মিস্টার ব্রাউনের বাড়ি
নিরাময় থেকে মিস্টার ব্রাউনের বাড়ি কয়েক মিনিটের পথ। এই দূরত্ব তিনি অজস্রবার হেঁটে এসেছেন, আজ মানুষের কাঁধে এলেন। এখন সকাল। পিলপিল করে মানুষেরা ছুটে আসছে। এই পাহাড় থেকে নীচের বাসরাস্তায় যাওয়ার একমাত্র পথ মিস্টার ব্রাউনের বাড়ির গেট ছুঁয়ে নেমে গিয়েছে। একমাত্র মদ্যপান, খাওয়া এবং ঘুমোনোর সময়টুকু বাদ দিয়ে বৃদ্ধ তাঁর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যে মানুষই নামাওঠা করত তাকে যিশুর কথা বলতেন, যিশুর মহানুভবতার কথা বলে তার জন্যে প্রার্থনা করতেন। এই পাহাড়ের যাবতীয় তথ্য মিস্টার ব্রাউনের জানা ছিল। পাহাড়ি মানুষদের কার বাড়ির কী সমস্যা তা তিনি প্রশ্ন করে জেনে নিতেন। আকাশে মেঘ অথচ কোনও মহিলা ছাতা ছাড়া বাজারে যাচ্ছেন দেখলে সতর্ক করতেন, বলতেন তাঁর ছাতাটা নিয়ে যেতে। দৈনন্দিন জীবনে পাহাড়, কুয়াশা, লম্বা গাছের জঙ্গল, চার্চের মতো মিস্টার ব্রাউন এই পাহাড়ি মানুষদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেই মানুষটা আজ নেই খবরটা পাওয়ামাত্র কেউ স্থির থাকতে পারেনি।
মিস্টার ব্রাউনকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল বাড়ির চাতালে তাঁর ব্যবহৃত খাটের ওপরে। চোখ বন্ধ। শরীর স্থির। মাথার ওপর নিকানো আকাশ। এত নীল আকাশ অনেকদিন মাখেনি। পায়ের কাছে মাথা নিচু করে বসেছিল ভুটো। তার প্রভুর কিছু একটা হয়েছে অনুমান করে চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার তামাং বিষ্ণুপ্ৰসাদকে ঘিরে জনতা বাড়ছে। হঠাৎ দেখা গেল ভুটো ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মিস্টার ব্রাউনের মুখের পাশে। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অদ্ভুত করুণ চিৎকার করল সে। ভুটো যে কাঁদছে এটা বুঝতে অসুবিধে হল না কারও। ডাক্তার তামাং বললেন, চুপ যা, এ ভুটো, চুপ যা। ভুটো চিৎকার করে যাচ্ছিল। তাকে সরিয়ে দিতে সাহস পাচ্ছিল না কেউ। হঠাৎ চিৎকার কানে এল। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল সিমি। মিস্টার ব্রাউনের শরীরটাকে দেখে পাথর হয়ে গেল সে। আর তখনই কান্না থামিয়ে ভুটো ছুটে গেল সিমির কাছে। সিমির দুটো পা জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজে আওয়াজ করতে লাগল। সিমি ঝুঁকে ওর মাথায় হাত রাখল। এবার এলিজাবেথকে দেখা গেল ভিড় সরিয়ে আসতে, তাঁর পাশে ম্যাথুজ। এলিজাবেথ মিস্টার ব্রাউনের পাশে এসে চাতালের ওপরই বসে পড়লেন, ইটস নট ফেয়ার মাই ফ্রেন্ড। আমি এসেছিলাম তোমার সঙ্গে দেখা করতে। দেখা করে চলে যাওয়ার কথা ছিল আমার। কিন্তু আমি থেকে গেলাম আর তুমি চলে গেলে? খুব নিচু গলায় কথা বলছিলেন ভদ্রমহিলা।
ডাক্তার তামাং কফিনের জন্যে লোক পাঠালেন। খবর পেয়ে ফাদার চলে এসেছেন। সামনের পাহাড়ি পথ মানুষের ভিড়ে এখন অচল। বয়স্ক ক্রিশ্চানরা শেষকৃত্যের ব্যাপারে কথা বলছেন। সায়ন ভেতরের ঘরে ঢুকল। যিশুর মূর্তির সামনে তখন মোমবাতি জ্বলছে না। শেষবার জ্বালিয়েছিলেন মিস্টার ব্রাউন। কী রকম মনে হল, সায়ন যিশুর ঘরে ঢুকল। তারপর সযত্নে মোমবাতিতে আগুন ধরিয়ে দিল। তার আলোয় ঝকঝক করে উঠল যিশুর মুখ। এই বাড়ি যাঁর তিনি আর কখনও মোমবাতি জ্বালাবেন না। অথচ যিশু থাকবেন তাঁর মহিমা নিয়ে।
কফিন এনে মিস্টার ব্রাউনকে স্নান করিয়ে পোশাক পরিয়ে তার মধ্যে শোওয়ানো হবে। ফাদার প্রার্থনা করবেন। তারপর শোকমিছিল কফিন নিয়ে প্রথমে যাবে চার্চে। সেখানকার বারান্দায় কিছুক্ষণ শায়িত থাকবেন মিস্টার ব্রাউন। তারপর যাওয়া হবে কবরখানায়। কিন্তু এসব করার আগে সবাই অপেক্ষা করবে মিস্টার ব্রাউনের বড়ছেলের জন্য। ভদ্রলোক শিলিগুড়িতে একটি নার্সারি স্কুল চালায়। অন্য দুই ছেলে রয়েছে সিমলা এবং মুম্বইতে। তাদের খবর দিয়ে আনানোর সময় নেই।
এই বাড়ির সর্বত্র মিস্টার ব্রাউনের স্মৃতি তার কী হবে? কোনও ছেলের পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়। ওঁর যে ছেলে সিমলার চার্চে আছেন তিনি হয়তো যিশুর মূর্তি নিয়ে যাবেন।
ডাক্তার তামাং ভেতরের ঘরে এলেন। গতরাত থেকে এই মানুষটি সব কাজ ফেলে মিস্টার ব্রাউনের পাশে আছেন। মুখচোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। ডাক্তার তামাং সায়নকে দেখে বললেন, মিস্টার ব্রাউন বলেছিলেন ওঁর কোটাটা শেষ হয়নি। আমি বলেছিলাম আমরা একসঙ্গে শেষ করব। মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হল মানুষ শেষ পর্যন্ত কথা রাখতে পারে না। মিস্টার ব্রাউনের দিশি মদের পাত্রটি তুলে গ্লাসে ঢাললেন ডাক্তার তামাং। তারপর গ্লাস ওপরে তুলে বললেন। লুক মাই ওন্ড ফ্রেন্ড, তোমার কোটা আমি শেষ করছি।
ঢক ঢক করে খানিকটা গলায় ঢেলে ঠোঁট মুছলেন ডাক্তার তামাং। তারপর এগিয়ে গিয়ে ফ্রিজ খুলে বললেন, মাই গড!
সায়ন এগিয়ে গিয়ে দেখল একটা বড় বাটি বোঝাই মাংস রান্না করে রাখা আছে। ডাক্তার তামাং জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি এসব খাওয়া বারণ?
সায়ন বলল, আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।
মাথা নেড়ে চামচ দিয়ে একটা প্লেটে কিছু মাংস তুলে স্টিলের প্লেটটা গ্যাস জ্বালিয়ে আগুনের ওপর রাখলেন। ডাক্তার তামাং বললেন, তুমি কি মনে করো না আমি খাচ্ছি বলে মিস্টার ব্রাউন খুশি হচ্ছেন?
আপনারা তো একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতেন।
ইয়েস, অনেক বছর চলে গেল। এই পাহাড়ে এলেই আমি এসে ওই চেয়ারে না বসে ফিরে যেতাম না। আমার জীবনে এই একটি মানুষ যিনি কোনওদিন কারও নিন্দা করেননি। মাংস গরম করে গ্লাস নিয়ে টেবিলে বসে বললেন, তুমি একটু আমার সামনে এসে বসবে?
বাইরে মানুষের চাপা গলার স্বর একত্র হয়ে বেশ সরব হয়েছে। চাতালে মিস্টার ব্রাউনের শরীর ঘিরে শোকার্তরা বসে আছেন আর ভেতরের ঘরে একজন মদ্যপান এবং মাংস খাচ্ছেন, এটা কি শোভনীয় হচ্ছে?
উত্তরটা সায়ন নিজেই দিল। ডাক্তার তামাং-এর অধিকার আছে এসব করার।
সে টেবিলের উল্টোদিকে বসলে ডাক্তার তামাং তাকালেন। কয়েক সেকেন্ড এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি নিজেকে কী মনে করো?
সায়ন অবাক হল, কী মনে করব? আমি একজন স্বাভাবিক মানুষ। অবশ্য আমার এই অসুখকে যদি স্বাভাবিক মানুষের অসুখ বলে মনে করা যায়।
মানুষ মাত্রই অসুস্থ হয়। কেউ কম কেউ বেশি। কিন্তু জানতে চাইছি তুমি কি মনে কর তোমার মধ্যে কোনও সুপার পাওয়ার কাজ করছে?
সুপার পাওয়ার?
যেটাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অবাস্তব বলে মনে করি। যে-সমস্ত মহামানব পৃথিবীতে এসেছেন, যাঁদের ঈশ্বরপুত্র বলা হয় তাঁরা অনেক কিছু করেছেন যা আমরা সাধারণ মানুষরা করতে পারি না। যেমন যিশু কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় করেছেন, কেউ মৃত মানুষের প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন। বুদ্ধদেব অথবা চৈতন্য সম্পর্কেও একই কথা শোনা যায়। এদের ঘিরে লক্ষ লক্ষ মানুষ একত্র হয়েছেন। এঁদের বাণীকে জীবনের আদর্শ করেছে যুগ যুগ ধরে। তুমি নিশ্চয়ই জানো।
জানি। এঁদের আপনি বিশ্বাস করেন না?
এঁদের অস্তিত্ব অবিশ্বাস করি না। কারণ এরা আমাদের আলোর পথ দেখিয়েছেন। কিন্তু এদের ঘিরে যেমন মিরাকলের কথা চালু আছে সেগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। একজন মানুষের উপকারের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন এইটুকুই তাঁর প্রতি মাথা নত করার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু আমি বিশ্বাস না করলে কী হবে কোটি কোটি মানুষ করেন, তাঁদের বোঝালেও তাঁরা বুঝতে চাইবেন না। ওই বিশ্বাসটাই তাঁদের বেঁচে থাকার অলিজেন। মিস্টার ব্রাউনও এইরকম বিশ্বাস করতেন। তুমি জানো?
উনি ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন।
ঠিক। কিন্তু মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে আমাকে কী বলেছেন জানো? সায়ন চুপ করে রইল।
উনি বলেছেন ওঁর কোনও আক্ষেপ নেই। কারণ তিনি যিশুকে জীবন্ত দেখেছেন। যিশুর মূর্তি থেকে বেরিয়ে এসে এক জ্যোতির্ময় পুরুষকে তোমার শরীরে প্রবেশ করতে দেখেছেন। তুমি কী মনে করো?
আমি জানি না।
মিস্টার ব্রাউনের অজ্ঞান হওয়ার ঠিক আগে তুমি তোমার শরীর মনে কোনও পরিবর্তন অনুভব করেছিলে?
সম্ভবত না।
তাহলে দ্যাখো, মানুষ নিজের ভাবনাকে বাস্তবে দেখতে খুব ভালবাসে। মিস্টার ব্রাউন তোমাকে স্নেহ করতেন। তোমার মধ্যে তিনি সেই পবিত্র মহামানবকে দেখার চেষ্টা করতেন। হয়তো তোমাদের চেহারায় কিছু মিল আছে যা তাঁকে এমন ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর মৃত্যুর আগে ওই বিশ্বাস থেকে তাঁর মনে প্রশান্তি এসেছিল। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। তোমাকে নিয়ে বারংবার এমন ঘটনা ঘটছে কেন? নীচের রাস্তায় মেরির মূর্তির সামনে তোমাকে দেখে যারা বিভ্রান্ত হয়েছিল তাদের সঙ্গে তো তোমার আগে পরিচয় ছিল না।
আমি কী বলব বলুন। সায়ন বলল, মিস্টার ব্রাউন মৃত্যুর আগে যদি কিছু বলে গিয়ে থাকেন তাহলে সেটা আর কাউকে বলবেন না।
কেন? গ্লাস শেষ করলেন ডাক্তার তামাং।
আমাকে বিব্রত হতে হবে।
কেন?
এর আগে কিছু মানুষের ধারণা হয়েছিল আমি অলৌকিক কিছু করতে পারি। আমি যে অতি সাধারণ মানুষ বুঝতে চায়নি ওরা।
ঠিক আছে। আমি বলব না। কিন্তু মিস্টার ব্রাউনের এমন ধারণা হল কেন?
আমি জানি না।
আমি জানি। উনি আমাকে বলেছেন এক রাত্রে স্বপ্নে দেখেছেন তোমাদের নিরাময়ের ওপর একটি তারাকে নেমে আসতে। অর্থাৎ ভদ্রলোক দীর্ঘকাল ধরে তোমাকে মনে মনে যিশুর আসনে বসিয়েছেন।
না। আমার সে যোগ্যতা নেই। তা ছাড়া উনি আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করতেন তাতে স্নেহ প্রকাশ পেত, ভক্তি নয়।
সায়নের প্রতিবাদ শুনতে শুনতে দ্বিতীয়বার গ্লাস ভর্তি করলেন ডাক্তার তামাং। এই সময় দরজায় শব্দ হল। ডাক্তার তামাং বললেন, কাম ইন।
ভেজানো দরজা খুলে একজন সম্ভ্রান্ত চেহারার মধ্যবয়সী মানুষ এবং দুজন প্রৌঢ় ঘরে ঢুকলেন। প্রৌঢ়দের একজন বলে উঠলেন, এ কী! আপনি মদ্যপান করছেন। ছি ছি ছি। এ বাড়ির এত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল, মানুষটার শরীর বাইরে শুয়ে রয়েছে, সবাই শ্রদ্ধা জানাতে আসছে আর আপনি!
ডাক্তার তামাং বললেন, তোমাকে চিনতে পারছি। এঁরা কে?
মধ্যবয়সী মানুষটি বললেন, উনি আমার শ্বশুর আর ইনি ওঁর ভাই। শিলিগুড়িতে থাকেন। ডাক্তার তামাং গ্লাসে চুমুক দিলেন, আমি অনুরোধ রাখছি।
মধ্যবয়সী বললেন, অনুরোধ?
যোশেফ, তোমার বাবার মৃত্যুর সময় তাঁর পাশে ছিলাম। গতকাল তাঁর কোটার মদ উনি কোনও কারণে শেষ করতে পারেননি। তাই আমাকে বলেছিলেন এখানে নিয়ে আসতে। নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। আমি কথা দিয়েছিলাম আজ শেষ করব। আবার চুমুক দিলেন তিনি, ভদ্রমহোদয়গণ, মিস্টার ব্রাউনের এই বাড়িতে আপনারা শেষ কবে এসেছেন তা দয়া করে বলবেন কী?
যোশেফের শ্বশুর বললেন, বিয়ের পর একবার এসেছিলাম। আমার ভাই কখনও আসেনি। তাতে কী হয়েছে?
মানুষটা বেঁচে থাকার সময় আপনারা এখানে তিনি কেমন আছেন দেখতে যখন আসেননি তখন আমাকে ভর্ৎসনা করার আগে আপনাদের দুবার ভাবা উচিত ছিল।
এই সময় ফাদার ঘরে এলেন। ডাক্তার তামাং-এর সামনে মদের বোতল ও গ্লাস তিনি যেন লক্ষই করলেন না, আমি আবার এক পরম বন্ধুকে হারালাম। রোজ দেখা হত না কিন্তু মনের যোগাযোগ ছিল। ডাক্তার তামাং, ওঁর ছেলে যোশেফ এসে গিয়েছে, এখন আপনারা পারলৌকিক কাজকর্মের সময়টা স্থির করুন। যদি অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের কথা ভেবে অপেক্ষা করতে চান তাহলে সেটা করা যেতে পারে।
ডাক্তার তামাং উঠে দাঁড়ালেন, ফাদার। আপনার সঙ্গে মিস্টার ব্রাউনের তো দীর্ঘকালের আলাপ। ওঁর কাছে কোনও আত্মীয়স্বজনকে আসতে দেখেছেন?
না। আমার চোখে পড়েনি।
তাহলে দেরি করে লাভ কী! অবশ্য যোশেফ যা বলবে তাই হবে।
যোশেফ তার শ্বশুরের দিকে তাকাল। তিনি বললেন, মৃতদেহ বেশি সময় রেখে দিলে পচন ধরতে পারে। উনি কখন মারা গিয়েছেন?
কাল মধ্যরাত্রে। ডাক্তার তামাং উত্তর দিলেন।
তাহলে তো এমনিতেই বেশ দেরি হয়ে গেছে।
ফাদার বললেন, তাহলে কফিন আসুক, আমরা প্রস্তুতি নিই। ওঁকে স্নান করাবার ব্যবস্থা করা দরকার।
ডাক্তার তামাং বললেন, একটা কথা। মৃতের প্রিয় কোনও দামি জিনিস আজকাল কফিনে দেওয়া হয় না বটে তবে সাধারণ জিনিস নিশ্চয়ই দেওয়া যেতে পারে ফাদার।
নিশ্চয়ই।
তাহলে বাকি মদটুকু সমেত এই বোতলটা কফিনে দিলে ওঁর আত্মা খুশি হবে বলে আমার বিশ্বাস।
সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল যোশেফ, কী বলছেন আপনি?
ফাদার বললেন, তোমার ব্যাপারটা ভাবতে অস্বস্তি হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমার বাবা মদ্যপানকে অপরাধ বলে মনে করতেন না। মদ্যপান করে কখনও ওঁকে বেসামাল হতে কেউ দেখেনি। ওটা তাঁর ভালবাসার জিনিস ছিল। তাই ডাক্তার তামাং ওই প্রস্তাব করে কোনও অন্যায় করেননি মাই সন।
যোশেফ মুখ ঘোরাল। ডাক্তার তামাং বোতল ভাল করে বন্ধ করে বললেন, মাই ওন্ড ফ্রেন্ড। তোমার কোটাটা আজ ভাগ করে খাব বলে কথা দিয়েছিলাম। আমি আমার ভাগ শেষ করেছি। বাকিটা তোমার কফিনে থাকবে। ওকে! তারপর ফাদারের দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা যেন মনে করে দেওয়া হয়।
আপনি তো থাকছেন! ফাদার বললেন।
না, আমি থাকছি না। একজন মৃত বন্ধুর সঙ্গে অনেকক্ষণ কাটিয়েছি, এবার জীবিত রুগিগুলোর কাছে যাওয়া দরকার। ডাক্তার তামাং এক পা হেঁটে দাঁড়িয়ে গেলেন, ফাদার, এই ছেলেটিকে আপনি চেনেন? কখনও দেখেছেন?
ফাদার তাকালেন সায়নের দিকে, নিশ্চয়ই। ও নিরাময়ে থাকে।
গুড।
ফাদার বললেন, ডাক্তার তামাং, মিস্টার ব্রাউন আপনার বন্ধু। ওঁকে কফিনে শোওয়ানো পর্যন্ত আপনি না গেলে ভাল হয়।
কাপড় দিয়ে জায়গাটাকে ঘিরে মিস্টার ব্রাউনের শরীরটাকে স্নান করানো হল। বয়স্করাই সেটা করলেন। যোশেফ ওঁর সেরা পোশাক বের করে দিল। মৃত মানুষকে সঠিকভাবে পোশাক পরানো সম্ভব নয়। তবু যেটুকু সম্ভব হল তাতেই ওঁকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। ইতিমধ্যে কফিন এসে গিয়েছিল। এখনই কফিনে পেরেক পোঁতা হবে না। একবার সেটা করলে আর খোলা রীতিবিরুদ্ধ। শেষ মুহূর্তে কোনও প্রিয়জন এসে গেলে তিনি মিস্টার ব্রাউনকে দেখতে পাবেন না। তাই ক্লিপের ব্যবস্থা আছে কফিনের ঢাকনাতে। একটা পাতলা বালিশের ওপর ওঁর মাথা রেখে কফিনে শুইয়ে দেওয়া হল সাবধানে।
ফাদার চোখ বন্ধ কবে নীরবে প্রার্থনা করলেন। ডাক্তার তামাং বোতলটা একটা কাগজে মুড়ে কফিনের ভেতর রেখে দিলেন।
এইসব আয়োজন যখন চলছে তখন মিসেস অ্যান্টনি এসে দাঁড়ালেন সায়নের পাশে, তোমার স্নান খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। আজ সকাল থেকে তুমি কিছুই খাওনি, ওষুধও না।
ডাক্তার আঙ্কল কি যেতে বলেছেন?
না। তিনি একজনকে নিয়ে ব্যস্ত আছেন।
কাকে নিয়ে?
কঙ্কাবতীর পাশের ঘরে যে বাচ্চা মেয়েটি থাকে, হঠাৎ তার শরীর খারাপ হয়েছে। প্রচণ্ড ব্লিডিং হচ্ছে।
আমি একটু পরে যাচ্ছি। প্লিজ।
মাথা নেড়ে মিসেস অ্যান্টনি ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন।
ঠিক এই সময় মোটরবাইকের আওয়াজ ভেসে এল। দুটো মোটরবাইক আর দুটো মারুতি ভ্যান হর্ন বাজাতে বাজাতে ওপরে উঠে আসছে। ভিড় তাদের জায়গা দিচ্ছিল না বলে তারা গালাগাল শুরু করল। ফলে রাস্তা তৈরি হয়ে গেল।
মোটরবাইকের দুজন আরোহী উঠে এল গেট খুলে। প্রথমজন বলল, আমার নাম সামু গুরুং। নিশ্চয়ই নামটা শুনেছেন। আমরা এই মাত্র খবর পেলাম মিস্টার ব্রাউন মারা গিয়েছেন। ওর ছেলেমেয়ে কেউ এখানে আছে?
যোশেফ এগিয়ে গেল, আমি ওঁর ছেলে।
আপনার বাবাকে আমাদের পার্টি শ্রদ্ধা করে। উনি কীভাবে মারা গিয়েছেন এবং কখন ঘটনাটা ঘটেছে?
আমি এখানে ছিলাম না। শুনলাম কাল মাঝরাত্রে বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছেন।
এখানে?
না। ওঁকে নিরাময়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
নিরাময় মানে ব্লাড ক্যানসার নাসিংহোমে। কে নিয়ে গিয়েছিল ওকে ওখানে? হার্ট অ্যাটাকের ট্রিটমেন্ট কি ওখানে হয়?
আমি জানি না।
আমাদের জানা দরকার। সামু গুরুং মাথা নাড়ল, ঠিক আছে, আমরা ওঁর ডেডবডি নিয়ে সারা শহর ঘুরব। তারপর পার্টি অফিসের সামনে রাখব। মালা-টালা দেওয়া হবে। নেতাদের বেলায় যেমন হয়। কফিন রেডি?
ফাদার বললেন, হ্যাঁ রেডি। কিন্তু উনি তো নেতা ছিলেন না। তা ছাড়া কবরখানায় ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়ে গেছে।
হোক না। আপনার কাজ প্রার্থনা করা, আপনি তাই করবেন ফাদার। ওঁর ছেলের যখন আপত্তি নেই–সামু গুরুং হাসল, আমি নিরাময় থেকে আসছি। তার পরেই ওঁকে নিয়ে যাওয়া হবে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আওয়াজ পাওয়া গেল। সেই সঙ্গে চিৎকার আর অশ্রাব্য গালাগালি। ওরা যে নিরাময়ের ওপর হামলা করছে তা বোঝা গেল। জনতা ভয় পেয়ে পালাচ্ছিল। যারা সাহসী তারা ওদের বক্তব্য শুনে মন্তব্য করছিল, নিরাময়ে না নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মিস্টার ব্রাউন বেঁচে যেতেন। ওই ডাক্তার হার্টের কিছু বোঝে না বলে লোকটা মরে গেছে। এবার আগন্তুকদের সঙ্গে এখানকার কিছু মানুষ যোগ দিল। নিরাময়ের গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বড় বড় পাথর ছোঁড়া হচ্ছে। জানলার কাঁচগুলো দোতলা থেকে ভেঙে পড়ছে।
এলিজাবেথ চিৎকার করলেন, এসব কী হচ্ছে? এ তো গুণ্ডামি!
তাঁর মার্কিন ইংরেজির অর্থ অনেকেই বুঝতে পারল না। এলিজাবেথ ছুটলেন আক্রমণকারীদের বাধা দিতে। উত্তেজিত কর্মীরা তাঁকে ছুটে আসতে দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিল। তারপর বক্তব্য শুনে জিজ্ঞাসা করল, হু আর ইউ?
আমি মিস্টার ব্রাউনের বন্ধু। আমেরিকা থেকে এসেছি।
সঙ্গে সঙ্গে স্লোগান উঠল, আমেরিকান দালাল তফাত যাও। আমেরিকান দালালি চলবে না চলবে। একজন ওঁকে এমন ধাক্কা মারল যে ভদ্রমহিলা মাটিতে পড়ে গেলেন।
সায়ন চারপাশে তাকাল। বিষ্ণুপ্ৰসাদকে খুঁজল। সে কাছেপিঠে নেই। এই সময় ডাক্তার তামাং বেরিয়ে এলেন ভেতরের ঘর থেকে। জিজ্ঞাসা করলেন কী হয়েছে? ফাদার ওঁকে ব্যাপারটা সংক্ষেপে বললেন। ডাক্তার তামাং দেখলেন সায়ন এগিয়ে যাচ্ছে নিরাময়ের দিকে। তিনি দ্রুত হাঁটতে লাগলেন।
সায়ন আগে পৌঁছোল সামু গুরুং-এর সামনে, আপনারা অন্যায় করছেন।
সামু ওর দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করল, অ্যাই তুই তো এখানে থাকিস? বাচ্চাদের গান শেখাস। ডাক্তার শালাকে ডাক। গেট বন্ধ করে মেয়েছেলের মতো বসে থাকলে বেঁচে যাবে ভেবেছে?
একটি বাচ্চা মেয়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ডাক্তারবাবু তার চিকিৎসা করছেন। এখন ওঁর বাইরে আসা সম্ভব নয়।
শালা দালাল। যখনই ঝামেলা করতে আসি তখনই শুনতে হয় কেউ না কেউ অসুস্থ! বাহানা?
আপনারা কেন এসব করছেন?
তোর ডাক্তার ওই বুড়োটাকে মেরে ফেলেছে।
এ কথা কে বলেছে আপনাকে?
আমি বলছি। এই এলাকায় আমার কথাই শেষ কথা। ও শালা হার্টের কিস্যু জানে না তবু বুড়োটাকে কেন এখানে নিয়ে এল? অ্যাই, গেট ভাঙ, ভেঙে গুঁড়িয়ে দে। চিৎকার করে আদেশ দিল সামু। মানুষগুলো উল্লসিত হল।
এলিজাবেথ মাটি ছেড়ে থরথর করে কাঁপছিলেন। সায়নকে দেখে ছুটে এলেন পাশে। ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা কী চায়? কে ওরা?
এরা রাজনীতি করে।
ও মাই গড!
এই সময় ডাক্তার তামাংকে দেখা গেল সামু গুরুং-এর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। সামু তাঁকে দেখে একটু হকচকিয়ে গেল, আপনি এখানে?
এসব কী করছ তোমরা?
এই লোকটা পাহাড়িদের শত্রু। কাল যদি বুড়ো ব্রাউনকে ও এখানে না নিয়ে এসে হাসপাতালে পাঠাত তাহলে হয়তো লোকটা বেঁচে যেত!
তোমাকে কে বলেছে এ কথা?
সবাই বলছে। ওকে এখানে নিয়ে এল কেন?
এর জবাব আমি তোমাকে দেব। কিন্তু তার আগে তুমি তোমার এই পাবলিককে থামতে বলো। ইমিডিয়েটলি! চিৎকার করলেন ডাক্তার তামাং।
সামু গুরুং কিছু ভাবল। তারপর হাত তুলে সবাইকে থামতে বলল। কিন্তু ভাঙার নেশা, যার একবার পেয়ে বসে তাকে থামানো খুব মুশকিল। সামুর ইঙ্গিতে পাবলিক ভ্রূক্ষেপ করল না। দেওয়াল বেয়ে দোতলার কাঁচভাঙা জানলায় উঠে গেছে কেউ কেউ। সামু চিৎকার করল কিন্তু তাতেও কাজ হল না।
এবার সামুর ইঙ্গিতে তার এক সহকারী শূন্যে রিভলবারের গুলি ছুড়ল। আচমকা সব চুপ মেরে গেল। সবাই মুখ ঘুরিয়ে ওই পরিচিত শব্দের উৎস খুঁজতে লাগল। ডাক্তার তামাং সামুর সামনে দাঁড়ালেন, তোমাকে পার্টি নির্দেশ দিয়েছে এখানে এসে হুজ্জোতি করতে?
এই প্রশ্নের জবাব আপনাকে দেব না।
দিতে হবে। তুমি জানো আমি সরাসরি চেয়ারম্যানের কাছে যেতে পারি!
যান না, আপনাকে কে বাধা দিচ্ছে!
চুপ করো। ওইভাবে আমার সঙ্গে কথা বোলো না। তুমি কি জানো মিস্টার ব্রাউনের ডেথ সার্টিফিকেটে আমি সই করেছি?
আপনি?
ওঁর শরীরের যে অবস্থা তখন ছিল হাসপাতাল দূরের কথা নীচের রাস্তা পর্যন্ত ওঁকে নিয়ে যাওয়া যেত না! আমি পাশে সারারাত ছিলাম, আমার সামনেই ওঁর মৃত্যু হয়, এ খবর তুমি পেয়েছ?
না। সামুর মুখ অন্য রকম হয়ে যাচ্ছিল।
এখন আমি যদি তোমাকে একটি চড় মারি হলে কি অন্যায় হবে?
আপনি আমাকে চড় মারবেন? যত নামকরা ডাক্তার হন তারপর আপনি পাহাড়ে থাকতে পারবেন?
তুমি এখন গুণ্ডা নিয়ে এখানে এসেছ। আমি চড় মারলে তোমার গুণ্ডারা আমাকে গুলি করে মারবে। কিন্তু পরে এর জন্যে তোমার শাস্তি হবে।
সামু গুরুং কাঁধ নাচাল, সেটা পরে দেখা যাবে। আপনি যখন ডেথ সার্টিফিকেট লিখেছেন তখন আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু ওই বুড়োটাকে বঞ্চিত করলেন আপনি। ওঁকে আর সম্মান দেখানো হবে না।
তোমরা চলে গেলে এই পাহাড়ের মানুষ খুশি হবে। এরাই মাথায় করে মিস্টার ব্রাউনকে নিয়ে যাবে সমাধি দিতে। ডাক্তার তামাং পাথরটার উপর উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন, আপনারা আমাকে চেনেন। আমি ডাক্তার তামাং সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে বলছি আমাদের প্রিয় মিস্টার ব্রাউনের মৃত্যুর জন্যে নিরাময়ের কেউ দায়ি নয়। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং আমি চিকিৎসা করি। সে সময় তাঁকে কোথাও নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এই সামু গুরুং আপনাদের মিথ্যে কথা বলে উত্তেজিত করেছে। আমি মিস্টার ব্রাউনের চিকিৎসক, আমি বলছি, এই ছোকরা মিথ্যেবাদী। অযথা গুণ্ডামি করতে এসেছে, এবং আপনাদের জড়িয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে জনতার মধ্যে গুঞ্জন উঠল। সামু চিৎকার করল, এই কী হচ্ছে, অ্যাঁ? মেরে খাদে ফেলে দেব তোকে! সে তেড়ে যাচ্ছিল ডাক্তার তামাং-এর দিকে। হঠাৎ সায়ন দৌড়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, সাবধান আর এক পা-ও এগিয়ো না।
সামুর বিরাট শরীরটা যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না।
ওই রকম রোগা শরীর ওইভাবে তাকে শাসাতে পারে। নিজেকে সামলে সায়নকে আঘাত করতে গেল সামু। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা চিৎকার এবং একটা পাথর উড়ে এল সামুর ওপর। সামু অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়াল। তৎক্ষণাৎ যে প্রতিক্রিয়া হল তা কেউ কল্পনাও করেনি একটু আগে। যারা একটু আগে সামুর প্ররোচনায় নিরাময়ে পাথর ছুড়ছিল তারাই ভাঙচুর করতে লাগল সামুদের আনা ভ্যান এবং মোটরবাইকগুলোকে। সামুর সঙ্গীরা রিভলবার ছুড়ল ভয় দেখাতে কিন্তু তার ফল আরও মারাত্মক হল।
জনতা ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই পুলিশের দুটো জিপ নীচ থেকে উঠে এল। পুলিশ দেখে জনতা থমকে গেল। যে অফিসার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি নেপালি। সামুর জামা ছিঁড়ে গিয়েছিল। সে দৌড়ে গেল অফিসারের কাছে, উত্তেজিত হয়ে জনতাকে দেখিয়ে অভিযোগ করতে লাগল। এক দঙ্গল পুলিশ তখন বেতের ঢাল নিয়ে মোকাবিলার জন্যে তৈরি। সামু ভ্যান এবং বাইকগুলো দেখাল। ভ্যানের কোনও কাঁচ আর আস্ত নেই।
সামু চিৎকার করল, দাঁড়িয়ে দেখছেন কী? অ্যারেস্ট করুন। থানায় নিয়ে চলুন, তারপর যা করার আমি করব।
অফিসার ডাক্তার তামাংকে চিনতে পারলেন। এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছিল ডক্টর?
ওঁর কথা কী শুনছেন? আমি যা বলছি তাই করুন। সামু ধমকাল।
অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে অ্যারেস্ট করব?
ভিড় সরে যাচ্ছিল ওপরে। দোতলার জানলায় যারা ঝুলছিল তারা এবার লাফিয়ে পড়ল রাস্তায়। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশেরা তাদের ধরে ফেলল। ধরা পড়তেই তারা চিৎকার করতে লাগল, সামু ভাই, তোমার কথায় আমরা জানলা ভাঙতে গিয়েছিলাম। আমাদের বাঁচাও।
সামু বলল, ওদের ছেড়ে দিন। ওরা আত্মরক্ষার জন্যে ওপরে উঠেছিল।
প্রবল হইচই শুরু হল। জনতা বলতে লাগল সামু গুণ্ডামি করতে এসেছিল, নিরাময় ভেঙেছে, ওকে অ্যারেস্ট করা হোক।
অফিসার হুকুম করলেন, আপনারা সবাই এখান থেকে চলে যান। এখনই।
জনতা সরে গেল। অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, এ বাড়িটার ওপর হামলা হল কেন? এটা তো একটা নার্সিংহোম!
সামু বলল, পাবলিক ক্ষেপে গিয়ে আক্রমণ করেছে। এখানে শালা বাঙালিদের ট্রিটমেন্ট হয়। নেপালিরা গরিব বলে জায়গা পায় না।
অফিসার বললেন, আপনারা থানায় চলুন, ওখানে গিয়ে কথা বলব।
ডাক্তার তামাং বললেন, এই গুণ্ডাটাকে যতক্ষণ অ্যারেস্ট না করছেন ততক্ষণ আমি কোনও কথা বলব না। সম্পূর্ণ বিনা কারণে ও এখানে এসে হামলা করেছে। আমি চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসা করব পার্টি কেন গুণ্ডা পোষে? এসব ভাঙচুর ওর দলের লোকজন করেছে, গুলি ছুঁড়েছে।
অফিসার চমকে গেলেন, গুলি? গুলি চলেছে এখানে?
সায়ন বলল, ওই দুজনের কাছে রিভলবার আছে।
অফিসার বলল, দাও। রিভলবার দিয়ে দাও।
সামু এগিয়ে গেল ভ্যানের দিকে। ভাঙচুর হওয়া সত্ত্বেও ভ্যান দুটো চালু হল। লোকজনকে দুটো ভ্যানে তুলে সামু চিৎকার করে বলল, মোটরবাইক দুটোকে আমাদের ওখানে দিয়ে আসবেন অফিসার।
ভ্যান দুটো নীচে নেমে গেল।
ডাক্তার তামাং বললেন, আশ্চর্য! আপনি নির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া সত্ত্বেও ওদের অ্যারেস্ট করলেন না?
অফিসার বললেন, কে সত্যি বলছে তাই তো বুঝতে পারছি না।
আমরা এতগুলো লোক মিথ্যে বলছি?
ঘটনাটা বলুন তো?
ডাক্তার তামাং সংক্ষেপে যা ঘটেছিল বললেন।
অফিসার সব শুনে মাথা নাড়লেন, বুঝতেই পারছি ওদের পুরনো রাগ আছে এখানকার ডাক্তারের ওপর। উনি কোথায়?
সায়ন বলল, উনি একজন সিরিয়াস পেশেন্টের কাছে আছেন।
অফিসার বললেন, ঠিক আছে, ওরা তো চলে গেছে, আপনারা এ নিয়ে আর ভাববেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমার প্রশ্নের জবাব আপনি দেননি অফিসার! ডাক্তার তামাং বেশ উঁচু গলায় বললেন, কেন ওদের ছেড়ে দিলেন?
ধরলেও বেল দিতে হত। কেস হলে প্রমাণ করা যেত না।
আমরা এতগুলো লোক সাক্ষী দিতাম।
তার আগেই আমি ট্রান্সফার হয়ে যেতাম।
আপনি ওয়েস্টবেঙ্গল গর্ভমেন্টের অফিসার। আপনাকে ট্রান্সফার করবে একটা গুণ্ডা? ডাক্তার তামাং ব্যঙ্গ করলেন।
আপনি আমার চেয়ে কম জানেন না ডাক্তার।
অথচ আন্দোলনের সময় আপনারা পাহাড়ে নির্দয়ভাবে অত্যাচার করেছেন। নির্দোষী মানুষকে মেরেছেন। ঠিক আছে, আপনি যেতে পারেন।
আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। মাঝে মাঝে আমি নিজেই বুঝতে পারি না যে কোন গর্ভমেন্টের চাকরি করছি। তবে আমি এই ঘটনাটা ওসি এবং এসপি সাহেবকে জানাব। ওঁরা যা চাইবেন তাই হবে।
ওঁরা চলে গেলেন। কিন্তু যাওয়ার আগে ওসি গুণ্ডাদের দুটো মোটরবাইককে তুলে নিয়ে যেতে ভুললেন না।
ডাক্তার তামাং এবার এলিজাবেথের দিকে তাকালেন। কাছে গিয়ে বললেন, সমস্ত ঘটনার জন্যে আমি খুব লজ্জিত। এখানকার মানুষের হয়ে ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে।
এলিজাবেথ মাথা নাড়লেন, আমাদের প্রত্যেকের ক্ষমা চাওয়া উচিত এই বাড়িটার কাছে। আসুন, যদি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা যায়।
বড়বাহাদুর গেট খুলল।
মিসেস অ্যান্টনি এগিয়ে এসে বললেন, ডাক্তার সাহেব এখনও মেয়েটার পাশে বসে আছেন। আমরা খবর দিয়েছি।
ওঁরা প্যাসেজ দাঁড়িয়েছিলেন। একটু বাদেই ডাক্তার নেমে এলেন, ও ডক্টর তামাং এনি প্রব্লেম?
আপনি কিছু শোনেননি?
শুনেছি। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় সমস্যায় আছি আমি।
আপনাকে সাহায্য করতে আমার কোনও অসুবিধে নেই।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। একবার মেয়েটিকে দেখে যেতে পারেন।
এলিজাবেথ বললেন, আমরা অসহায়ের মতো দেখলাম ওরা নিরাময়ের জানলা ভাঙল। ডাক্তার তামাং না থাকলে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে যেতে পারত।
ডাক্তার হাসলেন, আমি ওঁর কাছে কৃতজ্ঞ। এলিজাবেথ, ওই কাচগুলো ভেঙেছে বটে তবে আবার সারানো যাবে কিন্তু ওই বাচ্চাটার জীবন তো ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। আসুন ডক্টর তামাং।
.
বিকেলের অনেক আগে শোকযাত্রা বের হল। কাতারে কাতারে মানুষ লাইন করে চলেছে। প্রত্যেকেই নতমস্তকে হাঁটছে। কেউ কথা বলছে না। আজকের দিনটা ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এত রোদ পাহাড় অনেককাল পায়নি। চার্চের দিকে যত এগোচ্ছিল তত মিছিলের শেষ প্রান্ত বেড়ে যাচ্ছিল।
দুপুরের খাওয়া শেষ করে সায়ন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। মেয়েটি এখন অনেকটা ভাল। ডাক্তার তামাং চলে গিয়েছেন। মিস্টার ব্রাউনের শোকমিছিলে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিল সায়ন।
ডাক্তার বলেছিলেন, অনেকটা ওপরে উঠতে হবে, তুমি পারবে?
পারব?
জোর করে হেঁটো না। অসুবিধে হলেই থেমে যাবে। তোমার সঙ্গে কে থাকছে? আমি তো এখন নিরাময় ছেড়ে যেতে পারব না।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ এসেছে।
ওরা রওনা হয়েছিল। এতটা পথ অনেকদিন হাঁটেনি সায়ন? চড়াই ভাঙতে তার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। চার্চ ছুঁয়ে সমাধিস্থলে পৌঁছোল কফিন। সায়ন শুনল ফাদার প্রার্থনা শুরু করলেন। যার বাংলা করলে এমন দাঁড়াল– সুরক্ষা যিশুর কোলে/ তাঁর বক্ষ আশ্রয়স্থান। তাঁর প্রেমে হইয়া মগন তাঁয় বিশ্রাম তথায় প্রাণ। মাটি তার সন্তানকে কোলে পেল। যেমন পায়। হঠাৎ সায়নের শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল।
.
৩০.
মেয়েটির নাম সোমা। শিলিগুড়ি থেকে তার আত্মীয়স্বজন এসে পড়েছে খবর পেয়েই। মেয়েটির মা নেই। পিসি চলে গিয়েছে মেয়েটির ঘরে। তাকে এখন আর রক্ত দেওয়া হচ্ছে না, কাগজের মতো সাদা শরীরটা বিছানায় নেতিয়ে আছে।
ভিজিটার্স রুমে ওর বাবা এবং অন্য আত্মীয়রা গম্ভীর মুখে বসেছিলেন। সায়ন ঢুকে দেখল ডাক্তার আঙ্কল ওঁদের সঙ্গে কথা বলছেন। সে ইতস্তত করছিল কিন্তু ডাক্তার আঙ্কল তাকে দেখতে পেলেন, কিছু বলবে সায়ন?
সায়ন এগিয়ে গেল, সোমার জন্যে রক্তের ব্যবস্থা হয়েছে।
কী রকম?
বিষ্ণুপ্ৰসাদ অন্তত দশজনের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা রক্ত দিতে রাজি। নিশ্চয়ই ওদের কারও কারও রক্তের সঙ্গে সোমার ব্লাড গ্রুপ মিলে যাবে।
তারা কোথায়?
পাঁচজন এসেছে, খবর দিলে বাকিরাও আসবে।
ডাক্তার আঙ্কল বললেন, অনেক ধন্যবাদ। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর খেয়াল হতে বললেন, এই ছেলেটির নাম সায়ন রায়। কলকাতায় বাড়ি। আমার এখানে চিকিৎসার জন্যে এসেছিল। ওকে দেখে বুঝতেই পারছেন এখন কী রকম আছে। আমরা এখানে সবরকম চেষ্টা করি। কিন্তু কোনও কোনও ব্যাপারে মানুষ অসহায় এটা নিশ্চয়ই আপনারাও স্বীকার করবেন। আমি তো বলি, যদি সামর্থ্য থাকে তা হলে পেশেন্টকে আরও বড় জায়গায় নিয়ে যান। একটি প্রাণ যত বেশি দিন পৃথিবীতে থাকবে তত আমি খুশি হব।
কিন্তু এই যে রক্ত পাচ্ছেন, এসব কি পেশাদার ডোনার?
ডাক্তার আঙ্কল হাসলেন, না। পাহাড়ি মানুষরা লড়াইয়ের ময়দানে খুব সাহসী এবং বীর কিন্তু শরীর থেকে রক্ত বের করে তার বিনিময়ে টাকা পেতে অভ্যস্ত নয়। এরা রক্ত দেয় নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে বাঁচানোর জন্যে।
কিন্তু এদের রক্তে যদি অসুখ-বিসুখ থাকে—। আপনি কি পরীক্ষা করেন?
ডাক্তার আঙ্কলের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। অবশ্যই করা উচিত। আজকাল এইডস এইভাবেই সংক্রামিত হচ্ছে। আমিও চেষ্টা করি পরীক্ষা করার পর নিঃসন্দেহ হলে তবেই পেশেন্টের শরীরে রক্ত দিতে। কিন্তু বলুন তো, যেখানে প্রয়োজনটা জরুরি, পেশেন্টের শরীরে এখনই রক্ত না দিলে বিপদ হতে পারে, যেখানে পরীক্ষিত রক্ত আপনার হাতের কাছে নেই সেখানে আপনি কী করবেন? বলুন, উত্তর দিন?
এক ভদ্রলোক বললেন, সে রকম পরিস্থিতি যাতে না হয় তার জন্যেই তো ব্লাড ব্যাঙ্ক রয়েছে।
যেখানে ব্লড ব্যাঙ্ক নেই? অথবা যেসব লিউকোমিয়ার পেশেন্টকে ফ্রেশ রক্ত দিতে হয়, সেক্ষেত্রে? সেক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতেই হয়। খুব অল্প সময়ে যে পরীক্ষাগুলো করা সম্ভব তা নিশ্চয়ই করা যায়, কিন্তু আমার কাছে একজন পেশেন্টের প্রাণ বাঁচানো পরে অসুখ হবে কিনা ভাবার আগে অনেক জরুরি। আমাদের স্বভাব হল ক্রমাগত প্রশ্ন করে সমস্যাটাকে জটিল করে দেওয়া, তার সমাধানের পথ খুঁজতে সাহায্য না করা। আচ্ছা, আপনারা অপেক্ষা করুন। আমাকে যেতে হচ্ছে–।
এবার মেয়েটির বাবা বললেন, ডক্টর। আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে চাই!
নিয়ে যেতে চান? অসহায় লাগল ডাক্তার আঙ্কলের কণ্ঠস্বর।
হ্যাঁ। এখানে ওর দুবছর হয়ে গেল। মাঝে মাঝেই ওর বাড়াবাড়ির খবর পেয়ে ছুটে আসতে হয়। ও যে কখনও ভাল হবে না সেটা মেনে নিয়েছি আমি। শিলিগুড়িতে একজন বিখ্যাত হেমাটলজিস্ট এসেছেন। তাঁর চিকিৎসায় ও থাকলে চোখের সামনে থাকবে। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন!
পারছি। ডাক্তার আঙ্কল জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা এখনই ওকে নিয়ে যেতে চাইলে আমি অনুমতি দেব না। আপনার সন্তান, নিয়ে যেতে চাইছেন, আমার আপত্তি করার অধিকার নেই। ও একটু সুস্থ হলে নিয়ে যাবেন।
ডাক্তার আঙ্কল বেরিয়ে গেলেন।
সোমার বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এখানে কতদিন আছ?
সায়ন বলল, অনেকদিন।
তোমার কি সোমার মতোই–।
এখানে যারা আছে তাদের অল্পবিস্তর একই অসুখ। আচ্ছা চলি।
.
রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেল দুজনের রক্তের সঙ্গে সোমার ব্লাড গ্রুপের মিল আছে। তাদের রক্ত নেওয়া হল। লোক দুটো খুব ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু বেরিয়ে এসে হাসতে লাগল। একজন বিষ্ণুপ্ৰসাদকে বলল, দুর! এর চেয়ে অনেক বেশি রক্ত শরীর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল গুলি খেয়ে।
সায়ন জিজ্ঞাসা করল, গুলি খেয়ে!
বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলি খেয়েছিল ও। তখন ওর বয়স কুড়ি হয়নি।
মিসেস অ্যান্টনি ওদের ডাকলেন দুধ সন্দেশ এবং ফল খেতে।
ওরা দুজনেই মাথা নাড়তে লাগল।
মিসেস অ্যান্টনি বললেন, ডাক্তারবাবু তোমাদের খাওয়াচ্ছেন। এগুলো খেয়ে বিশ্রাম করে চলে যাও, শরীর ঠিক হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়জন বলল, কোনও দরকার নেই। শরীর আমাদের ঠিক আছে।
প্রথমজন হলুদ দাঁত বের করে ওকে সমর্থন করল। মিসেস অ্যান্টনি একটু জোর করলেন, অন্তত দুধ-সন্দেশ খাও।
না। আমরা রক্ত দিয়েছি এই দাদার জন্যে। কোনও কিছু খেলে মনে হবে দেওয়াটা ঠিক হল না। লোক দুটো সায়নকে নমস্কার করে চলে গেল।
মিসেস অ্যান্টনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারটা কী হল!
বিষ্ণুপ্ৰসাদ হাসল, এখানকার সবাই সায়নকে ভালবেসে ফেলেছে।
মিসেস অ্যান্টনি খুশি হলেও জিজ্ঞাসা করলেন, কেন?
