Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্বর্গ এখনও আছে || Sanjib Chattopadhyay

স্বর্গ এখনও আছে || Sanjib Chattopadhyay

স্বর্গ এখনও আছে

খাঁকি পোশাক পরা বেশ শক্তসমর্থ একজন মানুষ একটা ঘরের দরজা খুলে দিয়ে বললেন, এই আপনার ঘর। চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। নিশ্বাসে বিড়ির গন্ধ। গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। ঘরে ঢুকলুম। মোটামুটি সবই ঠিক আছে। বালবটা হোল্ডার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। ঝুলছে। সুইচ দিলুম। জ্বলল না।

কানে এল, এখন জ্বলবে না। পাওয়ার এলে জ্বলবে।

কখন আসবে?

যখন-তখন। ও নিয়ে ভাববেন না। দুপুরে কী খাবেন? বাজারে যেতে হবে। এখান থেকে তিন মাইল।

তুমিই বলো। কে রাঁধবে?

আমার বউ।

তাহলে তাঁকেই জিগ্যেস করো। যা খাওয়াবেন। এই নাও টাকা।

পুরোনো একটা সাইকেলে চড়ে লোকটি চলে গেল। জায়গাটা এমনি বেশ সুন্দর। চারপাশে প্রাচীন প্রাচীন গাছ। পাতায় পাতায় অতীত ঝুলছে। বিশাল মৌচাকে মৌমাছিদের নিতান্ত। ব্যস্ততা। একটানা একটা ঝরঝর শব্দ। অদূরেই ড্যাম। জল ছাড়ার শব্দ। নদীর দিকটা তেমন সুগম নয়।

লোকটি আমাকে একা ফেলে রেখে নির্দয়ের মতো চলে গেল। এখন আমি কী করি! খবরের। কাগজ নেই। চা নেই। বহু লোকের কোলাহল নেই। এলোমেলো, বিশৃঙ্খল শব্দ নেই। কী ভীষণ অসহায় আমি!

উইপোকা যেমন বইয়ে থাকে, আমিও সেইরকম শহরে থাকি। ধুলো, ধোঁয়া, কোলাহল।

বাংলোর গেটের দিকে এগোচ্ছি। একটি মেয়ে সাইকেলে চড়ে ঢুকছে। উজ্জ্বল একটি মেয়ে। সাইকেল থেকে নামতে নামতে বলল, চা এনেছি।

কে পাঠালেন? তুমি কে?

সুবেশা তরুণী হেসে বললে, আমি অরুণা। আমার মা পাঠিয়েছে।

বেঁচে থাকার কাহিনি শুনলুম একটু একটু করে। নাটকের চেয়ে নাটকীয়। এক শিক্ষিত ভদ্রলোক বিয়ে করেছিল শিক্ষিতা একটা মেয়েকে। সেই ভদ্রলোক মদ ধরল। অন্য মেয়ে এল নেশার তরল পথ ধরে। তারপর ব্যাঙ্কের তহবিল তছরুপ। তারপর কারাবাস। তারপর আত্মহত্যা! তারপর, কেউ-না-কেউ কোথাও-না-কোথাও একজন আর একজনের জন্যে অপেক্ষা করে থাকে। দেখা হয়, অথবা হয় না। এক্ষেত্রে দেখা হল।

বনবিভাগের বিহারীর সঙ্গে বিমলার দেখা হল। সর্ব অর্থে ক্ষত-বিক্ষত বিমলা। চাল নেই চুলো নেই। আত্মীয়স্বজন থেকেও নেই। সার্ভে করলে দেখা যাবে একালে কেন, সেকালেও আত্মীয় স্বজনদের ভূমিকা প্রশংসনীয় ছিল না। সেই কারণেই প্রবাদ, আপন চেয়ে পর ভালো, দেশ হতে বিদেশ ভালো। বিহারী বিমলার প্রথম পক্ষের সন্তান অরুণাকে বুকে করে মানুষ করেছে। অরুণা ভালো মেয়ে। কলেজে পড়ছে। আবার মায়ের পাশে থেকে ছোটখাটো একটা খাবার দোকান চালাচ্ছে। দোতলা একটি বাড়ি।

দোতলায় বসবাস। নীচের তলায় পরিচ্ছন্ন খাবার দোকান। এই দোকানের আয় থেকে অরুণার লেখাপড়ার খরচ চলে। কিছু কিছু মেয়ে থাকে যাদের মুখের হাসি কখনও মেলায় না। এক-একটা মুখ থাকে, যে-মুখে সদাসর্বদাই ভোরের আলো। বিমলা সেইরকম মেয়ে। মা আর মেয়ের যেন। একই বয়স। কলেজে পড়া দুই বান্ধবী। বিহারী ফরেস্ট বাংলোর চৌকিদার শুধু নয়, এদেরও চৌকিদার। তার নিজের কোনও চাহিদা নেই। তোমরা ভালো থাকো। তোমাদের ভালো থাকাটা আমি দেখি—প্রাণ ভরে দেখি। তোমাদের সেবা করি। তার চোখে বিমলা আর অরুণা দুই দেবী। বিহারী যেন মন্দিরের পূজারি। মঙ্গল আরতি দিয়ে শুরু। শয়ন দিয়ে দিনের সমাপ্তি।

আমি কাজে এসে অকাজে একটা মাস কাটালুম। আর যা শিখলুম, তা কেউ কোথাও আমাকে শেখাবে না কোনওদিন। এদের বাড়ির পিছন দিকে এক ঢল জমি। ক্রমশ নীচু হতে হতে নদী পেয়ে গিয়েছে। হাসি-খুশি, ঘরোয়া একটি নদী। বিমলা, অরুণার মতোই সংযত। নদীটার নাম রেখে এসেছি অরুণা-বিমলা। ওই জমিটুকুতে বিহারীর চাষবাস। ভোরবেলা ঠাসা একটা বাঁধাকপি বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধের দু-পাশে পূজারির উত্তরীয়ের মতো ঝুলছে

কড়াইশুটি শাক। গম্ভীর মুখের আড়ালে তপতপে একটা হাসি। আগুনের আভার মতো, ফুলের গন্ধের মতো, আকাশের নীলের মতো। খড়খড়ে একটা পাথরে বসে আমি দেবতা দেখছি নন্দলালার মতোই বিহারীলাল। শুধু আমি দেখছি না, বিহারীর গোল্ডেন রিট্রিভার কুকুরটিও মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে। তিনটে ল্যাজঝোলা পাখি ডাল থেকে প্রায় ঝুলে পড়ে এই অদ্ভুত মানুষটিকে। দেখছে। বিহারীর মাথায় বসে আছে চতুর্থ পাখিটা। বিহারীর ঝাঁকড়া চুলের বাসায় কোনওদিন তিনটে ডিম পেড়ে না বসে! দূরে, আকাশের গায়ে নীল একটা পাহাড় আশীর্বাদের মতো আটকে আছে।

এরই মাঝে একদিন দেখি, এই পাথরটার ওপর অরুণা বসে আছে, আর তার পায়ের কাছে। জমিতে বসে আছে বিহারী। অরুণার একটা পা বিহারীর কোলে। বিহারী পামিস স্টোন দিয়ে ঘষে ঘষে, অতি যত্নে অরুণার পায়ের গোড়ালি পালিশ করছে, যেন কোনও দেবীর পূজা হচ্ছে। অরুণার পিঠ ছাপিয়ে চুলের ঢল নেমেছে কালো ঝরনার মতো। একজোড়া ফড়িং পাশ দিয়ে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে। একটা অদ্ভুত রকমের বাহারি প্রজাপতি আনন্দে লাট খাচ্ছে। চারপাশে লেডিজ লেস, ফুলের বাহার। বসন্তের প্রথম কোকিল সজনে গাছের ডালে বসে আকুল স্বরে দূর বনভূমিকে জানতে চাইছে—ওরে ভাই! বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।

একদিন দেখি, বিহারী মোটা দাঁড়ার চিরুনি দিয়ে বিমলার চুলের জট ছাড়িয়ে দিচ্ছে। যেন দুই সখী। বিমলা একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল, এই মানুষটার কাম নেই, এর সবটাই প্রেম। আমাদের এই সংসার—আনন্দের সংসার। দুঃখ আমাদের পোষা কুকুরের মতো। আর কষ্ট হল আমাদের পাপোশ।

এই ভয়ংকর পৃথিবীর খাঁজে খাঁজে কোথাও না কোথাও এইভাবে স্বর্গ আটকে আছে। দেবতার দেখা পাওয়া যায়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *