Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ঘোড়াগোত্ত কাহারদের ডাক এসেছে

‘ঘোড়াগোত্ত’ কাহারদের ডাক এসেছে। বর-কনের পালকি বহন করতে হবে। ইলাম বকশিশ-কাপড়, পুরনো জামা, মদ, পেট ভরে লুচিমণ্ডা। যেতে হবে বৈকি। তারা যাবে। আটপৌরেদের ‘রাইবেঁশে’র দল আছে, ওদেরও নিয়ে যাবে। আলাদা হলে ওরাও কাহার, তারাও কাহার। পরমকে বলা যাক। পরমের ঘরে কালোশশীকেও একবার দেখে আসা হবে।

এই খানিক আগে, শিলাবর্ষণের সময়ে কালোশশী এসেছিল নীলবাধ থেকে হাঁস তুলে নিতে। যাবার সময়ে বকটাক্ষ করে গিয়েছে। সম্ভবত রাগ করেছে সে। রাগ হবারই কথা। বনওয়ারীরই মধ্যে মধ্যে রাগ ধরে নিজের উপর। মাতব্বরির পদ মনে হয় যেন আগুনে তপ্ত শালের উনোনের খবরদারির আসন। মাতব্বর যদি সে না হত, কালোশশীকে নিয়ে এই বয়সেই সে চলে যেত দেশান্তরের কাহার সমাজে। তাকে সাঙা করে ঘর বাঁধত। শুধু মাতব্বরির জন্য। ভাবতে ভাবতে নিজেই শিউরে ওঠে বনওয়ারী। বহু ভাগ্যের মনুষ্যজন্ম পেয়েও পূর্বজন্মের হীন কর্মের জন্য নীচকুলে জন্ম হয়েছে, ঘোড়াগোত্ত কাহার, মানুষ হয়েও ঘোড়ার মত উচ্চকুলের মানুষদের বহন করতে হয়, পালকির ডাণ্ডা ঘাড়ে নিয়ে, ঘাটা পড়ে সেখানে। বাকা বইতে হয়। মনিব-বাড়ির মরা গরু মোষ কুকুর বিড়াল ফেলতে হয়েছে এককালে—কালের গুণে বহু কষ্টে বনওয়ারীর মাতব্বরির আমলেই তা থেকে রেহাই পেয়েছে। কিন্তু চরণের তলে তো থাকতেই হবে চিরকাল। এ সব পূর্বজন্মের ফল। আবার এ জন্মে মন্দ কাজ করে কাহার থেকেও নীচকুলে জন্মাবে? কালারুদ্দের চড়কের পাটায় সে চেপেছে এবার। চড়ক-পাটার লোহার কাঁটায় শুয়ে আকাশপানে চেয়ে ডেকেছে বাবাকে। বাবা দয়া করেছেন, আবার সে পাপ করবে? আবার? না। না। ক্ষমা কর, প্রভু, ক্ষমা কর।

কিন্তু দেখতে, দেখা করতে দোষ কি? তাতে তো পাপ নাই? কালোশশীকে দেখবে। বুঝিয়ে বলবে তাকে এ জনমে হল না ভাই, আসছে জনমে যাতে তুমি পাও আমাকে আমি পাই তোমাকে তার লেগে বাবার থানে দুবেলা পেনাম কোরো। কালারুদ্দের থানে বটগাছের নামালে ঢেলা বেঁধো। আমিও তাই করব। আর মনের আগুনে পোডড়া, আমিও পুড়ি, পুড়ে পুড়ে খাটি হই, জ্বলুক। দিবানিশি কুলকাঠের ‘আঙোরা’র মত ভালবাসার আগুন ধিকিপিকি জ্বলুক। ঐ পুণ্যেই পাব আমরা দুজন দুজনকে।

রতন প্রহ্লাদ ছোকরারাও খুব উৎসাহিত হয়ে উঠেছে। অনেক দিন পর মোটা পাওনার ভাল বায়না এসেছে। উৎসাহে সদ্য এতবড় ঝড় এবং শিলাবৃষ্টির কথা ভুলে গিয়েছে। ‘বাত’ অর্থাৎ আবহাওয়া হয়েছে ভাল। এই জল এবং শিলাবৃষ্টির পরদিন হবে ঠাণ্ডা। ওদিকে মাঠে হয়েছে কাদা, সেখানে কাজ নাই। মুনিবদের চাল ভিজে ডব-ডব করছে, ও চালে এখন কদিন চাপা। যাবে না। ‘নিশ্চিন্দি’ অর্থাৎ নিশ্চিন্ত হয়ে চল সব।

মিত্ৰ-গোপালপুরে কায়স্থ মহাশয়দের উন্নতির অবস্থা। জাঙলের ঘোষ মহাশয়ের চেয়েও বাড়বাড়ন্ত। তাদের ছেলের বিয়ে। ধুমধামের বিয়ে। ‘বেলাতি বাজনা’ ‘গড়ের বাদ্যি’ ঢোল সানাই রসুন্চৌকি, শ্যামটা নাচ, রায়বেশেসে অনেক কাণ্ড। কাহারদের কপাল ভাল বিয়ে রেলরাস্তায় নয়, গায়ের পথে। আট আট ষোল বেহারার দুখানা পালকি যাবে। লুচি, মিষ্টি, পোলাও, মাছ, মাংস পেট পুরে খাওয়া—থমথমে অথচ চরণ ঠিক রাখা। তারপর সঙ্গে বিড়ি সিগারেট, ভাল কাষ্ঠগড়ার তামাক—মধুর মধুর গন্ধ, এ তো কাহারেরা মরে স্বর্গে গেলেও পাবে না। তার উপর প্রতিজনের এক-একখানা লাল গামছা কনের বাড়ির বকশিশ।

বরের বাড়ির বিদায়! এ কি ছাড়া চলে? আর কাহারেরা ছাড়লেই বা মিত্র মহাশয়েরা শুনবেন কেন? আর তো কলের গাড়ি—মোটর গাড়ির আমদানি হয়ে কাহারদের রেহাইই দিয়েছেন ওঁরা, নেহাত কঁচাপথ হলেই ডাকেন। এ না করলে চলবে কেন? এই পথের জন্যেই পালকিকাহার চাই, নইলে মিত্র মহাশয়রা ভাড়ার মোটর, বাস-মোটর আনতেন।

আট ক্রোশ করে যোল ক্ৰোশ পথ। খানিকটা পাকা, তারপর ক্রোশ ছয়েক কাচা গরুর গাড়ির পথ মাঝখানে খানিকটা আলপথ।

পালকি নইলে উপায় নেই। কাহারদের সৌভাগ্য।

পাগল আসতেই তার পিঠ চাপড়ে বনওয়ারী বললে—যেতে হবে সেঙাত। শুনেছ তো?

পাগলের খুব ইচ্ছে নাই, তবুও সে বললেচল। আজই সকালে কুলকন্ম নিয়ে বনওয়ারী তাকে যেসব কথা বলেছে, তাতে ‘না’ বললে বিচ্ছেদ হবে হয়ত।

–নাচ খানিক, নাচ।

পাগল নাচলে না। বসে পড়ল দাওয়ার উপর। তার মনে এখনও ঘুরছে করালীর কথা। তা ছোকরা খুব জবরদস্ত কথা বলছে—জাত মারে কে? তার ঘর কোথা? বটে, কথা ঠিক বটে। তুমি যদি ঠিক থাক তো জাত মারে কে? আবার বনওয়ারীর কথাও ফেনা নয়, পিতিপুরুষের কথা। সে ভাবছে।

বনওয়ারী পাগলের ভাবগতিক দেখে বিস্মিত হল। বললে—তোর হল কি বল দি-নি?

–বলব। গোপনে বলব। কঠিন কথা। বুয়েচ? মাথা ঘুরে যাবে।

বনওয়ারীর প্রাণে আনন্দের ছোয়াচ লেগেছে। পাগলের কথায় সে খুব চিন্তিত হল না; সেই পাগল তো! তার উপর করালীর ঘর উড়ে যাওয়ার পর, করালীর দম্ভের কথা সে ভাবতেই পারে না। করালীর ঘরখানা উড়ে যাওয়ায় দুঃখ হলেও সে খুশি হয়েছে। অর্থাৎ দুঃখও হয়েছে, খুশিও হয়েছে। দুঃখ-ঘরখানা, এমন ঘরখানা গেল! খুশিফঁড়া কেটেছে, পাপের অপরাধের দণ্ড ওই ঘরখানার চালের উপর দিয়ে গিয়েছে। সে তো চোখে দেখেছে মেঘের মধ্যে বাবার বাহনের রূপ। যাক ফাঁড়া কেটে গিয়েছে। এবং মনে মনে ধারণাও হয়েছে যে, করালীচরণ নিশ্চয় মনে মনে বুঝছেন। বাবাধন আজই উঠেছিলেন বাবাঠাকুরের আদ্যিকালের শিমুলবৃক্ষে। অনেক উঁচুতে উঠে খুব উঁচু হয়েছেন ভেবেছিলেন। তা এক ঝাপটে শাসনের নমুনা খানিকটা দেখিয়ে দিলেন বাবা; এবং এটাও নিশ্চয় যে, এই বনওয়ারী যদি বাবাঠাকুরকে না সন্তুষ্ট করত, তবে করালী এত অল্পে রেহাই পেত না। হয়ত বজ্ৰাঘাতই হয়ে যেত আজ।

সে চলে গেল আটপৌরে-পাড়ার দিকে। পরমের উঠানে গলার সাড়া দিয়ে ডাকলপরম! পরম রইছিস?

বেরিয়ে এল কালোশশী। পিচ কেটে ঠোট বেঁকিয়ে বললেও বাবা! পুণ্যিবান মাতব্বর। কি হে?

ভুরু নাচিয়ে ইশারা করে বনওয়ার প্রশ্ন করলে—কই? সে কোথায়? অর্থাৎ পরম।

বিচিত্ৰ হাসি হেসে কালোবউ বললে—কে জানে? হয়ত পেনয়িনীর বাড়িতে। তা তুমি? তুমি কি মনে করে? পথ ভুলে?

কিছুদিন আগের একটা কথা মনে পড়ে গেল বনওয়ারীর, সে বললপুণ্যির ভাগ দেবার কথা ছিল ভাই, তাই ভাগ এনেছি।

উত্তরে রসিকতা না করে মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে কালোশশী চাপা গলায় বললে— আসছে।

–পরম? ঘুরে তাকাল বনওয়ারী। পরম বেশ মদ খেয়েছে। টলতে টলতে আসছে।

–ক্যা? ক্যা রে? কোন্ শালো?

গম্ভীর স্বরে বনওয়ারী বললে—আমি রে পরম।

—তুমি ক্যা রে? আমিও তো আমি রে।

–আমি বনওয়ারী।

—বনওয়ারী?

–হ্যাঁ। মিত্তি-গোপালপুরের বিয়ের বায়না এয়েছে। কাহার, আইবিশে চাই। তাই খবর দিতে এয়েছি।

-হুঁ। মিত্তি-গোপালপুর? খুব ধুম! লয়?

–হ্যাঁ। যাবি তো?

—তা যাব। কিন্তুক–

—কি?

—তোর সঙ্গে আমার—বুলি কিনা, আমার একটা কাজ আছে।

—কি কাজ?

—আছে। আছে। বুলি কিনা, খুব দরকারি কাজ। তা—।

-বল কেনে।

–উঁ-হুঁ। বলব, সে একদিন বলব। বুয়েছিস? বেশ করে সব বুঝিয়ে বলব। তা, আজ লয়। বিয়েটা সেরে আসি, বুল্লি? কি বল্‌?

—বেশ, তাই বলিস।

বনওয়ারী ফিরল। এই সব পেঁচি মাতালের সঙ্গে তার বনে না। মদ খাবে—মদ কাহারদের। পোষ্টাই, তা খাও, কিন্তু টললে চলবে কেনে? পেঁচি মাতাল! কিন্তু এদিকে আবার সামনে কে?

সে হাঁকলে—কে?

–আমি।

–কে তু?

–আমি পানু–পানকেষ্ট।

–পানা? পা থেকে মাথায় রক্ত উঠতে লাগল বনওয়ারীর।—তু এখানে?

—মুনিব-বাড়ি যেয়েছিলাম। বাড়ি যেছি।

—হুঁ। বুঝেছে বনওয়ারী। পানা এখনও পাক দিচ্ছে সুতোয়। দে, তা দে। বনওয়ারী ভয়। করে না।

পানু বললে—তুমিঃ পরমের ঘর আইছিলে বুঝি?

-হ্যাঁ। বায়না আছে আইবেশের। মিত্তিবাড়িতে।

—তুমি সিরগাটটি খাও। আমার মুনিবের ছেলে স্কুলে পড়ে তো, সিরগাট খায়। আজ পকেট থেকে বার করে একেছিল কুলুঙ্গীতে, আমি এক ফাঁকে বুল্লে কিনা। হাসতে লাগল। পানা। আবার বলে— তা চুরি করাই সার হল। দুটির বেশি ছিল না বাক্সতে। আমি একটি খাব, তুমি একটি খাও।

নিমতেলে পানু ভেতরে তেতো, বাইরে মিষ্টি। বিলাতি নিমের কথা শুনেছে বনওয়ারী, ও সেই বিলাতি নিম। পানু হেসে বললেন্দুধর্মের কল বাতাসে লড়ে গেল। পিতিফল হয়ে গেল।

বনওয়ারী কোনো উত্তর দিলে না।

পানু বলেই গেল ঘর উড়ল করালীর। এত বাড় সহ্য হবে কেনে? নতুন ছাওয়ানো ঘর। বাবাঠাকুরের কোধ। একটু চুপ করে থেকে বললে—বাবাঠাকুর ওকে লেবেন, বুয়েচ? এ আমি নিশ্চয় বললাম। তার পমাণ আমি পেয়েছি।

অন্ধকারের মধ্যে খানিকটা দূর থেকে কে উত্তর দিয়ে উঠল—তা আবার পাবি না? তু বলে কত পুণ্যাত্মা, কত তোর সাধন ভজন, তু আবার পমাণ পাবি না? বলে, সেই পুণ্যির ছটায় আনারে আলো হয়। নখে তোর তিন কাল, চোখের দিষ্টিতে বক মরে, ঝুলিতে তো সিঁদকাঠি,

—তু আবার পমাণ পাবি না?

নসুবালা। কণ্ঠস্বর আর কথার ভঙ্গিতে চিনতে দেরি হল না নসুবালাকে। পানু চুপ করে। গেল। বনওয়ারী বললেন?

—হ্যাঁ? নসুবালাই বটি আমি।

—কোথা যাবি?

—মিত্তিবাড়ি চললাম। ওদের লোক পেয়েছি, চলে যেছি।

মিত্র-বাড়ির যে লোক বায়না দিতে এসেছে, তারই সঙ্গে নসুবালা চলেছে মিত্র-বাড়ি। এ অঞ্চলে বিয়েবাড়িতে নসুবালার বাধা নিমন্ত্রণ। ও নিজেই নেয় নিমন্ত্রণ। গিয়ে হাজির হয়। পরনে। মেয়ের সাজ, নাকে নথ, মাথায় খোপা, গায়ে গয়না, কাধে ঝুড়ি। গিয়ে ঝুড়িটি রেখে প্ৰণাম করে বলে—এয়োদের মঙ্গল হোক। এলাম মাঠাকরুণ, দিদি ঠাকরুণরা। এঁটোকাটা ফেলব, পাট-কাম করব, গান শোনাব। নাচব। যাবার সময় একখানি শাড়ি পোব, খাবার লোব, গুণগান করে নাচতে নাচতে বাড়ি যাব।

নসু তাই চলেছে। বনওয়ারী হাসলে। পানা পালাচ্ছে হনহন করে। নসুবালার তা চোখ এড়াল না। সে তার সিগারেটের আগুনটাকে চলতে দেখে বুঝতে পারছে। সে বললে—আজ ঘর উড়েছে, কাল হবে। বলেছে, এবার লোহার তার দিয়ে বাঁধেঙ্গা। বুঝলি রে সিড়িঙ্গি।

পরের দিনই করালী ঘর মেরামতের আয়োজনে লেগে গেল। ভোরে উঠেই চলে গেল চন্ননপুর, সেখান থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে ট্রেনে কাটোয়া গিয়ে ফিরল বিকেলে। ফিরল একেবারে ছুতোরমিস্ত্ৰি সঙ্গে নিয়ে। শুধু আফসোস হল, বনওয়ারী বাড়িতে নাই। থাকলে দেখিয়ে দিত চন্ননপুরের কারখানায় কাজ করার মুরদটা। ওরাও আজ সব খেয়েদেয়ে রওনা হয়ে। গিয়েছে মিত্তি-গোপালপুর বিয়ের পালকি বইতে। সুচাঁদ বললে—উ কি আমার যে-সে নোক! মোটা চাকরি করে। সায়েব হল মুনিব। সেকালে কুঠির সায়েবেরা মুনিব ছিল, তখনকার কাহারদের মত ভাগ্যি আমার করালীর।

করালী এ কথাতে চটে গেল।-বেশি বকিস না। সায়েবদের পালকি বহন করি না আমি।

সুচাঁদ বুঝতে পারে না, করালীর এতে রাগ করার কি আছে! এ নিয়ে ঝগড়াও একটা বাঁধতে পারত, কিন্তু করালীই ক্ষান্ত হল। নিজের যুক্তির মধ্যেই জোর পায় না করালী। পালকি না বইলেও এই সেদিন ছোট একটা খালের ঘাটে তাকে দশজন সাহেবকে কাঁধে তুলে পার করতে হয়েছে। যুদ্ধের জন্য সায়েব এসেছে অনেক।

উদ্যোগ আয়োজন সব ঠিক হয়ে গেল। পরের দিন কিনে-কেটে নিয়েও এল সব। কিন্তু করালীর সবই আশ্চর্য! নতুন বাঁশ কেটে দড়ি কিনে খড় কিনে পুনরায় চাল তৈরি করবার ঠিকঠাক করে সে হঠাৎ ঘোষণা করে দিল—উঁহু, থাঁক্।

—থাকবে কি? এবং কেন? পাখী বললে—মর মর্মর ঢঙ দেখে বাঁচি না!

–ঢঙ লয়, ঘরের চাল উড়েছে—ভালই হয়েছে, এবারে ‘নেপাট’ করে ভেঙে নতুন কোঠাঘর করব।

—কোঠা?

–হ্যাঁ, ওপরে যোব। নামোতে আন্না হবে, হাঁড়িকুঁড়ি থাকবে।

পাখী আনন্দে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল করালীর মুখের দিকে। লোকজন বিদায় হতেই সে ছুটে এসে দুই হাতে করালীর গলা জড়িয়ে ধরে পা গুটিয়ে ঝুলতে লাগল। মহানন্দে।

করালী অনেক ভাবলে, গবেষণা করলে, বললেঘর করব পুদুয়ারী, পচি বাগে থাকবে সিঁড়ি। দক্ষিণ দিকে আর পুব দিকে দুটো ‘বারজালা’ হবে। ইস্টিশান থেকে নেয়ার তার আনব, ইস্টিশানের টিনের ঘরে কোণে কোণে যেমন তার দিয়ে বেঁধে মাটিতে খুঁটো পুঁতে বাঁধন দিয়ে টান দেয়, তেমনি টান দোব। দেখি, বেটার ঝড় এবার কি করে ঘর ওড়ায়?

পাখীর নাচবার কথাই। পাখী সত্যই নাচল। নসুবালা নাই, সে গিয়েছে বিয়েবাড়ি নাচতে, এঁটো পরিষ্কার করতে। সে থাকলে ছড়া কেটে কোমর ঘুরিয়ে নাচত। বসন ভালমানুষ লোক, উচ্ছসিত হওয়া তার স্বভাব নয়, সে শুধু হাসলে। সুচাঁদ প্রথমটা হাসলে, ছড়া কাটলে, তারপর কদলে পাখীর বাপের নাম করে—তুই কোথা গেলি বাবা, দেখে যা রে পাখীর কোঠা হবে রে!

লোকে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল।

হাঁসুলী বাঁকের ঘর ঝড়ে উড়লে, বা আগুনে পুড়লে লোক ঘরের দেওয়াল অবশ্য আধ হাত এক হাত উচু করে চাল তোলে, কেউ কেউ উপরের নতুন দেওয়ালে হাঁড়ির মুখ বসিয়ে একটু আধটু বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা করে নেয়। বানে ঘর পড়ে গেলে নতুন করে পছন্দমত ঘর তৈরি করে ছোটখাটো জানালাও রাখে, ঘরদোর হয়ে গেলে বলে—মা-কোপাইয়ের দয়াতে এ এক রকম ভালই হয়েছে।

যাদের ভাঙে নাই, তারা আফসোস করে বলে আমার ঘরখানা পড়লে বাতাম! শুধু একপাট দ্যাল পড়েই ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে অইল যি!

সেই সায়েবডোবা চৌধুরী-বাড়িতে মা-লক্ষ্মী এসেছিলেন বানে, সেই বানে গোটা কাহারপাড়া ভেঙেছিল। সেবার নতুন করে হয়েছিল কাহারপাড়া। তার আগে নাকি কাহারপাড়ার ঘরগুলিতে কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না। সেবার নতুন করে কাহারপাড়া তৈরি হল, ঘরগুলি বর্তমানের আয়তন পেয়েছিল। এখন মাঝখানে মানুষ বেশ স্বচ্ছন্দে দাঁড়াতে পারে; কিন্তু চার কোণে এখনও মাথা ঠুকে যায়। এখন কাহারপাড়ার যে বড় ঘরগুলি দেখা যায়, সেগুলি সবই বানে ভেঙে যাওয়ায়, ওই মা-কোপাইয়ের দয়ায় হয়েছে। সেগুলির কোণে আর মাথা ঠুকে যায় না, দেওয়ালের উপর দিকে ছোট জানালাও আছে। কিন্তু করালীর এ যে বিষম কাণ্ড! ঝড়ে ঘরের চাল উড়ল, দেওয়াল খাড়া আছে, সেই দেওয়াল খরচ করে ভেঙে নতুন ঘর! তাও আবার কোঠাঘর! যা কখনও কাহারপাড়ায় হয় নাই?

বসন করালীকে ডেকে চুপিচুপি প্রশ্ন করলে বাবা, কোঠাঘরে খরচা অ্যানেক। তা—

করালী তাকে অভয় দিলে—তার লেগে তুমি ভেবো না।

বসন পাখীকে জিজ্ঞাসা করলে–হাঁ লো, টাকা কসগুলি আছে বল্ দি-নি!

-লবডঙ্কা।

–তবে?

—ধার করবে। ইস্টিশানে একজন টাকা ধার দেয়।

—ও মা গো! বসন শিউরে উঠল।–ধার করবে কি লো?

–হ্যাঁ। হপ্তা হপ্তা সুদ মিটিয়ে দেবে। আর কিছু কিছু আসল দিয়ে শোধ করবে।

অবাক হয়ে গেল বসন। আবার সে গেল করালীর কাছে। করালী তাকে জলের মত বুঝিয়ে দিলে। চন্ননপুর ইস্টিশানে একজন মাড়োয়ারী আছে, সে গোটা ঘোট লাইন বরাবর লাইনের বাবু থেকে আরম্ভ করে কুলিদের পর্যন্ত টাকা ধার দেয়। টাকায় নেয় একআনা হিসাবে সুদ, সপ্তাহে সপ্তাহে এক পয়সা হিসেবে টাকায় সুদ সে আদায় নেয়। মাসের শেষে কিছু করে আসলে উসুল চায়। দিতে পার ভাল, না পার তম্বি নাই। আর তিন মাসের মাসে আসলে উসুল কিছু চাই-ই। করালী তার কাছেই এক শো টাকা নেবে। সপ্তাহে তার রোজ এখন আট টাকা চার আনা ইস্টিশানে দুটো-চারটে মাল বয়, তাতেও টাকা দুয়েক হয়। এই দশ টাকা চার আনা থেকে সপ্তাহে সুদ তাকে দিতে হবে এক টাকা ‘ল’ আনা। থাকবে আট টাকা এগার আনা। মহাজন মাড়োয়ারী বলেছে, ও থেকে যদি করালী সপ্তাহে আড়াই টাকা হিসেবে আসলে উসুল দিয়ে যায় তো মোটা হিসেবে দশ মাসে এক শো টাকা শোধ হয় সূক্ষ্ম হিসেব সে পরে করে দেবে। এবং সে হিসেব সে মাস্টারবাবুকে দিয়ে যাচাই করে নেবে। বিশ্বাস না হলে শাশুড়ি মাথলাকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারে, সেও চাল তৈরি করবার জন্য তার কাছে তিরিশ টাকা ধার নিচ্ছে। নটবরকেও জিজ্ঞাসা করতে পারে। মাথলা নটবর এরা যখন চাষ ছেড়ে লাইনের কাজে ঢুকেছে।

বসন আরও অবাক হয়ে গেল। এমন ধারার লেনদেনের কথা সে কখনও শোনে নাই। হাঁসুলীর বাঁকের উপকথায় এ হিসেব—এ কারবার নতুন। জাঙলের মণ্ডল মহাশয়দের সঙ্গে কারবার তাদের অন্যরকম। ধান নেয়। এক মন নিলে দেড় মন দিতে হয়, শোধ না গেলে সুদে আসলে এক হয়ে আবার সুদ টানে। টাকা নেয়, ধার নয়—দাদন। সারের উপর দাদন, দুধের। উপর দাদন। নগদ সার বেচাকেনা হয় টাকায় তিন গাড়ি, চার গাড়ি, চার গাড়ি দরের সারের দাদনের দর-সাড়ে পাঁচ গাড়ি। টাকায় যোল সের দুধ, দাদন নিলে দুধের দর দিতে হয় টাকায়। বাইশ সের। পাঁচ টাকার উপর দাদন হলে দর দিতে হয় চব্বিশ সের। দশ টাকার বেশি দাদনই। নাই। ঘটি, বাটি, রুপোর গয়নাও দু-এক পদ বাধা দিতে হয় কঠিন বিপদে। তার হিসেব অত্যন্ত জটিল, সে ওরা বুঝতে পারে না, বুঝতেও চায় না, কারণ সে আর কখনও ফেরে না। সুতরাং এমন লেনদেনের কারবার বসনের কাছে পরমাশ্চর্যের কথা।

পৃথিবীতে যা আশ্চর্য, তাই হাঁসুলী বাঁকে ভয়ের কস্তু। আশ্চর্যকে ঘেঁটে দেখে তার স্বরূপ নির্ণয় করার মত বুদ্ধির তাগিদ ওদের নাই। যদিবা আদিকালে কখনও ছিল, বারবার ঘা খেয়ে খেয়ে তা মরে গেছে। সাহেব সদ্‌গোপ বাবুদের শাসন ঠেলে কখনও তা কঠিন এবং ধারালো হয়ে আশ্চর্যকে ভেদ করে ছেদ করে দেখবার মত নিৰ্ভয় বিক্রম লাভ করতে পারে নাই। বসন তাই শঙ্কিত হয়ে উঠল এ প্রস্তাবে। সারাদিন চিন্তা করে সে কোনো উপায় দেখতে পেলে না। করালীকে নিরস্ত করবার। অবশেষে মনে পড়ল বনওয়ারীকে। সন্ধ্যায় করালীকে ডেকে সে বললে আমি বলি কি বাবা, আজ কাল দুটো দিন সবুর কর।

করালী আজই কাজ শুরু করতে বদ্ধপরিকর। পুরনো ঘরখানাকে সে তার বন্ধু দুজনকে নিয়ে ভেঙে ফেলতে চায়। সে বললে—সবুর কেনে? কিসের সবুর?

—এই বনওযারীদাদা, অতনদাদা, পেল্লাদদাদা—এরা ফিরে আসুক। এদের সব শুদিয়ে। আবিয়ে যা বলবে সবাই, তাই করবে।

করালী হেসেই খুন-আমি ঘর করব তা শুধাব কাকে?

—শুধাতে হয়। মাতব্বরকে তো শুধাতে হবে। একটা রনুমতি নিতে হয়। বিয়েশাদির মতন এটাও তো শুভ কাজ।

—উঁই, রনুমতি আমার লেখা আছে। হঠাৎ হেসে সে বললে—রনুমতি? কার রনুমতি, কিসের রনুমতি? আমি করব ঘর, আর অনুমতি দেবে মাতব্বর। উঁহু। লে, লে, চাল গাঁইতি।

সে নিজেই দেওয়ালে উঠে কোপাতে লাগল।

আশ্চর্যের কথা, ঠিক সময় ছুটতে ছুটতে সুচাঁদ এল, হাঁপাচ্ছিল সে। হাঁপাতে পাতে বললে–না না না। কোঠাবাড়ি করতে পাবি নাপাবি নাপাবি না।

—যা ম’ল। তু আবার সঙু করতে এলি কেনে?

ওরে কেউ কখনও করে নাই। কাহারপাড়ায় কোঠাঘর করলে তু মরে যাবি। সইবে না। সুচাঁদ গিয়েছিল গুগলি তুলতে, সেই পুকুরের জলে গুগলি খুঁজতে খুঁজতে মনে পড়েছে কথাটা, যা পিতিপুরুষে করে না, তা করতে নাই। সয় না। সহ্য হয় না, মানুষ মরে যায়।

সুচাঁদ কাদতে লাগল। কথাটা বসন্তের মনে হল। সেও শিউরে উঠল।

সুচাঁদের কথার কোনো জবাবই দিলে না করালী। সে ভাঙতে লাগল ঘর। আঃ, বনওয়ারী কবে ফিরবে:


মাথলা নটবর এরাও মুখ ফুটে বলে ফেললো ভাই, মাতব্বরকে একবার শুধাবি না? সে এসে যদি আগ-টাগ করে?

করালী মাথা ঝুঁকি দিয়ে চুলগুলোকে পিছনে ফেলে দিয়ে বললে—আগ করে ঘরের ভাত বেশি করে খাবে। মাতব্বর কে রে? আমার মাতব্বর আমি। তারপর হঠাৎ বললে—চল্‌।

—কোথা?

–চল্‌। আজ আবার শিমুলগাছে উঠব। সেদিন গাছে উঠেছিলাম বলে নাকি ঝড়ে আমার ঘর উড়েছে। আজ আবার গাছে উঠব। আজ কি হবে হোক! সঙ্গে সঙ্গেই সে চলল। মাথলারা সভয়ে অনুসরণ করলে। না করে উপায় নাই। করালী এখন ওদের সর্দার যে। চন্ননপুরে ওর তবেই বেচারাদের খাটতে হয়।

করালী বললে-ভাল করলে মন্দ হয় কিনা! চন্ননপুরে তারে খবর এল—পেচণ্ড ঝড় আসছে। তুদিকে পেলাম না, ছুটে গাঁয়ে এলাম—গেরাম সাবধান করতে। এসে দেখি, গাঁয়ের মরদরা সব জাঙল গিয়েছে ঘোষেদের ঘর ছাওয়াতে। কি করি! আকাশ দেখি কালচে হয়ে গিয়েছে। বুঝলাম, চারিদিকে ঝোপের আড়ালে চালে বসে ঠাওর পায় নাই। উঠে পড়লাম শিরীষগছে। উঠে দেখি, পচি দিকে অঃ, সে কি ঘটা, কি বলব মাইরি। তা শিরীষ গাছটা তো খুব উঁচু লয়, দেখে সুখ হল না। তখন উঠে পড়লাম ওই গাছটাতে। বলিহারি! বলিহারি! সে আচ্ছা বাহার হয়েছিল!

নটবর বললে হয়েছিল, দেখেছিলি, বেশ করেছিলি। আজ আর থাক্। কাজ কি দেবতার গাছে উঠে?

শিমুলগাছটার কাণ্ডটা বিশাল, ওটাকে আঁকড়ে ধরে ওঠা অসম্ভব। করালী কাটার গায়ের কোটর ধরে উঠতে শুরু করে দিলে। উপরে প্রথম ডালটায় উঠে নটবরের দিকে থুতু ফেলে বললে—ভাগ শালা! তারপর বললেবা, এখান থেকে দয়ে ঝাপ দিতে ভারি সুবিধে মাইরি!

—এই, এই দয়ে কুমির আছে। বাবাঠাকুর আছে।

–তা বটে কুমির থাকতে পারে।

দয়ে আঁপ খাওয়া মুলতুবি রেখে উপরের দিকে উঠতে লাগল সে। উঠে সে আজ আবার হক মারলে—হো-

অর্থাৎ দেখ, তোমরা দেখ, আবার আমি উঠেছি শিমুলগাছে—

গোটা কাহারপাড়া সে হাক শুনে গাছের দিকে সভয়-বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress