মানুষ নাকি সুখে দুঃখে বাঁচে
মানুষ নাকি সুখে দুঃখে বাঁচে। সুখ আর দুঃখ নিয়ে মানুষের বাঁচার কারবার।
কথাটা সত্যি।
এই বন্য এলাকার বেশিরভাগ মানুষ নইলে কি এত বেশি দুঃখের সঙ্গে ছিটেফেঁটা সুখের ভেজাল দিয়ে বংশানুক্রমে বাঁচত!
মুশকিল এই যে, মানুষ কেন বাঁচে কেন মরে এই প্রশ্ন থেকে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড কেন চলে কিভাবে চলে এই সব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামিয়ে ঘামিয়ে যাদের জ্ঞানী গুণী বিদ্বান হতে হয়, মানুষের সুখ দুঃখের সাধারণ হিসাব নিকাশ তাদের কাছে বড়ই জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ এলাকার বেশিরভাগ মানুষ যারা একটুখানি সুখ আর অনেকখানি দুঃখ সম্বল করে বাঁচে, সুখ দুঃখের সহজ সরল স্পষ্ট মানে জেনেও তারা তাই ওপরতলার ওদের কর্তালিতে জীবনরহস্য ভেদ করার অক্ষমতায় বিনম্র বিভ্রান্ত হয়ে বিশ্বাস করে যে, সুখ দুঃখের মানে বোঝার চেষ্টা করাটাও আগেকার চোদ্দ পুরুষের মতো তাদের পক্ষেও মহাপাপ।
লখার মা গেঁয়ো ভাষায় এই গূঢ় তত্ত্বকথা গাঁয়ের মেয়েদের বোঝাবার চেষ্টা করে।
মেয়েরা তত্ত্বকথাটা বুঝুক না বুঝুক, তার কথার তাৎপর্য বোঝে।
বোঝে কিন্তু সুখ দুঃখের মানে বুঝেও না বোঝার মতো আসল মানেটা গুলিয়ে ফেলে।
লখার মা মাঝবয়সী। যৌবনে নিশ্চয় ভাটা শুরু হবে দু-চার বছরের মধ্যেই। গায়ের রং চোখ-জুড়ানো স্নিগ্ধ-রকম কালো।
ফর্সা একখানা থান ধুতি পরে সে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, পুরাণ রূপকথার নজির তুলে তুলে গেঁয়ো ভাষায় মেয়েদের বড় বড় দার্শনিক প্রশ্নের রসালো ব্যাখ্যা শোনায়।
সেদিন দুপুরে গৌরীর ঘরে গিয়ে হাজির।
মাজার টনটনানি কাবু করে ফেলেছিল গৌরীকে। তবু সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওঠে। বেতের মোটা চাচিতে বোনা সস্তা পাটি পেতে তাকে বসতে দেয়।
একটিমাত্র পান ছিল ঘরে, পানটি সেজে সমের সঙ্গে লখার মার হাতে তুলে দেয়।
একফেরতা ফর্সা থান ধুতি পরা লখার মা পিঠে একরাশি চুল ছড়িয়ে আঁকিয়ে বসেছে।
পান নিয়ে চিবোতে চিবোতে জিজ্ঞাসা করে, দেহটা বুঝি ভালো যায় না?
না। হাসপাতাল থেকে খালাস পেয়ে এলাম খবর রাখ না বুঝি মাসি?
খবর রাখি বলেই তো দেখতে এলাম রে। মেয়েরা আসতে শুরু করে।
সকলের আগে আগে নকুলের বৌ পঁচী, প্রায় পিছনে পিছনে তার শাশুড়ি আর মণ্টার মা। মণ্টার বৌ, বোন, মাসি একসাথে এসে গোবর-লেপা মেঝেতেই ঘপ্ ঘপ্ করে বসে পড়ে এইটুকু আসতেই যেন বড় শ্রান্ত হয়ে পড়েছে।
তারপর পাঁচটি ছেলেমেয়ের মা সুখের বৌ লক্ষ্মীকে গটগট করে ঘরে ঢুকে প্রায় লখার মার গা ঘেঁষে পাটিতে বসে পড়তে দেখে গোড়ায় মাথাটা ঘুরে যায় গৌরীর, তারপর রাগে গা জ্বালা করে।
এটা যেন ওর ঘরদুয়ার। যার স্বামী পিছন থেকে এই সেদিন ঘরের চালা জ্বালিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছিল সে কিনা এমন তেজের সঙ্গে নতুন ছাওয়া সেই পোড়া ঘরটাতে ঢুকে এমনভাবে জাকিয়ে বসতে পারে? কে জানে এরা কি দরের মানুষ!
লক্ষ্মী একটু নম্ৰভাবে লজ্জিতভাবে এলে, তার সঙ্গে দু-একটা কথা বলে দশজনের মধ্যে বসলে সুখের অপরাধের জন্য তাকে কিছুমাত্র দায়ী করার কথা গৌরী ভাবতেও পারত না–রাগে গা জ্বালা করা তো দূরের কথা।
প্রায় বছর বছর বিইয়ে বেচারা পাঁচটি বাচ্চার মা হয়েছে–কোলেরটির বয়স বছর খানেক, আবার পোয়াতি হয়েছে সন্দেহ হয়।
স্বামীর কোনো অপকর্মের সঙ্গে কি ওকে জড়ানো যায়!
আরো কয়েক জন হাজির হয় আধঘণ্টার মধ্যে।
দেহের ভারে যেন বড়ই কাতর এমনিভাবে হাতে ভর দিয়ে উঠে লখার মা বাইরে ঘুরে আসতে যায়।
ঘর প্রায় ভরে গিয়েছে। নিজের চালা ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে গৌরীর হঠাৎ খেয়াল হয় যে, তার মতো কমবয়সী মেয়ে বৌ এতগুলি মেয়েলোকের মধ্যে নেই বললেই হয়।
দু-একজন যারা এসেছে, তারা এসেছে শাশুড়ি ননদের আঁচল ধরে, এসে বসেছে শাশুড়ি ননদের পিঠের আড়ালে।
বাইরে ঘুরে এসে লখার মা জঁকিয়ে বসে।
চোখ বুজে আঙুল সঞ্চালন করতে করতে বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য কতগুলি শব্দ উচ্চারণ করে।
দু-তিন মিনিটের বেশি নয়।
তারই মধ্যে কয়েকজন সামনে ঝুঁকে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে তাকে প্রণাম করে।
চোখ মেলে এক গাল হেসে লখার মা বলে, কেমন আছ গো নদেরষ্টাদের মা? জ্বরে ভুগছ নাকি? ঘরে ঘরে এই খালি জর আর জ্বর, জ্বরে কাত না হয়ে দুটো-একটা মাস কে যে ঘর-সংসার করছে, কি কাণ্ড বল দিকি? শাউড়ি যদি খাড়া রইল, বৌ ঠিক জ্বরে কাত হবে। এটা কিসের জ্বর, ঘরে ঘরে কেন এত জ্বর, সে কাহিনী জান নাকি গো তোমরা?
ঈশ্বরের কাছে অনেকবার অনেকভাবে শুনে শুনে জ্ঞান জন্মে গিয়েছিল বলেই বোধহয় অন্য সব হিসাব ভুলে গৌরী বলে বসে, এটা তো ম্যালেরি জ্বর মশার কামড় থেকে হয়। ঠেসে কুইনাইন খেলেই নাকি জ্বর সেরে যায়।
তোর জ্বর তবে সারে না কেন?
মোর তো ম্যালেরি জ্বর নয়।
তবে কেন মিছে বকছিল? রাবণ-সীতার জ্বরের কথাটা মোকে বলতে দিবি? না চলে যাব?
গৌরী ভড়কে গিয়ে বলে, চলে যাবে কেন গো মাসি? চলে যেতে বলেছি? তুমি এয়েছ এ তো মোর পরম ভাগ্যের কথা!
লখার মা হেসে বলে, তবে বাজে কথা না বকে, চুপচাপ বোস্ না বাছা?
রাবণ ও সীতার জ্বরের কাহিনী!
বানানো বাজে কাহিনী। অদ্ভুত উদ্ভট কাহিনী বানাতে লখার মার কল্পনার দৌড় কোনোকিছুর ধার ধারে না। একটা নিয়ম শুধু সে মেনে চলে, শ্লীলতার সীমা কখনো সে খুব বেশি ছাড়িয়ে যায় না–যাতে পাকা শাশুড়ি আর কাঁচা বৌ-র একসাথে বসে তার গল্প শোনা মুশকিল হতে পারে।
তবু তার আসরে অল্পবয়সী মেয়ে বৌ বেশি জোটে না কেন লখার মা ভেবে পায় না। তার কল্পনার উদ্ভট দৌড়টাই যে বয়স্কা মা মাসি শাশুড়ি পিসিদের কাছে সরল সহজ সাধারণ অশ্লীলতার চেয়ে অনেক বেশি ভীতিকর, সরস সুন্দর জমকালো সহজ ভাষার সঙ্গে ভাবভঙ্গি মিশিয়ে বলার ধরন ও তার কাহিনী শুনে সমবয়সী মেয়ে বৌয়ের মাথা ঘুরে যাবার আশঙ্কা যে প্ৰায় সকলেই মনে মনে পোষণ করে—এটা আজো লখার মা টের পায় নি।
আজেবাজে কথা তুলে গেীরী গল্প বলায় বাধা সৃষ্টি করেছিল বলে কেউ রাগ করে না। অনেক কাল গল্প শুনছে, সবাই জানে যে, গোড়ায় এরকম একটু বাধা পেলেই লখার মার গলা খোলে, গল্প জমে।
আজকের গল্পের সার কথা হয় এই। রাবণ জগতের সেরা কামুক। ছিচকে লম্পট নয়, কামের মহা শক্তিশালী সাধক। এদিকে সীতাও জগতের সেরা সুন্দরী, সেরা যুবতী, মন্দোদরী কোথায় লাগে! অশোক বনে সীতা, রাক্ষসীরা দিবারাত্রি ঘিরে তাকে পাহারা দেয় আর নানাভাবে তার মন। ভোলাবার চেষ্টা করে। রাবণ পাগল হয়ে ছুটে ছুটে যায়, সীতাকে স্পর্শ করতে পারে না, মারাত্মক অভিশাপের খড়গ মাথায় ঝুলছে। ওদিকে রামের বিরহ সীতাকে অহরহ পোড়াচ্ছে।
এই পর্যন্ত মোটামুটি রামায়ণের মান রেখে লখার মা তার গল্পের গোড়া ফাঁদে, তারপর শুরু হয় তার কল্পনার খাপছাড়া উদ্ভট টানাপড়েন।
কামের জ্বালায় রাবণের এবং বিরহের জ্বালায় সীতার জ্বর হয়। সে জ্বর জগতে আগে ছিল না। ঘন ঘন পালা করে জ্বর আসে। সবচেয়ে আশ্চর্য কথা, দুজনেরই জ্বরের লক্ষণ হয় একরকম। হাড়ের মধ্যে শীত করে সর্বাঙ্গ কাপিয়ে জ্বর আসে, জ্বরের গরম তখন যেন ভেতর থেকে অসংখ্য সুচের মতো মাথা আর গা ছুঁড়ে ছুঁড়ে বেরোতে শুরু করে, তারপর ঘাম দিয়ে জ্বর কমে যায়।
সেই থেকে জগতে ম্যালেরিয়ার শুরু।
ম্যালেরিয়ার পৌরাণিক জন্মকাহিনী শোনাতে বেলা পড়িয়ে আনে লখার মা। কয়েকজন আবার তাকে প্রণাম করে, দু-একটা পয়সা বা কলা মুলো লাউ কুমড়ার ফালি তার সামনে ধরে দেয়। মৃত কার্তিক দাসের বৌকে যারা প্রণাম করতে রাজি নয়, তারাও পয়সা বা এটা ওটা দেয়।
জগৎ সংসারে কেউ নেই লখার মার। কত পুরুষ ওত পেতে আছে তাকে খাইয়ে পরিয়ে সুখে আরামে রাখার জন্যে। এইভাবে পেট চলে বলেই কি লখার মা ওদের কাউকে আমল দেয় না? অথবা ওদের আমল দেবে না বলেই সে এভাবে নিজের পেট চালায়?
ম্যালেরিয়ায় ভুগে ভুগে অল্প বয়সে লক্ষ্মণের মা যেন সাত বুড়ির এক বুড়ি হয়ে গিয়েছে। তার মাকেও তার চেয়ে কম বুড়ি মনে হয়।
মেয়ের দিকে আড়চোখে চেয়ে লক্ষণের মায়ের মা বলে, রাবণ রাজার রোগ। এত বছর ওই রোগে ভুগেও এ হারামজাদী মরছে না কেন বাছা? হাড় মাস কালি করে দিলে!
লক্ষ্মী বলে, ছিঃ, মরার কথা বলতে নেই!
সত্যিকারের বুড়ি তিরাশি বছরের রাধার মা সঙ্গে সঙ্গে বলে, না না, মরার কথা মা বললে কি দোষ হয় রে বাছা? মুয়ে শতবার শাপ দিক, মর তুই, মর তুই মনে মনে ঠিক বলছে, তোর মরণের বালাই নিয়ে মরি, তুই বেঁচে থাক শতেক বছর।
বাইরে দাওয়ায় বসে ঈশ্বর সব শুনছিল।
কয়েক বছর আগে হলে তার মনটা ঘরের ভিতরের মেয়েদের মতই গম্ভীরভাবে নাড়া খেত, প্ৰাণে রহস্যঘন ভাবের তরঙ্গ উঠত।
কিন্তু কবছর রবার্টসনের কারখানায় খেটে, হরেকরকম মানুষের সঙ্গে মিশে, তল্পিদার দেশী শিকারি হিসেবে প্রভাস রবার্টসনদের শিকার-সমারোহে কয়েকবার যোগ দিয়ে, গতবারের বাঘ মারার ব্যাপারটা থেকে অদ্ভুতরকম অভিজ্ঞতা লাভ করে, মনটা যেন কি রকম হয়ে গিয়েছে ঈশ্বরের।
আজ তার হাসি পায়।
মা অভিশাপ দিলেও সেটা হবে সন্তানের আশীর্বাদ!
জগৎ সংসারে প্রাণীদের জন্ম অবশ্য দিচ্ছে মায়েরাই। জন্মে যাতে বাঁচতে পারে তার গোড়ার ব্যবস্থাগুলিও করছে মায়েরাই।
মা ছাড়া জীব বা জীবন সম্ভব নয়।
কিন্তু আরেকটা দিকও তো আছে। ফ্ৰণ-হত্যা হচ্ছে না সংসারে? সন্তানকে মরণের মুখে তুলে দিয়েও ফুর্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে না অনেক মা? অন্ধ মায়ার বিকারে অনেকে সন্তানকে মেরে ফেলছে না?
ঈশ্বরের মাথা গুলিয়ে যায়।
আজকাল একটু ভাবতে শুরু করেছে বলেই কি এসব ভাবনা তার মগজে সহ্য হয়।
যাক গে।
ভেবে লাভ নেই।
লাইসেন্স বাতিল করে দিয়ে ঈশ্বরের সেকেলে পুরোনো দেশী বন্দুকটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সুখের হামলা শুরু হবার কয়েকদিন আগে।
বন্দুক নেই। কিন্তু বন যে ওদিকে কেবলই তাকে ডাকে।
নাগালের মধ্য দিয়ে উড়ে যায় বা গাছের ডালে বসে থাকে নানা জাতীয় সুস্বাদু পাখি বাঁশবন ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে সামনে দিয়ে ছুটে পালায় আধা বন্য খরগোশ ও অন্যান্য ছোট জাতের জীব। ঈশ্বরের হাত নিশপিশ করে। এসব শিকার করতে তার দামি টোটারও দরকার হত না, নিজের তৈরি বারুদ গেদে পেরেক আর শিক কেটে ছররা বানিয়ে কাজ সারত।
বড় পেরেক গেদে ওই বন্দুক দিয়ে তিনবার সে নদী থেকে প্রকাণ্ড তিনটে শঙ্কর মাছ তুলেছে।
একবার একটা অচেনা অজানা প্রাণীও। বড় শিকার ঘায়েল করতে বেশি বারুদ গাদতে হয়, অনেকে তাকে সাবধান করে দিয়েছিল।
বন্দুকের নাল ফেটে গিয়ে বিপদ ঘটার আশঙ্কা তার মনেও যে জাগত না তা নয়, কিন্তু ভয়কে সে আমল দিত না।
বন্দুকটা খারাপ হয়ে যেতে পারে টের পাবার পর সে ও-ভাবে বড় কিছু শিকার করবার চেষ্টা বন্ধ করেছিল।
অল্প বারুদে পেরেকের ছয়ূরা দিয়ে পাখিটাখি মারলে বন্দুকের ক্ষতির আশঙ্কা ছিল না।
বন তাকে ডাকে।
বর্ষায় পুষ্ট ঘন নিবিড় সবুজের হাতছানি নয়। বাঘের গর্জন মাঝে মাঝে স্পষ্টই শোনা যায়। কল্পনায় শোনা যায়, দেখা যায় ছুটন্ত হরিণের খুরের শব্দ আর গায়ে বাড়ন্ত আগাছার ডাল পাতা ঘষা লাগার চিকন মধুর সিরসির আওয়াজ। চিতা নেকড়েদের অদ্ভুত চলাফেরা। গাছের গুড়ি জড়ানো অজগরের মাথা তুলে দুলে দুলে গা শিউরানো হিসহিস আওয়াজ।
বনে গাদাগাদি করা আরো কত রকমের হিংস্র ও নিরীহ প্রাণীর ডাক।
ভাটার নদীর ধারে হলুদ পাঁকে মরা কাঠের মতো রোদ পোহায় কুমির।
অনেকবার চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত বন্দুকটা দিয়ে একটা কুমিরও ঈশ্বর ঘায়েল করতে পারে নি।
রাইফেলের গুলি ছাড়া কুমিরের চামড়া ভেদ করে তাকে মারাত্মক রকম আহত করা যায় না।
কিন্তু বন্দুকটা থাকলে এটাকে যে মারতে পারত না তার কি মানে আছে?
একবার একটা অজানা অচেনা প্রাণীও।
এমন কিম্ভূতকিমাকার ছিল চেহারাটা যে, কেউ বলতে পারে নি সেটা মাছ, হাঙ্গর বা শুশুক জাতীয় জীব।
গৌরী বেরিয়ে এসে করুণভাবে বলে, হাঁ গো, দু-চারটে পয়সা হবে? ঘরে এসেছে–একটু পান সুপারি তে দিতে হয়।
একটা বিড়ি নেই, এক ছিলুম তামাক নেই। ঘরে চালও হয়তো বাড়ন্ত। ট্যাকে পাঁচটা পয়সা ছিল, কোনো কথা না ভেবে চোখ-কান বুজে তামাক কিনে আনার কথা ভাবছিল।
নীরবে সে পয়সা পাঁচটা গৌরীর হাতে তুলে দেয়।
আট-ন বছরের লক্ষণ একমুহূর্ত দিদিমার সঙ্গ ছেড়ে থাকতে পারে না। আজো সে এসে দিদিমার গা ঘেঁষে বসেছিল গৌরী তাকে পয়সা দিয়ে পান সুপারি আনতে পাঠায়।
ঘরের কাছেই নর ছোট্ট দোকান। বাজারে পয়সায় পান ছটা হলে নন্দ দেয় চারটে, কিন্তু এখন ওর দোকান থেকেই না আনিয়ে উপায় কি!
নন্দর দোকান থেকেই এক পয়সার বিড়ি আর চার পয়সার তামাক আনার কথা ঈশ্বর ভাবছিল!
গা জ্বালা করে। মেয়েরা সকলে চলে যাবার পরে গৌরীকে সে বিশ্রী একটা গাল দিয়ে বলে, তোর জন্যে কাজ গেল, উপরি গেল, বন্দুকটাও গেল।
উপরি মানে শহুরে শখের শিকারি বাবুদের সঙ্গে গিয়ে যা মিলত।
চাষ আবাদ কিছু কিছু করত, সেটা গিয়েছে। কারখানায় কাজ পেয়েছিল, সেটাও গিয়েছে।
চাষ আবাদ করে বা কারখানায় খেটে কিছু রোজগারের ধার ধরতে চাওয়ার পালা সে যেন বাতিল করে দিয়েছে চিরজন্মের মতো।
তার ঝোঁক চেপেছে বন আর বুনো নদীতে শিকার করে নিজের আর গৌরীর এবং অবশ্যই মা ও কালা পিসি আর তার তিন ছেলে এক মেয়ের জীবিকা অর্জন করার।
জমি কিছু আছে থাক। ঠাকুরদার মতো শিকারটাই সে আসল পেশা করতে চায়।
বন্দুক কেড়ে নিয়ে গিয়েছে!
যে বাঘটা দিনদুপুরে সুজন ঘোষের সেজ ছেলেটাকে নদীর ওধার থেকে বনে টেনে নিয়ে গেল, সে বাঘটা মারার জন্যেও তাকে কি একটা বন্দুক দেওয়া হবেনা?
দুই ধারে উঁচু পাড়। মাঝে চওড়া উথল নদী। কাদার পকে হলুদ বরণ। হাঙ্গর কুমিরের মোটেই অভাব নেই।
এই নদী সঁতরে পার হবার জন্যে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রাখা।
বুদ্ধিমানের মতোই মাখন জোয়ার আসার পর সঁতরে নদী পেরোতে নেমেছিল।
ভাটার নদীতে নামলে তাকে হয়তো আর ওপারে গিয়ে পৌঁছতে হত না।
জোয়ার আসার সময় হাঙ্গর কুমিরেরাও খানিকটা বিব্রত বোধ করে। সমুদ্র বেশি দূরে নয়, এ নদীতে এখানে জোয়ার আসে রীতিমতো সমারোহের সঙ্গে।
সবচেয়ে বেশি সমারোহ হয় পূৰ্ণিমা-অমাবস্যার দিনে। সে এক দেখার ব্যাপার। বিশেষত পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্নার আলোতে ভাটার শান্ত নদীর বুকে ছোট ছোট ঢেউগুলি ওঠানামা করে, সেই ঢেউ-নাচা সমতল বুকে সমুদ্রের দিক থেকে প্রচণ্ড গর্জন করতে করতে ছুটে আসে উচু ফেনিল জলের বাঁধনহীন তোড়।
দূরে থাকতেই আওয়াজও শোনা যায়, চাঁদের আলোয় ঘোলাটে জলের সাদা ফেনায় ঢাকা ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপটাও চোখে পড়ে।
যত এগিয়ে আসে, গর্জন তত বাড়ে, এপার থেকে ওপার পর্যন্ত বিস্তৃত গতির রূপধর জীবন্ত সৌন্দৰ্যও স্পষ্টতর হয়।
সামনে দিয়ে যখন চলে যায় তখন ডাঙায় নিরাপদ আশ্রয়ে দাঁড়ানো মুগ্ধ অভিভূত দর্শকের বুক ভয়ে কাপে।
এর নাম কোটালের জোয়ার।
চলতি একটা ছড়া আছে–
কোটালের জোয়ার এল গাঙে,
দেখো ভাই বাঁধ যেন না ভাঙে।