শিয়ালদা স্টেশনে ট্যাক্সি
শিয়ালদা স্টেশনে ট্যাক্সির লাইনে দাঁড়িয়ে ঊর্মিলা বলল, উঃ, আবার সেই কলকাতা। নন্দিনী এখন অনেকটা স্বাভাবিক। পাহাড় থেকে নামার আগে কমলেন্দুকে দিয়ে এস টি ডি করিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কলকাতার লাইন পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত টেলিগ্রাম করা হয়েছিল। কবে কোন ট্রেনে ওঁরা ফিরছেন তাতে জানানো হয়েছিল। স্বভাবতই তিনি আশা করেছিলেন স্টেশনে স্বামী আসবেন। না দেখতে পেয়ে কমলেন্দু অবশ্য বলেছিল, আমরা পৌঁছোবার পরে টেলিগ্রাম আসবে দেখো। ওসব আজকাল গোরুর গাড়ির চেয়ে আস্তে চলে।
কথাটা ঠিকই বলে মনে হল নন্দিনীর। নইলে টেলিগ্রাম পেয়েও ভদ্রলোক সকাল নটায় বিছানা ছাড়বেন না? একেই তো ট্রেন লেট করেছে। নন্দিনীর মনে পড়ল সায়ন বলেছিল সে জানে তার বাবা ওকে দেখতে যাবে না। এই ছেলেটা যে কখন বড় হয়ে গেল কে জানে। স্বামী সম্পর্কে তার যাবতীয় অভিমান তিনি কখনও কাউকে মুখ ফুটে বলেননি। ছেলেটা এত তাড়াতাড়ি বুঝে গেল কী করে?
ট্যাক্সি পেয়েও শান্তি নেই। ফ্লাইওভার থেকে নামতেই জ্যামে আটকে গেল সেটা। এখন কলকাতায় বেশ গরম। কয়েক দিন ঠাণ্ডায় কাটিয়ে গরমটা অসহ্য লাগছিল। ঊর্মিলা আবার বলল, লোকে যে কী আনন্দে কলকাতায় থাকে! উঃ।
কমলেন্দু স্ত্রীর দিকে তাকাল, থাকতে বাধ্য হয়। পেট তো কাব্য বোঝে না।
পাহাড়ে যারা থাকে তারা কাব্য করে বুঝি? আসলে মানুষের স্বভাব হল যেখানে ভিড় সেখানেই জমে যাওয়া। ভারতবর্ষে কত ফাঁকা জায়গা আছে, সেখানে গেলে এখনও আরামে থাকা যায়, কেরানিগিরি না করে ছোটখাটো ব্যবসা করেও রোজগার করা যায় সেটা ভাববে না কেউ। গজ গজ করছিল ঊর্মিলা।
কয়েকদিন ফাঁকায় থেকে এখন রাস্তায় ভিড় দেখে কমলেন্দুরও অস্বস্তি হচ্ছিল। অবশ্য চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই এই অস্বস্তি কেটে যাবে। ঊর্মিলা যা বলল তার অনেকটাই ঠিক। এখন মানুষ কত অভিনব উপায়ে রোজগার করে। এবারই দার্জিলিং-এ বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটা বুথ দেখে এল ওরা। চারটে নেপালি ছেলে মিলে করেছে। ট্যুরিস্টদের হোটেলে জায়গা পেতে সাহায্য করে ওরা। কম টাকা ভাল হোটেল। টেলিফোনে বুক করে ট্যুরিস্টদের নম্বর দিয়ে দেয়। জিজ্ঞাসা করে জেনেছে ওই চারটে ছেলের দৈনিক রোজগার দু হাজার টাকার নীচে নয়। চারটে বাঙালি ছেলে ওই ব্যবসা করতে এগিয়ে যায়নি। তারা সদাগরি অফিসে দেড়-দু হাজারের চাকরি পেলেই বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে।
গেট পেরিয়ে বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থামতেই অবাক হয়ে গেল ওরা। যা একদা উদ্যান ছিল, সম্প্রতি ন্যাড়া মাঠ, সেটা খাঁ খাঁ করছে। শ্বেতপাথরের সুন্দরীরা উধাও। জন্ম ইস্তক যাদের দেখে অভ্যস্ত তাদের অনুপস্থিতি চোখে লাগছে খুব।
পাঁড়েজি এগিয়ে এল থপ থপ করে, নামানো সুটকেস তুলতে হাত বাড়াল।
কমলেন্দু বাধা দিল, থাক। তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। এর মধ্যে মূর্তিগুলো বিক্রি হয়ে গেল!
পাঁড়েজি মাথা নামাল। উত্তর দিল না। তার পর দুটো স্যুটকেস দু হাতে নিয়ে টলতে টলতে ভেতরের দিকে এগোল। মেয়েরা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলে কমলেন্দু দেখল ন’বাবু আসছেন।
কাছে এসে ন’বাবু বললেন, কী! ঘুরে আসা হল?
হ্যাঁ।
ওয়েদার কী রকম? ঠাণ্ডা এখনও পড়ে ওখানে?
তা তো পড়বেই।
কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
না।
এই যে শুনি বাঙালি দেখলেই নেপালিরা ক্ষেপে যায়, মারধর করে, সেসব কিছু হয়নি তোমাদের বেলায়? সত্যি বাঙালির হাল দ্যাখো। অসম থেকে তাড়িয়েছে, বিহার থেকে উৎখাত করেছে এখন দার্জিলিং থেকেও বিতাড়িত। অথচ গবমেন্ট কোনও স্টেপই নিচ্ছে না। ন’বাবু মাথা নাড়লেন।
আপনি কি এর মধ্যে দার্জিলিং-এ গিয়েছিলেন?
অ্যাঁ? না না। কেন বলো তো?
তা হলে আপনি ভুল শুনেছেন। বাঙালিদের ওপর নেপালিদের কোনও রাগ নেই, অত্যাচারও করে না। এসব যারা বলছে তারা অপপ্রচার করছে। নইলে প্রতি বছর এত হাজার হাজার ট্যুরিস্ট ওখানে যেত না। ওদের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনও সম্পর্ক নেই। তারা আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মতোই আচরণ করেছেন। কমলেন্দু বলল।
এ যে নতুন খবর দিলে হে।
কিন্তু এত তাড়াতাড়ি পরীগুলো বিক্রি করে দিলেন?
বিক্রি যখন করতেই হবে তখন দেরি করে লাভ কী। দাম মন্দ পাওয়া যায়নি। চেক দিতে চেয়েছিল, আমি রাজি হইনি। এতগুলো শরিক, কার নামে চেক নেব। ক্যাশেই হয়ে গেল। বড় মায়ের কাছে টাকাটা রেখে দেওয়া হয়েছে। এখন আমি পড়েছি মুশকিলে। ন’বাবু গলা নামালেন।
কমলেন্দু তাকাল।
আমি ভেবেছিলাম বাড়িটার যা হাল হয়েছে পরী বিক্রি করে সেই টাকায় ভাল করে সারিয়ে নেওয়া যাবে। এখন টাকাটা আসামাত্র কেউ কেউ ভাবছে এত পুরনো বাড়িতে হাত দিয়ে কী হবে। তার চেয়ে জমিজমা সমেত বাড়িটা বিক্রি করে দিলে আরও বেশি লাভ। ন’বাবু ফিস ফিস করে বললেন।
কারা এটা চাইছেন?
কাকে ছেড়ে কার কথা বলব! আমি এটা চাইছি না। হাজার হোক বাপ-পিতামহের এই বাড়ি, বংশের ঐতিহ্য, এসবের কোনও দাম নেই? প্রমোটারদের পায়ে সেসব বিসর্জন দিলে পূর্বপুরুষদের আত্মা শান্তি পাবে? বলো?
সেটা আমি বলতে পারছি না।
মানে?
আত্মীয়রা ঠিক কী চাইছেন তা তো জানার কোনও উপায় নেই।
অ। ন’বাবু চোখ ছোট করে দেখলেন কমলেন্দু ভেতরে ঢুকে গেল।
.
দরজা খুলেছিল কাজের মেয়ে। পাঁড়েজি স্যুটকেস নামিয়ে চলে যেতে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন নন্দিনী, বাবু বাড়িতে নেই?
না। তোমার টেলিগ্রাম পেয়ে স্টেশনে চলে গিয়েছেন।
টেশনে?
হ্যাঁ। ওই তো টেবিলের ওপর টেলিগ্রাম পড়ে আছে।
কখন বেরিয়েছেন উনি?
সেই সকালবেলায়।
নন্দিনী অবাক হলেন। স্টেশনে গেল অথচ দেখা হল না কেন? ট্যাক্সি ধরতে অনেকক্ষণ ওঁরা বাইরে অপেক্ষা করেছিলেন।
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বাবুর শরীর ভাল আছে?
হ্যাঁ। সানু কেমন আছে?
ভাল।
সেরে গেছে?
উত্তরটা দিতে হল না কারণ দরজায় হেনা। নন্দিনী তাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে কী ব্যাপার?
আমি ক্ষমা চাইতে এলাম।
তা তো হল, বাপের বাড়ি থেকে স্টেশনে যাওয়ার কথা ছিল, আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা করেছিলাম। নন্দিনী বললেন।
আমি হেরে গেলাম। কিছুতেই পারলাম না।
কেন? কী হয়েছিল?
এখান থেকে তোমাদের সঙ্গে স্টেশনে গেলে সমস্যা হতে পারে ভেবে বাপের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। আমি বুঝতে পারিনি সময়বিশেষে বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি এক হয়ে যায়। মা যেই জানল আমি শাশুড়ির অমতে দার্জিলিং-এ তোমাদের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছি অমনি বেঁকে বসল। বলল, জামাই বাইরে গিয়েছে, সে থাকলে এক কথা ছিল, এই অবস্থায় নাকি আমার কিছুতেই যাওয়া উচিত নয়, আমি অনেক তর্ক করেছি কিন্তু বাবা বললেন তিনি কোনও দায়িত্ব নিতে চান না। মায়ের অমতে বাড়ির বউ বাইরে গেল বলে ছেলে ফিরে এসে যদি সম্পর্ক ত্যাগ করে তা হলে তার দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে। হেনার মুখ থমথমে।
তার মানে?
এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে ও বাড়িতেও আমার জায়গা হবে না।
তোমার বাবা বললেন এ কথা?
হ্যাঁ। মাথা নাড়ল হেনা, তার মতে অপরাধ আমার। আমি নাকি মানিয়ে চলতে শিখিনি। সেইদিন তোমরা যখন স্টেশনে তখন আমি এ বাড়িতে ফিরে এলাম। মুখে যত বিপ্লবের কথা বলি না কেন রাস্তায় একা নামার ক্ষমতা যে আমার নেই তা হাড়ে-হাড়ে বুঝে গেলাম।
তোমার তিনি এসে গেছেন?
হ্যাঁ। তাকে বললাম সব। সে বলল কমলেন্দুর সঙ্গে তুমি গেলে চারপাশের লোক কুকথা বলত। আমি বললাম কমলেন্দু তার বউকে নিয়ে গেছে। সানুর মা আছেন সঙ্গে। তাতেও সন্দেহ করতে তোমরা? মাথা নাড়ল হেনা, সে বলল, তোমার দার্জিলিং যাওয়া নিয়ে তো কথা, ঠিক আছে পরে একসময় আমিই ঘুরিয়ে আনব। আচ্ছা, যেসব পুরুষ স্ত্রীর কথা শুনে চলে তাদের স্ত্রৈণ বলা হয় কিন্তু যারা সাবালক হওয়ার পর মায়ের সমস্ত অযৌক্তিক ব্যবহার মুখ বুজে মেনে নেয় তাদের কী বলে?
নন্দিনী হেসে ফেললেন, আমি জানি না।
হাসি তো পাবেই। কিন্তু আমি তো হাসতে পারছি না। শাশুড়ি প্রায়ই বলেন আমি নাকি ডাইনি, শরীর দিয়ে তার ছেলেকে বশ করতে চাই। ওনারও যখন শরীর ছিল তখন কখনওই সেই চেষ্টা করেননি। আমি বলতে পারি না, শ্বশুরমশাই যে ওঁর কথায় ওঠেন বসেন তা নিশ্চয়ই বুড়ো বয়সে পৌঁছে হয়নি। থাকগে, কেমন বেড়ানো হল তোমাদের?
ভালই। সানু এখন অনেক ভাল আছে। তোমার কথা বলল।
তুমি ওকে বলোনি তো যাওয়ার কথা ছিল তবু যাইনি।
বলেছি কি? চোখ বন্ধ করলেন নন্দিনী, বোধহয় বলিনি।
ডাক্তারের সঙ্গে আলাদা কথা হয়েছে?
হ্যাঁ। উনি ওকে ছোটখাটো কাজে লাগাবেন বলেছেন। এই তো, সামনের শীতে এখানে কিছুদিন থেকে যাবে সানু।
বাঃ খুব ভাল হবে। হেনা বলল, তুমি কতটা রাস্তা এসেছ আর ঢোকামাত্র আমি তোমাকে আটকে রেখেছি। চলি।
আরে, আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। নন্দিনী দেখলেন কাজের মেয়েটি দু কাপ চা নিয়ে এল।
নন্দিনী বললেন, এখনও বাইরের জামাকাপড় ছাড়িনি, বাথরুমে যাইনি, এখনই চা করে ফেললি? জিজ্ঞাসা করবি তো? আচ্ছা, দে, নাও, চা এসেছে যখন তখন ওটা খেয়ে যাও।
চায়ে চুমুক দিয়ে হেনা জিজ্ঞাসা করল, দেখেছ?
কী?
পাথরের পরীরা উধাও হয়ে গেছে, চোখে পড়েনি?
হ্যাঁ। কীরকম ফাঁকা হয়ে গেছে জায়গাটা।
কথা ছিল ওই টাকায় বাড়ি সারানো হবে। এখন শুনছি সেটা হচ্ছে না। আজ মিটিং হবে। হেনা কথা শেষ করা মাত্র দরজায় শব্দ হল। হেনা তাড়াতাড়ি বলল, আমি চলি।
নন্দিনী দেখল হেনার চা পড়ে আছে। সে আর তাকে ডাকল না। সায়নের বাবা বললেন, এসে গেছ। আমি আজ কী বোকামি করেছি।
নন্দিনী তাকালেন।
আমি ভেবেছিলাম তিস্তাতোর্সা হাওড়ায় আসে। সাতসকালে সেখানে গিয়ে বসে রইলাম। তারপর জানতে পারলাম ওটা শেয়ালদায় আসে। কী কাণ্ড! তবু শেয়ালদায় গেলাম। কিন্তু ট্রেন অনেকক্ষণ আগে পৌঁছে গিয়েছিল।
অনেক পরিশ্রম হল তোমার।
তুমি ঠাট্টা করছ?
ঠাট্টা? সে-অধিকার আমার আছে?
সায়নের বাবা চেয়ারে বসলেন, ছেলের অবস্থা কী?
ভালই।
আরে কীরকম ভাল তা বলবে তো?
এই অসুখে কীরকম ভাল থাকা যায় তা তো তোমার জানা।
তুমি রোজ দেখা করতে?
আচ্ছা, যাকে দেখব বলে অত দূরে গেলাম তার সঙ্গে রোজ দেখা করব না এমন ভাবনা তোমার মাথায় এল কী করে?
তুমি খুব রেগে আছ দেখছি। ও, আমি যাইনি, তাই?
তার জন্য রাগব এত বোকা আর আমি নই। হ্যাঁ, এখনও আমি যে আশা করি তুমি তোমার কথা রাখবে সেটা আশা করতে ভাল লাগে বলেই করি। কিন্তু তোমার ছেলে তোমাকে আমার চেয়ে ভাল চিনে নিয়েছে। সে বলেছে বাবা আসতেই পারে না। নন্দিনী শীতল গলায় বললেন।
সানু এ কথা বলেছে?
সত্যি কথাটা শুনতে তোমার খারাপ লাগছে, জানি।
আমি কী করব? যাকে একটা সাপ্লাই-এর দায়িত্ব দিয়েছিলাম সে ইদানীং দুনম্বরি কারবার আরম্ভ করেছে। আমি যদি চলে যেতাম তাহলে ওই পার্টি হাতছাড়া হয়ে যেত। আমার কমিশনের ওপর রোজগার।
তাই বোধহয় তোমার ছেলে এর মধ্যে ভাবতে শুরু করেছে তার অসুখের জন্যে তোমার জলের মতো টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। এটা ওর খুব খারাপ লাগছে। বোঝো, ওইটুকুনি ছেলেও কত বুঝদার হয়েছে।
আশ্চর্য! তুমি ওকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে নিষেধ করনি?
আমি যা করার করেছি। দ্যাখো তো, চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে নাকি?
কার চা?
হেনাকে দিয়েছিলাম। তোমাকে দেখে পালাল। নিজের কাপে চুমুক দিলেন নন্দিনী। না, এখনও ঠাণ্ডা হয়নি।
স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে চা খেয়েছি। এখন ভাল লাগছে না। থাকগে, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে সানুর এখনই কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই। আরে, এই বাড়ি যদি বিক্রি হয়ে যায় তাহলে আমি যে শেয়ার পাব তাতে সানুর চিকিৎসা নিয়ে ভাবতে হবে না।
এই বাড়ি বিক্রি হবে?
মূর্তিগুলো তো হয়ে গেছে, দেখেছ। ভালই পাওয়া গিয়েছে। টাকাগুলো আছে বড়মায়ের কাছে। মেরামত করতে সব বেরিয়ে যাবে। অথচ প্রত্যেকের ফ্যামিলি বড় হয়েছে। জায়গা কুলোচ্ছে না। বাড়ি সারিয়ে সেই সমস্যার সমাধান হবে না। অনেকেই চাইছে বাড়ি প্রমোটারকে দিয়ে দিতে।
প্রমোটার কে?
ওই যারা বাড়ি বানিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রি করে। এই আনপ্ল্যানড জীর্ণ বাড়ির তো কোনও দাম নেই। ইট আর কাঠ বিক্রি করলে কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু এতটা জমি, এর দাম তো অনেক। বাড়ি আর বাড়ির সামনের বাগান মিলিয়ে প্রায় তিন বিঘে। দু লাখ টাকার নীচে কাঠা যাচ্ছে না। দশজন শরিককে এক একটা তিনরুমের ফ্ল্যাট প্লাস পাঁচ লাখ টাকা মাথা পিছু দিতে অনেকেই লাইন দিয়ে আছে। আজ সন্ধেবেলায় এই নিয়ে মিটিং হবে।
নন্দিনী স্বামীর মুখে নানান রঙের আলো দেখতে পেলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সমস্ত শরীরে নোংরা লেগে আছে, আমি বাথরুমে যাচ্ছি।
.
সমরেন্দ্রনাথ খুব চিন্তিত। পূর্বপুরুষের তৈরি এই বাড়ি শুধু ইট কাঠের নয়, এর সঙ্গে রায়পরিবারের অস্তিত্বও প্রবলভাবে জড়িত। আজ সন্ধ্যায় যে-মিটিং হবে তাতে তিনি কোন পক্ষে যাবেন তা স্থির করতে পারছিলেন না। অতগুলো থোক টাকা এবং পরবর্তীকালে হাত-পা মেলে থাকার মতো ফ্ল্যাট আর এই বাড়ির ঐতিহ্য, কাকে বেছে নেবেন তিনি? এই সময় টুপুর ঘরে এল। এখন সে অনেক ধীরস্থির। আগের মতো ছটফটানি নেই। টুপুর বলল, বাবা জানো, সানুদার মা ফিরে এসেছে।
সমরেন্দ্রনাথ অন্যমনস্ক, বললেন, কেমন আছে সানু?
জানি না। গিয়ে জিজ্ঞাসা করে আসব?
পেছন থেকে কৃষ্ণার গলা পাওয়া গেল, তোকে তো বললাম এখন যাওয়ার দরকার নেই। সানু যদি চিঠির জবাব দেয় তাহলে ওরা পাঠিয়ে দেবেই।
টুপুর মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কী হয়েছে?
আর কী হবে! জানোই তো সব।
ও নিয়ে এত ভাবছ কেন? সবাই যা ঠিক করবে তাই মানতে হবে।
আশ্চর্য! সবাইটা কে? অ্যাঁ? তার মধ্যে আমিও তো আছি! তাই না? বিরক্ত হলেন সমরেন্দ্রনাথ।
বড়মা তো এখনও রায় দেননি।
হুঁ। বলেছেন মিটিং-এর আগে জানিয়ে দেবেন।
এই তো আড়াইটে ঘর, কাউকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর জায়গা নেই অথচ গালভরা নাম রায়বাড়ি। এর চেয়ে সাজানোগোছানো ফ্ল্যাটে অনেক আরামে থাকা যাবে।
কৃষ্ণা শেষ করামাত্র মনোরমা দরজায় এলেন, বউমা তোমার বাপের বাড়ির সবাই আলাদা হয়ে গেছে বলে তুমি তো চাইবেই ফ্ল্যাটবাড়িতে গিয়ে থাকতে। ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকে কারা? যাদের নিজের বাড়িতে থাকার ক্ষমতা নেই তারা। যত অসুবিধেই হোক তোমাকে পাঁচ জন রায়বাড়ির বউ হিসেবে যে সম্ভ্রমের চোখে দেখবে ফ্ল্যাটবাড়ির বউ হলে সেটা দেখবে? আমি তো এতদিন জানতাম যাদের বাড়ি বানাবার ক্ষমতা নেই আবার বস্তিতে গিয়ে থাকতে পারবে না তারাই ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকে।
সমরেন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করলেন, মা, এভাবে বলা ঠিক হচ্ছে না। এখন ভাল জায়গায় একটা পনেরোশো স্কোয়্যারফিটের ফ্ল্যাটের দাম কত জানো? পনেরো লাখ থেকে তিরিশ লাখ। এই টাকা যে খরচ করতে পারে তার পক্ষে জমি কিনে বাড়ি তৈরি করা এমন কিছু অসম্ভব ব্যাপার নয়। এখন মানুষ ফ্ল্যাটে থেকে তার কারণ সেখানে ঝুটঝামেলা কম, পরিবারের লোকসংখ্যা বেশি নয় বলে অসুবিধে হয় না।
মনোরমা বললেন, বাঃ। তাহলে তো চুকেই গেল। আমাকে আর এর মধ্যে ডাকাডাকি করা কেন। বাপ-পিতামহরা তাহলে চুলোয় যাক।
কৃষ্ণার চোয়াল শক্ত হল। মনোরমাকে কেউ এখন ডাকেনি। অথচ—
কৃষ্ণা বলল, তোমরা যাতে ভাল হয় তাই করো। আমি এর মধ্যে নেই।
.
দুপুর গড়াতেই বাড়ির সামনে ট্যাক্সি এসে থামল। পাঁড়েজি অবাক হয়ে দেখল আগন্তুককে। তারপর পড়ি কি মরি করে ছুটে গেল, খোকাবাবু! তুমি?
খোকাবাবু তিরিশের কাছাকাছি যুবক। ভাড়া মিটিয়ে এয়ারলাইন্সের লকেট লাগানো বিদেশি দুটো ঢাউস সুটকেস ডিকি থেকে নামিয়ে মৃদু হাসল, কেমন আছ?
আর আছি। এসব দেখার জন্যে রামজি আমাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছেন?
কী সব দেখছ?
ওই দ্যাখো। তারা নেই?
যুবক চারপাশে তাকিয়ে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না। পাঁড়েজি বলে যাচ্ছিল, ওরা ছিল বাড়ির মেয়ের মতো। না হয় ওরা পাথরের তৈরি তবু কত রোদ জল ঝড় সহ্য করে এ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। তাদের বিক্রি করা হয়ে গেল। কেন? না, এত বড় বাড়ি সারাবার মতো টাকা নেই।
যুবক বুঝতে পারল। তারপর বলল, কাউকে ডাকো। এত বড় স্যুটকেস এই বয়সে তোমাকে তুলতে হবে না।
পাঁড়েজি চোখ মুছল, তুমি যাও খোকাবাবু। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
পা বাড়াবার আগে যুবক জিজ্ঞাসা করল, বড়মা কেমন আছেন?
আছেন। কিন্তু তাঁর চোখে কি আর ঘুম আসে খোকাবাবু! দ্যাখো, গিয়ে কথা বলে দ্যাখো। উদাস হয়ে গেল পাঁড়েজি।
দুটো সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে ঠাকুরদালানে পৌঁছে গেল যুবক।
মা ব্যাঘ্রবাহিনী সামনে দাঁড়িয়ে। জন্ম ইস্তক সে এই মূর্তি দেখছে। অজান্তেই তার চোখের পাতা কয়েক মুহূর্তের জন্যে বন্ধ হল।
আরে। নাতিবাবু না। হঠাৎ চলে এলে?
যুবক চোখ খুলে দেখল ন’বাবু দাঁড়িয়ে। তাঁর ভঙ্গিটা এমন যেন তাকে প্রণাম করবে বলে অপেক্ষা করছেন। যুবক বলল, এলাম। আপনারা সবাই ভাল আছেন? টুকটুকির তো বিয়ে হয়ে গেছে।
হ্যাঁ। তুমি তো বিয়েতে এলে না। আচ্ছা, চলি।
ভদ্রলোকের উৎসাহে হঠাৎ কেন জল পড়ল বুঝতে পারল না যুবক।
.
ইজিচেয়ারে আধশোওয়া বড়মা আবিষ্কার করলেন তাঁর বাঁ চোখ কাঁপছে। দুবার চেষ্টা করলেন, স্থির রাখতে তারপর খুশি হলেন। এখন এই বয়সে আর নতুন করে ভাল কিছু ঘটবে না। পরি বিক্রি করে শেষ হয়নি এবার বাড়ি বিক্রির দিকে সবাই এগোচ্ছে। তাঁর কী দরকার বাধা দেওয়ার। তিনি এই বংশের কেউ নন। পরের বাড়ির মেয়ে এ বাড়িতে বউ হয়ে এলেও অনেকদিন ব্রাত্য হয়ে ছিলেন। মুশকিল হল, এখনও মনে মৃত্যুর ইচ্ছে আসেনি। শরীরে জরা জাঁকিয়ে বসেছে তবু পরের দিন সকাল দেখার সাধ যায়নি। এই যেমন আজই আতরবালাকে বলেছেন কচুর শাক আনাতে। ওটা বাঙালদের খাবার। এ বাড়িতে এককালে আড়মাছ, কচুর শাক ঢুকত না। বোয়াল তো নয়ই। সেটা অবশ্য এখনও ঢোকে না কিন্তু আড় খায় কেউ কেউ। একবার এক বাঙাল রাঁধুনি এসেছিল। তার হাতের রান্না ছিল চমৎকার। সেই কচুর শাক খাইয়েছিল। এইসব খাওয়ার ইচ্ছে যার এখনও হয় সে কেন অযথা মরে যাবে?
আতরবালা দৌড়ে ঘরে ঢুকে প্রায় হামলে পড়ল, ও বড়মা। বড়মা গো, এয়েছে, এয়েছে।
অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বাঁ হাতের ঝটকায় সরিয়ে দিলেন বড়মা, আ মলো যা। আমার গায়ে এসে পড়ছিস, এবার দেখছি মাথায় উঠবি।
আতরবালা রাগ করল না। ঠোঁট টিপে হেসে বলল, তোমার নাতিবাবু এসেছে।
কে এসেছে? বড়মার মাথাটা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল।
নাতিবাবু গো। বিদেশ থেকে।
এই সময় বড়মা তাকে দেখতে পেলেন। একদম এক গোরা সাহেব এসে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হল তাঁর। ততক্ষণে সামনে এসে ঝুঁকে পড়েছে যুবক। বড়মা মুখ ঘুরিয়ে বললেন, থাক, থাক।
বাঃ। এতদিন পরে এলাম, প্রণাম নেবে না?
আর ওসবের দরকার কী।
মনে হচ্ছে খুব ক্ষেপে আছ। যুবক হাসল।
বড়মা মুখ ঘোরানো অবস্থায় বললেন, আতর। ভেতরে নিয়ে যা। আর গঙ্গাজল এনে আমার পা ধুইয়ে দে।
সে কী? যুবক চোখ বড় করল।
সাতসমুদ্র পার হয়ে ম্লেচ্ছদের সঙ্গে কাটিয়ে বাইরের কাপড়ে আমার পা ছুঁয়ে দিল। এতদিন যা শিখিয়েছি তা বাইরে গিয়ে–! বড়মা কথা শেষ করতে পারলেন না। তাঁর গলায় বাষ্প জমল।
যুবক একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ইজিচেয়ারের পাশে বসল, তোমার কী হয়েছে? আমি তো রেগুলার চিঠি লিখেছি, ফোন করেছি।
নাতবউকে নিয়ে যেতে এসেছিস, নিয়ে যা। কথা বাড়াচ্ছিস কেন?
শুধু নাতবউ কেন এই বুড়ি ঠাকুমাকেও নিয়ে যাব।
পাগল। তার আগে আমি গলায় দড়ি দেব।
ইমপসিবিল।
তার মানে?
তোমার ওই ভারী শরীর নিয়ে এই বয়সে আর যেভাবেই মর গলায় দড়ি দিয়ে মরতে পারবে না। প্রথম কথা, দড়িটা সিলিং বা ফ্যানে বাঁধতে পারবে না। কেউ ধরে না তুলে দিলে চেয়ারে উঠে দাঁড়াতেও বোধহয় পারবে না। তাহলে ঝুলবে কী করে?
বড়মা খুব বড় নিশ্বাস ফেললেন, তবু এসব দেখার জন্যে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। কদিনের জন্যে আসা?
মাসখানেক।
আতরবালা বলল, কতদুর থেকে এয়েছে, একটু জিরোতে দাও, তারপর কথা বলো। যাও নাতিবাবু ভেতরে যাও।
যুবক উঠল। ততক্ষণে পাঁড়েজি লোক জোগাড় করে দুটো ঢাউস স্যুটকেস ওপরে পাঠিয়ে দিয়েছে।
পর্দা সরিয়ে যুবক তার শোওয়ার ঘরে ঢুকে দেখল পালঙ্কের ওপর পাশ ফিরে যুবতী শুয়ে আছে। এই হল বড়মার নাতবউ। একবার পেছনের দিকে তাকিয়ে নাতিবাবু পালকের পাশে নিঃশব্দে পৌঁছে আচমকা নাতবউকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো চুমু খাওয়া শুরু করল। এই অবস্থায় বিভ্রম হওয়া দোষের নয়, নাতবউ চিৎকার করে উঠেই স্বামীকে দেখতে পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেল।
দুটো ঘরের ওপাশে দাঁড়িয়ে বড়মা গলা তুললেন, ও নাতবউ, কী হল, পড়ে গেলি নাকি?
নাতিবাবু ইশারায় জবাব দিতে অনুরোধ করায় নাতবউ গলা তুলল, না।
নাতিবাবু জিজ্ঞাসা করল, স্পর্শে বুঝতে পার না, চেঁচাতে হল?
নাতবউ বলল, তুমি আমাকে ছোঁবে না।
বাপস। তোমারও গঙ্গাজলের ব্যাপার আছে নাকি?
এতদিন ওদেশে আছ। সেখানকার মেয়েছেলেদের সঙ্গে সম্পর্ক করেছ কিনা জানি না। আগে রক্ত পরীক্ষা করাও তারপর ছোঁয়াছুঁয়ি।
রক্ত পরীক্ষা?
হ্যাঁ। এইডস হয়েছে কিনা দেখে নেওয়া দরকার।
মাই গড! নাতিবাবুর চোখ বড় হয়ে গেল, এসব কোত্থেকে জানলে?
বই পড়ে।
না, কোনও মহিলার সঙ্গে আমার কিছুই হয়নি।
বিশ্বাস করি না। পুরুষমানুষ একা দিনের পর দিন থাকলে তার চরিত্রভ্রষ্ট হতে বাধ্য। কথায় বলে না চিতায় উঠলেও তোমাদের প্রবৃত্তি মরে না।
বাঃ কী সুন্দর অ্যাসেসমেন্ট! তা তুমিও তো এখানে একা আছ, তোমার সম্পর্কে যদি এ কথা বলি তাহলে কি ভাল লাগবে?
এক কথা হল না। বাইরে খাণ্ডারনি ঠাকুমা অষ্টপ্রহর পাহারায় আছেন। ওঁকে ফাঁকি দিয়ে কোনও ব্যাটাছেলে মশা পর্যন্ত এখানে ঢুকতে পারে না। যাক গে, হঠাৎ এলে?
মন খারাপ করছিল। তারপর তুমি লিখলে ওদেশে যাবে না। সেটা পড়ে আরও খারাপ লাগল। কী ব্যাপার বলো তো?
ওই বুড়ি মরার আগে কী করে যাব?
কেন? বুড়ি কিছু বলেছে?
বলেছে। নাক ফুলিয়ে বলেছে, যাও, চলে যাও।
ব্যাস, চুকে গেল!
না। চলে যাওয়া যায় না। এই বাড়ি ওঁর প্রাণ। পরিগুলো যেদিন বিক্রি হল সেই রাত্রে একবারও চোখের পাতা এক করেননি।
বিক্রি হল কেন?
বাড়ি মেরামতের টাকা জোগাড় করতে।
তারপর?
এখন শুনছি সবাই চাইছে বাড়িটা বিক্রি করে দিতে।
এই বাড়ি? নাতিবাবু এমন কথা শুনবে ভাবতে পারেনি।
নাতবউ বলল, হ্যাঁ। বাড়ি বিক্রি হয়ে গেলে বড়মা অনেক টাকা পাবেন ঠিকই কিন্তু যদ্দিন ফ্ল্যাট না পাচ্ছেন তদ্দিন থাকবেন কোথায়?
.
দেবী ব্যাঘ্রবাহিনীর সামনে প্রদীপ জ্বলছিল। যদিও ঠাকুরদালানের সব কটা আলো আজ জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। এখন সন্ধে সাতটা। রায়পরিবারের সমস্ত শাখার প্রতিনিধিরা আজ এখানে সমবেত। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। গন্ধরাজের পাশে চুপচাপ বসেছিল সদানন্দ। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কিছু ভেবেছেন?
গন্ধরাজ হাসলেন, আমার তো কোনও সমস্যা নেই যে ভাবতে বসব! একা মানুষ, কোনও পেছন টান নেই, যাওয়ার সময় তো কারও জন্যে কিছু রেখে যেতে হবে না। ভাববে তোমরা। রোজগারপাতি করছ, বিয়ে ঠিক হয়েছে?
সদানন্দ লজ্জা পেল, না-।
আরে লজ্জিত হওয়ার কী আছে। শরীর উপযুক্ত হয়েছে, তাই না?
সদানন্দ মুখ ফিরিয়ে নিল। গন্ধরাজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে দীর্ঘকাল এ বাড়িতে কানাঘুষো হয় কিন্তু তিনি যা করেন তা বন্ধ দরজার ওধারে, কেউ দেখতে পায় না। এই বাড়িতে থাকেন কিন্তু কেউ আগ বাড়িয়ে ওর সঙ্গে কথা বলেন না। সে দেখল বড়মায়ের নাতি নেমে এসে ব্যাঘ্রবাহিনীকে নমস্কার করছে। সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন বন্ধ হয়ে গেল।
ন’বাবু বললেন, এসো, এসো। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
নাতিবাবু বলল, আপনারা সবাই ভাল আছেন?
ফুলবাবু হাসলেন, চলে যাচ্ছে। তুমি তো এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদেশে চলে গেছ। কেমন লাগছে বিদেশ?
নাতিবাবু বলল, এখন আর বিদেশ বলে মনে হয় না। গ্রিন কার্ড পেয়ে গেছি।
সমরেন্দ্রনাথ বললেন, তাই নাকি? তুমি তো তাহলে এন আর আই। এখন তোমাদের খুব কদর। জ্যোতিবাবু তোমাদের জামাই আদরে ডেকে আনছেন।
কমলেন্দু বলল, আচ্ছা, এবার কাজের কথা শুরু করা যাক।
ন’বাবু বললেন, হ্যাঁ। বড়মা বলেছিলেন আজকের মিটিং-এর আগে তিনি তাঁর বক্তব্য জানিয়ে দেবেন। ওঁর কথার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। হ্যাঁ বাবা তিনি কি তোমাকে কিছু জানিয়েছেন?
নাতিবাবু মাথা নাড়ল, আপনারা সবাই জানেন তাঁর যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এ ব্যাপারে সবাই যে সিদ্ধান্ত নেবে তাই তিনি মেনে নেবেন।
ন’বাবুর মুখ দেখে বোঝা গেল তিনি খুব হতাশ হয়েছেন। ফুলবাবু বললেন, তাহলে শুরু করা যাক। আপনারা সবাই জানেন এই বাড়িতে আমাদের জায়গায় কুলোচ্ছে না। যখন ভাগ হয়েছিল তখন প্রত্যেকের পরিবার ছোট ছিল। সে সময় ঠিক কী নিয়মে ভাগাভাগি হয়েছিল তা নিয়েও কথা উঠেছে। যাক সে, এই বাড়ি রাখা মানে হাতি পোষা। আর সেই হাতির এমন বয়স হয়েছে যে নড়তে চড়তে পারে না। বাড়ির সামনে অনেকটা জমি এই বাজারে ফালতু পড়ে রয়েছে। আমরা কেউ একান্নবর্তী নই, যে যার নিজের মতো থাকি। সেই থাকাটা যাতে আরও ভালভাবে থাকা যায় তাই আমি প্রস্তাব দিচ্ছি এই বাড়ি প্রমোটারকে দিয়ে দিতে।
সমরেন্দ্রনাথ বললেন, দিয়ে দিতে মানে?
ফুলবাবু বললেন, আমরা জমি বিক্রি করব না। জমি আমাদের নামেই থাকবে। প্রমোটার এই বাড়ি ভেঙে কয়েকটা মাল্টিস্টোরিড বিন্ডিং বানাবে। একটা বিল্ডিং-এ আমাদের প্রত্যেক শরিক একটা করে বড় ফ্ল্যাট পাব। সেই সঙ্গে টাকা।
গন্ধরাজ জিজ্ঞাসা করলেন, কত টাকা?
অন্তত লাখ পাঁচেক।
ন’বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কতদিনে ফ্ল্যাট পাওয়া যাবে? বাড়ি বানাতে যতদিন সময় লাগবে ততদিন আমরা কোথায় থাকব?
ফুলবাবু বললেন, এ নিয়ে কথা বলতে হবে। প্রথমে এই বাড়ি না ভেঙে ওপাশের মাঠে ওরা বিল্ডিং তৈরি করে আমাদের হ্যান্ডওভার করে দিতে পারে। এতে কোথাও যাওয়ার সমস্যা থাকবে না। এখন বলুন, আপনারা সবাই একমত কিনা।
কমলেন্দু বলল, একমত না হলে কী হবে?
কী আর হবে? ভোট করে তো লাভ নেই, এইভাবেই থাকতে হবে। ফুলবাবু বললেন।
কমলেন্দু বলল, একটা ভুল হয়েছে, প্রমোটারকে শরিকদের প্রত্যেককে একটা করে ফ্ল্যাট তো দিতেই হবে তার ওপরে একটা বাড়তি ফ্ল্যাট দিতে হবে।
ফুলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কেন?
মা ব্যাঘ্রবাহিনীর জন্যে সেটা দরকার। কমলেন্দু বলল।
সমরেন্দ্রনাথ বললেন, নিশ্চয়ই। একতলায় আমরা মায়ের জন্যে জায়গা চাইব।
ন’বাবু বললেন, তোমরা চাইছ, আমি আর কী বলব। কিন্তু এই বাড়িতে আমাদের বাপ-ঠাকুরদার স্মৃতি ছড়ানো। সেটা কেউ ভাবছ না?
সদানন্দ বলল, তা যদি বলেন ভারতের মাটিতে সুভাষচন্দ্র, গাঁধীজি, রবীন্দ্রনাথ, চৈতন্যদেব, বুদ্ধদেবের স্মৃতি ছড়ানো। কেউ কি এখন সে কথা ভাবছে?
এইসময় নাতিবাবু কথা বলল, ওসব সেন্টিমেন্টের কোনও মূল্য এখন নেই। এই যে আপনাদের ছেলেমেয়ে বা নাতিনাতনি, তাদের অনেকের নামই আমি জানি না। অতএব আত্মীয় বলে ভাবতেও কিছুদিন বাদে অসুবিধে হবে। বড়মা বলেছেন, মা ব্যাঘ্রবাহিনীকে যথাযথ সম্মান দিয়ে রাখলে এই বাড়ি বিক্রিতে তাঁর কোনও অমত নেই।
ন’বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি পারবেন সহ্য করতে?
তাঁকে এসব দেখতে হবে না। আমার সঙ্গে উনিও চলে যাচ্ছেন।
.
২৬.
গত রাত্রে কঙ্কাবতীকে রক্ত দেওয়া হয়েছিল।
নিরাময়ের তালিকায় যেসব রক্তদাতার নাম আছে তাদের দুজনকে খবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের বদলে বিকেলবেলায় হাজির হয়েছিল শক্তপোক্ত চেহারার একটি ছেলে। সায়ন তখন অফিসঘরে। ছেলেটি দরজায় দাঁড়িয়ে নেপালিতে জিজ্ঞাসা করেছিল, ডাক্তারবাবু কোথায়?
সায়ন ভাঙা নেপালিতে জবাব দিয়েছিল, উনি একটু বেরিয়েছেন। আপনার যদি খুব প্রয়োজন থাকে তাহলে বসতে পারেন।
ছেলেটির বসার ভঙ্গি বলে দিল ওটা তার প্রয়োজন ছিল।
গতকালের খবরের কাগজ একটু আগে এসেছে কলকাতা থেকে। সেইটে পড়ছিল সায়ন। কিন্তু সামনে কেউ বসে থাকলে কাগজ পড়ে যাওয়া অভব্যতা।
সায়ন জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় থাকেন?
এই তো, পাঙ্খাবাড়ির রাস্তায়। আপনি ডাক্তারবাবুর কেউ হন?
না। আমি ওর পেশেন্ট।
পেশেন্ট? আপনি?
হ্যাঁ।
কিন্তু, শুনেছি, এখানে যারা পেশেন্ট হয়ে আছে তাদের রক্তের অসুখ আছে। প্রায়ই রক্ত দিতে হয়। তাই তো!
ঠিকই।
তার মানে, আপনিও?
হ্যাঁ। তবে আমি অনেক ভাল আছি। আজ একটি মেয়েকে রক্ত দেওয়া হবে। ওর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। দুজন পাহাড়ি বন্ধুকে খবর দেওয়া হয়েছে।
জানি। ওদের একজনের বেশ জ্বর আর একজন দার্জিলিং গিয়েছে।
সে কী?
হ্যাঁ। আমি তাই এসেছি। আমার রক্তে কাজ হবে?
আমি জানি না। কঙ্কাবতীর রক্তের গ্রুপের সঙ্গে যদি আপনার রক্ত মিলে যায় আর আপনার যদি অন্য কোনও অসুখ না থাকে তাহলে হবে। সেটা ডাক্তারবাবুই বলতে পারবেন।
কঙ্কাবতী কি বাঙালি?
না। নেপালি। সায়ন হাসল, কেন? বাঙালি হলে আপনি দেবেন না?
ছেলেটার মুখ কালো হয়ে গেল।
সায়ন বোঝাবার চেষ্টা করল, দেখুন, অসুস্থ মানুষের একটাই পরিচয়, সে অসুস্থ। তখন বাঙালি বিহারি নেপালি বলে ভাবা ভুল।
ছেলেটি খুব বিরক্ত হল, জ্ঞান দিতে আপনার খুব ভাল লাগে দেখছি।
জ্ঞান?
হ্যাঁ। আমি কী ভাবছি তা নিজেই ভেবে নিলেন? আমি শুনেছি বাঙালিরা উপদেশ দেওয়ার সুযোগ পেলে ছাড়ে না। ছেলেটি সোজা হয়ে বসল, আপনার কেন মনে হল কঙ্কাবতী বাঙালি মেয়ে হলে তাকে আমি রক্ত দেব না? বলুন? কলকাতা শহরের কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে মানুষকে বাঁচাতে এখানকার মতো যেচে এগিয়ে গিয়ে ছেলেমেয়েরা রক্ত দেয়?
এভাবে না হলেও, দেয়। প্রায়ই ব্লড ডোনেট করার জন্যে ক্যাম্পের আয়োজন করা হয় পাড়ায় পাড়ায়। সেখানে যারা রক্ত দেয় তারা ভালবেসেই দেয়।
আমি জানতাম না। কিন্তু আপনার মনে বাঙালি নেপালি আলাদা এই মনোভাবটা কেন এল?
এখানকার পার্টির ছেলেদের কথাবার্তা শুনে সেরকম ধারণাই হয়।
দুর। আপনাদের বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে আমেরিকান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ জানানো হয় না? আমেরিকান প্রেসিডেন্টের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো না? অথচ আপনাদের নেতারা ছুটি কাটাতে আমেরিকায় যান, সেখান থেকে ব্যবসাদার ধরে আনেন। এটাও সেরকম।
আপনি রাজনীতি করেন?
রাজনীতি করা বলতে আপনি যা বোঝাতে চাইছেন তা আমি করি না। কোনও দলের সদস্য নই। কিন্তু মানুষের জন্যে কিছু করতে চাই।
আমার নাম সায়ন। আপনি?
বিষ্ণু। বিষ্ণুপ্ৰসাদ। আমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে আপনার?
কী মনে হচ্ছে মানে?
আমি তো বাঙালি নই, পাহাড়ের মানুষ।
আপনি নেপালি!
বিষ্ণুপ্ৰসাদ হাসল, আমি লেপচা। আগে লেপচাদের নাম হিন্দুদের ভগবানের নামে হত না। এখন সব একাকার হয়ে গেছে।
লেপচা বলে একটা জাতের কথা শুনেছি। কিন্তু আপনাকে তো নেপালিদের থেকে আলাদা করা যাবে না।
মঙ্গোলিয়ান মুখ বলে। তবে লক্ষ করলে বুঝতে পারবেন। নেপালি, লেপচা, সিকিমিজ এবং ভুটিয়া, এদিকের এই চারটে পাহাড়ি জাতির মানুষের মুখের গঠনে পার্থক্য আছে। সিকিমিজ এবং ভুটিয়ারা অনেক বেশি লম্বা হয়। বাঙালিরা এসব খুঁটিয়ে দেখে না, ভাবেও না। বিষ্ণুপ্ৰসাদ হাত বাড়াল, কাম অন, আমরা কেউ কারও শত্রু নই।
সায়ন করমর্দন করতেই ডাক্তারবাবু ফিরে এলেন। সায়ন ওঁর সঙ্গে বিষ্ণুপ্রসাদের পরিচয় করিয়ে দিল। ডাক্তারবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ওদের পাওয়া যাবে না শুনে আপনি নিজে এগিয়ে এসেছেন? ভগবান আপনার ভাল করবেন।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ হাসল, ভগবানের অত ক্ষমতা নেই।
ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, কী রকম?
আমি যদি নিজেই নিজের ক্ষতি করতে চাই তাহলে ভগবান কী করতে পারেন?
তুমি বলছি। তুমি কেন নিজের ক্ষতি করতে চাইবে?
জানি না। মাঝে মাঝেই মনে হয় সব ভেঙে চুরমার করে দিই।
কেন মনে হয় না যত্ন করে কোনও কিছু গড়ে তুলি?
কারণ সেটা করলে অন্য কেউ কায়দা করে ভেঙে দেবে। দেখুন, আমার রক্তে আপনার কাজ হয় কিনা?
বিষ্ণুপ্রসাদকে নিয়ে ডাক্তার ভেতরে চলে গেলেন। সায়ন ওকে নিয়ে ভাবছিল। এরকম ছেলে সে কোনওদিন দেখেনি। খারাপ তো লাগছিলই না, উল্টে অদ্ভুত আকর্ষণ বোধ করছিল সে।
এই সময় মিসেস অ্যান্টনির গলা শুনতে পেল সে, আসুন। সকালে আসেননি কেন? আজ আপনার মেয়েকে রক্ত দেওয়া হবে।
সে কী? কেন? ওর কি শরীর খুব খারাপ? মহিলার গলা পেল সায়ন। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল প্যাসেজে দাঁড়িয়ে মিসেস অ্যান্টনির সঙ্গে কথা বলছেন কঙ্কাবতীর মা।
ভয়ের কিছু নেই। ডাক্তার মনে করছেন এখন রক্ত দিলে ওর উপকার হবে। মুশকিল হল যাদের আসার কথা ছিল তারা আসতে পারেনি। ওদের বদলে যে ছেলেটি এসেছে তার রক্তের গ্রুপ যদি আলাদা হয়–। মিসেস অ্যান্টনি কথা শেষ করলেন না।
তাহলে কী হবে? সায়নকে দেখতে পেলেন কঙ্কাবতীর মা। তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, আচ্ছা, আমি তো ওর মা। আমার রক্তে ও তৈরি। তাহলে আমি রক্ত দিলে নিশ্চয়ই কাজ হবে।
মিসেস অ্যান্টনি হেসে তার কাজে চলে গেলেন। সায়ন বলল, আপনি ভেতরে এসে বসুন। ডাক্তারবাবু এখনই ফিরে আসবেন। সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আপনি ওর মা হলেও দুজনের রক্তের গ্রুপ যে এক হবে এমন কোনও নিয়ম নেই।
কঙ্কাবতীর মা ভেতরে এলেন, তাই যদি হয় তাহলে তুমি ওটা এক করে দাও।
আমি? চমকে উঠল সায়ন, আমি কী করে করব?
তোমাকে দেখেই আমি বুঝে গিয়েছি তুমি মানুষের মতো নও। তুমি আমাকে নরকে তলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছ। তোমার ঘরে সেদিন যদি না যেতাম, তোমাকে যদি না দেখতাম তাহলে এই শরীরটা নোংরা হয়ে যেত। তোমাকে দেখেছি বলে আমি শিলিগুড়ি যাইনি।
ভাল করেছেন। ঠিক করেছেন।
হ্যাঁ। আমার স্কুলের চাকরি চলে গিয়েছে। অদ্ভুত গলায় বললেন ভদ্রমহিলা।
কেন?
আমি জানি না। শুনলাম গণেশ এখানে এসে নাকি মেয়ের সঙ্গে কীসব ঝামেলা করেছিল। তারপর পার্টি থেকে ওকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুব বকে। ওকে কালিম্পং-এ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আজ সকালে স্কুলে গিয়ে শুনলাম আমার চাকরি নেই। ওরা সমান বিচার করেছে।
সমান বিচার? আপনি কোনও অন্যায় করেননি। গণেশ এখানে এসে যা করেছে সে-তুলনায় কম শাস্তি পেয়েছে।
আমি জানি না। কী করে বেঁচে থাকব তাও জানি না। শুধু আমার মেয়েকে বাঁচিয়ে দাও তুমি। তুমি ইচ্ছে করলেই পারো। ভদ্রমহিলা কেঁদে কেঁদে কথাগুলো এমন ভঙ্গিতে বলছিলেন যেন প্রার্থনা করছিলেন।
সায়ন প্রচণ্ড অস্বস্তিতে পড়ল, আপনি এসব কী বলছেন? যা করার ডাক্তারবাবু করবেন। ওঁর ওপর ভরসা রাখুন। আমি এখানে আছি ওঁর কাছে চিকিৎসার জন্যে।
জানি। তুমি ইচ্ছে করে শরীরে অসুখ নিয়েছ। শুনেছি মহাপুরুষরা তাই নেন। তুমি মা মেরির আশীর্বাদ পেয়েছ। পাওনি?
সায়ন হেসে ফেলল, এসব কথা একদম বিশ্বাস করবেন না। আমি আপনার মতো মানুষ। না, ঠিক হল না, আপনি সুস্থ, আমি অসুস্থ।
এইসময় ডাক্তার ফিরে এলেন। পেছনে বিষ্ণুপ্রসাদ। ডাক্তার কিছু বলার আগেই বিষ্ণুপ্রসাদ বলল, হল না। মেয়েটার কাজে লাগতে পারলাম না। কপালটা দেখুন, এই জন্যে মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়।
ডাক্তার বললেন, তোমার রক্ত অত্যন্ত মূল্যবান। ওই রেয়ার গ্রুপের ব্লাড পাওয়া খুব মুশকিল। তোমার ঠিকানাটা বলো।
সেটা লিখে নেওয়ার পর ডাক্তার মহিলার দিকে তাকালেন।
আমার রক্ত নিন। মহিলা বিড় বিড় করলেন।
ডাক্তার প্রথমে ওঁকে চিনতে পারেননি। জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি?
সায়ন বলল, উনি কঙ্কাবতীর মা।
ওহো। সরি। আমি একটু–। হ্যাঁ, বলুন।
আমার রক্ত নিন।
আপনি কখনও এর আগে কাউকে রক্ত দিয়েছেন?
না।
আপনার গ্রুপ কী?
জানি না।
আসুন। ডাক্তার মহিলাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।
বিষ্ণুপ্রসাদ জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি অফিসে কাজ করেন?
না-না। সায়ন বলল, কিছু করার নেই, বসে আছি।
আপনার কী অসুবিধে হয়?
যতক্ষণ হেমোগ্লোবিন একেবারে না কমে যায় ততক্ষণ কোনও সমস্যা নেই। ওটা একটা বিশেষ মাত্রার নীচে নেমে গেলে–।
ওটা তো যে কোনও সময়েই হতে পারে।
পারে।
তার মানে এই আপনি সুস্থ কিন্তু খানিক বাদেই অসুস্থ হতে পারেন?
ঠিক ওইভাবে বলা ঠিক হবে না। তবে কোনও নিশ্চয়তা নেই। কখনও কোনও বিষয় নিয়ে ভাবতে গিয়ে যদি মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায় তখন বুঝতে পারি অসুস্থ হতে যাচ্ছি।
কিছু ভাবতে গিয়ে কুল না পেলে আমারও মাথায় যন্ত্রণা হয়। চোখ বন্ধ করল বিষ্ণুপ্ৰসাদ।
আপনি কী করেন?
চাকরি পাইনি। না, পেয়েছিলাম, মেনে নিতে পারিনি বলে চাকরি করতে পারিনি। ব্যবসা করার চেষ্টা করেছিলাম। হলদিরামের মাল কলকাতা থেকে আনিয়ে সাপ্লাই দিতাম পাহাড়ি শহরগুলোর দোকানে দোকানে। ছয় মাসেই ব্যবসা উঠে গেল।
কেন?
যারা দশ টাকার মাল নিত তারা তিন টাকা দিয়ে পরের মাল চাইত। বাকি রাখা নাকি ব্যবসার অঙ্গ। আমার টাকা ছিল না বেশি তাই বেশিদিন বাকি রাখার খেলা খেলতে পারলাম না। বিষ্ণুপ্ৰসাদ হাসল, বুঝলাম, আমার দ্বারা ব্যবসা হবে না।
আপনি চা খাবেন?
না। বিষ্ণুপ্ৰসাদ উঠে দাঁড়াল।
মিসেস অ্যান্টনি এলেন অফিসঘরে। আলমারি থেকে একটা কাগজ বের করে নিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ভাল খবর। মেয়ের আর মায়ের ব্লাড গ্রুপ এক। এখনই রক্ত নেওয়া হবে। সায়ন, কঙ্কাবতীর মা তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। মিসেস অ্যান্টনি চলে গেলেন।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন কেন?
সায়ন বেরিয়ে এল, আমি এর কারণ জানি না।
ওরা বাইরে এসে দাঁড়াল।
পাহাড়ে সন্ধ্যা নামে না, সায়নের মনে হয়, সন্ধ্যা ধুপ করে পড়ে যায়। এখন আকাশ দেখে মনে হল সেই পড়াটা পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যে ঘটবে না। বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, এই এলাকাটা একটু আলাদা। এখানকার মানুষ খ্রিশ্চান। হিন্দুদের থেকে খ্রিস্টানরা অনেক বেশি টিপটপ।
টিপটপ শব্দটা কানে যেতে হেসে ফেলল সায়ন।
ভুল বললাম?
না। আপনার হিন্দি নেপালি এবং ইংরেজি শব্দগুলো বেশ মজার।
আমি বেশিক্ষণ ইংরেজি বলতে পারি না, হিন্দি পারি কিন্তু বলতে গেলেই নেপালি বেরিয়ে আসে।
আপনি লেপচা, লেপচাদের আলাদা ভাষা নেই?
আছে। কিন্তু বড় মাছ ছোট মাছকে যেমন গিলে খায় তেমনই ধীরে ধীরে নেপালি আমাদের দখল করে নিয়েছে। এখনও পাহাড়ের কোনও কোনও ভ্যালিতে যেসব লেপচা গ্রাম আছে সেখানে গেলে শুনতে পাবেন। আচ্ছা, আমরা তো প্রায় সমবয়সী, তাহলে আপনি আপনি বলছি কেন?
আমারও তাই মনে হচ্ছে।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ দূরের পাহাড়ের দিকে তাকাল। ওই দিকে দার্জিলিং। দার্জিলিং-এর আসল নাম জানো?
দার্জিলিং আসল নাম নয়?
না। শব্দটা হল দার্জুলাঙ্গ। লেপচা শব্দ। দার্জুলাঙ্গের মানে হল ভগবানের বাসস্থান। অর্থাৎ পৃথিবীর স্বর্গ। পরে সিকিমের ষষ্ঠ বাজা নামগেল একটা মন্দির তৈরি করে নাম দেন দোর্জেলিঙ্গ। মানে বজ্র।
সে কী! খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো। সায়ন বলল।
হাই সায়ন। চিৎকারটা কানে আসতেই ওরা মুখ ফেরাল।
সিমি আর এলিজাবেথ। দুজনের হাতে অনেকগুলো প্যাকেট। এলিজাবেথ নিশ্চয়ই বাজারে গিয়েছিলেন সিমিকে সঙ্গে নিয়ে।
কাছে এসে এলিজাবেথ হাসলেন, কেমন আছ তুমি?
সায়ন বলল, ভাল। অনেক কিছু কেনা হল?
এই টুকটাক। কাজ চালাতে গেলে যেটুকু লাগে। এই মেয়েটা আমাকে খুব সাহায্য করেছে, খুব ভাল মেয়ে।
শোনামাত্র প্যাকেট হাতে নিয়ে সিমি এমন পোজ দিল যা টিভির মডেলরা দিয়ে থাকে। সায়ন লক্ষ করল বিষ্ণুপ্ৰসাদ বেশ অবাক হয়েছে। সে আলাপ করিয়ে দিল, ইনি এলিজাবেথ, মিস্টার ব্রাউনের বন্ধু। আমেরিকায় থাকেন। আর এ হল বিষ্ণুপ্রসাদ। নিজে থেকে রক্ত দিতে নিরাময়ে এসেছিল, এখন আমরা বন্ধু হয়ে গেছি বলা যেতে পারে।
আপনি নিজে থেকে রক্ত দিতে এসেছিলেন? এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, ম্যাডাম, আপনি যদি একটু ধীরে ধীরে কথা বলেন তাহলে আমার পক্ষে বুঝতে সুবিধে হবে। আমি ইংরেজি কম জানি।
এলিজাবেথ হাসলেন, ওয়েল। রক্ত দিতে এসেছিলেন বলে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এবার বললেন যথেষ্ট ধীরে।
এটা এমন কিছু নয়। তা ছাড়া গ্রুপ না মেলায় আমার রক্ত কাজে লাগেনি। আপনি এখানে বেড়াতে এসেছেন?
তাই এসেছিলাম।
কেমন লাগছে?
এখানকার প্রকৃতি খুবই ধনী কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ খুব গরিব। এই দুটো আলাদা বলে মনে ভাললাগা তৈরি হয় না।
বাঃ। চমৎকার বলেছেন।
সিমি উসখুস করছিল, ম্যাডাম এখানে কিছুদিন থেকে যাবেন।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, ভাললাগা তৈরি না হলেও থাকবেন?
ভাল যাতে লাগে তার চেষ্টা করার জন্যে থাকব। আপনি নিশ্চয়ই সমতলের মানুষ নন। আপনার পূর্বপুরুষ নিশ্চয়ই নেপাল থেকে এসেছিল?
না। আমার পূর্বপুরুষ এখানকার মানুষ ছিলেন।
আপনি নেপালি নন?
না। আমি লেপচা।
লেপচা? ইয়েস, এই শব্দটা আমি ট্যুরিস্ট ব্যুরোর লিফলেটে দেখেছি। তাহলে আপনি সিমি অথবা মিস্টার ব্রাউন থেকে আলাদা?
জন্মসূত্রে। তবে এখন ওসব নিয়ে চিন্তা করি না।
এলিজাবেথ বললেন, চলো ঘরে গিয়ে গল্প করি। সায়ন, আজ রাতটা আমি মিস্টার ব্রাউনের ওখানেই থাকছি, কাল শিফট করব।
কোথায়?
সিমি জবাবটা দিল, মিসেস ডিসুজা বাড়ি ছেড়ে দিয়ে কাঠমাণ্ডু চলে গেছেন। মিস্টার ব্রাউন সেটা ম্যাডামের জন্যে ভাড়া করে দিয়েছেন।
এলিজাবেথ বললেন, এসো। আপনিও আসুন।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ হাত বাড়াল, ওগুলো আমাকে দিন।
এলিজাবেথ মাথা নাড়লেন, না না। এগুলো বইতে আমার একটুও অসুবিধে হচ্ছে না। অনেক ধন্যবাদ।
সায়ন একটু ইতস্তত করছিল। সন্ধে হয়ে গেল বলে। এইসময় বাইরে গেলে ডাক্তারবাবু অসন্তুষ্ট হবেন। সে বলল, আপনারা এগোন, আমি যাচ্ছি।
ওরা এগিয়ে গেলে সে নিরাময়ে ফিরে এল। প্যাসেজে দাঁড়িয়ে ডাক্তার মিসেস অ্যান্টনিকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সেটা শেষ করে জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলেটি চলে গেছে?
না। ওরা মিস্টার ব্রাউনের বাড়িতে গেল।
ওরা মানে?
এলিজাবেথ আর সিমি বাজার থেকে ফিরছিলেন। পরিচয় হওয়ার পর মিস্টার ব্রাউনের বাড়িতে যেতে অনুরোধ করলেন। কাল থেকে এলিজাবেথ মিসেস ডিসুজার খালি বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন।
আচ্ছা। তুমি গেলে না?
না। অন্ধকার হয়ে এসেছে।
যেতে ইচ্ছে করছে?
সায়ন হাসল।
শরীর ভাল থাকলে কিছুক্ষণ গল্প করে আসতে পারো। ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বললে অনেক নতুন তথ্য জানতে পারবে। আফটার অল, একজন বিদেশিনী বেড়াতে এসে মানুষের উপকার করতে থেকে গেলেন। এদেশের ইতিহাসে এরকম কিছু ঘটনা এর আগেও অবশ্য ঘটেছে।
এইসময় কঙ্কাবতীর মা নেমে এলেন। সায়নকে দেখে দ্রুত এগিয়ে এসে হাতজোড় করলেন তিনি, ভগবান তোমাকে শক্তি দিয়েছেন। সেই শক্তি দিয়ে তুমি আমার মেয়েটাকে সারিয়ে দাও।
সায়ন হঠাৎ রেগে গেল, আপনাকে এর আগেও বলেছি এভাবে কথা না বলতে। আমি একজন সাধারণ মানুষ। কঙ্কাবতীর ব্যাপারে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলুন।
মহিলা হকচকিয়ে গেলেন। ডাক্তারবাবু এগিয়ে এলেন, ভগবান সবাইকে কিছু করার শক্তি দিয়েছেন। হঠাৎ সায়নকে বলছেন কেন?
মহিলা এবার কেঁদে ফেললেন, আমার শিলিগুড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। যে-লোকটা আমাকে লোভ দেখাচ্ছিল শুধু তাকে দোষী করব না, আমারও লোভ হচ্ছিল। কিন্তু ওকে দেখার পর মনটা কীরকম বদলে গেল। সেই রাত্রে গণেশ আমাকে খুব শাসিয়েছিল। বলেছিল আমাকে শিলিগুড়ি যেতেই হবে। ভেবেছিলাম যা হবার হবে কিছুতেই আমি মেয়ের কাছে সম্মান হারাব না। পরদিন শুনলাম পার্টি থেকে গণেশকে কালিম্পং পাঠিয়ে দিয়ে বলেছে এদিকে আর না আসতে। কেন দিল? আজ দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্ন দেখলাম একটা আলো আকাশ থেকে নেমে আসছে। আমি ভয় পেয়ে দৌড়োতেই পেছন থেকে শুনলাম, ভয় পাবেন না। তাকিয়ে দেখলাম ইনি দাঁড়িয়ে আছেন। ঘুম ভেঙে গেল। আজকে আমার মেয়ের রক্তের দরকার। দেখুন, আমার রক্তে ওর দরকারটা মিটে গেল। আমি যদি বলি ওঁর জন্যে সম্ভব হয়েছে তাহলে মিথ্যে বলব?
ডাক্তারবাবু হাসলেন, দেখুন, এসবই আপনি ভেবেছেন। ভাবতে আপনার ভাল লেগেছে। কিন্তু সায়ন আপনার মেয়ের মতো একজন মানুষ। যে যা নয় তাকে সেটা বললে বিব্রত করা হয়। আপনি রেস্টরুমে বসুন। ডাক্তারবাবু ঘুরে দাঁড়ালেন, কী হল? তুমি যাও, ওঁরা নিশ্চয়ই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আর হ্যাঁ, টর্চটা নিয়ে যাও। ছোটাবাহাদুর, সায়নকে টর্চ এনে দাও।
তখনও টর্চ জ্বালার প্রয়োজন হয়নি। হালকা আঁধার চোখের সামনে। কলকাতার শীতের শুরুতে সুতির আলোয়ানের কথা মনে পড়ল। শীত বাড়তেই সেটা বাতিল হয়ে যেত। পাহাড়গুলো আবছা, আকাশ নীল। সায়ন ভেবে পাচ্ছিল না এরা তার মধ্যে এমন কী দেখতে পাচ্ছে যা সে জানে না। অদ্ভুত ব্যাপার!
দরজা খুললেন মিস্টার ব্রাউন। খুলেই চেঁচিয়ে উঠলেন, কী আশ্চর্য! তুমি? এই সময়? যা আমি হেরে গেলাম।
কীরকম? সায়ন জিজ্ঞাসা করল।
ওরা এসে বলল, তুমি নাকি পরে আসছ বলেছ। আমি বললাম, সন্ধে হয়ে আসছে, এখন সায়ন আসতে পারে না।
উনি বললেন কাল এখান থেকে চলে যাবেন। তাই ডাক্তারবাবুর অনুমতি নিয়েই এসেছি।
গুড। এই হেরে যাওয়ায় আনন্দ আছে। এসো, ভেতরে এসো।
মিস্টার ব্রাউনের খাওয়া কামবসার ঘরে বিষ্ণুপ্ৰসাদ একা বসেছিল। মিস্টার ব্রাউন বললেন, আমাদের এই তরুণ বন্ধু চা খাবেন। মেয়েরা রান্নাঘরে। আমি আমার পানীয় খাচ্ছি। ওকে?
মিস্টার ব্রাউন তাঁর বোতল নিয়ে আসার আগেই এলিজাবেথ বেরিয়ে এলেন, তাঁর হাতে একটি বিদেশি মদের বোতল, মিস্টার ব্রাউন, আজ আমার অনুরোধ রাখতেই হবে। কাল সকালে নতুন বাড়িতে চলে যাব। এই বস্তুটি আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। যদিও আমি বেশি মদ্যপান পছন্দ করি না তবু আজ এটাকে খুলতে হবে।
মিস্টার ব্রাউন বললেন, স্কচ আমার ভাল লাগে না।
ভাল না লাগলেও অনেক কাজ করতে হয় আমাদের।
বেশ।
দিশি চোলাই মদের বদলে বিলিতি স্কচ হুইস্কি খেতে হচ্ছে বলে মিস্টার ব্রাউনের মুখ করুণ হয়ে উঠল। তিনি গ্লাসে সামান্য পানীয় ঢেলে জল না মিশিয়ে একটা চুমুক দিলেন, স্কটল্যান্ডের গন্ধ।
সিমি চা আর প্যাটিস নিয়ে এল, আমিও ভেবেছিলাম তুমি আসবে না। কিন্তু তোমার বন্ধু বলেছিল কথা দিয়েছে যখন আসবেই।
সায়ন হাসল। ওরা একটা টেবিলের চারপাশে বসেছিল। প্যাটিসে কামড় দিয়ে এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা লেপচারাও কি নেপাল থেকে এসেছে?
বিষ্ণুপ্ৰসাদ চায়ে চুমু দিয়ে বলল, না ম্যাডাম। এইসব পাহাড়ে আমরা হাজার হাজার বছর ধরে আছি। এখন যেটা সিকিম এবং দার্জিলিং, আমাদের পূর্বপুরুষদের বাস ছিল এখানেই। লেপচাদের দৃঢ় ধারণা, তারা ভগবানের সন্তান। গল্প আছে, প্রথম লেপচা মানব-মানবী ফোডোংথিঙ্গ এবং ন্যাজাত্তঙ্গুকে ভগবান তৈরি করেছিলেন কাঞ্চনজঙ্গার চূড়ায় যে পবিত্র তুষার জমেছিল সৃষ্টির প্রথম দিনে, তাই দিয়ে। তারপর তিনি ওদের পাঠিয়ে দিলেন কাঞ্চনজঙ্গার পায়ের তলার পাহাড়ে পাহাড়ে যেখানে সরল, পবিত্র জীবনযাপন করতে পারবে। এই জন্যে লেপচারা দাবি করে তারা হল ঈশ্বরের সন্তান।
এলিজাবেথ মন দিয়ে শুনছিলেন। বিষ্ণুপ্ৰসাদ থামলে জিজ্ঞাসা করলেন, ভগবান আদম ইভকে সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু সেটা মানুষের বিশ্বাস, ইতিহাস নয়। কিন্তু ধরে নিচ্ছি লেপচারা সিকিম এবং দার্জিলিং-এর আদি বাসিন্দা। সিকিম এখান থেকে কত দূরে?
খুব কাছে।
কিন্তু ওই গল্প ছাড়া অন্য কোনও প্রমাণ আছে?
নিশ্চয়ই। মানুষ যেখানে বাস করে তার নামকরণ তারাই করে থাকে। এই পাহাড়ের প্রায় প্রতিটি জায়গার নাম লেপচারা দিয়েছিল তাদের ভাষায়।
যেমন?
তার আগে একটা কথা বলা দরকার। লেপচা শব্দটা ব্রিটিশরা ভুল উচ্চারণ করায় তৈরি হয়ে যায়। আজ সবাই লেপচা বলছে আমাদের, আমরাও বলি, কিন্তু মূল শব্দটা হল ল্যাপচে। আমাদের এই নামকরণ করেছিল নেপালের মানুষরা। ল্যাপ মানে কথা, চে মানে নির্বোধ। ল্যাপচে হল যে নির্বোধের মতো কথা বলে থাকে। যদিও শব্দটা পবিত্র নেপালি পরিভাষায় আছে কিন্তু এটা ব্যবহৃত হয়েছিল ঠাট্টা করার জন্যে। লেপচারা সরল বলে বেশি কথা বলত। যেমন আমি।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ হেসে উঠতেই সবাই হাসল।
সিমি জিজ্ঞাসা করল, কাঞ্চনজঙ্গার আসল নাম কী ছিল?
মিস্টার ব্রাউন জবাব দিলেন, খাঙ্গচেন জোঙ্গা।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ মাথা নাড়ল, না স্যার। টিবেটিয়ানরা এদেশে এসে ওই নামকরণ করেছিল। যেমন ভুটিয়ারা বলত, কুভেরা। কাঞ্চনজঙ্গার আসল নাম ছিল কিংসুম জ্যাওঙ্গবু ছু। যার মানে হল পবিত্র শিখরের শীর্ষবিন্দু। সূর্যের প্রথম এবং শেষ আলো যখন কাঞ্চনজঙ্গার ওপর পড়ে তখন যে লাল এবং সোনালি দ্যুতি তৈরি হয় তার দিকে তাকালে ভগবানকে প্রত্যক্ষ করা যায়। লেপচারা বিশ্বাস করত এই কথা।
এলিজাবেথ একটা ডায়েরি নিয়ে এসে শব্দটা লিখতে চাইলেন, বানানটা বলবেন। কাঞ্চনজঙ্গার লেপচা নাম?
মিস্টার ব্রাউন বললেন, যতদূর মনে হচ্ছে এইরকম, Kingtsoom Zaongboo Choo। ঠিক বললাম তো?
বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, বানানটা ঠিক হল কিনা আমি জানি না। আমি আমার বাবার কাছে এই সব শুনেছি। কিন্তু আপনি একজন নেপালি হয়ে এই খবরগুলো রাখেন?
আমার একজন লেপচা বন্ধু ছিলেন। তাঁর নাম কে পি তামসাং। তিনি একটা লেখা পড়তে দিয়েছিলেন। আচ্ছা, আমি তখন থেকে ভাবছি, তোমার নাম বিষ্ণুপ্রসাদ কেন? লেপচারা তো এমন হিন্দু নাম রাখে না!
ঠিকই বলেছেন। আমাদের উপাধি হল র্যাপগে। আমাদের পূর্বপুরুষ ডুনো র্যাপগে ব্রিটিশ আর্মির সঙ্গে লড়াই করে নিহত হন। আমার মা মারা যান যখন আমি মাত্র পাঁচ মাসের। সেই সময় প্রতিবেশী একটি নেপালি পরিবারের সঙ্গে আমাদের সদ্ভাব ছিল। সেই বাড়ির একটি মেয়েকে বাবা বিয়ে করেন। সেই মা এসে আমার নামকরণ করেন বিষ্ণুপ্রসাদ। এর জন্যে আমাদের অন্যান্য লেপচা-আত্মীয়রা বাবাকে ত্যাগ করেছেন। বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল।
এলিজাবেথ এই গল্পে উৎসুক ছিলেন তিনি জানতে চাইলেন, আচ্ছা, দার্জিলিং কি নেপালি শব্দ?
না ম্যাডাম। নেপালি শব্দ হওয়ার কোনও কারণ নেই। লেপচায় বলা হত দ্যাৰ্জুল্যাং। তার মানে হল পৃথিবীর স্বর্গ। পরে সিকিমের রাজা টেন্ড্যান নামগেল চৌরাস্তার ওপর এক মনাস্টোরি তৈরি করে নামকরণ করলেন, দোরজেলিং। এর মানে হল বজ্রপাতের জায়গা।
বেশ। দোরজেলিং থেকেই দার্জিলিং হয়েছে? এলিজাবেথ লিখছিলেন।
হ্যাঁ। কিন্তু কীভাবে হয়েছে তা অনেকেই জানে না।
কীভাবে?
আঠারো শো সতেরো এবং আঠারো শো পঁচিশ সালে সিকিম এবং নেপালের সীমান্ত নিয়ে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। ব্রিটিশ সরকার নাক গলায়, জে ডব্লু গ্র্যান্ট এক সাহেবকে বিরোধ মেটাতে পাঠায়। গ্রান্ট সাহেব দার্জিলিং-এ পৌঁছে এর সৌন্দর্য দেখে চমকে যান এবং ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলকে অনুরোধ করেন দার্জিলিং দখল করতে। তাঁর মতে স্বাস্থ্যাবাসের পক্ষে ওই পাহাড়ি জায়গাটি অতীব মনোহর। তা ছাড়া সিকিম তিব্বত নেপাল এবং ভুটানের ওপর ওখান থেকে কড়া নজর রাখা সম্ভব হবে। সিকিমের রাজাকে ব্রিটিশ সরকার চাপ দিতেই তিনি কোনও শর্ত ছাড়াই মাত্র তিনশো পাউন্ডের বিনিময়ে দার্জিলিং ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে গেলেন। ভেবে দেখুন, লেপচাদের পবিত্রভূমি তাদের অনুমতি ছাড়াই সিকিমের রাজা সম্পূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশের হাতে তুলে দিলেন। ব্রিটিশ সরকার দার্জিলিং-এর অধিকার নিয়ে চৌরাস্তার মোড় থেকে মস্টোরি উঠিয়ে নীচের ভুটিয়া বস্তিতে পাঠিয়ে দিল। তারপর তারা লেপচা শব্দটাকে বাতিল করে নাম রাখল দার্জিলিং। এরও পরে যখন নেপালি উদ্বাস্তুরা এদেশে এল তারা নামটাকে ছোট করে বলতে লাগল, দার্লিং। যদিও এই নাম তেমনভাবে স্বীকৃত হল না। বিষ্ণুপ্ৰসাদকে যেন কথা বলার নেশায় পেয়েছিল। সে বলল, একটু নীচে যে শহরটাকে কার্সিয়াং বলে সকলে জানে তার লেপচা নাম ছিল কার্সঙ্গ। নেপালিরা ভুল উচ্চারণ করত, খাসাং। ব্রিটিশরা তাদের সুবিধে অনুযায়ী বলল কার্সিয়াং। কার্স শব্দের মানে হল, শুকতারা। অথবা সূর্য ওঠার আগে আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা। কালিম্পং শহরটার কথা ভাবুন। ওর মুল লেপচা নাম ছিল ক্যালেনপাঙ্গ। পরে নেপালিরা উচ্চারণ করল কালেবু। তিব্বতিরা বলল কাবু। আর ব্রিটিশরা উচ্চারণ করল কালিম্পং। পাহাড়ের নীচে দার্জিলিং জেলার সবচেয়ে বড় শহরটার নাম হল শিলিগুড়ি। শব্দটা বাংলা বা নেপালি নয়, লেপচা। মূল শব্দ হল, শ্যালিগ্রি। যার অর্থ ধনুকে ছিল রাও। পরে নেপালিরা উচ্চারণ করল শিলিগিড়ি, ব্রিটিশরা বলল, শিলিগুড়ি।
সায়ন চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। সে জিজ্ঞাসা করল, ধনুকে ছিলা পরাও শুনে মনে হচ্ছে ওখানে খুব যুদ্ধ হয়েছিল! তাই কী?
হ্যাঁ। আঠারো শো ছাব্বিশ সালে সিকিমের রাজা শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ব্রিটিশ আর্মিকে পাহাড় থেকে তাড়িয়ে সমতলে নিয়ে আসে লেপচা সৈন্যরা। প্রচুর ব্রিটিশ সৈন্য মারা যায় কিন্তু লেপচাদের মাত্র একজন শহিদ হন। তিনি আমার পূর্বপুরুষ ডুনো র্যাপগে। ওই যুদ্ধে তিনি একা বিষাক্ত তিরের সাহায্যে প্রচুর শত্রুকে নিহত করেন। লেপচা সৈন্যরা সমতলে নেমে এসে দেখে ব্রিটিশরা আবার যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসছে। লেপচা কমান্ডার আদুপ দোলে চিৎকার করে তাঁর সৈন্যবাহিনীকে নির্দেশ দেন, শ্যালিগ্রি! অর্থাৎ ধনুকে ছিলা পরাও। সেই যুদ্ধে লেপচাদের ব্রিটিশের আধুনিক অস্ত্রের কাছে হার মানতে হয়েছিল বটে কিন্তু পরবর্তীকালে আর যুদ্ধ হয়নি। যে-জায়গায় আদুপ দোলে চিৎকার করে শ্যালিগ্রি বলেছিল সেই জায়গাটাই এখন শিলিগুড়ি বলে পরিচিত। বিষ্ণুপ্ৰসাদ থামল, এসব আমার শোনা কথা।
মিস্টার বললেন, আমার মনে পড়ছে। ঠিক এই সব কথাই আমি কে পি তামসাং-এর লেখায় পড়েছিলাম।
এলিজাবেথ বললেন, একটা বেসিক প্রশ্ন করছি, নেপালিরা তা হলে দার্জিলিং-এর আদিবাসী নন। লেপচারাই সেই দাবি করতে পারেন।
বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, ব্যাপারটা এত সরল নয়। আমি শুনেছি এখনকার বাঙালিরা পশ্চিমবাংলার আদি বাসিন্দা নয়। তারা এসেছিল বাইরে থেকে। সায়ন এ ব্যাপারে কিছু জানো?