নিজেকে মানিয়ে নেয়া
মানুষ যে-কোনো অবস্থাতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। ফাঁসির আসামীও শুনেছি এক সময় মৃত্যুভয়ে অভ্যস্ত হয়ে যায়, নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করে, তরকারিতে লবণ কম হলে মেটকে চৌদ্দপুরুষ তুলে গালি দেয়। সেই হিসেবে আমাদের দীর্ঘ ছ মাসে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হওয়া গেল না। তার মূল কারণ সম্ভবত অনিশ্চয়তা; রাস্তায় রিকশা নিয়ে বের হলে দুটি সম্ভাবনা-মিলিটারিরা রিকশা থামাতে পারে, না-ও থামাতে পারে। থামলে ধরে নিয়ে যেতে পারে, না-ও ধরতে পারে। ধরে নিয়ে গেলে আবার ফিরে আসতে পারে, আবার না-ও ফিরে আসতে পারে। এই ধরনের অনিশ্চয়তায় বেঁচে থাকা যায় না।
যদি নিশ্চিতভাবে জানা যেত–এর বেশি আর কিছু হবে না, স্বাধীনতাটাধিনতার কথা চিন্তা করে লাভ নেই, তাহলে হয়তো সময় এত দুঃসহ হত না। কিন্তু একটি আশার ব্যাপার আছে। এক দিন হয়তো আবার আগের মতো রাস্তায় ইচ্ছামতো হাঁটা যাবে। রাত বারোটায় চায়ের দোকানে বসে সিঙ্গেল চায়ের অর্ডার দেওয়া যাবে। স্বাধীনতা একেক জনের কাছে একেক রকম। এই মুহুর্তে আমার কাছে স্বাধীনতা মানে হচ্ছে, রাত এগারটায় রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে গম্ভীর হয়ে পানের পিক ফেলা। মতিনউদ্দিন সাহেবের কাছে স্বাধীনতার মানে খুব সম্ভব রাতের বেলায় জানালা খোলা রেখে (এবং বাতি জ্বলিয়ে রেখে) ঘুমোনর অধিকার।
আজকাল আমি রাস্তায় দীর্ঘসময় হেঁটে বেড়াই। আগে কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করত না। এখন মাঝে-মাঝে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বাসা কোথায়? কোথায় যাচ্ছি? মুসলমান না। হিন্দু (হিন্দু বলতে পারে না, বলে ইন্দু)? এক বার শুধু—শুধু দু ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখল। আমার ধারণা, নিছক ভয় দেখিয়ে মজা করবার জন্যেই। আমার সঙ্গে আরেকটি ছেলে ছিল। সে বাজার করে ফিরছে। বাজারের ব্যাগ থেকে ইলিশ মাছের লেজ বের হয়ে আছে। ছেলেটি কুলকুল করে ঘামতে শুরু করল। নেহ্যাঁয়েত বাচ্চা ছেলে। হয়তো কাজের ছেলেটা আসে নি, মা জোর করে পাঠিয়েছে। আমি বললাম, ভয়ের কিছু নেই। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থােক। এক্ষুণি ছেড়ে দেবে। যে সেপাইটি আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখেছে, সে এক বার এসে জিজ্ঞেস করল, কেয়া, ডর লাগিতা?
ছেলেটি কোনো কথা বলতে পারল না। আমি বললাম, ইলিশ মাছ কত দিয়ে কিনেছ?
বেচারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। প্রচণ্ড ঘামছে সে। আমি বললাম, এক্ষুণি ছাড়বে, তয়ের কিছু নেই।
যদি না ছাড়ে?
কী যে বল! ছাড়বেই। তোমার নাম কী?
লম্বামতো একটি মিলিটারি এগিয়ে এল। এই সময়, এবং আমি কিছু বোঝবার আগেই প্রচণ্ড এক চড় মারাল ছেলেটির গালে। আমি হাত বাড়িয়ে ছেলেটিকে টেনে তুললাম। তার ব্যাগ ছিটকে পড়েছে দূরে। সেখান থেকে আলুগুলি বেরিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মিলিটারিটি আমাদের হাত নেড়ে চলে যেতে বলল। ছেলেটির গা কপিছিল, ঠিকমতো হাঁটতে পারছিল না। সে ফিসফিস করে বলল, আমাকে একটু বাসায় পৌঁছে দেবেন? আমরা একটা রিকশা নিলাম। ছেলেটি রিকশায় উঠে ক্রমাগত চোখ মুছতে লাগল। আমার খুব ইচ্ছা হল বলি–আজ তুমি যে লজ্জা পেয়েছ, সে শুধু তোমার একার লজ্জা নয়।–আমাদের সবার লজ্জা। কিন্তু কিছুই বললাম না। এই সব বড়ো বড়ো কথার আসলে তেমন কোনো অর্থ নেই।
আমি তাকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। ছেলেটির মা এমন ভাব করতে লাগল, যেন আমি তাকে মিলিটারির হাত থেকে ছুটিয়ে এনেছি। আমার জন্যে হালুয়া এবং পরোটা তৈরি হল। হালুয়া খাবার সময় ভদ্রমহিলা একটা তালপাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগল। আমি বললাম, রোজার সময় দেখবেন। এরা বেশি ঝামেলা করবে না। আর কয়েকটা দিন।
আমাদের কাদের মিয়াও খবর আনল, প্রথম রোজার দিন সব আটক লোকদের ছেড়ে দেয়া হবে। ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠকে বসবে। সব ঠিকঠাক। আমেরিকা নাকি শক্ত ধমক দিয়েছে। ইয়াহিয়া খানকে। ইয়াহিয়া মিটমাটের জন্যে একটা পথ খুঁজছে।
বুঝলেন ছোড ভাই, সাপ গিলার অবস্থা হইছে। না পারে গিলতে না পারে রাখতে। কাদের পহেলা রমজানের জন্যে খুব উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। তার উৎসাহের প্রধান কারণ, দরবেশ বাচ্চু ভাই ছাড়া পাবে।
দরবেশ বাচ্চু ভাই ছাড়া পেলেন না। রমজানের সময় অবস্থা অনেক বেশি খারাপ হল। আলবদর বাহিনী তৈরি হল। প্রথম বারের মতো অনুভব করলাম, কিছু কিছু যুদ্ধ সত্যি সত্যি হচ্ছে। নয়তো এতটা খারাপ অবস্থা হওয়ার কোনো কারণ নেই। ইজাবুদ্দিন সাহেবও অনেকখানি মিইয়ে গেলেন। বারান্দায় এখন আর তিনি এক শ পাওয়ারের বাতি দুটি জ্বালান না। ছয় রোজার দিন রাতে তারাবীর নামাজ শেষে ফেরবার পথে তিনি মারা পড়লেন। হাসিমুখে খবর আনল কাদের মিয়া। প্রচণ্ড ধমক লোগালাম কাদেরকে, এই লোকটার জন্য বেঁচে আছিস তুই কাদের। আর যেই হাসে হাসুক, তুই হাসিস না।
কাদেরের হাসি বন্ধ হল না। চোখ ছোট-ছোট করে বলল, খেইল শুরু হইছে। ছোড ভাই। বিসমিল্লাহ দিয়া শুরু।
মতিনউদ্দিন সাহেব শুধু বললেন, মানুষ মারাটা ঠিক না। মানুষ মারাটা কোনো হাসির জিনিস না কাদের মিয়া। ইজাবুদ্দিন সাহেব মানুষের অনেক উপকার করেছেন।
দুলাভাই খবর পাঠিয়েছেন এক্ষুণি যেতে হবে। দুলাভাইয়ের গাড়ির এই ড্রাইভারটি নতুন রাখা হয়েছে। লোকটি বিহারী। মিলিটারি গাড়ি থামালেই সে গলা বের করে একগাদা কথা হড়হড় করে বলে। ফলস্বরূপ গাড়ি থেকে নামতে হয় না।
দুলাভাইয়ের বাসায় গিয়ে দেখি, জিনিসপত্র গোছগাছ হচ্ছে। আপার মুখে আষাঢ়ের ঘনঘটা। দুলাভাই বললেন, ইণ্ডিয়া যুদ্ধে নামবে, বুঝলে নাকি শফিক? শহর ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।
কখন ছাড়ছেন শহর?
আন্দাজ করা দেখি?
আজকেই যাচ্ছেন নাকি?
ঠিক। এক ঘণ্টার মধ্যে। গাড়িতে করে যাব ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহে খবর দেয়া আছে।
হঠাৎ করে যাচ্ছেন দুলাভাই! আজকেই ঠিক করলেন নাকি?
হ্যাঁ।
আজকে ঠিক করার পিছনে কোনো কারণ আছে?
আছে। সিরিয়াস কারণ আছে।
বলেন শুনি।
তার আগে বল, তুমি একটা কাজ করতে পারবে কিনা?
কী কাজ?
লুনাকে তো চেন, শীলার বান্ধবী–এক মেজর বিয়ে করতে চায় তাকে।
চিনি।
সেই মেয়েটিকে তোমার ওখানে নিয়ে রাখবে। শুধু আজকের রাতটা। কাল ভোরে মেয়ের এক চাচা এসে মেয়েকে নিয়ে যাবে। খবর দেওয়া হয়েছে, তাঁকে তোমার ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি।
কিছুই বুঝতে পারছি না দুলাভাই। মেয়েটা কোথায়?
এইখানেই আছে। শীলার ঘরে আছে।
ব্যাপার মোটামুটি এই রকম, গত দশ দিন ধরে লুনা এই বাড়িতে আছে। মেয়ের বাবা-মা মেজর ভদ্রলোককে বলেছেন, মেয়ে চিটাগাং তার নানার বাড়িতে আছে। ঈদের পর আসবে। বিয়ের পাকা কথাবার্তা হবে তখন। মেজর সাহেব কিছুই বলেন নি। আজ সকালে কিছু লোকজন এসে মেয়ের বাবা-মাকে তুলে নিয়ে গেছে। দুলাভাইয়ের ধারণা, তাঁকে ধরতে আসবে আজকালের মধ্যে।
বড়ো আপা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, মেয়েকে আমার এখানে রাখার কথা তো আমি বলি নি, তোর দুলাভাই গলা বাড়িয়ে বলেছে। এখন দেখ না ঝামেলা।
ঝামেলা তো সবারই আপা। তুমি ঝামেলায় পড়লে দেখবে সাহায্যের জন্যে লোক আসছে।
রাখা রাখা। লম্বা লম্বা কথা ভালো লাগে না। লম্বা কথা অনেক শুনেছি।
বড়ো আপার ঢাকা ছাড়ার ইচ্ছা মোটেই নেই। তিনি আমার সামনেই এক বার দুলাভাইকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, সবচেয়ে ভালো হয়। এই বাসা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথায়ও ওঠা।
শফিকের ওখানে উঠতে দোষ কী? ঘর তো খালি পড়ে আছে।
দুলাভাই অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, ঢাকা শহরে এক ঘণ্টার বেশি আমি থাকব না। ওরা আমাকে খুজছে।
তুমি তো শেখ মুজিব! তোমাকে না হলে ওদের ঘুম হচ্ছে না।
দুলাভাই শান্ত স্বরে ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি বের করতে। আমাকে বললেন, লুনাকে সবকিছু বলা হয়েছে, খুব শক্ত মেয়ে। একটুও ঘাবড়ায় নি।
আমি বললাম, যদি ওর চাচা না আসে?
আসবেই। আর যদি না-আসে, তাহলে তুমি বুদ্ধি খাটিয়ে যা করবার করবে। মেয়ের এক দূরসম্পর্কের খালা আছে। ঢাকায়। লুনার কাছে ঠিকানা আছে।
ওর বাবা-মার খবর ওকে বলেছেন?
কান্নাকাটি করছে না?
আমাদের সামনে না। মেয়ে বড়ো শক্ত, মাচকাবার মেয়ে না। আমি খুবই ইমপ্রেসড!
দুলাভাই খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, একটা টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছি, সেই টেলিফোন নাম্বারে ফোন করে বলবে যে আমি চলে গেছি।
কাকে বলব?
যে টেলিফোন রিসিত করবে, তাকেই বলবে। বলবে মেসেজ রাখতে।
এইটি কি আপনার ব্রিগেডিয়ার বন্ধুর নাম্বার?
হ্যাঁ, তোমার ওর কাছে যাওয়ার দরকার নেই।