বনওয়ারী বিহ্বল
এক পাগল বনওয়ারীকে এনে বাড়িতে শুইয়ে দিল। বনওয়ারী বিহ্বল। পাড়ার লোক ভিড় করে এল। কি হল? কি করে হল?
পাগল বললে—জাঙলের ধারে পড়ে হাঁপাইছিল।
—জাঙলের ধারে?
-হ্যাঁ। কথাটা ভেবেচিন্তেই বলেছে পাগল। শেষের প্রায় সবটাই সে দেখেছে। কোপাইয়ের ধারে সে গিয়েছিল চাদের আলো দেখে মনের খেয়ালে। কালোবউ তখন গান। গাইছিল। অপার কৌতুকে বনওয়ারীর প্রেমলীলা দেখবার জন্য একটা গাছে উঠে বসেছিল। তারপর এল পরম, সমস্তটা ঘটে গেল চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতে। গাছ থেকে সে যখন। নামল, তখন পরম ওপারে; কালীদহের জল দুলছে, তীরে দাঁড়িয়ে বনওয়ারী কাঁপছে টলছে। সে ধরে ফেললে বনওয়ারীকে। দহে নামতে তারও সাহস হয় নাই। সে জানে, কালোবউয়ের দেহ কাল ভেসে উঠবে। পুলিশ আসবে। বনওয়ারী ওখানে ছিল বললে বনওয়ারীকে টানবে, তাকে ছাড়বে না। সেইবা ওখানে গিয়েছিল কেন? চাদের আলোয় সবাই ভোলে, দারোগাবাবু ভোলে না। তাই সে ভেবেচিন্তেই বনওয়ারীকে এবং নিজেকে রক্ষা করবার জন্য বললে— জাঙলের ধারে বসে হাঁপাচ্ছিল বনওয়ারী। সে জানে পরম ফেরার হয়েছে। সন্দেহ যদি পরমের উপর পড়ে, তবে সে অন্যায় হবে না। কালোবউকে পরমই মেরেছে। যদি দহে ড়ুবে না মরত কালোশশী, তবে পরম তাকে নিশ্চয় মারত। মুহুর্তে গলা টিপে মেরে ফেলত এবং দহেই ফেলে দিত। জাঙলের ধার কোপাইয়ের দহ থেকে অনেক দূর। জাঙল গ্রাম, তারপর মাঠ, তারপর কাহারপাড়া, তারপর বাঁশবেড়ে, তারপর জঙ্গল—সেই জঙ্গলের বুক চিরে চলে গিয়েছে। কোপাইবেটী—কোপাইয়ের দহে ভাসবে কালোবউ। দারোগাবাবু হাত বাড়িয়ে ধরতে পারবেন না বনওয়ারীকে।
পাগল বললে পরমের কাণ্ড। বনওয়ারী মাতালশালায় বলেছিল—পরমের জাত নাই, জাত গেল, ডোমেদের সাথে মদ খেলে। পরম শুনেছিল। পথে ডাকলে বনওয়ারীকে। আমরা বুঝতে পারলাম না। তারপর এই কাণ্ড।
সকলেই বিশ্বাস করলে।
করালী উঠল—কাঁহা সে পরম? কাঁহা?
অচেতনের মত বনওয়ারী তখন কাঁপছে। কম্প এসেছে। তার মধ্যেও সে বললে–না। পাগল, বারণ কর। আটপৌরেদের সঙ্গে দাঙ্গা করে ফেলাবে ছেড়া। আর–
দাঁতে দাঁতে কসকস করে উঠল সে। ওই–ওই ছোকরাই সব অনিষ্টের মূল। বাবাঠাকুরের বাহন মেরেছে। বাবাঠাকুরের শিমুলবৃক্ষে চড়েছে। করালীর দিকে সে তাকালে—বিস্ময়ে সে অভিভূত হয়ে গেল। করালীর পরনে কোট পেলেন। স্থির দৃষ্টিতে সে চেয়ে রইল।
গোপালীবালা তার হাত দিয়ে বনওয়ারীর চোখ ঢেকে বললে পাগলকে–ও দেওর, কি করে তাকাইছে দেখ, এ যে ঠকঠক করে কাঁপছে গো! কি হচে গো!
পাগল নাড়ি দেখতে জানে। হাত ধরে সে বললে–জ্বর আসছে, জ্বর। কাঁথা দাও, কাঁথা দাও।
বনওয়ারী বললে—দূর কর, ছামনে থেকে দূর কর্— বলতে বলতে প্রবল জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
পরের দিন সকালে কালোশশীর দেহ ভেসে উঠল কালীদহের মাঝখানে। এলোচুল ঢেউয়ে ঢেউয়ে নাচছে, কালোবউয়ের দেহটা ড়ুবছে আর উঠছে।
পরম নিরুদ্দেশ।
দুঃখ সবাই করলে। দুঃখ করলে না কেবল নয়ানের মা। বনওয়ারীর দুর্দশায় সে খুশি হয়েছে। কালোবউয়ের মৃত্যুতেও সে পুলকিত হয়েছে। কালোবউ যে বনওয়ারীর ‘অঙের মানুষ! সে স্নান করে এলোচুলে বাবাঠাকুরকে প্রণাম করে এল। বাবাঠাকুরের মহিমাকীর্তন করতে লাগল।
বিস্মিত কিন্তু কেউ হল না।
হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবনে ঘেরা বাঁশবাঁদির ইতিহাসে এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু যে বরাবরই ঘটে আসছে। সাপে কাটা, দাঁতালের দাঁতের আঘাতে মৃত্যু-এর তদন্ত নামমাত্র, তা ছাড়া জলে ডোবা, গাছ থেকে পড়াও প্রায় তাই, এরপর গলায় দড়ি আছে, বিষ খাওয়া আছে, নিজের গলায় বঁটি দিয়ে কাটার কথাও ইতিহাসে পাওয়া যায়। অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় মেয়েদেরই বেশি। থানার খাতায় আছে—মেয়েরা চরিত্রহীনা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতৃপ্ত বাসনা থেকে আত্মহত্যা করে। কখনও কখনও সন্দেহ করে থাকে যে, আত্মহত্যা নয়-হত্যা, পুরুষেরাই হত্যা করে থাকে। দু-চার জন চালানও গিয়েছে। সেসব আগের কালের কথা, একালে এসব বড় ঘটে না।
হাঁসুলীর বাঁকের উপকথা সবচেয়ে বেশি জানে সুচাঁদ। সে বলে—বনওয়ারীর বাবার বাবার বাবা আর আমার বাবার বাবা এক নোক তো। তা আমার কত্তাবাবা আমার পেথম কত্তামাকে শিলনোড়ার নোড়ায় মাথা ঘেঁচে মেরেছেল বুকে বসে, নোড়া দিয়ে। বলতে বলতে সুচাঁদের চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। চুপি চুপি বলে—আটপৌরেদের একজনকে আমার কত্তাবাবা এতের বেলায় ঘর থেকে বেরুতে দেখেছেল কিনা। বাস্, মাথায় অক্ত উঠে গেল। ঘরের সামনে শিলনোড়া, সেই নোড়া দিয়ে মাথা ঘেঁচে মেরেছেল পরিবারকে। তারপরে টেনে ফেলে দিল কোপাইয়ের গভ্যে; বললে পড়ে পাথরে মাথা ভেঙ্গে গিয়েছে। তখন সায়েব মশাদের আমল। সায়েবরা পুলিশ ফিরিয়ে দিলে। কিন্তুক কত্তাবাবাকে চাবুক দিয়ে সপাসপ মেরে পিঠ ফাটিয়ে দিয়েছে। তাদের বুদ্ধির কাছে তো ফাঁকি নাই বাবা!
রতনের পূর্বপুরুষ চড় মেরে মেরে ফেলেছিল তার বোনকে। তখন ওই দহতে ছিল বড় বড় কুমির, সেই দহে ফেলে দিয়েছিল লাশ।
গুপীর পূর্বপুরুষ বিষ খাইয়েছিল তার স্ত্রীকে।
পরমের পূর্বপুরুষের বাহাদুরি সবচেয়ে বেশি। সে তার বউয়ের হাতে-পায়ে বেঁধে মুখে কাপড় বেঁধে গলায় দড়ি ঝুলিয়ে দিয়েছিল। তারপর হাত-পায়ের দড়ি, মুখের কাপড় বার করে হইহই করেছিল। কেউ সন্দেহ করতে পারে নাই।
একমাত্র ছেলে মারা যেতে ঘরভাঙাদের নয়ানের প্রথম ঠাকুরমা ওই দহে ঝাঁপ দিয়ে মরেছিল। তারপর নয়ানের ঠাকুরমাকে বিয়ে করে নয়ানের ঠাকুরদাদা।
অম্লশূলের বেদনা অসহ্য হওয়ায় পানুর কাকা গলায় দড়ি দিয়েছিল।
উপকথায় অনেক কাহিনী আছে। তারই সঙ্গে কালোবউয়ের কাহিনী যোগ হল। পরম নিজে যেত জাঙলের এক পাড়ায়। সেখানে নফর দাসের বোনের বাড়িতে সন্ধে কাটাত। কালোবউয়ের স্বভাবচরিত্র ভাল ছিল না। পরম ডাকাতির দায়ে জেলে থাকতে সে চন্দনপুরে বড়বাবুদের বাড়িতে ছোটজাতের ঝিয়ের ‘পাট’ করত। বাবুদের দরোয়ান ভূপসিং মহাশয়ের সঙ্গে লোক জানাজানি করেই ভালবাসা করেছিল। তা করে। কাহারপাড়ায় অনেকে করে এমন ভালবাসা জাঙলে সদগোপ মহাশয়ের সঙ্গে করে, চন্ননপুরে বাবুদের ছেলেদের সঙ্গে দু-চার দিনের ভালবাসার খেলাধুলো—সে তো কেউ ধরেই না। পরম মধ্যে মধ্যে মারধর করত, তা সে আর এমন কি! কিন্তু এই বিয়েতে যাবার কদিন আগে থেকে সে কালোবউয়ের উপর খুব তর্জন গর্জন করতে আরম্ভ করেছিল। আটপৌরে-পাড়ার লোকেই বলল-কালোবউকে উচু গলায়। বলতে শুনেছে—বেশ করেছি, তোর খুশি তু সনজেবেলা জাঙলে যেথা খুশি যাস, আমারও যা খুশি তাই আমি করি। চলে যাব আমি তোর বাড়ি থেকে। আমার ভাতের অভাব? লোকে বলেছে, কালোবউ সিংজীর কাছে যাবে বলেই শাসিয়েছিল। কাল রাত্রে পরম আর বনওয়ারী মিত্তির-বাড়ির বিয়ে থেকে ফেরার পথে কথা বলবার জন্য পিছিয়ে আসছিল। আটপৌরেরা বলে, তারা পাড়ায় এসে মদ খাচ্ছে, রাত্রি কত তা খেয়াল ছিল না, তবে চাদ উঠেছিল তখন, সেই সময় পরমের উঠানে পরমের ক্রুদ্ধ হিংস্র কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। কালোবউকে সে ডাকছিল— কোথা গেলি? কই? যাবি কোথা? যম আমি তোর–বলতে বলতে সে বেরিয়ে গেল। দু-এক জন এসেও ছিল, তখন কিন্তু পরম কি কালোবউ কেউ ছিল না, পরমের গলা শোনা যাচ্ছিল জাঙলের বাঁশবন থেকে। তারা তার গলা শুনে বুঝেছিল সে নদীর ধার দিয়ে যাচ্ছে। তারপর আর কিছু তারা জানে না। পরম আর ফেরে নাই। সকালে যারা নদীর ধারে গিয়েছিল, তারাই দেখতে পায় কালোবউ দহের জলে ভাসছে। তাদের অনুমান তারা ফিসফিস করে বলে—পায়ে কাপড় জড়িয়ে দিয়ে পরমই তাকে দহের জলে ফেলে দিয়ে পালিয়েছে। কালোবউয়ের কাপড় পায়ের সঙ্গে জড়ানো ছিল। কিন্তু আসল কথা জানত পাগল কাহার। সে কিন্তু একটি কথাও বললে না। বনওয়ারীর জ্বর হয়েছে গেল রাত্রি থেকে। জ্বরে বেহুশ অবস্থায় তাকে পাওয়া গিয়েছে। জাঙলের ধারে। কোপাইয়ের কালীদহ ওখান থেকে অনেক দূর।
সুচাঁদ আক্ষেপ করে বলে—আঃ আঃ, কি যে দলমলে মেয়ে ছিল,—অ্যাই চুল, অ্যাই বুক, যেমন চোখ তেমন দাতগুলিকে বলবে যে যোবতী মেয়ে লয়—বয়েস হয়েছে! আঃ-আঃ! পাগল শুধু ছড়া কেটে গান গাইলে—“অঙের খেলায় যাই বলিহারি! জেবন দিলেও দিতে পারি, তবু তো ছাড়তে লারি মনের মানুষে”, তারপর খেদ করে বললে—আঃ আঃ! হে ভগবান! তারপর ঝোলা-ঝম্প নিয়ে উঠল—চললাম, ঘুরে আসি দুদিন। দ্যাশ-বিদ্যাশে নতুন গান শুনিয়ে আসি।
চলে গেল সে।
দিন পনের পর। অপরাহ্নবেলা।
রোগ থেকে সদ্য সেরে উঠে দু হাতে মাথা ধরে বসে কালোবউয়ের বিবরণ শুনছিল। বনওয়ারী। তাকে শোনাচ্ছিল সুচাঁদ। বনওয়ারী চুপ করে বসে ছিল মাটির দিকে চেয়ে। ফেঁটা ফেঁটা জল চোখ থেকে ঝরে পড়ছিল। বনওয়ারীর ইচ্ছে হচ্ছিল, চিৎকার করে কাঁদে। সকলের কাছে চিৎকার করে বলে—জান না, তোমরা জান না, দোষ আমার। আঃ! সে যদি পরমকে দেখে ভয়ে জলে না ড়ুবে জল থেকে উঠে পরমকে আটকাত, তা হলে কালোবউ ছুটত না এমন। দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে। দহের কিনারায় বাবাঠাকুরের শিমুলবৃক্ষের ওই শিকড় ধরে উঠতে যেত। না। পরমের তাড়ায় সে ছুটেছিল, করালীর পাপে বাবাঠাকুরের বাহনের দংশনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। গেল দহের জলে। দোষ তারই। করালীকে সে শাসন করে নাই। দোষ তারই, সে সঙ্গে সঙ্গে কঁপ দিয়ে পড়ে নাই। নিজের পরানের ভয়ে, দুর্নামের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পালিয়ে এসেছে। সে মরলেও তো পারত। দোষ তার নিজের
মনে মনে অত্যন্ত যন্ত্রণা হচ্ছে তার। এ পাপের তার আর খণ্ডন নাই। হে ভগবান, হে হরি, হে কালারুদ্দু, হে ধরম, হে বাবা কত্তাঠাকুর, তোমরা বওয়ারীকে মার্জনা কর, রক্ষা কর।
তাকে ঘিরে পাড়ার প্রবীণ মেয়েরা সব বসেছে। সকালবেলা মরদেরা সকলেই কাজে গিয়েছে। জ্যৈষ্ঠে জল পড়েছে, ধানের ক্ষেতে চাষের সময় হয়েছে। বীজ পাড়তে, জমিতে চাষ দিতে হবে। বাতের চাষ। অর্থাৎ সময়ের চাষ। এ সময় একটা ‘বাতের চাষ’ বিঘেহুঁই দু গাড়ি। সারের সমান। এ কামাইয়ের সময় নয়। ‘খানিক আধে’ শরীরের ‘বেজুত’ অর্থাৎ অসুস্থতা চাষের মুনিষে এ সময় গ্রাহ্য করে না। তা ছাড়া মনিব আছে, মনিবে বলে—এত যারা ‘সুকুমারী তাদের আবার চাষ করা কেন? কথা ঠিকই বলেন তারা। ‘মি নইলে মাড়ন হয় না, পাচন নইলে গরু হটে না, সওয়ার নইলে ঘোড়া ছোটে না, তেমনি মনিবওই সদ্গোপ মহাশয়দের মত চাষী মনিব ছাড়া কৃষাণ-কাহার মুনিষ ঠিক ঠিক কাজ করে না। বাবুদের হল অন্য কথা। তাদের ঠিক চাষে মন নাই। সদূগোপ মনিবদের কাহার কৃষাণেরা কেউ বাড়ি নাই। বনওয়ারীকে ঘিরে আছে পাড়ার প্রবীণ মেয়েরা। শুধু নয়ানের মা বাদে।
মেয়েদের দলের মধ্যে বসনও এসে সেই সকাল থেকেই বসে আছে।
তার সমস্যা মেয়ে-জামাই নিয়ে। করালী-পাখী কোঠাঘর তুলল। এই নিয়ে পাড়ার মেয়েরা যে গবেষণা করছে, তাতে তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। সে নিজেও ভেবে দেখেছে, কেউ কখনও করে নাই। করালী করছে—অনিষ্ট ঘটা বিচিত্ৰ কি? কিন্তু করালী মানবে না। অন্য কোনো মেয়ে হলে মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে ঝগড়াই হয়ে যেত। সুচাঁদের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গিয়েছে করালী-পাখীর করালী সুচাঁদকে প্রায় দূর করেই দিয়েছে। সুচাঁদ কাঁদছে, বাবাঠাকুরকে ডাকছে, করালী-পাখীকে এবার আর অভিসম্পাত দিচ্ছে না, তিরস্কার করছে এবং বাবাঠাকুরকে বলছে—মতি ফিরিয়ে দাও, সুমতি দাও। প্রথম দিন সে আনন্দে গৌরবে পাখীর বাপের জন্য, নিজের বাপের জন্য কেঁদেছিল। কিন্তু পরে বুঝেছে বিপদ। সর্বাগ্রে সে-ই বুঝেছে। বারণ করতে গিয়েছিল। করালী তাকে দরজা দেখিয়ে বলেছে—নিকালো অর্থাৎ বেরিয়ে যাও।
ও-পাশ থেকে নয়ানের মা ফোড়ন দিয়েই চলেছে। হে বাবা, একবার যেমন নিয়েছ, আবার তেমনি করে নিয়ো। তোমার বাহনের বিষ নিশ্বাসে ‘ফুস্ধা’ করে দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে এবার দ্যাল চাপা বাবা! কোঠাঘরের দ্যাল-হড়মুড় করে।
নসু গাল দিচ্ছে ইঙ্গিতে হাঁপাতে হাঁপাতে ‘ফুস-ধা’ হয়ে যাবে লো! অর্থাৎ নয়ান। যে মুখে পরের মন্দ চায় লোকে, সে মুখে লোকের পোকা পড়বে লো!
দু হাতের বুড়ো আঙুল নাড়ছে আর ঢেউয়ের মত দুলছে।
বাকি গোটা পাড়াটা স্তব্ধ হয়ে রয়েছে কালবৈশাখীর অপরাত্নের মত। বনওয়ারী ভাল হয়ে ওঠার অপেক্ষা করছে। করালী ভীষণ হাঙ্গামা বাধিয়েছে। সে বাবাঠাকুরের শিমুলবৃক্ষের চেয়ে মাথা উঁচু করে উঠেছে। সত্যিই উঠেছে। আবার সেদিন শিমুলগাছের উপরে উঠেছিল। এবার আর ডালে উঠেই ক্ষান্ত হয় নাই, একেবারে ডগায় উঠে কাহারপাড়াকে হেঁকে বলেছিল—দেখ।
করালীর অপরাধেই যত অঘটন ঘটছে, এই অপবাদের প্রতিবাদেই সে গাছটায় আবার উঠেছিল। এবার সে চমৎকার একটা টিয়াপাখির ছানা পেড়ে এনেছে শিমুলবৃক্ষের কোটর থেকে। আগের থেকে অনেক গুণ তার বড় বেড়েছে। কোট পেলেন পরে বেড়াচ্ছে। বলে-যুদ্ধের পোশক। যুদ্ধের চাকরি নিয়েছে করালী। হঠাৎ সেদিন ওই পোশক পরে এসে বললে যুদ্ধের চাকরি নিলাম! এবার আর দিনমজুরি নয়। মাসমাইনে। পায়ে জুতো। ফোস্কা পড়েছে, খুঁড়িয়ে চলছে, তবু জুতো ছাড়বে না। ছোঁড়ারা সব চুলবুলিয়ে উঠেছে। প্রবীণদের আশঙ্কার অবধি নাই। কিন্তু বসনের সমস্যা কোঠাঘর। সেই কোঠাঘরের কল্পনা সে কাজে পরিণত করতে শুরু করেছে। ঘর আরম্ভ করে দিয়েছে।
বিয়েবাড়ি থেকে ফিরেই হল বনওয়ারীর অসুখ। বসন বিব্রত হয়ে ধরেছিল রতনকে, প্রহ্লাদকে। পাগল থাকলে ভাল হত, কিন্তু সে সেইদিনই সকালে চলে গিয়েছে, বলে গিয়েছেদুদিন ঘুরে মন ভাল করে আসি। পনের দিন হয়ে গেল, আজও ফেরে নাই।
রতন প্রহ্লাদ অবাক হয়ে বলেছিল—কোঠাঘর।
–হ্যাঁ। তোমরা বারণ কর। যা পিতিপুরুষে করে নাই, তা করতে নাই। রতন এসে বললে—করালী?
—কি? করালী বুঝতে পেরেছিল।
—কোঠাঘর করেছিস তু?
–হ্যাঁ।
—পিতিপুরুষে কখনও করে নাই।
—তা না করুক। আমার বাবা যুদ্ধের কাজও করে নাই।
রতন এগিয়ে এল এবার।–দেখ করালী, কথা শোন্। ভাল, আমাদের কথা না শুনিস, বনওয়ারীর কথা শুনবি তো?
—যদি না শুনি?
প্ৰহ্লাদ এবার ধমক দিয়ে বললে—শুনতে হবে। সবাই শোনে, তুমি শুনবে না কি রকম? সে সেরে উঠুক, তার সাথে সলাপরামশ্য করে যা বলে কবি।
করালী বলেছিল-যাঃ কচু খেলে! এর আবার সলাই-বা কিসের, পরামশ্যইবা কেনে? যাও যাও। তোমাদের সলাপরামশ্য যদি লাগে তো মাতব্বরের জ্বর ছাড়ার লেগে বসে থাক গা। আমার সলাপরামশ্য চাই না।
প্ৰহ্লাদ বলেছিল—ঘর করতে হলে নেয়ম হল মাতব্বর এসে দড়ি ধরে।
–আমি নেয়ম মানি না।
—তোর বুঝি গায়ে জোর হছে বেজায়? ধরাকে সরা দেখছিস?
—সরা নয়, খুরি। যাও যাও, মেলা ফ্যাঁচফ্যাঁচ কোরো না।
রতন মাথলার বাবা, মাথলা করালীর সারে, রতন তাকে বলেছিল-দুদিন সবুরই কর। না কেনে বাবা।
উঁহু! বর্ষার আগে ঘর সারতে হবে অতনকাকা। সবুর করবার টায়েম কোথা? আমার আবার যুদ্ধের চাকরি। যেখানে হুকুম করবে, যখন বলবে, তখুনি যেতে হবে।
রতন বলেছিল—কিন্তু ভাল কাজ হচ্ছে না করালী। কেউ কখনও করে নাই কোঠাঘর।
—না করুক। আমি করবই।
গুপী বলেছিল—যা কেউ করে নাই, তা করতে গেলে খ্যানত হয়। চৌধুরী মাশায়রা দালান করতে ইট পোড়ালে, লোকে বারণ করেছিল, সে আমলে চৌধুরী শোনে নাই, ইটের ভাটা পুড়ল উদিকে চৌধুরী মাশায়ের ছোট বেটা ধড়ফড়িয়ে মরে গেল।
–আমার তো বেটা হয় নাই এখনও। হেসে জবাব দিয়েছিল করালী।
আফসোস হচ্ছে বসনের। এ জামাই নিয়ে কখনও সুখ পাবে না সে। এইসব কি কথাবার্তার ধরন, না ছিরি! এইসব মাথার মাথার লোকের সঙ্গে এই ধরনের কথাবার্তা যখন করালী বলে, তখন বসন ভয়ে লজ্জায় সারা হয়ে যায়। নিমতেলে পানুকে তো সে মারতে বাকি রেখেছে। নিমতেলে পানু করালীর সামনেও আসে নাই। মুখখামুখি তাকে কোনো কথা বলে নাই; নিজের বাড়িতে বসে সে নয়ানের মাকে বলেছিল—এ কাল তাকাৎ তিন-তিনটে মোড়লমাতব্বরের গুষ্টি গুজুরে গেল—আটপৌরেদের পরমদের ঘর, ঘরভাঙাদের বাড়ি, কোশকেঁধেদের গুষ্টি, তারা কেউ কোঠাঘরে পরিবার নিয়ে শোয় নাই বাবা।
কথাটা করালীর কানে উঠতেই সে পানুর বাড়ি বয়ে গিয়ে তার সামনে উপ্ত হয়ে বসে। বলেছে—হা শালো, মাতব্বরেরা কোঠায় শোয় নাই বলে আমি শুতে পাব না।
নিমতেলে পানু সেদিন সেই চড় খাওয়া অবধি করালীকে দুর্দান্ত ভয় করে। সে কোনো জবাব দেয় নাই। করালী তবু ছাড়ে নাই, নিরুত্তর পানার মুখের সামনে ঠিক পানার মত ভঙ্গিতে বসে ভেঙিয়ে মৃদুস্বরে শ্লেষের সঙ্গে বলেছে—হা শাপলা, বনওয়ারী মাতব্বরের পরিবারের যে রঙ কালো, দেখতে সে যে কুচ্ছিতা বলে আমি ফরসা সোন্দর মেয়ে বিয়ে করতে পাব না? তোমার পরিবারের তো অঙ ফরসা, তা—তাকে তুমি ছাড়। শালো। বলি ওরে শালো! বসে বসেই খানিকটা এগিয়ে গেল পানুর দিকে।
পানু বেচারি ভয় পেয়ে গিয়েছিল, সভয়ে সেও বসে বসেই পিছিয়ে সরে যেতে চেষ্টা করেছিল, বলেছিল—ওইওই, উ সব কি কথা?
করালীও বসে বসে পানুর দিকে আরও এগিয়ে গিয়েছে আর বলেছে ইটের বদলে পাটকেল রে ছুঁচো।
—তোর যা মন তাই কবৃগা কেনে! আমার কি!
আরও খানিকটা সামনে এগিয়ে বসে করালী প্রশ্ন করেছে—তাই তো শুধাইছি রে ছুঁচো, তোর কি? আমি কোঠাঘর করব, তাতে তু কথা বলবি কেনে? শালো ছুঁচো!
বসন্ত বারবার অনুরোধ করেও করালীকে প্রতিনিবৃত্ত করতে পারে নাই। মহিষের মত তার গো। অবশেষে পাখী এসে তাকে ক্ষান্ত করে উঠিয়ে নিয়ে যায়। যেমন করালী, তেমনি পাখী। মেয়ের রঙ যেমন গোরো, তেমনি তেজ–
যেন আগুনের হা। ভয়-ডর নাই। করালীকে বললে—উঠে আয়।
করালী গ্রাহ্য করলে না।
—শুনছিল?
–না।
মেয়ে এসে ধরলে তার হাত, ছাড়িয়ে নিলে করালী। পাখী ধরলে তার চুলের মুঠো, করালী মাথা ঝুঁকি দিয়ে চুল ছাড়িয়ে রেগে উঠল, হাক দিয়ে উঠল—অ্যা-ই! সঙ্গে সঙ্গে পাখী নিজের কপালে পাগলের মত কিল চড় মারতে আরম্ভ করলে—এই লে—এই লে—এই লে!
করালী হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর গিয়ে তার হাত ধরে মিষ্টি কথায় আনুগত্য স্বীকার করে বললেচ চ বাপু, চ। ঘর যেছি আমি। থাম বাপু, থাম। আসবার সময় নয়ানের মাকে বলে এসেছি, মরাকে আমি কোনো কথা বলি না। মরার গালেও আমার কিছু হবে না। দে তুই গাল, দে যত পারিস।
পাখী তাকে নিবৃত্ত করতে পারে কোঠাঘর তোলার সঙ্কল্প থেকে। কিন্তু পাখীও ক্ষেপেছে কোঠাঘরের জন্যে। যেমন একালের ছেলে, তেমনি একালের মেয়ে। পাখী বলেচন্ননপুরের বাউরিরা কোঠাঘর করেছে—হারু বাউরি, শম্ভু বাউরি, কানাই বাউরি।
—সে তো চন্ননপুরে। আর তারা তো কাহার লয়।
—তা হোক কেনে।
তাই বসন্ত এসে বসে আছে বনওয়ারীর কাছে। সুযোগ পেলেই বনওয়ারীকে বলবে। করালীকে এক সে-ই নিবৃত্ত করতে পারে। তা ছাড়া আর একটা আশঙ্কা আছে তার। করালী যাদের সঙ্গে ঝগড়া করেছে, তারা নিশ্চয় সাতখানা করে বনওয়ারীর কাছে করালীর বিরুদ্ধে লাগাবে। বনওয়ারীকে বুঝিয়ে সে আগে থেকেই ঠাণ্ডা করে রাখতে চায়। বনওয়ারী মাতব্বর বিরূপ হলে করালীর কি হবে, সে কথা ভেবে বসন্তের অনেক আশঙ্কা। কিন্তু এ মজলিসের মধ্যে বলবার সুযোগ পাচ্ছে না সে। ভাগ্যক্রমে হঠাৎ সুযোগ মিলল। হঠাৎ বনওয়ারী উঠল। গোপালীবালা বললে—এই, কোথা যাবা?
বাবাঠাকুরের থানে। তার মুখ দেখে কেউ ‘না’ বলতে পারবে না।
বনওয়ারী উঠতেই বসন্ত বললে—চল, আমি যাই সাথে।
স্নেহভরে বনওয়ারী বললে—আসবি? আয়। লইলে বনওয়ারী একটা জ্বরে কাবু হয় না, এখনও তোর এক কোশ পথ গিয়ে ফিরে আসতে পারি, দুপুরের মধ্যে। একটু হাসলে সে।
যাবার পথে হেসে বলদ দুটি এবং গাই কয়টির কাছে দাঁড়িয়ে তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করলে। ডাইনের আটকেলে অর্থাৎ সাদার উপরে আটটি কালো দাগবিশিষ্ট বলদটা বনওয়ারীর বড় ন্যাওটা। ওটা তার ঘরেরই বাছুর বলদটা তার হাত চেটে মাথা নেড়ে নানা ভঙ্গিতে আনন্দ প্রকাশ করলে। বনওয়ারী একটু প্রসন্নতার স্পর্শ পেলে ওদের কাছ থেকে। মনে মনে বললে মা ভগবতী, তোমাদের সেবার তো কখনও তুটি করি না মা, তোমাদের আশীর্বাদে আমার এই পাপটি খণ্ডে দাও।
পথে সেই আটপৌরে-পাড়ার বটগাছের তলায় কালোবউয়ের সঙ্গে তার দেখা হত। বনওয়ারী বললে—একটুকুন দাঁড়া বসন।
বসন ভাবলে, ক্লান্তি। বললে–না এলেই হত! বললে—পরে আমি এসে কত্তার গানের মিত্তিকে নিয়ে যেতাম।
বনওয়ারী উত্তর দিলে না। সে ভাবছে। কালোবউয়ের কথা, তার অপরাধের কথা।
—বনওয়ারী হ? অর্থাৎ বনওয়ারী নাকি?
বনওয়ারী ফিরে তাকালে। আটপৌরে-পাড়ার বুড়ো রমণ আটপৌরে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখে। রমণ পরমের আত্মীয়-ভায়রাভাই, কালোশশীর বড় বোনকে সে বিয়ে করেছে। বনওয়ারী তার বাকা ভেঙে-পড়া মূর্তির দিকে চেয়ে রইল। রমণ প্রবীণ লোক, সুচাঁদের বয়সী। তবে সুচাঁদ শক্ত আছে, রমণ ভেঙে যেন দুমড়ে গিয়েছে। এক সময় রমণ শাহী লম্বা ছিল। লোকটাকে রোগেও ধরেছে। বনওয়ারী শঙ্কিত হল। পরম-কালোশশীর আত্মীয় রমণ তাকে দায়ী করতে এল নাকি? বনওয়ারী জোর করে হেসে বললে–হা গো। যাব একবার কত্তার থানে। তা যে বিকেলের ওদ, বার-চোদ্দটা রোপবাস হল, শরীরে বল নাই, তাই বসলাম একবার গাছতলায়।
বসন বিরক্ত হল। কথাগুলি বলবার বড় সুন্দর সুযোগটি তার মিলেছিল।
রমণ বনওয়ারীর কাছে বসল। বললে—মদের বেপার তো সব শুনেছ? আঃ, কালোশশীর লেগে দুঃখ হয় আমার!
আবার বুকটা ধড়া করে উঠল। কে জানে বুড়ো কি বলবে? আটপৌরে-পাড়ার কেউ কি জানে না, কেউ কি শোনে নাই, পরম যে কথা জেনেছিল পানার কাছে? পানা কি
রমণ বললে যতই ঢেকে কর পাপ, সময় পেলেই ফলেন পাপ, পাপ মানেন না আপন বাপ। বুঝলে কিনা—পরমের পাপের ফল। কালোশশীরও বটে, নইলে অপঘাতে মিত্যু! অনেক মানা করেছি তাকে। ভূপসিং ব্রাহ্মণ, তার পরশে পাপ হয়—কতবার বলেছি।
বনওয়ারী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে।
রমণ বললে—আচ্ছা সেদিন এতে আসবার পথে কি কথা বলবার লেগে ডেকেছিল পরম? কি বলেছিল তোমাকে?
বনওয়ারীর বুক ধড়ফড় করতে লাগল।
-বনওয়ারী!
বনওয়ারীর একটা কল্পিত কাহিনী চকিতে মাথার মধ্যে এসে গেল। সে বললে বলেছিল চন্ননপুরের সিং মশায়ের কথা। বলে-ভাই, তু যদি আমার সাথে থাকিস; তবে ওই শালাকে একদিন ঠেঙাই। বলে—সাবাড় করে শালোকে দহে ফেলে দোর গলায় কলসিতে বালি ভরে। তা আমি অনেক বুঝালাম। শেষ চটাচটি হল আমার সাথে। আমাকে বললে—আমার জাত গিয়েছে বললি কেনে মাতালশালায়? বলে আচমকা লাফিয়ে পড়ল ঘাড়ে। তা’পরে মারামারি। আমি কাবু হয়ে গেলাম। আমাকে ফেলে তখন হনহনিয়ে চলে এল। কি করব আমি, সব্বাঙ্গে বেথা, ধুলো বালিপথে পুকুরে নামলাম। তখন শুনলাম, কালোবউকে গাল দিতে দিতে যেছে। পরম। আমার তখন জ্বর এয়েছে-কঁপছি। তা’পরেতে তো পাগল গেল। সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে।
রমণ বললে—যাক, তোমারও যে জ্বর! ডরিয়েছিল সকলে। বেঁচেছ এই কাহারপাড়ার ভাগ্যি। না মাথা, না ছাতা। এক তুমিই আছ। আমরা এ পাড়ায় তাই বলি, অমনি মাতব্বর যদি আমাদের হত! তা সেদিনে আমি বললাম পাড়াতে যে, আর আমাদের আলাদা হয়ে থেকে কাজ কি? এক হলেই হয়। করণকারণ কর, বিয়েশাদি হোক। আমাদের আটপৌরে আর ক’ঘর? বাঁশবাঁদি ছাড়া হুই হোথা—হেথাকার নীলকুঠি যেথা ছিল, সেখানে দু’ঘর চার ঘর আছে। তাও। আবার সব জাগায় নাই। তুমি বাবা, মাতর হয়ে এইটি কর। নইলে আটপৌরে-পাড়ার পিতুল নাই। আমি বিদ্ধ হলাম, এখনও আমার দাগী নাম ঘুচল না বাবা।
বনওয়ারী অবাক হয়ে গেল।
এ কি ভগবান হরি কালারুদ্দু কত্তাঠাকুরের লীলা! মনে মনে সে প্রণাম করলে দেবতাদের। এ কি দুঃখের মধ্যে সুখ, ভাঙনের মাঝে গড়ন!
সে বললে—একটুখানি সারি অমনদাদা। তা’পরতে হবে সব কথা।
রমণ বললে—তোমার শরীলে বল হোক, একদিন নিয়ে যাবা আমাদিগে চন্ননপুরে বড়বাবুর কাছারি। পরম তো ফেরার। সে আর ফিরবেও না। তা সায়েবডাঙায় পরম যে জমি পাঁচ বিঘে। নিয়েছিল, আমাদের আটপৌরেরা ভাগ করে লোব। বাবুর একটা ‘রনুমতি’ তো চাই। তা আমাদের হয়ে সে কথা বলবার নোক নাই।
বনওয়ারী উঠল। রমণের কথাটা সে বুঝেছে।
বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে ‘কত্তার থানে’র শোভাটি হয় মনোরম। বেলগাছগুলি অজস্র কচি পাতায় ভরে উঠেছে, কুলঝোপগুলিতেও কচি পাতার সমারোহ, বেলগাছের পাতায় সমৃদ্ধির মধ্যে পাকা বেল দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু গন্ধ উঠছে। কিন্তু কর্তা স্বয়ং যে গাছটিতে থাকেন, সে গাছটির আশ্চর্য মহিমা। সকল গাছে পুরনো পাতা ঝরতেই চৈত্রমাসের বিশ-পঁচিশ দিন চলে যায়, তারপর বেলগাছ কয়েকদিন ন্যাড়া হয়ে থাকে—শুধু বেলগুলো ঝুলতে থাকে, বৈশাখের আট-দশ দিন। গেলে তবে কচি পাতা দেখা দেয়। কিন্তু কর্তার বাস যে গাছটিতে, সেটির পাতা চৈত্রের প্রথম সপ্তাহে ঝরে যাবেই, গাজনের আগে তাতে পাতা দেখা দেবেই। না দিলে চলবে না যে। জাঙলের বাবা কালারুদ্রের মাথায় গাজনের পুজোয় ঐ গাছের নতুন বেলপাতা প্রথমেই চড়াতে। হয় যে। এমন চৈত্র মাসে পাতা-ধরা গাছ এ চাকলায় আর নাই। বাবার মহিমায় গাছটির আশপাশে এই বিবৃক্ষের দু-চারটি চারাপল্লবও হয়েছে। হবেই যে, যুগে যুগে এ মাহাত্ম্য বজায় থাকতে হবে তে। শেওড়া গাছগুলিতেও নতুন পাতা ধরেছে। সোয়াকুলের ঝোপগুলিতেও নতুন পাতা। গাছগুলির মাথায় চারিপাশের কুলঝোপগুলির মাথা ছেয়ে আলোকলতা ছড়িয়ে পড়েছে। ছাতার মত। মধ্যে মধ্যে ফুলে-ভরা ধুতুরা ও আন্দের গাছ; সবচেয়ে বাহার দিয়েছে একটা বাদলাঠির গাছ। গাছটা ভরে অজস্র হলুদ রঙের ফুল ফুটেছে লম্বা ডাটায় অসংখ্য ফুল। ফুলের ভারে নুয়ে পড়ে দুলছে। ফুলঝুরি না বললে সে ফুল ফোটার সঠিক বর্ণনা হয় না। চারপাশে তালগাছের বেড়া। তাল ধরে হয়েছে কাদি কাদি। কর্তার থানটির আর একটি মহিমাচারপাশে নজর চলে। পুবে ওই দূরে—পলেনের মাঠের কিনারায় দেখা যাচ্ছে বাঁশবাঁদি, তার পাশে সেই দহ, যে দহে ড়ুবেছে কালোবউ। উত্তরে তাকাও, দেখবে দেখা যাচ্ছে জাঙল গ্রাম। উত্তর-পূর্বে চন্ননপুর ইস্টিশান একেবারে পরিষ্কার দেখতে পাবে। পশ্চিমে তাকালে সায়েবডাঙা নজরে পড়বে। পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে তাকাও, নজরে পড়বে কোপাইয়ের হাঁসুলী বাঁকের প্রথম খোচ। মোটা কথা, কর্তা এই বেলগাছটিতে বসে রুদ্ৰাক্ষের মালা জপ করেন, আর গোটা হাঁসুলী বাঁকে তার দৃষ্টি দেন। প্রসন্ন দৃষ্টিতে মানুষের ঘরে সুখ শান্তি উছলে পড়ে, মাঠে ফসল লুটিয়ে পড়ে, পশ্চিম আকাশের ঝড় সসম্মানে হালীর বাঁকের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কোপাইয়ের বান দুকূল ভাসিয়ে আসতে আসতে এ কুল ছেড়ে ও কুল ভাসিয়ে চলে যায়। আবার কোপদৃষ্টি হানলে এর উল্টো হয়। ঘরে ঘরে দুঃখ, ঝগড়াঝাটি, লাঠালাঠি, মনে মনে অসুখ, গায়ে গায়ে বিবাদ, আকাশে অনাবৃষ্টি, মাঠে অজন্ম, মাথার উপর ঝড়, কোপাইয়ের বান সেবার হাঁসুলী বাঁকের ওই প্রথম খোচই বল আর খাজই বল—এইখানে যে বাঁধ আছে, সেই বাঁধ ভেঙে হালীর ব্যাক ভাসিয়ে চলে যায়।
উপুড় হয়ে পড়ল বনওয়ারী বেলগাছের সামনে। হে দয়াময়, হে প্ৰভু, হে হাঁসুলী বাঁকের মঙ্গল-অমঙ্গলের মালিক, হে বাবা ইহলোকের রক্ষাকর্তা, পরলোকের ত্রাণকর্তা, তুমি বনওয়ারীকে রক্ষা কর, ত্রাণ করবার ভরসা দাও। সকল পাপ তুমি ক্ষমা কর। পাপ সে। করেছে—একশো বার হাজার বার সে স্বীকার করছে তোমার চরণতলে। চোখ থেকে তার জল পড়ল। অনেক প্রার্থনা করে সে উঠে বসল।
বসন অবাক হয়ে গেল তার চোখে জল দেখে। বনওয়ারীদাদা ভাল লোক, ধৰ্মিষ্ঠ তা সে জানে; কিন্তু এত বড় ধর্মাত্মা তা সে জানত না। মাথার উপর রোদ চড়ছে, বনওয়ারীর দুর্বল শরীর, তাড়াতাড়ি ফেরাই উচিত, কিন্তু এরপর আর সেকথা বলতে তার সাহস হল না। গাছের ছায়া দেখে সেইখানেই বনওয়ারী বসল উবু হয়ে। এতক্ষণে তার মন খানিকটা শান্তি পেলে। বুকের ভিতরের উদ্বেগ অনেকটা উপশম হল। কর্তাবাবার কৃপায় পাপের অবশ্যই খণ্ডন হবে। মনে মনে সে মানত করেছে। তারপর রমণের সঙ্গে দেখা হয়েছে, সেও ভাল হয়েছে; পরমের সঙ্গে পথের বৃত্তান্তটাও খুব চমৎকার হয়েছে; এরপর আর কোনো দোষ তার ঘাড়ে আসবে না। অপরাধ অবশ্য তার অল্পই। সে পরমকে ইচ্ছা করলে মেরে ফেলতে পারত, কিন্তু মারে নাই। কালোবউকে নিজেও সে ডাকে নাই। সে তাকে দেখতে গিয়েছিল। বলতে গিয়েছিল পরমের আসবার কথা। কালোবউই নিজে থেকে তার হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল নদীর ধারে। পরমই কালোবউকে খুন করতে গিয়েছিল। কালোবউ নিয়তির টানে গিয়ে পড়ল কর্তার দহে। বলতে গেলে কৰ্তাই তাকে সাজা দিয়েছেন। তার অপরাধ—সে জলে ড়ুব মেরেছিল পরমকে দেখে, উঠে বাধা দেয় নাই, আর কালোবউকে তুলবার জন্য জলে ঝাপিয়ে পড়ে নাই। ভাবতে ভাবতে শিউরে উঠল সে। ভাগ্যও ভাল যে ঝাপ দিয়ে পড়ে নাই, নইলে সেও আর উঠত না। বাবার বাহন—বাবার বাহনই তাকে দহের বুকে ড়ুবিয়েছে। সে চোখে দেখেছে। করালীর পাপেই মরল কালোবউ।
হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় পাপ আছে—পুণ্য আছে। পাপপুণ্যের চেয়ে, বিষয়বুদ্ধি ধর্মবুদ্ধি বলাই ভাল। সংসারের বাঁশবন এবং জৈব কামনার আদিম কালের আপনি-জন্মানো, বট-অশ্বথ শিমুল-শিরীষ গাছের ঘন বনের ছায়ার তলায় জন্মানো পাপপুণ্যবুদ্ধির গাছগুলির চেহারা বিচিত্র হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবনে এবং বটবনে সযত্নে পোতা আম-কঁঠালের চারার মত বিবৰ্ণ এবং হিলহিলে তাদের চেহারা, বট অশ্বথ এবং বাঁশবনের ওই ঘন ছায়ার মধ্যেও এরা আলোক ও উত্তাপের কিছু কিছু আস্বাদ পায় এবং আরও বেশি পেতেও গভীর কামনা তাদের আছে। কিন্তু কোনোমতেই যেন পেরে উঠছে নাহাঁসুলী বাঁকের মাঠ যেন বটগাছ বাঁশগাছকেই বেশি রস দিচ্ছে। কাহারেরা সতৃষ্ণনয়নে তাকিয়ে থাকে এই আম-কঁঠালের গাছগুলির দিকে। কবে বড় হয়ে ছাড়িয়ে উঠবে বাঁশবনের অন্ধকার! বটের পাশে ওরা মেলবে পল্লব! কবে দেবে ফল! কিন্তু কোনো ভরসাই পায় না। এই গাছগুলি মরছে অথবা বাঁচবার পথে বাড়ছে—সে কথায় কাহারপাড়ায় দ্বিমত রয়েছে। সুচাঁদের মত হল, মরছে—নিশ্চয় মরছে। অধিকাংশ প্রবীণের মতই তাই। সুচাঁদ বলে—সেকালে লোকের ভক্তি কত ছিল। ঘর ঘর দিত মানসিকের পাটা। অ্যাই বড় বড় পাটা, অ্যাই তার ডাড়ি। ড্যার বছর এক বছর বয়েস না হলে বলিদানই দিত না। আতে চুরি করতে যেত মরদেরা-কত্তার ঠাঁইটিতে পেনাম করে তবে যেত। মেয়েরা কারুর সাথে অঙ করতে আগে কত্তার গাছতলায় একথান সিঁদুর দিয়ে তবে অঙ করতে নামত। কত্তা লোককে স্বপনে আদেশ দিত। গুপীর কত্তাবাবা মাথা ঠুকলে কত্তাবাবার গাছের শেকড়ে ই পরিবার নিয়ে আমি কি করি, তা বল বাবা তুমি! গুপীর কত্তামায়ের অঙ হয়েছিল ওই পাড়ার একজর সাথে। বাবা স্বপন দিলে—মেরে ফেলাও বিষ দিয়ে। স্বপনে বাবা ইয়েদের গরুমারা বিষ হাতে দিয়ে বললে—এই লে। সেই বিষে মরল গুপীর কত্তামা। তারপর সে বলে—সে আমও নাই, সে অযুধ্যেও নাই। মানুষের সে বেম নাই-ভক্তি নাই, বাবাও নিজের মহিমে গুটিয়ে নিয়েছেন। যেমন কলি তেমনি চলি। কলিকালে ধম্মই নাই। তাই মানুষের হালচাল এমুনি। জাঙলের চৌধুরী মশায় বলতেন—কলিকালে ধম্মের এক ঠ্যাঙ। তাও ক্ষয়ে আসছে।
ক্ষয়ে এলেও খানিকটা আছে, তাই এখনও কিছু কিছু আছে। বনওয়ারী তার উল্টো মত অবশ্য পোষণ করে না, কিন্তু তবু সে প্রত্যাশা করেহাঁসুলী বাঁকের মধ্যে সে ধর্মের ওই একটি ঠ্যাঙকে আর ক্ষয়ে যেতে দেবে না। বনওয়ারী এসে গড়িয়ে পড়ল বাবার থানে। সান্ত্বনাও সে পেলে। মনে মনে বললে—ক্ষমা কর, বাবা, ক্ষমা কর। আমি তার জন্যে দায়ী নই। তবে করালীকে আমি সাজা দিই নাই, সে অপরাধ আমার বটে। কিন্তুক হে বাবাঠাকুর, তার জন্যে তো আমার বুক খালি করে কালোবউকে কেড়ে নিয়েছ। এইবার তোমার কোধ শান্ত কর।
যে যতই বলুক, বনওয়ারী জানে, কালোবউয়ের সঙ্গে তার ‘অঙের’ খেলার অপরাধ বাবাঠাকুরের কাছে বড় পাপ নয়। অজ্ঞান কাহারদের এ অপরাধ ধরেন না বাবা। বাবাঠাকুর কাহারদের দণ্ডমুণ্ডের মালিক—তিনি বোঝেন যে কাহারদের ‘অঙের খেলা ছাড়া আর কোনো মন-ভুলানো খেলা নাই। বাবাঠাকুরের কাছে প্রধান অপরাধ করেছে করালী। সে-ই বাহনটিকে পুড়িয়ে মেরেছে। তার শিমুলবৃক্ষে বার বার উঠে তার ঘুমের ব্যাঘাত করেছে। করালীই আবার কাহারপাড়াকে যুদ্ধে যেতে বলেছে। অসুখের মধ্যে এইসব ভাবনা ভাবতে গিয়ে বনওয়ারী একটি নূতন সত্য পেয়েছে। বাহনের শিসের মানে বুঝেছে। শিস দিয়ে দিয়ে সাবোধান করে দিচ্ছিলেন। হাঁসুলী বাঁকের কাহারকুলকে সাবোধান! হাঁসুলী বাঁকের মাথার উপর দিয়ে গোঙাতে গোঙাতে নিত্যি উড়বে উড়োজাহাজ। চন্ননপুরের জাতনাশা কারখানা বেড়ে এগিয়ে আসবে এই দিকে। পিথিমীতে যুদ্ধ লেগেছে-সাবোধান! করালীকে আড়াল করতে গিয়ে বাবাঠাকুরের হাতে মার খেলে বনওয়ারী, বনওয়ারীর বুকে আঘাত দেবার জন্যেই বাহন ছোবল দিলে কালোবউয়ের বুকে।
বনওয়ারী চুপ করে বসে রইল বেলগাছটির তলায়। সামনেই পশ্চিমে সায়েবাঙা; সেখানে কালো কালো মানুষেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। মধ্যে মধ্যে গরম বৈশাখী দমকা বইছে। আটপৌরেপাড়ার সেই বটগাছটায় সাড়া জাগছে নতুন কচি পাতায় পাতায়।
সায়েবডাঙায় কালো কালো মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে—বাবুরা জমি কাটাচ্ছে। ওরা সাঁওতাল। বনওয়ারীর জমি আর এবার কাটানো হল না। সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ঘাড় নাড়লে।
বসন পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বনওয়ারীর মুখের চেহারা দেখে তার কথা বলতে সাহস হচ্ছে না। আর একবার যদি বনওয়ারীদাদা হাসে।
হঠাৎ বনওয়ারী উঠল। সুযোগ পেয়ে বসন্ত কথা বললে চল, বেলা অনেক হয়েছে। পথে সে সাহস করে বললে—বনওয়ারীদাদা!
—হুঁ।
—তুমি বাবু করালীকে একবার বারণ করবে।
—কাকে? করালীকে?–চোখ দুটো তার জ্বলে উঠল। বসন ভয় পেলে।
বনওয়ারী বললে—শুনেছি কোঠাঘর করছে সে! হবে তার বোঝাপড়া। একটু চুপ করে থেকে হেসে আবার বললে—আমি কি কোঠাঘর একখানা করতে পারি না বসন?
শিউরে উঠল বসন্ত। মনে পড়ল—করালী বসন্তকে এই কথার উত্তর কি দিয়েছে। বসন্ত বনওয়ারীর মনও ঠিক বুঝতে পারছে না। করালী তো কম নয়। শেষে কি দুজনে? কত কথা ভাবতে লাগল। হঠাৎ বনওয়ারী থমকে দাঁড়াল। বনওয়ারীর কিন্তু সবই অদ্ভুত! বসন বললে— কি হল? বলতে বলতে পিছন থেকে ঘূর্ণি হওয়া এসে দুজনকেই আবৃত করে দিলে। ধুলোয় পাতায় সর্বাঙ্গ ভরে গেল-মুখে ধুলোবালি ঢুকল। বসন্ত এবার এটাকেই তামাশার ভূমিকা করে নিয়ে অপরিমিত হাসতে লাগল–খু-খু, মা গো! পরক্ষণেই সে বিস্মিত হয়ে বনওয়ারীকে বললে—কি হল বনওয়ারীদাদা? দাঁড়ালে?
বনওয়ারী বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। ঘূর্ণিটা তাদের অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে চলেছে। অদূরেই আটপৌরে-পাড়ার বটগাছটা। ঘূর্ণিটা এগিয়ে গিয়ে কাণ্ডের গায়ে খুব ঘুরপাক খেয়ে থেমে গেল। গাছের পল্লবে পল্লবে চঞ্চলতা জেগে উঠল।
বনওয়ারী কাঁপতে লাগল। ব্যাপারটা বুঝেছে বসন। সে শঙ্কিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলে বা-বাওড়? অর্থাৎ ভূত?।
বনওয়ারী তার হাতটা ধরে বললে-পাশে পাশে আয়। বসন্ত তার হাতটা ধরে দেখলে, বনওয়ারীর হাতটা ঘামছে, থরথর করে কাঁপছে। বনওয়ারী তাকে সাহস দিতে চায়, না তার কাছ থেকে সাহস পেতে চায়-বুঝতে পারলে না।
সে ডাকলে-ব্যানোদাদা!
বনওয়ারী উত্তর দিলে না। হাঁসুলী বাঁকের বনওয়ারী মাতব্বর ঠিক চিনেছে, বসন চিনতে পারে নাই। কালোবউ! কালোশশী! আর কেউ নয়। কালোশশী হাসিখুশি! ঠিক তেমনি নেচে চলে গেল। সে ইশারা দিয়ে গেলবঁধু, এই গাছেই আমি বাসা বেঁধেছি।
হয়ত তাকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেল। বনওয়ারী সাহস সঞ্চয় করে আবার চলতে আরম্ভ করলে। বাড়ি এসে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। বসন নিরুপায় হয়ে ফিরে গেল।