সোনার হরিণ নেই (Sonar Harin Nei) : দুই
…অন্ন দেইখা দিবা ঘি, পাত্র দেইখা দিবা ঝি।
শুধু কথা নয়, এক বুড়োর ফ্যাসফেসে গলার টানা স্বরসুদ্ধু হুবহু মনে পড়ে গেলে বাপী তরফদারের।
ছেলেবেলা থেকে এ-পর্যন্ত একটিমাত্র গুণের ওপর মস্ত নির্ভর তার। প্রখর স্মরণ শক্তি। এই গুণটুকুও না থাকলে হাতের মুঠোয় বি-এস-সি’র ডিগ্রি ধরা দুরে থাক, স্কুলের গণ্ডী পার হতে পারত কিনা সন্দেহ। যা একবার দেখে নেয় তার ছাপ মগজ থেকে আর সরে না। যা একবার শোনে কানে লেগেই থাকে। কিন্তু এই গুণটাকে সে যদি কোনো উপায়ে বিস্মরণের রসানলে ঠেলে দিতে পারত, দিতই। একটুও দ্বিধা করত না। …অনেক দাহ অনেক যন্ত্রণার শেষ হত তাহলে
এক ধাক্কায় নটা বছর হুড়হুড় করে পিছনে সরে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে হাফপ্যান্ট আর মোটা ছিট কাপড়ের ফতুয়া পরা তেরো বছরের এক ছেলে, নাম যার বাপী—সে সেই বনাঞ্চলের সব থেকে শৌখিন রংচঙা কাঠের বাংলোর বাইরের সাজানো ঘরের দরজার পাশে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে। ভিতরের গদিআঁটা ঝকঝকে বেতের সোফায় বসে মুগা রঙের চোগাচাপকান পরা একজন সাদা দাড়িঅলা মুসলমান ফকির। সাদা দাড়ি নেড়ে নেড়ে অন্ন দেখে ঘি আর পাত্র দেখে ঝি দেবার কথা সে-ই বলছিল।
তার হাঁটুর এক হাতের মধ্যে চামড়া-ঢাকা চেকনাই মোড়ার ওপর মেমসাহেব বসে। অদূরের আর একটা সেটিতে সাহেব —যাঁকে সামনে দেখলে ভয়ে আর সম্ভ্রমে বাপীর বাবা আর বন-এলাকার সমস্ত মানুষের মাথা বুকের দিকে নুয়ে পড়ে। সাদা দাড়ি আর মাথায় সাদা ফেজ টুপী দেখেই অপরিচিত মানুষটাকে মনে মনে ফকির আখ্যা দেয়নি বাপী। সে যখন এসে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়েছে, ওই সাদা দাড়ি তখন সবে মেমসাহেবের হাত ছেড়ে তার ন বছরের মেয়ে মিষ্টিকে কাছে টেনে নিয়েছে। সোফার হাতলের পাশে এক হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। মিষ্টির পরনে জেল্লা ঠিকরনো বেগনে রঙের ফ্রক। ওই ফ্রকটাতে এত সুন্দর লাগছে মিষ্টিকে যে এক হাতে ওকে ওইভাবে জড়িয়ে ধরে থাকার জন্য বুড়োর ওপর রাগই হচ্ছিল বাপীর। আরো একটু গলা বাড়িয়েছে সে। ওদের পিছনে একটু দূরে আর একটা সোফায় আবার ভারিক্কি মুখে দীপুদা বসে। ওকে দেখতে পেলেই উঠে এসে মাথায় খট খট করে গাঁট্টা বসাবে। তবু সাবধানে মিষ্টিকে দেখার লোভ সামলে উঠতে পারছিল না বাপী।
…মিষ্টির ডান হাতটা বুড়োর সোফার হাতলে চিৎ করে পাতা। বাঁ হাতটা সামনে মেলে ধরা। ফুটফুটে হাতের ছোট চেটো দুটোতে যেন হালকা গোলাপী রং বোলানো। সেই দুটো হাতের ওপর বুড়ো তার এক হাতের পুরু কাঁচের চাকতিটা ফেলে একমনে দেখা শুরু করতেই বাপী বুঝে নিল লোকটা গণৎকার। ওই কাঁচের জিনিসটা সে চেনে। ম্যাগনিফাইং গ্লাস না কি বলে ওটাকে। গণৎকার যদি মুসলমান হয় তাকে ফকির ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে বাপী জানে না।
হাতের রেখার ওপর চোখ রেখে বুড়ো জিজ্ঞাসা করল, বেটীর নাম কি?
লজ্জা-লজ্জা মুখ করে মিষ্টি বলল, মালবিকা নন্দী। জবাব দিয়ে সকৌতুকে ও একবার বুড়োর মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার নিজের হাতের দিকে।
এরপর ভবিষ্যৎ বলা শুরু হল। খাসা মেয়ে। যত বড় হবে আরো খাসা হবে। উদ্গ্রীব মুখে তার মা আরো সামনে ঝুঁকল। আর বাবা সিগারেট ধরালো।
—খুব বুদ্ধিমতী মাইয়া। অনেক লেখা-পড়া অইব। বি.এ. এম.এ. পাস করবো। না, কোন রকম বড় অসুখবিসুখ দেখা যায় না, মায়ের কোনো ভাবনা নাই, বেটীর শরীর স্বাস্থ্য ভালো যাইবো।
মেমসাহেবের প্রশ্ন, আর বিয়ে? বিয়ে কেমন হবে দেখুন—
বাইরে থেকে বাপীরও মনে হল মিষ্টির সম্পর্কে এইটেই শুধু জানার মতো কথা, আর সব বাজে।
ওর দুটো হাতের ওপরেই কাচ ফেলে-ফেলে দেখছে বুড়ো। বেশ করে দেখে নিয়ে শেষে শ্লোকের মতো করেই কথা কটা বলল। ‘অন্ন দেইখা দিবা ঘি, পাত্র দেইখা দিবা ঝি’—
বাইরে থেকে স্পষ্টই শুনল বাপী কিন্তু অর্থ বুঝল না। মেয়ের বিয়ের মধ্যে অন্ন ঘি ঝি আবার কি ব্যাপার! মাথাটা আবার একটু বাড়িয়ে দিতে হল। মিষ্টি ও বড় বড় চোখ করে বুড়োর দিকে চেয়ে আছে।
মিষ্টির মা উদ্বিগ্ন একটু।—তার মানে গণ্ডগোল দেখছেন নাকি? প্রশ্নটা করেই কিছু খেয়াল হল। মেয়েকে বলল, এই মিষ্টি তোর হয়েছে, তুই যা এখন।
মিষ্টি মাথা ঝাঁকালো, দাদা থাকলে আমি থাকব না কেন!
ফলে দাদার প্রতিও মায়ের নির্দেশ, দীপু, তুইও বাইরে যা তো একটু—
শোনামাত্র এদিক থেকে বাপীর ছুট লাগানোর কথা। কিন্তু প্রস্তুত হবার আগেই ছেলের প্রতিবাদ কানে এলো, বা রে, আমারটা তো দেখাই হয়নি এখনো,’ আমি তাহলে বাড়ি থেকেই চলে যাচ্ছি—
বাপী জানে, মেমসাহেব ছেলের কাছে নরম মেয়ের কাছে গরম। ওমনি ছেলেকে অনুমতি দিল, আচ্ছা তুই থাক। সুর পাল্টে মেয়েকে বলল, মিষ্টি! কতদিন বলেছি না দাদা তোমার থেকে ঢের বড়–যাও, ও-ঘরে গিয়ে বই নিয়ে বোসো—
বাপী এদের সমস্ত খবর রাখে। বাইরের শাসন সাহেবের আর ভিতরের শাসন মেমসাহেবের। বিরস মুখে মিষ্টি দরজার দিকে পা বাড়ালো। এবারে বিপদ হতে পারে বাপী জানে, তবু দরজার আড়াল থেকে সে নড়ল না।
বাইরে পা দিয়ে ওকে দেখেই মিষ্টি থমকালো এক দফা। পরের মুহূর্তে ঘরের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, মা—বাপী পাজিটা এখানে দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে শুনছে সব!
এক লাফে জাহাজ মার্কা কাঠের বাংলো থেকে বাপী মাটিতে এসে পড়ল। খানিকটা নিরাপদ ব্যবধানে ছুটে এসে ঘুরে দাঁড়াল। না, ওর চিৎকার শুনে সাহেব বা মেমসাহেব কেউ বেরিয়ে আসেনি। এসেছে দীপুদা। চোখোচোখি হতে সে হাত তুলে মার দেখালো, তারপর আবার ভিতরে চলে গেল।
বয়সে দীপুদা তিন বছরের বড় হলেও আর সেবারে সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলেও ওই ননীর শরীরে জোর কত বাপীর তাতে সন্দেহ আছে। কিন্তু সাহেবের ছেলের জোর যাচাইয়ের প্রশ্ন ওঠে না। তাই হাতের নাগালে পড়লে বাপীকে গুঁতো খেতে হয়। সাহেবের ছেলে না হলে ও উল্টে লড়ে দেখতে পারত। ছুটে দীপুদা তার নাগাল পায় না কখনো, সে-চেষ্টা করলে জিভ বার-করা কুকুরের হাল হয়।
দীপুদা ঘরে ঢুকে যাওয়ার পরেও ফ্রক পরা মিষ্টি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে আর ওকেই দেখছে। এ-রকম একটা সুযোগ বাপী ছাড়তে পারে না। যতটা সম্ভব দু’পা ফাঁক করে দাঁড়াল। তারপর হাত দুটোও দুপাশে টান করে দিল। শেষে মুখটা বিকৃত-কুৎসিত করে আর ছ’আঙুল জিভ বার করে ভেঙচি কেটে দাঁড়িয়ে রইল।
ফল যেমন আশা করেছিল তেমনি। রাগের মাথায় ও-দিকের কাঠের বারান্দা থেকে মিষ্টিও চোখের পলকে ঠিক ওই রকম পা ফাঁক করে হাত দু’দিকে ছড়িয়ে আর জিভ বার করে ভেঙচি কেটে পাল্টা জবাব দিল। তারপরেই তারস্বরে আবার চিৎকার, ও মা! দেখে যাও বাপী পাজিটা আমাকে কি বিছুছিরি করে ভেঙাচ্ছে।
আর দাঁড়ানো নিরাপদ নয়। মেয়ের ডাকে ওই মেমসাহেব বাইরে এসে আঙুল তুলে ডাকলেই বাপীকে কাচপোকার মতো কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। দাঁড়িয়ে কানমলা বা চড় খেয়ে আসতে হবে। চড় অবশ্য এখন পর্যন্ত খেতে হয়নি, কিন্তু কানে দুই-একবার হাত পড়েছে। আর চড়িয়ে গাল লাল করে দেবার শাসানি শুনতে হয়েছে। এ-সব নির্যাতন ওই সোহাগী মেয়ের নালিশের ফল। নইলে দরকার পড়লে মেমসাহেব ওকে ডেকে ফাইফরমাস তো বেশ করে। আর, একটু সুনজরের আশায় বাপীও তার কোনো কাজ করতে পেলে বর্তে যায়।
সোহাগী মেয়ের চিৎকার শেষ হবার আগেই বাপী রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে সেঁধিয়েছে। তারপর জঙ্গলের ভিতর দিয়েই হাসতে হাসতে ঘরমুখো হয়েছে।
মাথায় ফকিরের কথাগুলো ঘুর-পাক খেতে লাগল। যা বলল তার অর্থ কি হতে পারে? ঘরে গিয়ে পিসীকে জিজ্ঞেস করতে হবে। পিসীর কথাবার্তার মধ্যে ও বাঙালের টান আছে, বিশেষ করে বাবার সঙ্গে যখন কথা বলে। আর ওই ফকিরের মতো অনেক রকমের ছড়া-পাঁচালি কাটে পিসী।
বাপীর যা-কিছু আদর আব্দার সব পিসীর কাছে। ঘরে মা নেই। মা-কে সে—রকম মনেও পড়ে না। চিন্তা করলে মায়ের একটা কাঠামো শুধু মনে আসে। আরো সাত বছর আগে অর্থাৎ বাপীর ছ’বছর বয়সের সময় এখনকার হাসপাতাল থেকে মা-কে শহরের বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে মা আর এই বানারজুলিতে ফিরে আসেনি। পিসী তার আগে থেকে এখানে ছিল। একদিন বিকেলের দিকে তাকে মেঝেতে আছড়ে পড়ে কাঁদতে দেখেছিল। আর বাবাকে মুখ কালি করে ঘরের কোণে বসে থাকতে দেখেছিল। তারপর জেনেছে মা বড় হাসপাতাল থেকেই সগে চলে গেছে। এই তেরো বছরের জীবনে তারপর মায়ের জন্য হাহুতাশ করার সময় খুব একটা মেলেনি।
ঘরে ঢুকে পিসীকে বলল, সাহেব বাংলোয় মস্ত এক ফকির এসেছে কোথা থেকে, সকলের হাত দেখছে—
হাত দেখা ফকিরের কথা শুনে পিসীর জিভে জল গড়ালো।—বলিস কি রে! কে ফকির? কোথাকার ফকির? তুই নিজের হাতটা একবার দেখিয়ে এলি না কেন?
বিরক্তিভরে শেষের প্রশ্নটারই জবাব দিল, কি যে বলো ঠিক নেই, সাহেব মেমসাহেব তাদের ঘরে বসে হাত দেখাচ্ছে সেখানে নিজের হাত বাড়াতে গেলে আস্ত থাকত—দুমড়ে ভেঙে দিত না!
এ-রকম কথা শুনলে পিসীর রাগ হয়ে যায়। কেন, ভেঙে দেবে কেন শুনি? ওদের ভবিষ্যৎ আছে তোর নেই—তুই কি বানের জলে ভেসে এসেছিস নাকি!
পিসী আবার বাবার ঠিক উল্টো। বাবা সাহেব মেমসাহেবের নাম শুনলে কাঁপে। পিসী জ্বলে। পিসীর রাগের কারণও বাপী নিজেই। তার কাছে ও দুধের ছেলে। সাহেবের ছেলে ভাইপোর গায়ে যখন-তখন হাত তোলে, আর মা-ও ভালো ব্যবহার করে না, ধমক-ধামক করে, কানে হাত দেয় পর্যন্ত—এ পিসী বরদাস্ত করতে পারে না। দাঁত কড়মড় করে, বাপীকেই ঠেঙাতে আসে, তুই নোলা বার করে যাস কেন ও-দিকে বেহায়ার মতো—এত হেনস্তার পর লজ্জা করে না ও-মুখো হতে?
বাপীর লজ্জা করে না। দীপুদা তার বাবা-মা, এমন কি ওই মিষ্টিটার ওপরে পর্যন্ত কি-রকম একটা আক্রোশ তারও বুকের তলায় জমাট বেঁধে আছে। তবু যায়। না গিয়ে পারে না। বিকেলে বা ছুটির দিনে একটা অদৃশ্য কিছু তাকে ওই বাংলোর দিকে টেনে নিয়ে যায়। ওই বাংলোটা তার চোখে রূপকথার নিষেধের এলাকার মতো। নিষেধ বলেই ওদিকে হানা দেবার লোভ।
পিসীর সামনে গ্যাঁট হয়ে বসল বাপী।—বাজে কথা ছাড়ো—অন্ন দেইখা দিবা ঘি পাত্র দেইখা দিবা ঝি—মানেটা কি চটপট বলে দাও দেখি?
হঠাৎ এই বচন শুনে পিসী হাঁ প্ৰথম।—কে বলেছে?
—ওই ফকির।
—কাকে বলেছে?
—মিষ্টির হাত দেখে তার মা-কে বলেছে।
পিসী মিষ্টিকে চেনে। মেমসাহেবকে লুকিয়ে ও বাপীর সঙ্গেই দু’দিন এখানে এসেছে। পিসী ওকে আদর করে নারকেলের নাড়ু আর মুড়ির মোয়া খাইয়েছে।
হাসিমুখে পিসী ভাইপোকে ছড়ার অর্থ বুঝিয়ে দিল। শুনে বাপী চিন্তিত হওয়া দুরে থাক উল্টে খুশি হল। ঢাক-ঢোল-শানাই বাজিয়ে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেই হল? হোক গণ্ডগোল —গণ্ডগোলটা যত বেশি হয় বাপী ততো খুশি হবে। ওই হাবা মেয়ে কি বোঝেনি। বুঝবে কি করে, তাকে তো ঘর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পিসীর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য না হলে নিজের মা ওকে ঘর থেকে সরাবে কেন! মিষ্টিটাকে এবার হাতের নাগালে পেলে হয়—
ডাকলে মিষ্টি যে ওর ধারেকাছে আসতে চায় না সেই দোষটা বাপীর নিজেরই। মেয়েটাকে দেখলেই মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চাপে। অবস্থার ফারাকটা ওরা যদি এত বড় করে না দেখত তাহলে বোধ হয় এতটা হত না। মেয়েটাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে একটা অজ্ঞাত লোভ মনের তলায় উঁকিঝুঁকি দেয়। ঝাঁকড়া আধা—কোঁকড়ানো চুলের সামনে ফর্সা টুলটুলে মুখখানা দেখে মনে হয় ছোট্ট মিশকালো একটা ঝোপের মধ্যে সুন্দর একখানা বড়ো ফুল বসানো।
একা পেলেই ডেকে বসত, এই মিষ্টি, শোন্—
মিষ্টি কাছে আসত। — কেন?
—-তোকে আমি খেয়ে ফেলব। তারপর আরাম করে এক গেলাস জল খাব।
এরপর আর রাগ না করে থাকতে পারে কোন্ মেয়ে। কাছে আসুক না আসুক, দেখা পেলেই বাপীর ওই কথা।—মিষ্টি, তোকে আমি খেয়ে নেব-দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কাছে এলে খেয়ে নেব বলে?
মিষ্টি এই নিয়ে তার দাদার কাছে আর মায়ের কাছে নালিশ করেছে। দীপুদা এই অপরাধে ওর মাথায় কম গাঁট্টা মারেনি। আর এই অপরাধেই মেমসাহেবের হাতে কানমলা খেয়েছে। তার ফলে দেখা হলে দূর থেকে আরো বেশি করে এই কথা বলে ছুটে পালিয়েছে। এরপর বাবার কাছে সাহেব বা মেমসাহেব কে তড়পেছে বাপী আজও জানে না। বাবা একদিন আপিস থেকে ঘরে ফিরেই ওকে ধরে বেদম ঠেঙানি। কি দোষে মার খাচ্ছে, পিসীর বা ওর তাও বুঝতে সময় লেগেছে। এই মারের ফলেই পিসীর সঙ্গে বাবার ঝগড়া বেধে গেছে। দোষটা তখন বোঝা গেছে। বাবা বলেছে, সাহেবের মেয়েটাকে দেখলেই মিষ্টি খাবে, মিষ্টি খাবে বলে চেঁচায়—আজ ওকে আমি শেষ মিষ্টি খাওয়াচ্ছি।
বাবার ওপরে রাগ করেই পিসী গুমগুম করে ওর পিঠে আরো কটা কিল বসিয়ে দিয়েছে—সাহেবের গরিব কেরানীর ছেলে হয়ে তোর এত লোভ—পা চাটতে পারিস না?
একরকম বিপাকে পড়ার ফলেই মিষ্টিকে দেখলে বাপী এখন আর গলার আওয়াজে জানান দিয়ে একথা বলে না। কিন্তু মনে মনে ঠিক বলে। আগের থেকে আরো বেশি বলে। আর সেটা ওই মেয়ে ঠিক বুঝতে পারে। কিন্তু কানে না শুনলে নালিশ করতে পারে না বলেই বাপীর ওপর আরো বেশি রাগ তার। দাদাকে বলেওছে ক’দিন, ও মনে মনে ঠিক আমাকে খাবার কথা বলছে, ঠোঁট নড়ছে দেখছ না—ধরে দাও না দু’ঘা!
কিন্তু দীপুদা যখন দেখে তখন আর বাপীর ঠোঁট নড়ে না। বোনের রাগের কথায় সে অতটা অবুঝ হতে পারে না। তবু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে নেয়, মনে মনে বলছিস?
যতটা সম্ভব মুখখানা নিরীহ করে তুলে বাপী মাথা নাড়ে। বলছে না।
দুপুরটা কোনরকমে কাটিয়ে জংলা পথ ধরে আবার সোজা বাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল। বিকেলে মিষ্টি বাংলো ছেড়ে বেরুবেই জানা কথা। নিজেদের বাগানে ছোটাছুটি করে আবার সামনের পাকা রাস্তা ধরে বেড়ায়ও। ফাঁক পেলে মেয়েটার জঙ্গলে ঢুকে পড়ারও লোভ খুব। কিন্তু একলা ঢুকতে সাহস পায় না। বাপীর তোয়াজ তোষামোদে মেজাজ ভালো থাকলে মা-কে লুকিয়ে তার সঙ্গেই মাঝে মাঝে ঢুকে পড়ে। ইদানীং বাপীরও তোষামোদের মেজাজ নয় বলে সেটা বন্ধ আছে। এমন কি মিষ্টি ওকে দেখলে বাগান ছেড়ে বাইরেই আসতে চায় না।
চুলবুলে মেয়ে ঘরে কতক্ষণ আর থাকবে। একটু বাদেই কাঠের বাংলোর বারান্দায় দেখা গেল ওকে। তারপর থমকেও দাঁড়াল; অর্থাৎ ওরও চোখ এই দিকে।
একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিল বাপী। কেউ নেই। গেট-এর সামনে এসে হাত তুলে ইশারায় কাছে ডাকল।
মিষ্টি দাঁড়িয়ে রইল। অপলক চোখ। রাগ-রাগ মুখ। বাপী বুঝে নিল সকালে যেভাবে ওকে ভেংচি কাটা হয়েছে, সহজে আসতে চাইবে না। খুব মোলায়েম গলায় ডাকল, মালবিকা, একটা কথা শুনে যা, খুব মজার কথা
মালবিকা বলে ডাকার মানে ওকে বোঝাতে চায় মনে মনেও সে এখন মিষ্টিকে খেয়ে ফেলার কথা ভাবছে না। কিন্তু মেয়েও ত্যাদড় কম নয়।—ফের তুই-তুকারি করে কথা! মা-কে ডাকব?
বাপীর ইচ্ছে হল দুই চড়ে ফোলা ফোলা লালচে গালে দশ আঙুলের দাগ বসিয়ে দেয়। তার বদলে দু হাত জোড় করে ফেলে বলল, ঠিক আছে আর তুই—তুকারি করব না, কিন্তু একবার এলে খুব মজার কথা বলতাম, সকালের সেই গণৎকারের কথা—পিসীমার কাছে চুপিচুপি জিগগেস করে জেনে নিয়েছি!
বাংলো ছেড়ে বাইরে আসার লোভ একটু একটু হচ্ছে বোঝা যায়। তবু মাথা নাড়ল, মা তোমাদের সঙ্গে মিশতে বারণ করে দিয়েছে।
এ-কথা মিষ্টি আগেও বলেছে। শুনলেই রাগে ভিতরে ভিতরে গজরাতে থাকে বাপী। কিন্তু এত শুনেছে বলেই কানে তোলার মতো নয়। সাদা-মাটা মুখ করে বলল, ঠিক আছে, শুনতে হবে না তাহলে…জঙ্গলের মধ্যে মস্ত একটা মৌচাকও দেখাব ভাবছিলাম। আবু বলছিল, শিগগীরই মওকা বুঝে এক রাত্তিরে ওটা পেড়ে ফেলবে—অনেক মধু হবে। তুই তোর মায়ের আঁচলের তলায় বসে থাকগে যা।
গেট ছেড়ে রাস্তার এ-ধারে চলে এলো বাপী।
লোভ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে মিষ্টির। এই পাজীটার সঙ্গে জঙ্গলে বেড়াতে ওর ভালই লাগে। বাবার সঙ্গে বা বাবার লোকের সঙ্গে ও আর দাদা জঙ্গলে ঘুরেছে। হাতীর পিঠে চেপেও ঘুরেছে। কিন্তু সে আর এক রকমের ঘোরা। বাপীর সঙ্গে ঘুরতে অন্য রকমের মজা। বাপী হাত ধরে টানাটানি করলেও মিষ্টি ঘন জঙ্গলে ঢোকে না অবশ্য। এমনিতেই গা ছমছম করে। দাদাও ভীতু, একলা বেশি দূর যায় না। কিন্তু বাপীর ভয়ডরের লেশমাত্র নেই। যেখানে বাঘ, ভালুক, চিতা থাকে, আবুর সঙ্গে ও নাকি সে-সব জায়গাও চষে বেড়িয়েছে। আর ঢিল নিয়ে বুনো মোরগ খরগোস বেঁজী সজারু তাড়া করতে মিষ্টি নিজের চোখেই দেখেছে। ছমছমানি ভাব কেটে গিয়ে তখন সত্যিকারের মজা।
রাস্তার ওদিকে চলে গেল দেখে মিষ্টির আর বাংলোয় দাঁড়িয়ে থাকা হল না। পায়ে পায়ে নেমে গেট-এর কাছে এসে চোখ বেঁকিয়ে দেখে নিল সত্যি চলে যাচ্ছে কিনা। তারপর অনেকটা নিজের মনেই কথা ছুঁড়ে দিল, হুঁ, মৌচাক দেখতে যাই আর বোলতা এসে কামড়ে দিক্।
বোলতার বদলে বাপীর নিজেরই ওই ফোলা গালে কামড় বসাতে ইচ্ছে করছিল। বলল, বোলতা আর মৌমাছির তফাৎ জানিস না—তোকে দেখতে হবে না। ঢিল না ছুঁড়লে মৌমাছি চাক ছেড়ে নড়ে?
—আবু চাক ভাঙবে কি করে, তখন কামড়াবে না?
—রাতে ধোঁয়া দিয়ে ভাঙবে। জঙ্গল-সাহেবের মেয়ের কত সাহস আবুকে বলে আসিগে যাই।
ওই একজনকে জঙ্গলের দেবতা বা অপদেবতা ভাবে মিষ্টি। আবু রব্বানীকে এ তল্লাটের মানুষ ছেড়ে জঙ্গলের সমস্ত জীব-জন্তুগুলোও চেনে বোধ হয়। জঙ্গলের খবর ওর থেকে বেশি কেউ রাখে কিনা সন্দেহ। এই জন্যে মিষ্টির বাবাও ওকে পছন্দ করে। আবুর বাবা এ জঙ্গলের হেড-বীটম্যান। ওর ছেলে আবুকে বাবা শিগগীরই বীটম্যান করে দেবে শুনেছে মিষ্টি। ওই আবু একসময় দাদার দু ক্লাস ওপরে পড়ত নাকি। বছর-বছর ফেল করার ফলে পাঁচ বছরের ছোট বাপী ওকে ধরেছিল। আর সেই বছরেই আবু ঘেন্নায় ইস্কুল ছেড়েছে। বয়সে দাদার থেকে মাত্র দু’বছরের বড়। বেশি হলে উনিশ। এরই মধ্যে শুধু পাথর ছুঁড়ে আর লাঠি পেটা করে কত রকমের জীব মেরেছে ঠিক নেই। এই সেদিনও পেল্লায় এক বিষধর সাপ মেরে মিষ্টির বাবাকে দেখাতে এনে খুব বকুনি খেয়েছিল। সাপ ইঁদুর খায়। ইঁদুর বনের ক্ষতি করে। তাই বেশি সাপ মারলে বনের ক্ষতি। বাবা বকুক আর যা-ই করুক, ওর বুকের পাটা আছে অস্বীকার করতে পারে নি। কেউ পারে না। জঙ্গলের ব্যাপারে তার আলাদা মর্যাদা।
বাপীকে নিয়ে আবুর সঙ্গেও মিষ্টি চুপি চুপি জঙ্গলে কম বেড়ায়নি। ছুটির দিনের দুপুরে বাবা-মা ঘুমোয়, দাদা শহরে যায়। ফাঁক বুঝে বাপীও এসে মিষ্টিকে ডেকে নিয়ে যায়। বাবা-মা ওকে না দেখতে পেলেও ভাবে কাছাকাছি আছে কোথাও। আবু সঙ্গে থাকলে আর হাতে সময় থাকলে মিষ্টি ওদের সঙ্গে একটু ঘন জঙ্গলে ঢুকতেও ডরায় না। এই আবুর কাছে মিষ্টির ভীরু অপবাদ কাম্য নয়।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেট খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতে হল। মেয়ে ভাঙবে তবু মচকাবে না। ঠোঁট উল্টে জবাব দিল, আবুকে বললে বয়েই গেল। বাবাকে বলে দেব আবু জঙ্গলের ক্ষতি করছে, ওকে যেন বীটম্যান না করে।
বাপীর ধৈর্য কমছে, তাই রাগ বাড়ছে।—কি? আবুর নামে নালিশ করবি তুই?
—ফের তুই?…তুমিই বা আমার নামে ওকে বলতে যাবে কেন? বোল্লার চাক কত দূর?
একবার শুধরে দেবার পরেও ফের আবার বোলতাই বলল। বাপীর মনে ওকে নিয়ে জঙ্গলে ঢোকার তাড়না।—খুব কাছে।…আচ্ছা, আবুকে কিছু বলব না। মিষ্টি অত সহজে ভোলবার পাত্রী নয়।—মজার কথা কি বলবে বলছিলে? টোপটা আরো একটু রহস্যজনক করে তোলার সুযোগ পেল বাপী। মুখে হাসি টেনে বলল, সকালে গণৎকারের সঙ্গে তোর বিয়ের কথা বলার সময় তোর মা তোকে ঘর থেকে সরিয়ে দিল কেন সে তো বুঝতেও পারিসনি বোকা মেয়ে! আয়, বলছি—
এবারে আর ‘তুই’ বলার জন্য ফোঁস-ফোঁস করে সময় নষ্ট করতে চাইল না মিষ্টি। আসলে মা বলেছিল বলেই, নইলে তুই-তুমির তফাৎ খুব একটা কানে লাগে না। ঘুরে দাঁড়িয়ে বাংলোর দিকটা দেখে নিল একবার। কেউ নেই। রাস্তা পেরিয়ে কাছে এলো।…বিয়ের কথা মানেই মজার কথা আর ভালো কথা, কিন্তু মা হুট্ করে ওকে ঘর থেকে চলে যেতে বলেছিল কেন সত্যিই মাথায় ঢোকে নি।
—বলো।
—আগে এদিকে আয়। কাছে পাওয়া মাত্র ওর একখানা হাতের ওপর দখল নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল। তারপরেও হাত ছেড়ে দিল না। মিষ্টির সুন্দর ছোট হাত নিজের হাতে নিয়ে টানা-হেঁচড়া করতে বা চাপাচাপি করতে ভালো লাগে।
—সকালের ওই গণৎকার কোত্থেকে এলো রে?
—বাবা শিলিগুড়ি থেকে আনিয়েছে। অনেক জানে।
—কি নাম?
—পীর বস্।
—তার মানে এক বাক্স পীর!
না বুঝে মিষ্টি বোকার মতো তাকালো তার দিকে।
বাপী বলল, বি-ও-এক্স বক্স মানে বাক্স না?
—তোমার মুণ্ডু, তুমি এই-সব বজ্জাতি করার জন্য আমাকে ডেকে এনেছ! হাত ছাড়াবার চেষ্টা।
—না রে না—তোর বিয়ের কথায় বুড়ো সেই ছড়াখানা কি বলেছিল মনে আছে?
একটা কি বলেছিল মিষ্টির মনে পড়ছে। চেষ্টা সত্ত্বেও কথাগুলো মনে পড়ল না। মাথা নাড়ল, মনে নেই।
‘অন্ন দেইখা দিবা ঘি, পাত্র দেইখা দিবা ঝি’! বাপী হেসে উঠল।
মনে পড়ল। বুড়ো গণৎকার এই কথাগুলোই বলেছিল বটে। বড় বড় চোখ করে মিষ্টি ওর দিকে মাথা বেঁকিয়ে তাকালো। তার মানে কি?
—’অ’ আর ‘নয়-নয়’ অন্ন মানে ভাত তো?
মিষ্টি মাথা নাড়ল। তাই।
—পচা গন্ধ-অলা চালের ভাতে ভালো ঘি ঢাললেও খেতে স্বাদ ভালো হয়? এবারে একটু ভেবে-চিন্তে মাথা নাড়ল মিষ্টি। হয় না বটে।
—আর পাত্র মানে হল ছেলে, যে-ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে। আর ঝি মানে হল মেয়ে—যে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হবে।
মিষ্টি ফোঁস করে উঠল, ঝি মানে কখনো মেয়ে নয়।
বাপী তেমনি জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ মেয়ে। পিসীর কাছে শুনে আমি ডিকশনারী দেখে নিয়েছি, বিশ্বাস না হয় তুইও দেখে নিস। ঝি মানে ঝিও হয় আবার মেয়েও হয়।
এ-কথা শুনে মিষ্টি দমে গেল একটু। বলল, ঝি মানে মেয়ে হলেই বা মা আমাকে ঘর থেকে যেতে বলবে কেন?
—তোর বিয়ে নিয়ে হ্যাঙ্গামা আছে বলে। বাপী-গম্ভীর!—পচা চালের মতো একটা বাজে ছেলের হাতে পড়বি তুই।
—কখনো না। পীর সাহেব তো বলেছে, আমার অনেক লেখা-পড়া হবে চেহারা আরো ঢের সুন্দর হবে, অসুখ করবে না, শরীর ভালো থাকবে—তাহলে খারাপ ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে কেন?
অনেক-জানার মতো মুখ করে বাপী হাসতে লাগল। বলল, ওই জন্যেই তো এই শোলকটারে! তোর পীরসাহেব বলেছে, যত ভালো মেয়েই হোক, সে-রকম ভালো ছেলের সঙ্গে যদি বিয়ে দিতে না পারো তাহলে পচা চালে ভালো ঘি ঢালার মতো হবে সেটা। বুঝলি?
বুঝেও গোঁ-ভরে মিষ্টি বলল, বাবা ঠিক দেখেশুনে ভালো ছেলের সঙ্গেই বিয়ে দেবে আমার—
বাপীর মুখের হাসি আরও প্রশস্ত হল।—তুই আচ্ছা বোকা, তোর বাবাও কি গণৎকার নাকি যে আগে থেকেই ছেলের সব জেনে ফেলবে। ভয় না থাকলে পীরসাহেবের মতো এত বড় গণৎকার এ-কথা বলবে কেন, আর তোর মা-ই বা তোকে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে সরিয়ে দিতে চাইবে কেন! পরিতুষ্ট বাপী ওর হাতে বড়সড় চাপ দিল একটা। অকাট্য যুক্তির মুখে পড়ে মিষ্টি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। বেশ রাগ হচ্ছে। একে হাসছে তায় হাতের ওপর হামলা।
—বোলতার চাক কই?
বাপী থতমত খেল একটু। চারদিকে তাকালো একবার।—কোন্ গাছটায় দেখেছিলাম ঠিক মনে পড়ছে না…একটু খুঁজলেই পেয়ে যাব।
এক ঝটকায় মিষ্টি নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল।—মিথ্যেবাদী, মিথ্যেবাদী! সঙ্গে সঙ্গে যে-দিক থেকে এসেছে সেইদিকে ছুট্।
মৌচাক জঙ্গলের কোথাও না কোথাও আছেই। একটা ছেড়ে অনেক আছে। কিন্তু একটাও দেখে রাখা হয়নি বলে বাপী মনে মনে পস্তালো একটু। ছুটে গিয়ে আবার ওকে চেপেচুপে ধরার লোভ। কিন্তু ধরতে পারলেও আজ আর ফেরানো যাবে না।…ওর ফুটফুটে নরম-গরম হাতটা এতক্ষণ নিজের হাতের মধ্যে ছিল, বেশ লাগছিল।
হৃষ্ট মুখেই বাপী এবার আর একজনের সন্ধানে চলল। বয়সে ছ বছরের তফাৎ হলেও এখানে প্রাণের দোসর একজনই।
আবু রব্বানী।
ওই রব্বানীর সে একনিষ্ঠ ভক্ত বললেও বেশী বলা হবে না। তার একান্ত কাছে থাকার ফলে বাপীর ইদানীং কত দিকে জ্ঞান বাড়ছে তা নিজেই অনুভব করতে পারে। বাপীর বিবেচনায় আবুর মতো মরদ তামাম বানারজুলিতে আর দুটি নেই। আবুরও ওর ওপর অকৃত্রিম স্নেহ। তার কারণ আছে। বীটম্যান হবার আশায় বানারজুলির এত বড় রিজার্ভ ফরেস্টের স্থানীয় সর্বেসর্বা রেঞ্জ অফিসারের মেমসাহেবটিকে আবু নানানভাবে তোয়াজ তোষামোদ করে চলেছে বটে। ঝুড়ি ভরতি ফিকে পীত রঙা শাল ফুল অথবা টকটকে লাল পলাশ দিয়ে আসে, আম জাম জামরুল পেয়ারা খেজুর নিয়ে যায়, বুনো মুরগী বা খরগোশ মারতে পারলে মেমসাহেবকে ভেট দিতে ছোটে। কিন্তু চাকরিটা একবার হয়ে গেলে ওর সমূহ মনিব কেরানীবাবু অর্থাৎ বাপীর বাবা হরিবাবু। তাই বাপীর সঙ্গে খাতির রাখাটা তার দরকারও বটে। কিন্তু আবুর অকৃত্রিম স্নেহটাই বড় করে দেখে বাপী।
—আরে থো থো—আল্লার খবর মোল্লায় রাখে!
বাপীর মুখে গণৎকার পীর বস্-এর সমাচার শুনে বাঙাল টান দিয়ে ওই মন্তব্য করেছিল আবু রব্বানী। বিশেষ করে মিষ্টির বি-এ এম-এ পাশ করে মস্ত বিদুষী হওয়ার সম্ভাবনাটা এক ফুঁয়ে বাতিল করে দিয়েছিল সে। বলেছে, বি-এ এম-এ দূরে থাক, ওই মেয়েকে ম্যাট্রিকও পাশ করতে হচ্ছে না বলে দিলাম।
আবু নিজে অনেক বছরের চেষ্টায় ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে প্রমোশন না পেয়ে পড়া ছেড়েছে একথা একবারও মনে হয় না বাপীর। সত্যিকারের বিস্ময় নিয়ে শুধিয়েছে, কেন বলো তো—মেয়েটা তো ওদের ক্লাসে ফার্স্ট হয়।
—ফার্স্ট হোক আর লাস্ট হোক, এই পীর যা বলে শুনে রাখ্
শুনে রাখার মতোই কথা বটে। সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু বেশি পড়াশুনা কেন হবে না বলো না?
আবুর মুখে সবজান্তা হাসি। তোর কোনো বুদ্ধি যদি থাকত! এই বয়সেই চেহারাখানা দেখছিস না মেয়েটার, ষোল-সতের বছরের ডবকা বয়সে এই মেয়ের চেহারাখানা কি রকম হতে পারে চোখ বুজে ভেবে দেখ দিকি? ভেবেছিস? ভালো করে ভাব—
বাপী সঠিক ভেবে উঠতে পারল না। তবে একটা সম্ভাব্য আদল চোখে ভাসল বটে। কিন্তু কি বলতে চায় বোঝেনি তখনো। মাথা নাড়ল। ভেবেছে।
আবু এবার ব্যাখ্যা শোনালো। সেই বয়সে কোনো কোনো বড়লোকের ছেলের চোখ পড়বেই ওর ওপর। বিয়ে করে ঘরে এনে পুরবে, তারপর লুটেপুটে শেষ করবে। বি-এ এম-এ পাস করার ফুরসৎ মিলবে কোত্থেকে?
হ্যাঁ করে বাপী আবুর মুখখানাই দেখছিল। মগজে এত বুদ্ধিও ধরে ও! রাস্তার পাশে জ্যোতিষীর জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওই মা মেয়েকে অপলক চোখেই দেখে নিয়েছিল বাপী তরফদার। তারপর শুধু মেয়েকেই চেয়ে চেয়ে দেখেছে। ওই মা পাশে না থাকলে হঠাৎ দেখে চিনতে পারত কিনা সন্দেহ। জ্যোতিষীর সামনে মিষ্টি টান হয়ে বসে ছিল। ডান পা-টা পিছনে মোড়া। জ্যোতিষীর দিকেই চেয়ে ছিল সে।
জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে স্থানকাল ভুলে বাপী তরফদার ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখেছে। মাথা…কপাল…নাক কান চোখ মুখ…গলা… কাঁধ বুক।
এক পা পিছনে মুড়ে বসার ভঙ্গী…বুক থেকে কোমরের নীচে পর্যন্ত ঈষৎ স্থির যৌবনরেখা…একটু নড়লে-চড়লে সেই রেখাগুলোও নড়া-চড়া করেছে।
নিজের অগোচরে মনে মনে একটা হিসেব সেরে নিয়েছে বাপী তরফদার। আবু রব্বানীর সেই ভবিষ্যদ্বাণী এখন পর্যন্ত ঠিক হয়নি। ঠিক ন’ বছর আগের কথা …মিষ্টির বয়েস এখন আঠারো। কিন্তু এখন পর্যন্ত কপালে বা সিঁথিতে সিঁদুরের আঁচড় নেই।
গাল দুটো আগের মতো ফোলা-ফোলা নয়। মেদ-ঝরা টানা মুখ। আগের তুলনায় আরো আয়ত চোখ। গায়ের রঙও আগের থেকে ঢের বদলেছে, অনেক কম ফর্সা মনে হয়। কিন্তু এই রঙের মধ্যে আদুরে ভাব থেকে তাজা ভাব বেশি।
নির্নিমেষে দেখছিল বাপী তরফদার। তার এই দেখাটা বাইরের প্রতীক্ষারত অন্য মেয়ে-পুরুষদের চোখে বিসদৃশ লাগছিল সে হুঁশ নেই। মা-মেয়ে যখন উঠেছে, বাপী তরফদার আত্মস্থ নয় তখনো। অনাবৃত অপলক দু চোখ মিষ্টির সর্বাঙ্গে ওটা-নামা করেছে। তারা বেরিয়ে আসতে বাপী তাদের দু’হাতের মধ্যে এসে মাকে ছেড়ে মেয়েকেই দেখেছে। দেখেনি, দুই চোখের বাঁধনে তাকে আটকে রাখতে চেয়েছে। চিনতে পারার কথা নয়, দুজনের কেউই চিনতে পারেনি। অস্ফুট ঝাঁজে ‘স্টুপিড’ বলে মেয়ের হাত ধরে মা গাড়িতে উঠেছে। মেয়েরও বিরক্তিমাখা লালচে মুখ। মৃদু শব্দ তুলে সাদাটে গাড়িটা চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। পিছনের লাল আলোয় গাড়ির নম্বরের ওপর চোখ আটকেছে বাপী তরফদারের।
সেই দিকে চেয়ে ন’ বছর নয়, নিজের অগোচরে আটটা বছর পিছনে পাড়ি দিয়েছে বাপী তরফদার।…ওর বয়েস যখন চৌদ্দ। …মিষ্টির দশ।
হঠাৎ জিভে করে নিজের শুকনো দুই ঠোঁট ঘষে নিল বাপী তরফদার। আট বছর আগের সেই আঘাতের চিহ্ন নেই—কিন্তু জিভে নিজের দেহের সেই তাজা রক্তের নোনতা স্বাদ!…এক মেয়েকে কেন্দ্র করে আট বছর আগে অপরিণত বয়সের ছেলের সেই প্রবৃত্তির আগুন বাইশ বছরের এই দেহের শিরায় শিরায় হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আবার
আবছা অন্ধকার শূন্য পথের দিকে চেয়ে দু চোখ ধক্ধক্ করছে প্রবৃত্তির ক্রূর আদিম অভিলাষ।