সেদিন সামু গুরুং-এর সামনে দাঁড়িয়ে ও প্রতিবাদ করেছিল। এ কথা সবাই জেনে গিয়েছে। ওর অসুখ করেছিল তা সত্ত্বেও ও সাহস দেখিয়েছে বলে সবাই ওর প্রশংসা করছে।
বিষ্ণুপ্রসাদ সায়নের কাঁধে হাত রাখল।
সায়ন বলল, সেদিন যদি লোকটা আমাকে একটা ঘুষি মারত তা হলে মরে যেতাম।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, তা হলে পুলিশও সামুকে বাঁচাতে পারত না। পাবলিক ওকে ওখানেই শেষ করে দিত। ঠিক আছে, আমি চলি।
মিসেস অ্যান্টনি মাথা নাড়লেন।
ওরা দুজনে নিরাময় থেকে বেরিয়ে এল।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, কী ব্যাপার বলো তো? তুমি এখন এমনভাবে হাঁটাচলা করছ যে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না তোমার শরীরে অসুখ আছে।
সায়ন হাসল, আমি যতক্ষণ সেটা ফিল করছি না ততক্ষণ কেন স্বাভাবিক হব না? তুমি কোথায় যাচ্ছ এখন?
ঘুম।
কেন?
ওখানে আমার এক মাসি থাকে। ডেকে পাঠিয়েছে।
ঘুম খুব সুন্দর জায়গা, না?
খুব। বেশ ঠাণ্ডা। যাবে?
ডাক্তার আঙ্কলকে না বলে যেতে পারব না। সায়ন কথাটা বলে কান খাড়া করল। একটা অদ্ভুত করুণ কান্না কানে এল। ওটা আসছে ওপর থেকে। সে ইশারা করে ওপরের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
দূর থেকেই ওরা দেখতে পেল। মিস্টার ব্রাউনের বন্ধ লোহার গেটের পাশে দাঁড়িয়ে ভুটো মুখ ওপরে তুলে কেঁদে যাচ্ছে!
বাড়িটার সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ। সমাধির কাজ মিটে গেলে মিস্টার ব্রাউনের ছেলে যোশেফ বাড়িটাকে তালাবন্দী করে শিলিগুড়িতে নেমে গিয়েছে। ভুটোকে নিয়ে গিয়েছিল সিমি। নিশ্চয়ই কুকুরটা ওদের বাড়ি থেকে পালিয়ে এখানে চলে এসেছে। এখন এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই কোনও মানুষ মিস্টার ব্রাউনের জন্যে কাঁদছে না। বেচারা ভুটোর দুর্ভাগ্য ও মানুষ নয়।
সায়ন ডাকল, ভুটো?
ভুটো মুখ নামাল। তারপর অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ছুটে এল সায়নের কাছে। এসে ওর প্যান্টের প্রান্ত কামড়ে ধরে টানতে লাগল ওপরের দিকে। সায়ন একটু ভয় পেয়েছিল। বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, ও কী করতে চায় দ্যাখো না।
সায়ন এগোল। লোহার গেটের সামনে ভুটো টেনে নিয়ে গেল সায়নকে। তারপর একবার গেটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। আর একবার সায়নের কাছে ছুটে এসে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছিল। লোহার গেটটায় হুড়কো লাগানো। সায়ন সেটা খুলে দিতেই কুকুরটা চাতালে চলে গেল। এবার তার গলায় স্বাভাবিক ডাক ফিরে এল। তারপর ছুটে গেল বন্ধ দরজার কাছে। সেখানে এসে স্বাভাবিকভাবে ডাকতে ডাকতে ওর স্বর করুণ হয়ে গেল।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, কুকুরটা পাগল হয়ে যাবে।
সায়ন জিজ্ঞাসা করল, কী করা যায়!
বিষ্ণুপ্ৰসাদ মাথা নাড়ল। কিস্যু করার নেই।
সায়ন এগিয়ে গেল। ভুটোর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ওর মাথায় হাত রাখল, ভুটো, কাঁদিস না।
বলমাত্র ভুটো মুখ ফিরিয়ে তাকাল।
সায়ন উঠে দাঁড়াল, কাম অন ভুটো। আমাদের নিরাময়ে চল তুই।
সায়ন গেটের দিকে এগোতেই ভুটোকে দেখা গেল তাকে অনুসরণ করতে। ওরা রাস্তায় পা রাখল, ভুটো সায়নের পেছনে চলে এল।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, এটা কীরকম হল?
কেন?
মিস্টার ব্রাউন নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে বাংলায় কথা বলতেন না। তা হলে তোমার বাংলা কথা ও বুঝতে পারল কী করে?
সায়ন বলল, কথা বুঝতে পারেনি। ভালবাসা বুঝতে পেরেছে।
ওরা নামছিল। নীচ থেকে দুজন প্রৌঢ়া নেপালি মহিলা উঠে আসছিলেন। সায়নদের দেখে দুজনেই দাঁড়িয়ে গেলেন।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ নেপালিতে জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবেন?
সামান্য পাকা চুল যাঁর তিনি এগিয়ে এসে সায়নের হাত ধরলেন, আমি যিশুর কাছে প্রার্থনা করেছি তিনি তোমাকে অনেক বছর আয়ু দেবেন।
কেন?
তুমি আমাদের মনে বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছ।
কীভাবে?
সামু গুরুং-এর মতো গুণ্ডার সামনে তুমি যখন দাঁড়িয়েছিলে তখন ওর মুখে ভয়ের ছাপ ফুটেছিল। আমরা কেউ সাহস পাইনি। ওদের অত্যাচার আমরা সহ্য করতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু তোমাকে দেখে আমি বুঝলাম, প্রতিবাদ করা যায়।
আপনি একটু বেশি বলছেন মা। ডাক্তার তামাং সেদিন একাই ওদের মোকাবিলা করেছেন। উনি না থাকলে আমরা কিছুই করতে পারতাম না।
ডাক্তার তামাং খুব ভাল কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁকে সবাই চেনে। ওপরমহলে তাঁর প্রভাব আছে। সামুর সাহস হত না ওঁর গায়ে হাত দিতে। এটা উনি জানেন।
আপনি কোথায় থাকেন মা?
আমার বাড়িতে তুমি যাবে? প্রৌঢ়ার মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, এই রাস্তাটার দু নম্বর বাঁকের গায়ে আমার বাড়ি। আমার স্বামীর নাম ডেভিড গুরুং। যে কেউ বলে দেবে।
এরা যখন কথা বলছিল তখন আরও কিছু মানুষ যাতায়াতের পথে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সেখানে। সবাই সপ্রশংস চোখে সায়নকে দেখছে। সবার সঙ্গে ভালভাবে কথা বলার পর ওরা যখন সরে এল তখন বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, এই ভালবাসাটাকে কাজে লাগাও। প্রত্যেকটা মানুষ ভেতরে ভেতরে একা, অসহায়। কিন্তু সবাই যদি একত্রিত হয় তাহলে অনেক ভাল কাজ হতে পারে। আচ্ছা চলি।
বিষ্ণুপ্রসাদ চলে গেল ঘুম শহরে যাবে বলে।
সায়ন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আজ রোদ নেই। কুয়াশারা পাক খাচ্ছে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। মাথার ওপর ময়লাটে মেঘ। সে পাথরটার ওপর গিয়ে বসতেই ভুটো চলে এল পাশে। শান্ত হয়ে লেজ নাড়তে লাগল।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলে গেল ভালবাসাটাকে কাজে লাগাও। ভালবাসা কী করে কাজে লাগানো যায়? সেটা তো ভালবাসাকেই অপমান করা। যত ভাল কাজই হোক, কারও নরম অনুভূতির সুযোগ নেওয়া। আর কাজে লাগিয়ে সে কী করতে পারে? তার তো কোনও কিছু করার ক্ষমতা নেই।
ভুটো শব্দ করল। সায়ন মুখ ফিরিয়ে দেখল কঙ্কাবতী এগিয়ে আসছে নিরাময়ের গেট পেরিয়ে। ওর গায়ে একটা পাতলা চাদর। কঙ্কাবতীর কথা বেশ কিছুদিন মনে ছিল না তার। এই যে এত বড় গোলমাল হল তখনও কঙ্কাবতীকে দেখতে পায়নি সে।
সায়ন গলা তুলে বলল, কেমন আছ?
ভাল। জানলা থেকে দেখলাম তুমি বসে আছ।
সায়ন ওপরের দিকে তাকাল। কঙ্কাবতীর ঘরের জানলার কাঁচ ভেঙে গেছে। সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি এখনও ওই ঘরে আছ নাকি?
মাথা নেড়ে না বলল কঙ্কাবতী।
তাই বলো। ওখানে তো এখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকছে।
আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।
চলে যাচ্ছ মানে! তোমার তো এখান থেকে স্কুলে যাওয়ার কথা।
ছিল। কিন্তু যা হয়ে গেল তাতে আর ডাক্তারবাবুকে আমি সাহায্য করতে বলতে পারি না। মানুষটা আমাদের উপকার করতে এসেছিলেন অথচ আমরাই তাঁকে চরম অপমান করছি। এর চেয়ে লজ্জার কী হতে পারে!
ওটা একটা সাময়িক ব্যপার। হয়তো তোমার স্কুলে যাওয়ার কথা ডাক্তার আঙ্কলের মনে নেই। আসলে সোমা নামের মেয়েটার বাড়াবাড়ি ওঁকে খুব চিন্তায় ফেলেছিল। তুমি চলে যেতে চাইছ শুনলে উনি দুঃখ পাবেন।
না। আমাকে যেতেই হবে।
কেন?
আমার মা আর একা থাকতে পারছে না।
ও। সেদিন আমি মিস্টার ব্রাউনকে তোমার মায়ের চাকরির জন্যে বলেছিলাম। উনি রাজি হয়েছিলেন কথা বলার জন্যে। কিন্তু তার পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেসব নিশ্চয়ই শুনেছ?
আমাদের কপালে এর চেয়ে অন্য কিছু লেখা নেই।
তুমি বাড়িতে গিয়ে কী করবে?
কী করব জানি না। কিন্তু মায়ের পাশে থাকতে পারব।
সায়ন উঠে দাঁড়াল, কঙ্কাবতী, তুমি আমাকে দুটো দিন সময় দেবে?
কেন?
আমি চাই না তুমি এখান থেকে চলে যাও।
নে? কঙ্কাবতী আবার প্রশ্ন করল।
তুমি চলে গেলে আমরা সবাই হেরে যাব।
হেরে যাবে?
হ্যাঁ। আমি তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারব না।
বেশ। কঙ্কাবতী আর দাঁড়াল না। যেভাবে এসেছিল সেভাবে ফিরে গেল। এই সময় ম্যাথুজকে দেখা গেল বাজারের ব্যাগ নিয়ে উঠে আসতে। ভুটো তাকে দেখে দুবার ডাকল।
ম্যাথুজ বলল, কেমন আছ সায়ন? তোমার কথা একটু আগে হচ্ছিল।
কী রকম?
ম্যাডাম বলছিলেন তুমি খুব ভাল ছেলে। এই কুকুরটা দেখছি এখানে চলে এসেছে। কী করে ফিরিয়ে নেওয়া যায়? আমি এখন বাজারে যাচ্ছি।
ও এখানে থাকলেই মনে হচ্ছে ভাল থাকবে।
এখানে মানে? তোমার কাছে?
উত্তরটা দিতে গিয়ে আটকে গেল সায়ন। নিরাময়ে একটা কুকুরকে নিয়ে তোলা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারল না। ডাক্তার আঙ্কলের সঙ্গে কথা না বলে সে উত্তরটা দিতে পারে না।
সায়নকে চুপ করে ভাবতে দেখে ম্যাথুজ বলল, আমার মনে হয় ডাক্তার সাহেব রাজি হবেন না। ওকে কোনও ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে কিনা জানি না। যদি কাউকে কামড়ে দেয়।
কথাটা ঠিক। সায়ন বলল, ঠিক আছে, তুমি ওকে নিয়ে যাও। ও মিস্টার ব্রাউনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল।
কিন্তু মুশকিল হয়ে গেল। ভুটো কিছুতেই যেতে রাজি হল না। বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ম্যাথুজ বাজারে চলে গেল। সায়ন নিরাময়ে ঢুকল। ভুটো চলে এল পেছন পেছন। বড় বাহাদুর কুকুর ঢুকছে দেখে মুখে শব্দ করে তাড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু ভুটো তাতে বিচলিত হল না।
এই সময় ডাক্তার আঙ্কলকে গম্ভীরমুখে নেমে আসতে দেখল সায়ন। কুকুরটাকে দেখতে পেয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এ কী!
মিস্টার ব্রাউনের কুকুর। ভুটো। ও বাড়ির লোহার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। আমাকে দেখে চলে এল।
এখন কী করতে হবে?
ম্যাথুজ বাজারে গিয়েছে। ও এলিজাবেথের সঙ্গে কাজ করে। উপরে থাকে। যাওয়ার সময় ভুটোকে নিয়ে যাবে। ততক্ষণ–! সায়ন শেষ করল না।
ডাক্তার আঙ্কল হাসলেন, মানুষ যখন নিরাময় ছেড়ে চলে যাচ্ছে তখন অন্তত কুকুরটা থাক। অনেক বেশি বিশ্বস্ত।
একটা কথা বলব?
ইয়েস!
আমি একটু বাজারে যেতে পারি?
বাজারে? কেন?
একটু দরকার ছিল।
বাঃ, তুমি দেখছি বেশ সুস্থ হয়ে গেছ। ও কে।
মিসেস অ্যান্টনিকে কথা দিতে হল, সে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে লাঞ্চ খাবে। কোনওরকম পরিশ্রম করবে না। তেমন বুঝলে ফিরে আসবে।
নিরাময় থেকে বেরিয়ে ঢালু পথ দিয়ে হাঁটতে লাগল। রাস্তাটা সুন্দর। ঢালু বলে পরিশ্রম হচ্ছে না, শুধু হাঁটার সময় ব্যালান্স রাখতে হচ্ছে। সায়ন নেমে এল পিচের রাস্তায়। এক পাশ দিয়ে ট্রেন লাইন চলে গেছে দার্জিলিংয়ের দিকে, অন্য পাশে বিশাল খাদ, খাদের তলায় সরু নদী। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। সায়ন হাঁটতে লাগল। রাস্তাটা নেমে গিয়েছে বাজারের দিকে। তাই হাঁটতে ভাল লাগছিল।
মাঝে মাঝে গাড়ি যাচ্ছে, দু একজন মানুষ ছাড়া রাস্তাটাকে নির্জনই বলা যায়! কতদিন বাদে সে এইভাবে হেঁটে চলেছে। বাঁক ঘোরার আগেই জলের শব্দ পেল সায়ন। বেশ জোরে জল পড়ছে। বাঁক ঘুরতেই ঝোরাটাকে দেখতে পেল। বাঁ দিকের পাহাড় থেকে জল পড়ছে নীচের পাথরে। নেমে যাচ্ছে খাদের দিকে। খুব শীতল জায়গাটা। সে মুখ ফেরাল। খানিকটা উঁচুতে মেরির মূর্তি স্মিতমুখে দাঁড়িয়ে। ওই মূর্তির কাছে সে অসুস্থ অবস্থায় উঠেছিল। সেদিন মা ছিল নীচে। গাড়ির ভিড় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ওরা তার মধ্যে ঠিক কী দেখেছিল সায়নের জানা নেই। সেই একই জিনিস কি মৃত্যুর আগে মিস্টার ব্রাউন দেখে গিয়েছেন? কী আছে তার মধ্যে যা সে নিজেই জানে না।
ট্যুরিস্ট লজের পাশ দিয়ে সে যখন বাজারের কাছে চলে এসেছে তখন একজন বৃদ্ধ তাকে দেখে চিৎকার করে ছুটে এল। এসে তার হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে এত দ্রুত কথা বলে যেতে লাগল যে তার নেপালির অনেকটা সায়ন বুঝতে পারছিল না। লোকটাকে দেখে অনেকেই এসে ভিড় জমাল তাকে ঘিরে।
এর মধ্যে একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি খ্রিস্টান?
মাথা নাড়ল সায়ন, না।
তা হলে তুমি যিশুকে, মেরিকে দেখতে পাও কী করে?
কে বলল, আমি তাঁদের দেখতে পাই?
আমরা সবাই জেনে গেছি। নইলে তোমার মতো এত রোগা মানুষ যে চিকিৎসার জন্যে এখানে এসেছে সে কোন সাহসে সামু গুরুংয়ের মোকাবিলা করতে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। লোকটা প্রশ্ন করল।
সায়ন বলল, একটা চড়াই পাখিও একসময় মরিয়া হয়, হয় না?
মরিয়া হয়ে একটা বাজপাখির সামনে দাঁড়িয়ে কী করবে?
বাজপাখিটা থমকাবে। দুবার ভাববে।
তারপর?
সেইসময় সব চড়াই যদি একসঙ্গে মরিয়া হয়ে ওঠে তখন বাজপাখিটা ঠিক পালিয়ে যাবে। আমি তাই চেয়েছিলাম। সায়ন হাসল, আমি ডাক্তার তামাং-এর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। কোথায় পাব তাঁকে?
ডাক্তার তামাং এখন আর চেম্বারে আসছেন না।
কেন?
জানি না। চেম্বারের দরজা বন্ধ। শুনেছি বাড়িতেই আছেন কিন্তু কোনও পেশেন্ট দেখছেন না।
ওঁর বাড়িটা কোথায়?
ওরা ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। সায়ন দেখল ভিড়টা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। লোকজন তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করেই সঙ্গ নিচ্ছে।
ডাক্তার তামাংয়ের বাড়িটা বাজার থেকে একটু ওপরে। একেবারে সাদামাটা বাড়ি। লোকটা বলল, ওই দরজা।
সায়ন বলল, এত লোক এখানে—!
সবাই আপনাকে দেখতে চায়।
কেন?
ওই যে বললাম, সবাই আপনার কথা শুনেছে।
ওঁদের একটু বুঝিয়ে বলুন। আমি কেউ নই, একেবারে সাধারণ মানুষ। ওঁরা যে যাঁর কাজে যেন চলে যান।
লোকটা চিৎকার করে নীচে জনতার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল। তাতে কোনও কাজ হল না।
অগত্যা সায়ন সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে বেলের বোতাম টিপল। তিনবারের মাথায় দরজা খুললেন ডাক্তার তামাং। তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি খুব নেশা করেছেন। বিরক্ত হয়ে কথা বলতে গিয়ে সায়ন এবং নীচের জনতাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার! তুমি এখানে এসেছ?
আপার সঙ্গে বিশেষ দরকার আছে ডক্টর,সায়ন বলল।
কাম ইনসাইড, ইউ অ্যালোন।
সায়ন ভেতরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিলেন ডাক্তার তামাং, তুমি ওই পাহাড় থেকে কীভাবে এখানে এসেছ?
কেন? হেঁটে। বেশি দূর তো নয়।
ইউ কান্ট ডু ইট। ডাক্তার তোমাকে এভাবে হেঁটে আসতে অ্যালাউ করল?
এটা কোনও সমস্যা নয় ডক্টর তামাং। গম্ভীর মুখে বলল সায়ন।
আচ্ছা! টলোমলো পায়ে ভেতরের ঘরে চলে গেলেন ডাক্তার তামাং। সায়ন অনুসরণ করল। এ বাড়িতে আর কোনও মানুষ আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে করতে ডাক্তার তামাং গ্লাসে মদ ঢাললেন। মিস্টার ব্রাউন যে ধরনের দিশি মদ খেতেন এটা সে শ্রেণীর নয়। বোতলটির চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ দামি।
হোয়াট ইজ ইওর প্রব্লেম?
সায়ন লক্ষ করছিল আজ ডাক্তার তামাং বেশি ইংরেজি বলছেন। সে বলল, এখন আপনার সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ হবে?
হোয়াই নট? আমাকে ড্রাঙ্ক মনে হচ্ছে? গ্লাস মুখে তুললেন তিনি।
আপনি স্বাভাবিক নন।
ঠিক। বিলকুল ঠিক। আমি রোজ মদ খেয়েছি কিন্তু নেশাকে বাড়তে দিইনি। এখন দিচ্ছি। মাঝে মাঝে স্বাধীনতা দেওয়া উচিত।
আপনি চেম্বারে যাচ্ছেন না?
আমার ইচ্ছে তাই যাচ্ছি না। কাউকে জবাবদিহি দেব না। এই শহরে অনেক ডাক্তার আছে, আমি একা নই।
আপনার কী হয়েছে, ডক্টর তামাং?
আমি নিজেকে আর মানুষ বলে মনে করছি না। আমার চারপাশে যাদের এতকাল মানুষ বলে চিকিৎসা করে এসেছি তারা কেউ মানুষ নয়। সব অমানুষ। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি এখন তাই মনে করছি।
তা হলে তো আপনার সঙ্গে কথা বলা যায় না।
যায় না? বোলো না। ও হো, তুমি তো যিশুর আশীর্বাদধন্য। অ্যাঁ। মিস্টার ব্রাউন পর্যন্ত সেই বিশ্বাস নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। অবশ্য তুমি বলেছ এসব কিছু জানো না। কী জানি। আমি ওইসব বুজরুকি বিশ্বাস করি না। মেয়েটা কেমন আছে?
সায়ন অনুমান করল ডাক্তার তামাং সোমার কথা বলছেন। সে জবাব দিল, একটু ভাল, তবে বিপদ কাটেনি। কিন্তু ওর বাবা ওকে বলেছেন ওকে শিলিগুড়িতে নিয়ে যাবেন।
কেন? চোখ বড় করলেন ডাক্তার তামাং।
ওরঁ বিশ্বাস সোমা সারবে না।
টলতে টলতে এগিয়ে এলেন ডাক্তার তামাং, দ্যাখো, আমি ঠিক বলিনি? আমাদের চারপাশে কীরকম অমানুষের ভিড়। একটা মানুষ সব কিছু ত্যাগ করে লিউকেমিয়া রোগের সঙ্গে লড়াই করতে চাইলেন আর আমরা তার অস্ত্রগুলো একের পর এক কেড়ে নিচ্ছি।
আপনি এই কথা বলছেন?
ইয়েস। আমি একসময় ওঁর বিরুদ্ধে কথা বলেছি। ডাক্তার হিসেবে উনি বড় কি না জানি না মানুষ হিসেবে আমার চেয়ে অনেক বড় এ কথা মেনে নিতে মন চায়নি। তাই–! চোখ বন্ধ করলেন ডাক্তার তামাং, তুমি কোন দরকারে আমার কাছে এসেছিলে?
আপনি কঙ্কাবতীকে চেনেন?
কে কঙ্কাবতী?
যে নেপালি মেয়েটিকে আপনার কথায় ডাক্তার আঙ্কল নিরাময়ে চিকিৎসা করছেন তার নাম কঙ্কাবতী।
ওহো। হ্যাঁ। ওকে তো আমিই পাঠিয়েছিলাম। সে কেমন আছে?
ওর শরীর এখন আগের থেকে ভাল। কিন্তু ওর মায়ের চাকরি গিয়েছে। বেচারা একটা স্কুলে আয়ার কাজ করত। কিন্তু পার্টির এক নেতার হুকুম মানতে পারেনি বলে ওর চাকরি গিয়েছে। এখন কোনও রোজগার নেই। তাই কঙ্কাবতী চাইছে মায়ের কাছে ফিরে যেতে।
মায়ের কাছে ফিরে গেলে তার মায়ের রোজগার বেড়ে যাবে?
না। কিন্তু তার মা নাকি একা থাকতে ভয় পাচ্ছে।
কেন?
আমি জানি না।
অ। আমাকে কী করতে হবে?
আমি সেদিন মিস্টার ব্রাউনকে বলেছিলাম কঙ্কাবতীর মায়ের জন্যে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। উনি রাজি হয়েছিলেন–!
চাকরি? আমি চাকরি কোথায় পাব?
আমার মনে হয়েছিল আপনি পারবেন।
মনে হয়েছিল?
চোখ বন্ধ করলেন ডাক্তার তামাং, তোমার এ কথা কেন মনে হয়নি এখানকার পার্টির নেতাদের অমান্য করে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না!
আমি এ কথা বিশ্বাস করি না।
করো না?
যারা অন্যায় করে তাদের মানুষ বেশিদিন মেনে নেয় না। একটা সময় আসবেই যখন অন্যায়কারী হাত গুটিয়ে নেবে। সাধারণ মানুষ তাদের বাধ্য করবে সেটা গোটাতে। সায়ন দৃঢ় গলায় বলল।
ডাক্তার তামাং অবাক হয়ে বললেন, তাই তুমি এত লোককে সঙ্গে নিয়ে এসেছ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে?
আমি কাউকে সঙ্গে নিয়ে আসিনি। আমার সম্পর্কে যেসব ভুল গল্প এখানে প্রচারিত হয়েছে ওরা সেসব শুনে এসেছে।
আমি কী করে চাকরি দেব সায়ন?
আপনার সঙ্গে চেয়ারম্যানের পরিচয় আছে, তাই না? হ্যাঁ আছে। তাঁকে বললে হয় না? এত সামান্য বিষয় নিয়ে তাঁকে বিরক্ত করা যায় না।
আপনি তো সামু গুরুংয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ওঁর কাছে যেতে পারেন? তাই না? সায়ন বলল।
ওয়েল, ভেবে দেখি।
আপনি আবার প্র্যাকটিস শুরু করুন।
কেন?
এতে মানুষের উপকার হবে।
তাতে আমার কী লাভ? ওই মানুষগুলোই তো সামুদের কথায় উত্তেজিত হয়ে নিরাময়ের কাঁচ ভাঙবে। তাই না?
আবার আপনার কথা শুনে তারাই সামুদের গাড়ি ভাঙবে।
অবাক হয়ে তাকালেন ডাক্তার তামাং। তারপর চেয়ারে বসে পড়লেন, টেল হার টু সি মি টুমরো মর্নিং।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
তুমি এখন কোথায় যাবে?
নিরাময়ে ফিরে যাব।
যাবে কী করে?
হেঁটে।
ওই জনতাকে সঙ্গে নিয়ে? পাগল।
কিন্তু আমার আর দেরি করা ঠিক নয়।
উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার তামাং, ফলো মি।
ভেতরের ঘরের দিকে যেতে গিয়ে দুবার ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে যেতে সামলে নিলেন ডাক্তার তামাং। সায়ন দেখল বাড়িতে আর কেউ নেই। পেছনের ঘরের দরজা খুলে নীচে নামতে ডাক্তার তামাংয়ের গাড়িটা দেখা গেল। হেসে বললেন, গোলমালের দিন গাড়ি নিয়ে যাইনি বলে এ ব্যাটা বেঁচে গেছে। উঠে পড়ো।
আপনি চালাবেন?
তুমি কি চালাতে জানো?
কিন্তু এই অবস্থায় আপনি চালাবেন কী করে?
ভূমিকম্পের সময় প্রাণীরা যেভাবে দৌড়ে যায়, উঠে পড়ো। ওরা উঠল। জনতা এদিকে নেই। কেউ ভাবেওনি পেছনের পথ দিয়ে ওরা বেরিয়ে যেতে পারে। পাহাড়ের বাড়িগুলোর সামনে পেছনে অনেক ক্ষেত্রে রাস্তা থাকে। ইঞ্জিন চালু হল। ফার্স্ট গিয়ার দিয়ে গাড়ি বের করতে গিয়ে একটা ড্রামের সঙ্গে অকারণ ধাক্কা লাগল। ডাক্তার তামাংয়ের হাত কাঁপছে। ওই অবস্থায় বেশ জোরেই রাস্তায় উঠে এলেন গাড়ি নিয়ে।
তীব্র শব্দে হর্ন বাজাচ্ছেন, গতিও বেশ। রাস্তার এপাশ ওপাশ ছুঁয়ে গাড়ি চলছে। মানুষজন ভয় পেয়ে সরে যাচ্ছে। সায়ন চিৎকার করল, একটু আস্তে চালান ডাক্তার তামাং।
ভয় পাচ্ছ?
হ্যাঁ।
বেশ। হঠাৎ গতি কমে গেল। শান্ত হয়ে গাড়ি উঠতে লাগল ওপরে। কে বলবে একটু আগে ওরকম টালমাটাল ছুটছিল। ডাক্তার তামাং বললেন, এখন পোষ মেনে গেছে। মাতালের হাতে স্টিয়ারিং সেট হয়ে গেলে আর কোনও ভয় নেই।
মেরির মূর্তির পাশ দিয়ে গাড়ি উঠে আসছিল। ডাক্তার তামাং বললেন, এই রাস্তায় নেমে যাওয়া সোজা কিন্তু হেঁটে উঠলে তোমার খুব কষ্ট হত। বুঝলে?
বুঝতে পারছিল সায়ন।
আচ্ছা, তুমি হঠাৎ কঙ্কাবতীর মায়ের জন্যে আমাকে বলতে এত দূরে গেলে কেন? তোমার কী ইন্টারেস্ট?
মেয়েটার আর পড়াশুনা হবে না ও যদি চলে যায়।
আর?
চিকিৎসাও হবে না।
বড় রাস্তা ছেড়ে ওপরে উঠতেই দেখা গেল একটা ট্যাক্সি রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার তামাং হর্ন বাজালেন। ড্রাইভার হাত দেখাল। নেপালিতে বলল, একজন প্যাসেঞ্জার নিরাময়ে যাবে, দয়া করে নিয়ে যাবেন? আমার ইঞ্জিন গোলমাল করছে।
আসতে বলল।
ট্যাক্সির ভেতর থেকে যে বের হল তাকে দেখে সায়ন অবাক। সে চিৎকার করে উঠল, আরে সদুদা? তুমি?
ব্যাগ হাতে সদানন্দ হাসল, আরে! তুই ভাল আছিস?
খারাপ থাকব কেন?
গুড। আমি তোকে নিয়ে যেতে এসেছি। কাকিমা অনেক করে বললেন। গাড়িতে উঠে পড়ল সদানন্দ। তারপর বলল, আমাদের পরিদের বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। নতুন বাড়ি বানাচ্ছে প্রমোটার। জানিস তো?