অলৌকিক
আজ অফিস থেকে ফিরতে বড্ড দেরি হয়ে গেলো। বেরোতে যাবো ঠিক সেই মুহূর্তে একটা কাজ চাপিয়ে দিলো! কাজটা আজকেই কমপ্লিট করে দিতে হবে।অগত্যা থাকতেই হলো ছুটির পরও। প্রাইভেট কোম্পানির এই হলো অসুবিধা।কিছু বলতে যাও সঙ্গে সঙ্গে বলবে “না পোষালে ছেড়ে দিন।” ধুর আর ভাল্লাগে না। নেহাত মাইনেটা ভালো দেয় তাই ছেড়ে দিতে কষ্ট হয়, নয়তো কবেই ছেড়ে দিতাম। বাড়ি গিয়েও কি শান্তি আছে! যত রাত-ই হোক গিয়েই চা করতে হবে,রান্না করতে হবে। বাড়ি ফিরে দেখি আমার বড়ো ভাসুর ঘরে বসে আছেন। আমার স্বামী সজল বলল “আগে একটু চা করো। আজ এতো দেরি করে ফিরলে? ঘড়িতে কটা বাজে সে দিকে দেখেছ? পাড়ার লোকজন কি বলবে! বাড়ির বৌ রাত বিরেতে বাড়ি ফিরছে!”
“দেখো, পাড়ার লোকের কথা বলতে পারবো না ; তবে তুমি তো বোঝো আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করি। অনেক সময়ই ছুটির পরও কাজ চাপিয়ে দেয়। আর্জেন্সি আছে বললে সবসময় কিছু বলতেও তো পারা যায় না। আর তা ছাড়া এটা তো রোজ রোজ হয় না। তুমি সরকারি স্কুলে চাকরি করো তো তাই তোমাদের এ সব জানা নেই…।
দাদা আপনি চা খাবেন তো?”
“হ্যাঁ,, চা কোরছো যখন দিও একটু।”
দাদা চা খেয়ে উঠতে গেছে হঠাৎ টাল খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতো হলো।আমি টেবিলের কাছেই ছিলাম চট করে ধরে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। সজল ধরে ধরে উপরে ওনার ঘরে পৌছে দিয়ে এলো। আমরা একই বাড়িতে থাকি। বড়ো ভাসুর তার পরিবার নিয়ে উপর তলায় থাকেন,আর আমরা নীচের তলায়। ঘরে গিয়ে দাদা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেন। ক্রমেই ওনার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। কথা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ফোন করলাম। ডাক্তার যখন আসলো তখন ঘড়িতে রাত্রি বারোটা বাজে। ডাক্তার এসে বলল “না কোনো আসা নেই ওনার প্রেসার,হার্ট,পাল্স কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছে না। উনি আর বেঁচে নেই। কিন্তু চার ঘন্টা না গেলে আমি ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিতে পারবো না। আপনারা কাল সকালে আমাকে একবার কল করবেন, তখন ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দেবো।” ডাক্তারবাবু চলে গেলেন। আমার বড় জা এমনিতেই শয্যাশায়ী, সে কোনো কিছু বোঝা-শোনার ঊর্ধ্বে। বাড়িতে সুস্থ লোক বলতে একজন মাত্র কাজের মহিলা।ভাসুরের ছেলে মেয়ে সব দূরে থাকে। আমার ছেলেও বাড়ি নেই। ও একটা আমেরিকান কোম্পানিতে চাকরি করে। ওর বেশিরভাগ সময় নাইট ডিউটি থাকে। আমার স্বামী আর আমি দু’জনেই ফোনে সবাইকে খবর দিতে লাগলাম। দুঃসংবাদ বোধহয় বাতাসের থেকেও তিব্র গতিতে ছোটে। এরই মধ্যে পাড়া প্রতিবেশীদের একটা দুটো করে ফোন আসতে শুরু করেছে। একেই সারাদিনের ক্লান্তি তার উপর সবার কৌতুহল “কখন হলো? কেমন করে হলো?”এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত। কখন যেন নিদ্রাদেবী এসে চোখে বসে ছিলেন টের পাইনি, সোফায় বোসে বোসেই চোখ লেগে গেছিলো। হঠাৎ মনে হলো কেউ জল চাইছে। আমার ঘুম এমনিতেই পাতলা,তার উপর ঘরের এই পরিস্থিতি। আমি তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বোসলাম। খাটের দিকে তাকিয়ে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! একি যে লোকটা কিছুক্ষণ আগে মারা গেলো, সে এখন বেঁচে উঠেছে! আমার তো ভয়ে মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরোচ্ছে না। আমি কাজের মহিলাকে কোনোক্রমে ঠেলা দিয়ে তুললাম। ও উঠে আমার মতোই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। আমার ভাসুর আবার বললেন “জল খাবো, একটু জল।” কাজের মহিলা তো ভয়ে ভূ…ত বলে চেচিয়ে উঠেছে। ওর চেঁচামেচিতে সজল পাশের ঘর থেকে ছুটে এসেছে “কি হলো চেঁচাচ্ছ কেনো?” আমি কোনোক্রমে বললাম “দাদা জল চাইছে।”
“কি!”
“হ্যাঁ, দাদা জল চাইছে।”
এর মধ্যে আবার উনি বললেন ” জল খাবো”
সজল খাটের কাছে গিয়ে দেখলো দাদা সত্যি ই জল চাইছে। খুব ক্ষীন আওয়াজ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে। তবে উনি যে বেঁচে উঠেছেন সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই।
আমার জীবনে এমন অত্যাশ্চর্য ঘটনা আমি আগে কখনও দেখিনি। আমি তাই পুরো ব্যাপারটাকে এখোনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না। সজল ঠিক বলছে!মৃত মানুষ বেঁচে উঠেছে!
দাদাকে একটু জল খাওয়ানো হলো। এবার উনি একটু সুস্থ বোধ করছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম “দাদা এখন কেমন লাগছে?”
“হ্যাঁ, এখন একটু সুস্থ বোধ করছি।”
“দাদা রাতের কথা আপনার কিছু মনে আছে? আপনার কি
হয়েছিল?”
“হ্যাঁ, মনে আছে তো। আমাকে কয়েকটা লোক এসে জোর করে তুলে নিয়ে গেলো। আমি অনেক করে বলার চেষ্টা করলাম আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?আামাকে ছেড়ে দাও। ওরা কোনো কথাই শুনলো না। আমি সজলকে ডাকলাম, তোমাকে ডাকলাম; এমনকি তোমার দিদিকেও ডাকলাম, তোমরা কেউ আমার ডাক শুনলে না। আমাকে ওই লোকগুলো জোর করে নিয়ে গেলো। তার পর কিছু দূর গিয়ে লোকগুলো কার সাথে কি কথা বলল। আমাকে বলছে ‘পাসপোর্ট দেখাও।’ আমি পাসপোর্ট কোথাথেকে দেখাবো? আমি কি পাসপোর্ট নিয়ে গেছি! বললাম ‘পাসপোর্ট তো বাড়িতে আছে।’ তারপর লোকগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলো ‘এ না! ভুল লোক কে ধরে আনা হয়েছে। ওকে ছেড়ে দে।’ ওদের মধ্যে একজন আবার বলছিল ‘ভুল লোক তুলে এনেছি বস জানতে পারলে আমাদের এক জনেরও প্রাণ থাকবে না।ওকে মেরে ফেল আমাদের ঝামেলা খতম।’ একজনের মেরেফেলায় সায় ছিলো না। ও বার বার বলছিল ‘ওকে ছেড়ে দে।’
ওদের নিজদের মধ্যে এই নিয়ে বচসা বেধে যায়। সেই ফাঁকে আমি কোনোক্রমে পালিয়ে এসেছি। দৌড়ে আসতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কত দিন কিছু খাইনি। শরীরে একটুও জোর পাচ্ছিলাম না। তেষ্টায় ছাতি শুখিয়ে কাঠ। কখন থেকে জল চাইছি তোমরা কেউ একটু জল দিচ্ছিলে না।”
আমি বললাম “আচ্ছা, ঠিক আছে, এখন আর বেশি কথা বলবেন না একটু রেস্ট নিন, আপনি এখোনো খুব দুর্বল।”
সকাল হলে ডাক্তারকে ফোন করে সবটা জানানো হলো। ডাক্তার এসে নাড়ি পরীক্ষা করে বলল “খুব দুর্বল। কয়েকটা টেস্ট দিচ্ছি এই টেস্ট গুলো করিয়ে নিন। আর কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে যাচ্ছি, এগুলো খাওয়ান।”
আমি ডাক্তার কে জিজ্ঞেস করলাম ” ডাক্তারবাবু এটা কি হলো? কাল রাতে যাকে মৃত বললেন সে বেঁচে উঠলো কি ভাবে? আমার কাছে এখনো সবটা কেমন যেন ধাঁধার মতো লাগছে।”
“অনেক সময় শরীরের সব যন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দিলেও যতক্ষণ না ব্রেন ডেথ হচ্ছে ততক্ষণ আমরা ডাক্তারি ভাষায় কাউকে মৃত ঘোষণা করতে পারি না। আমি কাল এই কারণেই ডেথ সর্টিফিকেট লিখে দিয়ে যাই নি। এই দুনিয়ায় চাবিকাঠি যিনি নাড়াচ্ছেন তিনি এরকম ঘটনাও ঘটিয়ে থাকেন। ওনার এখনোও পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার সময় হয় নি। পৃথিবীতে এখনও ওনার কাজ বাকি আছে। তাই তো নিয়ে গিয়েও আবার ফিরিয়ে দিয়ে গেলো। যাক এটা সায়েন্সের কথা না। এটা আমাদের বিশ্বাসের কথা। সায়েন্স যেখানে ফেল করে যায় সেখানে আসে দৈবিক শক্তির বিশ্বাস। আর এ কথা তো অস্বীকার করা যায় না দৈবিক শক্তি বা সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার বলে একটা কিছু যে আছে। সায়েন্স ও ধীরে ধীরে তা মানতে শুরু করেছে। যাক এ সব নিয়ে আর এতো ভাববেন না, মানুষটা যে আপনাদের মধ্যে আবার ফিরে এসেছে এটাই বড়ো কথা। ওঁর ছেলে মেয়েদের কি খবর দেওয়া হয়েছিল?”
“হ্যাঁ কাল রাতেই সবাইকে খবর দেওয়া হয়েছে।”
যাক, এই অজুহাতে বাবা মা’র সাথে দেখা তো হয়ে যাবে। আজকাল আমাদের যা অবস্থা; ছেলে মেয়ে মানুষ করে দাও; তারপর তারা বাবা মা’র কাছ থেকে দূরে চলে যায়। কখনো বা চাকরির কারণে, কখনো বা দয়িত্ব এড়ানোর জন্য। বেশিরভাগ বাড়িতেই এই বৃদ্ধ বয়সে কাজের লোক নির্ভর দু’টো মানুষ। আজ আপনারা যদি না থাকতেন তাহলে কি হতো ভাবুনতো?”
ডাক্তারবাবু চলে যাওয়ার পর আমরা নীচে এসে একটু বিছানায় গা এলালাম। কিন্তু ঘড়ি বলে দিচ্ছে ওঠো! আরাম করার সময় নেই! এখুনি ছুটতে হবে অফিসে। তার আাগে সংসারের কাজ গুলোও তো সারতে হবে। ছুটি চাইলেই কি ছুটি পাওয়া যায়!!