ঈশ্বর ডাকে
ঈশ্বর ডাকে, অ গৌরী, গৌরী?
বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে থেকে চোখ বুজে এরকম বৈরাগ্যমধুর শান্ত উদার গলায় মাঝে মাঝে ঈশ্বর তাকে ডাকে–ম্যালেরিয়া জঁকিয়ে আসার পর। জ্বর যখন অনেক দামি নেশার চেয়েও মজাদার উদ্ভট এলোমেলো বিকারের অবস্থায় তাকে টেনে নিয়ে যায়।
মনটা বিগড়ে যায় গৌরীর। ম্যালেরিয়া তো চুপি চুপি আসে না, কমপক্ষে কাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে কথাকণি-হেঁড়া কম্বল গায়ে চাপানের হাঙ্গামা নিয়ে আসে।
ঈশ্বর তো সারাদিন বাইরে কাটিয়ে বাইরে পেট ভরিয়ে খেয়ে খানিক রাতে ঘরে এসে শুয়েছে।
ডাক শুনে ঘরে গিয়ে বলে, কি বলছ?
ঈশ্বর সাড়াশব্দ দেয় না।
কপালে তালু রেখে গৌরী টের পায়, জ্বরের নামগন্ধও নেই। গা বরং বেশ ঠাণ্ডা।
নিশ্বাসে কি বিশ্ৰী বদ গন্ধ!
গন্ধটা কিসের খেয়াল করে তড়িতাহতার মতো ছিটকে দু পা পিছিয়ে গিয়ে কপাল চাপড়ে কেঁদে উঠতে যাবে এমন সময় বাইরে গম্ভীর পুরুষালি গলার আওয়াজে ডাক আসে, ঈশ্বর, ঘরে আছ নাকি হে ঈশ্বর?
কপাট গৌরী খোলে না। কান্না চেপে গলা সাফ করে চড়া গলায় শুধোয়, কে ডাকছ? মানুষটার জ্বর এসেছে, ঘুমিয়েছে।
ঘুমিয়েছে? বাঁচা গেল বাবা। অভ্যেস নেই, একধারসে চালিয়েছে। খানা ডোবায় পড়ে মরে নি বাপের ভাগ্যি! কী গুখুরি করেছিলাম ওটাকে মাল খেতে ডেকে নিয়ে গিয়ে। খানা ডোবায় মরলে সবাই মোকে দুষত।
সুখের গলার আওয়াজ। একটু জড়ানো অস্বাভাবিক আওয়াজ। জানা চেনা আছে, ঈশ্বর ঘরে আছে, পিসি ঘরে আছে, একেবারে অথর্ব হয়ে মরণ-দশায় পৌঁছালেও জ্যান্ত শাশুড়িটা ঘরে আছে। –কপাট খুলে ঘরে ডেকে বসালে কোনো দোষ হয় না।
কপট গৌরী খোলে না।
খুপরির মতো জানালার ফাঁকে মুখ রেখে বলে, কিছুই তো বুঝতে পারলাম না। তুমি ডেকে নিয়ে গিয়ে মানুষটার এই দশা করে ছেড়েছ?
সুখে নেশার কেঁকে দিশে হারিয়ে ব্যাকুলভাবে বলে, না না, তা নয়, তা নয়। দরজাটা খোল, ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি।
যাকে নিয়ে ব্যাপার, তাকেই কাল বুঝিয়ে বোলো।–বলে গৌরী সরে যায়।
স্বস্তিবোধের তার সীমা ছিল না।
নেশায় প্রায় অচেতন ঈশ্বরের নিশ্বাসে যে পদার্থের দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে সেটা সে নিজে থেকে ইচ্ছা করে গেলে নি, ইয়ারদের পাল্লায় পড়েও গেলে নি। সুখে এর জন্য দায়ী, এটা জানা যেন দেবতার আশীর্বাদের মতো মনে হয়।
শেষ রাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে ঈশ্বর উসখুস করতে করতে একবার বাইরে থেকে ঘুরে এসে আলো জ্বালে। গৌরী জেগে গিয়েছিল, গাঢ় ঘুমের ভান করে সে মটকা মেরে পড়ে থাকে।
দেখাই যাক ঈশ্বর কি করে।
আলো জ্বালাবার মানেটা তার মাথায় ঢোকে না। আর কাঠের তক্তপোশে পিসি আর শাশুড়ি শুয়েছে। কানে যতই কম শুনুক, একটা চোখে ছানি পড়তে শুরু হোক, অন্য চোখে নজর আছে বেশ। আলো জেলে রেখে তাকে ডেকে কৈফিয়ত দিয়ে মাফ চেয়ে মিটমাট করে নেবার চেষ্টা তো সে করতে পারবে না!
গোসা হলে শুধু মিষ্টি মিষ্টি নরম কথায় যে তার মানের চিড়ে ভেজে না, গায়ে হাত দিতে গেলেই গোড়ায় খানিকক্ষণ সে ফাঁসফাঁস করে উঠলেও শেষ পর্যন্ত বেশ খানিকটা আদরও তাকে করতে হয় এটা নিশ্চয় ঈশ্বর ভুলে যায় নি? অথবা এখনো নেশা কাটে নি ঈশ্বরের? সুখে বলেছিল, কাল অনেক বেশি গিলেছে। বেশি খেলে এক রাতের ঘুমে হয়তো ঘোর কাটে না, কে জানে!
গৌরী কাত হয়ে শুয়েছিল, ঈশ্বর আলো জ্বলে কি করছে দেখার সাধটা প্ৰাণপণে চেপে চোখ বুজে রেখেছিল। কারণ তাকে চোখ মেলতে দেখে ফেললে ঈশ্বর টের পেয়ে যাবে সে জেগে গিয়েছে।
অপরাধ করার জন্য ভয়ে ভয়ে মৃদু মোলায়েম আদর খাঁটিয়ে খাঁটিয়ে তার ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা আর করবে না।
হয়তো কোনো একটা হুকুম দিয়েই বসবে।
খেয়ালি মানুষ, ওকে বিশ্বাস নেই।
ঈশ্বর হঠাৎ কাতরভাবে আওয়াজ করে ওঠে, উঃ রে বাবারে, গেলাম রে, মরলাম রে!
বুকটা ধড়াস করে ওঠে গৌরীর।
সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে।
আলো জ্বলে এতক্ষণ ঈশ্বর কি করছিল কে জানে, দুহাতে মাথা চেপে ধরে মেঝেতে উবু হয়ে বসে এখন সে সামনে পিছনে দুলছে।
হল কি? বেশ তো নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলে নেশার ঘোরে?
কি সব খাইয়ে দিলে সুখে কাল, বিষম যন্ত্রণা হচ্ছে। যত বলি আর খাব না, এসব মোর সয় না, তত বেশি জবরদস্তি খাওয়ায়। সায়েবের পেয়ারের লোক, ইচ্ছে করলে কাজ খতম করে দিতে পারে।
গৌরী বলে, জানি জানি, সব মোর জানা আছে। ডেকে নিয়ে জোর করে গিলিয়েছে, সে খবরটা রাখি। কি রকম যন্ত্রণা হচ্ছে গো? তোমার যদুদা বংশী খুড়োদের ডেকে আনব, পিসিকে সাথে নিয়ে?
ওরা এসে কি করবে? সুখে কি খাইয়েছে, ওরা কি খবর জানে? ইস, যদি একবার খেয়াল হত বজ্জাতটা এমনিভাবে খাতির করে আমায় ঘায়েল করতে চায় কথা শেষ করতে পারে না, পরপর কয়েকটা হিব্ধা তুলে ঈশ্বর চুপ করে যায়।
মনে একটু খটকা লাগে গৌরীর। বিষম যন্ত্রণায় যার প্রাণ যাচ্ছে, বাবা রে মা রে বলে কাতরাচ্ছে–সে কি লাগসই কৈফিয়তের অত কথা বলতে চায়, না বলতে পারে?
ঈশ্বর কি জানে না যে, হাজার চড়া গোঁসা হলেও এরকম অবস্থায় আগে সে তাকে সুস্থ করার জন্য প্রাণপাত করবে, মানভঞ্জনের পালা নিজেই সে শিকেয় তুলে রাখবে?
তবে এটাও ভাববার কথা, আজ পর্যন্ত ঈশ্বর কোনোদিন তার সঙ্গে এরকম প্যাচ কষে নি। ওটা তার ধাতে আছে কিনা সন্দেহ।
গৌরী তাই সব হিসাব নিকাশ ভুলে যায়। উঠে গিয়ে ব্যাকুলভাবে বলে, মাথায় জল দেব?
তাই বরং দে।
মেটে কলসী থেকে ঠাণ্ডা জল অন্য পাত্রে গড়িয়ে আনে না গৌরী, কলসীটাই নিয়ে আসে।
এখন কি আর পুরোনো একটা মাটির কলসীর জন্য মায়া করার সময়! অবশ্য কলসীটা ভেঙেচুরে গেলে আরেকটা মাটির কলসী আনতে বিলম্ব হবে, কয়েকদিন ঘরে তার জলের কষ্টের সীমা থাকবে না।
কলসীর মুখ-ঢাকা মাটির সরায় জল ঢেলে ঢেলে গৌরী স্বামীর মাথা ধুইয়ে দিতে থাকে। সযত্নে সাবধানে জল ঢালে, গা যেন না ভিজে যায়।
হঠাৎ হড়হড় করে একগাদা বমি করে ফেলে ঈশ্বর।
গৌরীর হাত থেকে মাটির সরাটা কেড়ে নিয়ে কলসীর তলানি জলটুকু গড়িয়ে নিয়ে এক নিশ্বাসে খালি করে বলে, বাবাঃ, বাঁচলাম।
যশোদা কখন প্ৰাচীন আম কাঠের তক্তপোশ থেকে উঠে এসে পিছনে দাঁড়িয়েছিল তারা টের পায় নি।
বুড়ি শাশুড়ির এইসব চালচলন গৌরীর কাছে উদ্ভট লাগে। মানুষটাকে খাইয়ে দিতে হয়, প্রায় কোলে করে বাইরে নিতে হয়। এপাশ ওপাশ ফিরিয়ে দেবার জন্যও মাঝে মাঝে তাকে দরকার হয়—কটি শিশুর মতত ক্ষীণস্বরে এমন ভাবে কাঁদে!
অথচ মাঝে মাঝে নিজেই আম কাঠের বিছানা ছেড়ে বিনা সাহায্যে উঠে আসতে পারে।
তাদের একটি কথা বা আওয়াজও যশোদা শুনতে পায় নি। বমি করে জল খেয়ে মেঝেতে বিছানো চাটাই চট আর কথার বিছানার কোণে বসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ঈশ্বর পেট্রোল লাইটার দিয়ে বিড়ি ধরিয়ে টানতে শুরু করলে যশোদা চড়া খ্যানথেনে গলায় বলে, মদ খেয়েছিলি, না রে বাবা? ফুলুড়ি, বেগুনি, পেঁয়াজী খেয়েছিলি পেট পুরে?
নিজের কান দুটিতে শব্দের খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে যশোদা এমন চেঁচিয়ে কথা বলে যে, পাড়ায় কেন, অনেক দূরের থানায়ও বুঝি শোনা যায়।
ধমক দিয়ে লাভ নেই। শুনতেই পাবে না।
মুখটা গম্ভীর বিকৃত করে, ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়ে ইশারা করে ঈশ্বর মাকে হুকুম দেবার চেষ্টা করে–চুপ কর।
যশোদা গ্রাহ্য করে না।
মাথা ভরা শণের মতো পাকা চুল। তাতে বুঝি উকুনেরা দলে দলে বাসা বেঁধেছে। মাথা। চুলকোতে চুলকোতে যশোদা তেমনি চড়া খ্যানখেনে গলায় বলে, মোকে কেন ডাকলিনে বাবা? এত কষ্ট সইতে হত না। ঘি নয়তো তেল দিয়ে চিনি একটু খাইয়ে দিতাম, নুন গলে না এমন এক পিত্তর জল দিতাম। বাস্, ফুরিয়ে যেত। বমিও করতি, কষ্ট কমে গিয়ে রাতভোর ঘুমোতি নাক ডাকিয়ে।
ঈশ্বর উঠে গিয়ে দুহাত মুঠো করে মাথার উপর তুলে ধরে সর্বাঙ্গ শক্ত করে বিশেষ একটা বীভৎস ভঙ্গি করে যোদর সামনে মুখোমুখি দাঁড়ায়।
সে যেন ক্ষেপে গিয়েছে। সে যেন জামদগ্নির চেয়েও বিশ্রী ভয়ঙ্করভাবে উদ্যত হয়েছে নিজের মাকে খুন করে ফেলার জন্য।
এটা শুধু সঙ্কেত, ইঙ্গিতের ভাষা।
সাধারণ বোমার কেন, এটম বোমার আওয়াজ শোনার শক্তিও যশোদার ফুরিয়ে গিয়েছে।
নিজে রেগে বোমার মতো ফেটে গিয়েও কোনো হুকুম যে মাকে শোনাতে বা বোঝতে পারবে না, ঈশ্বরের তা অনেক বছর থেকে জানা আছে।
এই রকম ইশারায় সে মাকে তার আদেশ নির্দেশ জানায়।
দু-এক দিনের ব্যাপার নয়, কয়েক বছর ঈশ্বর এমনিভাবে পঙ্গু মাকে সামলে চলছে।
গৌরী পারে না।
রাবণের বুক চিরে শিরা-উপশিরা থেকে রক্ত শুষে পান করা বিশেষ এক বীরের মতো যাত্রা দলের সঙের মতো রূপ নিয়ে সামনে রুখে দাঁড়ালেও যশোদা কিছুমাত্র বিচলিত হয় না।
ছেলের শাসনের এই নির্বাক ভঙ্গি তারও অনেক দিনের জানা।
বলে, যাচ্ছি, যাচ্ছি–শুয়ে পড়ছি গিয়ে। একটু দই কিন্তু খাস যোগাড় করে, সব বিচ্ছিরিভাব কেটে যাবে।
ঈশ্বরকে ঘুষ দিয়ে বাগাবার জন্য রবার্টসন সুখেকে কাজে লাগিয়েছিল।
টাকা কিছু বেশি লাগে কিন্তু সহজ সরল উপায়–তাকে কেউ কোনোভাবে দায়ী করতে পারবে না।
ঈশ্বরকে কত টাকা দেবে আর নিজে কত টাকা মারবে–সেটা সুখের হিসাব নিকাশ বিচার বিবেচনা।
তার কাজটা হাসিল করা চাই, এটা সুখে খেয়াল রাখবে।
তার আসল কাজটা হাসিল করার জন্যই যে তার হাতে বিনা রসিদে এতগুলি কড়কড়ে নগদ টাকার নোট তুলে দেওয়া হয়েছে এই সোজা কথাটা একবার ভুলে গেলে তারই ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার হয়ে যাবে, কোনো বিশেষ কাজ হাসিল করার জন্য আর কেউ যে তার হাতে টাকা তুলে দেবে না–এটুকু জ্ঞান সুখের আছে।
নইলে সে তো ঈশ্বরকে প্রায় অর্ধেক বখরা দিতে রাজি হত।
ঘটনা ওইখানে থেমে থাকে না।
প্রভাস এজেণ্ট লাগায় না। ঈশ্বরকে বাড়িতে ডাকিয়ে এনে নিজেই কথা বলে।
বলে, একটা খুব গুরুতর ব্যাপারে তোমায় ডাকিয়েছি। মাথা ঠাণ্ডা করে বস, চা খাবার খাও, তারপর কথাটা তোলা যাবে। খুব জরুরি কথা, গোপনীয় কথা।
বাইরের ঘরে ডেকে বসিয়ে চা খাবার খেতে দিয়ে সমাদর করে তবু ঈশ্বরের এতটুকু কাচুমাচু ভাব না দেখে প্রভাস যেমন আশ্চর্য হয়, তেমনি ক্ষব্ধ হয়!
ছোটলোকেরা এতদিনে সত্যি সত্যি ছোটলোক হয়ে যেতে শুরু করেছে। কবছর আগে তার ফুলের বাগান করার শখ হলে এই ঈশ্বর মালীর কাজ পেয়ে তাকে যেন দেবতা মনে করত, সামনে এলে সেইরকম ভাব দেখাত।
দু মাস পরেই অবশ্য তাকে বিদায় করে অন্য লোক রেখেছিল। জঙ্গল সাফ করতে পারে, মাটি কোপাতে পারে, ফুলের গাছ লাগাতেও পারে কিন্তু দেশী বিলিতি শখের ফুল আর পাতাবাহারের বাগান গড়তে জানে না।
মনে মনে বিরক্ত হলেও প্রভাস বাইরে সে ভাব প্রকাশ করে না। একটু আদেশের সুরে মিষ্টি করেই বলে, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে ঈশ্বর–একটু স্বাৰ্থ ত্যাগ করতে হবে। আমার খাতিরে, এ দেশের লোকের মানের খাতিরে। ওর গুলি বোধহয় দু-তিন ফুট ফাঁক দিয়ে ফস্কে গেল, তবু রবার্টসন বাহাদুরি করবে যে ওই বাঘটা মেরেছে। সায়েব হলেই মস্ত শিকারি হয়, এদেশের লোক বাঘ মারতে পারে না! তোমায় বলতে হবে যে, বাঘটা আমি মেরেছি।
ঈশ্বর বলে, তবেই সেরেছেন!
প্রভাস গম্ভীর হয়ে বলে, না, ছোট সস্তা হিসাব তুমি ধরতে পারবে না। তোমার বন্দুকের গুলিতেই বাঘটা মরেছে সত্যি কিন্তু তুমি এই নিয়ে বাহাদুরি করতে গেলে উল্টো ফল ফলবে। তোমার কথার কেউ দাম দেবে না ওই সায়েব ব্যাটা জোর গলায় বলতে পারবে যে, ওর গুলিতে বাঘ মরেছে। কিন্তু তুমি যদি বল যে, প্রভাসবাবুই বাঘটা মেরেছেন, ও ব্যাটা জব্দ হয়ে যাবে।
ঈশ্বরের মজা লাগে, হাসি পায়। একটা বাঘ মেরেছে বানিয়ে বলতে পারার জন্য রবার্টসন কেন সুখের মারফত তাকে আড়াই শ টাকা দেয় অর্থাৎ আসলে আরো অনেক বেশি টাকা কেন খরচ করে–ভালোমতো বুঝে উঠতে পারছিল না।
এবার ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রভাস ও রবার্টসনের মধ্যে একটা ভয়ানক। ঝগড়া হয়েছিল, প্ৰায় খুনোখুনি ব্যাপার, এ গুজব তার কানেও পৌঁছেছিল কিন্তু তার জানা ছিল না। যে, ওই বাঘ মারা নিয়ে দুজনের বিবাদ বেধেছিল।
হাসি পায়, মজা লাগে–বেশিক্ষণের জন্য নয়। কি করবে ভেবে না পেয়ে তার পরেই ঈশ্বর বিব্রত বোধ করে।
রবার্টসনের টাকা খেয়ে সে যে দলিল লিখে দিয়েছে সে কথা কি প্রভাসকে বলা যায়?
তার জবাবের জন্য খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে প্রভাস বলে, আমি বরং তোমায় কিছু নগদ টাকাও ধরে দিচ্ছি ঈশ্বর। শুনলাম তোমার বৌ নাকি হাসপাতালে গিয়েছে। তুমি শুধু লিখে দেবে যে, আমার গুলিতে বাঘটা মরেছে।
ঈশ্বর খানিকক্ষণ মাথা হেঁট করে ভাবে। তার হৃদয় মনে যে কী আলোড়ন চলছে প্রভাস তা কল্পনাও করতে পারে না। বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেও বিস্ময়ের সঙ্গেই সে ভাবে যে, নগদ টাকা পাবে শুনেও একটা বাঘ মারার বাহাদুরির দাবি ছাড়তে ঈশ্বর ইতস্তত করে!
ঈশ্বর হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে, কত টাকা দেবেন?
তখন খুশি হয়ে প্রভাস বলে, তুমি কত চাও?
ঈশ্বর বলে, আপনাকে খুঁটি কথা বলি। বৌটি হাসপাতালে গিয়েছে, শ পাঁচেক টাকা হলে ওকে বাঁচানো যায়
প্ৰভাস রেগে উঠে সংযম হারিয়ে একটা বিশ্ৰী মন্তব্য করে বসলে সে তাড়াতাড়ি বলে, না না, আপনার কাছে পাঁচ শ টাকা চাইছি না। যা কিছু সম্বল আছে সব বেচে দিয়ে আড়াই শ টাকার। মতো যোগাতে পারব। আপনি যদি আড়াই শ দ্যান তাহলে লিখে দিতে রাজি আছি।
প্রভাস গম্ভীর হয়ে একটু ভাবে। তার মুখের গুমোট ভাব দেখে ঈশ্বরের রীতিমতো শঙ্কা জাগে যে, লোকজন ডেকে তাকে মারধর করে খেদিয়ে না দেওয়া হয়।
প্রভাস কিন্তু সংক্ষেপে শুধু জিজ্ঞাসা করে, সবটা নগদ চাই?
ঈশ্বর বলে, হা বাবু, চিকিচ্ছের ব্যাপার, প্রাণ নিয়ে টানাটানি তার গরিব চাষী মজুর মানুষ। সব খরচটা নগদ আছে না দেখলে বাবুরা চিকিচ্ছে রুই করবে না।
প্রভাস বলে, একটু বস তাহলে। অত নগদ ঘরে নেই, যোগাড় করে আনি। এই খসড়াটা নিজের হাতে ততক্ষণে লিখে ফ্যালো–আমি ফিরে এলে সামনে সই করে দেবে।
প্রভাসের আগে থেকে তৈরি করা ফুলস্কেপের দেড়পাতা খসড়াটা কাঁচা হাতের মোটা অক্ষরে কপি করতে করতে ঈশ্বরের বুক কঁপে, প্রাণটা জ্বালা করে।
গৌরী মরবে ধরেই নিয়েছিল। ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করার জন্য চুরিচামারি চালাকিবাজির একটা সুযোগ পেয়েছে বলেই মেনে নেবে?
সুখের দেওয়া ঘুষের টাকাটা পাওয়ায় গৌরীকে হাসপাতালে পাঠানো গিয়েছিল। কিন্তু ও টাকায় কুলোবে না। ওটা ছিল শুধু টাকা পেয়ে নিজের বাঘ-মারার বাহাদুরি ত্যাগ করা।
কিন্তু প্রভাসের কাছে টাকা সে কোন হিসাবে নেবে?
অথচ এটাকাটা না পেলে গৌরীর ফাড়া হয়তো কাটবে না, তাকে বাঁচানো যাবে না।
পিসি দিনরাত কানের কাছে জপ করে বৌটাকে মারিসনে ঈশ্বর মারিসনে। পুরুষমানুষ, চুরি-ডাকাতি করে টাকাটা যোগাড় করে কমাস নয় জেল খাট!
কথাগুলি কানে আর প্রাণে যেন ঝনঝন করে বাজে।
প্রভাসের টাকাটা নিলে গৌরী এবারকার মতো বাঁচবে। তার কপালে কি আছে কে জানে। সব জানবার বুঝবার পর রবার্টসন বা প্রভাস কি ছেড়ে কথা কইবে, তাকে সহজে রেহাই দেবে!
খসড়া কপি করার আগেই প্রভাস ফিরে আসে। নিজের হাতে লেখা দলিলে ঈশ্বর তার সামনে স্বাক্ষর করার পর দশ টাকা পাঁচ টাকার নোট মিলিয়ে প্রভাস আড়াই শ টাকা গুনে তার হাতে দেয়।
সুখেকে দুটো দশ টাকার নোট ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল। প্রভাসকে কিছুই ফিরিয়ে দিতে হয় না।
সায়েব আর সরকারি বাবুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরী হাসপাতাল–উপায় নেই বলেই কিছু কিছু সাধারণ মানুষকে ঢুকতে দেওয়া–খরচ নিয়ে।
নিয়মিতভাবে গৌরীকে ঈশ্বর দেখতে যেতে পারে না।
দেখাশোনার টাইম বাঁধা। ঈশ্বরকে তখন কারখানায় আটক থাকতে হয়।
দিন দশেক পরে ঈশ্বর গৌরীকে দুবেলা হাসপাতালে বাধা টাইমে দেখতে যাবার অবাধ অধিকার পায়।
সেদিন ভোর আটটায় কারখানার দরজায় হাজির হলে দারোয়ান রামভজন তার পথ আটকে জানায় যে, কারখানায় ঢাকা তার বারণ।
বড় সায়েব রবার্টসন স্বয়ং হুকুম দিয়েছে।
কা হুয়া ভাই?–রামভজন সহানুভূতির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে।
ঈশ্বরের জানাই ছিল যে, রেহাই সে পাবে না, গায়ের জ্বালায় প্রভাস আর রবার্টসন দুজনেই আঘাত হানবে।
প্রথম আঘাত দিল রবার্টসন।
ঈশ্বর তার নিজস্ব হিন্দিতে বলে, সাবকো বিবিকা সাথ পিরিত হুয়া, সাবকো তাই গোসা হুয়া।
কি করা উচিত এবং সঙ্গত? ঈশ্বর ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। অন্য মজুরদের জানিয়ে দিতে পারে যে, অকারণে এবং অন্যায়ভাবে তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে লড়াই একটা শুরু করে দিতে পারা যায়।
রবার্টসন আসল ব্যাপার প্রকাশ করবে না, অন্য অজুহাত দেবে সন্দেহ নেই।
কিন্তু ঈশ্বরের বিবেক সাড়া দেয় না।
গৌরীর প্রাণ বাঁচানোর জন্যই হোক আর যে কারণেই হোক ধাপ্পা দিয়ে সে পাঁচ শ টাকা বাগিয়েছে। সেটা গোপন থাকলেও সকলকে তার পক্ষ নিয়ে লড়াইয়ে নামাতে হলে কত মিছে। কথাই যে তাকে বলতে হবে, তার জন্য যারা প্রাণান্তকর দুঃখদুর্দশা বরণ করবে তাদেরও নানাভাবে ধাপ্পা দিতে হবে।
সে-ও তো খুলে বলতে পারবে না আসল ব্যাপার।
আজিজ, নকুল, মণ্টারা জন সাতেক রোজই একসাথে গল্পগুজব করতে করতে কাজে আসে, একজন প্রশ্ন করে, দাঁড়িয়ে যে?
ঈশ্বর মুখ খোলার আগেই রামভজন জানিয়ে দেয়, কাজ তার খতম হয়ে গিয়েছে, বড় সাহেবের হুকুমে।
সাতজনেই দাঁড়িয়ে যায়, পৃথকভাবে আরো দুজন গেটের মধ্যে প্রায় ঢুকে পড়েছিল–তারাও ফিরে এসে সামনে দাঁড়ায়।
কি ব্যাপার?
ঈশ্বরের আধা চাষী আধা মজুর সরল প্ৰাণে কি যে একটা ঝোঁক চাপে, সে বলে বসে, ওই। বাঘ মারার ব্যাপার, আবার কি! সায়েবের গুলি ফস্কে গেল, আমার বন্দুকে বাঘ মরল, এ অপমান কি সয়!
মণ্টা গর্জন করে বলে, বটে! ইয়ার্কি পেয়েছে নাকি! নিজের গুলি ফস্কে গেল, তোর গুলিতে বাঘ মরল, সেই দোষে তোকে ছাঁটাই করবে! তোকে না ঢুকতে দিলে আমরাও আজ কেউ ঢুকব না, যারা ঢুকেছে তারাও সবাই বেরিয়ে আসবে।
আজিজ বলে, ঠিক কথা। যাকে খুশি, যখন খুশি ছাটাই করবে–ইস্!
ঈশ্বর বড়ই বিব্রত হয়ে বলে, যা গে যাক, কাজ আমার জুটে যাবে।
মণ্টা বলে, যা গে যাক্ মানে? কাজ জুটবে কি জুটবে না, মোটেই সে কথা নয়। এরকম খেয়ালখুশির ছাটাই মোরা মানব না–এ ইয়ার্কি চলবে না।
প্রৌঢ় সাধু বলে, বটেই তো, আজ তোকে বিনা দোষে খেদাচ্ছে, কাল মোকে খেদাবে।
কাজ শুরু করার সময় ঘনিয়ে এসেছে। ভো বাজার আওয়াজ শুনে নিখুঁত হিসাবে সময় আন্দাজ করে পিলপিল করে খাটুয়েরা আসতে শুরু করেছে। অনেক দিনের অভ্যাসে আন্দাজ হয়েছে নির্ভুল।
কয়েক মিনিট আগে আসবে। বেশি আগে এসে কাজের পেছনে সময় নষ্ট করার বোকামি তাদের অল্প দিনেই কেটে যায়। বাধা টাইমের ধরাবাঁধা কাজ তো।
দেখতে দেখতে ঈশ্বরকে ঘিরে ভিড় জমে ওঠে। ইতিপূর্বে যারা ভিতরে ঢুকেছিল তারাও হয় খবর পেয়ে নয় টের পেয়ে বেরিয়ে এসে ভিড় বাড়ায়।
ঈশ্বর এভাবে ও-ভাবে রেহাই পাবার চেষ্টা করে। একবার বলে বড়ই তার অপমান বোধ হয়েছে, এখানে আর সে কাজ করবে না। তারপর বলে যে, অন্য জায়গায় বেশি মজুরিতে ভালো কাজ পাবে, ছাঁটাই হয়ে ভালোই হয়েছে। আবার বলে যে খাটুনি তার পোষায় না, এবার সে একটা দোকান দেবে।
তার দিশেহারা ভাব বেশ খানিকটা হকচকিয়ে দেয় সকলকে। খেয়ালের বশে অন্যায় করে সায়েব তার কারখানায় ঢোকা নিষেধ করে হুকুম দিয়েছে বলে মজুর কেরানি সকলে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে সাথে না নিয়ে একজনও কারখানায় ঢুকবে না স্থির করেছে–তার এমন কাচুমাচু দিশেহারা ভাব, সকলে তার পক্ষ নিয়ে লড়াই করবে তাতে এমন ঘোরতর আপত্তি!
কাজ শুরু করার টাইম পেরিয়ে আধঘণ্টা কেটে যায়, কাজ শুরু করা যায় না।
ইতিমধ্যে দেখা যায় যেন মন্ত্রবলে একদল পুলিশ এসে সেজেগুজে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়েছে অদূরে কদমগাছটার তলায়।
কয়েকজনকে ঠেলে সরিয়ে নন্দ এগিয়ে যায়, ঈশ্বরের মুখের কাছে মুখ নিয়ে শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, তোমার মতলবটা কি ঈশ্বর? তুমি কাদের এজেন্ট?
প্ৰাণ ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল ঈশ্বরের। সে হঠাৎ মুখ তুলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে, ভাই সব, কাজে যাও না তোমরা। বার বার বলছি, তোমরা শুনছ না। আমার ছাঁটাইয়ের মধ্যে অন্য ব্যাপার আছে–তোমাদের আমি তার মধ্যে জড়াব না।
মণ্টা বাঘের মতো থাবা উঁচিয়ে গর্জন করে বলে, এ কথাটা গোড়ায় বললেই হত না। হারামজাদা?
নন্দ তাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায়।
হৈচৈ কলরব নয়, পরস্পরের কথা বলাবলির একটা গুঞ্জনধ্বনি তুলে ভিড়টা কাজ করতে কারখানায় ঢুকতে শুরু করে।
প্রায় পৌঁনে এক ঘণ্টা লেট হয়েছে সকলের। কিন্তু বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, লেটটা হাজিরার হিসাবে গণ্য করা হয় না।
সবাই ঠিক টাইমে কাজে যোগ দিয়েছে এটাই অফিসিয়ালি ধরে নেওয়া হয়।
গুরুতর হাঙ্গামার আশঙ্কা জেগেছিল, এত অল্পে বিনা হাঙ্গামায় সেটা বাতিল হয়ে যাবে বড় কর্তারা কেন ছোট কর্তারাও সেটা ভাবতে পারে নি।
সকলকে তাই জানিয়ে দেওয়া হয় যে, বিশেষ অবস্থা বিবেচনা করে কারো লেট হাজিরায় ধরা হয় নি, তবে এক ঘণ্টা ওভারটাইম খেটে দিয়ে ওটা তাদের পুষিয়ে দিতে হবে।
আজিজ হেসে বলে, নিজেদের হিসাবটা ঠিক রাখে। লেট করেছ, মাপ করলাম, বিনা পয়সায় ওভারটাইম খেটে সেটুকু শোধ করে দিয়ে যেও!
যেন নেশা করেছিল, ঘোর কেটে যাচ্ছে এমনিভাবে স্থলিতপদে ঈশ্বর হাসপাতালে যায়। সকালে দেখা করার সময় পার হয়ে গিয়েছিল, তাকে বিকালে যেতে বলা হয়।
বিকালে হাসপাতালে গৌরীকে দেখতে যাবার পথে ঈশ্বর একেবারে সামনাসামনি পড়ে যায় কথায় মশগুল পাশাপাশি হন্টনরত প্রভাস আর রবার্টসনের।
একজন টানছে সিগার, অন্যজন ফুঁকছে সিগারেট।
অনায়াসে পাশের কচু কলা বাঁশ বনের আড়ালে চলে যেতে পারত ঈশ্বর ছোট ছেলেও লাফ দিয়ে পার হয়ে যেতে পারে পথের ধারের ময়লা কাদায় বুজে আসা নালাটা।
কিন্তু সে যেমন চলছিল তেমনিভাবে চলতে থাকে। কথা কইতে কইতেই প্রভাস ও রবার্টসন তার দিকে এক নজর তাকিয়ে চলে যায়।
দুজনের বিবাদ শুধু মিটে যায় নি, ভাবও হয়েছে। তারই জন্য সন্দেহ নেই।
কী মজার কাগুই না জানি হয়েছিল। তার দলিলের জোরে দুজনেই কি সকলের সামনে আবার বাঘ মারার দাবি ঘোষণা করেছিল এবং একটা হাস্যকর অবস্থা সৃষ্টি করে অপদস্থ হয়েছিল? দুজনকেই সে সমান জোরের সঙ্গে বাঘ মারার সার্টিফিকেট লিখে দিয়েছিল।
ঘটনা সে জানতে পারে অনেক কিছু ঘটবার পর। হাসপাতালে গৌরীকে দেখে ঘরে ফেরার পথের নির্জন স্থানে কয়েকজন অচেনা লোকের হাতে সে এমন বেদম মার খায় যে, কয়েকদিনের জন্য বিছানা নিতে হয়।
তার যথাসর্বস্ব যৎসামান্য–একদিন রাত্রে সবই প্রায় চুরি হয়ে যায়।
কদিন পরে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তার তিনপুরুষের ঘরের চালা।
এসব অবশ্য সুখের কীর্তি।
কিন্তু প্রভাস ও রবার্টসন সোজাসুজি প্রতিশোধের ব্যবস্থা না করলে সুখের পক্ষে এত কাণ্ড করা সম্ভব হত না।
প্রভাসের বসার ঘরে সুখেন্দুকে ডাকিয়ে এনে দাঁড় করিয়ে রেখে বেয়ারা পেগ দিয়ে গেলে গ্লাসে গ্লাসে ঠেকিয়ে চুমুক দিয়ে দুজনে কয়েক মিনিট কথা বলেছিল। তারপর রবার্টসন সুখেকে ধমক দিতে শুরু করেই মেজাজ চড়ে যাওয়ায় তার গালে মেরে বসেছিল একটা চড়।
রবার্টসনের মোটা কড়া থাবা। বেহিসাবী রাগের মাথায় চড় কমিয়ে দিয়ে থাকলে গালটা সুখের ফেটে যেত।
গালটা জ্বলেপুড়ে গেলেও সুখে টের পেয়েছিল, চড়টা হিসাব করে মারা, তাকে একেবারে ঘায়েল করার উদ্দেশ্য সায়েবের নেই।
তাকে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গ্লাসে আরেকটা চুমুক দিয়ে রবার্টসন অদ্ভুতরকম শান্ত গলায় সংক্ষেপে ব্যাপারটা তাকে জানিয়েছিল।
এবং ভয়ানক শাস্তির ভয় দেখিয়েছিল।
সুখে কাচুমাচু করে নি, ধীর গম্ভীরভাবে সবিনয়ে জানিয়েছিল, ঈশ্বর যে এমন বদমাশি করবে তার জানা ছিল না। ওকে সে শায়েস্তা করে দেবে।
প্রভাস বলেছিল, ওকে শায়েস্তা করার জন্য আমাদের কাছে থেকে আবার দু-পাঁচ শ আদায় করবে তো?
আজ্ঞে না। একটা পয়সাও চাইব না। রবার্টসন যেন জমে আসা নেশার ঝোঁকেই বলেছিল, গেট আউট, শূয়ারকা বাচ্চা।
সুখে কিন্তু টের পেয়েছিল যে, গালে চড় মারার মতো এটাও সায়েবের হিসাব করে দেখানো মেজাজ। অর্থ অতি পরিষ্কার।
তাকে একেবারে বাতিল করে বাদ দেবার ইচ্ছা সায়েবের নেই, কিন্তু এ ব্যাপারে হাতেনাতে সে কি করে আগে সায়েব সেটা দেখবে। নইলে আর খাতির নেই।
দু মাস পরে খানিকটা সেরে উঠে গৌরী ঘরে ফেরে। ঘর? না, ঘর ছাওয়া হয় নি ঈশ্বরের। আগুনে ঝলসানো কালচে-মারা মাটির দেয়াল শুধু দাঁড়িয়ে আছে।
ভাগ্যে গোয়ালের চালাটা বেঁচেছিল। ভাগ্যে ঈশ্বরের গরু নেই। গরু থাকলে বেচারাকে গাছতলায় ঠেলে দিয়ে তাদের ওই চালায় আশ্রয় নিতে হত।
সেরে উঠতে শুরু করে হাসপাতাল থেকে বিদায় হয়ে এসে গৌরীও ওই চালার কোণে আশ্রয় নেয়।
বুড়ি মা আর পিসিকে মণ্টা তার ঘরে রাত্রে শুতে দিচ্ছে তাই রক্ষা।
মরতে হবেই এ ভয় গৌরীর আর নেই। সেরে ওঠে নি, সেরে উঠবে ধরে নেওয়া হয়েছে কিন্তু সুনিশ্চিত মরণটা অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে গৌরীর।
বেঁচে যাবে এটা আশা করা চলে।
তাতেই কৃতজ্ঞতার সীমা নেই গৌরীর।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গোয়ালের চালার ঘরে নিচু নোংরা ভিজে কাদাটে ভিটেয় খড়। বিছিয়ে উঁচু গদি করা দেড় হাত চওড়া হেঁড়া কাঁথার বিছানায় শুয়ে সে খানিকক্ষণ দম নেয়, নিজেকে সামলায়। তারপর প্রায় গদগদ ভাষায় জিজ্ঞাসা করে, হ গো, এবারে তো ঘরে এয়েছি, এবার মোকে খুলে বল না, পাঁচ শ টাকা কোথা থেকে পেলে? কী করে মোর প্রাণ বাঁচালে?
পোড়া ঘরটার দিকে বারেক তাকিয়েছিল গৌরী? ওমা, ঘর পুড়লে নগদ টাকা জোটে নাকি? সরকার থেকে দেয়?
পাগল হয়েছিস? বড়লোকের কাছ থেকে টাকা বাগালে ঘর পোড়। ঘর পুড়েছে, একদম খালি গোয়ালঘরে শুয়ে আছিস, সেটা খেয়াল করেছিস?
গায়ের আঘাতের কয়েকটা চিহ্ন আজো মিলিয়ে যায় নি–মাথার ক্ষত চিহ্নটা কোনোদিন মিলোবে না।
ঈশ্বর সেগুলি গৌরীকে দেখায় কিন্তু আসল ঘটনাটা তাকে জানায় না। মেয়েমানুষের মুখের আগল নেই, গৌরীকে ব্যাপারটা সবিস্তারে জানালে বাঘ মারার ব্যাপারে দুজনের কাছে টাকা নিয়ে তার দুজনকে ঠকানোর কীর্তিকাহিনী সবাই জেনে যাবে।
গৌরী মনে করবে এটা তার মস্ত বাহাদুরির কথা!
গৌরীকে সে শুধু বলে যে, বাঘটা মারার জন্য পাঁচশ টাকা পুরস্কার পেয়েছে।