Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভোলাকে ভোলা যাবে না কিছুতেই || Anish Deb

ভোলাকে ভোলা যাবে না কিছুতেই || Anish Deb

ভোলাকে কিছুতেই ভুলতে পারা যাবে না। তার মানে এমন নয় যে, আমি ওকে ভুলতে চেষ্টা করেছি। বরং এটাই আমি সাদাকালোয় জানাতে চাই, ওকে ভুলে যাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। ও এমন সব কাণ্ড করেছিল যে, এই তিরিশ-বত্রিশ বছরেও ওর ছবিটা এতটুকু মলিন হয়ে যায়নি।

অনেকে ভাবতে পারেন, এ আর এমনকী! অনেক আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবকেই তো আমরা চিরদিন মনে রাখি! তা হলে ভোলাকে ভুলতে না পারার মধ্যে আশ্চর্যের কী আছে!

আছে এই কারণেই যে, ভোলা মানুষ নয়–রোবট।

এইবার বলুন, আজকের এই কলকবজার যুগে একটা যন্ত্রের কথা এতবছর ধরে কেউ মনে রাখতে পারে–যদি না সেই যন্ত্রের মধ্যে অদ্ভুত কিছু থাকে।

আজ সেই ভোলার কথাই বলব।

খুব ছোটবেলায় আমার মা মারা গিয়েছিল। আমার বাবা যখন আমাকে নিয়ে বেজায় হিমশিম খাচ্ছে, তখনই এশিয়া রোবোটিক্স কোম্পানি থেকে ভোলাকে নিয়ে আসে। ভোলা ছিল ভি. এক্স থ্রি মডেলের ডোমেস্টিক কম্প্যানিয়ান রোবট, অর্থাৎ, গৃহস্থের উপযুক্ত সঙ্গী রোবট।

এসব কথা আমি বড় হয়ে বাবার কাছে শুনেছি।

ছোটবেলা থেকেই ভোলাকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়াটা আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। একবারের জন্যেও মনে হয়নি ও যন্ত্রদাস কিংবা রোবট।

ভোলার চেহারায় চোখে পড়ার মতো আলাদা কিছু ছিল না। ও যে আসলে কী, সেটা ওকে দেখে একটুও বোঝা যেত না। তবে চলাফেরা কথাবার্তায় ব্যাপারটা আঁচ করা যেত।

ভোলার মাথায় কদমছাঁট চুল। মুখটা গোল ধরনের। চোখজোড়া সবসময়েই ছানাবড়া যেন কোনও কিছু দেখে অবাক হয়ে গেছে। গায়ে রংচঙে হাফশার্ট, পায়ে ডোরাকাটা পাজামা। হাত পাগুলো সরু-সরু হলেও তেমন বেমানান নয়। আর উচ্চতা ছিল চার ফুট।

ভোলার সঙ্গে খেলাধুলো করে আমার দিব্যি সময় কাটত। খেলতে-খেলতে আমি একসময় হাঁফিয়ে পড়তাম, ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। ধপাস করে বসে পড়তাম মেঝেতে।

ভোলা কিন্তু মোটেই ক্লান্ত হত না, হাঁফাত না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছানাবড়া চোখে আমাকে দেখত। তারপর জিগ্যেস করত, কী হল, ভাইটি, আর খেলবে না?

আমি বলতাম, না, ভোলা, ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। তোমার লাগছে না?

না, গো–আমার টায়ার্ড হওয়ার জো নেই।

আমি অবাক হয়ে ভোলাকে দেখতাম। ভাবতাম, মানুষের চেয়ে যন্ত্রই ভালো ইচ্ছেমতন যতক্ষণ খুশি খেলতে পারে।

প্রথম-প্রথম ভোলাকে আমি ভোলাদা বলতাম। কিন্তু বাবা একদিন শুনতে পেয়ে আমাকে বারণ করল? কী বলছ, সন্তু! রোবট আবার দাদা কীসের! ওকে তুমি নাম ধরেই ডাকবে–যেমন আমি ডাকি।

ভোলা কিন্তু বরাবর আমাকে ভাইটি বলেই ডাকত।

আমরা দুজনে সমসময় একসঙ্গে থাকতাম। বাবা অফিসে বেরিয়ে গেলে ভোলার কাছে আমাকে নিশ্চিন্তে রেখে যেত।

আমার স্কুলে যাওয়ার সময় হলেই ভোলা আমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোত। বড় রাস্তা পার করে বাস ধরে আমাকে পৌঁছে দিত স্কুলে। তারপর সারাক্ষণ স্কুলের বাইরে একটা গাড়িবারান্দার নীচে বসে অপেক্ষা করত।

স্কুল ছুটি হলে আবার আমাকে আগলে নিয়ে আসত বাড়িতে।

ওকে নিয়ে সবচেয়ে ঝামেলা হত পরীক্ষার সময়। সবসময় কানের কাছে বলত, ভালো করে পড়ো, ভাইটি, ভালো করে পড়ো৷ বাবা যত না বলত তার চেয়ে অনেক বেশি বলত ভোলা। পড়তে-পড়তে যখন আমি ঘুমে ঢুলে পড়তাম তখন ভোলা আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকত : ভাইটি, লক্ষ্মী আমার, ঘুমিয়ো না। কাল যে পরীক্ষা।

আমি চোখ ডলে ঘুম তাড়িয়ে আবার পড়তে শুরু করতাম। কিন্তু খুব রাগ হত ভোলার ওপর। বলতাম, তোমার কি কখনও ঘুম পায় না!

ভোলা হাসত। হাসলে ওর ঠোঁটটা সামান্য চওড়া হত। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত, ঘুম পেলে আমাদের চলে না, ভাইটি।

অনেকসময় এমন হয়েছে যে, ইতিহাস পড়তে-পড়তে ভীষণ বিরক্ত হয়ে চটাস শব্দে বই বন্ধ করে ফেলেছি ও দুর, কিচ্ছু মুখস্থ হতে চাইছে না! বারবার ভুলে যাচ্ছি।

ভোলা তখন বইটা আমার হাত থেকে টেনে নিয়েছে : কই, আমায় বইটা দাও দেখি! কোন জায়গাটা বলো তো…।

ওকে পৃষ্ঠাগুলো দেখিয়ে দিয়ে বলেছি, শুধু সাল-তারিখ আর গুচ্ছের রাজা-বাদশার নাম! এসব কখনও সহজে মুখস্থ হয়!

ভোলা পৃষ্ঠাগুলোর দিকে দু-পলক তাকাল, তারপর বইটা বন্ধ করে বলল, নাও, তুমি এবার চোখ বুজে শুনে যাও। একমনে শুনবে কিন্তু…।

ব্যস! ভোলা গড়গড় করে পৃষ্ঠাগুলো মুখস্থ বলে যেত আমার কানের কাছে। আর আমি ওর তাকলাগানো ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে যেতাম। ওর মুখে শুনতে-শুনতে ইতিহাসের পড়া দিব্যি মুখস্থ হয়ে যেত।

আমি ভোলাকে বলতাম, আমার বদলে তুমি পরীক্ষা দিলে রেজাল্ট অনেক ভালো হত।

ভোলা প্রতিবাদ করে বলত, না, ভাইটি, আমি ফেল করতাম। কোথা থেকে কোন পর্যন্ত লিখতে হবে সেটাই তো আমি বুঝতে পারি না!

তা হলে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে আমি পরীক্ষা দেব।

আমার এই অদ্ভুত বায়না শুনে ভোলা হেসে বলত, ভাইটি, এভাবে পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করার মধ্যে কোনও আনন্দ নেই।

আমি ওর কথাটা মন দিয়ে ভাবতাম। এতসব ও বোঝে কেমন করে!

আমার সঙ্গী হয়ে সময় কাটানো ছাড়াও কিছু-কিছু বাড়তি কাজ ভোলাকে করতে হত। যেমন, বাবার ফাইফরমাশ খাটা, দোকানে যাওয়া, টেলিফোন কিংবা ইলেকট্রিকের বিল জমা দিয়ে আসা– এইসব। কিন্তু এত কাজ করেও ভোলাকে কখনও বিরক্ত বা ক্লান্ত হতে দেখিনি। ওকে যদি জিগ্যেস করতাম, এত কাজ করতে করতে কখনও তোমার বিরক্ত লাগে না? তা হলে ও হয়তো হেসে বলত, বিরক্ত হলে আমাদের চলে না, ভাইটি।

আমার দেখাদেখি ভোলা বাবাকে বাবা বলেই ডাকত। বাবার অফিসের ব্যাগটা হাতে তুলে দিত, জুতো পালিশ করে দিত, বাবা কখন অফিস থেকে ফিরবে জিগ্যেস করত, সাবধানে যাতায়াত করার জন্যে পরামর্শ দিত।

ওর কাণ্ডকারখানা দেখে বাবা মাঝে-মাঝে আমাকে বলত, একটা ডোমেস্টিক কম্প্যানিয়ান রোবটের কাছ থেকে এত সার্ভিস পাব ভাবিনি।

আমি কোনও জবাব দিতাম না। তবে ভোলার সঙ্গে রোবট, সার্ভিস, এই শব্দগুলো জুড়ে কথা বলাটা আমার ভালো লাগত না।

একদিন আমরা তিনজনে ইভনিং শো-তে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম আমি, বাবা, আর ভোলা। ছবিটার নাম দ্য সাউন্ড অফ মিউজিক। ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে আর নাচ-গান নিয়ে দারুণ জমাটি ছবি। হল থেকে বেরোনোর সময় হঠাৎই শুনলাম ভোলা গুনগুন করে গান গাইছে : ডো আ ডিয়ার, আ ফিমেল ডিয়ার/রে আ রে অফ গোল্ডেন সান/ মি আ নেম আই কল মাইসেলফ…।

আমি জিগ্যেস করলাম, ভোলা, ছবি কেমন লাগল?

ভোলা বলল, দারুণ! যদিও পুরোপুরি বুঝতে পারিনি।

বাবা হেসে বলল, যাক, ভোলা অন্তত সত্যি কথাটা বলেছে!

আমি বললাম, রোবটরা মিথ্যে কথা বলে না, বাবা।

ফেরার পথে হঠাৎই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তখনও আমরা একটা খালি ট্যাক্সি জোগাড় করতে পারিনি। ছাতা সঙ্গে না থাকায় ফুটপাথের ধার ঘেঁষে একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে কোনওরকমে মাথা বাঁচাতে চেষ্টা করছি।

হঠাৎই একটা বিশাল অফিসবাড়ির আড়ালের এক অন্ধকার কোণ থেকে তিনটে ছায়া এগিয়ে এল আমাদের দিকে। মাথায় কঁকড়া চুল। পরনে টি-শার্ট আর চোঙা প্যান্ট।

খুব কাছাকাছি এসে একটা ছেলে বাবাকে লক্ষ্য করে বলল, দাদা, ফুলকি হবে, ফুলকি?

বাবা থতোমতো খেয়ে বলল, ফু-ফুলকি…মানে?

তখন পাশ থেকে তার এক সঙ্গী কড়া মেজাজে মন্তব্য করল, আরে ফুলকি মানে আগুন– সালা ন্যাকাষষ্ঠী! একটা সিগারেট কোথা থেকে বের করে ঠোঁটে রাখল সে।

এইবার বাকি দুজন বাবার দু-পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলল, মালকড়ি যা আছে ঝটপট দিয়ে দে।

তিননম্বর ছেলেটা একটা ক্ষুর বের করে বাবার গলার পাশটায় চেপে ধরল।

আমার তো গলা শুকিয়ে কাঠ। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠছিল। কিন্তু শত চেষ্টা করেও গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বের করতে পারছিলাম না। তা ছাড়া, কাছাকাছি এমন কাউকে চোখেও পড়ল না যে আমাদের বিপদে এগিয়ে আসবে।

হঠাৎই ভোলা দিব্যি স্বাভাবিক গলায় আমায় বলল, ভয় পেয়ো না, ভাইটি। দেখছি কী করা যায়। তারপর ছেলেগুলোকে লক্ষ্য করে ঠান্ডা এবং শান্ত গলায় বলল, বাবাকে ছেড়ে দাও।

তা হলে তোমাদেরও আমি ছেড়ে দেব।

বাবা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ছেলে তিনটে খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ল।

একজন পেটে হাত চেপে হাসতেহাসতে খানিকটা কুঁজো হয়ে গেল। তারপর কোনওরকমে হাসির দমক কমিয়ে বলল, লে, চারফুটিয়া কী বলছে শোন। তারপর বাচ্চাদের আধো-আধো উচ্চারণে ব্যঙ্গ করে বলে উঠল, ওলে বাবা! বিলাট মাছতান এচে গ্যাচে! পালা, পালা, ছিগিল পালা!

কথা বলতে বলতে ছেলেটা ভোলাকে লক্ষ্য করে লাথি চালিয়েছে। ভোলা কিন্তু নড়ল না– চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। লোহার সঙ্গে মানুষের পায়ের সংঘর্ষ হল। আর সঙ্গে-সঙ্গে বিকট চিৎকার করে ছেলেটা বসে পড়ল রাস্তায়। ডান পা-টা চেপে ধরে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল, আর কাটা ছাগলের মতো ছটফট করতে লাগল।

ক্ষুর হাতে ছেলেটা ভোলার মুখ লক্ষ করে অস্ত্রটা চালাল। ভোলা বাঁ-হাতে ওর ডানহাতটা খপ করে ধরে ফেলল। এবং ডানহাতে একটা মামুলি থাপ্পড় বসিয়ে দিল ছেলেটার গালে।

থাপ্পড়ের শব্দ কিংবা ফলাফল কোনওটাই মামুলি হল না।

ছেলেটার মুণ্ডুটা প্রায় নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গেল। গাল ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল। চোয়ালের হাড়ও সরে গেল বোধহয়। ও ছিটকে পড়ল রাস্তায়।

তিন নম্বর ছেলেটা ভীষণ বুদ্ধিমান। তাই ও চোখের পলকে বৃষ্টিভেজা রাস্তা ধরে ছুট লাগাল।

খুব অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো ঘটনা আমাকে আর বাবাকে একরকম হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল। আমরা যেন আবার সিনেমা দেখছিলামযার নায়ক চারফুট উচ্চতার একটি নিরীহ গেরস্থালি রোবট।

আমাদের মাথা কাজ করছিল না। বুঝতে পারছিলাম না, থানায় যাব, নাকি অকুস্থল থেকে সরে পড়ব।

সমস্যাটার সমাধান করে দিল ভোলা।

একটা চলন্ত ট্যাক্সিকে চট করে হাত দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। রাস্তায় পড়ে থাকা ছেলে দুটোকে দেখিয়ে বলল, এইমাত্র চারটে গুন্ডা এই ছেলে দুটোকে মারধোর করে পালিয়ে গেল। এক্ষুনি হয়তো গণ্ডগোল শুরু হয়ে যাবে। আমাদের একটু হেল্প করুন–শিগগির এখান থেকে নিয়ে চলুন, ভালো বকশিশ দেব।

বাড়িতে ফিরে ধাতস্থ হতে আমাদের বেশ কিছুটা সময় লাগল। তারপর বাবা ভোলাকে বলল, অতটা বাড়াবাড়ি করা তোমার ঠিক হয়নি। যদি এরপর পুলিশের ঝামেলা হয়?

আমি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালাম। ভোলা মারাত্মক বিপদে আমাদের বাঁচাল, আর বাবা বলছে বাড়াবাড়ি!

