার একটা আবেদন আছে।

বলুন।

আমি এই নিরাময়ের কর্মী হতে চাই।

ডাক্তারের কপালে ভাঁজ পড়ল। কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন তিনি, আপনি যদি একটু বিশদে বলেন তা হলে বুঝতে সুবিধে হবে।

আমার যেটুকু পড়াশুনা আছে তাতে আপনার অফিসের কাজ ঠিকঠাক চালিয়ে নিতে পারব বলে আশা করি। আপনি আমাকে সুযোগ দেবেন?

ডাক্তার হাসলেন, সরি, মিসেস অ্যান্টনি। নিরাময়ের পক্ষে এক হাজার টাকার বেশি এই কাজের জন্যে কাউকে মাইনে দেবার সঙ্গতি নেই। আর ওই টাকা কাউকে অফার করা সম্ভব নয় বলে–

মিসেস অ্যান্টনি হাত তুলতেই ডাক্তার থামলেন। মিসেস অ্যান্টনি বললেন, আমি হাজার টাকাতেই এই কাজ করতে রাজি।

আপনি কি ভেবে চিন্তে বলছেন? ডাক্তার বিস্মিত।

হ্যাঁ। আমি খুব একা। একমাত্র ছেলে বেঁচে থাকলেও আমার কাছে মৃত। আমার স্বামী যে টাকা রেখে গেছেন, তা খুবই সামান্য, তার সঙ্গে এই এক হাজার পেলে খাওয়া-পরার কোনও অসুবিধে হবে না। কিন্তু আপনার নিরাময়ের এই বাচ্চাদের একটুও উপকারে যদি আসি তা হলে বাকি জীবনটায় বেঁচে থাকতে আমার ভাল লাগবে। মিসেস অ্যান্টনি আন্তরিকভাবে কথাগুলো বললেন।

ডাক্তার এক মুহূর্ত ভাবলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কবে থেকে জয়েন করতে চান?

আগামীকাল থেকে।

বেশ। তাই হবে। আপনি আগামীকাল সকাল দশটায় আসবেন। আমি আপনাকে কী করতে হবে তা বুঝিয়ে দেব।

মিসেস অ্যান্টনি উঠে দাঁড়াতেই ছোটবাহাদুর দরজায় এসে দাঁড়াল, সাহেব, একটা গাড়ি এসেছে। ট্যাক্সি।

কে এসেছে?

বলল, ওদের ছেলে এখানে থাকে। কিন্তু আমি বললাম এখন দেখা করার নিয়ম নেই।

ছেলেটির নাম কী?

আমি জিজ্ঞাসা করিনি।

ওঁদের নিয়ে এসো।

ছোটবাহাদুর বেরিয়ে গেলে ডাক্তার বললেন, মিসেস অ্যান্টনি, আপনি, যদি সম্ভব হয়, আর একটু অপেক্ষা করে যান।

আমার কোনও তাড়া নেই ডাক্তার।

থ্যাঙ্ক ইউ। আপনার সঙ্গে আমি লোক দিয়ে দেব। এই অন্ধকারে আপনাকে একা যেতে হবে না।

ছোটবাহাদূরের সঙ্গে যে দুজন ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা অফিসঘরে এলেন তাঁদের দেখে অবাক হয়ে গেলেন ডাক্তার। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আরে আপনারা? এইসময় কীভাবে এলেন?

শিলিগুড়ি থেকে ট্যাক্সি নিয়ে এসেছি। ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, অম্লান কেমন আছে? ওর অবস্থা কী খুলে বলুন।

আপনারা আগে বসুন। ছোটবাহাদুরকে ডাক্তার বললেন চা আনার জন্যে।

ভদ্রলোক হাত তুলে বললেন, না। আমরা এখানে চা খেতে আসিনি। আপনার টেলিগ্রামে লিখেছেন কন্ডিশন ক্রিটিক্যাল, সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করার জন্যে আমাদের এখানে আসা দরকার। আগে ওর কথা শুনতে চাই।

এবার ভদ্রমহিলা বললেন, আগে আমি আমার ছেলেকে দেখতে চাই।

ডাক্তার বললেন, নিশ্চয়ই দেখবেন। যদিও এখন তার সময় নয় তবু স্পেশাল কেস হিসেবে আমি আপনাকে নিয়ে যাব। হ্যাঁ, আমি আপনাকে টেলিগ্রাম করেছিলাম কারণ ফোনে কলকাতার লাইন পাওয়া খুব মুশকিল ব্যাপার। অম্লান এখানে এসেছে ছয় মাস আগে। ধীরে ধীরে ও বেশ ইমপ্রুভ করছিল। এক্ষেত্রে নর্মাল আচরণকেই আমরা ইমপ্রুভমেন্ট বলে থাকি। হঠাৎ কয়েকদিন আগে ওর ব্লিডিং হয়। সঙ্গে সঙ্গে সমস্তরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়। রক্ত দেওয়ার পর ও কিছুটা সুস্থ হয়, কিন্তু কমপ্লেন করতে থাকে পেটে ব্যথা হচ্ছে। যে-পরিমাণ স্টুল হওয়া দরকার তার খুব অল্পই হচ্ছে এবং সেটা পারগেটিভ দিলে। ওর এক্সরে প্লেট বের করে আলো জ্বাললেন, দেখুন, একটা ডেলা মতন বস্তু ওর পেটে আটকে আছে। এইটেই ওর স্টুলকে স্বাভাবিকভাবে বের হতে দিচ্ছে না।

ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ওটা কী? টিউমার?

না। রাতারাতি এই সাইজের টিউমার হতে পারে না। ডাক্তার প্লেটটাকে বড় খামে ঢুকিয়ে রাখলেন, যখন হেমারেজ হয়েছিল তখন নাক এবং কান ছাড়া পেটেও তা পড়ে। এবং সেই রক্ত জমে গিয়ে ওই চেহারা নিয়েছে। যেহেতু ওর আকার বেশ বড় তাই স্টুলের সঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারছে না। যে-কোনও মুহূর্তে ওটা যদি বৃহদন্ত্রের মুখে চলে আসে তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ওর স্টুল একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে এবং পেট ফুলে উঠবে। সেই অবস্থা আমাদের কাম্য নয়।

সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলা চিৎকার করে উঠলেন, তার মানে ও বাঁচবে না?

ম্যাডাম, এই কথাটা একেবারেই মাথায় আনবেন না।

আপনি তো তাই বলছেন। ভদ্রমহিলা স্বামীর দিকে ফিরলেন, কী লাভ হল ওকে এখানে পাঠিয়ে? তোমাকে আমি পইপই করে বলেছিলাম ও আমার কাছ থাক, আমি ওর সেবা করব। তুমি শুনলে না। এত টাকা খরচ করছ ছেলে মেরে ফেলবে বলে? ও, ভগবান! ভদ্রমহিলা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন।

এবার ভদ্রলোক বললেন, ডক্টর, আমার ছেলের অসুখের ব্যাপারটা আমি জানি। ডক্টর দত্ত বলেছিলেন আপনার এখানে থাকলে ওর উপকার হবে। ওকে যখন নিয়ে এসেছিলাম তখন আপনি আমাকে ভরসা দিয়েছিলেন, ওর যা কন্ডিশন বেশ কয়েক বছরের মধ্যে ভয়ের কিছু হবে না। কিন্তু এ আপনি কী করলেন?

ডাক্তার বললেন, এটা নিছকই দুর্ঘটনা। আগে থেকে এর আন্দাজ পাওয়া কি যায়? তা ছাড়া আপনারা এত আপসেট হচ্ছেন কেন? ও তো ভাল হয়ে যাবে।

ভাল হয়ে যাবে? ভদ্রলোক সোজা হয়ে বসলেন।

নিশ্চয়ই। একটা ছোট অপারেশন করা দরকার। ওই বস্তুটিকে বের করে নিলে ওর কোনও সমস্যা থাকবে না। আমি সেই জন্যেই আপনাদের ডেকেছি। গোলমাল হল, আপনারা জানেন ওর রক্তে হিমোগ্লোবিন কম। আমি চেষ্টা করি যাতে মিনিমাম নর্মাল পয়েন্টে ওটাকে রাখা যায়। এ লড়াই-এ কখনও হারি, কখনও জিতি। এরকম অবস্থায় অপারেশন করা বেশ ঝুঁকির কাজ। প্রচুর রক্ত দরকার এবং পোস্ট-অপারেশন পিরিয়ডের অন্তত আটচল্লিশ ঘণ্টা টেনশনে থাকতে হবে। কিন্তু এখন ওই অপারেশন করা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা খোলা নেই।

আপনি বললেন ও বেঁচে যাবে!

হ্যাঁ। ওকে বাঁচাতে গেলে এই ঝুঁকিটা নিতে হবে। আমি অপারেশন করব আপনাদের লিখিত অনুমতি পেলেই। রক্তের জন্যে আপনাদের চিন্তা করতে হবে না।

ডাক্তার কথাগুলো বলামাত্র ভদ্রমহিলা প্রতিবাদ করে উঠলেন, না, কক্ষনও না। এইরকম গেঁয়ো পাহাড়ি জায়গায় আমার ছেলের অপারেশন আমি কিছুতেই করাব না। কোনও আধুনিক ব্যবস্থা আছে এখানে? আমরা ওকে এখনই কলকাতায় নিয়ে যাব।

এখনই কলকাতায় নিয়ে যাবেন? ডাক্তারের মুখে ছায়া ঘনাল।

হ্যাঁ। আমরা ওকে নিয়ে এখনই শিলিগুড়ি চলে যাব। কাল ওখান থেকে প্লেন ধরব।

আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না?

না। আর নয়। নিয়ে আসুন ওকে। ভদ্রমহিলা রীতিমতো উত্তেজিত।

এবার ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ওর শরীরের কন্ডিশন কীরকম? নিয়ে যাওয়া যাবে?

মনে হয় অসুবিধে হবে না।

তা হলে নিয়ে আসুন। বুঝতেই পারছেন, আমরা ভাল জায়গায় অপারেশন করাতে চাইব যাতে কোনও বিপদ না ঘটে। ভদ্রলোকের গলার স্বর একটু নরম।

এবার দ্বিতীয় ভদ্রলোক বললেন, আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না। আজকাল স্টোন রে দিয়ে গলিয়ে দেওয়া জলভাত হয়ে গেছে। পেট কেটে অপারেশন না করে ওই অবস্ট্যাকল গলিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এতে কোনও ঝুঁকি থাকবে না। আর সেই জন্য কলকাতায় যাওয়া ওর প্রয়োজন।

অম্লানের বাবা চমকে তাকালেন, এটা সম্ভব?

আমার তো তাই মনে হয়। কলকাতায় আমার পরিচিত ডাক্তার আছেন যিনি এ বিষয়ে অভিজ্ঞ। আপনি একদম চিন্তা করবেন না।

ডাক্তার বললেন, আপনারা নিয়ে যেতে চাইলে আমার কিছু বলার নেই। তবে এই রাত্রে, ওয়েদারও ভাল নয়, এখন না গিয়ে কাল সকালে গেলে স্বচ্ছন্দে প্লেন ধরতে পারবেন। আপনার আজ রাত্রে এখানে থাকুন না।

ভদ্রমহিলা বললেন, না। আমরা আজই যাব। শিলিগুড়ি বড় শহর। ওখানে আমার দিদি থাকেন। তেমন কিছু হলে তৎক্ষণাৎ সাহায্য পাওয়া যাবে।

মিসেস অ্যান্টনি চুপচাপ শুনছিলেন। তাঁর যদিও মনে হচ্ছিল উত্তেজিত হওয়া সত্ত্বেও এরা যা বলছেন তার মধ্যে যুক্তি আছে কিন্তু ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর খারাপ লাগছিল। ভদ্রলোককে যেন শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। এর মধ্যে কথা বলা তাঁর পক্ষে শোভন নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে উঠে বাড়ি ফিরে যেতেও তিনি পারছেন না। রাত নামলেও তিনি অপেক্ষা করবেন বলে ঠিক করলেন।

ডাক্তার বললেন, আপনারা এই ফর্মে সই করুন। কোনও পেশেন্টকে নিয়ে যেতে হলে গার্জেনকে সইটা করতে হয়।

ভদ্রলোক বিনা বাক্যব্যয়ে সই করে দিলে ডাক্তার উঠে পড়লেন। কোনও কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ওঁর যাওয়া দেখলেন সবাই, কেউ কথা বললেন না। শুধু ভদ্রমহিলা এমনভাবে আঁচল টানলেন যে মনে হল তিনি যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন। মিসেস অ্যান্টনি কিছুক্ষণ দেখলেন এদের। তারপর কথা না বলে পারলেন না, ভাই, আজ আমি আপনাদের ছেলের সঙ্গে কথা বলেছি। ও খুব ভাল ছেলে। আপনারা তো ওর বাবা-মা, সবচেয়ে বেশি আপনজন, ওকে একটু কষ্ট কম দিন না।

দ্বিতীয় ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি?

সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসলেন মিসেস অ্যান্টনি, আমি কেউ নই এখানকার। কাছেই থাকি। নিজের দরকারে এসেছিলাম। আপনার যা বলছেন তাতে যুক্তি আছে। কিন্তু অম্লানকে যদি কাল এখান থেকে নিয়ে যান তা হলে বিকেলের মধ্যে কলকাতার ডাক্তার ওকে দেখতে পারে। এ সময় ওকে নাড়াচাড়া যত কম করা যায় তত ভাল।

দ্বিতীয় ভদ্রলোক বললেন, ওঁর কথায় যুক্তি আছে।

ভদ্রমহিলা বললেন, আমি এই মৃত্যুকূপে ওকে আর এক মিনিটও রাখতে চাই না। অনেক শিক্ষা হয়ে গেছে, আর নয়।

মৃত্যুকূপ? মিসেস অ্যান্টনি শিউরে উঠলেন।

নয়তো কী?

আপনি খুব ভুল কথা বলছেন বোন। যাক গে, আপনাকে অনুরোধ ডাক্তারবাবুর সামনে ওই কথা উচ্চারণ করবেন না। ওঁকে আমরা খুব শ্রদ্ধা করি।

আমরা মানে?

এই পাহাড়ের মানুষরা।

ভদ্রমহিলা স্বামীর দিকে তাকিয়ে কাঁধ নাচালেন, দেখলে তো। উনি পাহাড়িদের হাত করে কেমন ব্যবসা করছেন!

দ্বিতীয় ভদ্রলোক বললেন, আহ, দিদি!

চুপ কর। এত জায়গা থাকতে এখানে স্যানেটারিয়াম করেছেন কেন? কারণ এখানকার লোকজন অশিক্ষিত, যা বোঝাবে তাই বুঝবে।

মিসেস অ্যান্টনি বললেন, এই অশিক্ষিত লোকরা কিন্তু একটা কাণ্ড করেছে। সংগ্রাম করে নিজেদের অধিকার অনেকটা আদায় করতে পেরেছে। পশ্চিমবঙ্গের কোন জেলার একজন মিউনিসিপ্যাল চেয়্যারম্যান মিস্টার ঘিসিং-এর মতো ক্ষমতা পেয়েছে বলুন? পশ্চিমবঙ্গের অনেক মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন না, কিন্তু উনি পারেন। আমরা কিন্তু এখনও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই রয়েছি। আপনাকে অনুরোধ এসব কথা উচ্চারণ করবেন না, সাধারণ মানুষ শুনতে পেলে পাহাড় ছেড়ে যাওয়া আপনাদের পক্ষে একটু অসুবিধে হবে।

ভদ্রমহিলার স্বামী বললেন, আপনি কিছু মনে করবেন না। ছেলের চিন্তায় ওর মাথার ঠিক নেই, কী বলতে কী বলে ফেলেছে!

আমি ঠিকই বলেছি। নেপালিরা ভাল যুদ্ধ করে, দারোয়ান হয় আর রাঁধে। এর বেশি আমি কোনওদিন শুনিনি।

মিসেস অ্যান্টনি বললেন, আপনি বাঙালি, তাই তো?

নিশ্চয়ই।

আজ থেকে আটশো বছর আগে বাঙালি বলে কোনও জাতি ছিল না। তিনশো বছর আগে আপনার বাংলায় কেউ লিখত না। আর পৃথিবীর চোখে এখন বাংলা বাংলাদেশিদের মাতৃভাষা, জাতীয়ভাষা, আপনাদের নয়। এ প্রসঙ্গ থাক, আপনারা যদি আজ এখানে থাকেন তা হলে ডাক্তারবাবুকে নিষেধ করতে হয়। নইলে উনি অন্নানকে নামিয়ে আনবেন। মিসেস অ্যান্টনি উঠে দাঁড়ালেন।

এবার ভদ্রমহিলার স্বামী বললেন, ঠিক আছে, আমরা কাল সকালেই ওকে নিয়ে যাব। ডাক্তারবাবুকে কি এটা বলা যেতে পারে?

মিসেস অ্যান্টনি বাইরে বেরিয়ে ছোটবাহাদুরকে দেখে খবরটা দিতে বললেন। ছোটবাহাদুর ছুটল। কয়েক মিনিট বাদে ডাক্তারবাবু নেমে এলেন। এসে বললেন, আপনারা সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করেছেন বলে খুব ভাল হল। আজ অম্লান এখান থেকে যেতে চাইছে না। আপনারা ইচ্ছে হলে দেখা করে আসতে পারেন।

ছোটবাহাদুর ওঁদের ওপরে নিয়ে গেল।

মিসেস অ্যান্টনি বললেন, আমি যাই।

ও হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আপনার অনেক দেরি হয়ে গেল। ডাক্তার গলা তুললেন, বড়বাহাদুর। এদিকে এসো।

ও থাক না।

না। ও আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

বড়বাহাদূরের আসার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে মিসেস অ্যান্টনি না বলে পারলেন না, ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেবেন না ডাক্তার।

কোন ব্যাপারটা?

অম্লানের–।

ও। দেখুন, ওঁদের ছেলে ওঁরা নিয়ে যাবেন এতে আমার আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু ওরা এইভাবে চলে গেলে আমি হেরে যাই। এতগুলো যুদ্ধ আমি একসঙ্গে লড়ছি। আমি তো চাইব প্রতিটি যুদ্ধে জিতব। ভগবান যদি আমাকে হারান তা হলে মন খারাপ হবে, কিন্তু গ্লানি আসবে না। কিন্তু এঁরা তো আমাকে লড়াই করার সুযোগ দিলেন না। ওই যে, ও এসে গিয়েছে। বড়বাহাদুর, তুমি এঁকে এঁর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসো। টর্চ নিয়ে যেয়ো। তা হলে ওই কথা রইল মিসেস অ্যান্টনি, কাল থেকে আপনার সাহায্য নিরাময় পাচ্ছে।

আমি সকালেই চলে আসব। মিসেস অ্যান্টনি বড়বাহাদূরের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন।

.

সন্ধেবেলা থেকে একটু বেশি পান করায় মিস্টার ব্রাউনের সামান্য নেশা হয়েছিল। সন্ধে থেকে ভেবেছেন নিজের জন্যে কিছু খাবার বানিয়ে নেবেন কিন্তু উঠব উঠব করেও টিভির সামনে থেকে উঠতে ইচ্ছে হয়নি। এখন ঠিক করলেন আর খাওয়ার ঝামেলা করবেন না, দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়বেন। বেচারা ভুটোর আজ রাত্রে খাওয়া জুটবে না। তখনই মনে পড়ল, ফ্রিজে সকালের মাংসটা পড়ে আছে। কিন্তু ওটা গরম করতে ইচ্ছে করছে না। ভুটো যদি ঠাণ্ডা মাংস খায়, তো খাক। এই সময় বাইরের লোহার গেট খোলার আওয়াজ হল। তারপর দরজাটা শব্দ করল। মিস্টার ব্রাউন তাকিয়ে দেখলেন সিমি ঢুকছে খাবার নিয়ে।

সিমি জিজ্ঞাসা করল, রান্না হয়নি তো?

ইচ্ছে করছে না।

সেটা জানতাম। এতটা মদ সাবাড় না করলে তো চলছিল না। কেন, নতুন মদের সঙ্গী আর একটু থাকল না? তা হলে তো এই রাত্রে নেশা হত না। মা দিয়েছে, দয়া করে খেয়ে নেওয়া হোক।

সিমিই ডাইনিং টেবিলে সব সাজিয়ে দিল। মিস্টার ব্রাউন বললেন, তুই খুব ভাল মেয়ে। আর জন্মে নিশ্চয়ই আমার কেউ ছিলি।

বাব্বা। হঠাৎ? একটা কাণ্ড হয়েছে।

কী কাণ্ড? খেতে শুরু করলেন মিস্টার ব্রাউন।

আজ সন্ধের পরে মিসেস অ্যান্টনি এসে বলে গেলেন চাকরিটা তিনি করতে পারছেন না। কাল থেকে নিরাময়ে যোগ দিচ্ছেন উনি।

তাই?

হ্যাঁ। সঙ্গে নিরাময়ের লোক ছিল। বলার সময় খুব খুশি দেখাচ্ছিল ওঁকে। এর মানে দাঁড়াল এই, কাজটা আমাকেই করতে হবে।

ভালই তো।

আমি একটু বেইজ্জত হলাম।

তা হোক।

কী কথা। নেশা হলে কথা ঠিক থাকে না। খাওয়া শেষ করলেন মিস্টার ব্রাউন। তারপর হাতমুখ ধুয়ে বললেন, এত রাত্রে একা যেতে পারবি?

এলাম না?

না আসাই ভাল। সিমি, তুই বিয়ে করবি?

না। মাথা নাড়ল সে।

তুই বিয়ে করলে আমি খুব খুশি হব।

না। মাথা নাড়ল সিমি, এবার আরও জোরে, আমি কাউকে ঠকাতে পারব না। বলে বাসন নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল।

.

১০.

গত কয়েকদিনে প্রচুর উপদেশ শুনেছে টুপুর। খানিকটা দূরত্বে বসে সৌদামিনী তাকে মেয়েমানুষ করার চেষ্টা করেছেন। প্রথম দিকে টুপুর প্রতিবাদ করত। তর্ক তুলত। কিন্তু শেষের দিকে আর কিছুই বলত না। ওই ছোট্ট ঘরে, যখন ঘুম আসত না, তখন গম্ভীর হয়ে বসে থাকত। তার বাইরের জগৎ দেখার একমাত্র উপায় হল জানলাটা। সেদিকে তাকালে শুধু এবাড়ি ওবাড়ির ছাদ বা দেওয়াল দেখা যায়। শব্দ অবশ্য অবিরত কানে আসে। যেমন আজ সকাল থেকেই সুমন চ্যাটার্জির গলা শুনতে পাচ্ছে। সৌদামিনী অবশ্য বলেছেন প্রথমবার বলেই তাকে এই কদিন বন্দী হয়ে থাকতে হবে। তারপর নিয়ম মেনে চললেই হবে। তাঁদের সময়ে প্রতি মাসে থাকতে হত। এই সময় টুপুরকে মাছ মাংস ডিম পেঁয়াজ রসুন খেতে দেওয়া হচ্ছে না। এগুলো ছাড়া তার খাওয়ার অভ্যেস এতকাল তৈরি হয়নি। প্রাথমিক প্রতিবাদ গ্রাহ্য না হওয়ায় সে এটাকেও মেনে নিয়েছে।

তাকে খাবার দিতেন কৃষ্ণা। মায়ের মুখের দিকে তাকালেই টুপুর বুঝতে পারে এই ব্যবস্থা উনি মেনে নিতে পারছেন না। সে সরাসরি মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তোমাকেও দিমা এইরকম বন্দী করে রেখেছিল?

কৃষ্ণা মাথা নেড়েছিলেন, না। আমাদের বাড়িতে এসব ব্যাপার কেউ ভাবতেও পারত না। কৃষ্ণা নিচু গলায় কথাগুলো বলেছিলেন।

তাহলে?

এ বাড়িতে যে নিয়ম রয়েছে তা না মেনে উপায় নেই।

তুমি প্রতিবাদ করছ না কেন?

মেয়ের মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে কৃষ্ণা উঠে গিয়েছিলেন। পরে সমরেন্দ্রনাথকে একা পেয়ে ভেঙে পড়লেন তিনি, আমি আর পারছি না।

সমরেন্দ্রনাথ অবাক হলেন, আবার কী হল?

কৃষ্ণা বললেন, তুমি কিছু বুঝতে পারছ না? তোমার একটুও খারাপ লাগছে না? ওইটুকুনি মেয়েকে তোমার মা জ্ঞান দিচ্ছেন, ওই বয়সে নাকি এককালে এ দেশের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত, স্বামীর ঘর করত তারা।

সমরেন্দ্রনাথ মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

কৃষ্ণা আরও উত্তপ্ত হলেন, ওকে ওইভাবে বন্দী করে রাখতে ভাল লাগছে?

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, বন্দী করে আমি রাখিনি, তোমরা রেখেছ।

আমরা? তার মানে তুমি বলছ আমিও রেখেছি। অবাক হয়ে গেলেন কৃষ্ণা। কথাগুলো বলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন স্বামীর দিকে।

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, হ্যাঁ। এই পুরো ব্যবস্থাটার তুমিও একটা অংশ। মা যা করছেন তা তাঁর অশিক্ষা অথবা এই বংশের পুরনো প্রথাকে অনুসরণ করার জন্যেই করে চলেছেন। মাথার ওপর ওই ওল্ড লেডি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন উনি অন্য কিছু ভাবতে পারবেন না। লোকে ব্যাপারটাকে যতই অবাস্তব বলুক কিছু করার নেই। ইংলন্ডের রাজপ্রাসাদে এখনও গত শতাব্দীর নিয়মকানুন চলে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের কোনও মিল নেই, কিন্তু ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে সবাই সেই নিয়মকানুন মেনে নিয়েছে। নেয়নি?

কৃষ্ণা কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে সমরেন্দ্রনাথ বললেন, তুমিও এই ব্যবস্থার সঙ্গী বলেছি কারণ তোমার মনেও পাপবোধ আছে।

আমার মনে?

হ্যাঁ। প্রাকৃতিক নিয়মে যখন তোমার শরীরে অস্বস্তি আসে তখন নিজেকে গুটিয়ে ফেল কেন? পৃথিবীর সব কাজ তখন করতে পারছ অথচ পুজোর কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নাও কেন? তুমি তখন নিজেকে অশুদ্ধ বলে মনে করো কেন?

কৃষ্ণা মুখ ফেরালেন, ওটা সংস্কার।

বাঃ, তা হলে মাকে সমালোচনা করা তোমাকে মানায় না। তোমার জ্বর সর্দি পেটে ব্যথা হলে স্বচ্ছন্দে বলতে পারো কিন্তু ওই ব্যাপার হলেই রাখঢাক শুরু হয়ে যায়। চোরের মতো লুকিয়ে রাখো। কেন? এতে লজ্জা অথবা অন্যায়বোধ কেন আসবে? কাগজে খবর পড়ো না? অলিম্পিকে মেয়েরা ওই অবস্থায় দৌড়ে পদক জিতছে! যে ব্যাপারটায় তোমাদের কোনও হাত নেই, যেটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সেটা নিয়ে কথা বলতে গেলে তোমাদের মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে যায়। যে কোনও শুভ কাজে হাত লাগাতে নিজেরাই পারো না। তাই তুমিও মায়ের ওই সংস্কারের একটা অংশ ছাড়া আর কিছু নয়। সমরেন্দ্রনাথ উত্তেজিত হয়ে বলছিলেন।

এই সময় দরজায় শব্দ হতে সৌদামিনীর গলা পাওয়া গেল, কে?

দরজা খোলার আওয়াজ হল। একটি বালক কণ্ঠ শোনা গেল, টুপুরের চিঠি। ও কোথায়?

কে দিয়েছে চিঠি? সৌদামিনীর গলা।

সানুদার মা দিতে বলল।

ঠিক আছে। আমাকে দে। দরজা বন্ধ করার পর সৌদামিনী ঘরের বাইরে থেকে ডাকলেন, বউমা!

চোখ মুছে কৃষ্ণা এগিয়ে গেলেন দরজায়।

সৌদামিনী বললেন, মেয়ে বড় হয়েছে। এইভাবে হুটহাট ওর কাছে চিঠি আসতে দিলে খাল কেটে কুমির ঢোকাবে।

কৃষ্ণা বললেন, মা, এটা তো সায়নের চিঠি।

তাতে সাতখুন মাপ হয়ে গেল? সে কি ওর নিজের মায়ের পেটের দাদা? কী লিখেছে পড়ে তবে ওকে দিও। সৌদামিনী চলে গেলেন।

কৃষ্ণা চিঠি নিয়ে কয়েক পা ফিরে এসে স্বামীর দিকে তাকালেন। সমরেন্দ্রনাথ বললেন, খোলা চিঠি না খামে করে পাঠিয়েছে?

খোলা।

ওকে দিয়ে দাও।

খামে করে এলে বুঝি মায়ের হুকুম পালন করতে?

না। চিঠিটা খামে করে পাঠালে আমাদের লেটার বক্সে থাকত, ওর মায়ের কাছে যেত না। সেইটে জানতে প্রশ্ন করেছিলাম। অন্যের চিঠি বাধ্য না হলে আমি পড়া পছন্দ করি না। আর যে লিখেছে তাকে তো আমরা সবাই জানি!

মৃদু হেসে কৃষ্ণা ততক্ষণে চিঠি পড়তে শুরু করে দিয়েছেন। হঠাৎ তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। তারপর মাথা নেড়ে জোরে জোরে পড়তে লাগলেন, রায়বাড়িতে যারা মেয়ে হয়ে জন্মায় তারা তো মেয়েমানুষ হয়ে মরে যায়। তোর উত্তর শুনে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। খোঁজ নিয়ে দ্যাখ, আমাদের বাড়ির অত জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে কোনও মেয়ে গ্র্যাজুয়েট নয়। যেসব বউ এসেছে অন্য বাড়ি থেকে তারাও কলেজে ঢোকেনি…! রায়বাড়ির প্রথম গ্র্যাজুয়েট মেয়ে শুধু নয়, প্রথম মেয়ে যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে এমন ভূমিকায় তোকে দেখতে চাই আমি।

কৃষ্ণা থামলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মা জানলে এই চিঠি কি ওকে দিতে বলবেন? আমি জানি উনি দিতে দেবেন না। কৃষ্ণা আর দাঁড়ালেন না। সোজা ছোটঘরের দরজা খুলে দেখলেন মেয়ে মেঝেয় পাতা বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। ঘুমোচ্ছে ভেবে চলে আসছিলেন এই সময় টুপুর ডাকল, মা!

কৃষ্ণা ফিরলেন, তারপর নিঃশব্দে চিঠি এগিয়ে দিলেন।

আমি ধরব?

কৃষ্ণা জবাব দিলেন না। টুপুর বলল, ওটা ছুঁলে তোমাকে স্নান করতে হবে?

না।

ঝট করে উঠে বসে কাগজটা নিয়ে টুপুর হাসল, আমি শুনতে পেয়েছি। এটা সানুদার চিঠি, না? প্রশ্ন করেই সে পড়তে লাগল। দরজায় দাঁড়িয়ে কৃষ্ণা মেয়ের মুখ দেখতে লাগলেন। ধীরে ধীরে অদ্ভুত একটা আলো ফুটে উঠল মেয়ের মুখে। নিজের মেয়ের এই রূপ কখনও দেখেননি কৃষ্ণা। পড়া শেষ করে টুপুর বলল, সানুদাদা খুব ভাল, তাই না মা?

কৃষ্ণা বললেন, হুঁ।

সানুদাদা ভাল হবে না মা?

ভগবান যা করেন তাই হবে।

ভগবান ছেলে না মেয়ে?

তার মানে?

তোমরা নীচে যে মা ভবানীর মূর্তি আছে তাকে ভগবান বল। মা ভবানী তো মেয়ে। আবার শিবঠাকুরও তো ভগবান। তিনি ছেলে।

এ সব ভগবানের নানান রূপ।

টুপুর হেসে ফেলল।

হাসছিস কেন?

আগের ক্লাসে একটা কবিতা পড়েছিলাম, বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ইশ্বর।

কৃষ্ণা জবাব দিলেন না। দরজা ভেজিয়ে চলে এলেন। আজ তাঁর কেবলই মনে হতে লাগল এই মেয়ে আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে না। তিনি মনে মনে বললেন, তাই হোক। তিনি যা পারেননি, তাঁর মতো মেয়েরা যা পারেননি, টুপুর যদি তা পারে–!

.

সকাল নটা। রোগা লম্বা বছর একুশের এক শ্যামলা যুবক হেলতে-দুলতে গেট পেরিয়ে রায়বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল। পাঁড়েজিকে দেখতে পেয়ে ছেলেটা দাঁড়াল, এই যে পাঁড়েজি, একটু খইনি ছাড়বে?

পাঁড়েজি মুখ ঘুরিয়ে নিল। ভঙ্গিটা দেখে ছেলেটা শব্দ করে হাসল, আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি মাদার তেরেসার নাম শুনেছ?

না।

ছেলেটা মাথা নেড়ে হাঁটতে লাগল। ওকে দেখেই বোঝা যায় রায়বাড়ির কেউ নয়। গায়ের রং বা মুখের গড়নে তফাতটা স্পষ্ট। সদরদরজা দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে জানলা খুলে দিল সে।

এ ঘরের আসবাব সেকেলে। ঘরের মাঝখানে দামি কাঠের গোলটেবিল এবং তার চারপাশে অনেকগুলো চেয়ার। ছেলেটির হাতে অনেকগুলো খবরের কাগজ ছিল। সেগুলো টেবিলে রেখে আরাম করে বসল চেয়ারে। প্রথম কাগজের হেডলাইন সে আগেই পড়েছিল। এবার খবরগুলো পড়তে লাগল।

এসে গিয়েছিস? সদানন্দ ঘরে ঢুকল।

ছেলেটা চোখ তুলল, কাল কটার সময় ঘুমিয়েছিস?

কেন? সদানন্দ চেয়ারে বসে একটা কাগজ টানল, নতুন খবর কিছু আছে?

আমি তোকে ফোন করেছিলাম। তোর বাড়ির কেউ বলল ঘুমিয়ে পড়েছিস। নটার সময় খবর পেলাম বিটি রোডে একটা হেভি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। কাল রাত্রেই গেলে কাজ হত। এতক্ষন কোনও না কোনও মাল ইন করে গেছে।

তোর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে বাদল। গিয়ে দেখবি উনিশশো ষাটের অ্যাম্বাসাডার। সারাতে পঁচিশ যাবে বিক্রি করলে পনেরোও পাবি না।

তাই? ধর, গাড়িটা টাটা সুমো। মালিক অ্যাকসিডেন্টে মরে গেছে। একটু ড্যামেজও হয়েছে গাড়ি। তা হলে? বাদল চোখ বন্ধ করল।

তুই স্বপ্ন দেখ। তোর উচিত ছিল ডায়নার অ্যাকসিডেন্টের খবর পাওয়া মাত্র প্যারিসে চলে যাওয়া। মার্সিডিজটাকে কবজা করতে পারতিস তা হলে। সদানন্দ হাসল।

বিশ্বাস কর, ভেবেছিলাম। কিন্তু তারপরে বিবিসিতে গাড়িটার যা চেহারা দেখলাম তাতে– আর ওখান থেকে এ দেশে আনা যেত না। ইম্পোর্টেড গাড়ির হেভি ট্যাক্স। আর ফরাসি জানি না বলে ওদেশে পার্টি পাকড়াতে পারব না। নে সার্চ কর।

দুজনে খবরের কাগজ নিয়ে বসে গেল। মিনিট কুড়ি বাদে বাদল চেঁচিয়ে উঠল, আই বাস। গুরু মিল গয়া, এস্টিম।

এস্টিম? সদানন্দ বলে উঠল।

হ্যাঁ। নামখানার রাস্তায় অ্যাকসিডেন্ট। চল পানসি বেলঘরিয়া।

সদানন্দ উঠে দাঁড়াল। মিনিটখানেকের মধ্যেই তার মোটরবাইক রায়বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। পেছনে বাদল। মোটরবাইকের আওয়াজে সায়নের বাবা জানালায় এসে ওদের আড়ালে চলে যেতে দেখলেন। নিজের মনে বললেন, এই যন্ত্রটাকে আমি একদম সহ্য করতে পারি না। যে কোনও সময় অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে।

নন্দিনী খামের মুখে আঠা বোলাচ্ছিলেন, বললেন, ওরকম করে বোলো না। এ বাড়ির ছেলে হয়ে খেটেখুটে নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে তো।

কেন? আমি কি অন্যের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি?

আঃ, তোমার কথা কে বলছে! তোমাদের সময় অন্যরকম ছিল।

এমনভাবে কথা বলছ যেন অনেক বয়স হয়ে গেছে আমার। আই অ্যাম জাস্ট ফর্টি ফাইভ। আমার চেয়ে রেখা বয়সে বড়।

ঠিক আছে বাবা, মানলাম তুমি এখনও যুবক। কাল সদানন্দ এসেছিল। ও দার্জিলিং-এ যাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করছিল সানুকে কিছু পৌঁছে দিতে হবে কি না।

দার্জিলিং যাচ্ছে কেন?

তা আমি কী করে জানব? আমরা খোকাকে লিখেছিলাম সামনের মাসে যাব। তুমি তো আজ পর্যন্ত টিকিট কাটলে না। ভাবছি নতুন বোনা সোয়েটার সদানন্দর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেব। নন্দিনী চলে যাচ্ছিলেন।

সায়নের বাবা একটু অন্যমনস্ক হলেন, স্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসার কথা বলা পুরুষমানুষের শোভা পা। না হলে তিনি বলতেন অনেক টাকার বিল আটকে আছে।

.

কলকাতার যানবাহনকে পাশ কাটিয়ে সদানন্দের মোটরবাইক বেহালা ছড়িয়ে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে ছুটে যাচ্ছিল। তার পেছনে বসে বাদল একটার পর একটা দেশাত্মবোধক গান গেয়ে যাচ্ছিল। সদানন্দ মুখ না ফিরিয়ে গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, কেসটা কী গুরু? হঠাৎ এসব গান?

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর চলে গেল, তাই সেলিব্রেট করছি।

চলে যাওয়ার পর?

তাই তো করে।

দাঁত পড়ে যাওয়ার পর লোকে দাঁত নিয়ে আফসোস করে। মাদার তেরেসা বেঁচেছিলেন যখন তখন কটা বাঙালি তাঁকে দেখতে যেত, সাহায্য করত? মরে যাওয়ার পর বলতে লাগল, যাঃ, কলকাতার শেষ গর্ব চলে গেল।

কিন্তু সমাধির দিন হেভি গ্যাঞ্জাম হয়েছিল।

গুড বাই ক্যালকাটা। আমরা কলকাতা ছেড়ে যাচ্ছি। বাদল বলল।

দুর। কলকাতা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। কয়েক বছর বাদে ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপও কলকাতা হয়ে যাবে। এস্টিমটা পাব? সদানন্দ জিজ্ঞাসা করল।

আলবত। আমার ডান পা নাচছে।

সত্যি? খুশি হল সদানন্দ। বাদলের ডান পা নাচা একটা শুভচিহ্ন। এর আগের কেসেও ওর ডান পা নেচেছিল, কাজটাও হয়েছিল।

বাদলের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব সেই ক্লাস থ্রি থেকে। মেট্রোপলিটনে পড়ত ওরা। বাদলের বাবার রোজগার বেশি ছিল না। পাস করে দুজনেই সিটিতে ভর্তি হয়েছিল। এই সময় একদিন বাদল বলল, আচ্ছা, আমরা পড়াশুনার চেষ্টা করছি কেন?

সদানন্দ অবাক হয়েছিল, চেষ্টা করছি মানে?

তা নয় তো কী? আমার তো পড়তে একটুও ইচ্ছে হয় না। কারণ খুব সিরিয়াসলি পড়লেও আমি দারুণ রেজাল্ট করতে পারব না। সেই এলেম আমার নেই। কোনওমতে পাস করে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে হবে, কেউ চাকরি দেবে না।

বাদল হাসল, এখন প্রায় তিন লক্ষ ছেলেমেয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেয়। তার মধ্যে ধরে নে সাড়ে সাত হাজার ছেলেমেয়ে দারুণ রেজাল্ট করল। এই সাড়ে সাত হাজার চাকরি পাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। তা হলে সাধারণ ছাত্রের কপালে যা লেখা আছে সেটা পড়ে নেওয়াই ভাল। তাই না? বি.এ- এম.এ পড়ে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।

তা হলে আমরা কী করব? সদানন্দ ধন্দে পড়েছিল।

ব্যবসা করব।

ব্যবসা?

ইয়েস গুরু। মাল্লু কামানোই যখন আসল ব্যাপার তখন এখন থেকে সেই ধান্দায় নেমে পড়া যাক।

কিন্তু মা চাইছে আমি যেন অন্তত গ্র্যাজুয়েট হই। আমাদের বংশে কোনও গ্র্যাজুয়েট নেই।

যাচ্চলে! মাকে গিয়ে বল, আগেকার দিনে গ্র্যাজুয়েট হলে লোকে গর্ব করে বলত, এখন বললে পাবলিক হাসবে।

কিন্তু কীসের ব্যবসা করবি?

গাড়ির চাকার।

সেকী রে?

যাদের গাড়ি আছে তাদের জিজ্ঞাসা করব চাকা রিসোলিং করাতে চান কি না। নতুন চাকা কিনতে যা লাগবে তার ওয়ান থার্ডে যদি পুরনো চাকা নতুনের মতো করে দেওয়া যায় তা হলে প্রচুর পার্টি রাজি হবে। আমার জানা একটা কারখানায় ওটা করিয়ে আনব। মিনিমাম পঞ্চাশ টাকা পার চাকা লাভ থাকবে।

কিন্তু লোকে আমাদের চাকা দেবে কেন?

বাঃ, এমনি দোকানে যা নেয় তার থেকে কমে কাজটা করে দেব।

কিন্তু আমাদের তো দোকান নেই। যদি ভাবে চাকা নিয়ে আর ফেরত না দিই।

সেটা একটা পয়েন্ট। তার জন্যে কার্ড ছাপাতে হবে।

কার্ড?

হ্যাঁ। তোর আর আমার নামে। তোর বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দেব। যদি কেউ সন্দেহ করে তাহলে বলব ফোন করে খবর নিতে। আমাদের যা-কিছু ইনভেস্টমেন্ট তা শুধু কার্ড ছাপার জন্যেই লাগবে। নাম দিবি এস বি এন্টারপ্রাইজ। সদানন্দ বাদল। শুধু তোর মাকে বলৰি ওই নামে ফোন এলে যেন স্বীকার করে।

কার্ড ছাপা হল! ছাপার খরচ সদানন্দই দিল। তারপর বাদলের অভিযান শুরু হল। প্রথম প্রথম সদানন্দ ওর সঙ্গে যেত। সকালবেলায় বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করানো দেখলেই সে আগে চাকা পরীক্ষা করত। চাকা প্লেইন হয়ে এসেছে দেখলেই সোজা মালিককে প্রস্তাব দিত রিসোলিং-এর। বেশির ভাগই বলত তাদের জানা জায়গা আছে, সেখান থেকে করাবে। কেউ কেউ বলতে লাগল, যদ্দিন না চাকা ফেরত দিচ্ছেন তদ্দিন একটা চাকা দিয়ে যান। স্টেপনি হিসেবে রাখব। কিন্তু কেউ কার্ড নিয়ে মাথা ঘামাল না।

বাদল হাল ছাড়ল না। সদানন্দ তার সঙ্গে দরজায় দরজায় ঘোর বন্ধ করলেও সে সেই কারখানা থেকে দুটো চাকা ভাড়া নিয়ে অর্ডার সংগ্রহ করতে লাগল। এর ফলে সপ্তাহে সে চারটে রিসোলিং-এর কাজ পেতে লাগল। ভাড়ার টাকা বাদ দিয়ে মাসে ছয়শো টাকা এল। তিনশো করে দুজন। এতে বাদল এত খুশি হল যে ওরা দুপুরে আমেনিয়ায় গেল লাঞ্চ করতে। চিকেন চাপ আর তন্দুরি রুটির অর্ডার দিয়ে বাদল বলল, এই ছয়শো টাকা হল শুরু। এটা হয় হাজার হবে, ছয় লক্ষ হয়ে যাবে একদিন। শুধু খেটে যেতে হবে বন্ধু।

সদানন্দ বলেছিল, কিন্তু এভাবে দরজায় দরজায় ঘুরতে ভাল লাগে?

সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ, মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভদের দেখিস না? ওরাও তো একই কাজ করে। কিন্তু ওরা মাইনে পায়, মালিক নয়। আমরা আমাদের মালিক। এই যে গতকাল যে গাড়িটাকে দেখে ঢুকলাম তার মালিক মরে গিয়েছে। ডাক্তার ছিল। ডাক্তারের স্ত্রী বললেন, আমার আর গাড়ির দরকার নেই, বিক্রি করে দিতে চাই। কম্পুটার নাম্বার মারুতি ভ্যান। ডাক্তারের গাড়ি বলে কম চলেছে কিন্তু একটা চাকা রিসোলিং করালে ভাল হয়।

করাল কেন?

বললাম, ওটা করালে বেশি দাম পাবেন বিক্রি করার সময়। হাসল বাদল। সে বুঝতে পারছিল সদানন্দ এত কথার পরেও ঠিক উৎসাহিত হচ্ছে না।

ভ্যানটার দাম কত? পাশের টেবিলে খেতে খেতে এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন।

অ্যাঁ? বাদল চমকে গেল।

আমি একটা মারুতি ভ্যান খুঁজছি। আপনি বলছিলেন বিক্রি আছে।

আছে। একদম টিপটপ কন্ডিশন। ডাক্তারের গাড়ি।

সেটা শুনেই ইন্টারেস্টেড হয়েছি। কোন সালের?

নাইনটিন নাইনটি। ডব্লু বি জিরো টু।

কত দাম?

এক লাখ চাইছে।

আট বছরের পুরনো গাড়ি এক লাখ? কী বলছেন?

দেখলেই বুঝবেন। নতুন গাড়ির চেয়ে বেটার। আর এখন নতুন গাড়ির দাম কত জানেন? অর্ধেক লাগছে না।

ভদ্রলোক হাসলেন, আপনারা এই লাইনের লোক নন দেখছি। এখন মারুতির দাম পড়ে গেছে।

সেই গাড়ি সেদিনই বিক্রি হয়ে গেল পঁচাশি হাজার টাকায়। ভদ্রলোক গাড়ির মালিককে আশি হাজার দিলেন এবং বের হবার সময় বাদলের হাতে পঞ্চাশটা একশো টাকার নোট দিয়ে বললেন, যে ব্যবসাই করুন সেটা ভালভাবে জেনে করবেন। আপনারা নতুন বলে এটা আপনাদের দিলাম। গাড়িটা আমি নিজের জন্যে নিচ্ছি না। এক লাখ দেবে এমন খদ্দের আমার রেডি আছে।

পাঁচ হাজার পেয়েও বাদলের মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। গাড়ি বিক্রির ব্যবসাটা জানে না বলেই মন খারাপ। সে সদানন্দকে বলেছিল, টাকাটা তুই রেখে দে যত্ন করে। এখন থেকে আর রিসোলিং-এর ব্যবসা করব না। এক মাস ধরে গ্যারেজে গ্যারেজে ঘুরব আমরা। এ ব্যবসার নাড়িনক্ষত্র আগে জেনে নিতে হবে।

পাঁচ হাজার টাকা ওদের তীব্রভাবে উৎসাহিত করেছিল। পার্ক সার্কাসের গ্যারাজ, মল্লিকবাজার এবং খালধারের গ্যারাজগুলোতে বিভিন্ন মিস্ত্রির সঙ্গে কথা বলে ওদের ধারণা হল এই ব্যবসা বিনা মূলধনে করলে লাভ থাকবে না। শুধু দালালি করলে লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়ে নেবে। অর্থাৎ মওকা বুঝে গাড়ি কিনতে এবং দাম পেলে বিক্রি করতে হবে। অন্তত এক লক্ষ টাকা চাই। বাদলের পক্ষে এই টাকা স্বপ্নেও পাওয়া সম্ভব নয়। সদানন্দ মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে সুদে টাকাটা জোগাড় করতেই ওদের অফিসঘর রোজ সকালে দালালে ভরে গেল। গাড়ি বিক্রির দালাল। এরা খোঁজ নিয়ে আসত অমুক জায়গায় অমুক গাড়ি বিক্রি আছে। পছন্দ হলে বাদল সদানন্দ ছুটে যেত দেখতে। তেমন বুঝলে মিস্ত্রি দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে দরাদরি করত। পুরনো অ্যাম্বাসাডার পঁচিশে কিনে তিরিশে বিক্রি করতে লাগল ওরা। ইংরেজি কাগজে গাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখে খোঁজ নিতে যেত। শেষ পর্যন্ত নিজেরাই বিজ্ঞাপন দিতে আরম্ভ করল। এস বি এন্টারপ্রাইজ এই করে করে দাঁড়িয়ে গেল শেষ পর্যন্ত। এখনই ওদের বছর গেলে লাখ আড়াই টাকা আসছে। সুদ সমেত মায়ের টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছে সদানন্দ। পুরনো গাড়ির চেয়ে অ্যাকসিডেন্ট হওয়া গাড়ি কেনা অনেক বেশি লাভজনক। এরকম একটা কারবার করে বাইক কিনে ফেলতে পেরেছে ওরা।

ডায়মন্ড হারবার ছাড়িয়ে নামখানার রাস্তায় পড়ে সদানন্দ বলল, ঠিক কোথায় অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল তা বের করতে কালঘাম ছুটে যাবে।

যেখানেই দেখবি পাবলিক জাবর কাটছে সেখানেই দাঁড়িয়ে যাবি।

কাল অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে আর আজ পাবলিক জাবর কাটবে?

পাবলিকের আর কোনও কাজ নেই।

দূর থেকেই দেখতে পেল ওরা। রাস্তার একপাশে গাছের গায়ে যে গাড়িটা আটকে আছে তাকে কেন্দ্র করে তখনও ভিড়। সদানন্দ বাইক থামাতে ভিড়টা তাদের দিকে তাকাল। দু-তিনজন এগিয়ে এল, মেয়েটা মরে গেছে?

কোন মেয়ে? সদানন্দ অবাক।

ও। আপনারা এদের কেউ নন?

বাদল ঝটপট উত্তর দিল, হ্যাঁ। কিন্তু গাড়িতে মেয়ে ছিল নাকি?

সঙ্গে সঙ্গে লোকটা বেশ গর্বের সঙ্গে জনতাকে শোনাল : কী? আমি ঠিক বলেছিলাম কি না। লোকটা মেয়েটাকে নিয়ে ফুর্তি করতে বকখালি যাচ্ছিল। তিরিশ বছরের আইবুড়ো মেয়ে, সিঁদুর-শাঁখা নেই, বউ হতেই পারে না।

দ্বিতীয় লোকটি বলল, আপনাদের কেউ হয় না?

বাদল ততক্ষণে বাইক থেকে নেমে গাড়ির কাছে চলে গিয়েছে। একদম নতুন এস্টিম গাড়ি। ড্রাইভারের দিকের দরজা গাছের ধাক্কায় ভেতরে ঢুকে গেছে। আর তার ফলে স্টিয়ারিং বসে গেছে সিটে। এরকম দুর্ঘটনা ঘটলে চালকের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম। কিন্তু বাদল সেটা নিয়ে ভাবছিল না। ইঞ্জিন যদি তেমন ক্ষতিগ্রস্ত না-ও হয় তবু হাজার চল্লিশেক চলে যাবে গাড়িটাকে নতুন চেহারায় ফিরিয়ে আনতে।

বাদল জিজ্ঞাসা করল, থানা কোনদিকে?

লোকজন উৎসাহিত হয়ে রাস্তা বলে দিল। এরই মধ্যে ওরা জেনে গেল ড্রাইভার মরে গেলেও তার সঙ্গিনীকে আহত অবস্থায় ডায়মন্ড হারবারের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

বাইক চালু হলে সদানন্দ জিজ্ঞাসা করল, কী বুঝলি?

নতুন এস্টিমের এই মডেলটার দাম পাঁচ লাখ টাকার একটু বেশি। কিন্তু সেকেন্ড হ্যান্ড হলে তিনের বেশি দাম পাওয়া মুশকিল। চল্লিশ হাজার খরচ আছে। ওটা একটু কমতেও পারে। তার মানে দুই সওয়া দুই-এ যদি ম্যানেজ করা যায় তা হলে ট্রাই নেওয়া যেতে পারে। মাসখানেকের মধ্যে পঞ্চাশ ষাট প্লাস হয়ে যাবে।

আছিস ভাল! অ্যাকসিডেন্টের গাড়ি শুনলে কোন পার্টি নেবে?

বলার কী দরকার?

ব্লু-বুক থেকেই মালিকের খবর জানা যাবে।

আগে থেকে মন খারাপ করে দিচ্ছিস কেন? এত দূর যখন এলাম তখন আর একটু চেষ্টা করতে দোষ কী।

থানায় গিয়ে খোঁজ করতেই হইচই পড়ে গেল, এসে গেছে, এসে গেছে।

একজন এস আই ধমকে উঠলেন, আশ্চর্য। কাল রাত্রে খবর পাঠানো হয়েছে, কাগজেও নিউজ বেরিয়েছে তবু কলকাতা থেকে এইটুকু আসতে এত দেরি করলেন?

সদানন্দ আমতা আমতা করল, মানে, ঠিক–!

সুজিত সেন আপনাদের কে হতেন?

কিছু হতেন না, মানে, আমরা ওঁকে চিনতাম না। বাদল বলল।

সে কী? তা হলে এসেছেন কেন?

বাদল সদানন্দের দিকে তাকাল। তার মন বলছিল এই এস আই-এর যা চেহারা এবং কথাবার্তা তাকে এস্টিম গাড়ির সন্ধানে এসেছে বলা ঠিক হবে না। সে বলল, আসলে ওদের একটা এস্টিম আছে। সেটা নিয়ে ওর মাসতুতো দাদা বেড়াতে বেরিয়েছিল কিন্তু কাল ফিরে যায়নি। কাগজে খবরটা পড়ে ভয় হল, তাই–?

তার নাম কী?

কানুদা, কানুদা বলে ডাকি।

না মশাই। এখানে যে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে তার ড্রাইভার ছিলেন সুজিত সেন। লাইসেন্স পাওয়া গিয়েছে। ওঁর সঙ্গে যে মহিলা ছিলেন তার নাম সুতপা মিত্র। ভদ্রমহিলা যে অফিসে চাকরি করতেন তার আইডেনটিটি কার্ড ব্যাগে ছিল। আর এই খবর সুজিতবাবুর বাড়িতে পাঠানো হয়েছে অথচ তাঁর আত্মীয়স্বজন কেউ এখন পর্যন্ত এলেন না।

সুজিতবাবুর বডি কোথায়?

ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালে।

আমরা তো কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি, যদি ওঁর ঠিকানাটা দেন তা হলে সেখানে গিয়ে বলে আসতে পারি আসার জন্যে। বাদল বিনীত গলায় বলল।

এস আই ঠিকানা দিয়ে দিতেই ওরা ছুটল। খানিকটা যাওয়ার পর বাদল বলল, পুলিশের কাছে গেলেই ওরা এমন হাবভাব করে যে মনে হয় অন্যায় করেছি।

আমার তো খুব ভয় করছিল!

ভয় করলেই ভয়, নইলে কিছুই নয়। বড়মামার কাছে শুনেছি আগেকার পুলিশ নাকি আরও ফেরোসাস ছিল। বাঘের ঠাকুরদা। যাক গে, সোজা হাসপাতালে চল।

হাসপাতালে কেন? ঠিকানাটা পেয়ে গেছিস তো।

লেটেস্ট খবর নিয়ে যাই। এই সুজিত সেন এখন স্বর্গে বসে আছে, সুতপা মিত্র যদি তার সঙ্গে না যায় তা হলে জানতে হবে ওদের সম্পর্ক কী?

হয়তো প্রেম-ট্রেম করত, ভালবাসত।

সেটা অন্যায় নয়। তবু খবরটা–!

ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালে এসে জানা গেল সুজিত সেনের শরীর মর্গে চলে গেছে কিন্তু সুতপা মিত্রের কন্ডিশন খুব খারাপ হয়েছে, তাকে এখনই কলকাতার বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার অথচ উদ্যোগ নেওয়ার মতো কেউ নেই।

ঠিকানা জোগাড় করে ওরা কলকাতায় রওনা হল। সদানন্দ বলল, কেসটা কী বল তো? এত বড় অ্যাকসিডেন্ট হল অথচ বাড়ির লোকজন আসছে না কেন?

হয় কেউ নেই, নয় কেস জন্ডিস।

আমার মনে হচ্ছে আমাদের আসাটা বৃথা হয়ে যাবে।

তা জানি না। কিন্তু গাড়িটার জন্যে চিন্তা হচ্ছে। একটা কনস্টেবল পর্যন্ত ওখানে পাহারা দিচ্ছে না। যদি পাবলিক সাফ না করে দেয় তা হলে পড়ে থাকলে এমনিতেই নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা পাই বা নাই পাই সেটা বড় কথা নয় কিন্তু একটা গাড়ি যদি ওইভাবে ধ্বংস হয়ে যায় তা হলে খুব দুঃখের ব্যাপার হবে। বাদলকে শোকগ্রস্ত দেখাচ্ছিল।

কলকাতায় ফিরে এসে ওরা প্রথমে সুতপা মিত্রের ঠিকানায় গেল। বেলেঘাটার সেই বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালেন যে ভদ্রমহিলা তাঁকে খুব বিরক্ত দেখাচ্ছিল। অদ্ভুত গলায় বললেন, আমি কী করব বলুন। আমার হাজব্যান্ড এখন কলকাতায় নেই। মেয়েছেলে হয়ে আমি তো কিছুই করতে পারি না।

বাদল বলল, উনি আপনার কে হন?

ননদ। ডিভোর্স করে এ বাড়িতে ছিল। চাকরি করত, টাকা দিত, আমার হাজব্যান্ডের নিজের বোন বলে আপত্তি করিনি।

কিন্তু এখনই ওঁর চিকিৎসার দরকার। ডায়মন্ড হারবার থেকে কলকাতায় না আনলে উনি বাঁচবেন না। আর কোনও পুরুষ আত্মীয় নেই আপনাদের?

না। এই যে শুনলাম মরে গেছে!

কে বলল?

থানা থেকে লোক এসেছিল। ভদ্রমহিলাকে এবার বিভ্রান্ত দেখাল।

না মরে যাননি। উনি তো চাকরি করেন। মরে গেলে যা হবার তা হবে। কিন্তু আপনারা কিছু করলেন না অথচ উনি বেঁচে গেলেন, তা হলে তো উনি কোনও সম্পর্ক রাখবেন না আপনাদের সঙ্গে। ক্ষতিটা বুঝতে পারছেন? বাদল জিজ্ঞাসা করল।

সত্যি বলছেন, মরেনি?

আমরা ওখান থেকেই আসছি।

ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে গেলেন। ওরা কী করবে যখন বুঝতে পারছে না তখন পাজামার ওপর পাঞ্জাবি চাপাতে চাপাতে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন, কোন হাসপাতালে আছে সুতপা?

ডায়মন্ড হারবারে।

এখান থেকে কীভাবে যাব? ট্রেন না বাস, কোনটায় তাড়াতাড়ি হবে?

বাসেই চলে যান, এসপ্লানেড থেকে ছাড়ে।

ভদ্রলোক ভেতরের দিকে মুখ করে বললেন, শুনছ? আমি যাচ্ছি। আমার জন্যে চিন্তা কোরো না। ভদ্রলোক হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

এবার ভদ্রমহিলা এলেন দরজা বন্ধ করতে।

বাদল জিজ্ঞাসা করল, উনি?

আমার হাজব্যান্ড। দড়াম করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

দুই বন্ধু হকচকিয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল। বাদল মাথা নাড়ল, দুর শালা।

বাইকের দিকে এগোতে এগোতে সদানন্দ হতভম্ব গলায় বলল, কী ব্যাপার রে।

জানি না। তবে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। বাদল বলল।

তুই?

বাইকের পেছনে উঠে বসে বাদল বলল, আমি কখনও বিয়ে করব না।

স্টার্ট না দিয়ে সদানন্দ মুখ ফেরাল, কেন?

বউকে দিয়ে এত মিথ্যে কথা বলাতে পারব না।

.

সুজিত সেনের বাড়িতে গিয়ে দেখল দরজায় তালা ঝুলছে। প্রতিবেশীরা জানালেন, অ্যাকসিডেন্টের খবর তাঁরা পেয়েছেন। পুলিশ এসেছিল। সুজিত সেনের স্ত্রী বছর খানেক আগে তাঁর মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছেন। তিনি যে টেলিফোন নাম্বার দিয়ে গিয়েছিলেন সেটা পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশীরা উৎসুক ছিল সুজিত সেনের সঙ্গিনীর ব্যাপারে খবর পেতে। ভদ্রমহিলা এখনও বেঁচে আছেন জেনে একজন মন্তব্য করল, ইস, কপালে দুঃখ আছে। বাদল মিসেস সেনের টেলিফোন নাম্বার জোগাড় করে সদানন্দকে বলল, এবার ফিরে চল।

খানিকটা দূরে এসে একটা টেলিফোন বুথ দেখে দাঁড়াতে বলল বাদল। বাইক দাঁড় করিয়ে সদানন্দ বলল, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে বাদল।

কেন?

আফটার অল ভদ্রমহিলার স্বামী মারা গিয়েছেন। নিশ্চয়ই এখন ওঁর মনের অবস্থা ভাল নয়। তুই এ সময় ফোন করে কী করবি?

আমি অন্য কারণে ফোন করছি। বাদল বুথে ঢুকে গেল। ভিড় ছিল না, নাম্বার ঘোরাতেই রিং হল। কয়েক সেকেন্ড বাদে একজন মহিলার গলার স্বর শোনা গেল। বাদল বলল, নমস্কার। আমি মিসেস সেনের সঙ্গে কথা বলতে পারি?

বলুন।

আমি জানি এই মুহূর্তে আপনি গভীর শোকের মধ্যে আছেন। তা সত্ত্বেও কিছু বাস্তব ঘটনাকে তো অস্বীকার করা যায় না। আপনার স্বামীর দামি গাড়ি অ্যাকসিডেন্টের জায়গায় পড়ে আছে। ইনসিওরেন্স কোম্পানিকে খবর দেওয়া এবং পুলিশকে অনুরোধ করে থানায় ওটাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা এখনই করা দরকার।

আপনি কে কথা বলছেন?

আমি একটা স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা থেকে বলছি।

দেখুন আমি ওসব ব্যাপারে একটুও ইন্টারেস্টেড নই। ঠিক আছে?

কিন্তু আপনি তো আপনার স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী?

আমি আপনার কাছে জবাব দিতে বাধ্য নই। লাইন কেটে দিলেন ভদ্রমহিলা।

দুই বন্ধু এসবের মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছিল না। যার অত দামি গাড়ি আছে তার সম্পত্তির পরিমাণ নিশ্চয়ই কম নয়। অথচ ডিভোর্সি না হওয়া সত্ত্বেও ভদ্রমহিলা সেই সম্পত্তির ব্যাপারে নিরাসক্ত হয়ে গেছেন। স্বামীর সঙ্গে অন্য মহিলার ঘনিষ্ঠতা তাঁকে বাপের বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য করেছিল কিন্তু তিনি আদালতে যাননি। যদি এই দুর্ঘটনায় সুজিত সেনের সঙ্গে কোনও মহিলা না থাকতেন তা হলে কি তিনি এই গলায় কথা বলতেন?

সদানন্দ বলল, মেয়েটার অবস্থা ভাব! ও চিরকাল জানবে কার অ্যাকসিডেন্টে মারা যাওয়ার সময় বাবার সঙ্গে একজন মহিলা ছিল!

বাদল বলল, তুই ভুল করছিস। ও যখন বড় হবে তখন এখনকার পাতি সেন্টিমেন্টগুলো থাকবে না। ও ভাবতে চেষ্টা করবে বাবার সঙ্গে কেন মা ছাড়া অন্য মহিলা ছিল। কিংবা এ নিয়ে ভাববেই না।

সদানন্দ বলল, আর কার কী পরিবর্তন হবে জানি না কিন্তু আমাদের রায়বাড়ির ছেলেমেয়েরা কিন্তু এখনকার মতো একই কথা ভাববে।

জোর দিয়ে বলতে পারিস না। আমি ভাবছি দুটো কথা। গাড়িটার কী হবে? আর ওই যে মহিলা সুতপা মিত্র, উনি নিশ্চয়ই সুজিত সেনকে ভালবাসেন। যদি বেঁচে যান তাহলে উনি কী পাবেন? ওর তো কোনও দোষ নেই। বিদেশ হলে উনি হয়তো ক্ষতিপূরণ চাইতে পারতেন। কুড়ি বছর পরে হলে সেটা হয়তো এ দেশেও সম্ভব হত। বাদল যেন নিজের মনেই কথা বলে যাচ্ছিল।

রায়বাড়ির গেট পেরিয়ে বাঁ দিকে শ্বেতপাথরের মূর্তিগুলোকে রেখে বাইকটাকে সিঁড়ির সামনে দাঁড় করাতেই একজন বৃদ্ধকে দেখা গেল এগিয়ে আসতে।

তোমার সঙ্গে কথা আছে সদানন্দ।

বলুন জেঠামশাই।

কথাটা শুধু তোমাকেই বলতে চাই।

বাইক থেকে নেমে পড়েছিল বাদল। বলল, আমি অফিসঘরে বসছি।

সে চলে গেলে বৃদ্ধ বললেন, শুনেছি তুমি ব্যবসা করছ। এ ব্যাপারে আমাদের নিশ্চয়ই আপত্তি করার কিছু থাকতে পারে না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা কেউ চাকরি করেনি কখনও, যে ব্যবসা করেছে সে সম্মানের সঙ্গেই তা করে এসেছে। কিন্তু তুমি এটা কী করছ?

কেন?

প্রতিদিন রায়বাড়িতে নিচু শ্রেণীর দালালরা আসছে যাচ্ছে। এখানে-ওখানে পোড়া বিড়ি ফেলছে। শুনলাম গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসা করছ। কিন্তু ওই লোকগুলোর নিত্য আসাযাওয়ায় এ বাড়ির সম্ভ্রম নষ্ট হতে বসেছে। অনেকেই বলছিল এ ব্যাপারে বড়মায়ের সঙ্গে কথা বলবে। কিন্তু আমি নিষেধ করেছি। বড়মাকে নিশ্চয়ই জানো। তিনি আমাদের অল্প বয়সে বলতেন, বাইরের বন্ধুদের গেটের বাইরে রেখে আসবে। কারণ তারা তোমার বন্ধু হতে পারে না। বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে। তিনি নিশ্চয়ই দালাল দূরের কথা, ওই যে ছেলেটি ভেতরে গেল তার আসাযাওয়া পছন্দ করবেন না। তাই, তুমি ব্যাপারটা ভেবে অন্য কিছু করার যাতে চেষ্টা কর তাই তোমাকে এত কথা বললাম।

সদানন্দের চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছিল। সে বলল, ঠিক আছে, আমি বড়মায়ের সঙ্গে কথা বলব। আর কিছু বলার আছে আপনার?

হ্যাঁ। আজ সন্ধ্যায় মা ভবানীর চাতালে মিটিং ডাকা হয়েছে।

মিটিং?

হ্যাঁ। আমরা তো সবাই এই বাড়িতে বাস করছি, বাড়িটার সমস্যা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাই না। মিটিং ওই বিষয়ে।

সদানন্দ ভেতরে ঢুকে অফিসঘরে এল। সেখানে তখন বাদল আবার খবরের কাগজ নিয়ে বসে গেছে। সদানন্দ জিজ্ঞাসা করল, তোর খিদে পায়নি?

জব্বর। কিন্তু কাজ না হলে বাইরে বেরিয়ে কিছু খাব না বলে ভেবেছিলাম।

তুই কাগজ দ্যাখ, আমি আসছি।

সদানন্দ ওপরে উঠে তাদের কাজের লোককে বলল দুজনের মতো খাবার নীচে পাঠিয়ে দিতে। তারপর সোজা চলে এল ওপরে।

দরজা খুলল আতরবালা। সদানন্দ জিজ্ঞাসা করল, বড়মা কোথায়?

বিশ্রাম করছেন।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল সদানন্দ। ইজিচেয়ারে শুয়েছিলেন বড়মা। বিরক্ত হয়ে তাকাতেই সদানন্দ বলল, আপনার সঙ্গে কথা আছে।

কী ব্যাপার? এ রকম হুটহাট চলে এলে ভেতরে?

আপনি আমাদের সবার বড়মা, মায়ের কাছে তো আসাই যায়।

বোসো।

সদানন্দ বসল, আমি একটা ব্যবসা করার চেষ্টা করছি। একতলায় আমাদের ভাগে যে ঘর পড়েছে সেখানে অফিস করেছি। ব্যবসার কাজে লোকজন আসে। এতে আপনার আপত্তি আছে?

বড়মা কথাগুলো শুনতে শুনতে যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। তাঁর চোখ যেন সদানন্দকে সর্বাঙ্গে দেখছিল। একটু চুপ করে থেকে তিনি অন্যরকম গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কাউকে দিয়ে তোমার ঠিকুজিটা আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress