সোনার হরিণ নেই (Sonar Harin Nei) : ২৫
নিজের পৃথিবী বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। জীবন প্রতারণা করেছে? বাপী তরফদার কার ওপর শোধ নেবে? কাকে ক্ষমা করবে? নিজের দুটো পা কপাল পর্যন্ত ওঠে না। নইলে সবার আগে ওটাকেই থেঁতলে দিত। এই কপালের ওপর বড় বেশি আশা ছিল। আস্থা ছিল। প্রেম প্রীতি ভালবাসার কোনো দুর্জয় শক্তির উপর নির্ভর করে বসেছিল। যেন যত খুশি লম্বা দুটো হাত বাড়িয়ে তারা স্থান-কালের গণ্ডী টপকে কারো জন্যে কাউকে আগলে রাখতে পারে। এই বিশ্বাসে সত্তার সব কড়ি উজাড় করে ঢেলে দেয় এমন বোকাও কেউ আছে!
আজ ফিরছে গায়ত্রী রাই জানে না। বাগডোগরায় তাই গাড়িও অপেক্ষা করে নেই। লাউঞ্জে পা দিতেই একদিকের সোফার দিকে চোখ গেল। যাবার সময় যে সোফায় মাস্টারমশাই ললিত ভড়ের মেয়ে কুমকুম বাপীর সামনে এসে বসেছিল। হাওয়া আপিসের এক অফিসার স্ত্রী সাজিয়ে ওকে কলকাতায় নিয়ে যাবে এ আশায় দু মাস ধরে দিন গুনছিল আর এখানে হানা দিচ্ছিল। আত্মনির্ভর জীবনে ফেরানোর আশ্বাস দিয়ে বাপী তাকে আট দশ দিন বাদে বানারজুলির ঠিকানায় দেখা করতে বলেছিল। বাপীর গলা দিয়ে নিঃশব্দ একটা কটূক্তি বেরিয়ে এলো।
এলে কি হবে? রেশমার কাজে লাগিয়ে দেবে, না দূর করে তাড়াবে? বাসনার যে আগুন শিরায় শিরায় জ্বলছে, নাগালের মধ্যে এলে আর কোনো মেয়ের তার থেকে অব্যাহতি আছে!
ইচ্ছে করেই বিকেল পার করে দিয়ে বানারজুলিতে পৌঁছুল। গত এক-দেড় বছরের মধ্যে সাইকেল রিকশা চালু হয়েছে এখানে। একটায় উঠে বসল। রিকশাঅলাটাকে হুকুম করল খুব আস্তে চালাতে। বানারজুলির আকাশ বাতাস জঙ্গল সব অন্ধকারে ডুবে যাক। আরো ঘন হোক, আরো গাঢ় হোক। বুকের ভেতরটা যেমন কালি হয়ে আছে তেমনি হোক।…সেই কবে আবু রব্বানী বলেছিল, তার মুখ দেখলেই ভেতর-বার সাফ মনে হয়, মেমসায়েবের পছন্দ হবে; কিন্তু আজ অন্তত বাপীর নিজের ওপর বিশ্বাস নেই। এই মুখ আজ অন্ধকারেই সেঁধিয়ে থাক!
—মিস্টার তরফদার, এক মিনিট। সাইকেল রিকশার টিমটিম আলোয়ও মুখ চিনে যে লোকটা হাত তুলে ডেকে থামালো, সে চা-বাগানের ক্লাবের ম্যানেজার ডাটাবাবু। রাস্তার উল্টো দিক থেকে হনহন করে আসছিল। ক্লাবে সন্ধ্যায় আসর বসার আগে ফেরার তাড়া সত্ত্বেও ওকে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়ে রিকশা থামিয়েছে।
—কি মুশকিলে পড়েছি বলুন তো, কত দিনের মধ্যে আপনাদের কোনো চালান নেই, এদিকে ভাল মাল প্রায় শেষ—আপনি এখানে নেই খবর পেয়ে আবু রব্বানীর কাছে গেছলাম, ও বলল, আপনি কলকাতা থেকে ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিছু মাল যে আমার এক্ষুনি দরকার।
বাপীর ইচ্ছে হল রিকশা থেকে নেমে ঠাস করে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। তার বদলে ঝাঁঝালো জবাব দিল, আপনার জন্যে আমি ঘরে মদের বোতল মজুত করে বসে আছি যে এক্ষুনি পাঠিয়ে দেব?
মেজাজের ঝাপটায় ডাটাবাবু বেসামাল।—না না, তা বলছি না, যত তাড়াতাড়ি হয়—
—চলো! ঝাঁঝালো বিরক্তির হুকুম রিকশাঅলাকে।
আগের বাঁকের মাথায় নেমে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে ট্র্যাভেল সুটকেস হাতে বাপী বাংলোর দিকে এগলো। বারান্দায় আলো জ্বলছে। মা বা মেয়ে সেখানে বসে নেই। এগিয়ে এসে নিঃশব্দে নিজের বাংলোর গেট খুলে ভেতরে এলো।
ফেব্রুয়ারির শেষ এটা। কলকাতার তুলনায় এখনো এখানে ঠাণ্ডা বেশি। অন্ধকার ঘরের জানালা-টানলাগুলোও না খুললে চলে। তবু টর্চ জ্বেলে বাপী ঘরের ভেতরটা দেখে নিল একবার। সুটকেসটা একদিকে আছড়ে ফেলল। কাধের কোটটা দূর থেকে আলনার দিকে ছুঁড়ে দিল। তারপর বিছানায় সটান শুয়ে পড়ে টর্চ নিভিয়ে দিল। পরনের ট্রাউজার বদলে পাজামা পরার ধৈর্যও নেই।
মাথাটাকে শূন্য করে দেবার চেষ্টা। কোনরকম চিন্তা মাথায় ঢুকতে দেবে না। ভালো না মন্দ না। আশা না হতাশা না। কিন্তু এমন অসম্ভব চেষ্টার সঙ্গে যুঝতে হয়। বাপী যুঝছে।…এই রাত পোহাবে। তখন আর অন্ধকারে সেঁধিয়ে থাকা যাবে না। মুখ দেখাতে হবে। দেখতে হবে। কিন্তু মাথার এই দাপাদাপি বন্ধ না হলে ভোর হবার আগেই পালাতে হবে কোথাও।
কতক্ষণ কেটেছে জানে না। আধ ঘণ্টা হতে পারে। জোরালো আলোর ঘায়ে বিষম চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো।
ঘরের আলো জ্বেলে বিমূঢ় বিস্ময়ে তার দিকে চেয়ে আছে ঊর্মিলা। পরনে সাদা ফ্রক। তার উপর কার্ডিগান। বাপীর মুখখানা ভালো করে দেখে নিচ্ছে।
বিছানার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল।—ফিরে এসে এমন ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছ? তুমি ফিরেছ মা জানে?
সরল বিশ্বাসেও কেউ হিংস্র পশুর খাঁচা খুলে দিলে কি হয়? বাপী চেয়ে আছে। ওর ভিতরের কেউ চিৎকার করে বলতে চাইছে, শিগগির চলে যাও— পালাও। কারণ, আর কেউ ওকে আরো কাছে টানার জন্য লোলুপ হয়ে উঠেছে। মাথা নাড়ল কি নাড়ল না। অস্ফুট স্বরে জিগ্যেস করল, তুমি জানলে কি করে?
—আমি ক্লাবে ডাটাবাবুর জন্য বসেছিলাম। কটা দিনের মধ্যে তোমাদের কারো কোনো খবর নেই…যদি চিঠিপত্র এসে থাকে। ডাটাবাবু বলল, তুমি ফিরেছ আর তোমার মেজাজও খুব খারাপ। কি হয়েছে…তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন?
—কি রকম দেখাচ্ছে?
ঊর্মিলা এতেই অসহিষ্ণু। গায়ের কার্ডিগানটা খুলে অদূরের চেয়ারে ছুঁড়ে দিয়ে আরো একটু কাছে এসে বলল, আমি জানি না, খবর কি বলো?
বাপীর চাউনিটা ওর মুখ থেকে বুকে নেমে আবার মুখে উঠে এলো। এই মেয়ের এমন মুখর যৌবনের দিক থেকে জোর করেই চোখ ফিরিয়ে ছিল এত দিন। আর তার দরকার আছে? ঠিক এই মুহূর্তে যে সংকল্পটা উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেল সেটাকে প্রশ্রয় দেবে, না ঠেলে সরাবে?
জবাব দিল, খবর ভালো না।
সঙ্গে সঙ্গে ঊর্মিলার ফর্সা মুখ ফ্যাকাশে একটু। উদ্গ্রীবও।—আঃ! চেপেচুপে কথা বলছো কেন? কার খবর ভালো না, আমার না তোমার?
মগজে লোভের হাতছানি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নয় কেন? প্রেম ভালবাসার কি মানে? শুধু শব্দ ছাড়া আর কি? মোহ ছড়ায়, ভোলায়। একবার দখলের আওতায় পাকাপাকি ভাবে টেনে নিয়ে আসতে পারলে এই মেয়েরই বা মোহ কাটতে আর ভুলতে কত সময় লাগবে? তবু আরো একবার ভিতরের আর কেউ বাপীকে এই লোভ থেকে ঠেলে সরাতে চেষ্টা করল। জোর করে ও-পাশ ফিরে বলল, আলোটা নিভিয়ে দিয়ে চলে যাও, আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে—
কাল কথা হবে।
কিন্তু ঊর্মিলারও ধৈর্যের শেষ। খাটের ওপর বসে পড়ে এদিক থেকেই ঝুঁকে তার মুখ দেখতে চেষ্টা করল। তারপর চিরাচরিত অসহিষ্ণুতায় এক হাতে বাপীর চুলের মুঠি আর অন্য হাতে বুকের কাছটা ধরে জোর করেই আবার তাকে নিজের দিকে ফেরাতে চেষ্টা করে বলে উঠল, তোমার মাথায় কিচ্ছু যন্ত্রণা হচ্ছে না— কি হয়েছে আমি এক্ষুনি শুনতে চাই। তুমি বলবে কি বলবে না?
বাপীর মুখের ওপর ওর নিঃশ্বাসের হলকা, পাঁজরে মাথায় ওর হাঁটুর ওপরের আর হাতের উষ্ণ স্পর্শ। ঘন নাগালের মধ্যে তপ্ত দুরন্ত যৌবন। যা ঘটার মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল। তারপর ঘটে যেতে লাগল। কঠিন দুটো হাতের ঝটকা টানে ওই সুঠাম নারীদেহ বাপী তরফদারের বুকের ওপর। নরম দুটো অধর নিজের দুটো ঠোঁটে বিদীর্ণ করে করে রসাতলের গহ্বরে তলিয়ে যেতে চাইল। নিজের শক্ত বুকের ওপর ওই উষ্ণ নরম বুক গুঁড়িয়ে দেবার আগে হাত দুটোও আর বুঝি ক্ষান্ত হবে না।
সমস্ত ব্যাপারটা এমন অবিশ্বাস্য যে ঊর্মিলার সম্বিৎ ফিরতেই সময় লাগল খানিকক্ষণ। তারপর প্রাণপণে ওই অমোঘ গ্রাস থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছিটকে নেমে দাঁড়াল। কপালের ওপরে বিশৃঙ্খল চুলের গোছা এক হাতে পিছনে ঠেলে দিল। দেখছে। হাঁপাচ্ছে। দুই চোখ বিস্ফারিত। এই লোককে সে চেনে না, কখনো দেখেনি।
এবারে দুই চোখে ওই নরম দেহ ফালা ফালা করছে। ঠোঁটের হাসি ধারালো ছোরার মতো ঝিলিক দিচ্ছে। গলার স্বরেও কোনো দ্বিধার পরোয়া নেই আর। ঠিক আজই আমি এরকম করে বলতে চাইনি তোমার দিকের খারাপ খবরটা কি। তুমি জোর করে বলালে।
নিজের দুটো কানের ওপরেও বিশ্বাস খুইয়ে বসেছে ঊর্মিলা। হাঁপাচ্ছে এখনো। চেয়েই আছে।
—দেখছ কি? আর অত অবাক হবারই বা কি আছে? এই মূর্তি দেখেই ভেতর আরো নির্মম বাপীর।—এ তো আমার পাওনাই ছিল। ড্রাইভিং শেখানোর গুরুদক্ষিণা হিসেবে অনায়াসে চুমুও খেয়ে ফেলতে পারো, বলেছিলে না? তবে এতে হবে না, এর থেকে ঢের বেশি দক্ষিণা দেবার জন্য তৈরি হওগে যাও।
শুধু চোখে নয়, গলা দিয়েও এবারে অস্ফুট আর্তস্বর বেরুলো ঊর্মিলার।— এ তুমি কি করলে বাপী! তুমি না ফ্রেন্ড? কলকাতায় গিয়ে হঠাৎ কি হয়ে গেল তোমার? তুমি এমন কথা বলছ কেন?
বাপীর হাসিতে এতটুকু মায়ামমতার ছোঁয়া নেই। দু চোখে নরম তাজা দেহ লেহন করছে এখনো। একটু আগের উষ্ণ স্পর্শ আগুন হয়ে মাথার দিকে উঠছে। জবাব দিল, ফ্রেন্ড বলেই আমার দাবি বেশি, কলকাতায় গিয়ে এই বাস্তব বুদ্ধিটুকু নিয়ে ফিরে এসেছি। এমন কথা বলছি কারণ তোমার মা যা চান তাই হবে। আর কদিনের মধ্যে ডলি মিসেস তরফদার হবে। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে?
ঠোঁটে হাসি। গলার স্বর অকরুণ। চোখে আবারও ওকে দখলের মধ্যে টেনে আনার অভিলাষ। ঊর্মিলা সত্রাসে চেয়ে রইল একটু। তারপর ছুটে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। গায়ের কার্ডিগানটা চেয়ারেই পড়ে থাকল।
মিনিট দশেক বাদে বাপী খাট থেকে নামল। ঠাস ঠাস করে ঘরের জানালাগুলো খুলে ফেলল। বাথরুমে এসে চোখে-মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিল। একটা দুর্বোধ্য যন্ত্রণা ভিতর থেকে ঠেলে উঠছে। ওটা নির্মূল করার আক্রোশেই বাপী মাথাটা কলের তলায় পেতে দিল। তোয়ালে মাথায় বুলিয়ে ঘরে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াতে হল।
চেয়ারের কাঁধে হাত রেখে গায়ত্রী রাই দাঁড়িয়ে। মাত্র কটা দিনের অদেখা এই মুখ আরো সাদা, রক্তশূন্য। শরীর আরো খারাপ হয়েছে, না মেয়ে গিয়ে কিছু বলেছে বলে এমন বিবর্ণ মূর্তি বোঝা গেল না। কিন্তু প্রথম কথায় মনে হল না, মহিলা মেয়ের কাছ থেকে বড় রকমের কিছু ধাক্কা খেয়ে এসেছে। এক নজর দেখে নিয়ে বলল, এই ঠাণ্ডায় মাথা ভিজিয়ে এলে, মোছো ভালো করে, জল ঝরছে।
বাধ্য ছেলের মতো ঘরের আর একটা শুকনো তোয়ালে দিয়ে আবার মাথাটা মুছে নিল। একটু সময় দরকার। কিছু শোনার জন্য আর কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি দরকার। তোয়ালেটা জায়গামতো রেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বাপী বলল, বসুন। খুব ভালো দেখছি না তো, কেমন ছিলেন?
—ভালো না।
বেশি অসুস্থ না হলে এরকম বলে না। চিরুনি থেমে গেল। আয়নার ভেতর দিয়ে বাপী তার দিকে তাকালো। মহিলা এখনো দাঁড়িয়ে। ওর দিকেই চেয়ে আছে।
—সেই কষ্টটা আবার বেড়েছিল?
বাজে কথায় সময় নষ্ট হচ্ছে বলেই যেন বিরক্ত।—কষ্ট লেগেই আছে, ও নিয়ে ভেবে কি করবে, তুমি কখন ফিরেছ?
—বেশিক্ষণ নয়। চিরুনি রেখে এগিয়ে এলো। আমি নিজেই তো যেতাম, আপনার কষ্ট করে আসার কি দরকার ছিল।
চেয়ারটা তার সামনে টেনে দিতে গিয়ে বাপীর দু চোখ হোঁচট খেল একপ্রস্থ। ঊর্মিলার কার্ডিগান এখনো চেয়ারেই পড়ে আছে। গায়ত্রী রাই দেখেছে। ঠাণ্ডা মুখে বাপী ওটা তুলে আলনায় রাখল।
গায়ত্রী রাই চেয়ারে বসল। ও খাটে এসে বসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর জিগ্যেস করল, ডলির কি হয়েছে?
জবাব না দিয়ে বাপী চুপচাপ চেয়ে রইল খানিক। ভাবলেশশূন্য এই সাদা মুখ দেখে আশা করছে কি হয়েছে বা কতটা হয়েছে মেয়ে হয়তো এখনো সেটা বলে নি। কিছু যে হয়েছে তাই শুধু বুঝে তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। ফিরে জিগ্যেস করল, ডলি কিছু বলেছে আপনাকে?
—না।
—কি করছে?
—ঘরে গিয়ে বিছানায় আছড়ে পড়ে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে কাঁদছে। ওর বাবা মারা যেতে এভাবে কাঁদতে দেখেছিলাম। তারপর আর দেখিনি। রাগ হলে তেজে ফোটে, কাঁদে না। কি হয়েছে?
মিথ্যের সঙ্গে সত্তার বিরোধ বাপীর। এই একজনের চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলা আরো কঠিন। তাছাড়া একলা ঘরে পশুর মতো যেভাবে দখল নৈওয়া হয়েছিল আর হামলা করা হয়েছিল, কান্না থামলে মেয়ে মায়ের চোখে সেই নিষ্ঠুর লোলুপতার দিকটাই বড় করে তুলবে। শেষ মুহূর্তে সেই দখল না ছিঁড়তে পারলে ওই পশুর হাত থেকে আজ আর অব্যাহতি ছিল না মেয়ে তাও বলতে ছাড়বে না। বাপীর চিন্তায় এখনো কোনো বিবেকের দংশন নেই, কোনো আপোস নেই। এই মুহূর্তে তাই মাথা খুব ঠাণ্ডা।
ধীর গলায় জবাব দিল, আমাকেই বিয়ে করতে হবে, আর কারো চিন্তা আর আমার বরদাস্ত হবে না, আপনার মেয়েকে আজ সেটা আমি খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছি।
গায়ত্রী রাই অপলক চেয়ে আছে। আগের মতো সেই ভেতর-দেখা চোখ। শুধু এ-জন্যেই মেয়ে রাগে না ফুঁসে বা গর্জে উঠে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে এ যেন বিশ্বাস করার মতো নয়। গলার স্বর নীরস একটু।—এ বোঝানোটা আরো অনেক আগে থেকে শুরু করোনি কেন?
—অসুবিধে ছিল।
অপলক চাউনিটা মুখের ওপর বিঁধেই থাকল খানিক। বোঝার চেষ্টা। জিগ্যেস করল, কলকাতায় গিয়ে সেই ছেলের সঙ্গে ফয়সালা করে এসেছ?
—না। এখানে এসে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে মন স্থির করেছি। দেখছেই। পরের প্রশ্নটাতেও তাপ-উত্তাপ নেই।—এতদিন তোমার নিজেরও মন স্থির ছিল না?
ভিতরে ভিতরে বাপী সচকিত। মায়ের কাছে এরপর নালিশ যদি করে ঊর্মিলা, পশুর মতো দখল নেবার কথাই শুধু বলবে না, মিষ্টির কথাও বলবেই। শয়তান বুদ্ধি যোগাচ্ছে বাপীকে। জবাব দিল, ছিল না। কেন ছিল না আপনার জানা দরকার। ডলিকে নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না, সব শুনে আপনি যদি আমাকে বাতিল করেন, সে-বিচার মাথা পেতে নেব।
চাউনিতে ব্যতিক্রম দেখা দিল একটু। জিজ্ঞাসু।
ধীর নির্লিপ্ত সুরে বাপী বলে গেল, ছেলেবেলায় এখানকার এক মেয়েকে আমি খুব পছন্দ করতাম। তখনকার রেঞ্জ অফিসার, জঙ্গলের বড়সাহেব। আমার বাবা তার আন্ডারে সামান্য কেরানী। অত বড় ঘরের মেয়ের সঙ্গে মিশতে চাইতাম বলে হামেশা তারা অপমান করত, তার ছেলে মারত, মা কান মলে দিত। সেই আক্রোশে ওই মেয়ের ওপর আমার পছন্দটা হামলার মতো হয়ে উঠেছিল। সেই পছন্দের শাস্তি কি পেয়েছিলাম এই দেখুন—
একটু অবকাশ না দিয়ে ঘুরে বসে একটানে ট্রাউজারের তলা থেকে শার্টটা টেনে মাথার দিকে তুলে ফেলল সে।
আধ-হাত-প্রমাণ পাঁচ-ছটা এলোপাথাড়ি সাদা দাগ পিঠের চামড়ায় স্থায়ী হয়ে আছে। জামা নামিয়ে বাপী আস্তে আস্তে ঘুরে বসল আবার। গায়ত্রী রাইয়ের সাদাটে মুখ বিমূঢ় এখন
তেমনি নিরুত্তাপ গলায় বাপী বলে গেল, বাবার তখন জ্ঞান ছিল না, চাবুকে চাবুকে বড়সাহেব আর তার মেয়ে আর তার মায়ের আর আরো অনেকের সামনে আমাকে অজ্ঞান করে ফেলেছিল। রক্তে জামা ভিজে গেছল। আমার বয়েস তখন চোদ্দ, সেই মেয়ের দশ। তার কিছুদিনের মধ্যে তারা এখান থেকে বদলি হয়ে চলে যায়। কিন্তু আমি তাদের কোনদিন ভুলিনি, ভুলতে চাইনি। বি-এস-সি পাশ করার পর কলকাতায় যখন চাকরির চেষ্টায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তখন আবার সেই মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আবারও অপমানে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আমি বানারজুলিতে ফিরে এসে আপনাকে পেয়েছি। কিন্তু এই চার বছরের মধ্যেও সেই মেয়ের সঙ্গে ফয়সালার চিন্তা আমার মাথা থেকে যায় নি। এবারে কলকাতা গিয়ে দেখলাম সেই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।
এর পরেও হতভম্বের মতো চেয়েই আছে গায়ত্রী রাই। রাগের চিহ্নও নেই, শুধুই বিস্ময়। এরই ফাঁকে বাপী ভিতরের আশঙ্কা ব্যক্ত করে ফেলল।—
—ডলি হয়তো আপনাকে এই মেয়ের কথা বলেও আমাকে বাতিল করতে চাইবে।
একটু নড়েচড়ে আত্মস্থ হল মহিলা। এবারে সদয় মুখ নয় খুব।—এত সবও ডলিকে তোমার বলা হয়ে গেছে তাহলে?
—আমি একটি কথাও বলিনি। এতটা ও জানেও না। ছেলেবেলার ব্যাপারটা আবু রব্বানী জানত। রেশমা আর দুলারির কাছে আবু সে-গল্প করেছে। ডলি রেশমার মুখ থেকে শুনেছে।
গায়ত্রী রাই ছোট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল একটা। ভালবাসা-টাসা নয়, যে—মেয়ের কথা শুনল তাকে ভুলতে না পারার পিছনে পুরুষের আক্রোশটাই বড় করে দেখছে। অপমান ভোলার ছেলে যে নয় তার থেকে বেশি আর কে অনুভব করতে পারে। তবু জিজ্ঞাসা করল, সেই মেয়ের যদি বিয়ে না হয়ে যেত তাহলে কি করতে?
সত্যি কি বাপীর মুখে শয়তান কথা যোগাচ্ছে? সাদামাটা এক জবাবে মহিলার সমস্ত সংশয়ের অবসান। বলল, তাহলে আমার এতদিনের রোগ ছেড়ে যেত কিনা আমি জানি না।
নীলাভ দুটো চোখের গভীর স্নেহের এমন উৎসও কি বাপী খুব বেশি দেখেছে? গায়ত্রী রাই ওকে দেখছে এখনো। পাতলা ঠোঁটের ফাঁকে সেই স্নেহ হাসির আকার নিচ্ছে। বলল, নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আমার কাছে তোমার ছেলেবেলার কথা তুলে ডলির খুব সুবিধে হবে না।
এতক্ষণে বাপী হাসল একটু।—আপনি যেমন ভাবছেন তেমন সুবিধেও হবে না। আমার জ্বর ছাড়লেও ডলির ছাড়েনি। বেগতিক দেখলে ও এখান থেকে পালাবে, হয়তো চিঠি লিখে বিজয় মেহেরাকে এখানে আনাবে। মাথা ঠাণ্ডা হবার আগে এরকম কিছু না করতে পারে আপনার দেখা দরকার।
স্নেহ-উপচনো ধমকের সুরে গায়ত্রী রাই বলে উঠল, আমার কি দায়! তুমি আগলাবে, তুমি দেখবে। ওর মন ফেরানোর মতো সময় আর সুযোগ কম পেয়েছিলে তুমি?
বাপী চুপ।
—কলকাতায় সেই ছেলের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?
বাপী মাথা নেড়ে সায় দিল।
—কি বুঝলে?
রণে বা প্রেমে নীতির বালাই রাখতে নেই। প্রেমে না হোক, রণে জেতার দুরন্ত জেদ এখন। ঠাণ্ডা জবাব দিল, বড় হয়েই ফিরেছে, ভালো মাইনে, ফ্যাক্টরির মধ্যেই কোয়ার্টারস। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত খাটুনি চলছে এখন, ফুরসত নেই বলে এখানে আসতে পারছে না। এক্ষুনি বিয়েটা করে ফেলতে চায়। একটু থেমে বিরূপ প্রতিক্রিয়াটুকু লক্ষ্য করে যোগ করল, সিগারেট খাওয়াটা আগের থেকেও অনেক বেড়েছে দেখলাম। আর সকাল-সন্ধ্যা কাজে ডুবে থাকার পর রাতে একা ভালো লাগে না বলে ড্রিংকস-এর মাত্রাও বেড়ে গেছে নিজেই বলল।
কাউকে পিছন থেকে ছুরি বসানোর মতো একটা গ্লানি বুকের ভিতরেই গুঁড়িয়ে দেবার আক্রোশ বাপীর।
কঠিন আঁচড়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গায়ত্রী রাইয়ের মুখে। রাগ বেশি হলে অল্প অল্প শ্বাসকষ্ট হয়ই। একটু লক্ষ্য করেই বাপী তাড়াতাড়ি বলল, আপনার শরীর ভালো দেখছি না, এ-সব কথা এখন থাক
—কলকাতায় তাকে তুমি কি বলে এসেছ?
—বলেছি আপনি খুব অসুস্থ, চিকিৎসার জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া দরকার হতে পারে। বিয়ে এক্ষুণি সম্ভব নয়।
—আমি রাজি হব না একথা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়ে এলে না কেন?
—জানালে ছুটি নিয়ে ডলির সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্যে সে ছুটে আসত। আপনার মেয়ে তখন আরো অবাধ্য হত। এখনো কারো কথা শুনবে মনে হয় না।
গায়ত্রী রাই আস্তে আস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।না শুনলে আমি কোনদিন ক্ষমা করব না, সেটা তার জানতে বুঝতে বাকি থাকবে না।
দরজার দিকে এগুলো। বাপীর উচিত তাকে ধরে ধরে পৌঁছে দিয়ে আসা। মন ঝুঁকলেও আজ আর এটুকু পারা গেল না। পিছনের দরজা পর্যন্ত এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সব ছেড়ে কেন যেন মহিলার স্যান্ডাল পরা ধপধপে ফর্সা দুই পায়ের দিকে চোখ গেল। মনে হল এমন দুখানা পা-ও বেশি দেখেনি।
বিবেকের গলা টিপে ধরে আছে। কিন্তু যতক্ষণ না একেবারে মরছে ওটা ততক্ষণ ছটফটানি আছেই। যন্ত্রণা আছেই। থাকুক। গুমরোক। আপনি ঢিট হবে। শয়তানের হাতে হাত মিলিয়েছে বাপী তরফদার। তার কাছে কারো জারিজুরি খাটবে না। সে নরকে টেনে নিয়ে যাবেই। বিবেকের দাস হয়ে থাকলে স্বর্গসুখ যে কত জানতে বাকি আছে? তার থেকে নরকের রাজত্ব ঢের ভালো।
ঘণ্টাখানেক বাদে কোয়েলা এসে তাকে খেতে ডেকে নিয়ে গেল। খাবার টেবিলে শুধু সে আর গায়ত্রী রাই মুখোমুখি। ঊর্মিলা নেই। থাকবে না জানা কথাই। দু চোখ তবু তার মায়ের মুখের ওপর উঠে এলো।
—ডলি খাবে না। তুমি শুরু করো।
ঠাণ্ডা মুখে মহিলা নিজেও খাওয়া শুরু করল। ইদানীং তার রাতের খাওয়া নামমাত্র। কিন্তু তাতে এতটুকু ব্যতিক্রম দেখা গেল না। মেয়ে খেল না বলে ওই মুখে কোন রকম প্রশ্রয়ের ছিটেফোঁটাও নেই। কিন্তু বাপীর কি হল? এক মেয়ে খাবে না শুনে জঠরে খিদে সত্ত্বেও মুখে রুচি নেই। শয়তানেরও মায়ামমতা আছে?
পরদিন সকালে বারান্দার চা-পর্বেও ঊর্মিলা অনুপস্থিত। ভিতরের ঘরেও তার অস্তিত্বের আভাস মিলল না। সতর্ক করার পরেও মেয়েকে আর একলা কোথাও ছেড়ে দেবার মতো কাঁচা নয় মহিলা। তবু আশঙ্কা। জিগ্যেস করল, ডলি কোথায়?
—বিছানা ছেড়ে ওঠেনি। খুব মৃদু আর নিরুত্তাপ কঠিন সুরে বলল, ওকে যতটা বোঝানো দরকার বুঝিয়ে দিয়েছি। কোয়েলা চোখ রাখবে, তুমিও একটু খেয়াল রেখো। কিছু মতলব ভাঁজছে হয়তো, নইলে ক্ষেপে উঠত।
বাপী তরফদার নয়, সংগোপনে শয়তান বড়সড় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মেয়েকে কতটা বোঝানো হয়েছে এই মুখ দেখে বাপী আঁচ করতে পারে। তার পরেও মেয়ে ওর পশুর মূর্তিটা মায়ের সামনে তুলে ধরেনি। দেহ দখলের হামলার কথা বলেনি। এখনো রাগে দুঃখে অপমানে ফুঁসছে হয়তো। পরে বলতে পারে। কিন্তু বাপী আর পরোয়া করে না। বললেও এই মা-টি আরো অকরুণ সংকল্পে মেয়ের বিরুদ্ধেই পরোয়ানা জারি করবে। যতটুকু বিশ্বাস করবে তাও পুরুষের দাপট আর পুরুষের অসহিষ্ণুতা ধরে নেবে। মনে মনে মহিলা বরাবর ওকে পুরুষের সম্মান দিয়ে এসেছে বলেই আজ তার এত স্নেহ, এমন অন্ধ বিশ্বাস।
এ কদিন ছিল না, বাপী তবু আজও আপিস ঘরের দিক মাড়ালো না। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো। আবুকে দরকার। এক্ষুনি গেলে ঘরেই পাবে হয়তো।
আবুর দুটো ঘরেরই ভোল পাল্টে গেছে অনেক দিন। পয়সার ব্যাপারে ভাগ ভিন্ন ভোগে বিশ্বাস নেই বাপীর। ফলে কাঁচা টাকার মুখ আবুও কম দেখছে না। মাটির ঘর বাতিল করে কাঠের ঘর তুলেছে। তাতে হলদে সবুজ রংয়ের জেল্লা তুলেছে। টকটকে লাল টালির ছাদ বসিয়েছে। শুধু দোস্ত-এর কাছে কেনা, নইলে আবু রব্বানী এখন বুক চিতিয়ে নবাবী চালে চলে!
গলা পেয়েই তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দোস্ত্ হুট করে কলকাতা কেন চলে গেছল জানে না। ফেরার খবরও রাখে না। বাপীর সাড়া পেলে যত কাজই থাক দুলারিও না এসে থাকতে পারে না। কিন্তু আজ আবুকে নিরিবিলিতে দরকার বাপীর।
আবু সাদর আপ্যায়ন জানালো, তুমি বাইরে থেকে হাঁক দাও কেন বাপীভাই, সোজা ভিতরে চলে আসবে। এসো—কলকাতা গেছ শুনলাম, এদিকে ডাটাবাবু তো তুমি নেই বলে চোখে অন্ধকার দেখছে।
—বাদশাকে আজ জিপ দিয়ে পাহাড়ে পাঠিয়ে দেব’খন, সে ব্যবস্থা করবে।…এখন আর বসব না, তুমি জঙ্গলের কাজে বেরুচ্ছিলে তো?…এসো।
দিন বদলালেও দুলারির ধাত বদলায়নি, মুখে কথা কম। দেখে বেশি। আজ বাপীর তাইতেই অস্বস্তিও বেশি।
জঙ্গলের পথে পা চালিয়ে বাপী সোজা প্রস্তাব করল, তোমাকে দিনকতক ছুটি নিতে হবে।
আবু হাঁ। কারো কাজে কোনো গুরুতর গাফিলতি ঘটে গেলে এ-রকম প্রস্তাব আসে জানে। দাঁড়িয়ে গিয়ে মুখের দিকে তাকালো।
তেমনি ঠাণ্ডা গলায় বাপী আবার বলল, ছুটি নিয়ে আমার নিজের একটু কাজে লাগতে হবে তোমাকে।
আবুর বদ্ধ নিঃশ্বাস মুক্তি পেয়ে বাঁচল। কিন্তু এবারে অবাক তেমনি।—কি করতে হবে?
—সকালে দুপুরে আর বিকেলে একজনের ওপর নজর রাখতে হবে। তোমাদের মেমসায়েবের মেয়ে খুব সম্ভব আবার পালাতে চেষ্টা করবে।
—এতদিনের মধ্যেও মিসিসায়েবের সেই জ্বর ছাড়েনি?
বাপী মাথা নাড়ল। ছাড়েনি।
বেশ মজাদার উত্তেজনার রসদ পেল আবু। দোস্ত-এর এমন গম্ভীর মুখ না দেখলে কিছু চপল রসিকতা করে বসত। সোৎসাহে বলল, কিন্তু আমি একলা কত দিক আগলাবো? আমার দু’তিনজন সাগরেদকেও লাগিয়ে দিই তাহলে?
বাপীর ঠাণ্ডা মুখে বিরক্তির আভাস।—মাথাটা আর একটু সাফ করো। বিয়ের আগে আমার বউ পালাতে পারে বা পালাবার চেষ্টা করতে পারে এটা জানাজানি হয়ে গেলে আমার মান থাকবে? বানারজুলি থেকে বেরুনোর একটাই পথ, তুমি সাইকেল নিয়ে ডাটাবাবুর ক্লাবের রাস্তা আগলালেই হবে—যেমন দরকার বুঝবে করবে।…এদিকে কোয়েলার চোখে ধুলো দেওয়া সহজ হবে না, আর আমিও চোখ বুজে থাকছি না।
শেষের কথাগুলো আর কানে গেল কিনা সন্দেহ। বিস্ময়ের অকূল দরিয়ায় পড়ে হাবুডুবু দশা।—তোমার বউ! তুমি বিয়ে করবে মিসিসায়েবকে?
যে মূর্তি দেখে আর যে কথা শুনে হাসির কথা, তাই দেখে বা শুনে বাপীর রাগ হচ্ছে কেন জানে না। জবাব দিল, তোমাদের মেমসায়েবের সেই রকমই হুকুম।
বিস্ময় আর উত্তেজনার ধকল সামলে আবু জিজ্ঞাসা করল, মিসিসায়েব বেঁকে বসেছে?
—হ্যাঁ।
আবুর সামনেই যেন দিশেহারা হবার মতো সমস্যা।—তাহলে কি করে হবে…ধরে বেঁধে বিয়ে করবে?
বাপী ভিতরে ভিতরে তেতেই উঠেছে। গলার স্বরে পাল্টা শেষ।—মরদ বেঁচে থাকতেও ভিতরে ভিতরে দুলারির দিকে হাত বাড়াওনি তুমি? দুলারির মেজাজ দেখে নিজে হাল ছেড়েছিলে?
এবারে একমুখ হাসি আবুর।—তার রাগের মধ্যেও একটু আশনাইয়ের ব্যাপার ছিল যে বাপীভাই। তোমারও যদি তাই হয়ে থাকে তো কুছ পরোয়া নেই—ধরে-বেঁধে ঘরে এনে ঢোকাও, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাপী চুপ। আশনাই অর্থাৎ প্রেম থাকলে সব ঠিক হয়ে যাবে শুনেও ভিতরটা অসহিষ্ণু। খুশি আর উত্তেজনায় আবু টইটম্বুর।—ইস! তুমি অনেক ওপরে উঠে গেছ দোস্ত, নয়তো তোমাকে কাঁধে নিয়ে ধেই ধেই করে খানিক নেচে নিতাম
ফেরার পথে সামনের গেটের কাছে বাপীর পা থেমে গেল। ঊর্মিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এদিকেই চেয়ে আছে। পিছনে তার মা চোখে চশমা এঁটে লিখছে কিছু।
ঊর্মিলা চেয়ে রইল।
এত দূর থেকেও ঝলকে ঝলকে তপ্ত আগুন ঠিকরে এসে বাপীর মুখ ঝলসে দিতে লাগল।
গেট ছেড়ে বাপী নিজের বাংলোর দিকে পা বাড়ালো। আগুনে ঝলসালে লোহা ছাই হয়, না উল্টে দগদগে লাল হয়? বাপীর মেজাজেরও সেই অবস্থা।
পর পর চার দিন দেখা হল এরপর। চোখাচোখি হল। দুবার তিনবার করে। একদিনও ঊর্মিলা খাবার টেবিল বা চায়ের টেবিলে আসেনি। গায়ত্রী রাই তাকে ডাকেনি। কোয়েলা তার খাবার বা চা ঘরে দিয়ে এসেছে। যেতে আসতে তবু দেখা হয়েছে। বেশ তফাতে দাঁড়িয়ে ঊর্মিলা দেখেছে ওকে। দুই চোখে গলগল করে ঘৃণা ঠিকরেছে। বিদ্বেষ উপচে উঠেছে। কিন্তু ঘৃণার আঘাতে কাবু হবে বাপী তরফদার? বিদ্বেষ তাকে সংকল্প-ছাড়া করাবে? এই দেখে বরং ভিতরটা তার আরো ধারালো কঠিন হয়ে উঠেছে।
রাত্রি। তখনো খাবার ডাক আসেনি। এ সময়টা বাপীর বই পড়ে কাটে। কদিন হল বই পড়ার নেশাও ছেড়ে গেছে। চুপচাপ চোখ বুজে শুয়ে ছিল। মাথাটাকে শূন্য করে দেবার ধকল পোহাচ্ছিল।
একটা ষষ্ঠ অনুভূতির ধাক্কায় চোখ মেলে দরজার দিকে তাকালো।
ঊর্মিলা। ভিতরে এসে দু হাত কোমরে তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তপ্ত লাল মুখ চোখোচোখি হতে গলগল করে ঘৃণা ঠিকরোতে লাগল। প্রস্তুত ছিল না বলেই হয়তো বাপী বে-সামাল একটু।
আরো পোড়ানো আরো ঝলসানোর জন্যেই যেন আরো একটু এগিয়ে এলো ঊর্মিলা।
গলায়ও হিসহিস আগুন ঝরল।—দেখছ কি? একাই এসেছি। গেটে দাঁড়িয়ে মা তোমার ঘরে ঢুকতে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে গেছে। কি দেখছ? দরজা বন্ধ করে দেব? তাহলে সুবিধে হবে? আজ সব সাধ মেটাবে?
আত্মস্থ হবার চেষ্টায় বাপী নিজের সঙ্গে প্রাণপণে যুঝছে। নিজের অগোচরে উঠে বসেছে। গলা দিয়ে অস্ফুট স্বর বেরুলো, বোসো—
বসব? তোমার কাছে এসে আনন্দে গল্প করতে এসেছি আমি? তুমি বেইমান, তুমি বিশ্বাসঘাতক, তোমার পরামর্শে বাড়িতে মা আর কোয়েলা ছায়ার মতো আমার সঙ্গে লেগে লেগে আছে, একটা চিঠি লিখতে বসলেও সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে—বাংলো থেকে নামলে কোয়েলা পিছু নেয়—কাজকর্ম ছেড়ে আড়াল থেকে তুমি চোখে আগলাচ্ছ—ক্লাবের সামনে আবু রব্বানীকে মোতায়েন রেখেছ—চারদিক থেকে আমাকে শিকলে আটকেছ—কিন্তু এই করে কি পাবে তুমি? কি পাবে আশা করো?
বাপী নির্বাক। এখনো নিজের বশে নেই। ঊর্মিলার হিসহিস গলার স্বর চড়ছেই।—যে রেশমা তোমাকে পুজো করত সেই রেশমার মরা মুখ তোমার মনে আছে? আছে? আর একখানা মরা মুখ দেখতে চাও? এত পাহারা দিয়েও সেটা ঠেকাতে পারবে? এই জ্যান্ত ডলি তোমার কোনো দিন ভোগে আসবে না সেটা জেনে রেখো আর মাকেও জানিয়ে দিও। বুঝলে? বুঝলে?
বোঝার ধকলে বাপীর কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। চেয়েই আছে। ঊর্মিলাও।
বাপী অপলক।
ঊর্মিলাও।
পরের মুহূর্তে ও যা করে বসল তাও অভাবিত। এত রোষ এত ঘৃণা হঠাৎ কান্না হয়ে ভেঙে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে উপচে-ওঠা আবেগে এগিয়ে এসে ওই বিছানায় বসে পড়ে দু’হাতে গলা জড়িয়ে ধরে সমস্ত যন্ত্রণা উজাড় করে ঢেলে দিতে চাইল।—বাপী, এ হবে না—এ হতে পারে না। তুমি আমার ফ্রেন্ড—এত বিশ্বাসঘাতকতা তুমি করতে পারো না,—এমন বেইমান তুমি হতে পারো না— কলকাতায় গিয়ে তোমার সাংঘাতিক কিছু নিশ্চয় হয়েছে—তাই তুমি পাগল হয়ে গেছ। বাপী—তোমাকে আমি কত ভালবাসি তুমি জানো না—আমার ফ্রেন্ড এমন কাজ করতে পারে না—আমার এত ভুল হতে পারে না—এত বিশ্বাস না থাকলে আমি নির্ভয়ে তোমার কাছেই ছুটে আসতে পারতাম না।
কোলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
বাপী মূর্তির মতো বসে