Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হরিপুরের হরেক কাণ্ড || Shirshendu Mukhopadhyay

হরিপুরের হরেক কাণ্ড || Shirshendu Mukhopadhyay

গদাই নস্কর ডাকাতি ছাড়লে

গদাই নস্কর ডাকাতি ছাড়লে হবে কী, হাঁকডাক ছাড়েনি, আর নগেন দারোগা চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন বটে, কিন্তু দাপট যাবে কোথায়? গদাই যখন ডাকাত ছিল আর নগেন যখন দারোগা, তখন দু’জনে বিস্তর লড়াই হয়েছে। গদাইকে দু-দুবার গ্রেফতার করেছিলেন নগেন, দু’বারই গদাই গারদ ভেঙে পালায়। দুজনেই ছিলেন দুজনের জন্মশত্রু। এখনও যে তাঁরা পরস্পরকে খুব একটা পছন্দ করেন তা নয়। তবে সন্ধেবেলায় দু’জনেই বসে হ্যারিকেনের আলোয় নিবিষ্ট মনে দাবা খেলেন। আজও খেলছিলেন।

শীতকালের শুরুতেই খুব ঝড়বৃষ্টি হয়েছে দুদিন ধরে। বাঘা শীতটা না পড়লেও উত্তুরে হাওয়ায় বেশ হি হি কাঁপুনি ওঠে। এই দুর্যোগের রাতে ডাকসাইটে জমিদার মহেন্দ্রচন্দ্র দেবরায় তাঁর কাছারি ঘরে নিচু তক্তপোষে তাকিয়া ঠেস দিয়ে বালাপোষ গায়ে বসে গড়গড়া টানছেন। সামনে একটা কাঠের চেয়ারে পা তুলে যে-লোকটা বসে আছে সে ত্রিশ বছর আগে ছিল রাজদ্রোহী পবনকুমার। মহেন্দ্রচন্দ্রকে সিংহাসনচ্যুত করে রাজ্যকে সুশাসিত করার জন্য যে প্রবল লড়াই করেছিল। আজ আর রাজ্যও নেই, সিংহাসনও লোপাট। মহেন্দ্রচন্দ্রের সময় কাটে না আর পবনকুমার মাস্টারির চাকরি থেকে রিটায়ার করে এখন একরকম ঘর-বসা। এই সন্ধেবেলাটা রোজই দু’জনের দেখাসাক্ষাত হয়। সুখ-দুঃখের কথা ওঠে। অবিশ্যি আড্ডায় আরও দু-চারজন রোজই থাকে। আজ বৃষ্টি-বাদলা বলে আর কেউ আসেনি।

অ্যালোপ্যাথ শহিদলাল আগে হোমিওপ্যাথ বিশু দত্তকে দু’চোখে দেখতে পারতো না। আর দু’জনেই ছিলেন কবরেজ রামহরির চক্ষুশুল। আজকাল তিনজনেই রোজএকসঙ্গে বসে খুব মাথা নেড়ে-নেড়ে হেসে-হেসে গল্প করেন। শহিদলাল আজকাল প্রায়ই চ্যবনপ্রাশ বা আর্নিকা থার্টি খেয়ে থাকেন। বিশু দত্ত দরকার পড়লেই পাঁচন বা অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেয়ে থাকেন। রামহরিরও আজকাল অ্যালোপ্যাথি বা হোমিওপ্যাথিতে অরুচি নেই। আজ-সন্ধেবেলা তিনজনেই রামহরির বাড়িতে বসে বাজারদর নিয়ে কথা কইছেন।

মল্লবীর নয়ন হাতির সঙ্গে ব্যায়ামবীর বজ্র সেনের কোনওকালে সদ্ভাব ছিল না। আজকাল দু’জনের মধ্যে খুব ভাব। সন্ধেবেলা নয়ন হাতির বাড়ির বৈঠকখানায় বসে দু’জনে একটা শ্লেটে কাটাকুটি খেলছেন।

শ্মশানকালীর মন্দিরে বটবৃক্ষের তলায় বসে বিখ্যাত তান্ত্রিক জটেশ্বর আজও ভাবের ঘোরে মা মা বলে চেঁচাচ্ছিল। একটু পেছনে বসে পরম বৈষ্ণব গোপেশ্বর দাস মিটিমিটি হাসছিল। জটেশ্বরের পুজো শেষ হলে দু’জনে একসঙ্গে বাড়ি ফিরবে। রোজই এরকমধারা হয়।

রাত আটটা বাজতে আর বিশেষ দেরি নেই। রাত আটটায়–ঠিক রাত আটটায় জড়িবুটিওলা শুলপাণি একটা বিকট অট্টহাসি হাসে। শীত-গ্রীষ্ম বর্ষা, যাই হোক গত ত্রিশ বছর ধরে শূলপাণি কাঁটায়-কাঁটায় রাত আটটায় অট্টহাসি হাসবেই। অনেকেই সেই হাসি শুনে ঘড়ি মিলিয়ে নেন। শূলপাণিকে কেউ বলে পাগল, কেউ বলে ছদ্মবেশী মহাযোগী পুরুষ, কেউ ভাবে ম্যাজিসিয়ান, কেউ ভাবে প্রেসিদ্ধ, কেউ ভাবে বৈজ্ঞানিক। শূলপাণি কোথা থেকে যে উড়ে এসে এ গাঁয়ে জুড়ে বসেছে তা কেউ জানে না। গাঁয়ের সরলাবুড়ির তিনকুলে কেউ ছিল না। সে-ই শূলপাণিকে আশ্রয় দেয়।

সরলা বুড়ি একশো চার বছর বয়সে মারা যাওয়ার সময় গাঁয়ের পাঁচজন মাতব্বরকে ডাকিয়ে এনে বলল, “বাবাসকল, শূলপাণিকে আমি ছেলের মতোই দেখি। বেচারা ভাবে ভোলা মানুষ। আমি মরলে তোমরা ওকে উৎখাত কোরো না। আমার ঘরেই থাকতে দিয়ো।”

তাতে অবশ্য গাঁয়ের লোকের আপত্তি হয়নি। সরলাবুড়ির পুরনো ঝুরঝুরে বাড়িটা পাকা হলেও ভগ্নদশা। বাঁশঝাড়ের পেছনে খালের পারে ওই বাড়িটার ওপর কারও কোনও লোভ ছিল না।

শূলপাণি রয়ে গেল। তবে সে খুবই রহস্যময় লোক। সে নানা ওষুধ বিষুধ তৈরি করে। নানা প্রক্রিয়া জানে, ছোটখাটো ম্যাজিক দেখাতে পারে। সে সাপ, পাখি, বিছে, হলোবেড়াল, বাঁদর ইত্যাদি ধরে জীবজন্তু পোষে। তার একটা মড়ালে কুকুরও আছে। কেউ-কেউ বলে, সে কিছু ভূত আর পেত্নিও পুষে রেখেছে। কৃষ্ণপক্ষের রাতে সে যে মাঠে-ঘাটে ভূত ধরতে বেরোয়, তা ভিতু ভূতনাথবাবু, সাহসী বীরেনবাবু এবং আরও অনেকেই স্বচক্ষে দেখেছেন।

তা সে যা-ই হোক, গত ত্রিশ বছর ধরে প্রতিদিন রাতে কাঁটায়-কাঁটায় রাত আটটায় শূলপাণির অট্টহাসি গাঁয়ের লোক শুনে আসছে। কোনওদিন নড়চড় হয়নি। শূলপাণি কেন হাসে তা অবশ্য অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেও জানা যায়নি। জিজ্ঞেস করলে শূলপাণি অম্লান বদনে শুধু বলে, “হাসি পায় বলেই হাসি।”

শূলপাণির হাসির সঙ্গে এ-গাঁয়ের অনেক লোকেরই একটা রুটিন করা থাকে। যেমন শূলপাণি হাসলেই প্রিয়নাথবাবু ফটিককে পড়ানো বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠে পড়েন। আবার ওই হাসির শব্দ পেলেই মহেন্দ্র তার মুদির দোকানের ঝাঁপ ফেলে হিসেব করতে বসে। শূলপাণি যেই হাসল, অমনি অন্নদাপিসি তাঁর জপ-আহ্নিক সেরে উঠে পড়েন। আর প্রবৃদ্ধ অন্নদাচরণ তাঁর ঠাকুর্দার আমলের পকেট-ঘড়িটার সময় ওই হাসির সঙ্গে রোজ মিলিয়ে নেন।

আটটা বাজে-বাজে। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন রাজদ্রোহী পবনকুমার। আটটা বাজলেই উঠে পড়বেন। আজ বাড়িতে সোনামুগ ডাল আর কাল নুনিয়া চালের খিচুড়ি হয়েছে।

মহেন্দ্রচন্দ্র গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “অমন ছটফট করছ কেন হে? কোন রাজকার্যে যাবে?”

পবনকুমার একটা শ্বাস ফেলে বলেন, “রাজকার্য তো তোমার। রাজাগজা লোকদেরই রাজকার্য থাকে।”

মহেন্দ্র একটু হেসে বললেন “আরে সেসব পাট তো চুকে গেছে কবে। এখন ঘরেরটা ভাঙিয়ে পেট চালানন। ঠাটবাট বজায় রাখা যাচ্ছে না। সবই তো জানো। এখন যা দুরবস্থা চলছে তাতে মনে হয় পঞ্চাশ বছর আগে তোমার তলোয়ারের কোপে বা বন্দুকের গুলিতে প্রাণটা গেলেই ভাল ছিল। তা হলে অবস্থার এই পরিবর্তনটা দেখতে হত না।”

খিদের চোটে পবনকুমারের পেট ডাকছিল। তবু হাসিমুখে বললেন, “তোমার হাতে আমি যদি মরতুম, তা হলেও মন্দ হত না। ইতিহাসে নাম থাকত মস্ত শহিদ বলে।”

শহিদলাল উসখুস করছিলেন, তাঁর দেওয়ালঘড়িতে ঢং ঢং করে আটটা বাজছে। কিন্তু শূলপাণির অট্টহাসি শোনা গেল না। তবে কি ঘড়িটা ফাস্ট যাচ্ছে? ঘড়িটা নিয়ে তাঁর খুব অহংকার। বিলিতি ঘড়ি। আজ অবধি গত পঞ্চাশ বছর ধরে ঠিকঠাক সময় দিয়ে আসছে।

হোমিওপ্যাথ বিশু দত্ত আটটার ঘণ্টা শুনে ঘড়ির দিকে চেয়ে বললেন, “এবার ঘড়িটা বেচে দাও হে শহিদ, এ যে ঘোড়দৌড় লাগিয়েছে।”

কিন্তু কবিরাজ রামহরি ক্রু কুঁচকে বললেন, “শোনো বাপু, আমার যেন কেমন একটা সন্দেহ হচ্ছে।”

বিশু বললেন, “কিসের সন্দেহ?”

কন্ডিশন রিফলেক্ট কাকে বলে তা তো জানোই। শূলপাণি রাত আটটার সময় অট্টহাসি হাসে। ত্রিশ বছর আগে প্রথম যেদিন হাসি শুনি সেদিন আমি ভীষণ চমকে গিয়ে ভয় খেয়েছিলাম। তারপর থেকে রোজ রাত আটটায় ওই হাসি শুরু হয় আর আমিও একটু চমকে উঠি। এই করতে-করতে এমন হল যে, ভিন গাঁয়ে বা শহরে গঞ্জে গেলেও রাত আটটার সময় আমি অজান্তে একবার চমকে উঠবই। শূলপাণির হাসি না শুনলেও ওই চমকে উঠলেই বুঝতে পারি আটটা বেজেছে। এই একটু আগেই ঘড়িতে শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার চমকানি হয়েছে। সুতরাং ঘড়ি ঠিকই আছে। শূলপাণি আজ হাসেনি।

হতেই পারে না। অসম্ভব। ঘড়ি ফাস্ট আছে। তোমার চমকানোটাই গণ্ডগোলের।

এদিকে বর্জ্য সেন হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বললেন, “ও হে নয়ন, শূলপাণি হাসল না যে বড়!”

নয়নও অবাক হয়ে বলল, “তাই তো! সোয়া আটটা বাজে যে!”

বজ্র সেন তাড়াতাড়ি উঠে বললেন, “চলো তো, ব্যাপারটা দেখা যাক।”

“চলো, আমরা ছাড়া দেখবেই বা কে?”

গদাই নস্কর আর নগেন দারোগারই শুধু বাহ্যজ্ঞান ছিল না। দাবা খেলায় মজে ছিলেন দু’জনেই।

হঠাৎ ভেতরবাড়ি থেকে নগেনের গিন্নি সুরবালা ঘরে ঢুকে আতঙ্কিত গলায় বললেন, “আজ শূলপাণি হাসল না যে গো! গাঁয়ে বোধহয় এবার মড়ক লাগবে। কী অলক্ষুণে কাণ্ড!”

চেঁচামেচিতে দু’জনেরই খেয়াল হল। নগেন আর গদাই সচেতন হলেন। নগেন অত্যন্ত রেগে গিয়ে বললেন, “হাসবে না মানে! হাসতেই হবে। না হেসে যাবে কোথায় ও?”

সুরবালা রেগে গিয়ে বললেন, “সব জায়গায় দারোগাগিরি চলে না। যাও, গিয়ে দেখে এসো শূলপাণির কী হল! আমার বাপু মোটেই ভাল ঠেকছে না।”

কথাটা ঠিক। রাত আটটায় শূলপাণির অট্টহাসি না শুনে গোটা গাঁ-ই উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত। একে-একে টর্চ, লণ্ঠন আর ছাতা হাতে বিভিন্ন বাড়ি থেকে লোকজন বেরিয়ে এল রাস্তায়। বেশ একটু হই-হট্টগোলই হতে লাগল।

বাঁশঝাড়ের পেছনে শূলপাণির অন্ধকার বাড়িতে ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও মেলা লোক জড়ো হয়ে গেল। তারপর ডাকাডাকি, “শূলপাণি! ও শূলপাণি।” কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।

.

০২.

বৃষ্টি, বাতাস আর শীতের মধ্যেও শূলপাণির বাড়িতে বিস্তর মেয়ে-পুরুষ জড়ো হয়ে গেল। টর্চ, লণ্ঠন, হ্যাঁজাকবাতির অভাব হয়নি। সামনে একটু ফাঁকা জায়গায় আগাছা জন্মে আছে। আগে বাগান ছিল। শূলপাণির বাগান টাগানের শখ নেই। পেছনে সরলা বুড়ির পুরনো বাড়ি। দরজার পাল্লা হাট করে খোলা। শেকলে বাঁধা কুকুরটা প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে।

নগেন প্রাক্তন দারোগা হলেও তারই অধিকার বেশি, সে সকলের দিকে ফিরে গমগমে গলায় বলল, “ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ, আপনারা কেউ ভেতরে যাবেন না। আমি আগে ঢুকে দেখি কী হয়েছে। যদি বিপজ্জনক কিছু ঘটে থাকে, ধরুন যদি কোনও খুনি শূলপাণিকে খুন করে ভেতরে ওত পেতে থাকে, কিংবা যদি কোনও বাঘ শূলপাণিকে খেয়ে ভেতরে এখনও বসে ঠোঁট চাটতে থাকে, কিংবা কোনও ভূত যদি-আচ্ছা, ভূতের কথা থাক। মোটকথা, আমি আগে শূলপাণির ঘরে ঢুকছি।”

নয়ন বলে উঠল, “কিন্তু আপনার তো পিস্তল নেই।”

নগেন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, তাতে কি? আমার দুটো চোখই জোড়া পিস্তলের সমান। এই গদাইকেই জিজ্ঞেস করো না, কোনওদিন চোখে চোখ রেখে কথা কয়েছে?”

“কিন্তু খুনির কাছে পিস্তল থাকতে পারে তো নগেনবাবু?”

নগেন দারোগা হো হো করে হেসে উঠে বলল, “পারেই তো। আর সেইজন্যই আমি সবার আগে ঢুকতে চাইছি। দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। দারোগাগিরি করে হাসিমুখেই প্রাণ দেব। তোমরা বটতলায় আমার নামে একটা শহিদ বেদি বানিও।”

গদাই নস্কর ফিচিক ফিচিক হাসছিল। চাপা গলায় বলল, “আর লোক হাসিও না বাপু। চম্বরপুরের জঙ্গলে আমার সাগরেদ কেলো বাঘের ডাক ডেকেছিল বলে তুমি ভয় খেয়ে কী পাঁই পাঁই করেই না ছুট দিয়েছিলে!”

নগেন বিরক্ত হয়ে বলল, “আচমকা ডেকে ওঠায় ভয় পেয়েছিলুম ঠিকই, কিন্তু বাঘের ভয় থাকলেও আমার ভালুকের ভয় নেই।”

“বাঘের চেয়ে ভালুক, আরও খারাপ। পাল্লায় পড়োনি বলে বলছ। বাঘ সব সময়ে তেড়ে আসে না, আর ভালুকের স্বভাবই হল কথা নেই বার্তা নেই তেড়ে এসে থাবা মারবে। অ্যাই বড় বড় নখ, বুঝলে?”

নগেন খুব বিরক্তির সঙ্গে বলে, “ভালুকের গল্প পরে হবে, হাতে জরুরী নেই। আমার তোমার পিস্তল নিয়ে নই। তুমি রিটায়ার কাজ রয়েছে। চলো, ঘরে ঢুকে দেখা যাক।”

“কে আগে ঢুকবে? তুমি, না আমি?”

নগেন বলল, “টস করা যাক।”

গদাই হেসে বলল, “তার দরকার নেই। তুমি রিটায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে সরকার বাহাদুর তোমার পিস্তল নিয়ে নিয়েছেন। আমার তো সে বালাই নেই। আমার পেটকোঁচড়ে সবসময়ে পিস্তল থাকে। তবে পিস্তলের দরকার হবে না। খুনি হোক, বাঘ হোক, এত লোক দেখে সে বসে নেই। এসো।”

গদাই ভেতরে ঢুকে চারদিকে টর্চ ফোকাস করে বলল, “ওহে নগেন, ব্যাপার সুবিধের নয়।”

টর্চের আলোয় যা দেখা গেল তা সুবিধের ব্যাপার নয় ঠিকই। শূলপাণির ঘর একেবারে লণ্ডভণ্ড। ঘটি বাটি বিছানা বাক্স সব ছত্রাকার ছড়িয়ে আছে। বানরটা ঘরের উঁচু একটা তাকে উঠে বসে আছে। ঘরের কোণে বসে বেড়ালটা ফ্যাঁস ফ্যাঁস আওয়াজ ছাড়ছে। মড়ালে কুকুরটা কোনও কালে বাঁধা থাকে না। সেটা আজ নতুন একটা চেন দিয়ে ভেতরের দরজার কড়ার সঙ্গে বাঁধা। চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বেচারার গলা ভেঙে গেছে। গাঁয়ের লোক দেখে সে নিজস্ব ভাষায় নানারকম নালিশ জানাতে লাগল।

নগেন বলল, “শূলপাণি কি খুন হল নাকি হে গদাই?”

“আগেই খুন ধরে নিচ্ছ কেন? রক্তপাত তো হয়নি দেখছ?”

“আহা, গলায় ফাঁস দিয়ে যদি—”

“তাহলে লাশ যাবে কোথায়?”

“সরিয়ে ফেলেছে।”

“কেন সরাবে?”

“প্রমাণ লোপ করার জন্য।”

“নাঃ, তুমি দারোগা হলেও বুদ্ধি খাটাচ্ছ না। লাশ সরানোর পরিশ্রম কম না। বিশেষ কারণ না থাকলে কেউ একটা ডেডবডি-কাঁধে করে নিয়ে যায় না, ফেলেই যায়।”

ব্যঙ্গের হাসি হেসে নগেন বলল, “তাই বটে। এসব তো তুমি ভালই জানো। অনেক করেছ কিনা, তাই অভিজ্ঞতা থেকেই বলছ।”

“অভিজ্ঞতার চেয়েও বড় কথা হল কমন সেন্স। তার জন্য মাথা খাটানো চাই। তুমি আস্ত পাঁঠা বা দেড়খানা পাকা কাঁঠাল খেতে পারো বটে, কিন্তু মস্তিষ্কচালনা তোমার একেবারে নেই। পেটের ব্যায়ামই হয়েছে, মাথার ব্যায়াম হয়নি। যদি তাই হত তা হলে দু-দুবার তোমার গরাদ থেকে আমি পালিয়ে যেতে পারতাম না।”

“অত বাহাদুরি কোরো না। আমার ফোর্সের মধ্যেও তোমার লোক ছিল। তারাই তোমাকে পালানোর পথ করে দিয়েছিল।”

“সেটা ধরতে তোমার এতদিন সময় লাগল কেন? যাকগে, এখন এসো, শূলপাণির ঘরদোর ভাল করে দেখে পরিস্থিতিটা খতিয়ে দেখা যাক।”

একটু কাঁপা গলায় পেছন থেকে ভূতনাথ বলে উঠল, “দেখার কিছু নেই ভায়া। আমি সেই কবেই শূলপাণিকে বলেছিলুম, ওরে শূল, ভূত-প্রেত ধরে অধর্ম করিস না। ওরাই একদিন তোর ঘাড় মটকাবে। সেই কথাই ফলে গেল।”

ভিড় ঠেলে জটেশ্বর তান্ত্রিক এগিয়ে এসে বলল, “কটা ভূত ছিল শুনি শূলপাণির? সব গাঁজাখুরি গল্প। এ-গাঁয়ের সব ভূত শ্মশানকালী মন্দিরের বট আর অশ্বত্থাগাছে ঝুলে আছে। আমি গুনে দেখে এসেছি একটু আগে। মোট সাতশো তিরানব্বইটা। এ-গাঁয়ে ও কটাই আছে। তাও চারশোর ওপর হচ্ছে বহু পুরনো ভূত। তাদের কারও-কারও বয়স হাজারের ওপরে। ঝুরঝুরে চেহারা, আবছা হয়ে এসেছে, তারা সাতে-পাঁচে থাকেও না। ভূতের নামে খর্বদার বদনাম দেবেন না।”

ভূতনাথ রামনামটা একটু থামিয়ে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, “বদনাম করিনি বাপু, পাঁচজনে বলছিল আর কি।”

বৈষ্ণব গোপেশ্বর দাস জটেশ্বরের পিছুপিছু এসে মিষ্টি করে বলল, “শূলপাণি কি কৃষ্ণে লীন হয়েছেন? এখানে এত গোল কেন?”

গোপেশ্বর বিনয়ী হলেও চতুর লোক। গাঁয়ের সবাই তাকে সমঝে চলে। পবনকুমার তার দিকে চেয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “শূলপাণি কৃষ্ণে লীন হলে তোমার সুবিধেটা কী বলল তো!”

“হরি হরি। আমার সুবিধে হবে কেন? জীবাত্মা যদি পরমাত্মায় মিলে গিয়ে থাকে তাহলে তো ভাল কথাই।”

“না, ভাল কথা নয়। এ-গাঁয়ের অনেকের ধারণা আছে যে, সরলাবুড়ির গুপ্তধন ছিল। আর সেই গুপ্তধনের সন্ধান সে শূলপাণিকে দিয়ে গেছে। সেই ধারণার বশবর্তী হয়ে যদি কেউ তার কাছ থেকে গুপ্তধনের সন্ধান আদায় করার জন্য গুম করে থাকে, তা হলে আশ্চর্য হব না। গোপেশ্বর, তোমাকে পরশুদিন দেখেছি বটতলায় বসে জটেশ্বরের সঙ্গে শূলপাণির গুপ্তধন নিয়ে কথা কইছিলে।”

রাজদ্রোহী পবনকুমারকে সবাই একটু ভয় খায়। এক সময়ে দুরন্ত পবনকুমারের দাপটে সবাই থরহরি ছিল।

গোপেশ্বর মিনমিন করে বলল, “সবাই বলে, আমরাও বলি। দোষের তো কিছু নয়। বিষয়-আশয়ে ডুবে থাকে জীব, সেই নিয়েই কথা হয়। তবে শূলপাণির কী হয়েছে তা আমাদের জানা নেই।”

কে যেন বলল, “ভূতপ্রেত নয়, গুপ্তধনও নয়। আমি ভাল করেই জানি, শূলপাণি একজন ছদ্মবেশী বৈজ্ঞানিক। একদিন দুপুরে আমি এ-বাড়ি থেকে নীল আর লাল ধোঁয়া বেরোতে দেখেছি।”

গাঁয়ের উটকো লোক রাখাল বলল, “আমি সবুজ ধোঁয়াও দেখেছি।”

বজ্র সেন বলল, “মনে হয় শূলপাণিকে আমরা ঠিক চিনতে পারিনি। তার কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্যই তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে কেউ।”

নগেন দারোগা বলল, “ওসব আষাঢ়ে গল্প।”

সুধীর ঘোষ বলল, “আচ্ছা দারোগাবাবু, শূলপাণির কি ঘড়ি ছিল?”

“জানি না।” কয়েকজন একসঙ্গে বলে উঠল, “ছিল না। ছিল না!”

সুধীর বলল, “ঘড়িই যদি ছিল না তা হলে শূলপাণি কি করে রাত আটটা বাজলে টের পেত আর হেসে উঠত বলুন তো!”

নগেন দারোগা ঘেঁচিয়ে উঠে বলল, “তার আমি কী জানি?”

সুধীর ঘোষ বলল, “তাতেই তো প্রমাণ হল শূলপাণি একজন বৈজ্ঞানিকই ছিল।”

নগেন দারোগা চোখ কটমট করে বলল, “কী করে প্রমাণ হল?” সুধীর ঘোষ সকলের দিকে চেয়ে বলল, “হল কি না ভাইসব?”

সবাই বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, “হলই তো।”

নগেন দারোগা মাথা নেড়ে বলল, “ডিসগাস্টিং।”

.

০৩.

যত রাত বাড়ছে দুর্যোগও ততই বাড়ছে। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি শুরু হওয়ায় শূলপাণির বাড়িতে জড়ো হওয়া লোকজন টকাটক সরে পড়তে লাগল। শেষ অবধি দারোগাবাবু, গদাই আর পবনকুমার ছাড়া কেউ রইল না।

গদাই শূলপাণির লণ্ঠনটা জ্বেলে মাঝখানে রাখল। তারপর তিনজন বসল পরামর্শ করতে।

নগেন বলল, পবনবাবু, আপনার অভিজ্ঞতা অনেক। শূলপাণির কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

পবনকুমার মাথা নেড়ে বলল, অনুমান করতে বলছেন? তাতে লাভ কী? শূলপাণিকে চিনি বটে, কিন্তু তার সম্পর্কে জানি কতটুকু? একটা লোকের স্বভাব-চরিত্র বা অতীতের জীবন খানিকটা জানলে অনুমান করা শক্ত হত না। কিন্তু শূলপাণি গাঁয়ের লোকই নয়। সরলা পিসি তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। সে গাঁয়ের কারো সঙ্গে বিশেষ মিশত না, আপন খেয়ালে নানা পাগলামি করে বেড়াত। এরকম লোক সম্পর্কে কিছু কি বলা যায়? ফলে সকালে পুলিশে খবর দিলে তারাই যা করার করবে।

নগেন দারোগা বলল, পুলিশে কাজ করেছি বলেই বলতে পারি, এই প্রত্যন্ত গাঁয়ে একটা পাগল নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে পুলিশ তেমন গুরুত্ব দেবে না। নিয়মমাফিক একটু খোঁজাখুঁজি করে ছেড়ে দেবে।

পবনকুমার বলল, তা জানি। তবু পুলিশকে জানিয়ে রাখা ভাল। আমরা তো আর হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকব না। কাল সকালে জেলেপাড়ায় খবর দিলে তারা গাঁয়ের পুকুরগুলোতে জাল ফেলে দেখবে শূলপাণির লাশ পাওয়া যায় কি না।

যদি পাওয়া না যায়?

তাহলে ধরে নিতে হবে হয় সে আপন খেয়ালে কোথাও চলে গেছে, কিংবা কেউ তাকে গুম করেছে। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা খুবই ক্ষীণ। শূলপাণিকে গুম করে কারও কোনও লাভ হবে বলে তো মনে হয় না।

নগেন দারোগা বলল, গুপ্তধনের কথা কী যেন আপনিই বলছিলেন!

পবনকুমার হেসে বলে, ওটা কথার কথা। গোপেশ্বরকে একটু ভড়কে দেওয়ার জন্য বলা। আসলে সরলা পিসিকে আমি আমার ছেলেবেলা থেকে জানি। তাঁর গুপ্তধন থাকার কথাই নয়। সামান্য টাকা-পয়সা যা ছিল তা শূলপাণিকে দিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু সেই টাকার পরিমাণ সামান্যই হবে। আপনারা এত আগেই রগরগে ঘটনা কল্পনা করছেন কেন? শূলপাণি ফিরেও আসতে পারে।

গদাই নস্কর এতক্ষণ চুপচাপ বসে কথা শুনছিল। এবার বলল, কথাটা যুক্তিযুক্তই মনে হচ্ছে। কিন্তু পবনবাবু, শূলপাণি গাঁ ছেড়ে যাওয়ার লোক নয়। এই হরিহরপুর তার খুব পছন্দের জায়গা। তাছাড়া সে তার পোষা জীব জন্তুদেরও খুব ভালবাসত। এদের এরকমভাবে ফেলে সে কোথাও চলে যাওয়ার পাত্র নয়। শূলপাণি পাগল, আমিও মানছি। কিন্তু সে উন্মাদ পাগল নয়। ছিটিয়াল বলতে পারেন।

পবনকুমার একটু গম্ভীর হয়ে বলে, সেটাও ভাবছি। তবু কাল অবধি দেখা যাক। তার আগে ঘরটা সার্চ করলে কেমন হয়? নগেনবাবু তো একাজে পাকা।

নগেন চারদিকটায় একটু চোখ বুলিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল, দেখার তেমন কিছু আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। পাগলা শূলপাণি রাজ্যের অকাজের জিনিস জড়ো করে রেখেছে দেখছি। তবু আপনি যখন বলছেন তখন দেখছি।

গদাই বলল, চলো, আমিও হাত লাগাই।

অবশেষে তিনজনই কাজে নেমে পড়ল। গদাইয়ের চৌকির নিচে একটা টিনের তোরঙ্গ পাওয়া গেল। তাতে পায়জামা, পুরনো কোট, কিছু কাপড়চোপড় ছাড়া একটা ম্যাজিক ওয়ার্ল্ড পাওয়া গেল। সরলাবুড়ির একটা আলমারি আর বাক্স খুলে রাজ্যের ন্যাকড়া, থান, জপের মালা, কাঁথা, পুরনো তেঁতুল, অজস্র কৌটোর মধ্যে ছাতা-পড়া মশলাপাতি ইত্যাদি বেরোলো। বাড়িতে আরও দুখানা ঘর আছে বটে, কিন্তু সেগুলো ব্যবহারযোগ্য নয়। ছাদ ফেটে গেছে, দেয়ালে ফাটল, রাজ্যের ধুলোময়লা জমে আছে।

গদাই ওপরের তাক থেকে একটা ছোটো কাঠের বাক্স টেনে নামাল। বাক্সটা পুরনো হলেও বেশ মজবুত। গায়ে কারুকাজ রয়েছে। বাক্সটা তালা দেওয়া।

গদাই তালাটা নেড়েচেড়ে বলল, এ তো বিলিতি তালা দেখছি। শূলপাণি এ তালা পেল কোথায়?

পবনকুমার ভ্রূ কুঁচকে বলল, এটা সরলা পিসির জিনিস নয়। আমি ছেলেবেলা থেকেই এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করি। সরলা পিসি নারকোলের নাড়, তিলুড়ি, পিঠে করে কত খাইয়েছে। তিনকুলে কেউ ছিল না তো, তাই আমাদের খুব ভালবাসত। তার জিনিসপত্র সব আমাদের চেনা। বাক্সটা খুলুন গদাইবাবু।

শূলপাণির জিনিস, খোলা কি ঠিক হবে?

নগেন বলল, ও হে, আমি তো প্রাক্তন দারোগা। আমার সামনেই তো খুলছে। বিপদে নিয়মো নাস্তি।

তাহলে দেখা যাক চাবি পাওয়া যায় কি না। চাবি পাওয়া গেল। শূলপাণির লণ্ডভণ্ড বিছানা হাতড়ে চাবিটা বের করে এনে ভারী বাক্সর ডালাটা খুলে ফেলল গদাই। তারপর অবাক হয়ে বলল, কিছুই তো নেই দেখছি। কয়েকটি কড়ি আর গোটা কয়েক তামার পয়সা।

তিনজনই ঝুঁকে দেখল, তাই বটে। মোট সাতটা কড়ি আর সাতটাই তামার পয়সা পড়ে আছে বাক্সের মধ্যে। আর কিছুই নেই।

নগেন বলল, এই তুচ্ছ জিনিসের জন্য বিলিতি তালা?

পবনকুমার বলল, তাই তো দেখছি।

কড়ি আর পয়সাগুলো নেড়েচেড়ে দেখে গদাই বলল, এ ব্রিটিশ আমলের পুরনো পয়সা। অচল জিনিস। আর কড়িগুলোরও তেমন বৈশিষ্ট্য কিছু নেই।

পবনকুমার বলল, নাঃ, কোনও রহস্যেরই আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। দারোগাবাবু, তাহলে চলুন ঘরে ফেরা যাক। আজ রাতটা ভেবেচিন্তে কাল যা হয় করা যাবে।

হ্যাঁ, তাই ভাল। চলুন।

গদাই বলল, কিন্তু এই অবোলা জীব-জন্তুগুলোর কী ব্যবস্থা হবে? এদের দেখভাল করবে কে?

নগেন বলল, আমার অনেকদিন ধরে একটা বাঁদর পোষার শখ। বাঁদরটা আমি নিয়ে যেতে পাড়ি।

গদাই বলল, কুকুরটা আমি নেবো।

পবনকুমার বলল, তাহলে বেড়ালটা আমার কপালে? বেড়াল আমি একদম পছন্দ করি না। তবু অসহায় জীব বলে নিতে রাজি আছি।

কার্যকালে দেখা গেল, প্রস্তাব যত সহজ কাজটা তো সহজ নয়। দারোগাবাবু যতই চেষ্টা করলেন বাঁদরটা ততই লাফঝাঁপ করে নাগাল এড়িয়ে গেল। গদাই শিকল খুলতে যেতেই কুকুরটা এমন তেড়ে এল যে গদাই আর এগোলো না। আর বেড়ালটা স্রেফ একটা লাফ মেরে ভেতরের ঘরে পালিয়ে গেল।

লণ্ঠন নিবিয়ে টর্চ জেলে গদাই বলল, কাল সকালে যা করার করা যাবে। কিন্তু সদর দরজাটা কি খোলা থাকবে?

পবনকুমার বলল, দামী জিনিস যখন কিছু নেই তখন থাক খোলা।

তিনজনেই বেরিয়ে বৃষ্টি-বাদলার মধ্যেই এগোতে লাগল। হঠাৎ পবনকুমার দাঁড়িয়ে বলল, নগেনবাবু, গদাইবাবু, আমার মনে হচ্ছে কাঠের বাক্সটা ফেলে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না।

কেন বলুন তো?

কারণ বলতে পারব না, মনটা টিকটিক করছে। আমার মনে হয় ওটা নিয়ে আসা ভাল। শূলপাণি যদি ফিরে আসে তখন ফেরত দেওয়া যাবে।

নগেন বলল, ইচ্ছে হলে নিয়ে আসুন। বাধা কিসের? আমরা দাঁড়াচ্ছি, আপনি যান।

পবনকুমার দ্রুত ঘরে ফিরে এসে টর্চ জ্বাললেন। যা দেখলেন তাতে তার বাক্য হারিয়ে গেল। বাক্সটা তাকের ওপর নেই।

গদাই জিজ্ঞেস করল, কী হল পবনবাবু?

শিগগির আসুন।

দুজনেই দৌড়ে এল।

পবনকুমার টর্চের আলো ফেলে বলল, দেখুন, কাণ্ড। তিনজনেই কিছুক্ষণ হাঁ হয়ে চেয়ে রইল। তারপর গদাই তার পেটকোঁচর থেকে রিভলভার বের করে হাতে নিয়ে ভেতর বাড়িতে ছুটে গেল। পিছু পিছু পবন আর নগেন। কোথাও কাউকে দেখা গেল না। সব শুনসান। পবন বলল, আশ্চর্য কাণ্ড! ভুতুড়ে ব্যাপার নাকি? নগেন মাথা নেড়ে বলল, না, ভূতের কাজ নয়। এ পাকা লোকের কাজ।

.

০৩.

শেষরাতে বৃষ্টি থেমে দুযোগ কেটে গেল। সকালবেলায় কুয়াশায় মাখা একটু রোদও উঠল। এই সাতসকালে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে মদন হালদার আর সুজন বোস। দুজনেরই বয়স সত্তরের ওপরে।

মদন বলল, এবার গাঁয়ে একটা অনাসৃষ্টি না হয়েই যায় না। সুজন সায়েন্স জানা লোক। বিলেতে আমেরিকায় বিজ্ঞানী হিসেবে অনেকদিন চাকরি করে এসেছে। শেষ জীবনে একটু শান্তিতে নিরিবিলি জীবন কাটাতে হরিপুরের পৈতৃক ভিটেয় ফিরে আসা। তবে একা থাকতে হয়, ছেলেমেয়েরা সব বিদেশে পাকাঁপাকিভাবে থেকে গেছে। স্ত্রীও এই অজ পাড়াগাঁয়ে আসতে রাজি নয়। একগুঁয়ে সুজন একাই আছে। মদনের কথাটা শুনে ভ্রূ কুঁচকে বলল, কেন বলো তো!

শূলপাণির কথাই বলছি। কাল রাত আটটায় তার হাসি শোনা গেল না। গাঁ শুদ্ধ লোক গিয়ে জড়ো হল তার বাড়িতে। কিন্তু সব ভোঁ ভাঁ, শূলপাণি হাপিস।

হ্যাঁ, ঘটনার কথা শুনেছি। কিন্তু তার সঙ্গে হরিপুরের অনাসৃষ্টির সম্পর্কটা কী?

কি জানি ভাই, মনে হয় এসব অলক্ষুণে কাণ্ড। হরিপুর শান্ত জায়গা, এখানে এরকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটে না।

সুজন একটু হেসে বলল, তোমাদের সাবালক হতে আরও কতদিন লাগবে সে কথাই ভাবছি। শূলপাণি হাসেনি বলে সবাই নানা রকম আশঙ্কা করছে কেন তাও বুঝতে পারছি না। ও তো একটা পাগল। পাগলের কাণ্ডর কি কোনও লজিক্যাল ব্যাখ্যা হয়? সোজা কথা হল, শূলপাণি কোথাও চলে গেছে।

তা হতে পারে। কিন্তু তুমি কি শূলপাণিকে ভাল করে চিনতে?

খুব চিনতাম। আমি সায়েন্টিস্ট বলে সে প্রায়ই আমার কাছে আসত আর নানা উদ্ভট জিনিস জানতে চাইত।

কিরকম?

পাখির মতো আকাশে ওড়া যায় কি না, কোনও.জিনিস শূন্যে কী করে ভাসিয়ে রাখা যায়, একজন মানুষের মুণ্ডু আর একজনের ধড়ের সঙ্গে জুড়ে দিলে কি হয় এইসব আবোল তাবোল। আমি বেশি পাত্তা দিইনি।

কিন্তু রাত আটটার সময় শূলপাণি অট্টহাসি হাসত কেন তা ভেবে দেখেছো?

কন্ডিশন রিফ্লেক্স কাকে বলে জানো তো?

হ্যাঁ, পাবলভের থিয়োরি।

আমার মনে হয় এটাও ওরকম কিছু। এ ছাড়া অন্য কোনও কারণ নেই।

তুমি বৈজ্ঞানিক মানুষ, বিশ্বাস করবে না জানি। কিন্তু শূলপাণির কিছু অদ্ভুত ক্ষমতাও ছিল।

কিরকম ক্ষমতা?

সে খালি হাত মুঠো করে অনেক জিনিস মুঠো থেকে বের করতে পারত।

সুজন হেসে বলল, ও তো রাস্তার বাজিকররাও দেখাতে পারে। এমন কি আমিও পারি। হাতসাফাই ছাড়া কিছু নয়।

একদিন সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি কিসের গন্ধ ভালবাসি। আমি বললাম, কস্তুরী। কী করল জানো? আমার ডান কৰ্জিতে স্রেফ ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা ঘষে দিল। অমনি ভুরভুর করে কস্তুরীর গন্ধ বেরোতে লাগল।

ভায়া হে, ওটাও কোনও মিরাকল নয়। একটু প্র্যাকটিস করলেই পারা। যায়। শূলপাণি সম্পর্কে তোমরাই একটা রহস্যের ঘেরাটোপ গড়ে তুলেছে। গাঁয়ে-গঞ্জে এরকম হামেশাই হয়।

তুমি কি বলতে চাও লোকটা বুজরুক?

তাও নয়। বুজরুকের অন্যকে ঠকানোর মতলব থাকে। শূলপাণির সে মতলব ছিল না। তবে সে যে পাগল তাতে সন্দেহ নেই। একবার আমার কাছে কতগুলো জিনিস দেখাতে এনেছিল।

কি জিনিস?

হরিপুরের হরেক কাঙ কয়েকটা কড়ি আর তামার পয়সা।

বলো কী? কাল তার ঘরে একটা কাঠের বাক্সে নাকি পাওয়া গিয়েছিল জিনিসগুলো। কিন্তু সেগুলো কে বা কারা সরিয়ে ফেলেছে।

সুজন এবার একটু চিন্তিত হয়ে বলল, সরিয়ে ফেলেছে? হ্যাঁ হে, দারোগাবাবুর নাকের ডগায় ঘটনা। তা তোমার জিনিসগুলো দেখে কী মনে হয়েছিল?

মাথা নেড়ে সুজন বলে, কিছুই নয়। সাধারণ তামার পয়সা, সাধারণ কডি। কোনও গুপ্তধন নয়।

আর কিছু হতে পারে কি?

কোনও সংকেত? তা আমি জানি না। মোট সাতটা কড়ি, আর সাতটা পয়সা ছিল। সংকেত হলেও তা ভেদ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে পয়সাগুলো বহু পুরনো। কোনও কালেকটারকে বেচলে কিছু টাকা পাওয়া গেলেও যেতে পারে। তার বেশি কিছু নয়।

তোমার বাড়িতে তো একটা ল্যাবরেটারি আছে।

তা আছে। তবে গাঁ-গঞ্জে তো আর আধুনিক ল্যাব করা সম্ভব নয়। এ গাঁয়ে এখনও ইলেকট্রিকই আসেনি। সুতরাং ল্যাব বলতে যা বোঝায় তা নয়। ছোটোখাটো জিনিস বা এক্সপেরিমেন্ট হতে পারে। কিন্তু কেন বলো তো?

ঐ কড়ি আর পয়সা ল্যাবরেটারিতে একটু পরীক্ষা করে দেখলে পারতে।

সুজন হাঃ হাঃ করে হেসে বলল, আমি ওরকম কাজ করতে যাবো কেন বলো তো? কড়ি আর পয়সার মধ্যে কী এমন থাকতে পারে?

-ই যদি থাকবে তাহলে তা চুরি যাবে কেন? চিন্তিত সুজন বলে, সেটা একটা ভাবার মতো কথা। ওই সামান্য জিনিস নিয়ে কারও কোনও লাভ নেই। অন্তত কমন সেন্স সেই কথাই বলে। তবে সংকেত হলে আমার কিছু বলার নেই।

সাতটা পয়সা এবং সাতটা কড়ি-ব্যাপারটা বেশ রহস্যময় মনে হয় না?

রহস্য মনে করতে চাইলে করতে পারো। বাধাটা দিচ্ছে কে?

.

০৫.

মহেন্দ্রচন্দ্রকে ইদানীং ভারি আলিস্যিতে পেয়েছে। আগে সারা তল্লাট ঘুরে বেড়াতেন, কখনও মোটরবাইকে, কখনও ঘোড়ায় চেপে, কখনও পায়ে হেঁটে, সাঁতার কাটতে ভালবাসতেন, ফুটবল বা টেনিস খেলাতেও খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু জমিদারি যাওয়ার পর থেকেই একটু একটু করে গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। এখন বাড়ি ছেড়ে যাননি, বেরোতে চান না, এমন কি বিছানা ছেড়ে নামতেও চান না বিশেষ।

এই শীতের সকালে আগে প্রাতঃভ্রমণে বেরোতেন। এখন লেপের তলায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে ওঠেন সেই বেলা আটটায়, তাও এমনিতে নয়, পিসিমার তাড়নায়।

পিসিমা ব্রজবাসিনী দেবীর চেহারা রোগামতো, ছোটোখাটো, কিন্তু দাপট সাঙ্ঘাতিক। তাঁর দাপটে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। তাঁর স্বামী মস্ত শিকারী এবং কুস্তিগীর পরঞ্জয় দত্ত এ বাড়িতে জড়োসড়ো হয়ে বাস করেন। দুই ছেলে বিজয় এবং দুর্জয় মায়ের ভয়ে একেবারে কেঁচো। মহেন্দ্রচন্দ্রের অবস্থাও বিশেষ ভাল নয়। এখন তাঁর বয়স পঞ্চাশের ওপর তবু পিসিমার নির্দেশ মেনেই তাঁকে চলতে হয়, মহেন্দ্রচন্দ্রের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদেরও একই অবস্থা।

ব্রজবাসিনীর দেবীর সবচেয়ে বড় দোষ তিনি মনে করেন সব মানুষেরই প্রচুর পরিমাণে খাওয়া উচিত। কেউ খেতে না চাইলে বা কম খেলেই তাঁর মাথা গরম হয়ে যায়। আর তখনই বকাবকি চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। সুতরাং এ বাড়ির প্রত্যেকটি প্রাণীকৈ ব্ৰজবাসিনীকে সন্তুষ্ট রাখতে প্রাণপণে খেয়ে যেতে হয়। পরঞ্জয় দত্ত কুস্তিগীর মানুষ, খেতেও ভালবাসেন কিন্তু পঁয়ষট্টি বছর বয়সের পরেও যে সকালে তাঁকে উনিশটি করে পরোটা এবং তৎসহ চারখানা ডিম ও ছটা কলা খেতে হচ্ছে, এটাকে তিনি বাড়াবাড়ি মনে করেন। দুর্জয় আর বিজয়কে খেতে হয় বারোটা করে পরোটা আর তিনটে করে ডিম আর চারটে করে কলা। মহেন্দ্র চন্দ্রকে খেতে হয় পনেরোখানা পরোটা চারটে ডিম আর পাঁচটা কলা। সকালে এই বিপুল জলখাবারের পর দুপুরে আবার বিপুলতর আয়োজন। খেয়ে খেয়েই বোধহয় দুর্জয় আর বিজয়ের মাথামোটা হয়ে লেখাপড়া হল না। শরীর হল ঢোলের মতো। মহেন্দ্রচন্দ্রকে ঘোর আলসেমিতে ধরে ফেলল। পরঞ্জয় অবশ্য কুস্তিটুস্তি করে। মগুর ভেজে কোনওরকমে নিজেকে এখনও ফিট রেখেছেন কিন্তু এ জিনিস চললে যে রক্তচাপ এবং অন্যান্য অসুখ দেখা দেবে তাতে সন্দেহ নেই।

মহেন্দ্রচন্দ্র সকাল সাড়ে ছটায় ঘুম ভেঙে লেপের তলায় একটু এপাশ ওপাশ করছেন। কাল রাত্রেও তিনি নানারকম দুঃস্বপ্ন দেখেছেন, মনটা ভাল নেই, পেটে বায়ু আর শরীরের চর্বি বেশ বেড়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। নড়চড়া করতে আজকাল ইচ্ছে যায় না।

হঠাৎ তাঁর কানে এল পিসিমা ব্রজবাসিনী একতলায় প্রচণ্ড চেঁচামেচি করছেন। ব্রজবাসিনী হামেশাই চেঁচামেচি করে থাকেন, সেটা এমন কিছু অভিনব ব্যাপার নয়। কিন্তু আজকের চেঁচামেচির মধ্যে নতুন একটা খবর রয়েছে। ব্রজবাসিনী যেন চেঁচিয়ে কার নিরুদ্দেশ হওয়ার কথা জানান দিচ্ছেন।

গাঁয়ে সদ্য একজন নিরুদ্দেশ হয়েছে এবং তার রেশ এখনও কাটেনি। এর মধ্যে আবার কে নিরুদ্দেশ হল তা বুঝতে না পেরে মহেন্দ্র আলস্য ত্যাগ করে লেপ ছেড়ে উঠলেন, গায়ে গরম চাঁদর জড়িয়ে ভেতর দিককার বারান্দায় এসে নিচের উঠোনে চেয়ে দেখলেন ব্রজবাসিনীকে ঘিরে দাসদাসী এবং আত্মীয়-স্বজনদের একটা ভিড়। ব্রজবাসিনী চিৎকার করে বলছেন, এ নিশ্চয়ই সেই ডাইনির কাণ্ড, জলজ্যান্ত লোকটা হঠাৎ উবে যায় কখনও?

মহেন্দ্ৰ ওপর থেকে ঝুঁকে বললেন, “কে উবে গেল পিসিমা? ব্রজবাসিনী ওপরের দিকে চেয়ে ডুকরে উঠে বললেন, “ওরে তোর পিসেমশাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

কবে থেকে?

আজই সকাল থেকে।

মহেন্দ্র বিরক্ত হয়ে বললেন, “এখনও তো ভাল করে সকালটা হল না, নিরুদ্দেশ যে হল তা বুঝলে কী করে?

বুঝতে কিছু বাকি নেই রে।

পিসেমশাই তো সকালে উঠে রোজই জগিং করতে যান। হয়তো তাই গেছেন।

তাই যদি যাবে তো দু দুটো বন্দুকের বাক্স, অ্যাত বড় স্যুটকেস, তিন জোড়া বুটজুতো, তোষক বিছানা মশারি, দাড়ি কামানোর জিনিস এসব গেল কোথায়?

মহেন্দ্র খুব নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, “অ! তাই বলো! পিসেমশাই তো তাহলে কোনও ট্যুরে গেছেন।

ট্যুরে গেলেই হল? আমাকে না বলে যাবে–তার ঘাড়ে কটা মাথা?

হয়তো তোমাকে বললে যেতে দেবে না, তাই না বলেই গেছেন।

যেতে দেবো না সে তো সত্যি। কিন্তু তা বলে আমাকে না জানিয়ে যাবে এমন মানুষ সে নয়।

কখন গেল কিছু জানো?

না রে। রাতে তো খেয়েদেয়ে এসে দিব্যি লেপমুড়ি দিয়ে শুলো, নাকও ডাকতে লাগল। সকালে উঠে দেখি, জলজ্যান্ত মানুষটা কর্পূরের মতো উবে গেছে।

ও পিসি, সাধু হয়ে যায়নি তো? সংসারের জ্বালায় কত মানুষ সাধু হয়ে যায়।

সাধু কি সঙ্গে বন্দুক নিয়ে যায় রে হাঁদারাম? নাকি তাদের স্যুটকেস বা বুটজুতোরই দরকার হয়? তাদের তো কৌপীন, কমণ্ডলু আর কম্বল হলেই হল।

সকালে কি ঘরের দরজা খোলা অবস্থায় দেখেছিলে?

খোলা ছিল বলেই তো ভাবছি।

তবে আর ভাববার কিছু নেই। পিসেমশাই গভীর রাতে সাধু হয়ে চলে গেছেন। কিন্তু সদর দরজাটা খুলে রেখে গিয়েছিলেন বলে পরে কোনও চোর এসে বন্দুক, বাক্স, বিছানা সব চুরি করে নিয়ে গেছে।

ওরে না না, এ সেইসব কাণ্ড নয়। এ হল অশৈলী ব্যাপার। শূলপাণিকে যে নিয়েছে তোর পিসেমশাইকে সে-ই নিয়েছে। তাকে চিরকাল দেখে এসেছি, কোনও কালে আমাকে না বলে এক পাও কোথাও যায় না। তেমন মানুষই নয়। বাক্স, বিছানা, বন্দুক এত সব জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়া কি একজন মানুষের কাজ, বল তো!

সেই কথাই তো বলছি, পিসেমশাই ঝাড়া হাতপায়েই গেছেন, বাকি জিনিসগুলো চোরে নিয়েছে। দাঁড়াও থানায় একটা খবর পাঠাচ্ছি।

থানায় খবর গেল, পুলিশও এল। তার আগে এল গা-শুন্ধু লোক।

নগেন দারোগা বলল, পরঞ্জয়বাবু রাশভারি সিরিয়াস মানুষ, এমন হঠকারিতা করবেন না, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে কোনও কাজ করে বসার মানুষ নন। সুতরাং তার নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে অন্য পক্ষের হাত থাকা বিচিত্র নয়।

গদাই চাপা গলায় বলল, পরঞ্জয়বাবু অবশ্যই নিরুদ্দেশ হতে পারেন।

কেন বলো তো?

ইদানীং তাঁর ব্লাড কোলেস্টোরাল ভীষণ বেড়ে যাচ্ছিল।

ব্লাড কোলেস্টোরাল বাড়লে কেউ নিরুদ্দেশ হয় নাকি?

কিছু বলা যায় না।

নয়ন হাতি কপাল চাপড়ে খুব হাহাকার করতে লাগল। অত বড় একজন পালোয়ানকে যদি তুলে নিয়ে যেতে পেরে থাকে তাহলে আমাদের আর নিরাপত্তা কিসের? আমি ওকে ওস্তাদ বলে মানতাম, আমাকে একটা তিব্বতী প্যাঁচ শেখাবেন বলে কথা ছিল।

জটেশ্বর বলল, আমি আর গোপেশ্বর কিছু বললেই পবনবাবু রেগে ওঠেন। তবু সত্যি কথা না বলেও পারছি না, ইদানীং পরঞ্জয়বাবু প্রায়ই শূলপাণির বাড়িতে যাতায়াত করতেন। এমন কি গত শনিবার সন্ধের মুখে শ্মশানকালীর মন্দিরের চাতালে বসে দুজনকে গভীর পরামর্শ করতেও দেখেছি।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 1 of 6 ): 1 23 ... 6পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress