সোনার হরিণ নেই (Sonar Harin Nei) : চার
আবু রব্বানী বলেছিল, যদি মরদ হোস তো একদিন শোধ নিবি। একটা চোখ ছোট করে অন্য চোখ সটান তাকিয়ে শুধিয়েছিল, কি রকম শোধ বুঝলি?
চৌদ্দ বছরের বাপী মাথা নেড়েছিল, বুঝেছে। আবুর কল্যাণে এর ঢের আগে থেকেই না-বোঝার মতো কত কি জল-ভাত তার কাছে। তাছাড়া না বুঝলে নিজের কপাল নাক মুখ তো অক্ষতই থাকত। শোধ নেওয়ার কোনো কথাই উঠত না। তবু আবু রব্বানীর কথাগুলো নতুন করে মনে পড়েছে বাপীর।
পরের দুদিনও একটা অবুঝ অস্থিরতা সকালে-বিকেলে গলায় শেকল পরিয়ে এ পর্যন্ত টেনে এনেছে তাকে। এই সাতাশি নম্বর বাড়িটার দরজা পর্যন্ত। শুধু অস্থিরতা নয়, এক ধরনের অব্যক্ত উপোসী যন্ত্রণাও। শুকনো দুই ঠোঁট বার বার জিভে ঘষেছে। নিজের একদিনের সেই থ্যাতলানো মুখের রক্তের নোনতা স্বাদ লেগেই আছে। সেই ফয়সালা বাকি। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার স্বপ্ন দেখতে অসুবিধে হয়নি। কল্পনার জগতের সোনার সিংহাসনেও চেপে বসা গেছে। তারপর এক মেয়ের সঙ্গে চরম কিছু ফয়সালার মুখোমুখি এসে থেমে গেছে। সেটার ছক কোনো সময় মনের মতো হয়নি।
সেটা আজও বাকি। সেই মেয়ের দেখা মেলার সঙ্গে সঙ্গে নিভৃতের একটা অস্বাভাবিক বিশ্বাস মগজে দাগ কেটে বসেছে। ফয়সালা হবে বলেই এত বড় দুনিয়ায় এত বছর বাদে আবার দেখা তার সঙ্গে।
ভিতরে ভিতরে এমন একটা নাড়াচাড়া না পড়ে গেলে বাপী তরফদার হয়তো আর একটু মাথা খাটিয়ে বাস্তবের মাটিতে পা ফেলে চলত। গত পরশু আর কাল শুক্রবার আর শনিবার গেছে। এ দুদিনের হাজিরায় কোনরকম ব্যাঘাত ঘটেনি। সকাল সাড়ে নটার আগে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দেয়ালের নেম-প্লেটের নামটা মুখস্থ হয়ে গেছে। অনিমেষ ঘোষ, অ্যাডভোকেট। মালবিকার মায়ের বাবা হবে হয়তো। মুখ দেখে আর বয়েস আন্দাজ করে সেইরকমই মনে হয়েছে।
…পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়নি। প্রথমে বই বুকে করে বেণী দুলিয়ে ওই মেয়েকে সুতৎপর গাম্ভীর্যে গাড়িতে উঠে বসতে দেখেছে। তিন দিনে তিন রকমের শাড়ি পরতে দেখল। যেদিন যেটা পরেছে সেটাই যেন সব থেকে ভালো মানিয়েছে। গাড়িতে ওঠার ফাঁকে বাপীর দিকে চোখ গেছে। উল্টো দিকের রকে আর দোতলার বারান্দায়ও। দোতলার বারান্দায় সোনালি ফ্রেমের চশমা। রকে দুটো তিনটে বা চারটে ছেলে। বাপীকেও এদের মতোই নতুন একজন ধরে নেওয়া হয়েছে, সন্দেহ নেই। চিনতে না পারাটা বাপীর ক্ষতর ওপর নুন ছড়ানোর মতো লেগেছে।
এক আধ মিনিটের মধ্যে বয়স্ক ভদ্রলোক গাড়িতে এসে ওঠেন। দোতলার বারান্দায় তখন মালবিকার মা মনোরমা নন্দীর অপ্রসন্ন মুখখানাও দেখা যায়। গাড়িটা সকলের নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে গেলে তিনি ভিতরে পা বাড়ান বিকেলেও একই ব্যাপার। পাঁচটা পনের থেকে কুড়ি মিনিটের মধ্যে সাদা গাড়ি সাতাশি নম্বরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। ওই মেয়ে আগে নেমে ভিতরে চলে যায়। পিছনে বয়স্ক ভদ্রলোক। তাঁর কোনদিকে বা কারো দিকে চোখ নেই। আত্মতৃপ্ত সুখী মানুষ মনে হয়। রকে সেই দুটো তিনটে বা চারটে ছেলে। সামনের দোতলার ।বারান্দায় সেই সোনালি ফ্রেমের চশমা। আর সাতাশি নম্বরের দোতলার বারান্দায় মনোরমা নন্দীর অপ্রসন্ন মুখ।
…গত বিকেলেও বাড়িতে ঢুকে পড়ার ঝোঁক অনেক চেষ্টায় সামলেছে বাপী তরফদার। আজ রবিবার। কলেজ বন্ধ। সকাল সাড়ে আটটা না বাজতে ভিতরের দুর্জয় তাড়না তাকে এখানে ঠেলে নিয়ে এসেছে। এমনিতে দেখা পাওয়ার আশা কম। আজ বাপী ভিতরে ঢুকেই পড়বে। তারপর যা হয় হবে। এরকম ঝোঁকের ফলেই অন্য কোনো বাস্তব সম্ভাবনা তার হিসেবের মধ্যে ছিল না।
খাবার লোভে বা সঙ্গিনীর লোভে কোনো বেপাড়ার কুকুর সীমানা লঙ্ঘন করে ঢুকে পড়লে পাড়ার সগোত্র-দল সেটা যেমন বরদাস্ত করে না, ঘেউ ঘেউ রব তুলে চারদিক থেকে ছেঁকে ধরে আঁচড়ে কামড়ে ওটাকে পাড়া-ছাড়া করতে চায়—হঠাৎ সেই গোছের দাঁড়াল অবস্থাখানা। রোববারের রকের মজলিশে জন পাঁচেক বসে। পর পর কদিন সকাল-বিকেলে দুবেলা একটা উটকো লোককে ওই সাতাশি নম্বর বাড়ির সামনে টহল দিতে দেখেছে তারা। সামনের দোতলা বাড়ির সোনালি ফ্রেমের চশমা পরা সুশ্রী লোকটাও দেখেছে। সকলেরই একসঙ্গে ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।
আগেও এদের হাব-ভাব সদয় মনে হয়নি বাপী তরফদারের। তা বলে এরকম অতর্কিত হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সাতাশি নম্বরের সামনে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে রকের ছেলেগুলো উঠে এসে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। ওদের এক মুরুব্বির হাত সোজা তার কাঁধের ওপর উঠে এলো।
—কি মতলব ব্রাদার?
বাপী তরফদার জবাব হাতড়ে পেল না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।
পাশ থেকে একজন সোল্লাসে ফোড়ন কাটল, অসুবিধে দেখে ব্রাদার বোবা হয়ে গেছে, দু’ঘা না বসালে কথা বেরুবে না।
এসব মজার ব্যাপারের চট করে গন্ধ পায় লোকে। অবশ্য একটু চেঁচামেচিও শুরু হয়ে গেছে। এদিক ওদিক থেকে বাচ্চা-কাচ্চারা স-কলরবে দৌড়ে আসছে। রাস্তার দুদিকেরই দোতলার বারান্দায় লোক দেখা যাচ্ছে। ভেবাচাকা খাওয়া মুখ তুলে বাপী তরফদার তাদেরও দেখল একবার। এদিকে মালবিকা… মিষ্টি… রেলিংএ ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে। পাশে তার মা। ওদিকে সেই সোনালি ফ্রেমের চশমা। পাশে আরো দুই-একজন। পরিস্থিতি জমে উঠতে যারা তাকে ছেঁকে ধরেছে তাদেরও উল্লাস বেড়েছে। এদিক ওদিক থেকে ধাক্কা মেরে কথা বার করতে চেষ্টা করছে। মুরুব্বিটি কাঁধে একটা বড় ঝাঁকুনি দিয়ে তর্জন করে উঠল, জিভ টেনে ছিঁড়ব বলে দিলাম। কি মতলবে রোজ দুবেলা এখানে এসে ছোঁক ছোঁক করা হচ্ছে?
নিরুপায় বাপী তরফদার এবারে সাতাশি নম্বরের বাড়িটাই দেখিয়ে দিল। ওখানে ঢোকার জন্যে।
ছেলেগুলো থমকে গেল একটু। সকলেই বাড়িটার দিকে তাকালো। দলের
মুরুব্বি এবারে যথাসম্ভব গলা মিষ্টি করে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, মাসিমা কদিন ধরে এই লোকটা আপনাদের বাড়িতে ঢোকার জন্যে ঘুরঘুর করছে বলছে— একে চেনেন নাকি?
সরোষে মাথা নেড়ে মনোরমা নন্দী ভিতরে চলে গেলেন। মেয়ে দাঁড়িয়েই থাকল।
কাঁধ ছেড়ে মুরুব্বি এবার মুঠো করে বুকের জামা টেনে ধরল তার।—শালা মেরে একেবারে তক্তা বানিয়ে দেব—পাড়ায় ঢুকে এত সাহস তোমার?
সঙ্গে সঙ্গে এদিক-ওদিক থেকে জামা ধরে টানাটানি চলল। জামাটা ফ্যাস—ফ্যাস করে ছিঁড়তে থাকল। কাঁধে কোমরে দুই-একটা গুঁতোও পড়ল। একজন চুলের মুঠি চেপে ধরেছে।
সামনের বাড়ির দোতলা থেকে সোনালি, ফ্রেমের সুশ্রী তরুণ গম্ভীর নির্দেশের সুরে বলল, ঘাড় ধরে পাড়ার বার করে দিয়ে এসো, আর যেন না ঢোকে!
এই নির্দেশ মতোই কাজ করল ছেলেগুলো। মারধরের দিকে না গিয়ে রাস্তা পার করে দেবার জন্যেই সামনের মোড় পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে চলল তাকে। যে লোভে নিজেরা সকাল-বিকেল রকে বসে থাকে সেই লোভেই আর একজন একটু বেশি এগিয়ে এসেছে বলে কত আর হেনস্থা করা চলে। আশা তো কারোরই নেই, চোখে দেখাই সার। মোড়ের এধারে ছেড়ে দিয়ে শুধু শাসালো, আর এদিকে রস করতে এসো না ব্রাদার, ওই অসিতদা না বললে আজ তোমার মিষ্টি মুখখানা একেবারে থেঁতো হয়ে যেত।
তার ওপর দিয়ে বিস্ময়ের পলকা রঙ চড়ালো আর একজন। —কি ব্যাপার বল্ তো মাইরি, ওই অসিতদার সব থেকে বেশি কলজেয় জ্বালা ধরার কথা, আর সে-ই আগেভাগে ক্ষমা করে ফেলল।
মুরুব্বি গম্ভীর মন্তব্য করল, রোমান্টিক গ্রেটনেস। থাম্ এখন—
বাপীকে বলল, যাও বাছা, ঘরের ছেলে ঘরে চলে যাও —
ওরা ফিরে চলল। বাপী তরফদার সেদিকে চেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সামনের বাড়ির দোতলার সোনালি ফ্রেমের চশমা-পরা পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ফর্সা লোকটাই অসিতদা হবে। একটা মেয়ের জন্য তারও কলজে পুড়ছে আগেই বুঝেছিল। এখন আরো ভালো বোঝা গেল।
হনহন করে হেঁটে চলল বাপী তরফদার। কারো দিকে তাকাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সকলেই আস্ত ট্রাউজারের ওপর লণ্ডভণ্ড ছেঁড়া জামাটা দেখছে। আক্রোশের একটা জ্বলন্ত পিণ্ড গলার কাছে দলা পাকিয়ে আছে। সেখান থেকে একটা অসহ্য তাপ চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ছে।
এত বড় হামলাটা যারা করল, রাগ এই মুহূর্তে তাদের ওপর নয়। গুষ্টির পিণ্ডি ওই অসিতদা না কে, তার ওপরেও নয়। আক্রোশ নিজের ওপর। আরো বেশি দোতলার রেলিং-এ ঝুঁকে দাঁড়ানো ওই মেয়ের ওপর। যার নাম মালবিকা। মিষ্টি তাকে ঘিরে সেই মেয়ে একপাল পথের কুকুরের খেয়োখেয়ির মজা দেখছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।…আবু রব্বানী বলেছিল, মরদ হোস তো শোধ নিবি। সেই চরম শোধের নিষ্ঠুর অভিলাষ শিরায় শিরায় জ্বলছে এখন।
উঠোনে পা দিতেই রতন বনিকের বউ কমলার সঙ্গে চোখাচোখি। এটাই সব থেকে অবাঞ্ছিত বাপী তরফদারের। উঠোনের একধারের বাঁধানো কলতলায় শুধু কমলা ছাড়া আর কেউ নেই। বেলা দশটার ওধারে এখন কারোরই থাকার কথা নয়। ছুটির দিনে পুরুষেরা ভালো-মন্দ বাজার করে আনে, তারপর ঘরে বসে বা বাইরে কোথাও আড্ডায় মশগুল হয়। মেয়েরা রান্নায় ব্যস্ত থাকে। টিউব—ওয়েলের হাতল চালিয়ে কমলাকে ওখান থেকে জল নিতে কমই দেখা যায়। তার ঘরের জল এমন কি স্নানের জলও রতনই তুলে দেয়। তাদের রান্নাঘরের পিছনে ছোট ঘেরানো স্নানের জায়গা আছে। আব্রু যাদের তাদের অনেক ঘরেই এরকম ব্যবস্থা।
আজ হয়তো কোনো কারণে জল ফুরিয়েছে। রবিবারে বেলা দুটো আড়াইটের আগে রতনের টিকির দেখা মেলে না। বাজার ফেলে দিয়েই সে বেরিয়ে পড়ে। ছুটির দিন মানেই তার কিছু বাড়তি রোজগারের দিন। বেশ খানিকটা আদর-কদর মেলার দিন। অনেক ক্লায়েন্ট জোটে। কোনো কোনো রবিবারে আবার আপিসের বাবুদের বাড়িতেও ভবিষ্যৎ-বচন শোনাতে যেতে হয়।
অন্য দিন হলে টিউবওয়েলের হাতল চালিয়ে কমলার ঘড়ায় জল ভরার দৃশ্যটা দেখতে মন্দ লাগত না বাপীর। আজ ভিতরটা ডবল চিড়চিড় করে উঠল। শুধু ওর হেনস্থা দেখার জন্যেই যেন বউটা এ সময় ওখানে দাঁড়িয়ে।
কমলার এদিকে অর্থাৎ সামনের দিকে মুখ। উঠোনে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি। টিউবওয়েলের হাতল হাতেই থেকে গেল। নামছে উঠছে না। কমলার দু’চোখ কপালে।
ওই দৃষ্টি থেকে সরোষে নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে বাপী তরফদার ঘরে ঢুকেই ঠাস করে দরজা দুটো বন্ধ করে দিল। নড়বড়ে দরজায় ছিটকিনি নেই, ছেড়ে দিতেই চার ছ’ আঙুল ফাঁক আবার।
পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে ক্যাঁচ করে একটা মৃদু শব্দ কানে আসতেই বাপীর ঝাঁজালো দৃষ্টি দরজার দিকে। এক পাট খুলে কমলা ঘরে ঢুকল। শাড়ির আঁচলে ভিজে হাত মুছতে মুছতে দু পা এগিয়ে এলো। বাপী তার খাটিয়ায় বসে। ছেঁড়া—খোঁড়া জামাটাও গা থেকে খোলার ফুরসৎ পেল না। দু চোখের উগ্র ঝাপটায় ওকে আবার ঘর থেকে বার করে দিতে চায়।
চোখের বিস্ময় মুখে নেমে এলো কমলার। ব্যাপার কি গো বড়বাবু মারামারি-টারামারি করে এলে নাকি কোথাও থেকে?
এই অবস্থা দেখে ঢুকেছে যখন এমনিতে ঘর ছেড়ে যাবার মেয়ে নয় কমলা। বাপী কি করবে এখন? জবাবে উঠে এসে ধাক্কা মেরে বার করে দেবে?
কমলা খুঁটিয়ে দেখছে ওকে। উসকোখুসকো চুল, ক্রুদ্ধ বিবর্ণ মুখ, ছেঁড়া—খোঁড়া ঝলঝলে জামা। চকিতে কাছে এগিয়ে এলো সে। বাপীর হাঁটুর লাগালাগি প্রায়। তারপর ঝুঁকে ছেঁড়া জামার ভিতর দিয়ে গা দেখতে চেষ্টা করল। আঘাতের দাগ চোখে পড়ে কিনা সভয়ে তাই দেখছে।
বাপীর গলার কাছে একটা গরম নিঃশ্বাসের ছেঁকা লাগল। পরের মুহূর্তে মাথায় ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠে গেল। দুটো চোখের শলাকা কমলার ঝুঁকে পড়া মুখ থেকে নেমে বুকের ওপর বিদ্ধ হল।…বহুদিনের উপোসী ক্রুদ্ধ জানোয়ারটাকে এই মুহূর্তে খোলস ছিঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেবে? স্থান ভুলে কাল ভুলে রসাতলে ডুবে যেতে দেবে? আজকের অত বড় অপমানের জ্বালা জুড়োবে তাহলে?
আবার সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কমলা বিষম থতমত খেল এক প্রস্থ। দু’পা পিছনে সরে গেল। এরকম চাউনির একটাই অব্যর্থ অর্থ হতে পারে বুঝি। কৈফিয়তের সুরে বলল, কোথাও লাগল-টাগল কিনা দেখছিলাম….
ফাঁড়া কাটলো। নিজের কি সামনে যে দাঁড়িয়ে তার, বাপী জানে না। মাত্র কটা মুহূর্তের মধ্যে নিজের সঙ্গে অনেক যুঝে অশান্ত ক্রুদ্ধ জানোয়ারটাকে আবার খোলসের ভিতরে ঠেলে দিতে পেরেছে। কিন্তু তার ধকল চোখেমুখে এখনো এত স্পষ্ট যে কমলাও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে মনে হল। বাপী তার মুখের ওপর রূঢ় ঝাপটা মেরে বসল একটা।—কেন দেখছিলে? কেন তোমরা এভাবে জ্বালাতন করো আমাকে?
—আমরা! কমলার বিস্ময়-ঝরা দু’চোখ তার মুখের ওপর নড়েচড়ে স্থির হল।…অন্য কোনো মেয়ের জ্বালাতনে আজ এই হাল নাকি তোমার?
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেই চলেছে।—তুমি যাবে এখন এখান থেকে?
কমলা মোলায়েম করে বলল, কি হয়েছে শুনি আগে—উঠোনে পা দিতেই ওই মূর্তি দেখে আমি আঁতকে উঠেছিলাম—
খাটিয়া ছেড়ে বাপী প্রায় তেড়েই এলো, তুমি এক্ষুণি যাবে কি যাবে না আমি জানতে চাই?
কমলা চেয়ে আছে। রাগ ছাড়া কিছু দেখার আছে যেন। এক পাট খোলা দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল। গম্ভীর। শামলা মুখ একটু মচকে বলল, আমার বাড়ি আমার ঘর, তুমি তাড়াবার কে?
—ও। ঠিক আছে, আমিই যাচ্ছি।
অসহিষ্ণু হাতের টানে ছেঁড়া জামাটা ছিঁড়েই গা থেকে খুলে খাটিয়ার ওপর আছড়ে ফেলল। দড়ি থেকে আর একটা আস্ত জামা টেনে নিয়ে সরোষে দরজার দিকে এগিয়েই থমকে দাঁড়াল। এক পাট খোলা দরজা আগলে কমলা তেমনি দাঁড়িয়ে।
দুজনে সোজা তাকালো দুজনের দিকে। বাপীর লাল চোখ। কমলা প্রায় তেমনি গম্ভীর।
—কি হল, যাও?
বাপী ফুঁসে উঠল, সরো বলছি!
পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে একবার বাইরেটা দেখে নিল কমলা। কেউ নেই। থাকলেও এই দিনমানে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করতে দেখলে খুব কিছু মনে করবে না কেউ। বুড়োর গণনা আর বোলচালের ফলে বড়বাবুকে এখনো মস্ত বাবুই ভাবে সকলে।
আবার সোজা তাকিয়ে পলকা ঝাঁজে কমলা বলল, এক বস্ত্রে চলে যাচ্ছ— তোমার ওই রাজ-শয্যা, বাড়তি জামাটামা আর ওই ভাঙা টিনের সুটকেস কার জন্যে রেখে যাচ্ছ?
বয়েস মাত্র বাইশ, কিন্তু নিজের ভিতরের বয়েস কতো এগিয়ে আছে বাপীই শুধু জানে। রমণীর এই তেজ আর এই উক্তির বিপরীত রসের আঁচটুকু ভালোই অনুভব করতে পারে। সভয়ে এদিকটাই এড়িয়ে চলেছে এতকাল। কিন্তু আজ হাতে-নাতে ধরা পড়েছে। এই মেয়ে ভিতর দেখেছে তার। সেই জোরেই এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এমন কথা বলছে।…এক মেয়ের চোখের ওপর অপমানের সেই চাবুকের জ্বালা আষ্টেপৃষ্টে লেগে আছে। এখন সামনে এক হাতের মধ্যে যেভাবে আর একজন দাঁড়িয়ে, তাকে দেখে জ্বালা জুড়োবার সেই ক্রুর লোভ নিজের দুটো চোখের তারায় আবারও চিকিয়ে উঠছে।
এবারে কমলার গলার স্বর মোলায়েম-এ।—ঠাণ্ডা হয়ে বোসোগে যাও। তার পর ইচ্ছে হয় বলবে, ইচ্ছে না হয় বলবে না। আমি কি তোমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছি!
ভিতরের অসহিষ্ণু তাড়না মাড়িয়ে বাপী খাটিয়ায় এসে বসল।
কমলা অনড় তার পরেও। দেখছে। ———এক গেলাস চা করে এনে দেব?
—না!
—বাবা রে বাবা, বাইরে কোথায় কি কাণ্ড করে এসে এখন ঘরের ভালো মানুষদের কাছে যত দাপট আর হম্বি-তম্বি…রান্নাটা সেরে ফেলিগে যাই, তুমিও চানটান করে মাথা ঠাণ্ডা করো।
যেতে যেতে চোখের কোণ দিয়ে খাটিয়ায় বসা মুখখানা আর একবার দেখে নিল।
বাপী সটান শুয়ে পড়ল। স্নায়ুর ওপর দিয়ে আবার এক প্রস্থ ঝড় বয়ে গেছে। অসাড়ের মতো পড়ে থাকল খানিক। নিজের বুকের তলার টিপটিপ শব্দ কানে আসছে। হঠাৎ নিজের ওপরেই আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে লাগল সে। এই পৃথিবীর মুখ একেবারে না দেখলে কি হত? না জন্মালে কি হত? মানুষের খোলসে ঢাকা ভিতরের এই হিংস্র অবুঝ জানোয়ারটাকে আর কতকাল ধরে পুষবে? মাত্র কটা মুহূর্তের জন্য হলেও খোলস ছিঁড়ে নিঃশব্দ হুংকারে ওটা বেরিয়েই এসেছিল। থাবা উঁচিয়েছিল। কমলা দেখেছে। চিনেছে। অথচ সত্যিই তার দোষ নেই। যে মূর্তিতে ঘরে ফিরতে দেখেছে, আঁতকে ওঠারই কথা। ছুটে আসারই কথা।
চোখের সামনে আর একখানা মুখ ভেসে উঠল। সে-ও রমণীর মুখ। অকরুণ মুখ। কিন্তু সেদিন সেই সময়ে খুব অকরুণ ছিল না। মণিদার বউ গৌরী। বাপীর থেকে ছ’ বছরের বড় গৌরী বউদি। রসভঙ্গের এক মূর্তিমান কৌতূকের মতো বাপী তরফদার অসময়ে বাড়ি ফিরেছিল সেদিন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে দেরি তখনো। সেই প্রকাশ্য নির্জনে পাশের লাগোয়া ফ্ল্যাট থেকে কোনো পুরুষের বেপরোয়া অভিলাষের আবেদন এবং এ ফ্ল্যাট থেকে সেটা নাকচের নিঃশব্দ প্রহসন চলছিল। বাপী তরফদার স্বচক্ষে দেখেছে। দোতলার বারান্দা থেকে ওকে দেখে পাশের ফ্ল্যাটের দিকে একটা লঘু ভ্রুকুটি নিক্ষেপ করেছিল গৌরী বউদি। রস-ভঙ্গের ব্যাপারখানা উপভোগ্য ব্যতিক্রমের মতো।
…সেদিনও মাথায় আগুন জ্বলছিল বাপী তরফদারের। অপমান আর হতাশার যন্ত্রণা ভিতরটা কুরে খাচ্ছিল। সেই মূর্তি দেখে কমলার মতো আঁতকে উঠে গৌরী বউদি বসার ঘরের দরজা খুলে ছুটে না আসুক, কাছেই এসে দাঁড়িয়েছিল।
—কি ব্যাপার? এ সময়ে যে?
জবাব না পেয়ে আর একটু এগিয়ে এসে গৌরী বউদি আরো ভালো করে দেখে নিয়েছিল।—এই মূর্তি কেন? কে তাড়া করল?
…সেদিনও বাপী তরফদার স্থানকাল ভুলেছিল। পুরুষের রোষে বাসনা ঝলসে উঠেছিল। মনে হয়েছিল অপমান আর হতাশার আক্রোশ উজাড় করে জাহান্নমে ডুবিয়ে দেবার মতো এক রমণীয় আধার নাগালের মধ্যে দাঁড়িয়ে।
…আর, চোখের সামনে হঠাৎ একটা দুর্বিনীত তাজা পুরুষ দেখেছিল গৌরী বউদি।
কি মনে হতে বাপী তরফদার খাটিয়ায় উঠে বসল। তারপর জামাটা টেনে নিয়ে গায়ে পরল। তাকে চান করে মাথা ঠাণ্ডা করতে বলে কমলা রান্না সারতে গেছে। রান্না শেষ হলেই আবার আসবে। ওকে ঠেলে স্নানে পাঠাবে। তারপর জোর করে ঘরে ধরে নিয়ে গিয়ে খেতে বসাবে। নয়তো এ-ঘরে ওর খাবারটা নিয়ে আসবে। পরে কি হবে বলা যায় না, কমলা গৌরী বউদির মতো নয় এখনো। তার মতো অকরুণ নয়। মায়া দয়া আছে। আছে বলেই ওই উদ্ভ্রান্ত মূর্তি দেখে ছুটে এসেছিল। আর অত ছলা-কলা জানে না বলেই অমন কাছে এসে ছেঁড়া জামার ভিতর দিয়ে ব্যাকুল চোখে গায়ে আঘাতের চিহ্ন খুঁজেছিল। আজ অন্তত কমলা ওকে বাইরে খেতে যেতে দেবে না। বাপী তরফদারের এটা নির্ভুল অনুমান।
আবার একটা অসহিষ্ণুতা ঘরের বাইরে ঠেলে নিয়ে এলো ওকে। তারপর উঠোনে নামিয়ে দিল।
—ও কি! না খেয়ে এ-সময় আবার চললে কোথায়? বড়বাবু শোনো—শোনো বলছি? উঠোনের চারদিকে ঘর, কত আর গলা উঁচিয়ে ডাকতে পারে কমলা?
বাপী তরফদার ফিরেও তাকালো না। হনহন করে বেরিয়ে গেল।
নিরুদ্দিষ্টের মতো হেঁটে চলল অনেকক্ষণ। অনেক পথ। এই করে নিজেকে ক্ষয় করার তাগিদ। কিন্তু ক্ষয় সত্যিই করা যায় না। ক্লান্তি সার। সামনে পার্ক। বকুল গাছের ছায়ায় একটা খালি বেঞ্চিতে গা ছেড়ে বসল। শীতকাল হলেও এই অবেলায় দ্বিতীয় লোক নেই পার্কে।
ক্ষুধা তৃষ্ণা কিছু টের পাচ্ছে না। বুকের দিক থেকে একটা চিনচিন যন্ত্রণা শুধু পেটের দিকে নামছে। সেটা সাতাশি নম্বর বাড়ির সামনের সেই অপমানের যন্ত্রণা হতে পারে। নিজের ভিতরের গ্লানির দরুনও হতে পারে। গ্লানি স্বাভাবিক। ওপরঅলার অভিশাপের মতোই প্রবৃত্তির অবুঝপনা হঠাৎ-হঠাৎ দখল দিয়ে বসে তার ওপর। নইলে বরাবর একটাই লক্ষ্য তার। একজনই লক্ষ্য। আট বছর ধরে ভিতরে বাইরে একজনকেই সে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেছে। আট বছর বাদে তার দেখা মিলেছে।
সব ভুলে বাপী তরফদার দুটো মেয়েকে দেখছে এখন চোখের সামনে। একজনের বয়েস দশ। নাম মিষ্টি। ফুটফুটে রং। ফোলা-ফোলা গাল। মাথায় ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল। বাপী নামে একটা দুরন্ত ছেলে মিষ্টি খেয়ে জল খেতে চায় শুনে সে রাগে ফুঁসছে, জিভ ভেঙাচ্ছে।
…আর একজনের বয়েস আঠের। নাম মালবিকা। গাল দুটো ফোলা নয় একটুও। মেদ-ঝরা সুঠাম দেহ, টানা মুখ। আয়ত চোখ। অনেক কম ফর্সা কিন্তু ঢের বেশি তাজা।…বাপী তরফদারের একটা বয়েস চৌদ্দয় আটকে আছে, আর একটা বয়েস বাইশ ছাড়িয়ে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে কেউ কল্পনা করতে পারে না। ওই মেয়েও না। ওই মেয়ে চেনেও না তাকে। চেনার আগ্রহও নেই। বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হৃষ্টচিত্তে একটা অপমানের প্রহসন দেখেছে শুধু। নিগ্রহ দেখেছে।
বাপী তরফদার সোজা হয়ে বসল। স্নায়ুগুলো সব টান হয়ে উঠল। নিঃশ্বাসে এক ঝলক তপ্ত বাষ্প ঠেলে বেরুলো। চৌদ্দ বছরের একটা ছেলের ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত মুখ দেখছে। সেটা যদি শেষ কথা না হয়ে থাকে, আজকের এই অপমান আর নিগ্রহও শেষ কথা নয়। বাপী তরফদার তা হতে দেবে না।
বছরগুলো পিছনে সরে যাচ্ছে। আট বছর…ন’ বছর…দশ বছর। চোখের সামনে শান্ত গম্ভীর রহস্যে ছাওয়া বানারজুলি এগিয়ে আসছে।