সেই প্লাবনে
সব স্বপ্ন পূরণ হয়না মানুষের, সেকথা সত্যি। কিন্তু তা যে আবার এমন বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়ে উঠতে পারে ,সেকথা জানা ছিল না অমিতার।
সমুদ্র নিয়ে অমিতার মনে বেশ একটা রোম্যাণ্টিক ভাবনাই ছিল বলতে গেলে । আসলে ঐ ভাবনাটা এসেছিল দুবছর আগে ছাব্বিশে জানুয়ারি রজতের সঙ্গে পুরী গেছিল, সেই তখন থেকেই। সমুদ্র সৈকতে ঝিনুক কুড়িয়ে বেড়িয়েছে কোনদিন , কখনো আবার পায়ের পাতা জলে ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। শিরশিরে একটা অনুভূতিতে হয়েছে রোমাঞ্চিত। পায়ের তলার বালি গুলো সুড়সুড় করে সরে সরে যাচ্ছিল আর ততই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল সে। দেখেছিল মাছ ধরা ডিঙিগুলোকে, কেমন ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে এগিয়ে আসে । সেই তখন থেকেই অমিতা স্বপ্ন দেখত সমুদ্রের ঢেউয়ের তালে তালে দুলতে দুলতে এগিয়ে যাচ্ছে সে ।
তাই বলে সেই স্বপ্ন যে তার এমন করে সত্যি হবে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারে নি অমিতা।
ভয়ঙ্কর এই ঘূর্ণাবর্ত কোথায় নিয়ে আছড়ে ফেলবে তাকে, আতঙ্কে দিশাহারা অমিতা ভাবতেই পারছে না, আসলে ভাববার মতো মনের অবস্থা তার আর নেই।
রজতের সঙ্গেই এসেছিল দীঘায়,সেটাও অমিতার ইচ্ছেতেই। রজত স্ত্রীকে ভালোই চেনে। বাধা দিয়ে লাভ নেই জানে তাই ব্যাগ গুছিয়ে সঙ্গী হয়েছিল।
সতর্ক বার্তাও শুনেছিল হোটেলের ঘরে বসেই । তবুও রোমাঞ্চকর অভিযানের খোঁজে সকলের চোখ এড়িয়ে দুজনেই বেরিয়ে এসেছিল পায়ে পায়ে।
ঘুরপথে এসে দাঁড়িয়ে দূর থেকেই দেখছিল সমুদ্রের বিশাল বড়ো বড়ো ঢেউগুলো সবেগে আছড়ে পড়ছে। ছাতা আড়াল করে কয়েকটা ছবি তুলছিল, কী যে হলো হঠাৎ করে একটা বিশাল বড়ো ঢেউকে এগিয়ে আসতে দেখল, তারপরেই সব অন্ধকার! অমিতা এখন জলের তলায়, একবার ডুবছে একবার ভেসে উঠছে । হাতটা তুলতে চেষ্টা করলো ভীষন ভারী! একটা কোনোকিছুর সঙ্গে আটকে আছে। ভাসতে ভাসতে কতদূর চলে এসেছে বুঝতে পারছে না। এখানে জলোচ্ছ্বাস ততটা প্রবল নয়।একটু থিতু হতেই মনে হলো রজতের কথা ।সে কোথায়!
দেখলো তার হাত আটকে গেছে একটা বড়ো গাছের গুঁড়ির সঙ্গে,শুধু হাত নয় তার পুরো শরীরটাই এখন গাছের ডালপালা গুলোর সঙ্গে একসাথে ভাসছে। গাছের সঙ্গে না আটকে থাকলে সে এতক্ষণে জলের তলায় পৌঁছে যেত। রজতের খোঁজে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে।
এতক্ষণে নজর পড়ে ঐ গাছেরই একটা মোটা ডাল আঁকড়ে ধরে ভাসছে রজত।
এভাবেই ভেসে যাচ্ছে দুজনে। কতক্ষণ কে জানে!বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে সমানে, অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। অমিতার পাশদিয়ে সম্ভবতঃ একটা সাপ পেরিয়ে গেল। সমস্ত শরীর ভয়ে শিরশির করতে থাকে। কোন কিছুর পচা দুর্গন্ধে গা ঘুলিয়ে উঠছে। বমি পাচ্ছে,ভীষণ বমি পাচ্ছে অমিতার।
তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে , বড়ো অবসন্ন লাগছে, শরীর সায় দিচ্ছে না। এ জল তো এত নোংরা বলার নেই। রজতও বুঝতে পারছে অমিতা আর পারছে না। কী করবে সে!
যে করেই হোক অমিতার কাছে ওকে পৌঁছতেই হবে!
এক হাতে ডালটা ধরে হাত বাড়িয়ে অন্য ডাল ধরে আস্তে আস্তে পা ঘষে ঘষে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।
অমিতার কাছে গিয়ে ওর হাতের উপর হাতটা রাখতেই চমকে ওঠে রজত। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে যে! অমিতার মুখে কেমন একটা ম্লান হাসির রেখা ফুটে উঠে পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়। কী করবে ভাবতে পারে না রজত, এই প্রথমবার নিজেকে ওর বড্ড অসহায় বলে মনে হয়। অমিতার শরীরটা কেমন যেন শিথিল হয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে না! না না এ তার মনের ভুল, সেরকম কিছু হতেই পারে না অমিতার !
অমিতাকে অচৈতন্য দেখে ভয়ে আতঙ্কে একেবারে দিশাহারা হয়ে যায়, সব শেষ হতে বসেছে। যেটুকু আশা ছিল…….
অমিতার জ্ঞান ফেরাবে কী করে!
নিজের অবস্থান ভুলে তাকে দু হাতে ধরে ঝাঁকুনি দিতে যায় আর হাত ফসকে একবারে অথৈ জলে। মুহুর্তের মধ্যে প্রবল জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল তাকে ।
অচৈতন্য অমিতা এসব কিছুই জানতে পারলো না! গাছের সাথে আটকে ভয়ঙ্কর সেই জলপ্লাবনে ভেসে চললো ,একা! একেবারে একা!