গগন-ডাক্তারের বড় ছেলে
গগন-ডাক্তারের বড় ছেলে হরিবন্ধু যে একটি গবেট তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রত্যেক ক্লাসেই এক-আধবার করে ঠেকে ঠেকে ক্লাস সেভেনে উঠে সেই যে সে অ্যালজেবরা, জিওমেট্রি, গ্রামার আর সংস্কৃতের বেড়াজালে পড়ে গেল, আর সেই জাল কেটে বেরোতেই পারে না। সেভেনেই তার বয়স তিন বছর আরও বেড়ে গেল। ছোট ভাই-বোনেরা পটাপট তাকে ডিঙিয়ে ওপরের ক্লাসে উঠে যেতে লাগল। হরির গোঁফের রেখা দেখা দিল, গালে উঠে পড়তে লাগল দাড়ি।
গগনবাবু খুবই শান্ত ও ধৈর্যশীল মানুষ। তাঁর তিন ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্যে হরিকে বাদ দিলে আর কেউই তেমন ফেলনা নয়। আহামরি না হলেও সকলেই ভাল নম্বর পেয়ে ফি বছর নতুন ক্লাসে ওঠে। মেজো ছেলে খেলাধুলোয় ভাল, দু’মেয়েরই গানের গলা চমৎকার। ছোট ছেলে বেশ সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। হরি শুধু গবেট নয়, তার আর কোনও গুণই আছে বলে মনে হয় না।
সে তিনবার সেভেনে ফেল করার পর হেডমাস্টারমশাই নলিনীকান্ত রায় একদিন গগনবাবুকে ডেকে খুব ভদ্রভাবেই বললেন, “ডাক্তারবাবু, আপনি শহরের গণ্যমান্য লোক বলেই হরিবন্ধুকে এই স্কুলে এতদিন রেখেছি। আমরা এমনিতে ফেল করা ছাত্রকে রাখি না। হরিবন্ধুর জন্য এবার আপনাকে অন্য ব্যবস্থা করতেই হবে। নইলে স্কুলের রেকর্ড খারাপ হচ্ছে, ব্যাড প্রেসিডেন্স তৈরি হচ্ছে। আমরা ওকে এবারই টি সি দেব, স্কুল অথরিটি আমাদের সেবকমই অডার দিয়েছে।”
লাল টকটকে মুখ নিয়ে গগনবাবু তাঁর চেম্বারে ফিরে এলেন। চেম্বারে তখন অনেক রোগী অপেক্ষা করছে। কিন্তু গগনবাবু রাগে দুঃখে ক্ষোভে এমনই বিমনা হয়ে পড়েছেন যে, একজন রোগীর পেট টিপে পরীক্ষা করতে গিয়ে এমন আঙুলের খোঁচা দিলেন যে, সে ‘আঁক’ করে উঠল। আর-একজনের প্রেশার মাপতে গিয়ে এমন পাম্প করলেন যে, সেই রোগীর হাতে ঝিঁঝি ধরে গেল।
দুখিরামবাবুও গগনবাবুর রোগী। বিচক্ষণ প্রবীণ মানুষ। নামে দুখিরাম হলেও তিনি বিরাট বড়লোক। আট-দশরকমের ব্যবসা আছে। তিনি বিদেশেও মাল চালান দেন। এতক্ষণ তিনি চুপচাপ বসে ছিলেন। গগনবাবুর ভাবসাব দেখে তাঁর ভাল ঠেকল না। তাই তিনি তাঁর পালা এলে খাস চেম্বারে ঢুকে পড়ে গগনবাবুকে বললেন, “আপনার কি আজ মেজাজটা ভাল নেই?”
গগনবাবু দুখিরামবাবুকে খুবই খাতির করেন। অন্য কেউ এ-প্রশ্ন করলে চটে যেতেন। দুখিরামবাবুর ওপর চটলেন না। মস্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কী আর বলব। আমার বড় ছেলেটা বড়ই গবেট। তিনবার ফেল করেছে। স্কুল থেকে টি সি: দিচ্ছে। কী যে করি।”
দুখিরামবাবু স্থিরভাবে বসে বললেন, “সবটা খুলে বলুন। দ্বিধা করবেন না।”
গগনবাবু বললেন, দুখিরামবাবু শুনলেন।
শুনে একটি মাত্র প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি এ-বিষয়ে নিশ্চিত যে, আপনার বড় ছেলে হরিবন্ধুর কোনও গুণই নেই?”
“থাকলে এতদিনে টের পেতাম।”
“মা বাপেরা অনেক সময়ে দোষ-গুণ কোনওটাই টের পায় না। তা সে যাকগে। আপনি মোতিগঞ্জের নাম শুনেছেন?”
“না। সেটা কোথায়?”
“সাঁওতাল পরগনায়। বেশ স্বাস্থ্যকর জায়গা। তার চেয়ে বড় কথা, সেখানে চারুবালা বেঙ্গলি স্কুল বলে একটা স্কুল আছে। তার খুব নাম-ডাক।”
গগনবাবু হতাশার গলায় বললেন, “নাম-ডাকওয়ালা স্কুল আমার গবেট ছেলেকে নেবে কেন?”
“নেবে। তার কারণ ওই স্কুলের নাম-ডাক গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানানোর জন্যই। একসময়ে সারা দেশের গবেট ছেলেরা ঝেটিয়ে আসত ওই স্কুলে পড়তে। এখন ততটা নয়। হোস্টেলও একটা ছিল, কিন্তু এখন তত ছাত্র হয় না বলে হোস্টেল তুলে মাস্টারমশাইদের কোয়ার্টার বানানো হয়েছে। তবে তাতে কোনও অসুবিধে নেই। মোতিগঞ্জে আমার একটা কারবার আছে। স্বাস্থ্যকর জায়গা বলে হালে সেখানে একখানা পুরনো বাড়িও কিনেছি। গৃহপ্রবেশ করারও সময় পাইনি। আপনার ছেলে দিব্যি সেই বাড়িতে থাকতে পারবে। দরোয়ান আছে, সে দেখাশোনা করবে, দরোয়ানের বউ দু’বেলা বেঁধে দেবে। কোনও অসুবিধে হবে না। ভেবে দেখুন, যদি রাজি থাকেন তবে আমাকে জানাবেন।”
এই বলে দুখিরামবাবু উঠলেন। আজ আর গগন-ডাক্তারকে নাড়ি দেখাতে তাঁর সাহস হল না। ডাক্তারের মুখ এখনও রক্তবর্ণ হয়ে আছে।
কিন্তু রেগে থাকলেও গগন বন্দ্যোপাধ্যায় ধৈর্যশীল শান্ত মানুষ। ছেলেমেয়েদের গায়ে হাত তোলেন না। তবে গম্ভীর মানুষকে সকলেই ভয় পায়। তাঁর ছেলেমেয়েরাও তাঁকে যমের মতো ডরায়। গগনবাবু সারাদিন শরীরে রাগটা চেপে রাখলেন। রাত্রিবেলা খাওয়াদাওয়ার পর বড় ছেলেকে ডাকিয়ে আনলেন তাঁর ঘরে। তাঁর মনে হল, দুখিরামবাবুর প্রশ্নটার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম খোঁচা আছে, “আপনি কি এ-বিষয়ে নিশ্চিত যে, আপনার বড় ছেলে হরিবন্ধুর কোনও গুণই নেই?” আসলে গগনবাবু একজন ব্যস্ত ডাক্তার। নিজের ছেলেমেয়েদের দিকে মনোযোগ দেওয়ার মতো সময় তাঁর নেই। কাজেই কার কোন্ গুণ আছে সে বিষয়ে তাঁর ভাল ধারণা
-ও থাকতে পারে। দুখিরামবাবু তাই খোঁচাটা দিয়ে গেছেন। গগনবাবুর মনে হল, তাঁর বড় ছেলে হরিবন্ধুর বাস্তবিকই কোনও গুণ আছে কি না, তা তাঁর একটু খোঁজ করা উচিত।
হরি সামনে এসে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়ানোর পর গগনবাবু বললেন, “হরি, লেখাপড়া যা করেছিস তা তো দেখতেই পাচ্ছি। এখন বল্ তো, কোন্ সাবজেক্টটা তোর কাছে তত কঠিন বলে মনে হয় না।”
হরিবন্ধু এই প্রশ্নে খুবই ভড়কে গিয়ে অনেকক্ষণ আমতা-আমতা করে বলল, “ইয়ে, বাংলা কবিতাটা বেশ সোজা।”
“বাঃ, বাঃ, তা হলে কবিতার দিকে ঝোঁক আছে! বেশ, এবার বল্ তো, লেখাপড়া ছাড়া আর তোর কোন গুণ আছে বলে মনে হয়? সোজা কথায় তুই আর কী কী পারিস?”
হরিবন্ধু ফের আকাশ-পাতাল ভাবল, তারপর মাথা চুলকে-টুলকে বলল, “ইয়ে..বোধহয় গাছ বাইতে পারি।”
“বাঃ, বেশ। টারজান। টারজানও বেশ ভাল গাছ বাইতে পারত। তা আর কী পারিস?”
“গুলতিতে পাখি মারতে পারি।”
“বাঃ, এটাও তো গুণই ধরতে হবে। তার মানে লক্ষ্যভেদ করতে পারিস। অর্জুনের এ-গুণ ছিল, একলব্যের ছিল, কর্ণের ছিল। বাঃ, বাঃ। আর কী কী করতে ভাল লাগে তোর?”
হরি নির্দ্বিধায় বলল, “খেতে।”
গগনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “এটা খারাপ কিছু নয়। খেতে সকলেই ভালবাসে। স্যার আশুতোষও বাসতেন। আর?”
“আর? আর ঘুমোতে।” গগনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “নট ব্যাড। ঘুম জৈব ধর্ম। নেপোলিয়ন ঘোড়ার পিঠে বসে যুদ্ধ করতে করতে ঘুমোতেন। তোর পড়তে পড়তে ঘুম পেতেই পারে। আর কী ভাল লাগে তোর?”
একটু লাজুক গলায় হরি বলল, “আর স্কুল-পালাতে।”
গগনবাবু গেল বার হরিদ্বারে বেড়াতে গিয়ে একখানা কাঠের লাঠি কিনে এনেছিলেন। সেটার দিকে হাত বাড়িয়েও থেমে গিয়ে বললেন, “স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও স্কুল করতে পছন্দ করতেন না, তোর আর দোষ কী?”
হরি বিনয়-বিগলিত মুখে মাথা নিচু করে রইল। গগনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কিন্তু এত গুণ থেকেও তো তোর কোনও উন্নতি হচ্ছে না রে হরি। আমার মনে হয়, এবাড়ির আবহাওয়ায় তোর আর উন্নতি হবেও না। তাই আমি ঠিক করেছি তোকে মোতিগঞ্জে পাঠাব। সেখানে আমার চেনা এক ভদ্রলোকের মস্ত বাড়ি আছে। সেখানে থাকবি, স্কুলটাও ভাল। কয়েক দিনের মধ্যেই যেতে হবে। তৈরি থাকিস।”
বাবা হলেন হাইকোর্ট, তাঁর ওপরে আর কথা নেই। মা-ঠাকুমা মেলা কান্নাকাটি করলেন বটে, কিন্তু হরিকে শেষ অবধি টিনের স্যুটকেস আর শতরঞ্চিতে বাঁধা বিছানা নিয়ে মোতিগঞ্জে যেতেই হল।
এইবার মোতিগঞ্জ জায়গাটার একটু বর্ণনা দেওয়া দরকার। এক কথায় এমন সুন্দর জায়গা বিরল। চারদিকে ছোটখাটো পাহাড়ের শ্ৰেণী আর শাল-মহুয়ার জঙ্গলে ঘেরা। জঙ্গলে বাঘ আছে, ভালুক আছে, হায়না এবং বুনো কুকুর আছে। আবার সৌন্দর্যও বড় কম নেই। বিভিন্ন ঋতুতে জঙ্গলের গাছে-গাছে নানারকম ফুল ফোটে। মোতিগঞ্জ ঠিক শহর নয়, ছোট একখানা গঞ্জ। তবে স্বাস্থ্যকর জায়গা বলে এখানে কলকাতার অনেক বড়লোক বাড়ি করে ফেলে রেখেছেন। সারা বছরই বলতে গেলে বাড়িগুলো খালি পড়ে থাকে। একজন মালি বা দরোয়ানের হেফাজতে। মোতিগঞ্জের কাছাকাছি একটি অভ্রখনি ছিল, সেটা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। জগবন্ধু সাহা নামে একজন বাঙালি ব্যবসাদার ওই খনি কিনে একদা প্রচুর পয়সা করেছিলেন। মানুষটির দানধ্যানের জন্য খ্যাতি ছিল। তিনিই মোতিগঞ্জের চারুবালা বেঙ্গলি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। স্কুলটি যাতে ভাল চলে, সেজন্য জগবন্ধু সাহা খুঁজে-খুঁজে ভাল-ভাল শিক্ষককে বেশি মাইনে দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। একটি চমৎকার ছাত্রাবাসও তিনি তৈরি করে দেন। নিজে ভাল লেখাপড়া জানতেন না বলে শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল। চারুবালা তাঁর মা। জগবন্ধু বা চারুবালা কেউই আজ আর বেঁচে নেই। তবে স্কুলটি আছে। চারুবালা বেঙ্গলি স্কুলের বৈশিষ্ট্য হল, যে-কোনও ছাত্রকেই এখানে ভর্তি করা হয়। চূড়ান্ত গবেটকেও ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। তারপর তাদের কড়া ডিসিপ্লিন ও হাড়ভাঙা খাটুনির ভিতর দিয়ে মানুষ করে দেওয়া হয়। সেখানে ফাঁকির স্থান নেই।
স্কুল থেকে আধমাইল দূরে শহরের প্রায় প্রান্তে একখানা বাগান-ঘেরা বাড়ি। বাড়িখানা পুরনো, যত্নের অভাবে রং চটে গেছে। তবে বেশ বড় বাড়ি। গগনবাবুর রুগি দুখিরামবাবু শখ করে বাড়িখানা কিনেছিলেন। মাঝে-মাঝে হাওয়া বদল করতে আসবেন বলে। এ বাড়িরই একতলার সামনের দিকে কোণের একখানা ঘরে হরির জায়গা হল। দরোয়ান থাকে গেটের পাশে ছোট্ট ঘরে। দরোয়ানের বউ আছে, দুটো ছেলে-মেয়ে আছে। বাগানখানা ভারী চমৎকার। পেয়ারা, আম, জাম, আতা, কুল, সবেদা, ফলসা, বেল কোনও গাছেরই অভাব নেই। ফুলও ফোটে মেলা।
হরির ঘরখানা বেশ ভাল। মস্ত পালঙ্ক আছে, বইয়ে ঠাসা গোটা দুই আলমারি, টেবিল-চেয়ার কিছুরই অভাব নেই। দেওয়ালে কয়েকটা অয়েল পেন্টিং আছে। একটা ছবি এক বুড়ো মানুষের। গোটাতিনেক ছবি বিদেশের নিসর্গ দৃশ্যের। লাগোয়া বাথরুমও আছে। জানলা খুললেই বাগান। এত সুন্দর পরিবেশে হরি কখনও থাকেনি।
দুখিরামবাবু এবাড়িতে কখনও থাকেননি। এসব আসবাবপত্র, ছবি, বই কিছুই তাঁর নয়। হারানো বাড়িতে বহুকাল ধরেই এগুলো ছিল, তিনি এসব সমেতই বাড়িখানা কিনেছেন।
মোতিগঞ্জে হরিবন্ধুকে পৌঁছে দিতে সঙ্গে এসেছিল বাড়ির পুরনো ভূত্য গোবিন্দ। সকালবেলায় স্টেশনে নেমে একখানা টাঙ্গা ধরে তারা যখন এসে বাড়ির ফটকে নামল, তখনই গোবিন্দ খুব ভাল করে চারদিকটা দেখে নিয়ে বলল, “এ বাপু আমার বিশেষ সুবিধের ঠেকছে না।”
হরিবন্ধু বলল, “কিসের অসুবিধে?”
“গণ্ডগোল আছে।”
“কিসের গণ্ডগোল?”
“কাজটা ভাল হল না।”
“কোন কাজটা?”
“এই যে তোমাকে এখানে পাঠানো হল, একাজটা ভাল হয়নি। বাড়িটা কেমন যেন অলুক্ষুনে ঠেকছে।”
হরিবন্ধুর কাছে গোটা ব্যাপারটাই অলুক্ষুনে। মা বাবা-ভাই-বোন এবং সর্বোপরি ঠাকুমাকে ছেড়ে এই পাণ্ডববর্জিত দেশে আসতে তার বুক ফেটে যাচ্ছিল। ঠাকুমার গায়ের সঙ্গে লেটে না শুলে তার ঘুম আসে না। মা ভাত বেড়ে না দিলে খেয়ে তার পেট ভরে না। সে একটু বোকা বলেই বোধহয় তার ছোট ভাই-বোনেরা তাকে ভীষণ ভালবাসে। গাছ থেকে আম, জাম, কুল পেড়ে দিয়ে সে-ও তো ওদের খুশি করতে ভালবাসে। গাছকে মাটি থেকে উপড়ে ফেললে গাছের কেমন অনুভূতি হয়, তা হরি জানে না বটে, কিন্তু চলে আসার সময়ে তার মনে হচ্ছিল যে, তাকে কেউ যেন মাটি থেকে শিকড়সমেত উপড়ে ফেলছে। এই যাত্রাই তার শেষ যাত্রা। বাড়ি থেকে তো একরকম তাড়িয়েই দেওয়া হল তাকে। সে কি আর ফিরে যেতে পারবে কোনওদিন?
যাই হোক, বাক্স-বিছানা নিয়ে নামতেই একজন গম্ভীরমতো দরোয়ান এসে বিনা প্রশ্নে ফটক খুলে দিল। একটিও কথা না বলে সে গটগট করে হেঁটে গিয়ে নীচুতলার একখানা ঘর খুলে দিয়ে চলে গেল। তার হাবভাব দেখে হরির একটু কেমন-কেমন লাগছিল। ঠিক যেন মানুষ নয়, যন্ত্রমানব। ভাবলেশহীন পাথুরে মুখ, বিশাল মজবুত চেহারার এই লোকটাই যে এখানে তার খবরদারি করবে এটা ভেবে তার মনটা কিন্তু-কিন্তু করতেই লাগল।
দরোয়ান যেমনই হোক, ঘরখানা কিন্তু ভাল। বেশ খোলামেলা। জানলা খুললেই সবুজ গাছপালা আর বাগান দেখা যায়। জানলা বেয়ে কেঁপে উঠেছে বোগেনভেলিয়ার পুষ্পিত ডালপালা। ঘরে বেশ আলো-হাওয়া আছে।
গোবিন্দ খুব খুঁতখুঁতে চোখে চারদিকটা দেখে নিল। ভিতরদিককার দু’খানা বন্ধ দরজা ঠেলেঠুলে দেখল। জানলার পাল্লা, গ্রিল, দরজার কাঠ পরীক্ষা করল। বাথরুমে ঢুকে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে নিল। তারপর বলল, “বাড়িখানা পুরনো হলেও মজবুত। ব্যবস্থাও যা দেখছি ভালই। তবে বলছি বাপু, এবাড়ি আমার ভাল ঠেকছে না।”
হরি মন খারাপ করে জানলার ধারে বসে বাইরের দিকে চেয়ে ছিল। বাড়ির কথা ভেবে তার চোখ ভরে জল আসছে। গোবিন্দর কথা তার কানেও গেল না। দুখিরামবাবু একখানা চিঠি দিয়ে দিয়েছেন। সেখানা নিয়ে আজই স্কুলে গিয়ে হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে হবে। আজই স্কুলে ভর্তি করে নেওয়া হবে তাকে। তারপর এখানেই থেকে যেতে হবে তাকে। কতকাল কে জানে।
গোবিন্দ তার অবস্থা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ভেবে আর কী করবে। আজ আবার ইস্কুলে যেতে হবে। চানটান করে তৈরি হও। আমি একটু দেখিগে ব্যাটা প্যাঁচামুখো দরোয়ানটা রান্নাবান্নার কী বিলি ব্যবস্থা করল।”
হরি চোখের জল মুছে উঠল এবং স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে লাগল। ফলে কাল সকালের গাড়িতে গোবিন্দদাও ফিরে যাবে। তারপর
সে একদম একা। ভাবতেই বুকটা হাহাকার করে উঠল তার।
ফটকের পাশেই আউট-হাউস। সেখানে দরোয়ান জগুরাম থাকে। গোবিন্দ গিয়ে খুব তেজী গলায় ডাকল, “জগুরাম! বলি জগু আছিস নাকি রে?”
দরজা খুলে বিশাল চেহারার জগুরাম দেখা দিল। চোখে রক্তজল করা দৃষ্টি। সেই সাঙ্ঘাতিক চোখে সে গোবিন্দকে নীরবে নিরীক্ষণ করতে লাগল।
গোবিন্দর গলা তিন পদ নেমে গেল হঠাৎ। বিগলিত একটু হেসে সে বলল, “এই যে জগুভায়া, আপনার কথাই হচ্ছিল এতক্ষণ। তা ইয়ে, খাবারটাবার কি কিছু মিলেগা? এই ধরো চাট্টি ভাত, একটু ডাল…”
জগুরাম সেইরকমই নিষ্কম্প চোখে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খুবই মৃদু স্বরে বলল, মিলেগা।”
“তথাস্তু।” বলে গোবিন্দ পালিয়ে বাঁচল, মনে-মনে ভাবল, ব্যাটা একেবারেই পাষণ্ড, আর একটুক্ষণ ওরকম চেয়ে থাকলে ভস্মই করে দিত আমাকে।
ফটকের বাইরে এসে গোবিন্দ চারধারটা ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগল। পাড়াটা এতই নির্জন যে, এই সকালবেলাতেও একটিও মানুষ নেই পথে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব বাগানে ঘেরা নির্জন বাড়ি। কোথাও মানুষ তো থাকে বলে মনে হয় না। দুখিরামবাবুর বাড়ির দু’পাশে যে দুটি বাড়ি আছে সেগুলোতে দরোয়ানও নেই। ফটকে জংধরা তালা ঝুলছে। ভিতরের বাগান আগাছায় ছেয়ে গেছে। বাড়ির দেওয়ালে শ্যাওলা ধরেছে।