ভোলা গায়ের জামাটা ঠিকঠাক করতে করতে বলল, ঝামেলা কিছু হবে না, বাবা। দেখবে, ওই ছেলেগুলোর নিশ্চয়ই পুলিশের খাতায় নাম আছে।

বাবা যা-ই বলুক, আমার কেন জানি না মনে হচ্ছিল, ভোলার কাছে আমাদের ঋণ থেকে গেল। বাবাকে এসব কথা কিছু বলিনি। কারণ, বললেই বাবা হয়তো বলে বসবে, রোবটের কাছে আবার ঋণ কীসের! যতসব আজগুবি ভাবনা!

এর কয়েকমাস পর বাবা বাড়িতে একটা কম্পিউটার কিনে নিয়ে এল। তারপর থেকেই বাবা ওই যন্ত্রটা নিয়ে মশগুল হয়ে গেল। সময় পেলেই শুধু কম্পিউটারের কি-বোর্ড নিয়ে মেতে ওঠে। আর আমাকেও একটু-আধটু শিখিয়ে দেয়।

তখন থেকে বাবা প্রায়ই আপনমনে বিড়বিড় করে, ভোলাটার যদি ঘটে আর-একটু বুদ্ধি থাকত তা হলে ওকে কম্পিউটারে বসিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নিতে পারতাম।

বাবা কিন্তু ভোলাকে দিয়ে কম্পিউটার চালানোর চেষ্টা করতে ছাড়েনি। তবে হলে হবে কী, ভোলা মেশিন ছেড়ে উঠে চম্পট দিতে পারলেই বাঁচে! ও আমাকে আড়ালে বলত, ভাইটি, সবাইকে দিয়ে কি সব কাজ হয়!

আমি ওর কথা শুনে হাসতাম।

একদিন রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে একথা সে কথা বলতে বলতে বাবা হঠাৎই ভোলার প্রসঙ্গ তুলল।

ভোলার নানান কাজ নিয়ে, কাজের খুঁত নিয়ে কয়েকটা মন্তব্য করল বাবা। তারপর ও কম্পিউটার চালাতে পারে না, আধুনিক যুগের কাজের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না, এইসব বলে বেশ বিরক্তি দেখাল।

ভাগ্যিস ভোলা তখন সামনে ছিল না। থাকলে আমার ভীষণ বাজে লাগত। তা ছাড়া, বাবার মুখে-মুখে আমি ঠিক কথা বলতে পারি না। তাই বাবার কথায় আমার খারাপ লাগলেও কিছু বলতে পারিনি।

হঠাৎই খেয়াল করলাম, রান্নাঘরের দিক থেকে ভোলা একগ্লাস জল নিয়ে আসছে। আমিই ওকে জল আনতে বলেছিলাম।

বাবা খাওয়া শেষ করে জলের গ্লাস হাতে নিয়ে বললেন, শোনো, সন্তু। এশিয়া রোবোটিক্স কোম্পানি একটা এক্সচেঞ্জ অফার অ্যানাউন্স করেছে। ভি. এক্স-থ্রি মডেলের রোবট আর তিরিশ হাজার টাকা দিলে ওরা ওদের লেটেস্ট কম্পিউটার কম্প্যাটিবল ডোমেস্টিক কম্প্যানিয়ান রোবট দেবে। মডেলটার নাম ভি. এক্স. আই. কিউ-ওয়ান। এই রোবটটা কম্পিউটার চালাতে তো জানেই, তা ছাড়া আরও বহু আধুনিক কাজ জানে…।

আমি বুঝতে পারছিলাম বাবা কী বলতে চলেছে। তাই মুখের মধ্যে ভাত নিয়ে শক্ত করে চোয়াল বন্ধ করে বসেছিলাম। কেমন যেন দম আটকে যাচ্ছিল আমার।

ভোলা অনেকটা কাছে চলে এসেছিল। বাবার কথা ও ঠিক কতটা শুনতে পেয়েছে বুঝতে পারলাম না। ও আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ভাইটি, এই নাও তোমার জল। গ্লাসটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল ভোলা।

বাবা মাথা ঘুরিয়ে একবার বিরক্তভাবে ভোলাকে দেখল। তারপর বলল, নাঃ, আর কোনও উপায় নেই! ভোলাকে পালটে ওই নতুন মডেলের রোবটটা নিয়ে আসতেই হবে। কাজের ভীষণ প্রবলেম হচ্ছে…।

বাবা ভোলা এক অদ্ভুত গলায় ডেকে উঠল। ওর হাত থেকে জল ভরতি গ্লাসটা খসে পড়ে গেল মেঝেতে।

আমি যেন স্লো-মোশানে কোনও সিনেমা দেখছিলাম।

জল ভরতি গ্লাসটা বাতাস কেটে পড়ছে-তো-পড়ছেই। তার মধ্যে বন্দি জল চলকে উঠে ঢেউ তুলছে। তারপর গ্লাসটা ধাক্কা খেল মেঝেতে। কাচ ভেঙে টুকরো-টুকরো হল, জল ছিটকে পড়ল চারিদিকে। জলের ফোঁটাগুলো শূন্যে লাফিয়ে উঠে হিরের কুচির মতো দেখাল। তারপর মেঝের অনেকটা ভিজে গেল। জলে মাখামাখি কাচের টুকরোগুলো এপাশ-ওপাশ ছড়িয়ে পড়ে রইল।

আমার বারবার মনে হচ্ছিল, মেঝেতে জল নয়–রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আর কাচ ভাঙার এককণা শব্দও আমার কানে ঢোকেনি। কারণ, ভোলার বুক ভাঙা বাবা! ডাকটা বারবার আমার কানে বাজছিল।

বাবা মেঝের দিকে তাকিয়ে গ্লাসটার হাল দেখে বলল, হোপলেস।

ভোলা পায়ে-পায়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

কদমছাঁট চুল, ছানাবড়া চোখ, চারফুট হাইট, অথচ ওকে দেখে এখন মোটেই হাসি পাচ্ছিল না।

বাবা, আমার মডেলটা পুরোনো বলে, তুমি আমাকে বদলে ফেলতে চাইছ!

বাবা কোনও জবাব দিল না।

ভোলা উত্তরের জন্যে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল, তারপর আবার বলতে শুরু করল, আমি যে এত বছর তোমাদের কাছে রইলাম, তোমাকে, ভাইটিকে এত যত্ন করলাম, তার কোনও দাম নেই! তুমি বলছ, বাজারে এখন অনেক ভালো মডেলের রোবট পাওয়া যাচ্ছেতাই আমাকে বদলে ফেলতে চাও। তা হলে একটা পালটা উদাহরণ তোমাকে দিই–শুনতে হয়তো তোমার খারাপ লাগবে। ভোলা একবার মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখল। তারপর ও ভাইটির বয়েসি অনেক ছেলেকে আমি দেখি যারা ভাইটির চেয়ে দেখতে ভালো, লেখাপড়ায় ভালো, অনেক গুণ আছে–মানে, অনেক ভালো মডেলের ছেলে। তা হলে তুমি কি চাইবে, ভাইটিকে বদলে আর একটা ভালো মডেলের ছেলে নিয়ে আসতে? সম্পর্কের কোনও দাম নেই তোমার কাছে?

বাবা রাগে কাঁপতে শুরু করেছিল। ভোলার দিকে আঙুল তুলে বলল, এসব কী উলটোপালটা বকছ! তোমার আর একটি কথাও আমি শুনতে চাই না।

আজ আমাকে বলতেই হবে, বাবা! জেদি গলায় বলল ভোলা, তুমি বলছ আমি অনেক কাজ পারি না। ঠিক কথা। কিন্তু অন্য অনেক কাজ তো পারি! তুমিও তো অনেক কাজ পারো না, বাবা! এটাই তো পৃথিবীর নিয়ম ও কেউই সব কাজ পারে না। তাতে তো লজ্জার কিছু নেই। এত বছর ধরে তোমাদের জন্যে যা-যা কাজ আমি করেছি সবই তো নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা করেছি। কখনও তো বিরক্ত হইনি। তা হলে বলো, আমার দোষটা কোথায়! আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাব না, বাবা।

বাবা ভোলার দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে মাথা নাড়ল ও নাঃ, একে বোঝানো যাবে না। মনে হয়, ওর ভেতরের প্রোগ্রামগুলো সব ঘেঁটে গেছে।

ভোলা আবার যখন কথা বলল ওর গলাটা কেমন ভাঙা কান্নার মতো শোনাল ও আমাকে। তুমি তাড়িয়ে দিয়ো না, বাবা। তোমাদের ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।

বাবা এবার অন্য পথ ধরল। হাত নেড়ে বেশ শান্ত গলায় ভোলাকে বোঝাতে চাইল।

শোনো, ভোলা, তুমি আসলে একটা রোবট–চাকর রোবট। তুমি আমাকে বাবা বলে ডাকো বটে, কিন্তু আমি তোমার বাবা নই, তুমিও আমার ছেলে নও। আমার মনে হয়, তোমার ভেতরের প্রোগ্রামগুলো সব গোলমাল হয়ে গেছে। তুমি একটু স্থির হয়ে..।

কী বলছ, বাবা! তুমি আমার বাবা নও! আমিও তোমার ছেলে নই!

ভোলার কথাগুলো আমাকে বিরাট ধাক্কা দিল। এই শক্ত কথাগুলো বাবা ওকে না বললেও পারত। তাই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যে আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম, প্লিজ, ভোলা, ভুল বুঝো না। তুমি ছেলে না হলে কী হয়েছে–ছেলের মতো তো বটেই! আমিও তোমার ভাইয়ের মতো…।

ভোলা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো ছিটকে ঘুরে তাকাল আমার দিকে। ওর অভিব্যক্তিহীন যান্ত্রিক চোখজোড়া যেন পলকে জ্যান্ত হয়ে উঠল। সে-চোখের দৃষ্টি থেকে ঘৃণা ঠিকরে বেরোচ্ছিল। আমি ওর চোখে বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারলাম না–চোখ সরিয়ে নিলাম।

ভোলা খুব ধীরে-ধীরে উচ্চারণ করে বলল, ভাই…এর..মতো! ছেলে…র…মতো!

তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে রইল, আমাকে আর বাবাকে বারবার দেখতে লাগল।

অবশেষে খুব আলতো গলায় বলল, সম্পর্কের তা হলে কোনও দাম নেই, ভাইটি? বুঝেছি..তোমরা আসলে মানুষ নও…মানুষের মতো…।

শেষ কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে ঘরের দরজার দিকে এগোল ভোলা। ওর চোখের নজর বোধহয় ঠিকমতো কাজ করছিল না–কারণ, ও একটা চেয়ারে ধাক্কা খেল, তারপর দেওয়ালের কোণে ওর মাথা ঠুকে গেল।

কোনওরকমে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে সদর দরজার পাশটিতে উবু হয়ে বসে পড়েছিল ভোলা। মাথাটা গুঁজে দিয়েছিল ভাঁজ করা দুটো হাতের ফাঁকে।

পরদিন বিকেলে এশিয়া রোবোটিক্স কোম্পানির গাড়ি এসে ওকে তুলে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ও একইভাবে বসে ছিল।

বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমি বেশ কয়েকবার ওকে ডেকেছিলাম। কিন্তু ও কোনও সাড়া দেয়নি। হয়তো আমাদের কথায় ওর ভেতরের প্রোগ্রামগুলো তছনছ হয়ে গিয়েছিল। হয়তো ওর ভেতরটা শর্ট সার্কিট হয়ে গিয়েছিল। কে জানে!

সেই থেকে ভোলাকে আমি কখনও ভুলতে পারিনি ভুলতে পারবও না।

ও আমাকে সবসময় মনে করিয়ে দেয়, আমি মানুষের চেয়ে একটুখানি কম। সেইজন্যেই আমি সারাটা জীবন ধরে পুরোপুরি মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে চলেছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *