Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বাল্য সখী || Mallik Kumar Saha

বাল্য সখী || Mallik Kumar Saha

বাল্য সখী

একখানা চটের বস্তা হাতে করিয়া আনিয়া মালিনী মাস্টার মশাইয়ের বাড়ীর বারান্দায় বিছাইয়া বই শ্লেট রাখিয়া পড়ায় মনোযোগ দিবার চেষ্টা করিল। দুঃখিনী মায়ের একমাত্র সন্তান। পিতার অবর্তমানে কন্যার যাবতীয় দায়িত্ব পালনের ভার আসিয়া মাতার উপর পড়িল। নিজে নিরক্ষর হইয়াও মেয়েকে সাক্ষরিত করিবার আপ্রাণ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। প্রতিবেশীর কয়েকটি বাড়ীতে ঝি-এর কাজ করিয়া এক রকম সংসার চলিয়া যায়। মালিনীর পিতার অকাল মৃত্যুতে আত্মীয়স্বজন একে একে মুখ লুকাইল। তাই বলিয়া কানন বালার আত্মশক্তি বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় নাই।

মালিনী যে শুধু একা মাস্টার মশাইয়ের কাছে পড়িতে আসিত তাহা নহে। সঙ্গে আসিত জনা কয়েক ছেলেমেয়ে। তাহাদের মধ্যে অন্তরা নামের মেয়েটির সঙ্গেই মালিনীর বড় ভাব। অন্তরা প্রায়ই তাহার প্রাণের সইকে বাড়ীতে ডাকিয়া ভাল করিয়া ফলার করাইয়া দেয়। আমবনে ছায়ার তলে গোল্লাছোট খেলিয়া, বিকালে কলসি লইয়া জল ভরিতে যাইয়া ঘাটপারে বসিয়া মনের গল্প করিতে করিতে তাহারা হাতে পায়ে বাড়িয়া উঠিল। আজকাল গুন্ডিগুন্ডি ছেলেমেয়েদের মতো সেইকালে অতি অল্প বয়সে স্কুলে যাইবার ধারাবাহিকতা ছিল না। বয়স বাড়িয়া উঠিলেও বিদ্যাশিক্ষার তাগিদ ফুরাইয়া যাইত না। তাহাছাড়া মেয়েদের বিদ্যাশিক্ষার ব্যাপারে বয়সের মাপদন্ড না রাখাই ভাল। ঘর সংসার হইতে বাহির হইয়া অভিনব চিন্তা শক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠা পাইবার লক্ষ্য গ্রাম্য পরিবেশের মধ্যে তখনও প্রবেশ করে নাই। পূজার পাঁচালী পাঠ করা ও আত্মীয়স্বজনের নিকট পত্র লিখিয়া যোগাযোগ স্থাপন করিতে পারা এই দুইটি কাজ জানিতে পারিলে ব্যবহারিক জীবনে মেয়েদের যথেষ্ট সম্মান থাকিত।

মাস্টারমশাইয়ের গ্রামের কুটিরে শহর হইতে একদা এক বন্ধুর আগমন ঘটিল। শহরের কোলাহল হইতে মনের অবস্থা পরিবর্তন করিবার উপায় হিসাবে গ্রাম্য পরিবেশের তুলনা নাই। গ্রাম্য জীবনের সরলতায় দীনেশবাবু অতিশয় আকৃষ্ট হইলেন। শহরে ফিরিবার আগে দীনেশবাবু মাস্টার মশাইয়ের কাছে মালিনী সম্পর্কে জানিতে চাহিলে তিনি বলিলেন, “একেবারে কাঁচা সোনা। আমার নিজের হাতেই গড়া। কয়েক বৎসর হইল পিতৃবিয়োগ ঘটিয়াছে। সংসারে মা ছাড়া আর কেহই নাই ।”

—মেয়েটির বংশ পরিচয় বলিতে কিছু জান কি?

যতদূর জানি, মালিনীর পিতামহ একখানা মুদি দোকান করিতেন। তাহার পর হইতে মালিনীর পিতৃদেব ঐ দোকানখানি দেখাশুনা করেন। এককালে তাহার দাদুর এই গাঁয়ে সুনাম ছিল। তাহার পর যাহা কিছু— সকলই তোমার চোখের সামনে।

— মেয়েটিকে আমার বেশ পছন্দ। একবার যোগাযোগ করিলে ভাল হইত না?

আমি বলিলে মালিনীর মা অমত করিবে না। কিন্তু তোমার বাড়ীর লোকেদের পছন্দ অপছন্দের কথা আছে। বিশেষ করিয়া আর্থিক অবস্থা তাহাদের একেবারেই জীর্ণ।

— ঐ সব আমার উপর ছাড়িয়া দাও। আশাকরি সকলেই আমার কথায় রাজী হইবে।

মাস্টার মশাইয়ের সহযোগীতায় বৈশাখের এক শুভদিনে গ্রাম্য যুবতী মালিনীর সহিত শহরে দীনেশবাবুর বিবাহ হইয়া গেল। দীনেশবাবু পিতার ব্যবসায়ের শতাংশই দেখাশুনা করেন। বহুদিন ধরিয়া এক ধনী ঘরের সুসভ্য পাত্রীর খোঁজে দীনেশবাবুর মা আশায় ছিলেন। একমাত্র ছেলেকে খুব ঘটা করিয়া বিবাহ করাইবার সকল প্রকার চেষ্টা তাহার বৃথা হইয়া গেল। শেষে কিনা এক পাড়াগাঁয়ের কাঙালীনীর মেয়ে তাহার ঘরে আসিয়া জুটিল ! আশা ও প্রত্যাশা লইয়া মনের মাঝে তিনি যে অমরাবতী রচনা করিয়া ছিলেন তাহা তাসের ঘরের মতো অচিরেই ভাঙিয়া পড়িল। পাড়া গাঁয়ের মেয়ে বলিয়া মালিনী যে দেখিতে অসুন্দরী তাহা নহে। আসলে ছেলের বিয়েতে যৌতুক বলিতে কিছুই না পাওয়ায় মনে ঈর্ষা জন্মিয়াছে। সেই হইতেই মালিনীর শতগুণ থাকা সত্ত্বেও শ্বাশুড়ির আদর-স্নেহ হইতে বঞ্চিত।

এইভাবেই বিবাহের প্রথম দিন হইতে নানা উপহাসের মধ্যে কয়েকটি মাস কাটিয়া গেল। মালিনী নীরবে মুখ বুজিয়া তাহা সহ্য করিয়াছে। ভাবিয়াছিল বিস্তর সম্পত্তির অধিকারিনী শ্বাশুড়ি মাতা কিছু সময় পর তাহার স্বভাবের পরিবর্তন ঘটাইয়া পুত্র বধুকে স্বীয় কন্যা রূপে স্বীকার করিয়া স্নেহের স্পর্শে জড়াইয়া রাখিবেন। কিন্তু সময়ের মতো সময় চলিয়া গেলেও তাহার প্রতি শ্বাশুড়ির রুক্ষ স্বভাবের কোন পরিবর্তন লক্ষিত হইল না। কালে কালে মালিনীর মনোকষ্ট বাড়িয়াই চলিল।

অন্যদিকে মালিনীর ছোট বেলার সই অন্তরারও সেই একই শহরে বিবাহ হইয়া গেল। খুশির খবর এই যে অন্তরার শশুরবাড়ী এক প্রাচীন বনেদি পরিবার এবং দীনেশবাবুর পরিবারের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র থাকায় সপরিবারে নিমন্ত্রণ পাইয়া সেইখানে যাইবার জন্য মালিনীর আনন্দের সীমা রহিল না। বিবাহ বাড়ীতে যাইয়া একদিকে যেমন মালিনী তাহার বাল্যসখীর সঙ্গ লাভ করিল, ঠিক অন্যদিকে তাহার শ্বাশুড়ি অন্তরার গা ভর্তি গহনা ও ঘরভর্তি আসবাবপত্র দেখিয়া জ্বলিয়া পুড়িয়া গেল।

শ্বশুরবাড়ীতে নববধূর কোনরূপ অপমান হইলে বাপের বাড়ীর লোকেরা ঢাল হইয়া দাঁড়ায়। মালিনীর ক্ষেত্রে তাহা সম্ভবপর নয়। না আছে তাহাদের অর্থবল, না আছে লোকবল। আর্থিক ভাবে বলবান না হইলে এ সমাজে চাটুকারের যে বড় অভাব। দীনেশবাবু মাতার কুরুচিকর মন্তব্যের প্রতিবাদ না করায় মালিনী অধিকতর নিঃসহায় মনে করিত।

একদা অন্তরা মালিনীর হৃদয় কষ্ট জানিতে পারিয়া সাতিশয় দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করিল। মালিনী রূপ ও গুণে অন্তরার থেকে শ্রেষ্ঠ হইয়াও এমন জীবন যাপন করিবে তাহা সে মানিয়া লইতে রাজি নয়। বিদ্যাভ্যাসে শতচেষ্টা করিয়াও সে কখনও মালিনীকে হার মানাইতে পারে নাই। সাংসারিক জ্ঞানে মালিনীর ধারের কাছেও আসিতে পারে নাই বলিয়া অন্তরাকে বহুবার মায়ের নিকট অবজ্ঞার ছেচুনি খাইতে হইয়াছে। এই সংকট কালে অস্তরা মালিনীর কাছে এক প্রস্তাব রাখিল যে তাহাদের বাড়ীর সন্নিকটে এক বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা নিযুক্ত হইবে, মালিনী ইচ্ছা করিলেই সেইখানে নিযুক্ত হইতে পারে। একেই সরকারী বিদ্যালয় — মাস ফুরাইলেই মাইনে। এই ব্যাপারে তাহার আপত্তি কি থাকিতে পারে?

মালিনী সখীর এইরূপ অভিনব প্রস্তাবে রাজী হইয়া অতি সাবধানতার সহিত সেই সরকারী চাকুরি পাইবার যাবতীয় প্রচেষ্টা চালাইল। শ্বাশুড়িকে আরও অধিক যত্ন সহকারে সেবা করিয়া মন জয় করিবার নূতন নূতন পন্থা অবলম্বন করায় শ্বাশুড়ি ভাবিলেন পুত্রবধূ একেবারে তাহার বাগে চলিয়া আসিয়াছে। কিন্তু তিনি বুঝিতে ভুল করিলেন যে অবলা প্রাণীও মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারে।

একদিন সকালবেলায় গৃহকর্ম সমাপনান্তে বেশ পরিপাটি হইয়া ঠাকুরঘর হইতে বাহির হইতেই শ্বাশুড়িমাতা আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বৌমা, কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

— মা, আমি শহরের বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষিকার চাকরি পেয়েছি। সেই চাকরিতে আজ যোগ দিতে যাচ্ছি। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করবেন।

শ্বাশুড়ি গলা চড়া করিয়া বলিল, “সে অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?”

— আমি এ বাড়ীর বউ। যে সম্পত্তির উপর ভর দিয়ে আপনি আমাকে শাসন করে চেপে রাখতে চাইছেন, সেই সম্পত্তি আমার আর দরকার নেই। শিক্ষার কালি কিছুটা হলেও আমার পেটে আছে। আপনার মতো অশিক্ষিতা ও নির্বোধ আমি নই। পাড়া গাঁয়ের অর্থশূন্য ঘরের মেয়ে হতে পারি, কিন্তু নিরীহ মানুষদের অবহেলার চোখে দেখার শিক্ষা মা আমাকে দেননি। শতকষ্ট করে, ঝড়-ঝাপ্‌টা মাথায় নিয়ে মা আমাকে যেভাবে আদর যত্ন করে মানুষ করেছেন তার মূল্য আপনার কাছে কোনদিন পাইনি। আজ থেকে আমি আপনার আর পোষাপাখী নই যে চাইলেই খাঁচায় ভরে রাখবেন। বিদ্যার শক্তিই আমাকে পথ দেখিয়েছে ; আর অধিকারও সেখান থেকেই পেয়েছি। আমি চললুম !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *