সোনালী সেই দিনের কথা
(একুশ)
” আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো প্রিয় কলকাতা
– তসলিমা নাসরিন
ভালো নেই আমি, এভাবে কেউ কোনওদিন ভালো থাকেনি কোথাও।
এভাবেই তুমি আমাকে রেখেছো কলকাতা, এভাবেই নির্বাসনে,
এভাবেই একঘরে করে। এভাবেই অন্ধকূপে।
পায়ের তলায় পিষছো প্রতিদিন, প্রতিদিন পিষছো পায়ের তলায়।
গলা টিপে ধরেছো কথা বলেছি বলে,
হাত কেটে নিয়েছো লিখেছি বলে।
কাউকে হত্যা করিনি, কারও অনিষ্ট করিনি, কারও দিকে পাথর ছুঁড়িনি,
মানবতার পক্ষে কিছু অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করেছি বলে আমাকে তোমার পছন্দ নয়।
আমাকে উৎখাত করেছো আমার মাতৃভাষা থেকে, উৎখাত করেছো আমার মাটি ও মানুষ থেকে,
উৎখাত করেছো জন্ম – জন্মান্তরের ইতিহাস থেকে উৎখাত করেছো ঘরবাড়ি বাসস্থান থেকে,
পৃথিবীতে আমার সর্বশেষ আশ্রয় থেকে।
আমি ভালো নেই তাতে কী !
তুমি ভালো থেকো,
তুমি বড় বড় কবির শহর,
সাহিত্যিকের শহর,
দার্শনিক শুভবুদ্ধির শহর ,
ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রগতিশীল শহর তুমি, কলকাতা, তুমি তো সংস্কৃতির পীঠস্থান, তুমি ভালো থেকো।
তুমি সুখে থেকো প্রিয় কলকাতা,
নাচে গানে থেকো, উৎসবে আনন্দে, মেলায় খেলায় থেকো সুখে।
তুমি তো মহান, তুমি বিরাট, তুমি অট্টহাসি হাসো, জগত দেখুক।
কাব্যগ্রন্থ
‘ বন্দিনী ‘
২৮.০২.২০০৮. “
সে সময় কমল সাহা, রথীন চক্রবর্তী গান্ধী কলোনী ( কলকাতা -৭০০ ০৯২) থাকত। দিঙ্মাত্র পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক-শিখা দাস, সুনন্দা মুখার্জী ( গতবারে মহিলা কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন) থাকত শ্রীকলোনী ( কলকাতা -৭০০ ০৯২)। কতদিন পায়ে হেঁটে বিদ্যাসাগর কলোনী (কলকাতা-৭০০ ০৪৭) থেকে শ্রীকলোনী, গান্ধী কলোনী গেছি ওদের সঙ্গ যাপন করতে। কমল আর রথীনের বাড়ি প্রায়ই যেতাম।
কমল সাহা তখন নতুন প্রকাশিত প্রায় সব লিটল ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদপট আঁকত।
ওর চারটে নেশা ছিল। ছবি আঁকা, কবিতা লেখা, চা আর চার্মিনার সিগ্রেট। ওর বড় দাদার – ‘অমি প্রেস’ ছিল কলেজস্ট্রীটে। তখনকার প্রায় সব নতুন লিটল ম্যাগাজিন ওই প্রেসেই ছাপা হত। কমল রোজ প্রেসে যেত প্রুফ দেখত। মাঝে মাঝে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেত। লেখা নিয়ে কত আলাপ আলোচনা হত ওর সঙ্গে।
কমল ছিল শঙ্খ ঘোষের অনুরাগী, আমি ছিলাম শক্তি/ সুনীলের। আমাদের সে সময় কবিতা অনুরাগীরা দু ভাগে বিভক্ত ছিল। একদল শক্তি / সুনীলের, অন্যদল শঙ্খ /অলকরঞ্জনের।
আমি ছিলাম প্রথম দলে, কমল ছিল দ্বিতীয় দলে। এ নিয়ে প্রায়ই আমাদের বিতর্ক হত , কে বড় কবি তাই নিয়ে ( কি শিশুসুলভ ব্যাপার, আজ ভাবলে হাসি পায়)।
শক্তি সুনীলের অনুরাগীরা বলত, শঙ্খ ঘোষ তো রবীন্দ্র ভাবনাই আধুনিক ভাষায় লিখে থাকে। তার নিজ ভাবনা কোথায়? আমি এসব অভিযোগগুলি শক্তি সুনীলের অনুরাগীদের কাছে শুনে শুনে, একদিন কমলকে বলায়, কমল তো রেগে আগুন তেলে বেগুন ( হেভী ফায়ার), আমার সাথে প্রায় একমাস কথা বন্ধ রেখেছিল। এমন অনুরাগী ছিল সে শঙ্খ ঘোষের।
কবিতা লেখায় মুন্সীয়ানা ছিল ওর, ছিল প্রচন্ড ছন্দ জ্ঞান। প্রখর অনুভূতি সম্পন্ন কবি ছিল কমল। প্রায় সব পত্রিকায় ওই সময় কমলের কবিতা প্রকাশিত হত। কমল সাহা তখন এক জনপ্রিয় কবির নাম।
শ্যামল কান্তি দাশ সেইসময় – ‘সূর্যনেশা’ নামে একটি পত্রিকা মেদনীপুর থেকে প্রকাশ করত।
কমল তখন এতটাই জনপ্রিয় কবি, শ্যামল আমাদের সমসাময়িক কবি হয়েও সূর্যনেশা পত্রিকার বিশেষ কমল সাহা সংখ্যা বের করেছিল। যা এখন ভাবাই যায় না সমকালীনদের কাছে থেকে। শ্যামল কান্তি দাসের তখন ছিল ছিপছিপে শ্যামলা রঙের ঝকঝকে চেহারা।
চোখদুটি সব সময় হাসিমাখা।
সেই জনপ্রিয় ( প্রচন্ড সম্ভবনাময়) কবি হঠাৎ সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে (কেউ কেউ বলে অবশ্য অর্থ নেশায়?) মুম্বাই চলে গেল, ইন্টেরিয়ার ডেকরশনের কাজে। আর ফেরেনি কবিতার জগতে। এ যে আমাদের কত বড় ক্ষতি কে তার হিসাব রাখবে।
ওর ওই তরুণ বয়সেই দুটে কবিতার বই বেরিয়ে আমাদের তরুণদের মধ্যে আলোড়ণ তুলেছিল।
রথীন চক্রবর্তী তখন স্বকীয় লেখার তুলনায়,ল্যাটিন আমেরিকান কবিতার অনুবাদ
করতে মনোনিবেশ করত বেশী। একটি অনুবাদ গ্রন্থ বেরিয়ে, আমাদের মন জয় করেছিল।
ওর লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ছিল দেখবার মতো। প্রতিটি লিটল ম্যাগাজিন যত্ন করে সুবিন্যস্ত ভাবে সাজিয়ে রাখত টেবিলে। কোন পত্রিকার কোন সংখ্যা কোথায় আছে , সব তার নখদর্পনে থাকত। প্রয়োজনে সব সময় বের করে দিত। নির্ভর যোগ্য , বিশ্বস্থ সহযোগী বন্ধু ছিলেন আমাদের।
তখন এমন যত্ন করে খুব কম লোকই লিটল ম্যাগাজিন রক্ষা করত। অন্ততঃ আমার চোখে সে রকম বেশী পড়েনি। রথীন ছিল এ ব্যাপারে পাওনিয়ার। পরে সন্দীপ দত্ত সে কাজ করেছে। পরে তার কথায় আসছি।
বর্তমানে রথীন চক্রবর্তী সল্টলেকে থাকে।
ওখান থেকেই একটি বিশিষ্ট নাট্য পত্রিকা- ‘নাট্যচিন্তা’ নামে নিষ্ঠার সাথে বের করে যাচ্ছে।
” আত্মবিলাপ
আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু,হায়,
তাই ভাবী মনে?
জীবন-প্রবাহ বহি কাল-সিন্ধু পানে যায়,
ফিরাব কেমনে?
দিন দিন আয়ুহীন হীনবল দিন দিন ,–
তবু এ আশার নেশা ছুটিল না? এ কি দায়!
রে প্রমত্ত মন মম! কবে পোহাইবে রাতি?
জাগিবি রে কবে?
জীবন-উদ্যানে তোর যৌবন-কুসুম-ভাতি
কত দিন রবে?
নীর বিন্ধু, দূর্বাদলে,নিত্য কিরে ঝলঝলে?
কে না জানে অম্বুবিম্ব অম্বুমুখে সদ্যঃপাতি?
নিশার স্বপন-সুখে সুখী যে কী সুখ তার?
জাগে সে কাঁদিতে!
ক্ষণপ্রভা প্রভা -দানে বাড়ায় মাত্ত আঁধার
পথিকে ধাঁদিতে!
মরীচিকা মরুদেশে,নাশে প্রাণ তৃষাক্লেশে–
এ তিনের ছল সম ছল রে এ কু-আশার।
প্রেমের নিগড় গড়ি পরিলি চরণে সাদে
কী ফল লভিলি?
জ্বলন্ত-পাবক-শিখা-লোভে তুই কাল ফাঁদে
উড়িয়া পড়িলি
পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়,ধাইলি,অবোধ,হায়
না দেখলি না শুনিলি,এবে রে পরাণ কাঁদে
বাকি কি রাখিলি তুই বৃথা অর্থ-অন্বেষণে,
সে সাধ সাধিতে?
ক্ষত মাত্ত হাত তোর মৃণাল-কণ্টকগণে
কমল তুলিতে
নারিলি হরিতে মণি, দঃশিল কেবল ফণী
এ বিষম বিষজ্বালা ভুলিবি, মন,কেমনে!
যশোলাভ লোভে আয়ু কত যে ব্যয়িলি হায়,
কব তা কাহারে?
সুগন্ধ কুসুম-গন্ধে অন্ধ কীট যথা ধায়,
কাটিতে তাহারে?
মাৎসর্য-বিষদশন, কামড়ে রে অনুক্ষণ!
এই কি লভিলি লাভ,অনাহারে,অনিদ্রায়?
মুকুতা-ফলের লোভে,ডুবে রে অতল জলে
যতনে ধীবর,
শতমুক্তাধিক আয়ু কালসিন্ধু জলতলে
ফেলিস,পামড়!
ফিরি দিবি হারাধন,কে তোরে,অবোধ মন,
হায় রে,ভুলিবি কত আশার কুহক-ছলে!”
– মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
(বাইশ)
” প্রত্যাশার বাইরেই ছিল
প্রত্যাশার বাইরেই ছিল ব্যাপারটি। রোজকার
মতোই টেবিল ঘেঁষে পুরোনো চেয়ারে
আরামে ছিলাম বসে, ঘড়িতে তখন
সকাল আটটা ফ্যাল ফ্যাল ক’রে তাকিয়ে রয়েছে।
আমি কি না-লেখা কোনও কবিতার পঙ্ক্তি মনে-মনে
সৃজনে ছিলাম মগ্ন? একটি কি দুটি শব্দ হয়তো-বা ভেসে
উঠছিল আমার মানস-হ্রদে। আচমকা
চোখে পড়ে ঘরে একটি প্রজাপতির চঞ্চলতা।
বেশ কিছুকাল থেকে কৃষ্ণপক্ষ দিব্যি গিলে রেখেছে আমার,
আমাদের বসতিকে। আলো জ্বালাবার
প্রয়াস নিমেষে ব্যর্থ হয় জাহাঁবাজ
তিমিরবিলাসী ক্রূর হাওয়ার সন্ত্রাসে নিত্যদিন। তবুও তো
একজন রঙিন অতিথি ঘরটিকে দান করে অকৃপণ
সোন্দর্যের আভা, মুগ্ধ চোখে দেখি তাকে। মনে হয়,
একটি কবিতা যেন ওড়াউড়ি করছে এ-ঘরে,
অথচ দিচ্ছে না ধরা আমার একান্ত করতলে, যার ধ্যানে
দীর্ঘকাল মগ্ন ছিল কবিচিত্ত সম্ভবত অবচেতনায়
আধো জাগরণে কিংবা ঘুমের আংশিক এলাকায়।
– শামসর রহমান।
(‘ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছে’ – কাব্যগ্রন্থ থেকে)
তার কিছুকাল পরে, সম্ভবতঃ ১৯৭৮ সালে , সন্দীপ দ্ত্ত গড়ে তোলেন লিটল ম্যাগজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্র। আমাদের মতো লিটল ম্যাগাজিনের লেখক ও কবিদের, বহুদিনের মনের গোপন প্রত্যাশা পূরণ করেন।
এই মহৎ কাজটি করার পিছনে, তার মনের ভিতরের এক তিক্ত অভিজ্ঞতা কাজ করেছিল। এ কথা তার মুখেই শোনা, এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তে।
১৯৭৭ সালে ( সম্ভবতঃ) একদিন সন্দীপ দত্ত ন্যাশানাল লাইব্রেরীতে যান তার কোন প্রয়োজনে।
গিয়ে দেখেন, লাইব্রেরীর বাইরে বারান্দায় ডাই করে ফেলে রাখা হয়েছে সমস্ত লিটল ম্যাগাজিনগুলো অবহেলায়। বৃষ্টিতে ভিজছে।
দেখে ওর মনে একটা কষ্টের দানা ঢুকে পড়ে।
দৃশ্যটা তীরের ফলার মতো বুকে বিঁধে থাকে।
কিছুতেই শান্তি পান না, মনে মনে আলোড়ণ ওঠে।
মনে মনে এর প্রতিকারের কথা ভাবতে থাকেন।
এর কিছুদিন পর নিজেই প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন। দায়িত্ব ভার একাই কাঁধে তুলে নেন এর প্রতিকারের জন্য।
নিজের বাড়িতেই শুরু করেন লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্র।
আজকাল কতজন সেখান থেকে গবেষণা করে উপকৃত হচ্ছেন। সন্দীপ নিজে শিক্ষকতার করার পর বাকী সময়টা লাইব্রেরীর কাজে নিঃস্বার্থ ভাবে এতদিন ধরে ব্যয় করে আসছে।
এ রকম আত্মত্যাগের ফলেই আজ লিটল ম্যাগজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্র বিরাট মহীরূহের আকার ধারণ করেছে।
শুধু তাই নয়। তারই উদ্দীপনায় জেলায় জেলায় আজ গড়ে উঠেছে কত লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী কেন্দ্র। যা স্বাস্থ্যকর শিল্প সাহিত্যের পক্ষে। শুভ লক্ষণ।
” সত্তর দশক মুক্তির দশক। “
আমি মুক্তি খুঁজি কবিতায়।
আমি কবিতা লিখতেে আসার আগে, কবিতার জগতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ঘটে গেছে। তার কিছু কিছু প্রভাব সত্তরের কবিদের উপরে পড়েছে।
ত্রিশ দশকের কল্লোল যুগের পর চল্লিশ দশকে এসে কবিতা সুকান্ত, সুভাস মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ, রাম বসু, বীরেন্দ্র চটাটোপাধ্যায়ের হাত ধরে বামপন্থী ধারার অভিমুখে চলা শুরু করে।
পঞ্চাশে এসে সে ধারা বাঁক নেয় সতন্ত্র পথে কৃত্তিবাস, শতভিষা, কবিপত্র- র হাত ধরে।
পঞ্চাশের শেষ দিকে শুরু হয়, হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ( বিক্ষুব্ধ কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দ্বারা)। এই আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পরে করছি।
ষাট দশকে এসে কবিতার অভিমুখ ভিন্ন দিকে ঘোরে শ্রুতি আন্দোলন এবং ধ্বংসকালীন আন্দোলনের ফলে। এই আন্দোলন নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। সে আলোচনার অবতারনা একটু পরেই করছি ।
সে এই একই সময়ে বাংলাদেশে ঘটে স্যাড জেনারেশন আন্দোলন।
সত্তর আশি দশকে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য আন্দোলনের ঘটনা ঘটেনি। বাম জমানায় দেখতে পাই, সাহিত্যের আন্দোলন যেন কেমন একটু থমকে যায়। নতুন করে আর তেমন কোন বড় আন্দোলন ঘটেনি সাহিত্য জগতে।
তবে লেখার ধারা ক্রমাগতঃ পাল্টে যেতে থাকে।
এখনও যাচ্ছে।
আঙ্গিক নিয়ে, শব্দ ব্যাবহার, চিত্রকল্পের উপস্থাপনা নিয়ে আজও নানা পরীক্ষা নীরিক্ষা চলছে কবিতায়। সাম্প্রতিক কবিদের লেখা পড়লেই সে কথা বোঝা যায়। কবিতা কোথাও থেমে পড়েনি। নতুন নতুন ভাবে, চিত্রকল্পে, ভাষায় লেখা হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে।
আমার ধারণা কবিতা কোথাও থামতে জানে না।
” ভালোবাসা দিতে পারি
ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায় –
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়ে না; তবু ভালোবাসা দিতে পারি।
শাশ্বত, সহজতম এই দান — শুধু অঙ্কুরের
উদগমে বাধা না দেওয়া, নিষ্পেষিত অনালোকে রেখে
ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না ক’রে শ্যামল হতে দেওয়া।
এতই সহজ, তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলে ফেলি।
গ্রহণে সক্ষম নও। পারাবত, বৃক্ষচুড়া থেকে
পতন হলেও তুমি আঘাত পাও না, উড়ে যাবে।
প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি
চ’লে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।”
– বিনয় মজুমদার।
(তেইশ)
” অবুঝের সমীকরণ
কবিতা বোঝে না এই বাংলার কেউ আর
দেশের অগণ্য চাষী, চাপরাশী
ডাক্তার উকিল মোক্তার
পুলিস দারোগা ছাত্র অধ্যাপক সব
কাব্যের ব্যাপারে নীরব!
স্মাগলার আলোচক সম্পাদক তরুণীর দল
কবিতা বোঝে না কোনো সঙ
অভিনেত্রী নটী নারী নাটের মহল
কার মনে কাতোটুকু রঙ?
ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা
সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে
কবিতা বোঝে না!
কবিতা বোঝে না আর বাংলার বাঘ
কুকুর বিড়াল কালো ছাগ,
খরগোস গিরগিটি চতুর বানর
চক্রদার যত অজগর!
কবিতা বোঝে না এই বাঙলার বনের হরিণী
জঙ্গলের পশু-পাশবিনী।
শকুনী গৃধিনী কাক শালিক চড়ুই
ঘরে ঘরে ছুঁচো আর উই;
বাংলার আকাশের যতেক খেচর
কবিতা বোঝে না তারা। কবিতা বোঝে না অই
বঙ্গোপসাগরের কতেক হাঙর!”
– আল মাহমুদ।
সাহিত্যের সঙ্গে পঞ্চাশ বছর সহবাসের পর, একটা কথা বুঝেছি, ভাল কবিতা লিখতে গেলে আগে কবিতাকে ভাল বাসতে শিখতে হয়।
পূর্বসুরীদের লেখা মন দিয়ে পড়তে হয়। একান্ত ভাল পাঠক হতে হয়। প্রতিদিন আহার নিদ্রার মত কবিতা পড়াকেও অভ্যাসে পরিণত করতে হয়।
কবিতার রাজ্যে ইদানিং কিছু ভূঁইফোর কবির দেখা মেলে, যারা পূর্বসুরীদের কোন লেখা পড়ার কোন তোয়াক্কা করে না। রবীন্দ্র নজরুল সুকান্তর কবিতা খামচা খামচা খানিকটা গিলে, কাব্য বিশারদ হয়ে উঠে, কবিতা লিখতে শুরু করে।
তা করুক, আপত্তি করার কিছু নেই। বাস্তবে দেখা যায়, অচিরেই কিছু দিনের মধ্যে লেখার দম ফুরিয়ে আসে। অন্যের লেখা চুরি করে একটু অদল বদল করে নিজের নামে ছাপে, তবু তাদের কবি খ্যাতি চাই। হয়তো তারা ভাবে কবি যেন একটা তকমা, যা গায়ে জড়ালেই মান বাড়বে সমাজে।
যাক এসব, এবার —
ডুব ডুব ডুব,
ডুব দে রে মন
মনে মনে,
স্মৃতির অতল গহনে।
ত্রিশ দশকের অচিন্ত- প্রেমেন- বুদ্ধ( কল্লোল যুগ), জীবনানন্দ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে, সমর সেনের লেখার ধারা চল্লিশ দশকে এসে অনেকটা পালটে যায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়, রাম বসু, সিদ্ধেশ্বর সেন, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, জগন্নাথ চক্রবর্তী, মঙ্গলাচরণ, চিত্ত ঘোষ, কিরণশংকর সেনগুপ্তের কলমে।
আবার পঞ্চাশ এসে, কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সুনীল, শক্তি, অলোকরঞ্জন, শরৎ মুখার্জী, ফণিভূষণ আচার্য্যরা কবিতায় মুক্তি খোঁজেন নিজেদের মতন করে। ফলে সে সব লেখার ধারা পূর্ববর্তীদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম হয়ে ওঠে। একেবারে নতুন রকমের লেখা, যা সেই সময় পড়ে আমাদের তাক লেগে যেতে থাকে।
ষাট দশকে এসে সাহিত্য আন্দোলন কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ধারায় পর্যায়ক্রমে ভাগ হয়ে পড়ে।
এই সময়ই ` আরও কবিতা পড়ুন ‘ স্লোগানে পথে নেমে আসেন আলোক সরকার ( শতভিষা গোষ্টী) শংকর চাটার্জীরা পোষ্টার ফেস্টুন হাতে।
রাসবিহারী রোড থেকে হাজরা পর্যন্ত চলে মিছিল।
এ ধরণের বিচিত্র মিছিল দেখে কেউ কেউ হতচকিত হয়ে পড়েন। আগে কখনো এ’ধরণের মিছিল চোখে পড়েনি বলে।
আমরাও পরবর্তীকালে বাসে উঠে কবিতা পড়েছি। কেউ আনন্দ পেয়েছে, কেউ বিরক্ত হয়েছে। তবু কেউ কোন আপত্তি করেনি, আমাদের কবিতা পাঠে কোন রকম বাধা সৃষ্টি করেনি।
সে সময় কবিদের মধ্যে একটা মাতোয়ারা ভাব ছিল কবিতা নিয়ে। না হলে ভাবুন ঘন্টায় ঘন্টায় কবিতা পত্রিকা ধ্রুপদী প্রকাশিত হতে পারে?
ষাট দশকে এসে প্রথাগত ধারার কবিরা ছাড়া, অন্য কবিরা মূলতঃ ভাগ হয়ে পড়ল তিনটি ধারায়।
এক. হাংরি
দুই. শ্রুতি
তিন. ধ্বংসকালীন
এদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আমি পরে করছি।
” অঙ্গার
তোমার প্রেমিক,তাঁর সাদা পাতলা দাড়ি–
ফরসা রং–হাসিখানি অপূর্ব সুন্দর
যখন ঘাঢ় ঘুরিয়ে হেসে তাকালেন
মুহূর্তে তোমার বুকে ঝড়
এ ঝড় আমার জন্য কোনওদিন উঠবে না আর
‘সাবধানে থাকবেন’–বলে চলে যেতে-যেতে
আমার বুক ফাঁক করে ভরে দিয়ে গেলে
একমুঠো ধকধকে অন্ধকার
– জয় গোস্বামী।
(চব্বিশ)
” ফুল ফুটুক না ফুটুক
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।
শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।
আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে
তারপর খুলে-
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে-
যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে।
গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেলে
একটা দুটো পয়সা পেলে
যে হরবোলা ছেলেটা
কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত
-তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো।
লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মত
আকাশটাকে মাথায় নিয়ে
এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে
রেলিঙে বুক চেপে ধ’রে
এই সব সাত-পাঁচ ভাবছিল-
ঠিক সেই সময়
চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল
আ মরণ! পোড়ারমুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি!
তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ।
অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে
দড়িপাকানো সেই গাছ
তখন ও হাসছে।”
– সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
স্বপন চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় সত্তরের শুরুতেই। তখন কয়েকজন স্বপন চক্রবর্তী লিখত। তাই ওকে আমি শৌভিক (সাহসী) নামে লিখতে বলি। এর পর থেকে ওর লেখা শৌভিক নামে বেরতে থাকে। সকলে ওই নামেই ওকে চেনে। আসল নাম স্বপন হারিয়ে যায়। অরুণ ঘোষ ও স্বপন চক্রবর্তী মিলে প্রথম বর্ণালী নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিল। অরুণের সাহিত্যে অনুরাগ ছিল। অরুণ ছিল আবার দেবানন্দ দে-র বন্ধু। দেবানন্দের বাড়িতে অরুণ আর স্বপনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়।
দু চারটি পত্রিকায় আমার কবিতা তখন প্রকাশ হতে শুরু করেছে। আমিও কবি যশঃপ্রার্থী।
ওরা আমার কবিতা বর্ণালীতে ছাপতে চায়। সেই শুরু, তারপর আর শেষ নেই। বর্ণালীর দুটি সংখ্যা বের হবার পর, বন্ধ হয়ে যায়।
আমি তার আগেই জোনাকি পত্রিকা বের করে
কিছুটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি সম্পদনার কাজে। ওরা আমাকে সঙ্গে নিয়ে একটি নুতন পত্রিকা বের করার আগ্রহ প্রকাশ করে।
তখন কৃত্তিবাস পত্রিকা সুনীল গাঙ্গুলীর সম্পাদনায় বের হচ্ছে। সুনীলদার বাড়িতে তখন আমার যাতায়াত আছে। তাকে বলি, আমরা একটি পত্রিকা বের করতে চাই তরুণরা। কি নাম দেওয়া যায় বলুন তো সুনীলদা।
উনি বললেন, বেদব্যাস দাও।
আমরা সকলে মিলে নতুন করে বেদব্যাস পত্রিকা
বের করতে শুরু করি। সে সময় আঞ্চলিক ভাবে
বেদব্যাস খুব আলোড়ণ তুলেছিল সাহিত্য রসিক মহলে। প্রতি সংখ্যায় রুদ্রনাথ করের সমালোচনা
‘ কড়া চাবুক ‘- এর ঘায়ে জর্জরিত হত, দীপাঞ্জন দত্তের ‘আবর্ত’- পত্রিকা, অশোক মিত্রের ‘দেয়া’- পত্রিকা (বাঁশদ্রোনী থেকে বেরত) , সুনন্দা মুখার্জীর ‘দিঙ্মাত্র’-পত্রিকা ও অন্যান্ন আঞ্চলিক লিটল ম্যাগাজিনগুলো।
দিঙ্মাত্র -র সম্পাদক সুনন্দা মুখার্জীর (আগেই বলেছি, গত মহিলা কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন)। ওর সঙ্গেও আমার প্রথম পরিচয় হয় দেবানন্দ দে-র বাড়িতে। সুনন্দা আর দেবানন্দ তখন একই কলেজে (নেতাজীনগর কলেজ) পড়ত। সুনন্দার সঙ্গে প্রথম দিন আলাপেই আমার সঙ্গে ওর সাহিত্য সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে, আলোচনা করতে গিয়ে, প্রচন্ড মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। পরে আমরা অবশ্য খুব ঘনিষ্ট বন্ধু হয়ে পড়েছিলাম।
একসঙ্গে দলবেধে সাহিত্য সভায় গেছি। ঘুরতে গেছি এখানে সেখানে। নিযমিত দেখা সাক্ষাৎ হত। শিল্প সাহিত্য রাজনীতি নিয়ে উত্তাল আলোচনা হত। আমরা কখনও কখনও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গিয়ে বসতাম।
সুনন্দা তখন RSP রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরে ক্ষিতি গোস্বামীকে বিয়ে করে, তাকে জীবন সঙ্গী করে নেয়।
সুনন্দার সাহিত্যে অনুরাগ ছিল, রাজনীতির প্রতি টানের মতোই।
সেই সব অন্তরঙ্গ দিনের সঙ্গী ছিল অনেকেই। তারা অনেকেই আজ আর ইহলোকে নেই। শৌভিক( স্বপন) চক্রবর্তী, নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (ছড়াকার, পঁচিশে বৈশাখ পত্রিকার সম্পাদক, ত্রিশ বছর বের করেন) অসীম চক্রবর্তী ( গল্পকার) , নিতাই সরকার (পরে নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে) , শচীন দাশ (গল্পকার) প্রমুখ আরও কতসব লোকজন সকলের নাম করতে গেলে বোধহয় মহাভারত হয়ে যাবে।
আমরা তখন বেদব্যাস পত্রিকা বের করি।
সে আড্ডায় এছাড়াও থাকত অমিত বিক্রম উজ্জ্বল চন্দ, অঞ্জন মুখার্জী, বিপ্লব সিংহ, দিব্যেন্দু গাঙ্গুলী ( বর্তমানে পোল্যান্ডে, গ্রোটস্কির সঙ্গে নবনাট্য আন্দোলনে যুক্ত আছে) ।
” হে সময়, অশ্বারোহী হও
বিরক্ত নদীর মতো ভুরু কুঁচকে বসে আছে আমাদের কাল।
যাচ্ছি যাব, যাচ্ছি যাব এই গড়িমসি করে চূড়ো ভাঙা চাকা ভাঙা রথ
যে রকম ঘাড় গুজে ধুলোয় কাতর, সে রকমই শুয়ে বসে আছে।
খেয়াঘাটে পারাপার ভুলে-যাওয়া, নৌকার মতন, সময় এখন।
মনে হয় সময়ের পায়ে ফুটে গেছে দীর্ঘ পেরেক বা মনসার কাঁটা
ছিড়ে গেছে স্ম্যান্ডেলের স্ট্র্যাপ কিংবা জুতোর গোড়ালি
মনে হয় তার সব কোটপ্যান্ট ধোবার ভাটিতে
হয়তো বা কোনও এক লেকা্যাল ট্রেনের হু হু ভিড়ে
চুরি হয়ে গেছে পার্স, পার্সে ছিল অগ্রিম টিকিট।
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নিয়ে যাবে পাহাড়ের সোনালী চূড়োয়
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আকাশের সিথি থেকে সিদুরের টিপ এনে দেবে
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নক্ষত্রের ক্যামেরায় ছবি তুলে উপহার দেবে অ্যলবাম
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে কলকাতায় এন দেবে শঙ্খের সাগর।
প্রতিশ্রুতি যত্রতত্র ছড়াবার ছিটোবার কথ, থুতু, মলমুত্র নয়
প্রতিশ্রুতি লাল নীল পতাকার ব্যতিব্যস্ত ওড়াউড়ি নয়
প্রতিশ্রুতি প্রেসনোট, দৈববাণী, দেয়ারের লিপিচিত্র নয়।
প্রতিশ্রুতি শীতের চাদর
প্রতিশ্রুতি ভাঙা চালে খড়
প্রতিশ্রুতি সাদা ভাত, ভাতে দুধ, দুধে ঘন সর
প্রতিশ্রুতি চেতনার স্তরে স্তরে সপ্তসিন্ধুজলের মর্মর।
হে সময়, হে বিকলাঙ্গ বিভ্রান্ত সময়
কানা কুকুরের মতো এটো-কাটা ঘাঁটাঘাঁটি ভুলে
পৃথিবীর আয়নায় মুখ রেখে জামা জুতো পরে
সূর্যের বল্লম হাতে, একবার অশ্বারোহী হও।
– পূর্ণেন্দু পত্রী।
[কাব্যগ্রন্থ ‘হে সময় অশ্বারোহী হও’ থেকে]
(পঁচিশ).
” আমি ছিন্নভিন্ন-বিগত বছরের এটাই সর্বাপেক্ষা
প্রধান সংবাদ
বিশ্বের সমস্ত প্রচার মাধ্যম থেকে একযোগে প্রচারযোগ্য
এই একটাই বিশ্ব-সংবাদ, আমি ছিন্নভিন্ন
যদিও একান্ত ব্যক্তিগত এই শোকবার্তা কারো মনে
জাগাবে না সামান্য করুণা
তবু মনে হয় এই শতাব্দীর এটাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ
একটি সংবাদ-শিরোনাম : আমি ছিন্নভিন্ন ;
এই কবিতার মদ্যে আমি এই একান্ত জরুরী খবরটাই শুধু
উদ্ধৃত করেছি
শিল্পের সমস্ত সংবাদ উৎস হতে এই একটাই বার্তা শুধু
প্রচারিত হচ্ছে একটি শতাব্দী ধরে-
মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখো, তার বুকের কাছে মুখ নিয়ে
জিজ্ঞেস করো সে বলবে, আমি ছিন্নভিন্ন
গোলাপের দিকে তাকাও সে বলবে, আমি ছিন্নভিন্ন
বন কিংবা উদ্ভিদের কছে যাও সেও এই একই কথাই বলবে,
অনন্ত নীলিমার দিক চোখ ফেরাও তার কন্ঠে শুনতে পাবে
এই একই ভয়াবহ বার্তা ; আমি ছিন্নভিন্ন
পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে ফিরে তাকাও
সেও ক্রমাগত আর্তনাদ করে উঠবে, আমি ছিন্নভিন্ন
সৌন্দর্যকে জিজ্ঞেস করো সেও এই একই উত্তর দেবে,
মানুষের শুদ্ধতাকে প্রশ্ন করো সেও নিঃসঙ্কোচে
বলবে, আমি ছিন্নভিন্ন
প্রকৃতি ও শস্যক্ষেত্রের কাছে যাও অন্য কিচুই শুনতে পাবে না,
এমন যে শান্ত জলধারা তার কাছেও যাও
আহত কন্ঠে বলবে সেও দলিত-মথিত, ছিন্নভিন্ন
গোলাপের কৌমার্য, ফুলের শুদ্ধতা আর হৃদয়ের বিশুদ্ধ আবেগ
তারাও এই একই কথা বলবে ;
দেশ ছিন্নভিন্ন, মানুষ ছিন্নভিন্ন,মানুষের সত্তা ছিন্নভিন্ন
যতোই লুকোতে চাই তবুও প্রকৃত সত্য হচ্ছে
আমি ছিন্নভিন্ন,কাঁটায় কাঁটায় বিদ্ধ ও বিক্ষত
ট্রাজিডির করুণ নয়ক যেন চোখের সম্মুখে দেখে
একে একে নিভিছে দেউটি, অগ্নিদগ্ধ স্বর্ণলঙ্কাপুরী
মুহূর্তে বিরাম এই সমগ্র জীবন,
হয়তো সম্মুখ যুদ্ধে হইনি আক্রান্ত
ভূমিকম্প কিংবা ঘূর্ণিঝড় তছনছ করেনি উদ্যান,
তবুও তাকিয়ে দেখি আমি যেন ধ্বংসস্তপ
এর ব্যক্তিগত শোকবর্তা যদিও কারোই মনে
বিশেষ চাঞ্চল্য কিছু জাগাবে না ঠিক
তবুও যেমন একটি গোলাপ বলে, একটি উদ্ভিদ বলে,
এই দেশ বলে, মানুষের সত্তার শুদ্ধতা বলে
আমিও তেমনি বলি সব চেয়ে সত্য আর মর্মান্তিক একটি সংবাদ ;
আমি ছিন্নভিন্ন-
আমার সমস্ত সত্তা ছিন্নভিন্ন, ছিন্নভিন্ন আমার শরীর
ছিন্নভিন্ন, তবুও দাঁড়িয়ে আছি।”
– কবি মহাদেব সাহা।
নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ( কবি, গীতিকার, পঁচিশে বৈশাখ পত্রিকার সম্পাদক) বাঘাযতীনে একটা প্লাম্বিংয়ের দোকান ছিল।
সেখানে আমাদের নিয়মিত আড্ডা হত। সেখানে থাকত অসীম চক্রবর্তী (গল্পকার), শচীন দাস (গল্পকার) আমি, শৌভিক, প্রকাশ সান্যাল (সমাজকর্মী) , কোকিল মিস্ত্রী (প্লাম্বার) আরও অনেকে। সকাল সন্ধায় আড্ডা জমে উঠত। আলোচনা হত রাজনীতি, সাহিত্য, সিনেমা, খেলা, সাম্প্রতিক ঘটনা।
সে সব সোনালীদিনগুলো এত দ্রুত ফুরিয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।
বেদব্যাস পত্রিকা ছিল একটা একান্নবর্তী পরিবারের মতো। পত্রিকাটি বহুদিন প্রকাশিত হয়েছে (অনিয়মিত ভাবে) । নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তো একটা গানই লিখে ফেলেছিল বেদব্যাস নিয়ে। নিজে অপূর্ব সুর দিয়েছিল। আমরা একত্র হলে মাঝে মাঝে আনন্দ উচ্ছাসে সে গান কোরাস গাইতাম
” বেদব্যাস বেদব্যাস বেদব্যাস
আমরা সবাই বেদব্যাস
পাখিদের মতো ডানা ছড়িয়ে
আমরা বেড়াই ঘুরে ঘুরে
এখানে সেখানে কাছে দূরে
আনন্দে সকলে উড়ে উড়ে। “
যে দিন গেছে হারিয়ে, আর ফিরবে না কোনদিনও, জানি, তবু ভাবি।
আজ সব স্মৃতি।
বেদব্যাস পরিবারের আমি ছাড়া আজ আর কেউ নেই।
একদিন কিরণ দা (রবীন্দ্র পুরুস্কার প্রাপ্ত কবি, কিরণশংকর সেনগুপ্ত) তার সম্পাদিত ” সাহিত্য চিন্তা ” পত্রিকা দিতে, আমাকে সাথে করে নিয়ে গেলেল কবি বুদ্ধদেব বসুর বাড়ি। সেই প্রথম বুদ্ধদে্ব বসুর সঙ্গে আমার পরিচয় হল। আগে দূর থেকে দেখতাম তাকে। কাছে গিয়ে পরিচয় করার সাহস হয়নি।
সেই শুরু হল তার কাছে যাতায়াত। কত সময় গিয়ে, অযথা তার কত সময় নষ্ট করেছি, আজ বুঝি। তখন বুঝিনি। কারণ, তিনি তা বুঝতে দেননি।
সেখানেই পরিচয় হয় তার স্ত্রী প্রতিভা বসুর (গল্পকার, উপন্যাসিক), মেয়ে মীনাক্ষি দত্ত (জ্যোতির্ময় দত্তর স্ত্রী) , ছেলে শুদ্ধশীল বসু ( দেশ পত্রিকার শিল্প সমালোচক ছিলেন) সকলের সঙ্গে।
এক সময় তো তাদের বাড়ির লোক হয়ে পড়েছিলাম। কয়েক দিন না গেলে, খোঁজ খবর নিতেন আমার অন্য কোন লোক মারফৎ।
হুট করে সময় নেই অসময় নেই, চলে যেতাম তাদের বাড়ি। মীনাক্ষি দত্ত সে সময় ” বন জ্যোৎস্না” নামে একটি সিনেমার নায়িকা হয়ে ছিলেন।
হুট হাট করে তাদের বাড়ি চলে যেতাম বলে, তাদের কাউকে কখনও বিরক্ত হতে দেখিনি। আমার ছিল অবাড়িত দ্বার।( অবশ্য সকলের জন্য তা ছিল না ।)
ফলে তখন বুঝিনি, তাদের কত সময় অযথা নষ্ট করছি। আজ বুঝে, মনে মনে অনুতাপ করি একা একা।
” বিনিময়
তার বদলে পেলে—
সমস্ত ঐ স্তব্ধ পুকুর
নীল-বাঁধানো স্বচ্ছ মুকুর
আলোয় ভরা জল—
ফুলে নোয়ানো ছায়া-ডালটা
বেগনি মেঘের ওড়া পালটা
ভরলো হৃদয়তল—
একলা বুকে সবই মেলে
তার বদলে পেলে—
শাদা ভাবনা কিছুই-না-এর
খোলা রাস্তা ধুলো-পায়ের
কান্না-হারা হাওয়া—
চেনা কণ্ঠে ডাকলো দূরে
সব-হারানো এই দুপুরে
ফিরে কেউ-না-চাওয়া
এও কি রেখে গেলে। “
– কবি অমিয় চক্রবর্তী।
(ছাব্বিশ).
” চিল্কায় সকাল
কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়
কেমন করে বলি?
কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,
যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান
দিগন্ত থেকে দিগন্তে;
কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে;
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে,
মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।
তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,
স্টেশনে গাড়ি এসে দাড়িয়েঁছে, তা-ই দেখতে।
গাড়ি চ’লে গেল!- কী ভালো তোমাকে বাসি,
কেমন করে বলি?
আকাশে সূর্যের বন্যা, তাকানো যায়না।
গোরুগুলো একমনে ঘাস ছিঁড়ছে, কী শান্ত!
-তুমি কি কখনো ভেবেছিলে এই হ্রদের ধারে এসে আমরা পাবো
যা এতদিন পাইনি?
রূপোলি জল শুয়ে-শুয়ে স্বপ্ন দেখছে; সমস্ত আকাশ
নীলের স্রোতে ঝরে পড়ছে তার বুকের উপর
সূর্যের চুম্বনে।-এখানে জ্ব’লে উঠবে অপরূপ ইন্দ্রধণু
তোমার আর আমার রক্তের সমুদ্রকে ঘিরে
কখনো কি ভেবেছিলে?
কাল চিল্কায় নৌকোয় যেতে-যেতে আমরা দেখেছিলাম
দুটো প্রজাপতি কতদূর থেকে উড়ে আসছে
জলের উপর দিয়ে।- কী দুঃসাহস! তুমি হেসেছিলে আর আমার
কী ভালো লেগেছিল।
তোমার সেই উজ্জ্বল অপরূপ মুখ। দ্যাখো, দ্যাখো,
কেমন নীল এই আকাশ-আর তোমার চোখে
কাঁপছে কত আকাশ, কত মৃত্যু, কত নতুন জন্ম
কেমন করে বলি।”
– কবি বুদ্ধদেব বসু।
সে সময় সিগারেটের পিছনে কোন ফিল্টার থাকত না। অনেক ব্রান্ডের সিগারেট পাওয়া যেত। যেমন, মার্কোপোলো, পলমল, পানামা,সিজার্স,ক্যাপস্টেন, পাচইনশো, রেড এন্ড হোয়াইট, ব্লু এন্ড হোয়াইট।
এখন আর কোনটারই অস্তিত্ব নেই।
বুদ্ধদেব বসুর খুব সিগারেটের নেশা ছিল।
দিনে কুড়ি পঁচিশটা। আর, ব্লু এন্ড হোয়াইট ছিল তার ব্রান্ড। কখনো সিগারেট ফুরিয়ে গেলে, দ্বিধা ভরে, সংকোচে, আমাকে এনে দিতে বলতেন, পকেট থেকে টাকা বের করে, আমার হাতে দিয়ে।
আমি এনে দিতাম।
খুব খুশি হতেন।
এটুকু কাজ তার জন্য করে দিতে পেরে, আমিও ধন্য হতাম, খুশি হতাম।
একদিন সিগারেট এনে দেওয়ার পর, তিনি একটা সিগ্রেট ধরিয়ে নিয়ে হাল্কা একটা টান দিয়ে, একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন আমাকে, তুমি কবি হতে চাও, নাকি কবিতা লিখতে চাও ?
প্রশ্নটা শুনে আমি হতচকিয়ে হই, খুব বিভ্রান্ত বোধ করি।
বললাম, দুটোই।
দুটো একসঙ্গে হয় না।
কবিতা লিখতে চাইলে, মন দিয়ে সারা পৃথিবীর কবিতা পড়। পড়ার পর যদি মনে হয়, তোমার নতুন কিছু বলার আছে। তাহলে লেখ নিজের মতন করে, কবি হওয়ার বাসনা মনের মধ্যে না পুষে রেখে।
আর কবি হতে চাইলে?
আমি কৌতূহলে প্রশ্ন করি।
আমার প্রশ্ন শুনে উনি নিঃশব্দে হাসলেন। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল সে হাসি। ধোঁয়ার আড়ালে সে মুখ অলৌকিক লাগছিল।
উনি বললেন, তাহলে কোন পড়াশুনার দরকার নেই। যা মনে আসে লিখে যাও। আর কবি সন্মেলনগুলোতে নিয়মিত উপস্থিত থেকো,তাহলে কবি তকমা জুটে যাবে।
কথাগুলোর গূঢ় মানে সেদিন ঠিক মত না বুঝতে পারলেও, আজ বুঝি বেশ ভাল ভাবেই।
তার এত সান্নিধ্য পেয়েও, হেলায় হারিয়েছি সেই সব মূল্যবান সময়।
তার কাছে কতকিছু শেখার ছিল।জানার ছিল।
তিনি হিসাব বানান লিখতেন, হিশাব।
তার কারণ জিজ্ঞাসা করায়, তিনি যুক্তি দিয়ে কি সব যেন বলেছিলেন, মনে রাখতে পারিনি, ভুলে গেছি।
তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কবিতা যখন আসছে না, কিছু লিখতে পারছি না, তখন কি করব?
কবিতা আসার জন্য অপেক্ষা করব ?
তিনি বলেেছিলেন, সে সময় দেশ-বিদেশের কবিতা পড়বে। সম্ভব হলে অনুবাদ করবে। তাতে লাভ হবে। নতুন কবিতা আসবে নতুন ভাবনায়।
এ’ভাবেই তো রিলকে, বোদলেয়ারেরর অনুবাদ করেছি।
আজ যদি সামান্য কিছুও লিখতে পারি আমি, তাহলে, তার সান্নিধ্যের ফল তা হয় তো!
তার পানাভ্যাস ছিল বলে শুনেছি। কিন্তু কোনদিন আমান চোখে পড়েনি। আমার তো যাওয়ার আসার, কোন সময় অসময় বলে কিছু ছিল না, তবু কিছু দেখিনি আমি। তবে তার পুত্র শুদ্ধশীল পানোন্মোত্ত থাকত সকাল থেকেই। সেকারণেই অকালে প্রাণটা হারিয়েছে। খুব প্রতিভাবান শিল্প সমালোচক ছিলেন।
আমাদের এই গড়িয়া কেন্দ্রিক নাকতলা রামগড়ে যেমন অনেক লেখক কবিরা থাকতেন (আগেই তাদের কথা বলেছি) , তেমনি বের হত অনেক পত্র পত্রিকা। রমেশ পুরকায়স্তের- দরোজা, সুপ্রিয় বাগচীর – Kavita, দীপাঞ্জন দত্তর – আবর্ত,বসন্ত দাসের – অশনি, আমাদের বেদব্যাস, অশোক মিত্রের দেয়া, অমিত গুপ্তের – শকুন্তলা(বাউল মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হত), কেদার ভাদুড়ী আর দেবকুমার বসুর (কবি প্রবাল বসুর পিতা) সম্পাদনায় – সময়ানুগ, সুনন্দা মুখার্জীর – দিঙ্মাত্র, সুব্রত রাহার – বিচিত্রা,গৌরী বসুর – খেয়া, কিরশংকর সেনগুপ্তের – সাহিত্যচিন্তা,
নগেন্দ্র দাশের – রাঙামাঠি, বিমল দেব আর অশোক রায়চৌধুরীর – মহাকাব্য প্রভৃতি।
বিমল দেব সেসময় দু ফর্মার এটি প্রেমের কবিতা সংকলন প্রকাশ করে ছিল। তাতে আমার লেখা প্রথম প্রেমের কবিতাটি স্থান পেয়েছিল।
আমাদের সান্ধ্য আড্ডা হত তখন , গড়িয়ার কমলাকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারে। দোকানটি আজও আছে, শুধু আড্ডাটা আজ আর নেই। আড্ডার লোকগুলো, অনেকেই নেই আজ পৃথিবীতেই ।
মহাকালের লীলা সত্যি বড়ই অদ্ভুত। তাই বা বলছি কেন? এটাই তো স্বাভাবিক, পরিবর্তন।
তবু সেই স্মৃতি মনের ভিতরে আজও ঝলমল করে।
” কালের যাত্রার ধ্বনি
কাল কভু চুপ নাহি রয়,
কথা কয়, সে যে কথা কয়।
সে আবার জেগে ওঠে প্রত্যহের জীবন-স্পন্দনে;
সে দুর্বার প্রাণবেগে বেঁচে ওঠে নিত্যের স্মরণে।
দুর্জয় শক্তিতে তার কীর্তি লেখে যুগের প্রাচীরে
শতাব্দীর সাক্ষ্য রাখি, দিবস-নিশীথ-বক্ষ চিরে
গতি চলে তার,
তার সাথে ছন্দ রেখে চলে সিন্ধু নদী পারাবার।
কত প্রভাতের সূর্য হেসে আসে বাড়াইয়া কর,
হেলে পড়ে শোণিতাক্ত দীপ্ত দ্বিপ্রহর,
শোকাচ্ছন্ন অপরাহ্ন আসে,
নিশীথের সুপ্তি ভাঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে ভয়ে অবিশ্বাসে।
তারও পরে আসে সেই দিন
মৃতের কঙ্কাল পরে জেগে ওঠে জীবন নবীন।
বিলুপ্ত প্রত্যাশা কাঁপে শক্তিরূপে বক্ষের পঞ্জরে
সে মূর্ত প্রতীক হয়ে আযাদীর তরে
শতাব্দীর রুদ্ধ দ্বার আঘাতে আঘাতে করি চুর
বন্দীত্ব শৃঙ্খল ভাঙ্গা ধ্বনি শুনে অতি সুমধুর।
শোণিত উচ্ছ্বাসি ওঠে, শিরায় শিরায় জাগে সাড়া,
কোটি কণ্ঠে বেজে ওঠে উদাত্ত গম্ভীর সেই ‘নারা’।
বিদ্যুৎ চমকি যায় শিহরণ লাগে তীব্র বেগে
বজ্রের আরাবে মেঘে মেঘে
নির্ঘোষিয়া স্বর প্রসারিয়া কর
ঊধর্ে্ব তুলি উড়ায় পতাকা
শ্বেত-শ্যাম অর্ধ চন্দ্র-পূর্ণতারা অাঁকা।
শান্তি সাম্য সেবা মৈত্রী ঘোষিয়াছে প্রসারিয়া হাত
কওমী হেলাল আজ দীনি-জমহুরিয়াত!
শানের জলুস চলে রাজপথে দৃপ্ত সুগম্ভীর মহিমায়,
নিত্যকার সূর্য তার সুপ্রসন্ন কিরণ ছড়ায়।
আ-সমুদ্র হিমাচল গিরিদরী বনানীর পারে
তৌহীদের মন্ত্র বাজে ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে।
ওড়ে একই ঝা-ার প্রতীক,
সর্বকালে সর্বদেশে সর্বদিগ্বিদিক
যে জাতি দিয়েছে পাড়ি,
গড়িয়া তুলেছে নিজ দেশ,
ক্ষুদ্র তুচ্ছ ভেদাভেদ করিয়া নিঃশেষ,
মহান ধর্মের সিংহদ্বার
মুক্ত করি রাখিয়াছে, মিলনের মহা-পারাবার
গড়িয়াছে মানুষে মানুষে,
দিয়াছে আসন সব, মানুষের সব জাতিধর্ম-নির্বিশেষে,
যারা মুক্তি লাগি
গড়েছে বাঁশের কেল্লা, যে মহান ত্যাগী
মুক্তির অমৃত ফল করেছে সন্ধান-
যত মহা মানবের প্রাণ
অলক্ষ্যে রহিয়া তারা কালের যাত্রার ধ্বনি শুনি
হেরে নাকি সেই সঞ্জীবনী।
লভিয়াছে তাহাদের উত্তর সাধক
কালের কুটির কক্ষে অবরুদ্ধ ছিল যে আলোক
তাহার এনেছে প্রাণ, দুর্গমেরে করিয়াছে জয়
কাল কভু চুপ নাহি রয়-
কথা কয় সে যে কথা কয়। “
– কবি বেগম সুফিয়া কামাল।
(সাতাশ).
” ১লা মে-র কবিতা
লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে,
কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকায়?
কতদিন তুষ্ট থাকবে আর
অপরের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট হাড়ে?
মনের কথা ব্যক্ত করবে
ক্ষীণ অস্পষ্ট কেঁউ-কেঁউ শব্দে?
ক্ষুদিত পেটে ধুঁকে ধুঁকে চলবে কতদিন?
ঝুলে পড়া তোমার জিভ,
শ্বাসে প্রশ্বাসে ক্লান্তি টেনে কাঁপতে থাকবে কত কাল?
মাথায় মৃদু চাপড় আর পিঠে হাতের স্পর্শে
কতক্ষণ ভুলে থাকবে পেটের ক্ষুদা আর গলার শিকলকে?
কতক্ষণ নাড়তে থাকবে লেজ?
তার চেয়ে পোষমানাকে অস্বীকার করো,
অস্বীকার করো বশ্যতাকে।
চলো, শুকনো হাড়ের বদলে
সন্ধান করি তাজা রক্তের,
তৈরী হোক লাল আগুনে ঝলসানো আমাদের খাদ্য।
শিকলের দাগ ঢেকে দিয়ে গজিয়ে উঠুক
সিংহের কেশর প্রত্যেকের ঘাড়ে।
– কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য।
সে সময় অনেক প্রতিশ্রুতিবান কবি গল্পকারের আবির্ভাব ঘটেছিল যারা পরবর্তীকালে লেখা-লেখি থেকে সরে গেছেন ( যে কোন কারণেই হোক) । তাদের মধ্যে – কবি কমল সাহা, পরেশ মন্ডল, সুভাষ সরকার, গল্পকার উৎপল কুমার দত্ত ( চতুরঙ্গে গল্প লিখত) , অমল চন্দ ( এই দশক – এ লিখত) । আজকাল তাদের কথা লোকে ভুলে গেছে। কৃত্তিবাসের কালেও এমন একজন প্রতিশ্রুতিবান কবি ছিলেন, তন্ময় দত্ত , দীপক মজুমদার (যাদের কোন কাব্য সংগ্রহ নেই) ।
আবর্ত – সম্পাদক দীপাঞ্জনের বাড়ি রবিবার সকালে বসা হত। থাকতাম আমি, বিমল দেব, যতীন সরকার, প্রবীর রায়, স্বনন সেন কখনও আসত শংকর আচার্য( মিনি বাস চালক কবি) প্রমুখ।
আলোচনা হত সাম্প্রতিক লেখা নিয়ে। কবিতা গল্প পড়া হত। আলোচনা হত। আড্ডা ভাঙত একটায় ( তাও দীপাঞ্জনের মায়ের তাড়নায়) ।
দীপাঞ্জনের আসল নাম গনেশ, গনেশ দত্তর সম্পাদনায় সোনার তরী – পত্রিকার দুটো সংখ্যা বেরিয়েছিল।
মা বাবার দেওয়া গনেশ নামটা ওর সংকোচের কারণ ছিল। আমার কাছে তা নিয়ে প্রায়ই অনুযোগ করত, একদিন আমি ওকে দীপঞ্জন নামটা রাখতে বললাম, নামটা ওর মনে ধরল। সেই থেকে গনেশ হল দীপাঞ্জন। সোনার তরী নাম করন করা হল – আবর্ত। তারপর থেকে দীপাঞ্জন দত্তর সম্পাদনায়
নির্বিচ্ছিন্ন ভাবে আবর্ত বেরিয়েছে, যতদিন পর্যন্ত ও বেঁচে ছিল।
তারপর আবর্ত প্রকাশের সমস্ত দায়িত্ব ভার কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন একা কবি অর্ধেন্দু চক্রবর্তী।
সহযোগী হিসাবে বিমল দেব, যতীন সরকার আর আমি ছিলাম।
বহু বছর পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছে অর্ধেন্দু চক্রবর্তীর সুযোগ্য সম্পাদনায়। তিনিও আজ আর নেই।
অর্ধেন্দু চক্রবর্তীকে শুধু মাত্র কবি হিসাবেই অনেকে জানেন। কিন্তু তারা জানেন না। সমসাময়িক দেশি বিদেশি সাহিত্যের প্রতিভূ ছিলেন তিনি।
তার কাছেই প্রথম জানতে পারি, কাফকার সাহিত্য বিশেষত্বের কথা । গিনসবার্গের কবিতার কথা, মায়াকভস্কির কবিতার ইংরেজি অনুবাদ তার কন্ঠে শুনি, ইয়েভতুমেংকো অনুবাদ তার ভাষায় পড়ি।
লালন, রামকৃষ্ণের ভাব ধারা তার লেখা পড়ে জানতে পারি।
ইরানের আধুনিক গদ্য সাহিত্য , জাপানের কবিতা, গোয়েসলার, সুফি ফতেহ আলী ওয়াসী, সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের – শক্তি, সুনীল, তুষার রায়, পৃথ্বিশ গাঙ্গুলী (শিল্পি) , দীপেন বন্দোপাধ্যায় ( পরিচয় গোষ্ঠির গল্পকার) তাদের নিয়ে এমন ভাবে আলোচনা করতেন, আমি বিমূঢ় বিস্ময়ে, মুগ্ধ হয়ে শুনতাম সে সব কথাগুলো। শুনতে শুনতে তাদের লেখা, পড়ার আগ্রহ মনে তৈরী হত। সুযোগ মতো, খুঁজে পেতে তাদের লেখা পড়তাম। পড়ে ঋদ্ধ হয়েছি।
এই প্রসঙ্গে, আরও দু এক জনের নাম করতে হয়, যারা আমার মনে সহিত্যের বীজ গোপনে বপন করে ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় (রবীন্দ্র পুরুস্কার প্রাপ্ত) , যজ্ঞেশ্বর রায় (দস্তয়ভক্সির জীবনি লিখে – সোভিয়েত দেশের নেহেরু পুরস্কার প্রাপ্ত) ।
গৌরী বসুর খোয়াই পত্রিকায় আমি প্রথম পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হই।
তারপর একদিন দেশপ্রিয়র ” সুতৃপ্তি ” – তে পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন কবি শংকর চট্টোপাধ্যায়। সেই শুরু, আজ তিনিও আর আমাদের মধ্যে নেই।
একসময় সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের ( বর্তমানে চলচিত্র বিশেষজ্ঞ, সমালোচক) অস্তিত্ব অনস্তিত্ব সংক্রান্ত পবিত্র মুখার্জীর কবিতার বইটির উপর একটি সুন্দর প্রবন্ধ লিখে আমাদের মধ্যে আলোড়ণ তুলেছিল, একটি চটি বইও বেরিয়ে ছিল। সে বইটি পড়ার পর। কৌতূহল বশতঃ আমি পবিত্র মুখার্জীর সব কবিতার বইগুলি ধীরে ধীরে পড়ে ফেলি। আজ বুঝি পড়ে কতটা লাভবান হয়েছি। আজও তার কবিতা পড়ে আলোড়িত হই।
রূপকথা
খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে,
স্বপ্নের ঝিকিমিকি আঁকা যেখানে।
এখানে রাতের ছায়া ঘুমের নগর,
চোখের পাতায় ঘুম ঝরে ঝরঝর।
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের,
আকাশের নীল রং ছাউনিতে এর।
পরীদের ডানা দিয়ে তৈরি দেয়াল,
প্রজাপতি রং মাখা জানালার জাল।
তারা ঝিকিমিকি পথ ঘুমের দেশের,
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের।
ছোট বোন পারুলের হাতে রেখে হাত,
সাতভাই চম্পার কেটে যায় রাত।
কখনও ঘোড়ায় চড়ে হাতে নিয়ে তীর,
ঘুরে আসি সেই দেশ চম্পাবতীর।
এই খানে আমাদের মানা কিছু নাই,
নিজেদের খুশি মত কাহিনী বানাই।
– কবি আহসান হাবীব।
(আঠাশ).
আমার কী এসে যাবে
আমি কি নিজেই কোন দূর দ্বীপবাসী এক আলাদা মানুষ?
নাকি বাধ্যতামূলক আজ আমার প্রস্থান,
তবে কি বিজয়ী হবে সভ্যতার অশ্লীল স্লোগান?
আমি তো গিয়েছি জেনে প্রণয়ের দারুণ আকালে
নীল নীল বনভূমি ভেতরে জন্মালে
কেউ কেউ চলে যায়, চলে যেতে হয়
অবলীলাক্রমে কেউ বেছে নেয় পৃথক প্লাবন,
কেউ কেউ এইভাবে চলে যায় বুকে নিয়ে ব্যাকুল আগুন।
আমার কী এসে যাবে, কিছু মৌল ব্যবধান ভালোবেসে
জীবন উড়ালে একা প্রিয়তম দ্বীপের উদ্দেশ্যে।
নষ্ট লগ্ন গেলে তুমিই তো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
সুকঠিন কংক্রিটে জীবনের বাকি পথ হেঁটে যেতে যেতে
বারবার থেমে যাবে জানি
‘আমি’ ভেবে একে-তাকে দেখে।
তুমিই তো অসময়ে অন্ধকারে
অন্তরের আরতির ঘৃতের আগুনে পুড়বে নির্জনে।
আমাকে পাবে না খুঁজে, কেঁদে-কেটে, মামুলী ফাল্গুনে।
– কবি হেলাল হাফিজ।
[ লেখা – ৪.৮.৮০
কাব্যগ্রন্থঃ- যে জলে আগুন জ্বলে]।
জলে যেমন বুড়বুড়ি কেটে বুদ্বুদ উপরে উঠে আসে,সে-ভাবেই স্মৃতির অতল থেকে বুড়বুড়ি কেটে উঠে এল, একদিনের একটা ঘটনার কথা। সেটা বলি।
কেশব মুখার্জী সম্পাদিত স্বাধীন বাংলা পত্রিকার প্রকাশ উপলক্ষ্যে একটা কবি সভার আয়োজন করা হয়েছিল, যাদবপুর কফিহাউজে।
আহ্বাহক ছিলেন বোধহয় জ্যোতির্ময় দত্ত ( বুদ্ধদেব বসুর জামাই, কলকাতা পত্রিকার সম্পাদক) । আমন্ত্রিতদের মধ্যে এসেছিলেন, কবি অরুণ মিত্র, কিরণশংকর সেনগুপ্ত, শক্তি চ্যাটার্জী, আরও অনেকেই ছিলেন, সবার নাম মনে করতে পারছি না। আর আমরা তরুণ প্রজন্মের কবিরা তো ছিলামই।
উদ্বোধনী সঙ্গীতের পর, কবিতা পড়তে উঠলেন কবি অরুণ মিত্র। দুটি কবিতা পড়েছিলেন, সাম্প্রতিক লেখা কবিতা। তারপর শক্তি আমাদের শোনালেন প্রথমে, অবনী বাড়ি আছ- কবিতাটি।
পরে শুরু করলেন পড়তে – ” পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল টলমল “
ততক্ষণে, জ্যোতি দা, পিটার স্কচের বোতল খুলে ফেলে, বড় একপেগ অরুণ মিত্রের দিকে এগিয়ে দিলেন। তিনি সাবলীল ভাবে হাতে নিয়ে, সহজ ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে পান করতে লাগলেন।
ততক্ষণে শক্তির কবিতা পাঠ শেষ হয়েছে। কবিতা পাঠ করতে উঠলেন, কবি কিরণশংকর সেনগুপ্ত।
শক্তিদা Podium (মঞ্চ) থেকে নীচে নেমে এ বসতেই, জ্যোতিদা তার হাতে বড় এক পেগ দিলেন। শক্তিদা সেটা হাতে নিয়ে স্রেফ জল পান করার মতোন করে, এক চুমুকে গ্লাসটা শেষ করে ফিরিয়ে দিলেন।
কিরণ দা সাম্প্রতিক লেখা দুটি কবিতা পড়েছিলেন।
কিরণ দা মঞ্চ থেকে নেমে আসার পর, জ্যোতিদা তাকেও অফার করলেন।
কিরণদা অভ্যেস নেই বলে, একগাল হেসে প্রত্যাখান করলেন। সে পেগটা জ্যোতিদা নিজেই টেনে দিলেন, সকলকে একটু আড়াল করার ভঙ্গিতে। একটু পরে কেশবকে দিলেন।
আর কাকে কাকে দিলেন যেন, লক্ষ্য করিনি অতোটা। মন দিয়ে কবিতা পাঠ শুনছিলাম।
হঠাৎ করে জ্যোতিদা আমার হাতটা টেনে নিয়ে, আমার হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিলেন। আমার তখন ছুঁচো গেলার অবস্থা। কিরণদার সামনে খাব কখনও ভাবিনি। আমি ইশারায় কিরণদাকে দেখিয়ে গ্লাস ফেরৎ দিতে গেলাম। জ্যোতিদা তার স্বভাবসুলভ তাচ্ছিলের স্বরে বললেন, গুলি মারো, টেনে দাও। আমিও জ্যোতিদার কথা আর উপেক্ষা করতে পারলাম না। আমি কিরণদাকে আড়াল করেই গ্লাসে চুমুক দিলাম। জ্যোতিদার হাতে গ্লাস ফেরৎ দিয়ে দেখি, কিরণদা বিস্ময়ে বড় বড় চোখ করে আমাকে দেখছেন। ভাবলেন বোধহয়, দু একটা কবিতা লিখেই, এদের পাল্লায় পড়ে, একেবারে গোল্লায় গেছে ছেলেটা। যাই হোক, সে কবিতা পাঠের আসরটি জমে উঠেছিল দারুণ, সকলের আন্তরিক সহযোগিতায়।বহুদিন মনে রাখার মতো একটি অনুষ্ঠান, তাই আজও মনে আছে।
কেশব মুখার্জীর স্বাধীন বাংলার আর একটি অনুষ্ঠানে ( নেতাজী নগরে হয়েছিল) কবি বিপুল চক্রবর্তী ও অনুশ্রী চক্রবর্তীর ( বিপুল -স্ত্রী) সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আজও তাদের গান কবিতা আমাকে টানে ।
স্বাধীন বাংলার আর একটা অনুষ্ঠান কেশব করে ছিল বাংলা একাডেমিতে। সেখানে নামকরা অনেক কবি কবিতা পাঠ করে ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন জয় গোস্বামী। জয়ের পরেই আমাকে কবিতা পাঠের জন্য ডাকা হল।
প্রথমে আমি আমার একটা সাম্প্রতিক লেখা কবিতা পাঠ করলাম।
জয় দেখলাম কবিতা না শুনে, তার গুনমুগ্ধের স্তুতিতে বিগলিত খুশিতে হাসছে। আমার মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল। জয়ের পিছনে একটু লাগার ইচ্ছে হল। উদাত্ত কন্ঠে শুরু করলাম পাঠ।
কবি
ছোট কবি বড় কবি মেজ কবি ওরা
কবিদের মধ্যেও ভাগ করে কারা ?
যাদের স্বার্থ থাকে তারা ভাগ করে
বড় কবি গড়ে ওরা ব্যবসাটা সারে।
এতদিন শক্তিকে বড় কবি বলে
ব্যবসাটা গিয়েছিল মোটামুটি চলে
শক্তির বয়স হয় শক্তিও কমে
বড় কবি খুঁজতেই ঘাড়ে মেদ জমে।
এতদিনে পাওয়া গেল জয় গোস্বামী
মোহে পড়ে জয়ও ভাবে মহাকবি আমি।
জয় কোন কথা না বলে, নিঃশব্দে কবতাটি শুনল। পাঠ শেষে ফিরে এলে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল। কি বলে ছিলেন, মনে নেই আজ।
ঐ ঝড়ো হাওয়া আর পোড়ো দরজাটা,
মেলাবেন তিনি মেলাবেন-
কবি অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার সুর মিলিয়ে ছিল কেশব স্বাধীন বাংলার সম্পদনায়, দুজনকে একসঙ্গে যুক্ত করে। একজন জ্যোতির্ময় দত্ত ( নিন্দুকদের চোখে CIA- এজেন্ট) অন্যজন আজিজুল হক ( নকশাল নেতা) । দু জন দুই ভাবধারার মানুষের একত্রিকরণের কাজ একমাত্র কেশব মুখার্জীর দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল।
(উনত্রিশ).
” দারিদ্র্য রেখা
আমি নিতান্ত গরীব ছিলাম, খুবই গরীব।
আমার ক্ষুধার অন্ন ছিল না,
আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় ছিল না,
আমার মাথার উপরে আচ্ছাদন ছিল না।
অসীম দয়ার শরীর আপনার,
আপনি এসে আমাকে বললেন,
না, গরীব কথাটা খুব খারাপ,
ওতে মানুষের মর্যাদা হানি হয়,
তুমি আসলে দরিদ্র।
অপরিসীম দারিদ্র্যের মধ্যে আমারকষ্টের দিন,
আমার কষ্টের দিন, দিনের পর দিন আরশেষ হয় না,
আমি আরো জীর্ণ আরো ক্লিষ্ট হয়ে গেলাম।
হঠাৎ আপনি আবার এলেন, এসে বললেন,
দ্যাখো, বিবেচনা করে দেখলাম,
দরিদ্র শব্দটিও ভালো নয়, তুমি হলে নিঃস্ব।
দীর্ঘ নিঃস্বতায় আমার দিন রাত্রি,
গনগনে গরমে ধুঁকতে ধুঁকতে,
শীতের রাতের ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে,
বর্ষার জলে ভিজতে ভিজতে,
আমি নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে গেলাম।
আপনার কিন্তু ক্লান্তি নেই,
আপনি আবার এলেন, আপনি বললেন,
তোমার নিঃস্বতার কোনো মানে হয় না,
তুমি নিঃস্ব হবে কেন,
তোমাকে চিরকাল শুধু বঞ্চনা করা হয়েছে,
তুমি বঞ্চিত, তুমি চিরবঞ্চিত।
আমার বঞ্চনার অবসান নেই,
বছরের পর বছর আধপেটা খেয়ে,
উদোম আকাশের নিচে রাস্তায় শুয়ে,
কঙ্কালসার আমার বেঁচে থাকা।
কিন্তু আপনি আমাকে ভোলেননি,
এবার আপনার মুষ্টিবদ্ধ হাত,
আপনি এসে উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দিলেন,
জাগো, জাগো সর্বহারা।
তখন আর আমার জাগবার ক্ষমতা নেই,
ক্ষুধায় অনাহারে আমি শেষ হয়ে এসেছি,
আমার বুকের পাঁজর হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে,
আপনার উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে
আমি তাল মেলাতে পারছি না।
ইতিমধ্যে আরো বহুদিন গিয়েছে,
আপনি এখন আরো বুদ্ধিমান,
আরো চৌকস হয়েছেন।
এবার আপনি একটি ব্ল্যাকবোর্ড নিয়ে এসেছেন,
সেখানে চকখড়ি দিয়ে যত্ন করে
একটা ঝকঝকে লম্বা লাইন টেনে দিয়েছেন।
এবার বড় পরিশ্রম হয়েছে আপনার,
কপালের ঘাম মুছে আমাকে বলেছেন,
এই যে রেখা দেখছো, এর নিচে,
অনেক নিচে তুমি রয়েছো।
চমৎকার!
আপনাকে ধন্যবাদ, বহু ধন্যবাদ!
আমার গরীবপনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার দারিদ্র্যের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার নিঃস্বতার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার বঞ্চনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার সর্বহারাত্বের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আর সবশেষে ওই ঝকঝকে লম্বা রেখাটি,
ওই উজ্জ্বল উপহারটির জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।
কিন্তু,
ক্রমশ,
আমার ক্ষুধার অন্ন এখন আরো কমে গেছে,
আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় এখন আরো ছিঁড়ে গেছে,
আমার মাথার ওপরের আচ্ছাদন আরো সরে গেছে।
কিন্তু ধন্যবাদ,
হে প্রগাঢ় হিতৈষী, আপনাকে বহু ধন্যবাদ!”
– কবি তারপদ রায়।
কলেজ ফেরৎ কখনও গেছি, কাঁকুলিয়া রোডে সুশীল রায়ের বাড়ি। আবার কখনও গেছি ঢাকুরিয়া ব্রীজের নীচে সুনীল গাঙ্গুলীর বাড়ি। আবার কখনও ঢাকুরিয়া ব্রীজ পেরিয়ে এসে, ঢাকুরিয়া স্টেশন রোডে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি কিংবা ফণিভূষণ আচার্যের বাড়ি। এভাবেই কলেজের দিনগুলো ফুরিয়ে আসছিল।
আমার সাথে সাউথ সিটি কলেজে পড়ত শুভ মুখোপাধ্যায় ( গল্পকার শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র) । ও তখন কবিতা লিখত, ভাল কবিতা লিখত।
বাক সাহিত্য প্রকাশনী ওদের ছিল। সেখান থেকে নিয়মিত মাসিক “কালি কলম” পত্রিকা প্রকাশিত হত। ওর সাথে, ক্লাস অফ থাকলে, শিল্প সাহিত্য নিয়ে গভীর আলোচনা হত। বেশ সমজদার ছিল।
সে সময় দেখেছি, অনেক প্রকাশনী থেকেই মাসিক বা ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হত।
মিত্র ঘোষ প্রকাশনী থেকে ” কথা সাহিত্য” প্রকাশিত হত। আসলে তখনকার প্রকাশকরা এখান থেকেই প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন নতুন লেখক কবিদের খুঁজে পেতেন, তাদের নতুন বই প্রকাশ করতেন। আজকাল সে রেওয়াজ নেই।
কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে ( বি. কম) পাশ করে বের হই। তার কিছুদিন পরেই আমি আর শ্যামল মজুমদার ( গল্পকার) মিলে বের করি “সোনালি বয়স”। শ্যামল থাকত কলাবাগান লেন ( নবীনা সিনেমা হলের কাছে) । তখন একদিন শ্যামলের সঙ্গে যাই কাছেই হরিপদ দত্ত লেনে গল্পকার – উপন্যাসিক বরেন গাঙ্গুলীর বাড়িতে।
অমায়িক আড্ডাবাজ মানুষ। একদিনের পরিচয়েই আপন করে নিলেন। তিনি সুন্দরবনের বাদার কোন একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, নামটা এখন আর মনে নেই। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও তখন একটা স্কুলে পড়াতেন ( কালিঘাট অরিয়েন্টাল সেমিনারী), সেখানেও গেছি তার কাছ থেকে লেখা আনতে “সোনালি বয়স” পত্রিকার জন্য।
সে সময় আমার অধিকাংশ সময়টাই কাটত গোল পার্কের পুরনো বইয়ের দোকানে, বসন্ত মন্ডল, প্রভাস হালদার, নির্মল, রাম, পি. এন. দা, সত্য, কালিপদ প্রমুখদের সঙ্গে। নানা ধরণের বইপত্র ঘেঁটে, নেশাতুর আমেজে কাটত। রাতে বাড়ি ফিরতাম সে আমেজেই বুঁদ হয়ে। কতদিন যে সেভাবে কেটেছে তার কোন হিসেব নেই।
শক্তি চ্যাটার্জী আর সুব্রত রুদ্রের সম্পাদনায় সে সময় প্রকাশিত হয় “দৈনিক কবিতা”। প্রতিদিন প্রকাশিত হত। সুশীল রায়ের কবিতা ঘন্টিকার ( ঘন্টায় ঘন্টায় প্রকাশিত হত) পর এ আর এক চমক ছিল আমাদের কবিদের কাছে।
কবিতা নিয়ে কী রকম উন্মাদনা ছিল আমাদের মধ্যে ( একবার ভেবে দেখুন) , না হলে প্রতিদিন কবিতা পত্রিকার প্রকাশ, আজকাল ভাবা যায়?
আমার এই সাহিত্য জীবনের পাশাপাশি সমান্তরাল (Parallel) আর এক কঠিন বাস্তবের কঠোর জীবন যাপন করতে হয়েছে আমাকে। সে কথা কাউকে কখনও জানতে দিইনি, বুঝতে দিইনি।
এখানে তার খানিকটা সংকোচে নিবেদন করি।
বাবার মোটেও ইচ্ছে ছিল না পড়াশুনা করে অযথা পয়সা নষ্ট করি।
আমি ক্লাস ফোর পাশ করার পরই তার ইচ্ছেয় একটা চায়ের দোকানে কাপ ডিস ধোয়ার কাজে ঢুকি, মাসিক পাঁচ টাকা বেতন। বাবা তো খুব খুশি সংসারের সুরাহা হবে খানিকটা। সে সময় পাঁচ টাকার দাম অনেক, বিশেষ করে অভাবের সংসারে। ওখানেই হয়তো শেষ পর্যন্ত টিকে যেতাম।
কিন্ত একট ঘটনা ঘটার ফলে তা আর হল না।
একদিন কয়েকটা গ্লাস, মালিকের তাড়নায়, দ্রুত ধুয়ে আনার সময় হাত থেকে একটা গ্লাস পড়ে ভেঙে যায়। মালিক তখন চা করছিল , গ্লাসটা পড়ে ভেঙে যেতে দেখে, আমার গায়ে গরম জল ছুঁড়ে দিলেন। আমার গা হাত অনেকটা পুড়ে গেল।
বাড়ি ফিরে এলে মা দেখে জ্বলে উঠলেন। বাবাকে বললেন, চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়, তুমি কোরো। আমার ছেলেকে আমি পড়াব , দরকার হলে ঠোঙা বানিয়ে দোকানে বেচে ওর পড়ার খরচ চালাব। বাস্তবিক, করেছিলেনও তাই। যা কথা, তাই কাজ। ঠোঙা বানিয়েই আমাকে পড়ার খরচ জুগিয়েছেন উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত। আমার মা খুব দৃঢ়চেতা ছিলেন। যা করবেন বলে একবার ঠিক করতেন, যত প্রতিকূলতাই থাক, হতাশ হতেন না। তিনি তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভিমুখে বাঁধা কাটিয়ে এগোতে যেতেন। সফলতা বাধ্য হত তার কাছে ধরা দিতে। এ আমার বহুবার দেখা ঘটনা।
বাবা মার হয়তো ধারণা ছিল, ছেলে গ্রাজুয়েট হয়ে বেরোলে, নিদেনপক্ষে একটা কেরানির চাকরি জুটে যাবে সরকারী বা বেসরকারী সংস্থায়। সংসারের কিছুটা সুরাহা হবে। অনেকের জুটেও গেল ব্যাঙ্কে, পোষ্ট অফিসে,রেলে, কাস্টমসে, ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ে, তদবির তদারকি করে । আমার কিছুই জুটলো না। কাউকে তদবির তদারকি করার মত মানসিকতা বা যোগ্যতা আমার ছিল না। নতুবা কত নামী দামী লোকের সঙ্গে তখন পরিচয় ছিল। কাউকে মুখ ফুটে কখন বলতে পারিনি আমার অভাব অনটনের কথা দ্বিধা সংকোচে।
জন সেবক পত্রিকায় কিছু স্টাফ রিপোর্টার নেবে জানতে পেরে, সুনীলদা( গাঙ্গুলী) আমার জন্য একটা সুপারিশ পত্র লিখে দেবেন বলেছিলেন, আমার আর গিয়ে, তার কাছ থেকে তা আনা হয়নি, সংকোচে।
” ময়ূর দিয়েছে
একটি ময়ুর তার পেখমের সবটুকু অভ্র ও আবীর দিয়েছে আমাকে।
একটি ময়ূর তার হৃদয়ের বিছানা বালিশে
মশারির টাঙানো খাটে, দরজায়, জানালায়, নীল আয়নায়
অতিথিশালার মতো যখন-তখন এসে ঘুমোবার, হেঁটে বেড়াবার
সুখটুকু, স্বাধীনতাটুকু
সোনার চাবির মতো হাতে তুলে দিয়েছে স্বেচ্ছায়।
এটোঁ কলাপাতা ঘেঁটে অকস্মাৎ জাফরাণের ঘ্রাণ পেয়ে গেলে
ভিখারীরা যে রকম পরিতৃপ্ত হয়,
সে রকমই সুখ পেয়ে হাঁসের মতন ডুবে আছি
হিমে-রোদে, জলে স্থলে, জয়ে পরাজয়ে।
মনে হয় নিমন্ত্রণ পেয়ে গেছি নক্ষত্রলোকের।
কখন অজ্ঞাতসারে পকেটে কে পুরে দিয়ে গেছে ভিসা পাসপোর্ট
সব উড়োজাহাজের এয়ারপোর্টের
সমুদ্রের কিনারের সব কটি উচু মিনারের।
রেশমের, পশমের, মখমলের মতো শান্তি সঙ্গী হয়ে আছে।
একটি ময়ূর তার হৃদয়ের অপর্যাপ্ত অভ্র ও আবীরে
আমার গায়ের আঁশ, ক্ষয়, ক্ষতি, ক্ষত, অক্ষমতা
সব কিছু রাঙিয়ে দিয়েছে।
– কবি পূর্ণেন্দু পত্রী।
[কাব্যগ্রন্থ – হে সময় অশ্বারোহী হও।]
(ত্রিশ).
[ কবিতার সঙ্গে সহবাস ]
(১).
“কবি কোন তকমা নয়, কবি এক বিশেষ পরিচয়
মনের ভাব যার কথায়, ছন্দে চিত্রে প্রকাশ পায়।”
– কবিতা মিত্র।
সব বিদ্যে শেখানো যায়, কবিতা লেখা শেখানো যায় না। ওটা যার হয় তার হয়, ভিতরের ব্যাপার ( অনুভূতির তীব্র আবেগে, প্রকাশের তাগিদ)। তবে আজকাল বানানো কবিতার ছড়াছড়ি, চোখে পড়ে।
কবিতা আসে স্বতস্ফূর্ত ভাবে, ছন্দ মাত্রা তাল লয় ভেবে আসে না। কবি অনেক সময় তা নিয়ন্ত্রণ করে, তার জ্ঞান বুদ্ধি শিক্ষা দিয়ে, সে নিয়ন্ত্রণে, কবিতা অনেক সময় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
ভিতরে কবিত্ব বোধ থাকলে তবেই হবে নতুবা সবটাই যাবে ফাঁকি।
বিদেশে কবিতা লেখা শেখাবার কিছু স্কুল আছে অবশ্য , সেখানে লেখা শিখে কেউ বড় কবি হতে পেরেছেন বলে শোনা যায়নি।
সুনীল গাঙ্গুলী , সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত প্রমুখেরাও আশির দশকে কলকাতায় সে রকম একটা প্রচেষ্টা করেছিলেন , কৃত্তিবাস পত্রিকার পক্ষ থেকে , সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তারা কোন সৃষ্টিশীল কবি তৈরী করতে পারেননি দেখেই, সেই পরিকল্পনা থেকে অচিরেই সরে আসেন ।
(২).
দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে কবিতার সঙ্গে সহবাস আমার, তবু কতটুকু বুঝতে বা জানতে পেরেছি তাকে? স্পষ্ট করে বলতে পারব না। সে আজও আমার কাছে সম্পূর্ণ রহস্যময়, আগের মতো সমান আকর্ষণীয়।
তবু যতটুকু বুঝেছি তাকে, তা নিয়ে কিছু বলাটা বোধহয় অসমীচীন হবে না।
অন্য কোন কবির, কবিতা লেখার পদ্ধতির কথা জানি না। তবে, নিজের লেখার পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা বলতে পারি, যা একান্ত ব্যক্তিগত, যদি কারও কোন উপকারে আসে, তাই বলা।
আমি কোন কবিতা লিখি না, বরং কবিতাই আমাকে দিয়ে কিছু লিখিয়ে নেয় , কেমন করে তাও বলি শুনুন।
আচমকাই এক একটা পংক্তি কোথা থেকে এসে মাথায় ঢুকে পড়ে, যার কোন রকম পূর্ব প্রস্তুতি থাকে না।
তারপর সেটা মনে মনে লালন করার পর্ব শুরু হয়, দ্বিতীয় পংক্তির জন্য প্রার্থনা চলে,
মনে মনে। সেটা কখন আসবে তা কেউ জানে না।
আমি মনেকরি, কবিতা লেখা পার্টটাইম জব নয়, ফুলটাইম ওয়ার্ক। নিরবিচ্ছিন্ন ব্যাপার, ভোরে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা থেকে শুরু হয় , তারপর ঘুমের আগে অবধি চলে কবিতা সৃজনের কাজ মনে মনে। ঘুমের ভিতরও অনেক সময় চলে স্বপ্নে।
অনেক সময় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে,
হঠাৎ একটা পংক্তি এসে বিরক্ত শুরু করে, সকালে উঠে আর সেটা মনে থাকে না, তাই আমি তখনই সেই পংক্তিটি লিখে রাখার চেষ্টা করি আজকাল। হাতের কাছে যা পাই তাতেই লিখে রাখি তখনকার মতো, প্রেসক্রিপশনের উল্টো পিঠে, ক্যালেন্ডারের ছেঁড়া পাতায়,লন্ড্রির বিল, কিংবা কিছু কেনাকাটার রসিদ ইত্যাদি হাতের কাছে যা পাই তাতেই।
সকালে উঠে, প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম সেরে, চায়ে চুমুক দিতে দিতে,পংক্তিটি নিয়ে মনে মনে নাড়া চাড়া করি। আওড়াই বার কয়েক উচ্চারণ করে। ভিতরে ভিতরে কবিতাটি লেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় বলা চলে।
সব সময় সফল হই তা নয়, প্রায়শই বিফল হই, কখনও সখনও সফলতা আসে তাঁর ( কার সেটা বলা মুশকিল) অনুগ্রহ পেলে। লেখাটা পূর্ণতা পায়। রাজশেখর বসু অবশ্য কবিতাকে, সরস্বতীর বরপুত্র বলেছেন। তাঁর কথা অনুযায়ী দাঁড়ায়, সরস্বতীর কৃপা।
নিজের মনঃপূত না হলে, তার উপরও কাটাকুটি চলে, যতক্ষণ না পর্যন্ত তুষ্টি আসে মনে। এইভাবেই আমার কবিতা লেখার প্রক্রিয়া চলে, বলা যায়।
কবিতার নিজস্ব একটা ভাষা আছে , তা আয়ত্ব করতে বহুদিন সময় লাগে, দেশী বিদেশী ভাল ভাল কবিতা পড়তে হয় বারবার, অনুসন্ধিৎসু থাকতে হয় মনে মনে, পূর্বসূরীদের লেখা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা একান্ত জরুরী, হঠাৎ ভূঁই ফোড়ের মতো কিছু হয় না।
ভাবতে হয় সে’সব লেখা নিয়ে নিয়মিত, দীর্ঘদিন এ’রকম প্রচেষ্টার ফলে, তা কিছুটা আয়ত্বাধীন হয়। তারপর চলে নিজের মতো করে তার উপর পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ। সেটা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়।
আমার মনেহয় হঠাৎ করে এসব আয়ত্ব করা সম্ভব নয়। যারা এ’কথা বিশ্বাস করেন না, বা বোঝেন না, কিংবা মানেন না, তাদের কবিতা লেখার প্রচেষ্টা, ছন্দ মিলিয়ে পদ্য লেখা ছাড়া, তা’ আর বেশী কিছু হয় বলে আমার মনে হয় না।
সে’রকম লেখাই আজকাল চোখে পড়ে বেশী , যাতে কোন প্রাণের সাড়া মেলে না।
মূর্তি গড়া হয় বটে, তা কখনই প্রতিমা হয়ে ওঠে না। প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায় না।
কবিতা মানে তো তাই, যা সহজেই মানুষের চিত্তে চাঞ্চল্য ঘটায়, মনে করুণার উদ্রেক করে, নর নারীর বন্ধনকে মধুর করে কিংবা বিরহকে করুণ সুরে মনে অনুরণন সৃস্টি করে এবং হিংস্র ক্রুদ্ধ যোদ্ধার মনেও সান্ত্বনা ও স্বস্তি এনে দেয়।
মানুষ কাব্যে সান্ত্বনা খোঁজে, জীবনের দিকদর্শন চায়, আনন্দ খোঁজে এই নিরানন্দময় জীবনে। আমার তো মনে হয় তাই। নতুবা পাঠক অযথা কবিতা পড়তে যাবেন কেন, আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে, যেখানে মানসিক উপভোগের সব রকম সামগ্রীই সহজলভ্য।
বস্তুতঃ বহু শতাব্দী ধরে এ’কারণেই, কবিতা টিঁকে আছে আজও তার নিজস্ব সত্তা ও অস্তিত্ব নিয়ে, বহাল তবিয়তে। থাকবেও ভবিষ্যতে আশা করা যায়।
এ’ব্যাপারে পাঠকদের সুচিন্তিত মতামত প্রত্যাশা করি।
(৩).
কবিতা সরাসরি কথা বলে না। কবিতা লেখা হয় সান্ধ্যভাষায়, তাই বহুক্ষেত্রে কবিতার ভাষা ইঙ্গিতবাহী, শঙ্খ ঘোষ যাকে বলেন, কবিতার অবগুন্ঠণ।
সে ইঙ্গিত সূক্ষ্ম হতে পারে, আবার স্থুলও হতে পারে।
স্থুল ইঙ্গিত কবিতার নিয়মিত পাঠকেরা সহজেই ধরতে পারেন, বুঝতে পারেন।
সূক্ষ্ম ইঙ্গিত সকলের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় বলে, সে’সব কবিতাগুলো দূরহ বলে মনে হয়, তাদের কাছে। কবিতায় দুর্বোধ্যতা ভিন্ন ব্যাপার।
সূক্ষ অনুভূতিতন্ত্রের লোকেরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন সে’সব লেখা, অবশ্য তাদের সংখ্যা খুবই কম।
কবিতা ভাষা যেহেতু ইঙ্গিতবাহী সেকারণে – রূপক, চিত্রকল্প, উৎপ্রেক্ষণ, নিপুণ শব্দ ব্যাবহারের আশ্চর্য দক্ষতা, সব কিছুই বিশেষ ভাবে ফুটে ওঠে কবির কবিতায়, ভাবে ও ভাষায়।
অবশ্য কবিতা লেখার সময় এতসব ভেবে কবিতা লেখা হয় না। কিংবা বলা ভাল লেখা যায় না।
কবিতা লেখার পূর্বেই এ’সব নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াগুলে চলতে থাকে নিঃশব্দে,মনের ভিতরে ভিতরে। এইসব প্রক্রিয়াগুলো, মানসিক ভাবে কবিকে তৃপ্ত করতে পারলে, তবেই কবিতাটি ভূমিষ্ট হবার সুযোগ পায়।
কবি তার প্রয়োজনে ছন্দকে ব্যবহার করেন তার কবিতায়, অবশ্য সর্বদাই সে ছন্দের অনুশাসন মেনে চলবেন এমন কোন কথা নেই।কোথায়ও ছন্দের একচুল কম বেশী হলে, তিনি গায়ে মাখেন না। কবির মূখ্য লক্ষ্য থাকে কবিতাটির সুষ্ঠ বিন্যাস। তিনি মনে করেন, ছন্দ যদি পুরোপুরি কবিতাকে শাসন করে, তবে
অনেক সময়,কবিতার স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয়।কবিতা খর্ব হয়ে পড়ার সম্ভবনা থেকেই যায়।
অবশ্য ছান্দসিকের সেটা মনঃপূত না হতেই পারে, তাতে কবির কিছু এসে যায় না।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায, ররীন্দ্রনাথের একটি কবিতার ছন্দ প্রয়োগ নিয়ে, ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন একদা আপত্তি তুলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তার তেমন কোন গুরুত্ব দেননি। কারণ ছন্দ ঠিক রাখতে গেলে, কবিতার ভাব বিভ্রাট ঘটত।
ছান্দসিকরা ভুলে যান, কবিতার জন্যই ছন্দ, ছন্দের জন্য কবিতা নয়। ছন্দ কবিতার বাহন মাত্র, তার বেশী কিছু নয়।
ছন্দ মানুষকে বেশী মাতাতে পারে, তার একটা নিজস্ব চুম্বক আকর্ষ আছে, যা যে কোন প্রাণীকেই অমোঘ ভাবে টানে। তাই কবিতায় ছন্দ অপরিহার্য না হলেও কাঙ্খিত। কারণ, তাতে সহজেই মানুষের মনে দোলা দিয়ে, কবিতার ভাব সঞ্চারে সহজ সহায়তা করে।
কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন,
‘কোন কবিতা ছন্দে লেখা হবে, তা ভিতরে ভিতরেই ঠিক হয়ে যায়,কবিতাটি ভূমিষ্ট হবার পূর্বেই।’
প্রত্যেক মনীষারই এক বিশেষ ক্ষমতা থাকে, সে তার নিজের জগতে সিদ্ধ, কবির সিদ্ধিও তার কাব্য সৃষ্টির ভিতরে। অবশ্য তার মানে এই নয় যে কবি ব্যবহারিক জীবনে অকর্মণ্য, বরং সাধারণ বুদ্ধিমান লোকের মত, সে তার ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম।
কবিতা মূলত লোকশিক্ষা নয়, কিংবা তাকে রসসিক্ত করে পরিবেশন নয়, তাই যদি হতো তবে “সদ্ভাব শতক” শ্রেষ্ট কাব্যের মর্যাদা পেত, তা কিন্তু পায়নি। কিংবা খনার বচন কবিতা বলে গণ্য হতো। তা হয়নি কখনও।
স্লোগান কিংবা কোন বাণীও সেই অর্থে কবিতা নয়।
সামজিক পরিবর্তেন দায় কবির নিজের ঘাড়ে না নেওয়াই বাঞ্ছণীয়। তার জন্য সমাজপতিরা রয়েছেন। কবির কাজ সমাজপতিত্বের দায় কাঁধে তুলে নেওয়া নয়। অবশ্য তার মানে এই নয় যে তিনি সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কনবেন না। অবশ্যই করবেন, করবেন তা তার নিজস্ব ভাষার পরিমন্ডলের মধ্যে, তা কখনও, সমাজপতিদের মতো উচ্চকিত স্লোগান ধর্মী হবে না। কবি কখনই অসামজিক মানুষ নয়, ফলে তার কবিতায় সামাজিক প্রতিচ্ছবি ফুঠতে বাধ্য, সৎ কবি কখনই সমাজ ত্যাগ করে গজদন্ত মিনারে বাস করে কবিতা লেখেন না আজকাল। তিনি আর পাঁচ জন মানুষের মতো এই সমাজেরই একজন বাসিন্দা। তাই তাকেও অন্য সকলের মতো হাঁট বাজার করতে হয়। ফলে সমাজের ভাল-মন্দের দায় তার উপরও বর্তায় বইকি। তিনি সমাজের সঙ্কটময় মুহূর্তে নীরব থাকতে পারেন না বা থাকেন না।
এই জন্যই বোধহয়, দার্শনিক এরিস্টটল কবিকে ‘সমাজের সদা জাগ্রত প্রহরী’ বলে
অভিহিত করেছেন।
অবশ্য তার গুরু সক্রেটিস ভাবতেন, সমাজে কবির কোন কাজ নেই, ফলে সমাজে তার কোন স্থান নেই। অসামাজিক মানুষ তিনি। কবি শঙ্খ ঘোষ যাকে শ্লেষ করে অনায়াসে বলেছেন,
“মূর্খ বড় ,সামাজিক নয়”।
কবিতা পাঠ একটা একটা সতন্ত্র রসাস্বাদনের ব্যাপার। সে স্বাদ গ্রহণের জন্য পাঠকেরও প্রয়োজন হয় মনে মনে প্রস্তুতি গ্রহণের, নতুবা তার কাছে, সে’রসের স্বাদ অধরাই থেকে যায় আজীবন।